দুইটি জুয়াচুরি

দুইটি জুয়াচুরি 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

গোবিন্দ বাবুর বাসস্থান কলিকাতার ভিতর না হইলেও, তাঁহাকে কলিকাতাবাসী বলা যাইতে পারে। এখন তাঁহার বয়ঃক্রম যদি ষাট বৎসরও না হইয়া থাকে; কিন্তু পঞ্চান্ন বৎসরের কম কোন প্রকারেই হইবে না। যখন ইঁহার বয়ঃক্রম আঠার-উনিশ বৎসর, সেই সময় ইনি প্রথম কলিকাতায় আগমন করেন, এবং সেই সময় হইতেই তিনি কলিকাতায় বাস করিতেছেন। দুই এক বৎসর অন্তর কখন কখন তিনি আপনার দেশে গমন করিয়া থাকেন সত্য; কিন্তু সেও দুই একদিবসের নিমিত্ত। ইনি কলিকাতায় সপরিবারে বাস করিয়া থাকেন। 

প্রথম কলিকাতায় আসিবার কিছুদিবস পরেই তিনি সরকারী আফিসে একটি সামান্য চাকরী সংগ্রহ করিয়াছেন। পরিশেষে যথেষ্ট পরিশ্রম করিয়া ও নিজের কার্য্য-দক্ষতা দেখাইয়া, তিনি ক্রমে ক্রমে আপনার মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠেন; সুতরাং দিন দিন ক্রমশঃই তাঁহার পদের উন্নতি হইতে থাকে। 

এইরূপে একাদিক্রমে প্রায় কুড়ি বৎসরকাল চাকরী করিবার পর, তিনি অতিশয় পীড়িত হইয়া পড়েন। পরিশেষে বাধ্য হইয়া তাঁহাকে সেই সময়েই পেন্‌স গ্রহণ করিতে হয়। যে কিছু অর্থের সংস্থান করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, পীড়ার চিকিৎসা করিতে তাঁহাকে তাহার অনেক অর্থ ব্যয় করিতে হয়। পীড়া আরোগ্য হইবার পর, তাঁহাকে অর্থ উপার্জ্জনের পুনরায় চেষ্টা দেখিতে হয়। কারণ, কেবলমাত্র তাঁহার সামান্য পেসনের উপর নির্ভর করিয়া তিনি কোনরূপেই আপন জীবিকা নির্ব্বাহ ও পরিবারগণকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হইতেন না। 

পুনরায় কোন স্থানে যদি তিনি একটি চাকরীর সংগ্রহ করিতে পারেন, এই ভাবিয়া প্রথমতঃ তিনি অনেকরূপ চেষ্টা করেন; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারেন না। তখন ব্যবসার চেষ্টা দেখিতে প্রবৃত্ত হন। সেই সময় তাঁহার হস্তে এরূপ কিছু অধিক অর্থ ছিল না, যাহার দ্বারা তিনি কোনরূপ একটি ভাল ব্যবসা আরম্ভ করিতে পারেন। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া কোন একজন প্রধান কন্ট্রাক্টারের অধীনে একটি ছোট গোছের কন্ট্রাক্ট গ্রহণ করেন। এইরূপ ভাবে কার্য্য করিয়া তিনি কখনও কিছু উপার্জ্জন করেন, কখন বা আবার ঘর হইতে তাঁহাকে লোকসান দিতে হয়। এইরূপ ভাবে কার্য্য করিতে করিতে তিনি প্রায় পনর ষোল বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন, এখন তাঁহার লাভের মধ্যে এই হইয়াছে যে, তাঁহার হস্তে আর একটিমাত্র পয়াসও নাই! জীবনধারণের উপায়ের মধ্যে পেনসন। তথাপি তিনি তাঁহার সেই কন্ট্রাক্টের কার্য্য পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হন নাই। 

আমি অন্য যে সময়ের ঘটনা পাঠক-পাঠিকাগণকে উপহার প্রদান করিতেছি, সেই সময় একটি ছোটো বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার প্রধান কন্ট্রাক্টারের নিকট কন্ট্রাক্ট লইয়াছিলেন। 

যে স্থানে সেই বাড়ী প্রস্তুত হইবে, সেই স্থানে ভিত প্রস্তুত করিবার উপযোগী বনিয়াদ খনন করা হইয়া গিয়াছে, অথচ রাজমিস্ত্রীর কার্য্য আরম্ভ হয় নাই; এরূপ সময় একদিবস অতিশয় বৃষ্টি হইয়া নিকটবর্ত্তী স্তূপীকৃত মৃত্তিকারাশি বৃষ্টির জলে ধৌত হইয়া, সেই বনিয়াদের স্থানে স্থানে পুনরায় পতিত হওয়াতে উহা একরূপ পূর্ণ হইয়া যায়। সেই বনিয়াদের একদিকে সরকারী রাস্তা এবং অপরদিকে আর একজনের পুরাতন বাড়ী। সেই বনিয়াদের মৃত্তিকা শীঘ্র স্থানান্তরিত করিয়া, যদি উহাতে রাজমিস্ত্রীর কার্য্য শীঘ্র আরম্ভ না হয়, তাহা হইলে এক পার্শ্বের সরকারী রাস্তা ভাঙ্গিয়া পড়িবার এবং অপর পার্শ্বের সেই পুরাতন বাড়ীর দেওয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। কাজেই সেই কাৰ্য্য যাহাতে গোবিন্দ বাবু শীঘ্র সম্পন্ন করিতে পারেন, প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোন প্রকারেই উপযুক্ত পরিমিত মজুরের সংস্থান করিতে পারিলেন না। অনেক কষ্টে দুইটিমাত্র মজুর সংগ্রহ করিয়া তিনি সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন, এবং নিজে সেই স্থানে দণ্ডায়মান থাকিয়া উহাদিগের কার্য্যের পরিদর্শন করিতে আরম্ভ করিলেন। 

এইরূপে একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে তিনি সেই স্থানে দাঁড়াইয়া আছেন এবং দুইজন মজুর পূৰ্ব্ব-কথিত মৃত্তিকা সকল স্থানান্তরিত করিতেছে, এমন সময় একটি ভদ্র- পরিচ্ছদধারী লোক আসিয়া হঠাৎ সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এবং গোবিন্দ বাবুকে কহিল, “আপনি কেবলমাত্র দুইটি লোক লইয়া কিরূপে এই কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে সমর্থ হইবেন? আমি যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে এইরূপ ভাবে কার্য্য হইলে সরকারী রাস্তাও ভাঙ্গিয়া যাইবে, পার্শ্বের বাড়ীও পড়িয়া যাইবে।” 

গোবিন্দ। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। আমিও দেখিতে পাইতেছি, সরকারী রাস্তা ভাঙ্গিয়া গেলে, বা পার্শ্বের বাড়ী পড়িয়া গেলে, আমার আর বিপদের শেষ থাকিবে না। কিন্তু কি করি, সবিশেষ চেষ্টা করিয়াও, আমি উপযুক্ত পরিমিতমজুরের সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

অপরিচিত। মজুরের ভাবনা কি? আপনি যত মজুর লইতে ইচ্ছা করেন, আমি তত মজুর আনিয়া আপনাকে প্রদান করিতে পারি। কারণ, আমার কার্য্য– কুলি-সরবরাহ করা। আপনি যে দিবস যত কুলি প্রার্থনা করিবেন, একদিবস পূর্ব্বে আমাকে জানাইলে, আমি সংগ্রহ করিয়া তাহা আপনাকে দিতে পারিব। কুলিগণের যে সকল মজুরি হইবে, তাহা তাহাদিগকে আপনি প্রত্যহ প্রদান করিবেন। তদ্ব্যতীত প্রত্যেক কুলির নিমিত্ত আমাদিগকে দুই পয়সা অতিরিক্ত দিতে হইবে। 

গোবিন্দ। আপনাকে প্রত্যেক কুলির নিমিত্ত দুই পয়সা অতিরিক্ত প্রদান করিব কেন? 

অপরিচিত। আমাদিগের কিছু প্রত্যাশা না থাকিলে, আপনার কার্য্যে আমরা হস্তক্ষেপ করিব কেন? আমি যে অতিরিক্ত দুই পয়সার কথা বলিতেছি, তাহা আমি একাকী গ্রহণ করিব না। এই কার্য্যের নিমিত্ত আমার একজন সর্দ্দার আছে, আবশ্যকীয় কুলির বন্দোবস্ত করিয়া, সে-ই উহাদিগকে আপনার নিকট আনিবে। সেই দুই পয়সা আপনি তাহার হস্তে প্রদান করিবেন, উহা আমরা উভয়ে অংশ করিয়া লইব। সেই দুই পয়সা ব্যতীত সর্দ্দারকে আর অধিক কিছু প্রদান করিতে হইবে না। 

গোবিন্দ। আচ্ছা মহাশয়! আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত আছি। 

অপরিচিত। তাহা হইলে কল্য আপনার কতগুলি কুলির প্রয়োজন হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন; সর্দ্দারের সমভিব্যাহারে আমি তাহাদিগকে পাঠাইয়া দিব। আপনার ঠিকানাও আমাকে বলিয়া দিন। 

গোবিন্দ। কল্য দশজন কুলি আমার এই স্থানে পাঠাইয়া দিবেন। 

এই বলিয়া গোবিন্দ বাবু তাঁহার নাম ও ঠিকানা একখানি কাগজে লিখিয়া সেই অপরিচিত ব্যক্তির হস্তে প্রদান করিলেন। 

সেই কাগজখানি লইয়া তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। পরদিবস অতি প্রত্যূষে একজন সর্দ্দার দশজন কুলির সহিত আসিয়া গোবিন্দ বাবুর নিকট উপস্থিত হইল। সবিশেষ চেষ্টা করিয়াও গোবিন্দ বাবু অধিক পরিমিত কুলির সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না; সুতরাং এইরূপ ভাবে কুলির সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়া তিনি মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, ও কুলিগণকে কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। পরে কুলিগণ কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইলে সর্দ্দার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল; যাইবার সময় বলিয়া গেল যে, সন্ধ্যার সময় পুনরায় সে আগমন করিবে। কুলিগণ নিয়মিতরূপ কার্য্য সম্পন্ন করিয়া, আপনাদিগের মজুরিগণ্ডা বুঝিয়া লইয়া প্রস্থান করিল। সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে সেই সর্দ্দার পুনরায় আগমন করিয়া, তাহার নিজের পাওনা অর্থাৎ প্রত্যেক কুলি দুই পয়সা হিসাবে গ্রহণ করিয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিল, এবং যাইবার সময়, আগামী কল্য পুনরায় কতগুলি কুলি প্রদান করিতে হইবে, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া গেল। 

এইরূপে গোবিন্দ বাবু প্রত্যহ যত কুলি চাহিতে লাগিলেন, সেই সর্দ্দার তত কুলিই দিয়া তাঁহার কার্য্য শেষ করিয়া দিতে লাগিল। এই প্রকারে প্রায় এক মাসের মধ্যে সর্দ্দার প্রায় তিন শত টাকার কুলি তাঁহাকে প্রদান করিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

এইরূপে প্রায় মাসাবধি সবিশেষ বিশ্বাসের সহিত সেই সর্দ্দার গোবিন্দ বাবুর কার্য্য নির্ব্বাহ করিল। সেই সময় সদার একদিবস কথায় কথায় গোবিন্দবাবুকে কহিল, “বাবু! কুলি সংগ্রহ করিবার ক্ষমতা আমার যথেষ্ট আছে; কিন্তু নিজের অর্থ নাই। এই সময়ে আবার হস্তে যদি কিছু অর্থের সংস্থান থাকিত, তাহা হইলে অল্পদিবসের মধ্যেই আমি বেশ দুই পয়সার সংস্থান করিয়া লইতে পারিতাম।” 

সর্দ্দার। একজন সাহেব একটি নূতন আফিস খুলিয়াছেন। সেই আফিসের উদ্দেশ্য কুলি সরবরাহ করা। সহরের ভিতর যত বড় বড় ইংরাজ মহাজন আছেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেকের আফিসের সহিত তিনি বন্দোবস্ত করিয়াছেন যে, জাহাজে তাঁহাদিগের সমস্ত মাল আমদানি ও রপ্তানি করিতে যত কুলির আবশ্যক হইবে, তাহার সমস্তই তিনি প্রদান করিবেন। 

গোবিন্দ। এত কুলি তিনি সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারিবেন? 

সর্দ্দার। নিজের চেষ্টা করিয়া একজন কুলিরও সংগ্রহ করিতে হইবে না। কারণ, তিনি আবার অন্যান্য লোককে কন্ট্রাক্ট প্রদান করিতেছেন। এই সংবাদ শুনিয়া অনেক কন্ট্রাক্টার জুটিয়া গিয়াছে, অনেকে তাঁহার সহিত বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছে। অনেকের বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে, এবং এখনও অনেক কাৰ্য্য বাকী আছে। 

গোবিন্দ। যাহারা বন্দোবাস্ত করিয়া লইয়াছে, বা লইতেছে, তাহাতে তাহাদিগের লাভ কি? 

সর্দ্দার। জানি না, সাহেব সওদাগরদিগের নিকট হইতে কি দরে কুলির বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছেন; কিন্তু তাঁহার সহিত যাঁহারা বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছেন, তাঁহাদিগকে তিনি প্রত্যেক কুলির নিমিত্ত যেরূপ দর দিতেছেন, তাহাতে তাঁহাদের সবিশেষরূপ লাভ হইবারই সম্ভাবনা। 

গোবিন্দ। প্রত্যেক কলির নিমিত্ত সাহেব কিরূপ দর প্রদান করিতেছেন? 

সর্দ্দার। প্রত্যেক কুলির দিবসের কার্য্যের নিমিত্ত বার আনা ও রাত্রির কার্য্যের নিমিত্ত দেড় টাকা করিয়া প্রদান করিতেছেন। ইহা বড় সামান্য লাভ নহে! আমরা প্রত্যেক কুলিকে দিবসের কার্য্যের নিমিত্ত ছয় আনা হইতে আট আনা পর্যন্ত প্রদান করি, এবং রাত্রির কার্য্যের নিমিত্ত বার আনা হইতে এক টাকা দিয়া থাকি। এরূপ অবস্থায় প্রত্যেক কুলির নিমিত্ত চারি আনা হইতে ছয় আনা এবং আট আনা হইতে বার আনা, কি সামান্য লাভের কথা! কিন্তু কি করিব? আমাদিগের অদৃষ্ট সেরূপ নহে। এই সময়ে কিছু সামান্য টাকা থাকিলে, ক্রমে আমি বড় মানুষ হইতে পারিতাম।

গোবিন্দ। ইহাতে টাকার প্রয়োজন কি? কুলির মজুরি ত সেই সাহেব দিবে, তুমি লাভের টাকা গ্রহণ করিবে বই ত নয়? 

সৰ্দ্দার। টাকা ত সাহেব দিবেন সত্য; কিন্তু তিনি ত আর প্রত্যহ কুলির মজুরি প্রদান করিবেন না। তিনি টাকা দিবেন হপ্তা হপ্তায়, অর্থাৎ এক সপ্তাহ মধ্যে আমাদিগের যত টাকার কার্য্য হইবে, সপ্তাহ পূর্ণ হইলেই হিসাব করিয়া তিনি একবারে সমস্ত টাকা প্রদান করিবেন। 

গোবিন্দ। কুলিদিগের মজুরিও তুমি সেইরূপ এক সপ্তাহ পরে প্রদান করিও, তাহা হইলে আর টাকার প্রয়োজন হইবে না। 

সর্দ্দার। কুলিগণ তাহা শুনিবে কেন? উহারা ত আর আমার চাকর নহে। যেস্থানে উহারা নগদ টাকা পাইবে, সেই স্থানেই উহারা কার্য্য করিবে। বিশেষতঃ এক সপ্তাহকাল নিজে পেটে খাইতে ও পরিবার প্রতিপালন করিতে পারে, এরূপ সংস্থান কয়জন কুলির আছে? 

গোবিন্দ। যদি এই কাৰ্য তুমি গ্রহণ কর, তাহা হইলে প্রত্যহ কি পরিমিত কুলি তোমাকে সংগ্রহ করিতে হইবে? সদার। যে দিবস যত কুলি প্রদান করিতে হইবে, সাহেব তাহা অগ্রে বলিয়া দিবেন। সে সমস্ত আমরা ঠিক করিয়া লইতে পারিব. এখন টাকার সংগ্রহ করিতে পারিলেই হয়। আপনি যদি টাকার সংস্থান করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনি কেন আমাদিগের সহিত মিলিত হউন না। টাকার সংস্থান করিবার নিমিত্ত আপনি লাভের একটি অংশ গ্রহণ করিবেন, এবং কুলি সরবরাহ ও সমস্ত কার্য্য দেখিয়া শুনিয়া করিবার নিমিত্ত আমাদিগকে একটি অংশ প্রদান করিবেন। আপনাকে কোন কাৰ্য্য দেখিতে হইবে না। আপনি গৃহে বসিয়া টাকা দিয়াই খালাস। কেবলমাত্র সপ্তাহ পরে, একবার সাহেবের নিকট গিয়া টাকাগুলি আনিতে হইবে। হিসাব-পত্রের নিমিত্তও আপনাকে গমন করিতে হইবে না, তাহাও আমরা ঠিক করিয়া রাখিয়া দিব। 

গোবিন্দ। আচ্ছা, এ বিষয়ে আমি বিবেচনা করিয়া দেখি। কল্য আমি ইহার উত্তর তোমাকে প্রদান করিব। গোবিন্দ বাবুর সহিত সর্দ্দারের এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, সর্দ্দার সে দিবস আপন স্থানে প্রস্থান করিল। পরদিবস নিয়মিতরূপে আবার আসিয়া উপস্থিত হইল। এ কথা ও কথা সমস্ত কথার পর, পুনরায় পূৰ্ব্ব প্রস্তাবিত সেই কন্ট্রাক্টের কার্য্যের কথার উত্থাপন করিল ও কহিল, “কেমন মহাশয়! আপনি কন্ট্রাক্টের কার্য্য সম্বন্ধে কিরূপ বিবেচনা করিলেন? যদি আপনি এই কাৰ্য্য করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে কিরূপ করিবেন, তাহা এখনই আমি জানিতে ইচ্ছা করি। কারণ, আমাদিগকে সাহায্য ও নিজে দুই পয়সা উপার্জ্জন করিবার নিমিত্ত আর একজন মহাজন উপস্থিত হইয়াছেন। তবে আপনার নিকট আমি এতদিবস কার্য্য করিয়াছি। আমি কি চরিত্রের লোক, তাহা নিশ্চয়ই আপনি বুঝিতে পারিয়াছেন, এবং আপনারও প্রকৃতি আমার বুঝিতে বাকী নাই। সুতরাং আপনি যদি আমাদিগের সহিত মিলিত হন, তাহা হইলে অপর মহাজনের নিকট গমন করিতে আমি ইচ্ছা করি না। আর যদি একান্তই আপনি এই কার্য্যে প্রবৃত্ত না হন, তাহা হইলে কাজেই আমাদিগকে অপরের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবে। 

গোবিন্দ। তোমাকে অবিশ্বাস করিবার আমার কোন কারণ নাই; কিন্তু অধিক টাকার সংস্থান করিবার ক্ষমতা আমার নাই। অল্প টাকার মধ্যে যদি কার্য শেষ করিতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারি। 

সর্দ্দার। এই কার্য্যে প্রথম প্রথম অধিক টাকার প্রয়োজন হইবে না। অল্প টাকাতেই আমরা কার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া লইব এবং এইরূপে কিছু অর্থের সংস্থান করিয়া লইতে পারিলে, সেই অর্থের দ্বারাই পরিশেষে অধিক পরিমিত কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিব। 

গোবিন্দ। ন্যূনকল্পে আপাততঃ কত টাকা হইলে এই কাৰ্য্য চলিতে পারিবে? 

সর্দ্দার। আপনি যে পরিমাণে টাকা প্রদান করিবেন, আমরা সেই পরিমাণেই কার্য্য করিব। সপ্তাহের মধ্যে হাজার টাকা বাহির করিতে পারিলেই হইবে। 

গোবিন্দ। একবারে হাজার টাকা বাহির করিবার ক্ষমতা আমার নাই। তিন চারিশত টাকায় এই কার্য্য চলিতে পারে কি? এই টাকায় যদি কার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া উঠিতে পার, তাহা হইলে আমাকে বলিও। আমি দেখিব, যদি কোন প্রকারে সেই টাকার সংগ্রহ করিতে পারি। 

সর্দ্দার। তিন চারি শত টাকায় কেন চলিবে না? তবে এত অল্প টাকায় মন খুলিয়া কার্য্য করিয়া উঠিতে পারিব না। অধিক টাকা হইলে যেমন লাভ অধিক হইত, অল্প টাকায় লাভও সেইরূপ অল্প হইবে। আপনি যতদূর পারেন, টাকার চেষ্টা করুন। সাহেবের সহিত বন্দোবস্ত হইবার পরই কার্য্য আরম্ভ করা যাইবে। এখন আপনি সাহেবের নামে এই মর্ম্মে একখানি দরখাস্ত লিখিয়া দিন যে, আপনি যেরূপ কুলি-সরবরাহ করিবার কার্য্যে অপরকে কন্ট্রাক্ট দিতেছেন, আমিও সেইরূপ কন্ট্রাক্ট লইতে ইচ্ছা করি। 

গোবিন্দ। আমি কাহার নামে দরখাস্ত করিব? যে সাহেবের কথা তোমরা আমাকে বলিতেছ, তাঁহার সহিত আমার পরিচয় নাই, এবং তাঁহার নামও আমি জানি না। 

সর্দ্দার। আচ্ছা, তাহার বন্দোবস্ত আমি করিব, আর সাহেবের নাম আনিয়া আমি আপনাকে প্রদান করিব। নাম পাইলে আপনি সেই নামে দরখাস্ত লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করিবেন; সেই দরখাস্ত লইয়া গিয়া আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং তিনি যেরূপ বলেন, তাহা কল্য আসিয়া আমি আপনাকে বলিব। 

এই বলিয়া সর্দ্দার সে দিবসের নিমিত্ত বিদায় গ্রহণ করিল। গোবিন্দ বাবুও টাকার সংগ্রহ করিতে নিযুক্ত হইলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

পরদিবস প্রত্যুষেই সর্দ্দার আসিয়া গোবিন্দ বাবুর নিকট উপস্থিত হইল, এবং তাঁহার হস্তে এক টুকরা কাগজ প্রদান করিয়া কহিল, “এই কাগজে সেই সাহেবের নাম লেখা আছে। এই নামে এক খানি দরখাস্ত লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করুন, আমি সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া আসিব।” 

সর্দ্দারের কথা শুনিয়া গোবিন্দবাবু তাহাই করিলেন। একখানি দরখাস্ত লিখিয়া সর্দ্দারের হস্তে প্রদান করিলেন। সেই দরখাস্তের মর্ম্মা এইরূপ:– 

সর্দ্দারের প্রমুখাৎ শুনিতে পাইলাম যে, যাহারা আপনার আদেশমত কুলির সরবরাহ করিতে পারিবে বলিয়া আপনার নিকট দরখাস্ত করিতেছে, আপনি তাহাদিগের দরখাস্ত মঞ্জুর করিয়া তাহাদিগকে কুলি সরবরাহ করিবার কন্ট্রাক্ট প্রদান করিতেছেন। যদি আমাকে সেইরূপ ভাবে একটি কন্ট্রাক্ট দেন, তাহা হইলে আমি ভরসা করি, আপনার ইচ্ছামত কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইব। 

গোবিন্দ বাবু দরখাস্তখানি সর্দ্দারের হস্তে প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু বলিয়া দিলেন, “তুমি একবারে সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া আসিও না। যদি জানিতে পার যে, সাহেব আমাদিগকে কাৰ্য্য দিতে সম্মত হন, তাহা হইলে আমাকে বলিও। আমি নিজে গিয়া সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া, সমস্ত কথা স্থির করিয়া আসিব।” 

সর্দ্দার। তাহা ত হইবেই। আপনাকে গিয়া সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিতে হইবে। তাহার পর আপনার আদেশমত আমরা কুলির সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইব। 

এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর সেই দরখাস্তখানি লইয়া সর্দ্দার সে দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পরদিবস সন্ধ্যার সময় সেই সর্দ্দার আসিয়া পুনরায় গোবিন্দ বাবুর নিকট উপস্থিত হইল, এবং তাঁহার হস্তে একখানি পত্র প্রদান করিয়া কহিল, “মহাশয়! আমি কল্যই সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম, ও আপনার লিখিত সেই দরখাস্তখানি দিয়াছিলাম। তিনি আপনার দরখাস্ত মঞ্জুর করিয়াছেন, এবং এই পত্রখানি লিখিয়া আপনাকে প্রদান করিবার নিমিত্ত আমাকে দিয়াছেন।” 

সদারের কথা শুনিয়া গোবিন্দ বাবু সেই পত্রখানি খুলিলেন ও পড়িয়া দেখিলেন। সেই পত্রে সেই সাহেবের সই আছে, এবং উহাতে লেখা আছে, “আপনি যে কার্য্যের নিমিত্ত আবেদন করিয়াছেন, আপনাকে সেই কার্যে নিযুক্ত করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই; কিন্তু এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে একবার আমার নিকট আগমন করিয়া সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া গেলেই ভাল হয়।” 

পত্র পাঠ করিয়া গোবিন্দ বাবু সদারকে কহিলেন, “সাহেব আমাকে ডাকিয়াছেন; একবার তাঁহার নিকট গমন করিয়া তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ করা উচিত।” 

সর্দ্দার। সাহেব আমাকেও তাহাই বলিয়া দিয়াছেন। 

গোবিন্দ। তাঁহার আফিস কোথায়, আমাকে বলিয়া দেও; আমি সেই স্থানে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিব। 

সর্দ্দার। তাঁহার আফিস কোথায়, তাহা আমি জানি না। শুনিয়াছি, গঙ্গার ধারে কোন এক বাড়ীতে তাঁহার আফিস। কিন্তু তিনি আফিসে প্রায়ই থাকেন না। অনেক সওদাগরের কাম করিতে হয় বলিয়া, তাঁহাকে প্রায়ই বাবুঘাটে থাকিতে হয়। যে জাহাজে যত কুলি কার্য্য করিবে, তাহা সেই স্থান হইতে তিনি বন্দোবস্ত করিয়া দেন, এবং জাহাজে জাহাজে নিজে গিয়া কাৰ্য্য সকল পরিদর্শন করিয়া বেড়ান। তাঁহার বড়বাবু ও তাঁহার প্রধান সরকার সর্ব্বদাই প্রায় তাঁহারই সহিত থাকিয়া কার্য্যের তত্বাবধান করেন। তাঁহাদিগের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ করিবার প্রয়োজন হইলেই, বাবুঘাটে গিয়া আমরা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি, এবং সেই স্থানেই সকল কার্য্যের বন্দোবস্ত হয়। আপনি যদি সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান, তাহা হইলে আমাকে সঙ্গে যাইতে হইবে। নতুবা আপনি সাহেবকে চিনিবেন কি প্রকারে? আর কোন্ স্থানে সাক্ষাৎ হইবে, তাহাই বা জানিবেন কিরূপে? 

গোবিন্দ। কোন্ সময়ে গমন করিলে, সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা? 

সর্দ্দার। যে সময় যাইবেন, সেই সময়েই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। কোন্ সময় গমন করিতে পারিবেন বলুন, সেই সময় আমি আসিব, এবং আপনাকে আমি সাহেবের নিকট লইয়া যাইব। 

গোবিন্দ। আগামী কল্য দিবা একটার পর আসিও। সেই সময় আমি তোমার সহিত গমন করিয়া, সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিব এবং সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত শেষ করিয়া আসিব। 

গোবিন্দ বাবুর সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত হইবার পর, সর্দ্দার সে দিবস প্রস্থান করিল। 

সর্দ্দার গমন করিবার পর, গোবিন্দ বাবু মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, কলিকাতা সহর জুয়াচোরে পূর্ণ। সদার আমাকে এইরূপ প্রলোভনে প্রলোভিত করিয়া, কোনরূপ জুয়াচোরের হস্তে আমাকে অর্পণ করিবে না ত? কিন্তু সে আমার নিকট প্রায় একমাস কার্য্য করিতেছে, ইহার মধ্যে তাহাকে কোনরূপ অবিশ্বাসের কার্য্য করিতে দেখি নাই; অধিকন্তু তাহাকে ভাল লোক বলিয়াই বোধ হয়। এরূপ অবস্থায় কি সে আমাকে জুয়াচোরের হস্তে অর্পণ করিতে পারিবে? না, তাহা কখনই হইবে না। যাহাতে আমার ও তাহার দুই পয়সা উপার্জ্জন হয়, সে তাহারই চেষ্টা করিতেছে মাত্র। 

গোবিন্দবাবু মনে মনে এইরূপ ভাবিলেন; তথাপি মনকে স্থির করিতে না পারিয়া, তিনি তাঁহার একজন সবিশেষ বিশ্বাসী বন্ধুর নিকট গমন করিয়া নিজের মনের ভাব ও তাঁহার সর্দ্দারের প্রস্তাবিত সমস্ত বিষয় তাঁহাকে কহিলেন। তিনি সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইয়া, যদিও সর্দ্দারের দুরভিসন্ধির কোন কথা মনে স্থান দিতে পারিলেন না, তথাপি কলিকাতার ভাবগতি তিনি উত্তমরূপে অবগত থাকায়, তাহার উপর একবারে বিশ্বাসও করিতে পারিলেন না। তখন উভয়ে পরামর্শ করিয়া এই স্থিরীকৃত হইল যে, পরদিবস গোবিন্দ বাবু যখন সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন, সেই সময় তিনিও তাঁহার সহিত গমন করিবেন। সাহেবের সহিত কিরূপ ভাবে কথাবার্তা হয়, এবং কিরূপ ভাবে কাজ-কর্ম্মের বন্দোবস্ত হয়, তাহা দেখিলে স্পষ্টই জানিতে পারা যাইবে যে, ইহার ভিতর কোনরূপ জুয়াচুরি আছে কি না। আর ইহাও স্থিরীকৃত হইল যে, সাহেবের সহিত কথাবার্তা হইবার পূর্ব্বে এই কার্য্যের নিমিত্ত সদারের হস্তে কোনরূপে অর্থ প্রদান করা হইবে না। 

এইরূপ পরামর্শ করিবার পর, পরদিবস উভয়েই সর্দ্দারের সহিত সাহেবের নিকট গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

পরদিবস দিবা একটার পর গোবিন্দ বাবু তাঁহার বন্ধুর সহিত সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবার মানসে প্রস্তুত হইয়া, সেই সর্দারের অপেক্ষায় বসিয়া রহিলেন। ক্রমে বেলা একটা বাজিয়া গেল, দেখিতে দেখিতে আরও একঘণ্টা অতীত হইয়া গেল; কিন্তু সর্দ্দার আসিল না। 

সর্দ্দারের বিলম্ব দেখিয়া, গোবিন্দ বাবু ও তাঁহার বন্ধুর মনে ক্রমে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। তাঁহারা ভাবিলেন, সাহেবের আফিস প্রভৃতির কথা সমস্তই মিথ্যা। কেবল সাহেবের নাম লইয়া, কোন গতিতে কিছু অর্থ বাহির করিয়া লওয়া ভিন্ন, ইহাতে সর্দ্দারের আর কোনরূপ অভিসন্ধি আছে বলিয়া বোধ হয় না। 

গোবিন্দ বাবু ও তাঁহার বন্ধু বসিয়া এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে একটি অপরিচিত লোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এবং তাঁহাদিগের উভয়কেই লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয়! গোবিন্দ বাবু কাহার নাম?” 

গোবিন্দ। কেন, তুমি কাহার অনুসন্ধান করিতেছ? 

অপরিচিত। আমি গোবিন্দ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আসিয়াছি। 

গোবিন্দ। তুমি কে, এবং তোমার প্রয়োজনই বা কি? 

অপরিচিত। আমিও একজন সর্দ্দার। গোবিন্দ বাবুর নিকট যে সর্দ্দার কর্ম্ম করিতেন, আমি তাঁহারই নিকট হইতে আসিতেছি। 

গোবিন্দ। আমার নাম গোবিন্দ বাবু। 

২য় সর্দ্দার। আপনার সর্দ্দারের একটু অসুখ বোধ হওয়ায়, তিনি আর আপনার নিকট আগমন করিতে পারেন নাই; যদি পারেন, তবে ঘাটে গিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। তিনিই আমাকে আপনার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন এবং বলিয়া দিয়াছেন যে, আজ আপনারা সাহেবের নিকট গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, এইরূপ কথা আছে। তিনি আসিতে পারিলেন না, তাই আমি আসিয়াছি। যদি আপনারা সাহেবের নিকট গমন করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমার সহিত আগমন করুন। আমি আপনাকে সেই সাহেবের নিকট লইয়া যাইতেছি। সেই স্থানে সেই সর্দ্দারের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলেও হইতে পারিবে। 

উক্ত ব্যক্তির কথা শুনিয়া গোবিন্দ বাবু ও তাঁহার বন্ধু বুঝিতে পারিলেন, এ ব্যক্তিও একজন সর্দ্দার। অপর সর্দ্দারের সহিত এ কাম-কৰ্ম্ম করিয়া থাকে। সুতরাং ইহার সহিত সাহেবের নিকট গমন করিলে কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া উভয়েই সেই সর্দ্দারের সহিত গমন করিতে প্রস্তুত হইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। সেই সর্দ্দার তাঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া একবারে বাবুঘাটে গিয়া উপস্থিত হইল। গোবিন্দ বাবু সেই স্থানে গমন করিয়াই, তিনি তাঁহার পূর্ব্ব-কথিত সর্দ্দারকে সেই স্থানে দেখিতে পাইলেন। সেই সময় সেই সর্দ্দার দুইটি বাবুর সহিত কথা কহিতেছিল। 

সেই দুইটি বাবুর মধ্যে একজন পেণ্টুলেন-চাপকান পরা। তাঁহার মস্তকে একটি কাল গোল ফ্যাশানের টুপি। হস্তে একখানি কাল রঙ্গের বাঁধান পকেট বুক। অপর বাবুটির পরিধানে ধুতি, গায়ে একটি কোট, চাদর নাই, হাতে একখানি লম্বা গোছের খাতা। 

গোবিন্দ বাবু সেই স্থানে গমন করিবামাত্রই, সেই প্রথম সর্দ্দার তাঁহার নিকট আগমন করিল ও কহিল, “আপনি আসিয়াছেন, একটু অপেক্ষা করুন। সাহেব তাঁহার কার্য্যের তত্ত্বাবধান করিবার নিমিত্ত জাহাজে গমন করিয়াছেন, এখনই আসিবেন। যে পর্য্যন্ত তিনি আগমন না করিবেন, সেই পর্য্যন্ত আপনি তাঁহার এই বাবুদিগের সহিত কথাবার্তা করুন, তাহা হইলে কার্য্যের অবস্থা অনেক বুঝিতে পারিবেন।” 

এই বলিয়া সেই বাবু দুইটিকে গোবিন্দ বাবুর সহিত পরিচিত করিয়া দিলেন ও কহিলেন, “এই যে পেন্টুলেন চাপকান পরিহিত বাবুটিকে দেখিতেছেন, ইনি সাহেবের বড় বাবু। ইনি সাহেবকে যাহা বলিবেন, সাহেব তাহাই করিবেন। আমাদিগের যে কিছু কার্য্য হইবে, তাহা ইঁহার হস্ত দিয়াই হইবে। আর যে অপর বাবুটিকে দেখিতেছেন, ইনি সাহেবের সরকার। যখন যে সকল কুলি আমরা কার্য্যে নিযুক্ত করিব, ইনি তাহাদিগের হাজিরা ইত্যাদি গ্রহণ করিবেন, এবং ইনিই তাহাদিগের কার্য্যের তত্বাবধান করিবেন।” 

সদারের বাক্য-অনুসারে গোবিন্দ বাবু সেই বড় বাবুর সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিলেন ও কহিলেন, “আমি সর্দ্দারের কথা শুনিয়া এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছি, কার্য্যের অবস্থা নিজে এখন পর্য্যন্ত কিছুই অবগত নহি। আপনি ভদ্রলোক দেখিতেছি, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, এ কার্য্যে আমাদিগের কিছু সুবিধা হইবার সম্ভাবনা আছে কি?” 

বড় বাবু। এ কার্য্যে সুবিধা হইবার সম্ভাবনাই অধিক। কারণ, আমার সাহেব যে হারে কুলির দাম দিয়া থাকেন, তাহাতে কোনরূপেই কার্য্যের অসুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। তবে সুবিধা-অসুবিধা আপনাদিগের নিজের হস্তে। কারণ, এই কার্য্যে লাভের প্রধান উপায় কুলি সংগ্রহ করা। সাহেব যে দিবস যে পরিমিত কুলি সরবরাহ করিতে আদেশ প্রদান করিবেন, সেই দিবস যদি সেই পরিমিত কুলির সংগ্রহ করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে এই কার্য্যে আপনারা খুব লাভ করিতে পারিবেন। 

গোবিন্দ। সদার বলিতেছে, আপনারা যে দিবস যত কুলির আদেশ প্রদান করিবেন, সেই দিবস তত কুলিই সে প্রদান করিবে। 

সরকার। আমি উভয় সর্দ্দারকেই জানি। উহারা মনে করিলে, অনেক কুলি সংগ্রহ করিয়া দিতে পারিবে। উহাদিগের অধীনে অনেক কুলি আছে। 

বড় বাবু। আর একটি ধনীর সাহায্যে উহারা আমার নিকট আর একবার কর্ম্ম করিয়াছিল। তাহাতে যে দিবস যত কুলি আমি চাহিতাম, তত কুলিই উহারা আনিয়া উপস্থিত করিত। ইহারা যদি মনে করে, তাহা হইলে কুলি সংগ্রহ করিতে ইহাদিগের কোন কষ্ট হয় না। 

১ম সর্দ্দার। যে ধনীর সাহায্যে আমরা কার্য্য করিতেছিলাম, তিনি যদি হঠাৎ মরিয়াই না যাইবেন, তাহা হইলে আর আমাদিগের ভাবনা কি? আর কিছু দিবস কার্য্য করিতে পারিলে, আমাদিগকে আর অপর ধনীর তল্লাস করিতে হইত না। 

২য় সর্দ্দার।  কুলি যত বলিবেন, আমরা তাহার সংগ্রহ করিয়া দিব। কেবল অর্থই প্রদান করিতে পারিব না।

গোবিন্দ। আমাদিগকে কিরূপ ভাবে এবং কোন্ সময় কুলি দিতে হইবে? 

বড় বাবু। আমাদিগের কার্য্যের কিছুই স্থিরতা নাই। দিবাভাগে হইয়া থাকে, আবশ্যক হইলে রাত্রিকালেও কার্য্য হয়।

গোবিন্দ। কি হিসাবে প্রত্যেক কুলির মূল্য আমাদিগকে প্রদান করিবেন? 

বড় বাবু। আপাততঃ একমাসকাল দিবাভাগে কার্য্যের নিমিত্ত প্রত্যেক কুলিকে আমরা বার আনা হিসাবে, এবং রাত্রির নিমিত্ত দেড় টাকার হিসাবে প্রদান করিব। একমাস পরে পুনরায় নূতন বন্দোবস্ত হইবে। অভাব বুঝিয়া কুলির মূল্য অধিক হইতে পারে, আধিক্য বুঝিয়া পারিশ্রমিক অল্পও হইতে পারে। 

গোবিন্দ। কিরূপ নিয়মে আপনারা টাকা দিবেন? 

বড় বাবু। আমাদিগের আফিসের যেরূপ নিয়ম আছে, অর্থাৎ এক সপ্তাহকাল কাৰ্য্য হইলে সেই সপ্তাহের সমস্ত মূল্য আপনারা একদিবসে পাইবেন। প্রত্যেক সোমবারে আমরা টাকা প্রদান করিয়া থাকি। রবিবার হইতে আরম্ভ করিয়া শনিবার পর্য্যন্ত আপনাদিগের যত টাকার কার্য্য হইবে, সোমবারে তাহার সমস্ত প্রাপ্ত হইবেন। এইরূপে প্রত্যেক সোমবারে টাকা প্রদান করাই আমাদিগের আফিসের নিয়ম। 

গোবিন্দ। আপনাদিগের সহিত যেরূপ ভাবে আমাদিগের কার্য্য করিতে হইবে, তাহা কোনরূপ লেখাপড়া করিবার প্রয়াজন হইবে কি? 

বড় বাবু। আমি তো কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না। তবে ইচ্ছা করেন, লেখা-পড়া করিয়া দেওয়া যাইতে পারে।

গোবিন্দ। কিরূপ ভাবে লেখা-পড়া হইবে? 

বড় বাবু। লেখা-পড়া করিতে হইলে, উকীলের বাড়ীতে দস্তুরমত লেখা-পড়া করিয়া লওয়াই কৰ্ত্তব্য। তাঁহারা যেরূপ ভাল বিবেচনা করিবেন, সেইরূপ ভাবেই লেখা-পড়া হইবে। ইতিপূর্ব্বে আরও কয়েকজনের সহিত লেখা-পড়া হইয়াছে। যদি আপনার কোন ভাল উকীলের সহিত আলাপ-পরিচয় থাকে, তাহা হইলে তাঁহারই আফিসে লেখা-পড়া হইবে। নতুবা আমাদিগের উকীলের আফিসেও লেখা-পড়া হইতে পারে। 

গোবিন্দ। আপনাদিগের সাহেব কখন আসিবেন? 

বড় বাবু। তিনি এখনই আসিবেন। 

এই বলিয়া বড় বাবু নৌকা ও জাহাজ পরিপূর্ণ ভাগীরথীর দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন ও কহিলেন, “আমাদিগের সাহেব ওই ডিঙ্গিতে আসিতেছেন।” এই বলিয়া গঙ্গার মধ্যস্থিত একখানি ডিঙ্গি দেখাইয়া দিলেন। সেই ডিঙ্গির উপর প্রাকৃতই একজন সাহেব দণ্ডায়মান ছিল। 

ডিঙ্গির মাঝিরা ক্রমে সেই ডিঙ্গি বাহিয়া কিনারায় আসিতে লাগিল। ক্রমে সময় মত সাহেব আসিয়া কিনারায় উপস্থিত হইলেন। 

ডিঙ্গি হইতে অবতরণ করিবার পরই বড় বাবু, সরকার মহাশয় ও সর্দ্দার দুইজন তাঁহার নিকট গমন করিল এবং তাঁহার সহিত দুই চারিটি কথা কহিবার পরই, সকলে যেস্থানে গোবিন্দ বাবু ও তাঁহার বন্ধু দণ্ডায়মান ছিলেন, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন সাহেব বড়বাবুকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহাদিগের মধ্যে গোবিন্দ বাবু কে?” 

গোবিন্দ। মহাশয়! আমারই নাম গোবিন্দ। 

সাহেব। আপনিই কি কুলি-সরবরাহ কার্য্য করিবার নিমিত্ত আমার নিকট দরখাস্ত করিয়াছিলেন? 

গোবিন্দ। আজ্ঞা হাঁ। 

সাহেব। কিরূপ ভাবে কার্য্য করিতে হইবে, তাহা আপনি বড় বাবুর নিকট হইতে অবগত হইয়াছেন কি? 

গোবিন্দ। বড় বাবু আমাকে অনেক কথা বলিয়াছেন। 

সাহেব। কেমন, আপনি উহাতে সম্মত আছেন কি? 

বড় বাবু। গোবিন্দ বাবু আমার নিকট হইতে সমস্ত বিষয় জানিয়া লইয়াছেন, এবং আমাদিগের নিকট কর্ম্ম করিতে সম্মত হইয়াছেন। কিন্তু একটি বিষয়ে ইহার কিছু আপত্তি আছে বলিয়া আমার বোধ হয়। 

সাহেব। কোন্ বিষয়ে ইঁহার আপত্তি আছে? 

বড় বাবু। ইহার ইচ্ছা, কোন উকীলের বাড়ী হইতে লেখা-পড়া করিয়া লইয়া ইনি এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হন।

সাহেব। সে উত্তম কথা। উঁহার নিজের যদি কোন উকীল থাকে, তাহা হইলে সেই স্থানে লেখা-পড়া করিয়া দেও। আর যদি উঁহার কোন উকীলের সহিত পরিচয় না থাকে, তাহা হইলে আমাদিগের উকীলের বাড়ীতেই লেখা-পড়া হউক। তদ্ব্যতীত একখানি খাতা করিয়া দেও। যে দিবস উহাদিগের যত কুলি কার্য্য করিবে, তাহার পরদিবস সেই সকল কুলির সংখ্যা সেই খাতায় লিখিয়া দিবে। এইরূপে এক সপ্তাহের মধ্যে যত কুলি নিযুক্ত করা হইবে, সেই খাতা দেখিয়া তাহাদের হিসাব প্রস্তুত করিয়া তোমাদিগের নিজের হিসাবের সহিত মিলাইয়া দেখিয়া যত টাকা পাওনা হইবে, তাহা তৎক্ষণাৎ প্রদান করিব। 

বড় বাবু। তাহাই হইবে, আমি একখানি হাতচিঠা প্রস্তুত করিয়া দিব। 

সাহেব। যে পৰ্য্যন্ত উকীলের বাড়ীতে লেখা-পড়া শেষ না হয়, তাহার মধ্যে যদি উঁহারা কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন, তাহা হইলেও উঁহারা কার্য্য করিতে পারিবেন। তাহাতে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই। আর যদি লেখা-পড়া শেষ হইবার পূর্ব্বে উহারা কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত না হন ___(?)দিগের কোন ক্ষতি নাই। কিন্তু উকীলের বাড়ীতে লেখাপড়া শেষ হইতে, এবং সেই দলিল রেজিষ্টারি করিতে অভাবপক্ষে পনর দিবসের কম কোনরূপেই হইতে পারিবে না। এরূপ অবস্থায় গোবিন্দ বাবু যে সময় হইতে কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইবেন, সেই সময় হইতেই তাঁহাকে কৰ্ম্মে নিযুক্ত করিও। 

এই বলিয়া সাহেব অপর কতকগুলি কার্য্যের কথা বড় বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ:- 

অমুক জাহাজে আজ যত কুলি কার্য্য করিতেছে, অমুক জাহাজে আজ কত কুলির প্রয়োজন হইবে, অমুক সদার আজ কত কুলির সরবরাহ করিয়াছে, অমুক কন্ট্রাক্টার গতরাত্রিতে কত কুলি প্রদান করিতে পারিয়াছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি- 

সাহেবের কথায় বড় বাবুও সেইরূপভাবে উত্তর প্রদান করিলেন; তাঁহার কথার ভাবে অনুদান হইল, সে দিবস প্রায় দুই সহস্র কুলি কার্য্য করিতেছিল। রাত্রিতেও প্রায় তিন শত কুলি কার্য্য করিয়াছিল। সর্দ্দারগণ ও কন্ট্রাক্টারগণের মধ্যে প্রায় সকলেই আদেশমত কুলির যোগাড় করিয়া দিতেছেন, কেবল দুই একজন পারিতেছেন না। 

এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর সাহেব সেই ডিঙ্গিতে আরোহণ করিলেন, এবং একখানি জাহাজে কার্য্য পরিদর্শন করিতে যাইতেছেন বলিয়া, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

সাহেব সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, বড় বাবু গোবিন্দ বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন মহাশয়! সাহেবের সহিত ত আপনার সাক্ষাৎ হইল এবং কথাবার্তাও হইয়া গেল; এখন আপনি কি করিতে চাহেন? লেখা-পড়া হইলে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইবেন, কি এদিকে কার্য্যও করিবেন, অপর দিকে উকীলের বাড়ীতে লেখা-পড়ার কাৰ্য্যও হইতে থাকিবে? 

১ম সর্দ্দার। লেখা-পড়ার নিমিত্ত কার্য্য বন্ধ থাকিবে কেন? আপাততঃ আপনি হাতচিঠা লিখিয়া দিন, আমরা কার্য্য করিতে থাকি। ও দিকে লেখা-পড়া হউক। কি বলেন গোবিন্দ বাবু? 

বড় বাবু ও সর্দ্দারের কথা শুনিয়া গোবিন্দ বাবু তাঁহার সমভিব্যাহারী সেই বন্ধুকে ডাকিয়া লইয়া একটু দূরে গমন করিলেন, এবং তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বল ভাই! কিরূপ বোধ হইতেছে?” 

বন্ধু। ইহার ভিতর যে কোনরূপ জুয়াচুরির কারখানা আছে, এরূপ ত বোধ হইতেছে না। আমার বিবেচনায় কার্য্য আরম্ভ করা যাইতে পারে। 

গোবিন্দ। আমারও সেই বিবেচনা। দুই একদিবস কার্য্য করিয়া দেখা যাক না। দুই একদিবস কার্য্য করিবার পর, যদি কার্য্য করাই স্থির হয়, তাহা হইলে উকীলের বাড়ীতে লেখা-পড়া করিয়া লওয়া যাইবে। নতুবা আস্তে আস্তে প্রস্থান করিলেই চলিবে। 

বন্ধু। তাহাই ভাল। আজ শুক্রবার, আজ আর কোন কার্য্য হইতে পারিবে না। শনিবার হইতে কার্য্য করিলেই বুঝিতে পারিব। কারণ, সেই একদিবস কার্য্য করিলেই সপ্তাহ শেষ হইয়া যাইবে, তখন বুঝিতে পারিব যে, সোমবারে উঁহারা কিরূপ ভাবে টাকা প্রদান করেন। তাহা বুঝিয়া কার্য্য করা আর না করার কথা বিবেচনা করিব। কার্য্যের ভাবগতি না দেখিয়া, প্রথমতঃই একটি লেখা-পড়া করিয়া, বাঁধাবাঁধির ভিতর যাওয়া উচিত নহে। 

গোবিন্দ। আমারও তাহাই মত। আপনি উত্তম পরামর্শ দিয়াছেন। 

এই বলিয়া গোবিন্দ বাবু বড় বাবুর নিকট পুনরায় গমন করিলেন ও কহিলেন, “আমাদিগের এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়াই স্থির হইল। কল্য হইতে আমরা কার্য্য আরম্ভ করিব।” 

গোবিন্দ বাবুর কথা শুনিয়া প্রথম সর্দ্দার কহিল, “আপনি যেরূপ বিবেচনা করিবেন, এবং যেরূপ ভাবে কার্য করিতে আদেশ প্রদান করিবেন, আমরা সেইরূপই করিব। এখন আপনারা আপন স্থানে গমন করুন। কিয়ৎক্ষণ পরে আমরাও আপনার বাড়ীতে গমন করিয়া, কায-কর্ম্মের সমস্ত পরামর্শ স্থির করিয়া, কল্য হইতেই কার্য্য আরম্ভ করিয়া দিব।” 

এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, বড় বাবু ও সরকার তাঁহাদিগের কার্য্য পরিদর্শন করিবার ভান করিয়া, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। পরিশেষে সর্দ্দার দুইজনও অপর এক দিকে গমন করিল। গোবিন্দ বাবু এবং তাঁহার বন্ধু আপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

গোবিন্দ বাবুর নিজ বাড়ীতে প্রত্যাবৃত্ত হইবার প্রায় দুইঘণ্টা পরে, পূর্ব্বোক্ত দুইজন সর্দারই তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হইল, এবং গোবিন্দ বাবুকে বলিল, “কেমন মহাশয়! কল্য হইতেই আমরা কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইতে পারি?

গোবিন্দ। যখন কার্য্য করাই স্থির হইতেছে, তখন কল্য হইতে কাৰ্য্য আরম্ভ করাই কর্তব্য। কিন্তু তোমাদিগের সহিত অগ্রে একটা বন্দোবস্ত হওয়া উচিত নয় কি? 

১ম সর্দ্দার। সে ভাল কথা। আমাদিগের সহিত একটা বন্দোবস্ত হইলেই ভাল হয়। না হয়, আমরা কার্য্য করি, আপনার যেরূপ বিবেচনা হইবে, তাহা পরে করিবেন। 

গোবিন্দ। না, সে ভাল কথা নহে। অগ্রে একটা বন্দোবস্ত হওয়াই কর্তব্য। তোমরা কিরূপ বেতন বা অংশ লইতে চাহ, তাহা আমাকে অগ্রেই বল। 

২য় সর্দ্দার। বেতন গ্রহণ করিয়া এ কার্য্য করিলে আমাদিগের চলিবে না। আমাদিগের একটা অংশ স্থির করিয়া দিন। 

গোবিন্দ। কিরূপ অংশ তোমরা লইতে চাহ? 

২য় সর্দ্দার। সপ্তাহের মধ্যে যত টাকার কার্য্য হইবে, তাহার মধ্য হইতে কুলিগণের মজুরি যে পরিমাণে আপনাকে প্রদান করিতে হইবে, তাহা বাদ দিয়া, যাহা কিছু লাভ থাকিবে, তাহার অর্দ্ধেক আপনি লইবেন, অবশিষ্ট অর্দ্ধেক আমাদিগকে প্রদান করিবেন। 

গোবিন্দ। তাহা ঠিক হয় না। কারণ, এই কার্য্যের নিমিত্ত আমাকেই সমস্ত টাকা প্রদান করিতে হইবে। আমার নিজের অর্থ নাই, কর্ম্ম করিয়া সেই টাকার সংগ্রহ করিতে হইবে। তাহার সুদ আছে। সুতরাং ওইরূপ অংশে আমি কোনরূপেই সম্মত হইতে পারি না। 

১ম সর্দ্দার। কিরূপ অংশে আপনি সম্মত হইতে পারেন, তাহা বলুন। আপনি যেরূপ টাকা দিয়া আমাদিগকে সাহায্য করিবেন, আমরাও সেইরূপ কুলির সংগ্রহ করিয়া দিয়া আপনাকে সাহায্য করিব। এই সকল বিবেচনা করিয়া, আপনি আমাদিগকে যেরূপ অংশ দিতে ইচ্ছা করিবেন, আমরা তাহাতেই সম্মত হইব। 

গোবিন্দ। লাভের তিন অংশের দুই অংশ আমি গ্রহণ করিব, অবশিষ্ট এক অংশ তোমাদিগকে প্রদান করিব। কেমন, ইহাতে তোমরা সম্মত আছ? 

১ম সর্দ্দার। কাজেই আপাততঃ সম্মত হইলাম। কারণ, এ কার্য্যের যে কি মজা, তাহা আপনি জানেন না। আপনার প্রস্তাবিত অংশ গ্রহণ করিয়া আমরা একমাসকাল কার্য্য করিব। তাহার পর আমাদিগের সহিত নূতন বন্দোবস্ত করিতে হইবে। কেমন, আপনি তাহাতে সম্মত আছেন কি? 

গোবিন্দ। একমাস কাৰ্য্য করিয়া দেখি, যদি বুঝিতে পারি, ইহাতে লাভের সম্ভাবনা আছে, তাহা হইলে তোমাদিগকে কিছু অধিক অংশ দিতে আমার কোন আপত্তি থাকিবে না। 

১ম সর্দ্দার। তবে কলা হইতে আমরা সাহেবের আদেশমত কুলি নিযুক্ত করিতে পারি? 

গোবিন্দ। পার। 

গোবিন্দ। হুক কি? 

১ম সর্দ্দার। জাহাজ হইতে বস্তা নামাইবার সময়, বা জাহাজে বস্তা বোঝাই করিবার সময়, কুলিগণ একরূপ বাঁকা লোহার দ্বারা সেই সকল বস্তা ধরিয়া উঠিইয়া থাকে, তাহাকেই হুক কহে। কল্যই ত তাহার আবশ্যক হইবে। 

গোবিন্দ। উহা ত আমাদিগের নাই। 

১ম সর্দ্দার। তাহা হইলে কিরূপ কার্য্য আরম্ভ করা যাইতে পারে? 

২য় সর্দ্দার। বহুবাজারের একটি বিক্রীওয়ালার দোকানে সেই রূপ অনেক পুরাতন হুক আমি দেখিয়া আসিয়াছি। অল্প মূল্যে সেই স্থান হইতে কতকগুলি খরিদ করিয়া লইলে হয় না? আমাদিগের একদিবসের কার্য নহে, প্রত্যহই উহার আবশ্যক হইবে। 

১ম সর্দ্দার। উত্তম কথা বলিয়াছ, সেই ভাল। পুরাতন দামে কতকগুলি হুক খরিদ করিয়াই লওয়া যাউক।

গোবিন্দ। কত টাকা হইলে উহা খরিদ হইতে পারে? 

১ম সর্দ্দার। অতি সামান্য টাকা। পনর বা কুড়ি টাকাতেই আপাততঃ কার্য্য চলিতে পারিবে। তাহা হইলে টাকা কয়েকটি এখনই আমাদিগকে প্রদান করুন, আমরা উহা খরিদ করিয়া আনি। না, আপনি অপর কাহার দ্বারা খরিদ করাইয়া আনাইয়া রাখুন, আমরা অতি প্রত্যূষে তাহা লইয়া যাইব। 

গোবিন্দ। আমি আর কোথা হইতে তাহা আনাইয়া রাখিব? আপাততঃ এই দশ টাকা লইয়া যাও, ইহার দ্বারা আপাততঃ কাৰ্য্য চলিবার নিমিত্ত কতকগুলি হুক খরিদ করিয়া লও। আবশ্যক হয়, পরবর্তীতে আমি খরিদ করিয়া দিবে। 

এই বলিয়া গোবিন্দ বাবু সর্দারের হস্তে দশ টাকা প্রদান করিলেন। সেই টাকা লইয়া সদারগণ সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

পরদিবস সর্দ্দারদ্বয় পুনরায় সন্ধ্যার পূর্ব্বে গোবিন্দ বাবুর নিকট আগমন করিয়া ও কহিল, “আজ দিবসে কেবলমাত্র চল্লিশজন কুলি দিবার নিমিত্ত সাহেব আদেশ করিয়াছিলেন। আমরাও তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি। সেই চল্লিশজন কুলিকে আট আনা হিসাবে কুড়ি টাকা এখন প্রদান করিতে হইবে।” 

গোবিন্দবাবু সর্দ্দারদ্বয়ের কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহাদিগের হস্তে কুড়ি টাকা প্রদান করিলেন। সর্দ্দারদ্বয় সেই টাকা লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পরদিবস অর্থাৎ রবিবারে সন্ধ্যার পূর্ব্বে পুনরায় আসিয়া কহিল, “শনিবার রাত্রিতে আমরা পঁচিশজন কুলি দিয়াছিলাম। রবিবার দিবাভাগে পঞ্চাশজন কুলি প্রদান করিয়াছি, ও রাত্রিকালে বোধ হয়, কিছু কুলি সরবরাহ করিতে হইবে।” 

এই বলিয়া সদারদ্বয় সাহেবের দস্তখতি একখানি হাতচিঠাও গোবিন্দ বাবুকে প্রদান করিল। সেই খাতা খুলিয়া গোবিন্দ বাবু দেখিলেন যে, শনিবার দিবাভাগে চল্লিশজন, রাত্রিকালে পঁচিশজন, এবং রবিবারের দিবাভাগে পঞ্চাশজন কুলি উহাতে দস্তুরমত জমা করিয়া দেওয়া আছে। 

এই খাতা দেখিয়া গোবিন্দ বাবু আরও সন্তুষ্ট হইলেন, এবং শনিবারের রাত্রির নিমিত্ত পঁচিশজন কুলির মজুরী এক টাকা হিসাবে পঁচিশ টাকা ও রবিবার পঞ্চাশজন কাজের হিসাবে দিবাভাগের পঞ্চাশজন কুলির আট আনা হিসাবে পঁচিশ টাকা সদারদ্বয়ের হস্তে প্রদান করিলেন। টাকা লইয়া সদারদ্বয় সেই স্থান প্রস্থান করিল। যাইবার সময় বলিয়া গেল কল্য সকালে আসিয়া কতগুলি কুলি রাত্রিতে কার্য্য করিল, তাহা আপনাকে বলিয়া যাইব, এবং হাতচিঠাও লইয়া যাইব, কারণ, সোমবারে সাহেবের হিসাব করিবার দিন। গত সপ্তাহে আমাদিগের মোটে একদিবস কাৰ্য্য হইয়াছে। সেই দিবসের হিসাব করিয়া আমাদিগের যাহা কিছু পাওনা হইবে, তাহা সোমবারে আমাদিগের আনা আবশ্যক।” 

সদারদ্বয় যেরূপ বলিয়া গিয়াছিল, সোমবারে প্রাতঃকালে সেইরূপ আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “গত রাত্রিতে সাহেব আমাদিগের নিকট হইতে পঞ্চাশজন কুলি গ্রহণ করিয়াছিলেন।” এই বলিয়া গোবিন্দ বাবুর নিকট হইতে পঞ্চাশ টাকা গ্রহণ করিল, এবং হিসাবের হাতচিঠা লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। গমনকালীন বলিয়া গেল, “আজ আমরা শনিবারের হিসাব ঠিক করিয়া রাখিব, আপনি একটার পর বাবুঘাটে গমন করিবেন এবং সেই স্থানে সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, গত সপ্তাহের টাকা লইয়া আসিবেন।” 

গোবিন্দ বাবু সেইরূপ কার্য্যই করিলেন। দিবা একটার পরই তিনি বাবুঘাটের কিছু দক্ষিণে, অর্থাৎ যে স্থানে পূর্ব্বে আর একবার গমন করিয়াছিলেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, সর্দ্দারদ্বয় ও সাহেবের বড় বাবু সেই স্থানে উপস্থিত আছেন। 

গোবিন্দ বাবুকে দেখিয়া বড়বাবু কহিলেন, “আপনার হিসাব আমি ঠিক করিয়া রাখিয়াছি। একটু অপেক্ষা করুন, সাহেব আসিলে তাঁহার অনুমতি লইয়া সেই টাকা আমি আপনাকে প্রদান করিব। 

“গত সপ্তাহে সোমবারে একদিবস আপনার কাৰ্য্য হইয়াছে। শনিবাবে দিবারাত্রি চল্লিশজন কুলি দিয়াছিলেন, তাহাদিগের প্রত্যেকর মজুরি বার আনা হিসাবে ত্রিশ টাকা হইতেছে এবং সেই দিবস রাত্রিকালে আপনার পঁচিশজন কুলি এখানে কার্য্য করিয়াছে, তাহাদিগের মজুরি প্রত্যেকের দেড় টাকা হিসাবে সাড়ে সাঁইত্রিশ টাকা হইতেছে। সুতরাং গত সপ্তাহে আপনার কেবলমাত্র সাড়ে সাতষট্টি কাৰ্য্য হইয়াছে।” 

বড় বাবুর সহিত গোবিন্দ বাবুর যখন এরূপ কথাবার্তা হইতেছে, সেই সময়ে একজন সর্দ্দার কহিল, “মহাশয়! ওই সাহেব আসিতেছেন।” এই কথা শুনিয়া সকলেই গঙ্গার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। দেখিলেন, একখানি ডিঙি করিয়া প্রকৃতই সাহেব সেই দিকে আগমন করিতেছেন। দেখিতে দেখিতে সাহেব ডিঙ্গি হইতে অবতরণ করিয়া সেই দিকে আগমন করিলেন, এবং বড় বাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “যে সকল কন্ট্রাক্টার গত সপ্তাহে কার্য্য করিয়াছিল, তাহাদিগের সকলকে হিসাব অনুযায়ী টাকা প্রদান করা হইয়াছে কি?” 

উত্তরে বড় বাবু কহিলেন, “সকলেই আসিয়া তাঁহাদিগের টাকা লইয়া গিয়াছেন। কেবল গোবিন্দ বাবু দেরি করিয়া আসিয়াছেন বলিয়া, তাঁহাদিগের সহিত একত্র টাকা লইয়া চলিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার টাকা এখনও দেওয়া হয় নাই।” 

“হিসাবে উঁহার কত টাকা পাওনা হইয়াছে?” 

“সাড়ে সাতষট্টি টাকা।”

‘সেই টাকা উঁহাকে এখনই প্রদান করেন এবং বলিয়া দেও, আগামী সপ্তাহে যেন একটু সকাল সকাল আসেন। কারণ, সকলের টাকা একবারে প্রদান করিতে পারিলে, আমার কার্য্যের একটু সুবিধা হয়।” 

এই বলিয়া সাহেব সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। বড় বাবু নগদ সাড়ে সাতষট্টি টাকা গোবিন্দ বাবুর হস্তে প্রদান করিলেন। 

পাঠকগণ অনায়াসেই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, এই কাৰ্য্য উপলক্ষে গোবিন্দবাবু এ পর্যন্ত মোট এক শত ত্রিশ টাকা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে সাড়ে সাতষট্টি টাকা অদ্য প্রাপ্ত হইলেন। সেই টাকা লইয়া গোবিন্দ বাবু একটু দূরে গমন করিলে, সর্দ্দারদ্বয় ও তাঁহার নিকট উপস্থিত হইল এবং গোবিন্দ বাবুকে কহিল, “গত সপ্তাহের হিসাব যখন সাহেব মিটাইয়া দিলেন, তখন এই সঙ্গে আমাদিগের হিসাবটাও মিটিয়া গেলে হয় না?”

গোবিন্দ বাবু তাহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া গত সপ্তাহের হিসাব এইরূপে মিটাইয়া ফেলিলেন। গত সপ্তাহের খরচ লোহার হুক খরিদ দশ টাকা, ও শনিবারের কুলিগণকে দেওয়া যায়, দুই দফায় পঁয়তাল্লিশ টাকা, মোট পঞ্চান্ন টাকা। সাহেবের নিকট হইতে পাওয়া গেল, সাড়ে সাতষট্টি টাকা। গোবিন্দ বাবুর দুই অংশে আট টাকা সাড়ে পাঁচ আনা, সর্দ্দারদ্বয়ের এক অংশে চারি টাকা আড়াই আনা। এই বলিয়া চারি টাকা আড়াই আনা গোবিন্দ বাবু সদারদ্বয়ের হস্তে প্রদান করিলেন। সদারদ্বয় সবিশেষ সন্তুষ্ট মনে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। গোবিন্দ বাবুও আপন লাভের টাকা, আট টাকা সাড়ে পাঁচ আনা লইয়া মনের আনন্দে আপন স্থানে গমন করিলেন। যাইবার সময় মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, এইভাবে যদি কিছু দিবস কাৰ্য্য চালাইতে পারেন, তাহা হইলেই অনায়াসেই তিনি বেশ দশ টাকার সংস্থান করিতে সমর্থ হইবেন। 

পরদিবস প্রাতঃকালে সদারদ্বয় গোবিন্দ বাবুর নিকট গিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, গত কল্য দিবাভাগে আমরা এক শত পঞ্চাশজন কুলি প্রদান করিয়াছিলাম, এবং রাত্রিকালে এক শত কুলি কার্য্য করিয়াছে।” এই বলিয়া সেই দিবস গোবিন্দ বাবুর নিকট হইতে এক শত পঁচাত্তর টাকা লইয়া আসিল। 

যে সময় সদ্দারদ্বয় এক শত পঁচাত্তর টাকা লইয়া গমন করে, সেই সময় গোবিন্দ বাবু তাহাদিগকে কহিলেন, “আমরা প্রত্যহ যে সকল কুলি সরবরাহ করিতেছি, তাহারা কিরূপ কার্য্য করে, তাহা দেখিতে আমি ইচ্ছা করি।” 

১ম সর্দ্দার। কার্য-কর্ম্মের সহিত আমাদিগের কিছুমাত্র সংস্রব নাই, বা তাহারা কায করুক, বা না করুক, তাহা দেখিবারও আমাদিগের প্রয়োজন নাই। সাহেবের আদেশমত আমরা যে সকল কুলি আনিয়া দিব, সাহেব নিজে বা তাঁহার বড় বাবু, অথবা তাঁহার সরকার, যে কেহ একজন সেই সকল কুলি আমাদিগের নিকট হইতে গণিয়া লইয়া, আমাদিগকে তাহার রসিদ প্রদান করে। তাহার পর, তাহারা কোন কার্য্য করিল, কিনা করিল, তাহার কিছুমাত্র আমাদিগের দেখিবার প্রয়োজন নাই। 

গোবিন্দ। কার্য্যে কোনরূপ তত্ত্বাবধান করিবার আমাদিগের প্রয়োজন নাই, তাহা আমি বুঝিতে পারি। তথাপি তাহারা কিরূপে তাহাদিগের কার্য্য নির্ব্বাহ করে, কেবল তাহাই দেখিবার নিমিত্ত আমার কৌতূহল জন্মিয়াছে, এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি। 

১ম সর্দ্দার। সে উত্তম কথা। আগামী কল্য প্রাতঃকালেই আমাদিগের সহিত গমন করিবেন, আপনি আমাদিগের কুলিগণ কিরূপ ভাবে কার্য্য করিতেছে, তাহা অনায়াসেই দেখিয়া আসিতে পারিবেন। আমি কিন্তু কল্য প্রাতঃকালে আসিতে পারিব না। অপর সর্দ্দার আসিয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাবে। 

গোবিন্দ। আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন কি? আমি নিজেই বাবুঘাটে গিয়া উপস্থিত হইব। 

১ম সর্দ্দার। আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন আছে। কারণ, কল্য প্রাতঃকালে আমাদিগের প্রদত্ত কুলিগণ কোন্ স্থানে ও কোন্ জাহাজে কার্য্য করিতে নিযুক্ত হইবে, তাহা ত আমরা এখন বলিতে পারি না। কল্য কুলিগণ কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইবার পর আমরা জানিতে পারিব, এবং সেই সময় আপনাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত এই দ্বিতীয় সর্দ্দারকে আপনার নিকট পাঠাইয়া দিব। ও আসিয়া আপনাকে যে ঘাটে, বা যে জাহাজে লইয়া যাইবে, আপনি তাহার সহিত যেস্থানে গমন করিবেন, সেই স্থানেই আপনার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে। আমি সেইখানে আপনার অপেক্ষায় থাকিব, আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া কুলিগণের কার্য্য আপনাকে দেখাইয়া দিব। 

এই বলিয়া সদারদ্বয় সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। গোবিন্দ বাবু তাহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, পরদিবস তাঁহার কলিগণের কার্য্য দেখিবার নিমিত্ত তাঁহার সর্দ্দারের সহিত গমন করিতে সম্মত হইলেন। 

পরদিবস যথা সময়ে দ্বিতীয় সর্দ্দার আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং গোবিন্দ বাবুকে সঙ্গে করিয়া কয়লাঘাটে লইয়া গেল। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া, গোবিন্দ বাবু সেই সদারকে কহিলেন, “বাবুঘাটের পরিবর্তে কয়লাঘাটে কেন?” উত্তরে সর্দ্দার কহিল, “আজ আমাদিগের প্রদত্ত সমস্ত কুলি এই স্থানে কার্য্য করিতেছে।” 

এই বলিয়া সদার কয়লাঘাটে একখানি ছোট ডিঙ্গি ভাড়া করিয়া, গোবিন্দ বাবুর সহিত উহাতে আরোহণ করিল, এবং একখানি জাহাজের নাম উল্লেখ করিয়া সেই ডিঙ্গির মাঝিকে কহিল, “আমাদিগকে সেই জাহাজে লইয়া যাও। মাঝি তাহাই করিল, এবং ভাগীরথীর মধ্যস্থলে নঙ্গর করা একখানি জাহাজের নিকটে গিয়া তাহার ডিঙ্গি লাগাইয়া দিল। জাহাজ হইতে একটি কাছির সিঁড়ি ঝুলিতেছিল, সর্দ্দার প্রথমটা সেই সিঁড়ি বাহিয়া জাহাজের উপর উঠিল ও পরিশেষে উপর হইতে গোবিন্দ বাবুকেও উঠিতে কহিল। গোবিন্দবাবু সবিশেষ কষ্টে ও ভয়ে কোনরূপ সেই দড়ি ধরিয়া উপরে উঠিলেন। সর্দ্দার সেই জাহাজের উপর তাঁহাকে এক স্থানে লইয়া গেল। দেখিলেন, সেই স্থানে তাঁহার প্রথম সর্দ্দার দাঁড়াইয়া রহিয়াছে এবং প্রায় দুইশত কুলি সেই জাহাজের ভিতর এক স্থানে কর্ম্ম করিতেছে। প্রথম সর্দ্দার গোবিন্দ বাবুকে দেখিবামাত্রই তাঁহার নিকট আগমন করিল, এবং সেই সকল কুলিকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, “এই জাহাজে এখন যত কুলি দেখিতেছেন, উহার সমস্তই আমাদের প্রদত্ত কুলি। এই জাহাজের উপর ইতিপূর্ব্বে যে সকল বস্তা বোঝাই করা হইয়াছিল, সেই সকল বস্তা এখন ওই সকল কুলি এক স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া উত্তমরূপে সাজাইয়া রাখিতেছে। 

গোবিন্দ বাবু সর্দারের কথা শুনিয়া, অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সেই স্থানে দণ্ডায়মান থাকিয়া, কুলিদিগের কার্য্য দেখিতে লাগিলেন। পরিশেষে প্রথম সর্দ্দারকে সঙ্গে লইয়া সেই দড়ির সিঁড়ি ধরিয়া ধীরে ধীরে আপন ডিঙ্গিতে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন। যে সর্দ্দার তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছিল, সে সেই জাহাজের উপরেই রহিয়া গেল। 

গোবিন্দ বাবু এবং তাঁহার সর্দ্দার তাহাদিগের ডিঙ্গিতে চড়িয়া কিনারার দিকে গমন করিতেছেন, এমন সময় আর একখানি ডিঙ্গিতে পূর্ব্বোক্ত সাহেব, তাঁহার বড় বাবু ও সরকারকে সেই দিকে আসিতে দেখিলেন। সাহেবও উঁহাদিগকে দেখিতে পাইয়া, নিজের ডিঙ্গি গোবিন্দ বাবুর ডিঙ্গির সন্নিকটবর্তী করিয়া লইয়া যাইতে কহিলেন। উভয় ডিঙ্গি সন্নিকটবর্তী হইলে, সাহেব সর্দারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, কুলিগণ উত্তমরূপে কার্য্য করিতেছে ত?” উত্তরে সর্দ্দার কহিল, “কুলিগণ বেশ কাজ করিতেছে, এবং আমাদিগের একজন সর্দ্দারও সেই স্থানে আছে।” উত্তরে সাহেব কহিলেন, “আমিও সেই স্থানে যাইতেছি।” এইরূপ দুই একটি কথা হইতে হইতেই উভয় ডিঙ্গি দূরবর্তী হইয়া পড়িল। 

গোবিন্দ বাবু যে কি অভিপ্রায়ে কুলিগণের কার্য্য দেখিতে চাহিয়াছিলেন, তাহা আমরা অবগত নহি। কিন্তু সেই সকল দেখিয়া তিনি সবিশেষ সন্তুষ্ট মনে আপন গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। 

পাঠকগণকে বোধ হয়, এই স্থানে বলিয়া দিতে হইবে না যে, যে সকল কুলি দেখিয়া, গোবিন্দ বাবু হৃষ্টচিত্তে আপনার গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন, সেই সকল কুলি তাঁহাদিগের প্রদত্ত কুলি নহে। সেই সকল কুলি অপর কোন মহাজনের। গোবিন্দ বাবু ও সদারদ্বয়কে দেখিয়া, সেই সকল কুলি মনে করিল, ইঁহারা হয় ত তাহাদিগের নিয়োগকারীর প্রেরিত লোক। তাহারা কিরূপ কার্য্য করিতেছে, তাহাই দেখিবার নিমিত্তে গমন করিয়াছেন। এদিকে গোবিন্দবাবু মনে করিলেন, সেই সকল কুলি তাঁহাদিগেরই প্রদত্ত। 

সেই দিবস সন্ধ্যার সময় সর্দ্দারদ্বয় পুনরায় গোবিন্দ বাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইল, এবং যে পরিমিত কুলি দিবাভাগে কার্য্য করিবার নিমিত্ত নিযুক্ত করা হইয়াছে বলিয়াছিল, তাহাদিগকে দিবার ভানে আরও কিছু টাকা সেই দিবস তাঁহার নিকট হইতে গ্রহণ করিল। 

এইরূপে দ্বিতীয় রবিবার পর্যন্ত প্রত্যহ গোবিন্দ বাবুর নিকট হইতে টাকা আনিতে লাগিল, প্রত্যহ সেই সকল কুলি খাতায় লিখাইয়া আনিয়া তাঁহাকে দেখাইতে লাগিল। এইরূপে ক্রমে ক্রমে এক শত দুই শত করিয়া সোমবারের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার টাকা গোবিন্দ বাবুর নিকট হইতে গ্রহণ করিল। সোমবারের প্রাতঃকালে পুনরায় সাহেবের সহিত হিসাব করিবার নিমিত্ত, সেই হাতচিঠা গোবিন্দ বাবুর নিকট হইতে লইয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল, “টাকা আনিবার নিমিত্ত আপনি সে দিবস যে সময় গমন করিয়াছিলেন, অদ্য তাহার কিছু পূর্ব্বে সেই স্থানে গমন করিবেন। আমরা হিসাব ঠিক করিয়া রাখিয়া দিব, আপনি গমন করিবামাত্রই টাকা লইয়া আসিতে পারিবেন।” 

গোবিন্দ বাবুও তাহাই করিলেন। সোমবারে সকাল সকাল আহারাদি করিয়া, তিনি পুনরায় বাবুঘাটে গমন করিলেন। যাইবার সময় মনে মনে হিসাব করিয়া দেখিলেন, তাঁহার কত টাকা পাওনা হইয়াছে। হিসাব করিয়া বুঝিলেন যে, এক সপ্তাহে দিবাভাগে কার্য্য করিয়াছে—দুই হাজার কুলি; তাহাদিগকে দিতে হইয়াছে, এক হাজার টাকা। পাইবেন, এক হাজার পাঁচ শত টাকা। রাত্রিকালে কার্য্য করিয়াছে, এক হাজার পাঁচশত কুলি তাহাদিগকে দিতে হইয়াছে, এক হাজার পাঁচ শত টাকা। দুই হাজার দুইশত পঞ্চাশ টাকা। অর্থাৎ মোট তিনি ঘর হইতে প্রদান করিয়াছেন, দুই হাজার পাঁচ শত টাকা। পাইবেন তিন হাজার সাত শত পঞ্চাশ টাকা। এক সপ্তাহে লাভ হইবে, এক হাজার দুই শত পঞ্চাশ টাকা। এইরূপ ভাবে কিছুদিবস কাৰ্য্য চলিলে তিনি বড় মানুষ হইয়া যাইবেন। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে তিনি বাবুঘাটের সেই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু আজ আর তিনি কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। বড় বাবু আর সেখানে নাই, সাহেব আর সেই স্থানে আসিলেন না, সর্দ্দারদ্বয়েরও আর দেখা পাইলেন না। এইরূপে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই স্থানে বসিয়া বসিয়া চলিয়া আসিলেন। ভাবিলেন, তবে কি আমি জুয়াচোরের হস্তে পড়িলাম। জুয়াচোরগণ এইরূপ জুয়াচুরি করিয়া কি, আমার নিকট হইতে আড়াই হাজার টাকা গ্রহণ করিল!! 

পরদিবস অতি প্রত্যূষে তিনি পুনরায় সেই স্থানে গমন করিলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই স্থানে বসিয়া রহিলেন। কিন্তু সেই সকল ব্যক্তির মধ্যে কাহাকেও আর তিনি দেখিতে পাইলেন না, বা সদারদ্বয়ও আর তাঁহার বাড়ীতে আসিল না। তিনি যে জুয়াচোরগণের হস্তে সবিশেষরূপে প্রতারিত হইয়াছেন, ইহা বেশ বুঝিতে পারিয়া পুলিসের সাহায্য গ্রহণ করিবার মানসে, তিনি একটি থানায় গমন করিলেন। থানার ইনস্পেক্টার সাহেব তাঁহার নালিশ লিখিয়া লইলেন মাত্র। কিন্তু কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া, গোবিন্দ বাবুকে কোনরূপ সাহায্য করিতে পারিলেন না। কারণ, আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় জুয়াচুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে পুলিসের কোনরূপ ক্ষমতা ছিল না। গোবিন্দ বাবু মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট গিয়াও তাহার কোনরূপ অনুসন্ধানের চেষ্টা করিতে পারিলেন না। কারণ, তিনি কাহার উপর নির্ভর করিবেন? সেই জুয়াচোরগণের কাহারও প্রকৃত নাম তিনি জানিতেন না, বা তাহাদিগের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি কোথায় থাকে, তাহাও তিনি সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়াছিলেন না। কাজেই কোন প্রকারে ইহার কোনরূপ প্রতিবিধান করিতে পারিলেন না। কেবলমাত্র আপন বুদ্ধির নিন্দা করিয়া মনের কষ্টে দিনযাপন ও অন্য উপায়ে উপার্জ্জন করিয়া ঋণ পরিশোধ করিতে লাগিলেন। 

উপসংহার 

এই জুয়াচুরি ঘটিত প্রবন্ধ লিখিয়া মুদ্রাঙ্কনের নিমিত্ত আমি প্রদান করিয়াছি এবং সেই স্থানে উহা মুদ্রিত হইতেছে, এইরূপ সময়ে ঠিক এইরূপ একটি নালিশ আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। যিনি প্রতারিত হইয়াছিলেন, তিনি আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে, তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া, আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, এই প্রবন্ধে জুয়াচুরির বিষয় যেরূপ বর্ণিত আছে, তিনি প্রায় সেইরূপেই প্রতারিত হইয়াছেন। কিন্তু অর্থটা তত অধিক নহে, কেবল সাত শত পঞ্চাশ টাকামাত্র। অর্থ অধিক না হইলেও, যে ব্যক্তি প্রতারিত হইয়াছেন, তাঁহার পক্ষে সেই অর্থই যথেষ্ট। 

যে সময় এই নালিশ আনিয়া আমার নিকট উপস্থিত হয়, তাহার কিছুদিবস পূর্ব্ব হইতেই পূর্ব্ব আইন পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। যে সকল জুয়াচুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা আমাদিগের ছিল না, নূতন আইনের বলে সেই সকল মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা আমাদিগকে সম্পূর্ণরূপে প্রদত্ত হইয়াছে। সুতরাং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমি প্রবৃত্ত হইলাম। অনুসন্ধান করিয়া, উভয় সর্দ্দারের প্রকৃত নাম জানিতে পারিলাম। সাহেব, তাহার বড় বাবু এবং তাহার সরকারের নাম ও ঠিকানা অনুসন্ধানে অবগত হইলাম। কিন্তু তাহাদিগের কাহাকেও পাওয়া গেল না। আমরা তাহাদিগের বাড়ীতে গমন করিবার পূর্ব্বে তাহারা আপন আপন বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। একমাসকাল অনবরত পরিশ্রম করিয়া, কেবল যে ব্যক্তি প্রধান সর্দ্দার পরিচয়ে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, কেবল তাহাকেই ধৃত করিতে সমর্থ হইয়াছি। ইতিপূর্ব্বে এইরূপ অপরাধের নিমিত্ত সে দুই একবার শ্রীঘরেও বাস করিয়া আসিয়াছিল। 

প্রধান সর্দ্দারের বিচার এখনও শেষ হয় নাই, সে এখন হাজত-গৃহে বাস করিতেছে। অপরাপর আসামীগণের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে। উহারাও যে শীঘ্র ধৃত হইবে, সে বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *