দুঃস্বপ্ন

দুঃস্বপ্ন – উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

এক

তবে তুমি এখানে দাঁড়াও আমি দেখছি ভিতরে কেউ আছে কিনা!

সোমা দাঁড়িয়ে থাকল। মনীষ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সে উঠে যাচ্ছে। সোমা তাকে উঠে যেতে দেখছে। সিঁড়ির বাঁকে মনীষ হারিয়ে গেলে সোমা সংস্কৃত কলেজের পাশে সেই পুরনো বইয়ের দোকানগুলো দেখল। এখানে সে নানাভাবে এসেছে। মনীষের সঙ্গে সামনের দেবদারু গাছটার নিচেই প্রথম আলাপ হয়েছিল।

এখানে এসে সেই প্রথম আলাপের দিনক্ষণগুলো কেমন মনে পড়ে গেল। বিয়ের পর সে যে এখানে দু—একবার আসেনি তা নয়, এসেছে। প্রথম বেশ কয়েকবারই এসেছে। কিন্তু এলেই সে দেখেছে বন্ধুবান্ধবদের আর আগের কৌতূহল সোমা সম্পর্কে আদৌ নেই। সে ওটা চাইছেও না। তবু মনে হয়েছে কেন জানি মনীষকে বিয়ে করার পর সব পুরুষবন্ধুদের কাছে তার দাম কমে গেছে। সেজন্য পরে আর এদিকে মাড়ায়নি সোমা। বরং মনীষই গিয়ে মাঝে মাঝে খবর নিয়েছে সবার।

তখনই মনে হল পিছন থেকে কে ডাকছে। সে তাকাল। মনীষ নয়। ওর অন্য চেনা পুরুষবন্ধু। বলল, এসো সোমা।

ও কোথায়?

বসে গেছে। আমি তোমাকে নিতে এলাম।

তুমি কেমন আছ?

ভালো। তুমি?

ভালো। তবে মাঝে মাঝে তোমাদের কথা মনে হলে খুব এখানে আসতে ইচ্ছা করে।

হয়েছে থাক। কী করছ বল?

কী আর করব। বাড়িতে আর বসে থাকতেও পারি না। ও অফিস চলে গেলে একা একা ভালো লাগে না বলে কলেজে একটা কাজ নিয়েছি।

ভালো করেছ। যা দিনকাল পড়েছে!

সোমা ওপরে উঠে দেখল জাঁকিয়ে বসে গেছে মনীষ। যেন সে এখানে একাই এসেছে। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। সোমা যে ঢুকল সে তা পর্যন্ত টের পায়নি। হা হা করে কী কথায় হাসছে। সোমা কাছে যেতেই বলল, এতগুলো অকালকুষ্মাণ্ড একসঙ্গে বসে আছে দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না সোমা। বসে গেলাম। তুমি বসো। এই বিনু একটা চেয়ার এনে দে তোর বৌদিকে। এতদিন পর আমরা এসেছি, সোমার নামে কিছু আজ সেলিব্রেশান হোক।

বিনু সোমার সহপাঠী ছিল। সে সোমাকে, সোমা বলে ডাকত। তুই—তুকারি করত। সোমা এই বছর চারেকের ভিতর সামান্য ভারী হয়েছে। এবং চুল সে সবসময়ই শ্যাম্পু করত। চোখ খুব টানা, তার ওপর সোমার ভারি বদ স্বভাব ছিল, সে এলেই খুব একটা জাঁকজমক করে আসত না। খুব সাদাসিদে পোশাক, যেন সে ঘরেই ছিল পথ ভুল করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে নেমে এসেছে। বিনু কতদিন বলেছে, এই সোমা শোন, তুই একদিন চোখে কাজল টেনে আয় না। তোকে ভালো করে দেখি।

নিমেষে বিনুর সে সব কথা মনে পড়ে গেল। এবং মনীষ যেহেতু ওর সমবয়সি ছাত্র এবং সহপাঠী, সে তার চোখে—মুখে কোনো পূর্বস্মৃতি ধরা পড়ুক তা চাইল না। খুব হয়েছে। শালা তুমি তো খুব এখন সাঁতার কাটছ আর আমি চেয়ার টেনে মরব এমন বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বলতে পারল না। সে একটা টিনের চেয়ার টেনে নিল। অন্য চেয়ারে নানারকমের মানুষ বসে গেছে। ওর ইচ্ছা ছিল না সোমা একটা সামান্য টিনের চেয়ারে বসুক। সে নিজে উঠে যাবার সময়ই বলে গেল, তুই বস সোমা। আমি নিয়ে আসছি। সোমা বিনুর দিকে তাকাল। কেমন আছিস?

তুই?

খুব ভালো।

আমরা ভালো নেই।

কেন কী হয়েছে? ভালো নেই কেন? একটা বিয়ে করে ফেল।

কী সময় পড়েছে! এ—সময়ে কেউ বিয়ে করে!

সুধীর বলল, এখন বিয়ে বিয়ে ভাল্লাগে না! কে আজ সেলিব্রেট করছে বল?

বিনু বলল, আমার পকেটে ভাই পয়সা নেই।

অশোক বলল, তোর পকেটে কোনদিন পয়সা থাকে?

বিনু বলল, না থাকলে কী করব।

সোমা বলল, তোমরা বিনুকে চটিও না। বরং আমি তোমাদের সবাইকে আমার নামে সেলিব্রেট করছি।

মনীষ বলল, হল! বললাম তোদের আজ কিছু খসাব, এখন শালা উলটো চাপ।

কী হচ্ছে! শালা শব্দ মনীষ উচ্চারণ করায় সোমার যেন সম্মানে লেগেছে। না মাইরি বিনু, এখন আর আমাদের—স্বাধীনতা নেই।

আমাদের বলছিস কেন? বল তোর নেই। একটু খিস্তি—খেউড় করলে সোমা, মানুষ ছোট হয়ে যায় না। কেমন গম্ভীর গলায় বিনু এমন বলল।

তাই বুঝি।

সুধীর ডাকল, এই আবদুল, আজ স্পেশাল কী আছে রে?

চিকেন প্যাটিস, চিলি চিকেন।

ওসব চিলি ফিলি চলবে না? মনীষ তুমি কী খাবে। সোমা শীতকাল বলে একটা মেরুন রঙের চাদর গায়ে দিয়েছে। এবং চাদরে ওর মুখের অর্ধেকটা ঢাকা। সে যখন কথা বলে চাদরটা নামিয়ে নেয়। বিনুর এসব সহ্য হচ্ছে না। অশোকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সোমা কোনো কথা বলছে না। সে একবার রেস্তোরাঁতে সোমাকে খাওয়াবে বলে নিয়ে গিয়ে অযথা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কী সব করতে চেয়েছিল, পারেনি। সেই থেকে সে অশোকের সঙ্গে দেখা হলে বেশি কথা বলত না। বিয়ের পর বন্ধ করেই দিয়েছিল। এখানে ওর যতটুকু অসুবিধা হচ্ছে এই মানুষের জন্য। কিন্তু অশোকই প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মনীষের সঙ্গে। এবং অশোক মনীষের খুব বন্ধু লোক। তবে এই যে রক্ষে, অশোক কখনও বন্ধুত্বের দাবিতে ওর বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেনি। কেন জানি আজ অনেক দিন পর সোমার সবার সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করতে ইচ্ছে হল।

সোমা বলল, অশোক তুমি কী খাবে?

সে কেমন উদাসীন গলায় বলল, বল কিছু একটা।

কেন, তুমি বলতে পার না? সোমা পুরনো জলছবি মুছে দেবার চেষ্টা করছিল। অশোকই সহসা বলল, তোমরা হঠাৎ? তুমি তো এখন বড়মানুষের বউ।

একটা শো দেখতে এসেছিলাম। অনেকদিন পরে আসা, তাই ও বলল, দেখি আমাদের পুরনো বন্ধুবান্ধব কে আর এখন এখানে আসছে। সে অশোকের কথা গায়ে মাখল না।

ভালো করেছ এসে, অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম।

অশোক কী ওর সেই বিসদৃশ ঘটনা এখন বেমালুম ভুলে গেছে! ওর তো এখন শুধু সেই ঘটনার কথাই মনে হবার কথা। সোমা আজ অশোকের ওপর আর রাগ পুষে রাখেনি। কারণ সে দেখেছে মেলামেশার সুযোগে কেউ একটু বেশি চালাকি করে ভালোবাসা করে, কেউ কম। অশোককে সোমার এখন বরং বোকাই মনে হয়। বলে কয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা অশোকের ছিল না। অশোকের সহিষ্ণুতা ছিল না। ধুম—ধাড়াক্কা সে কিছু না বলেই সবটা করতে চেয়েছিল। তাকে সেদিন সোমার ইতর এবং ফাজিল মনে হয়েছিল। বলেছিল অশোক তুমি এমন ইতর, নীচ, জানতাম না।

অশোক সেদিন কিছু বলেনি। সে মাথা নিচু করে বসে ছিল। একটা কথাও বলেনি। সোমা খাবার ফেলে চলে এসেছিল। বিয়ের পর সে বুঝেছে মনীষও এটাই চেয়েছে। মনীষ ভালোবাসার ব্যাপারে শুধু সহিষ্ণুতা বেশি।

বিনু বলল, তা হলে অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।

সুধীর সোমার দিকে তাকাল।

ভয় নেই। যতটা খুশি দিতে পার।

সবাই এবার নড়েচড়ে বসল। মনীষ সবার বড় এমন একটা ভারিক্কি চালে বসে রয়েছে। কারণ এই চারজনের ভিতর সে—ই মোটামুটি এই ভালোবাসার ব্যাপারটাতে কী রহস্য আছে সব জেনে ফেলেছে। সে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, রমেশ দিল্লিতে বড় একটা চাকরি নিয়ে চলে গেছে।

ও শালা কেরিয়ারিস্ট। ওর কথা তুলে আর আমাদের এমন ভালো দিনটা মাটি করে দিস না মনীষ। সুধীর এটুকু বলে কী বলবে ভেবে একবার সোমার দিকে তাকাল, পরে মনীষের দিকে। ওর যেন মনীষকেই কিছু আঘাত দিতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা হচ্ছে মামার দৌলতে তুমিও কম যাও না। কিন্তু সোমা সহসা একসঙ্গে এতটাকা খরচ করতে রাজি হয়েছে, এমন একটা খাবার টেবিলে আর হোস্টকে বিব্রত করে লাভ নেই। সে বলল, তুই নিতাইয়ের খবর জানিস?

না।

সে আত্মহত্যা করেছে।

বলিস কি!

সোমা বলল, আত্মহত্যা কেন?

আত্মহত্যা কেন সে তো সে বলতে পারবে।

এমন মানুষ কখনও আত্মহত্যা করতে পারে!

পারে। সব পারে, মনীষ খুব উদাসীন গলায় বলল।

সোমা বলল, ও তো কাজলকে বিয়ে করেছিল না?

একটা ছেলেও হয়েছে। বিনু বলল।

আহা রে! সোমার মুখটা যথার্থ খুব উদ্বিগ্ন দেখাল।

অশোকের এ—সব মৃত্যু—ফিত্যুর কথা শুনতে আদৌ ভালো লাগে না। চারিদিকে এখন অরাজকতা, রোজ মানুষ খুন হচ্ছে, বারাসতে এগারো জন, সকালে উঠেই এসব দেখতে দেখতে সে ভিতরে বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে থাকে। এখানে সারাদিন পর আসা একটু রিলিফের জন্য। বাড়িতে একগাদা ভাই—বোন। সে স্কুলে যতক্ষণ থাকে শান্তি, এখন আবার সে স্কুলও কর্তৃপক্ষ রোজ রোজ বোমাবাজির জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। কী করে যে দিনটা কাটে তার! সে বলল, স্রেফ আমরা খাব আর সুখের গল্প করব। এত দুঃখ চারিদিকে যে তাকানো যায় না। এখানে এসেও যদি তোমরা আত্মহত্যা—ফত্যা নিয়ে কথা চালাচালি কর—তো উঠে যাব।

ঠিক আছে বোস। মনীষ বলল। কেউ আর এ নিয়ে আলোচনা করবে না। তুই কি এখনও সেই জে.এন.অ্যাকাডেমিতেই আছিস?

কী করব ভাই। চেষ্টা তো করলাম। সুরেন্দ্রনাথে নাইটে একটা পার্ট টাইম হবার কথা ছিল। সে পর্যন্ত হল না। ওরা এইসব আন্দোলনের একটা কিনারা না হলে কিছু করছে না।

অশোককে দেখলেই মনে হয়, সে স্কুলের শিক্ষক বলে কেমন এখনও একটু মনমরা হয়ে আছে। আর সবাই কলকাতার কাছাকাছি কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। সে কোনো কলেজে কিছু করে উঠতে পারল না।

সোমা বলল, তাহলে অশোক তুমি একটা জায়গায় আছ?

অশোক বলল, তা আছি। কখন প্রাণটা যায়। তোমাদের কলেজে কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে না?

হচ্ছে না আবার! পরীক্ষা বন্ধ। বড়দি দুবার চেষ্টা করতে গিয়ে ভীষণ নাজেহাল হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি পারবেন না। কর্তৃপক্ষ স্কুলে পুলিশ পাহারা দেবে বলেছিল। তিনি রাজি হননি।

যা চলেছে!

আমরা কিন্তু আবার সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছি। মনীষ সবাইকে মনে করিয়ে দিল।

বিনু বলল, আমি, সোমা তোকে একটা অনুরোধ করব। রাখবি?

কী অনুরোধ? বলে সোমা মুখ থেকে চাদর নামিয়ে দিল। বিনু এতক্ষণ পর ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। বড় সুন্দর ঢলঢলে মুখ। বলল, তুই চোখে কোনোদিন কাজল দিলি না।

ও, সেই কথা?

না, সে কথা নয়। সেই গানটা গাইবি গুনগুন করে, আমরা সবাই শুনব।

কোন গানটা?

এখন নিজের ছায়ায় রচিছে কত মালা…। বড় ভালো লাগত এ—গানটা।

এটা কী গান গাইবার জায়গা?

তোকে জোরে জোরে গাইতে বলছি না। গুনগুন করে গাইবি। আমরা চুপচাপ কান পেতে শুনব।

বাড়িতে আয় না! কত গান শুনতে পারিস দেখব।

সে যাব’খন একদিন।

হয়েছে। কতবার বলেছিস, যাবি। কোনোদিন গেলি না।

যাব এবার ঠিক যাব। গাইবি?

না। এখানে গান গাওয়া যায় না।

মনীষ তুই বলে দেখ না।

তোর কথাই শুনছে না, আর আমার কথা শুনবে?

আবদুল জল রেখে গেল। বিনু অপলক দেখছে সোমাকে। ওর অনুরোধ রাখল না বলে কেমন দুঃখী মুখ নিয়ে বসে রয়েছে। মনীষ সে দুঃখ দেখে বলল, সোমা তুমি গেয়ে শোনাও না গানটা। তা না হলে, আবার একটা আত্মহত্যার খবরপাবে। পুলিশ ধরতেই পারবে না কেন সে আত্মহত্যা করল। মনীষ ব্যবহারে সব সময় ওদের খুব কাছাকাছি আসতে চাইল।

সোমা বলল, কী বাজে বকছ!

দেখলি তো আমাকে ও কী চোখে দেখে!

বিনু বলল, আমি সত্যি আত্মহত্যা করব সোমা। আমি লিখে রাখব, এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী সোমা। বালিশের তলায় রেখে গেলে দেখবে কেমন মজা।

ও বাবা, দরকার নেই, আমি গেয়ে শোনাচ্ছি। সে দু’বার গলা সাফ করে বলল, আচ্ছা তোমরা কী! একটা সময় অসময় নেই? তোমরা কী সবাই পাগল?

এখন খুব সময় অসময় দেখানো হচ্ছে। আগে তো, এই সোমা গা না, ব্যাস, গান আরম্ভ হয়ে গেল। টেবিলে তাল দিচ্ছে নিশীথ। তোমার নিশীথকে মনে পড়ে সোমা?

খুব।

সে বেটা এখন কৃষ্ণনগরে পোলট্রি করেছে।

এই না সে বলত, আমেরিকায় যাবে ডক্টরেট করতে?

কেন, করেছে তো। পোলট্রিতে। নানা জাতের মুরগি ব্রিডিং করাচ্ছে। সুধীর জলের গেলাসগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে এমন বলল। বেটা সারাজীবন হাঁস—মুরগি ব্রিডিং করল। নিজের কিছু হল না।

কার কী হয়েছে? তোমরা বাদে কে কী ব্রিডিং করতে পারছে?

সোমা বলল, আমরা কিন্তু টেবিল ম্যানার্স মানছি না।

সুধীর বলল, আমরা ভুলেই গেছিলাম এখানে একজন মহিলা বসে আছেন। এবং তিনি আমাদের বন্ধুপত্নী।

বিনু বলল, সুধীর তোর মুখ বড্ড আলগা। আজ ক’টা উইকেট ডাউন রে?

সোমা বিনুর এমন কথায় নিজেকে খুব সেকেলে ভাবল।

শীত আরম্ভ হয়ে গেছে। এ—বছর বিদেশ থেকে কোনো টিম খেলতে আসছে না।

পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ে। রঞ্জি ট্রফি আরম্ভ হতে অনেক দেরি। হয়তো ইংল্যান্ড—অস্ট্রেলিয়ার খেলার কথা বলছে। কিন্তু সে যতটা জানে খেলা আরম্ভ হতে আরও সপ্তাহখানেক বাকি।

সুধীর বলল, আজকের খবর জানি না।

অশোক বলল, শুনেছি শোভাবাজারে সকালের দিকে ওয়ান উইকেট ডাউন খেলা চলছে।

কারা খেলছে?

বলা নিরাপদ তো? বলে সে চারিদিকে তাকল। যা আজকাল দিন যাচ্ছে।

সোমা খুব উদ্বিগ্ন মুখে তাকাল। বলল, কেন কী হয়েছে? বল না শুনি।

ভাই আমার চোখে দেখা নয়। শোনা। চিৎপুরে ট্রাম—বাস বন্ধ।

সোমা এবার বুঝতে পারল। কোন পার্টি কার বিরুদ্ধে খেলছে আজকাল সে—সব আর খুলে কেউ বলতে চায় না। মনীষ এমন লক্ষ্মীছাড়া দেশের যে কী হবে ভেবে মুখ উদাস করে রাখল।

আবদুল খাবার রেখে গেছে। ওরা চিকেন—প্যাটিস এবং ক্রিম কফি খাচ্ছে। তখনই মনে হল সোমার, কয়েকটা টেবিল পার হলে একটা গোলাকার টেবিলে চার পাঁচজন খুব নিভৃতে কী যেন আলাপ করছে। এবং সবচেয়ে উঁচু লম্বা যে মানুষটি ওর দিকে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে, সোমার মনে হল মানুষটাকে সে কোথাও দেখেছে এবং খুব চেনা। অথচ সে মনে করতে পারছে না সে কে। কোথায় কীভাবে আলাপ। সোমা একটুকরো প্যাটিস মুখে দিতে দিতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

এ—জায়গা খুব পরিচিত জায়গা। অন্যত্র হলে সোমা ভয় পেত। বারবার ফিরে ফিরে তাকানো ওকে কেমন বিব্রত করে তুলছে। এবং কিছুটা চুরি করে দেখার মতো ভাব চোখে। সোমাও যতটা পারছিল সবার অলক্ষ্যে মাঝে মাঝে সেদিকে তাকাচ্ছে। এবং সেই চোখ যা তাকে কোনো দূরাগত স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে চাইছে।

বিনু বলল, আমাদের কিন্তু সেই গানটা এখনও শোনা হল না।

সোমা বলল, আমার ভালো লাগছে না। সোমার চোখ—মুখে এমন মায়া মাখানো যে বিনু আর ওকে অনুরোধ করতে পারল না। শুধু বলল, সোমা, আমরা বেশিদিন আমাদের মুক্ত জীবনকে ধরে রাখতে পারি না।

অশোক বলল এই আরম্ভ হয়ে গেল নীতিবাক্য।

না রে নীতিবাক্য নয়। ভেবে দেখ তো কী সুন্দর ছিল সেইসব দিনগুলো।

সোমা বলল, আমরা যে যার বাড়ি থেকে কত মিথ্যা কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য বের হয়ে গেছি। রোদ জল ঝড় মানিনি। ফিরতে রাত হয়ে গেছে। মাকে একবার সাপ্টে ধরে গালে চুমু খেলেই মা—র রাগ সব জল! কী বাবা দস্যি মেয়ে, মা বলত। একবার মনে আছে মনীষ, তোমরা আমাকে ম্যাড হাউসে নিয়ে গিয়েছিলে। জোর করে প্রথম এক পেগ জিন খাওয়ালে লাইমজুস দিয়ে, কী আমার ভয়, কিন্তু বাড়ি গিয়ে স্রেফ বলে দিলাম, মাথা ধরেছে কিছু খাব না। পার পেয়ে গেলাম। বেশ স্বপ্নের মতো মনে হয় দিনগুলো।

তা মনে হবে না কেন? মনীষ বলল, চারপাশে বন্ধুজন, বান্ধবী এবং উড়ে বেড়ানো। মেয়েদের তো ঐ স্বভাব, মধুটি খাব, কাঁটার ঘা—টি খাব না।

বাজে বকো না, সোমা এমন ভর্ৎসনার সুরে বলল। কেবল মেয়েদের বেলায় এটা খাটে না। তোমরাও কম যাও না বাপু। বলেই সোমা তাকাল দূরের টেবিলে, দেখল মানুষটা তাকে আবার চুরি করে দেখছে।

এখন আমরা উঠব। সোমা বলল।

এত তাড়াতাড়ি?

না রে, দিনকাল বড় খারাপ। আটটা বাজতেই রাস্তা ফাঁকা।

অশোক বলল, কী বই দেখলি?

মহান পরিচালকের বই।

কেমন দেখলি?

মনীষ তাকাল সোমার দিকে। খুব ভালো। সোমা কিছু হয়তো বলবে এ—ব্যাপারে। কারণ সোমার ভালো লাগেনি। ওর বোর করেছে। কিন্তু সোমা কিছু না বলতে সে কেমন উৎসাহ পেয়ে গেল। সে বলল, বোঝা যায় ফিল্মের যে আলাদা একটা ল্যাঙ্গোয়েজ আছে। সে তার নিজগুণেই ভাস্বর।

যা ব্বে? সুধীর কেমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তুই কবে থেকে আবার ফিল্ম ক্রিটিকের কাজ নিলি? শুনেছি তো ক্যাপিটালিস্ট বনে যাবার জন্য দিন—রাত উইকেটে দাঁড়িয়ে বেমক্কা খেলে যাচ্ছিস।

ফিল্ম—ক্রিটিকের কী আছে। তবে সাধারণ দর্শকদের ভালো নাও লাগতে পারে।

ওরা একটা নিটোল গল্প খুঁজতে চায়।

সে গল্পটা বল। সোমা মুচকি হাসল।

মনীষ কিছুতেই বলতে চাইছে না। সে বলল, ওদের কথা বাদ দাও। ওরা এসেছিল খুব একটা মারামারি, অথবা নিটোল প্রেম, কিংবা হত্যা রাহাজানি এসব দেখবে বলে।

তুই এটা কী বলিস! ওঁর মতো পরিচালকের কাছে সেটা কেউ আশা করে না। ওরা নিশ্চয়ই ওঁর ছবি দেখতে ভালোবাসে বলেই এসেছে।

সোমা বলল, বের হয়ে দেখি তিন যুবক আর এক যুবকের কলার চেপে ধরেছে। বলছে, বোঝাও কী দেখলে। একজন বলল, শালা তুমি আমাদের সিডিউস করছ। তুমি না বললে আমরা আসতাম না।

মানে! বিনু বলল।

মানে জানি না। সোমা বলল, দেখলাম, সে আমতা আমতা করে তার তিন বন্ধুকে বোঝাচ্ছে, আজকের দিনের কত বড় সমস্যা তিনি এই সামান্য সময়ের ভিতর তুলে ধরেছেন। প্রায় গীতিকাব্যের শামিল।

এ—ভাবে বই শেষ হয়! আজকের দিনের সমস্যা গীতিকাব্যের মতো!

হয় না?

ধুস শালা! তুমি বোঝ না কিছু, তুমি জান না ওর ডিউপার্ট আছে। ওটা পরে দেখানো হবে। বলে সেই বন্ধুর হাসি নকল করতে চাইল সোমা।

মনীষ সোমার কথায় কেমন ছোট হয়ে গেল। বলল, মুশকিল কী জানিস, এ—দেশের মানুষের একটা স্বভাব আছে, সে স্বভাবটা হচ্ছে যা বুঝি না তাই বোঝার ভান করি।

সোমা বলল, তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে বল।

আমি নিজের দিকে তাকিয়েই বলছি, ফিল্ম ওয়ার্লডে এটা রেভলিউশান।

বিনু বলল, আমি দেখেছি। আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হয়েছে।

মনীষ ব্যাগ খুলে টাকা গুনছিল। সে না তাকিয়েই বলল, কী মনে হয়েছে?

তোমরা ব্লো—আপ দেখেছ কেউ?

অশোক বলল, আমি দেখেছি।

বিনু বলল, বইটা এলে তোমরা সবাই দেখো। তারপর আবার আলোচনায় বসা যাবে।

মনীষ বুঝল বিনু এ—ব্যাপারে আর এগুবে না। বিনু বাজে তর্ক করেও না, করতে ভালোও বাসে না।

মনীষ বলল, তবু তোরা সবাই দেখিস। না দেখলে বড় কিছু একটা মিস করবি।

আবদুল টাকার চেঞ্জ ফিরিয়ে দিল। সে বিশটা পয়সা রেখে বাকি সব তুলে সোমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে এমন ভাবতেই দেখল, দূরের টেবিলে সোমা কাকে দেখছে। প্রায় চুরি করে দেখার মতো।

মনীষের এটা ভালো লাগল না। সোমা যে ধরা পড়ে গেছে সে তার আচরণে এমন কিছু প্রকাশ করল না। সে শুধু বলল, আমরা যাচ্ছি!

দুই

কে এই মানুষ! প্রশ্নটা দুজনের মনেই উঁকি দিয়েছে। সোমার ভিতর নানাভাবে দূরের স্মৃতি উঁকি দিয়ে যাচ্ছে আর মনীষ ভেবেছে সোমা তার কাছে লুকোবার চেষ্টা করছে। টেবিল থেকে উঠে পড়ার সময় সে দেখেছে সোমা এবং সেই মানুষটি কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিল। ধরা পড়ে যাবার ভয়টুকু পর্যন্ত সোমার প্রাণে ছিল না।

ফলে ওরা যখন সিঁড়ি ধরে নামছিল, তখন কেউ কথা বলেনি। চুপচাপ নেমে গেছে। সোমা ভেবেছে মনীষ কথা বলছে না কারণ ওরা পরস্পর ভিন্ন মত পোষণ করছে বই সম্পর্কে। এবং সোমা ওকে ছোট করার জন্য সব বলে দিয়েছে, এমনকি নিজের ভালো না লাগার ব্যাপারও জানিয়ে এসেছে, এসব কারণে মনীষ ওর ওপর রাগ করতে পারে। তবে সে মনীষের এই রাগ অথবা অভিমান মুহূর্তে ভেঙে দিতে পারে, তার হাতে জাদুর কাঠি, সে শুধু দু’দিন শরীর খারাপ যাচ্ছে, কিছু ভালো লাগছে না বলে গলায় র‍্যাপার জড়িয়ে শুয়ে থাকবে। তখনই মনীষের মুখ বড় কাতর। সে কেমন শিশুর মতো মুখ করে রাখে। সে কাছে এসে বসবে। মাথায় হাত বুলাবে। আদর করতে চাইবে। তারপর সেই এক জায়গায় চলে যাওয়া। সে হাত দিতে দিতে যখন জায়গামতো চলে যাবে তখনই বলা—আমার শরীর ভালো নেই, আমি পারব না মনীষ। আমাকে তুমি আর কষ্ট দিও না। এবং তারপরই মনীষের পালা। কী করে এই মেয়ে সোমা যার চোখ বড়, যার লাবণ্য শরীরে বাড়ে দিনে দিনে, যে না হলে তার রাতের জলপান হয় না, সে তৃষ্ণার্ত থাকে। কী নরম আর পুষ্ট বাহু সোমার। সে সোমার শরীরে হাত রাখার জন্য পৃথিবীর যাবতীয় ঐশ্বর্য তখন চুরি করে আনতে পারে। সুতরাং মনীষ যে কথা বলছে না, মনে মনে সোমার ওপর চটে গেছে, সেজন্য তাকে সোমা আদৌ আমল দিল না। সোমা চুপচাপ পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে এবং গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেছে।

বেশ শীতের ঠান্ডা। ক’দিন আগে ঝড়—বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ওরা শীত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। ভিতরে ঠান্ডা ঢুকছে। মনীষ ওপাশের দরজায় কাচ তুলে দিলে। এবং নিজের দিকের কাচ তুলে চুপচাপ একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলল।

হঠাৎ সোমা একটা ওকের মতো তুলে আর একটু সরে বসল। সে জানে এই ওক দেওয়া মনীষকে উদ্বিগ্ন করে তুলবে। সে বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না। সোমা আবার একটু বড় ঢেঁকুর তুলে কেমন কষ্টবোধের ভান করল। এবং সে যেন এখন কিছুই দেখছে না শুধু শহরের ট্রাম—বাস দেখছে। ওদের গাড়ি গড়ের মাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে। বোধহয় শীতের জ্যোৎস্না মাঠে। এমন জ্যোৎস্নায় আর কেউ বুঝি আজকাল এই মাঠে প্রেম করতে আসে না। সোমার ইচ্ছা হল, বলে, আমরা কতবার এসেছি এখানে, গঙ্গার জেটিতে গিয়ে বসেছি। ফোর্ট উইলিয়ামের র‍্যামপার্টে। সে—সব তোমার মনে পড়ে মনীষ? কিন্তু মনীষ উলটোমুখে গাড়ি—ঘোড়া এবং যে—সব বেশ্যা রমণীরা বের হয়েছে মাঠে খদ্দেরের আশায় তাদের দেখছে। সোমা আবার একটা গলা—জ্বালা ছেঁকুর তুলে ভীষণ কষ্টবোধে কাতর হচ্ছে এমন চোখ—মুখ করে রাখল।

মনীষ আর পারল না। তোমার কী প্যাটিস খেয়ে অম্বল হয়েছে?

না।

তবে এমন ঢেঁকুর উঠছে কেন?

কী করে বলব বল?

কোনো কষ্ট হচ্ছে?

বুকটা কেমন করছে।

জ্বালা জ্বালা করছে না তো?

ঠিক জ্বালা জ্বালা না। কেমন ধড়ফড় করছে।

কাল অসিতকে একটা তবে কল দিচ্ছি।

তুমি যে কী না মনীষ! টাকার গাছ আছে তোমার।

শরীর ভালো লাগছে না বলছ। বুক কেমন করছে—

ঠিক হয়ে যাবে।

আবার চুপচাপ। ওরা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকে গেল। বড় সব এমপ্লিফায়ারে গানের সুর ভেসে আসছে। মনীষ বলল, কতদিন আর বড় জলসাতে রাত কাটাই না। চল একদিন আমরা সারারাত গান শুনব।

এই শীতের সময় বড় সামিয়ানার নিচে বসে আলি হোসেনের সানাই অথবা গোলেমালির গান কী মজা! পাশে সোমার মতো মেয়ে বসে থাকবে, চুলে সুন্দর গন্ধ, তসরের বেনারসি পরনে, নীল রঙের ব্লাউজ, আর কপালে বড় সিঁদুরের টিপ চুল টেনে বাঁধা, পায়ে সে কখনও যদি রুপোর চেলি পরে যায় মনীষের মনে হয় রাত নিশীথে সে আর সোমা গানের জলসায় দুই বেহুলা—লক্ষীন্দর। সোমার সুন্দর চোখ দেখলে সে কিছুতেই আর রাগ পুষে রাখতে পারে না।

সোমা বলল, চল এখানেই আজ আমরা বসে যাই।

গেলে ভালো হত, আমরা আবার আমাদের পুরনো দিনগুলো ফিরে পেতাম। বস্তুত এই এক মানুষের রহস্য, কিছুদিন কাছে থাকলে ভিতরের রহস্য মরে যায়। মনীষ বিয়ের আগে সোমাকে দেখবে বলে গাড়ি চালিয়ে সেই দেবদারু গাছটার নিচে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। কী মজা ছিল, কী যে মধুর মনে হত, এখন সে সব তার মনে হয় মরে গেছে। এত কাছে থাকলে শুধু বুঝি শরীরটা থাকে।

সোমা ইচ্ছা করেই নানা কথার ভিতর নিজেকে অন্যমনস্ক হতে দিচ্ছে না। সে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই ধরা পড়ে যাবে বুঝি। সে কে? তাকে সে কোথায় দেখেছে? তার চোখ দেখে মনে হয়েছিল সে কিছু সোমাকে বলতে চায়। তার চারপাশে যে জীবন—প্রবাহ চলেছে, তার থেকে মানুষটা যেন আলাদা।

তার চোখে কী এক ভাষা ছিল, কী এক মাধুর্য ছিল যে কেবল তার অজান্তেই তাকে নদীর পারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

সোমা বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না মনীষ। তুমি কেন যে আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেলে?

কী ঘটেছে?

কী ঘটবে?

তবে তুমি এমন বলছ? মনীষ ইচ্ছা করেই ওর সেই অপলক দেখা এবং মতিবিভ্রম হয়ে যাওয়া খানিক সময়ের জন্য, এড়িয়ে গেল! সোমা নিজে থেকে কিছু না বললে সে—ও কিছু বলছে না। সে যেন ব্যাপারটা জানে না এমন চোখে—মুখে থাকল।

ওরা যেতে যেতে ফুটপাথে অজস্র ভিখারি দেখল। শীতের রাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে সব রাস্তায় সারি সারি শুয়ে আছে। কিছু গাছগাছালি আছে এখানে, কিছু অন্ধকার আছে, ভিতরে মনে হল কোনো পুরুষ রমণী পরস্পর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আর দূরে একটা বাচ্চা ছেলে লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

মনীষ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ননসেন্স! কলকাতায় ভদ্রভাবে মানুষের চলা দায় সোমা।

সোমা বলল, সবাই শরীর বেচে খাচ্ছে। ওদের আর দোষ কী।

তোমার আজ কী হয়েছে সোমা?

কী আবার হবে।

মনীষের কেমন আর্ত গলা শোনা গেল। গাড়িটা আবার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গ্যারেজের তালা খুলে সে ভিতরে গাড়ি রেখে দিল। মাথার ওপর আলো। এবং নানারকমের পোকা সেই আলোর চারপাশে। এমন সুন্দর আলো আর তার চারপাশে কত সব কুৎসিত নীলবর্ণের পোকা। মনে হল দু—একটা পোকা ওর মাথার ওপর এসে বসেছে। সে হাত দিয়ে সেই সব পোকা ধরতে গেলে দেখল ওরা উড়ে গেছে। হাতে সব পোকা ধরা যায় না, ধরে মারাও যায় না।

গাড়িটা ঢুকিয়ে গেট টেনে দিল এবং বড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিল গেটে, গেটের ওপর পেতলের তালা, সেটা লোহার রডের সঙ্গে লেগে কেমন ঢঙ ঢঙ করে শব্দ করছে। সেই শব্দ মনীষের বুকে কী একটা তোলপাড় তুলে ওকে উধাও করে দিতে চাইল। সেই মানুষটা কে? সোমার কে হয়? সোমার আগে কোনো প্রণয় ছিল বলে তার জানা নেই। যদি থাকে সে কী তার ভিতর কেউ? নতুবা সোমার চোখে ওর চোখে এমন দুষ্টবুদ্ধি ধরা পড়ে গেছে কেন? ভিতরে ভিতরে মনীষ গুমরে মরছিল। তার কিছু জেদ আছে। সে সেই জেদের বশেই সোমাকে কিছু প্রশ্ন করল না। সোমাকে সে আপ্রাণ বিশ্বাস করে। মানুষের কিছু দোষ—ত্রুটি থাকে, সে সেটা নিয়ে না জন্মালেও ইনস্টিংক্ট তাকে সে সব বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্মাতে সাহায্য করে। এবং সোমারও যে এমন কিছু ঘটনা ঘটবে তাতে বিচিত্র কী। তবু এ সব ব্যাপারে সে যতটা জানে সোমা জীবনে কোনো কুৎসিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েনি। ওর মতো মেয়ের পক্ষে জড়িয়ে পড়া সম্ভবও নয়। এক সময় সে এই কফি হাউসের অনেককে চিনত। তার কবিতা লেখারও স্বভাব ছিল। সে প্রথমত এই এখানে কবিতার টানেই চলে আসত। কতদিন সে সোমাকে তার কবিতা শোনাবে বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে আর কাপের পর কাপ কফি নিজে খেয়েছে, বন্ধুবান্ধবদের জন্য অর্ডার দিয়ে গেছে। সোমা এলেই ওর প্রাণে জল আসত। সোমার বিধবা মা আর সে। বাবা কিছু টাকা ব্যাঙ্কে রেখে গেছেন সে এমন জানত। ওর মা খুব বুদ্ধিমতী এবং হিসেবি। সোমাকে এতটা বড় করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় সে যে হাজির করেছিল তার কৃতিত্ব যত না তার, তার চেয়ে বেশি মায়ের। সোমা বাড়ি থেকে গোনাগুনতি পয়সা নিয়ে বের হত। ওর কোনো কোনো দিন টিফিনের পয়সা থাকত না। সে এলেই প্রথম বলত, কী খাবে সোমা? কী অর্ডার দেব?

সোমার খেতে কোনো আপত্তি থাকত না। যা সে পছন্দ করত তাই সে অর্ডার দিত। তারপর কবিতা পড়া। সোমা ভালো না বললে সে কবিতা যথার্থই কিছু হয়নি তার এমন মনে হত। সে সেই কবিতা যে কতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখেছে। ওর কিছু কবিতা লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল একসময়। সবই যেন প্রেমের ব্যাপারে পাল্লা দেওয়া। সে ছাত্র হিসাবে মোটামুটি ভালো। দেখতে রূপবান না হলেও মানানসই। সে তেমন উঁচু লম্বা নয়। তবু সোমার পাশে দাঁড়ালে তাকে বেমানান লাগে না। সে সোমাকে পাবে বলে যা সে করে না তাও করেছে।

যেমন সে একবার সব বন্ধুদের নিয়ে ম্যাড হাউসে গিয়েছিল। অশোক এমন একটা চালিয়াতি মার্কা জীবনযাপন করত এবং আড্ডার টেবিলে তার এমন ব্যাখ্যা রাখত যে মনে হত মাঝে মাঝে এ—সব না করলে, যেমন একটু মদ্যপান, পালিয়ে চুমু খাওয়া ভালোবাসার মেয়েকে এবং রঙিন কোনো ছায়াছবিতে একপাশে সব শেষের রো—তে বসে ফষ্টিনষ্টি, একটু হাত দেওয়ার ব্যাপার না থাকলে প্রেম—ফেমের মূল্য কী। মনীষ সে সব বিয়ের আগেই সোমাকে নিয়ে করেছে। সোমার এতে সায় ছিল। এবং এত বেশি সায় ছিল যে সে কথায় কথায় মাঝে মাঝেই রঙিন ছবিতে একটা মুরগি—মোরগা পাছা তুলে নাচছে এমন দেখতে পেত। সবচেয়ে সেই ছবি যেখানে নায়িকা মুরগি বনে গেছে এবং কক কক করে ডাকছে—অ মোরগা।

মোরগ—মুরগির লড়াইতে সোমা কম যায় না। নাচে ভালো। সব ভালো তার। তবু আজ কেন জানি সোমার চোখে চুরি করে অন্য ঘরে উঁকি দেওয়া ভালো লাগল না। সে ভাবল সোমা যখন একা শুয়ে থাকবে, নীল মৃদু আলো জ্বালিয়ে শিয়রে, সে যখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনবে রেকর্ড—প্লেয়ারে এবং অবিকল নকল করে সেই গান গাইবে তখন তার পাশে বসে কোমল, উষ্ণ উত্তাপের ভিতর হাত রাখতে রাখতে বলবে, সে কে সোমা? তুমি চুরি করে কাকে দেখছিলে?

মনীষ চুপচাপ আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকল। মনোরমা এসে দরজা খুলে দিচ্ছে। সে জেগে থাকে। যতক্ষণ না বাবু—বিবি বাড়ি ফিরে আসে ততক্ষণ সে জেগে থাকে। ওদের ফিরতে কোনো কোনোদিন বেশ রাত হয়ে যায়। বোধহয় পার্টি থাকে। পার্টিতে কতরকমের খাবার। সোমা অথবা মনীষের আজকাল সেসব অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে রোজ রোজ ভালো লাগে না। মাসে দু—একবার হলে মন্দ নয় এমন ভাব। সে বেশি কিছু খায় না। দু—পেগ জিন, ওর ওতেই ম্যাকসিমাম। মনীষ আজকাল যেদিন খায় চার—পাঁচ পেগ অনায়াসে টেনে আসতে পারে। মনীষকে ছোটখাট একটা ব্যবসা চালাতে হয়। তার বড়মামা ব্যবসায় ফন্দিটা শিখিয়ে দিয়েছে। এবং সে তার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কত সহজে এ তিন—চার বছরে দশগুণ করে ফেলেছে। এবং ওর ধারণা সোমা লক্ষ্মীমেয়ে। সে না এলে লক্ষ্মী তার ঘরে এমন দশভুজা হয়ে আসত না। তার চারপাশে আজকাল মাঝে মাঝে ঝমঝম করে টাকার বৃষ্টি নামে। সে তখন ভেবে পায় না এই শহরে এত ঐশ্বর্য আর এসব মানুষেরা কেন ফুটপাথে থাকে? আসলে ওর মনে হয় তখন, এদের বড় বেশি উদ্যমের অভাব।

সোমা ঘরে ঢুকেই কেমন সোফাতে গা এলিয়ে দিল। এখন মনোরমা আসবে। এসেই জিজ্ঞাসা করবে খাবার গরম করে দেবে কিনা। কারণ খাবার কোনো কোনো দিন ঠান্ডা হয়ে যায়। সোমার নিজেরই ঠিক থাকে না কখন ফিরবে। যেমন আজই ধরা যাক ওদের কথা ছিল ছবি দেখে সোজা বাড়ি চলে আসবে। কোথাও বসবে না। কিন্তু আটকে গেল। এমন কথা ছিল না। এ—স্বভাবটা মনীষেরও আছে সেই প্রথম জীবনের কিছু ঠিকঠাক না থাকার মতো।

সোমা মনোরমাকে দেখেই বলল, আমরা আজ বেশি কিছু খাব না। খেয়ে এসেছি।

মনীষ সোজা বাথরুমে ঢুকে গেছিল। ওর বাইরে কোথাও বাথরুমের দরকার হলে খুব অসুবিধা হয়। ওর নিজের জন্য আলাদা বাথরুম। বাথরুমের চারপাশে বড় আয়না। পাশের বাথরুম সোমার। সোমার বাথরুমেও চারপাশে বড় আয়না আছে। ওদের শোবার ঘরে চারপাশে বড় আয়না। সাধারণত সে ঘরে কোনো আত্মীয়স্বজনের ঢোকার নিয়ম নেই। মনোরমা দিনে দুবার ঢুকতে পারে। একবার সকালে। আর একবার বিকেলে। পৃথিবীর যাবতীয় ন্যুড ছবি ঘরে। দেওয়ালে কোণারকের ডিজাইন। সে এ—ঘরটা নিজের পছন্দমতো তৈরি করেছে। সঙ্গে এ—ঘরেও আলাদা আলাদা দুটো বাথরুম। সেজন্য বাইরে কোথাও বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই ওদের বাথরুমে যাবার স্বভাব। অথচ আজ বাথরুমে ঢুকেই সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। নীলবর্ণের একটা আলো জ্বেলে দিল। সে কেন যে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকছে, সে কি এখনও সেই রহস্যজনক মুখের কথা ভাবছে? এবং ভিতরে একটা হিংসা, ক্রোধ। অথবা সে কি নিজেকে কোনো অপরিণামদর্শী যুবক ভাবছে? কিছু করণীয় নেই, সব ভবিতব্য। সে যে কেন দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারল না। কোনো কোনো দিন অত্যধিক মদ্যপান করলে সে এ—ভাবে একা বাথরুমে নীলরঙের আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরটা তার খালি মনে হয়। সেই বড় গম্বুজের মতো মুখের মানুষটাকে দু’নখে চিরে ফেলতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু সে জানে তার কাছে অথবা তাদের মতো মানুষের কাছে সে বান্দা। সে যা চাইবে তাই দিতে হবে। যদি সে তার সোমাকে চায়, এমন বৈভবের চাবিকাঠি তাদের হাতে সে না দিয়ে যাবে কী করে। কারণ না দিলেই সোমা আর দশভুজা থাকবে না। সোমা লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাবে।

বস্তুত একা দাঁড়িয়ে মনীষ যে কী ভেবেছিল নিজেও জানে না। সে বুঝতে পারছে শুধু এলোমেলো চিন্তা ওকে গ্রাস করছে। সে অসহায়ের মতো আয়নায় অবিরাম নিজেকে দেখে চলেছে। বস্তুত সে এতদিনে নিজের এই চেহারা চিনতে পারছে কিনা, এই মানুষই মনীষ দত্ত কিনা, ভেবে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সে নিজেকে কেন জানি চিনতে পারে না। মাথার ভিতর তার কেমন গোলমাল হয়ে যায়।

এমন সময় ওর মনে হল পাশের বাথরুমে ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে। জল পড়ার শব্দে ওর হুঁশ ফিরে এল। আয়না থেকে সে চোখ নামাল। ওপরের দিকে অহেতুক তাকাল সে। এ—সময়ে সোমা স্নান করছে। সোমা এই শীতের রাত্রিতে স্নান করছে। কিছু অপবিত্রতা তাকে সময়ে সময়ে গ্রাস করে, কী যে সেই অপবিত্রতা সে বুঝতে পারে না! গভীর রাতে কখনো কখনো বিছানা ছেড়ে সোমা বাথরুমে ঢুকে অনবরত ফোয়ারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। আজও ওর এমন হয়েছে। মাঝে মাঝে সে এটা সোমার অসুখ ভাবত। চার বছরের ওপর ওরা এই বাড়িতে উঠে এসেছে। বিয়ের পরই সে এখানে উঠে এসেছে। সে কী জেনে ফেলেছে মনীষ দত্ত এই পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে বান্দা হয়ে আছে? প্রয়োজন হলে মনীষ দত্ত সোমা নামক এক সুন্দরী মেয়েকে অবহেলায় বিক্রি করে দিতে পারে? সে যে কী ভাবছে!

মনীষ যখন বাথরুম থেকে ফিরে এল তখন সে দেখল ঘড়িতে দশটা বাজে। মনোরমা বাইরের বারান্দায় পায়চারি করছে। পার্লারে সে নতুন একটা লাল রঙের কার্পেট বিছিয়েছে কিছুদিন আগে। সেই কার্পেটে কত বিচিত্র সব ফুলের ছবি। ছবিতে কত রঙ—বেরঙের প্রজাপতি। মনোরমা গরম কফি রেখে গেছে। সে একটা চুরুট ধরিয়েছে, কফি খেতে খেতে অফিসের কিছু ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। সে এক বিষাদ কুড়িয়ে এনেছে সঙ্গে এবং এই বিষাদে তাকে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে, কেন যে সোমা এমন রহস্যময় মুখের কাছে ধরা পড়ে গেল বুঝতে পারছে না। আর পারছে না সে। সে এবার সোমা বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেই বলবে, তুমি ওকে চেন সোমা? তোমার সঙ্গে ওর কবে আলাপ?

মনোরমা বলল, দাদাবাবু আপনার খাবার ঠিক করব?

মনীষ বলল, সোমা আসুক।

দশটা বাজলে ওরা খেয়ে নেয়। দশটা বেজে গেছে বলেই মনোরমা ওদের খাবার টেবিল সাজাবে কিনা জিজ্ঞাসা করল। সোমা এমন কতদিন এসেই বলে দেয়, আমরা কিছু খাব না, খেয়ে এসেছি। যেন সোমা বাইরে থেকে এসে কতক্ষণে শরীর মুছে ধুয়ে অথবা স্নান করে তার সেই প্রিয় রেকর্ড—প্লেয়ার খুলে গান শুনবে। ওর প্রিয় গান সব থাকে সাজানো। অনেকদিন সে আলো জ্বেলে শুয়ে থাকে। রেকর্ডপ্লেয়ারে তখন বাজছে ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে, উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে’। মনীষ তখন দেখতে পায় একটা নীলরঙের আলোর নিচে সোমা সিল্কের গাউন পরে শুয়ে আছে। সাদা রঙের বিছানায় ঠিক একটা পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে মনে হয়। সে এসে ধীরে ধীরে কখনো ডেকে দেয়। সোমা এসো খাবে। কোনো কোনো রাতে সোমা আপন মনে জানালায় দাঁড়িয়ে গায়। তখন অজস্র নক্ষত্র আকাশে। কেমন অসুখী মনে হয়। মনের ভিতর ওর যে কী কষ্টের ছায়া পড়েছে ক্রমে সে বুঝতে পারছে না।

আজও মনে হল বাথরুম থেকে বের হয়ে সে চুপচাপ বসে থাকবে। অথবা আপন মনে সে গাইবে ওর সেই প্রিয় গানটা—গোলাপফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ হোথা যাসনে, ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাসনে। মাঝে মাঝে গাইতে গাইতে চোখ থেকে জল পড়ে সোমার। অথচ কখনো কখনো সে সোমাকে নিয়ে যখন গাড়ি করে বের হয়ে যায়, কোনো পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে হাত ধরাধরি করে অথবা পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে যায়, অনেক ওপরে, কেন যে মনে হয় তখন এই পৃথিবীতে সে আর সোমা, সোমা বিহনে সে নদীর পাড়ে একা পড়ে থাকবে—কেবল যেন গাইবার ইচ্ছা, ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি, ওগো সুন্দরী। চাও কী প্রেমের চরম মূল্য দেব আনি, দেব আনি, ওগো সুন্দরী। সে সোমার হাত ধরে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। চারপাশে উপত্যকাময় অজস্র ফুলের ওপর বাতাস বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোথায় কোন ম্লান অন্ধকার চুপ করে প্রতীক্ষা করছে মনে থাকে না। সে তখন সোমাকে নিয়ে কতদূরে চলে যেতে পারে। তার ভয় থাকে না। অথচ আজ কী যে ভয় তাকে পেয়ে বসেছে!

সোমা স্নান করে এসে এতটুকু শীতে কাঁপল না। ঘরের ভিতর এখন উষ্ণ আবহাওয়া। বড় পবিত্র চোখ—মুখ তার। এয়ার কন্ডিশান মেশিনটা কেমন একটা থেকে থেকে ক্লপ ক্লপ শব্দ করছে। আমার খেলা যখন ছিল তোমার মনে, ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত, যেন আমার আপন সখার মতো—সোমা গুনগুন করে গাইতে থাকল—তখন কে তুমি কে জানত, ওগো সেদিন তুমি গাইলে যে—সব গান, কোন অর্থ তাহার কে জানত শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ, সদ্য নাচত হৃদয় অশান্ত। হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি, স্তব্ধ আকাশ নীরব শশী রবি, তোমার চরণ পানে নয়ন করি নত, ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত, খেলা যখন ছিল তোমার সনে….। সোমা মাথা নিচু করে রেখেছে। এবং নিভৃতে গেয়ে চলেছে। মনীষ গান শেষ হলে ডাকল, সোমা।

গানটা শেষ করার পরও তার ভিতরে গানের রেশ থাকছে। সে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে পারল না।

মনীষ কাছে এসে বসল। ওর ঠান্ডা হাত তুলে ডাকল, তুমি ওকে চিনতে?

সোমা কিছু বলল না। মনীষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।

আমি দেখেছি সোমা, তুমি ওকে চুরি করে দেখছিলে, তুমি কি চেন ওকে?

সোমা ঘাড় নাড়ল। না। সে চিনতে পারছে না এমন বলতে চাইল।

তবে সে তোমার দিকে এমন তাকাচ্ছিল কেন?

জানি না।

তুমি কিছু জান না সোমা?

না, কিছু জানি না।

কিন্তু তোমাদের মুখ দেখে মনে হয়েছে যেন কতকালের জানা—চেনা।

ওর চোখ দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে। কতকালের যেন সে চেনা—জানা।

সোমার এই মুখ দেখলে কে বলবে, কিছুক্ষণ আগে কফি হাউসে বসে সোমা ঠাট্টা—মসকরা করেছে, সে ওকে দেখতে দেখতেও ঠাট্টা—মসকরা করেছে। কিন্তু সোমা যখন উঠে আসছিল, সোমা যখন দেখছিল—তখনও মানুষটা তাকে দেখছে এবং কাছে যেতেই কী যে মনে হল তার, সোমা কেমন নিভৃতে চলে গেল। অন্ধকারের অন্তরে সে বারবার তাকে সাড়া দিচ্ছে। সে আর কথা বলতে পারল না। চুপচাপ সিঁড়ি ধরে নেমে এসেছিল। আমি আবার আসব। সোমার চোখে—মুখে এমন আভাস যেন।

মনীষ এ সময় আর ওকে এসব বলে বিব্রত করতে চাইল না। তুমি বরং খেয়ে নাও।

তুমি না খেলে ভালো লাগে?

মনীষের অনুরোধে সে টেবিলে বসল মাত্র। সে খুব যত্নের সঙ্গে মনীষকে পরিবেশন করল। শুধু এটা ওটা নিয়ে সে চেখে দেখল। দেখতে দেখতে বলল, মনীষ, কাল তুমি অফিস যেয়ো না। আমি একা থাকলে মরে যাব, আমার কেমন ভয় করছে।

সোমার রাতে ঘুম আসছিল না। দরজা—জানালা বন্ধ। মনীষ পাশের খাটে ঘুমোচ্ছে। ওর এখন বাইরের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। সদর বন্ধ। লম্বা করিডোর পার হয়ে গেলে মনোরমার ঘর, সিঁড়ির নিচের ঘরে রসুল থাকে। রসুল মনীষের খাস বেয়ারা। সোমা অথবা রসুল একজন না একজন মনীষের সঙ্গে থাকে। যখন ওরা দূরে বেড়াতে যায় তখন রসুল ওদের পাহারাদার। বড় বিশ্বস্ত রসুল।

সোমার কেন যে ভয় ভয় করছিল! সে মানুষটা তার বাড়ি চিনে যদি চলে আসে। রসুল ওকে চেনে না, রসুল ওকে ঢুকতে দেবে না। সে রসুলকে যদি বলে আমি সোমার সঙ্গে দেখা করব, রসুল এমন একজন চেহারার মানুষকে কিছুতেই ফেরাতে পারবে না। সে এসে বলবে কে একজন এসেছেন মা, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সোমা পায়ে তখন আলতা পরবে। চোখে কাজল। বিনুর বড় ইচ্ছা ছিল কাজল টেনে চোখে বিনুর সঙ্গে সে কোথাও বেড়াতে যায়। সোমা পাশ ফিরে শোবার সময় এমন ভাবল।

ওর কষ্ট হচ্ছিল মনীষের কথা ভেবে। বেচারা সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। ভয় পেলে ঘুমোয় কী করে। সে কি ঘুমোচ্ছে, না চুপচাপ শুয়ে আছে? নড়ছে না। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে একবার দেখে—সে ঘুমোচ্ছে কিনা। না ঘুমোলে সে আজ আবার সারারাত ওকে পাশে বসিয়ে রেকর্ড—প্লেয়ার চালিয়ে দেবে। কিছু ইংরেজি গান মনীষের পছন্দ। কিছু ইংরেজি সাহিত্য ওর প্রিয়। এবং ওথেলো নাটকের কিছু সংলাপ। যখন মনীষ অত্যধিক মদ্যপান করে ফেলে তখন মনীষ সোমাকে জড়িয়ে কিছু অবিশ্বাসের সংলাপ একের পর এক বলে যায়। সোমা তখন খিলখিল করে হাসে।

কে সেই মানুষ! মনীষের চিরদিন একটা অবিশ্বাস। সোমা এত বেশি সুন্দর যে ওর বিশ্বাস সোমা কবে যে নদীর পারে চলে যাবে। সে ভয়ে ভয়ে থাকে। সোমাকে তার সব ঐশ্বর্য দেবার জন্য সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। সোমার আজকাল কোনো শৈলশহরে বাড়ি কেনার ইচ্ছা। বাড়িটা সাদা রঙের হবে। সদরে দারোয়ান। এবং দারোয়ানের চোখ—মুখ একটা কাফ্রির মতো। কানে বড় বড় রিং। হাতে বল্লম নিয়ে সে পাথরের মতো সদরে বসে থাকবে। প্রায় জল্লাদের মতো চেহারা। নীচে অজস্র গ্রাম্য কুটির। সেখানে শীতের রাতে আগুন জ্বেলে পাহাড়ি মানুষেরা যে মাংস পুড়িয়ে খাবে সোমা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে তা দেখবে। অথবা রাতে সোমা এবং সে ওথেলো নাটকের সংলাপ আবৃত্তি করতে করতে সামান্য মদ, নরম চিলি চিকেন, মৃদু আলো, আকাশ ভরা নক্ষত্র উপভোগ করবে। এত করেও পাশ ফিরে শুলে সেই মুখ—অপলক তাকে দেখছে। যেন বলছে সোমা তোমার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না।

আমার কী হওয়ার কথা ছিল?

তুমি ভুলে গেছ তা?

কে এমন মানুষ যাকে বলে এসেছে সে অন্যরকমের হবে? সে তার কলেজ জীবনের কথা মনে করার চেষ্টা করল। এই যেমন রমেন আর অনিল। ওদের একজন কি সে! সে ভালো করে ওদের মুখ—চোখ পর পর ভেবে গেল। সাত—আট বছরে সে ওদের ভুলে যাবে? ওদের এত বেশি পরিবর্তন আসবে? ঠিক চিনতে পারেনি বলে ওকে দূর থেকে দেখেছে। ওর চোখের ওপর ওরা মিছিলের মতো ভেসে গেল। রমেন কালো, বেঁটে। চুল ওর ব্যাকব্রাশ করা। চোখ ছোট। মানুষটার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। আর একজন উঁচু, লম্বা, নাক চ্যাপটা, থুতনিতে ভাঁজ, চুল শ্যাম্পু করা সব সময়—সে তো অমিয়। ওদের ভিতর অনিল স্মার্ট। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কিন্তু চোখে—মুখে বড় বেশি স্বার্থপর সে। তবু অনিলকে সোমার ভালো লাগত।

সে তার অনার্সের অনেক নোট অনিলের কাছে নিয়েছে। কলেজের শেষ প্রান্তে যেখানে জেলখানার পাঁচিল আরম্ভ হয়েছে, যেখানে সার মণীন্দ্র নন্দী, কে. সি. আই—এর স্ট্যাচু আছে তার নিচে বসে ওরা দুজন প্রায়ই গল্প করত। কিছু কিছু সংলাপ সে এখনও মনে করতে পারে। যেমন অনিল প্রায়ই বলত, তুমি সাঁতার জানো সোমা?

কেন জানব না।

অনেক মেয়ে সাঁতার জানে না।

তুমি অনেক মেয়ের মতো আমাকে ভাবলে কী করে?

তুমি তা হলে আলাদা?

আমার তাই মনে হয়।

মেয়েরা কখনো আলাদা হয় না।

কেন হয় না?

ওদের ঈশ্বর গড়েছেন একভাবে।

তুমি ঈশ্বর—টিশ্বর মানো দেখছি।

তুমি মানো না?

না, আমার মানতে ভালো লাগে না।

কেন লাগে না?

এই ঈশ্বরই প্রথম মানুষকে মিথ্যাকথা বলতে শিখিয়েছে বলে।

কী বলছ সোমা?

ঠিক বলছি। এই যেমন ধর ঈশ্বর যে বলেছেন আমি ঈশ্বর—

ঈশ্বর কখনো এমন কথা বলেন?

তবে মানুষ বলছে—ঐ দ্যাখো ওপরে ঈশ্বর আছেন।

মানুষ বলেছে বলতে পারো।

মানুষ কি ঈশ্বর দেখেছে?

মানুষ কল্পনা করেছে।

সোমা মাঝে মাঝে রেগে উঠলে বেশি, আঁচলটা মাথার ওপর টেনে দিত। তারপর খুব যেন ভেবে উত্তর দিচ্ছে, তা হল দেখো সেই কল্পনাটাকেই সত্য ভেবে আমরা কী না করছি। আমরা মন্দিরে মসজিদে মাথা ঠুকছি। ঈশ্বর নিজেই প্রথম মিথ্যার বেসাতি খুলে মানুষকে ভড়কে দিয়েছে।

অনিল চুপ করে থাকত। সে এসব তর্ক পছন্দ করে না। সে হালকা তর্ক করতে চায়। কিন্তু যা মেয়ে সোমা, তাকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। সে বলত, তুমি বলতে চাও, যার কোনো মূল অস্তিত্ব নেই তাকে নিয়ে আমরা মন্দির মসজিদ বানিয়ে নিরুপায় মানুষকে ভয় দেখাচ্ছি?

তা ছাড়া আর কী।

দ্যাখো সোমা, আমরা এ—সব তত্ত্বকথা এখনও তেমন বুঝি না। আমাদের সে বয়স হয়নি। এত সহজে কিছু নস্যাৎ করা ঠিক না।

আমি করতে পারি।

তুমি তবে রাজমহিষী।

অন্য কিছু বল।

আর কী বিশেষণ দিতে পারি?

যা খুশি।

তোমাকে একটা বিশেষণে ডাকব বলে অনেকদিন ভেবেছি। কিন্তু পারিনি। ভয় করেছে।

ভয় করলে থাক। তেমন বিশেষণে আমার দরকার নেই।

তুমি অভয় দিলে—

তুমি পুরুষ নও অনিল। তোমাদের ভিতর তুমি সবচেয়ে স্মার্ট, তার যদি এমন অবস্থা হয় তবে পুরুষ জাতটার ওপর আর বিশ্বাস রাখি কী করে?

তুমি অভয় দিলে আমি বলতাম।

যাক। যা বলছিলাম। তুমি বলে যাও, আমি নোট করে নিচ্ছি। ঐ দ্যাখো, এন. কে. জি. যাচ্ছেন। চুপচাপ মুখোমুখি বসে থাকতে দেখলেই বলবেন, দুপুরবেলায় টাওয়ারের মাথায় আজকাল চাঁদ ওঠে নাকি সোমা?

অনিলের মুখটা ভীষণ লাল দেখাচ্ছিল সেদিন।

আর সোমার কী হাসি পাচ্ছিল। সে মাথায় আঁচল তুলে বলল, অনিল, আমাদের বাড়ি এসো একদিন। তুমি যা ভাবছ সেটা সুবিধামতো ভেবে দেখা যাবে। এখন নোট নিচ্ছি, নোট নিতে দাও।

সে নোট নিতে নিতে অনিলের মুখ চুরি করে দেখছিল। আহা বেচারা, দুঃখে আর তাকাচ্ছে না। কেবল খাতায় মুখ রেখে বলে যাচ্ছে। ভয়ে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। তাকালেই বুঝি সোমা হেসে ফেলে। সে অপমান বোধ করবে আবার! অথচ সোমার শরীরে কী যে আকর্ষণ, উঁচু লম্বা সোমার চোখে কাজল থাকে না। কাজল দিলে এই যুবতীর চোখে এক অকারণ বিষণ্ণতা ভেসে ওঠে।

সোমা পাশ ফিরে আবার মনীষের দিকে তাকাল। ওর শরীর থেকে চাদর সরে গেছে। সে উঠে গিয়ে পাশে বসল এবং শরীরের চাদরটা তুলে দিতেই খপ করে ধরে ফেলল মনীষ।

তুমি ঘুমোওনি তবে?

না, আমার ঘুম আসছে না।

তোমার ঘুম না আসার কী হল?

তুমি তো জান আমার কেন ঘুম আসে না।

আমি আজ আর পারব না বাপু।

লক্ষ্মীমেয়ে। একটু পাশে শোও।

লক্ষ্মীছেলে। এমন করে না। দুষ্টুমি আমার এখন ভালো লাগবে না!

মনীষ উঠে বসল। সাপ্টে ওকে কোলের উপর ফেলে দিয়ে চুমু খেল। ভীষণ খারাপ লাগছে সোমা। আমি পারছি না।

সোমা বলল, ছাড় তো আগে।

মনীষ ছেড়ে দিল।

সোমা জানলা খুলে দিল। কেমন গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী থেকে যাবতীয় শীত কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। সে এতটুকু ঠান্ডা বোধ করছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কেন জানি মনীষকে পর্যন্ত ভয় পেতে শুরু করেছে।

নিচে লন। সবুজ ঘাস। কিছু লাল গোলাপ। দামি ফ্লোরেসেন্ট বাতি গোলাপের ভিতর। ছোট ছোট টিনের ফ্রেমে সেই আলো জাফরি কাটা। চারপাশে কী সমারোহ বাঁচার। আর একটু দূরে গেলেই ফুটপাথে অজস্র মানুষ, শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। গরিব, খেতে না পাওয়া হাজার হাজার মানুষের মুখ যেন চুপি চুপি পাঁচিলের পাশে এসে জড়ো হয়েছে এবং রাতে যখন সে ঘুম যাবে, সদরে কেউ থাকবে না, সোমা দত্ত ঘুম যাবে, তখন অতর্কিতে আক্রমণ ঘটবে। এইসব অন্নহীন মানুষের ভিতর সেই মানুষের মুখটাও উঁকি দিয়ে আছে দেখতে পেল। তাকে ওরা এ—বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

সোমা কেমন অতর্কিতে হাহাকার করে উঠল—মনীষ মনীষ!

মনীষ ছুটে বের হয়ে গেল? কী হয়েছে! এমন করছ কেন?

সোমা কেমন বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে দেখল শুধু গোলাপ, বড় বড় লাল গোলাপ, শুধু আলো, চারপাশে আলো আর আলো, এই আলো, ফুল এবং নক্ষত্র দেখে কেমন তার বুক কেঁপে উঠেছিল। আর কিছু নেই। মনীষ বারবার ওকে বলেও কিছু জানতে পারছে না।—তোমার যে কী হয়েছে সোমা!

সোমা বলল, আমি জল খাব।

মনীষ টিপয় থেকে কাচের মীনা—করা গেলাস এনে সামনে ধরল।

সে যেবার জার্মানিতে ব্যবসা—সংক্রান্ত টুরে গিয়েছিল, এবং যাদের কলাবরেশনে সে মধ্যমগ্রামের কাছে একটা দুর্লভ কাচের কারবার করবে ভেবেছিল, তাদের উপহার দেওয়া এই গেলাস। দামি। কত দামি মনীষেরও জানা নেই। সোমা এই গেলাসেই জল খেতে পছন্দ করে। সে বলল, আরও জল খাব? এনে দেব?

গেলাসটা দেবার সময় সোমা বলল, না আর লাগবে না।

তুমি আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভিতরে এসো।

তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।

আমাকে তুমি এভাবে ডাকলে কেন?

তোমাকে ডেকেছি!

ডাকলে না?

হঠাৎ কী যে হল।

মনীষ মাঝে মাঝে সোমার কিছু স্নায়বিক দুর্বলতা লক্ষ্য করেছে। ওর ডাক্তার বন্ধুর অভাব নেই। সে কাউকে এ—ব্যাপারে খুব কিছু একটা খুলে বলেনি। বললেই ওর অতীত নিয়ে আলোচনা হবে। এবং অতীতে সোমা কোনো ভয়াবহ কাজে লিপ্ত ছিল কী না, শিশুকালে কোনো অপমৃত্যু দেখেছে কী না, অথবা সে এমন কোনো পাপ কাজের সঙ্গে নিযুক্ত ছিল যা এখন তাকে মাঝে মাঝে অস্থির করে তুলছে।

মনীষ এও জানে বেশি সময় সোমার এটা থাকে না। সে সেজন্য আজ আর কোনো দৈহিক সম্পর্কের কথা ভাবল না। সে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কিছু করব না। ভয় করলে তুমি আমার পাশে শোও। ছুঁয়ে বলছি তোমাকে ডিস্টার্ব করব না। আমার পাশে শুলেই তুমি ঘুম যেতে পারবে।

সোমা হাসল। বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি মনীষ। বিশ্বাস করি বলেই তোমাকে বিয়ের আগেই সব দিয়ে ফেলেছিলাম। কেউ দেয়? বল, মেয়েদের এইটাই তো অহঙ্কার?

মনীষ এমন কথায় আপ্লুত না হয়ে পারল না। সে বলল, এসো সোমা, আমার পাশে শোবে। বলে মনীষ নিজেই দুটো খাট টেনে একসঙ্গে করে নিল। বিছানা বড় করে ফেলল। বালিশ পাশাপাশি রেখে দিল। সোমা নরম বালিশে ঘুম যেতে পারে না। ওর শক্ত বালিশ লাগে। সোমা শোবার আগে আঁট করে খোঁপা বাঁধে। সাদা রঙের সিল্কের গাউন। নানারকম লাল সবুজ সুতোর লতাপাতা আঁকা। ফুলের ওপর প্রজাপতি আঁকা। কোনো কোনো দিন সে খুব কালো রঙের গাউনও পরে। ওর সাদা পা তখন মোমের মতো নরম লাগে। যেন একটু তাপ লাগলেই গলে যাবে। এত নরম আর উষ্ণ যে সে ভয়ে তখন ওকে আলিঙ্গন করতে পারে না। জোরে চাপ দিতে পারে না। হুড়মুড় করে হাড়—পাঁজরা বুঝি তার সব ভেঙে যাবে।

সোমা ওর খাটের পাশে চুপচাপ বসে থাকল। শুল না।

তুমি মনে করতে পারলে?

না।

কোথায় দেখেছ মনে করতে পারছ না?

না পারছি না। আমি যে কী করি! কিন্তু জান, খুব চেনা। এবং কতকালের চেনা মনে হচ্ছে।

তুমি যে বলতে ছেলেবেলা তোমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল, তার মা—মরা ছেলে তোমাদের বাড়ি থেকেই মানুষ?

অমলের কথা বলছ?

হ্যাঁ, অমল।

ওকে দেখলে আমি চিনব না! সে কি বসে থাকার ছেলে! দিদি বলে ছুটে আসত না!

তুমি অযথা ভাবছ। হয়তো চেনাই নয়। তুমি সুন্দর বলে চোখ ফেরাতে পারেনি। পালিয়ে পালিয়ে তোমাকে দেখছিল।

তা এ—ভাবে দেখে?

তোমার মন বড় দুর্বল। সে হয়তো এমনি দেখছিল, এখন তুমি তার নানারকম অর্থ খুঁজছ।

হবে। সে এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাইল না। না, ঘুমোনো যাক, বলে সে এক পাশে আলগা হয়ে শুল।

কাছে এসে শোও না, যেন পরপুরুষের কাছে রাত কাটাতে এসেছ।

সোমা বলল, বেশ আছি মনীষ। আমাকে আর টানাটানি কোরো না। আমাকে ঘুমতে দাও।

সে এবার ঘুম যাবার জন্য চোখ বুজল। এবার সে ঘুমোবে। অযথা সে আর আজে বাজে চিন্তা মনে টেনে আনবে না।

চার

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল, সোমা বিছানাতে নেই। সোমার ঘুম থেকে বেলায় ওঠার স্বভাব। মনীষ ঘুম থেকে উঠে একবার চা খেয়ে নেয়। তখনও সোমা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। ওর সুন্দর পা বিছানার ওপর খালি। গাউন ওপরে উঠে থাকে। এ—ঘরে কেউ আসবার যেহেতু নিয়ম নেই, মনীষ ইচ্ছা করেই গাউন টেনে নামিয়ে দেয় না। সে ধীরে ধীরে চায়ের কাপ নিয়ে এ—ঘরে ঢুকে যায়, চা খায়। এবং পায়চারি করতে করতে সোমার অস্বাভাবিক সুন্দর সুঠাম শরীর দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজ সে দেখল বিছানা খালি। এত তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়ায়, বাথরুমে গেছে সে এমন ভাবল। সে ডাকল, সোমা আছ? কোনো সাড়া সে পাচ্ছে না।

সে বাইরে এসে দেখল সোমা একটা ইজিচেয়ারে মোটা একটা র‍্যাপার জড়িয়ে বসে আছে। সব শরীর ঢাকা। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। হলুদ রঙের স্কার্ফ। করুণ শীতার্ত চোখ—মুখ তার। মনীষকে দেখেও সে এতটুকু নড়ে বসল না। প্রায় স্থির পাথরের মূর্তির মতো। যেন কেউ এই সকালে বারান্দার দেয়ালে সুন্দর এই শীতার্ত ছবি এঁকে দিয়ে গেছে। চোখের নিচে ঘুম না যাবার চিহ্ন। ক্লান্ত চোখ—মুখ। সে বলল, তোমার ঠান্ডা লাগবে সোমা।

সোমা কেমন ওম শব্দ করে ফের নিরুত্তর থাকল। মনীষ কেন যে ভীষণ ক্ষেপে গেল, সে বলে উঠল, কী বলছি শুনতে পাচ্ছ? বলছি ভিতরে যাও। ঠান্ডা লাগিয়ে অসুখ বাধাবে।

যেন দেয়ালের ছবি মুহূর্তে জ্ঞান পেয়ে ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। কী বলছে শোনার চেষ্টা করল, তারপর ফের ঘুম গেল দেয়ালে। সোমা চোখ নামিয়ে নিল।

মনীষ বুঝল এবার ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার। এভাবে ব্যাপারটাকে চাপা দিলে চলবে না। সে ফোন করল, অসিত আছিস?

কে?

আমি মনীষ।

মনীষ দত্ত? কী ভাগ্য! সহসা গরিবের এত্তালা?

শোন, তুই সকালে ফ্রি আছিস?

কেন, কী হয়েছে?

আছিস কিনা বল?

নেই। তবে তুমি বললে করে নিতে হবে।

একটু আমার বাড়িতে আসবি? সোমাকে একটু দেখবি?

কী হয়েছে ওর?

ফোনে সব বলা যাবে না। এলে জানতে পারবি।

সোমা কান খাড়া করে শুনছিল। মনীষ ওকে জোর করে কিছু করতে চায়। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। মনীষ ডাক্তার ডাকছে। আমার কিছু হয়নি মনীষকে এমন বলতে চাইল। কিন্তু বললে কে শুনছে? সে রাতে ঘুমোতে পারেনি। সে এখানে এসে এই শীতের রাতে কেমন কষ্ট অনুভব করতে চেয়েছে। যেন এই যে চারপাশে এত দীন দুঃখী মানুষ সারারাত ফুটপাথে কাটায়, এই যে গ্রামে মাঠে মানুষ অন্নহীন বস্ত্রহীন দুঃখী, সে দুঃখী মানুষের মতো থাকতে চায়। সে তার মুখ দেখার পর চোখ দেখার পর এমন করতে ভালোবাসে।

আর আশ্চর্য, অসিত এলে সোমা তাকেই বলল, আসুন। কী ব্যাপার, এদিকে পথ ভুল করে?

মনীষ এমন স্বাভাবিক চেহারা সোমার আশাই করতে পারেনি। শুধু চোখে—মুখে রাতের না ঘুমোনোর কষ্টকর ছবি। সে সিনেমাতে যে সোমাকে নিয়ে গিয়েছিল এ ঠিক সেই সোমা।

সোমা অনুযোগ করল, আজকাল আর এদিকে একেবারেই আসেন না।

অসিতের চোখ ট্যারচা হয়ে গেল। তবু সে ডাক্তার। অনেক সময় রুগির স্বাভাবিক কাজকর্মের ভিতরই অনিয়ম থাকে, শৃঙ্খলা থাকে না। আপাত মনে হবে সবই ঠিক, অথচ একটু খুঁটিয়ে দেখলে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, না, গোলমাল আছে। সে বসল।

সোমা বলল, কফি না চা? হট না কোল্ড? কী চাই?

অসিত বলল, হট।

সোমা বলল, আজকাল হটই পছন্দ সবার। যা দিনকাল পড়েছে।

অসিত বলল, আজ আমাদের হাসপাতালে চারজন এসেছে।

সবাই বেঁচে আছে তো?

একজন বাদে সবাই টেঁসে গেছে।

কীরকম বয়স?

এই পনেরো থেকে কুড়ি!

আহা রে! কার মার সন্তান!

অসিত সোমার মুখ দেখল। সোমা উঠে গেলে মনীষকে বলল, কিরে, বাপ হবার চেষ্টা করছিস না?

করছি তো। কিন্তু কিছুতেই পা মাড়াচ্ছে না। সব অনিয়ম হতে পারে, কিন্তু ট্যাবলেটটি খেতে ভুলবে না।

আমার তো কিছু খারাপ লাগছে না, কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।

মনীষ গত রাতের ঘটনা সোমার অজ্ঞাতে বললে অসিতকে কেমন চিন্তিত দেখাল।

সোমা এসে দেখল দুই বন্ধু মুখ ভার করে বসে আছে। সোমা বুঝতে পারল মনীষ সব বলেছে। সে হেসে দিল ওদের মুখ দেখে।—কী হল আপনাদের? চুপচাপ?

অসিত তাকাল সোমার দিকে। সোমা আবার হেসে দিল। আপনারা ভাবছেন কী জানি কী হয়ে গেল। কিচ্ছু হয়নি। কাল কফি হাউসে আমার খুব পরিচিত একজন মানুষকে দেখলাম। অথচ চিনতে পারলাম না। এখনও মনে করতে পারছি না। কেবল এটুকু মনে পড়ছে আমি যা হতে চেয়েছিলাম পারিনি।

মনীষ বলল, দ্যাখো সোমা, ছেলেবেলায় আমরা অনেক কিছু ভাবি। ছেলেরা সবাই বিদ্যাসাগর হতে চায়। আর মেয়েরা ভগবতী দেবী। কিন্তু কী জান, যত বড় হই তত দেখি এমন সমাজ—জীবনে আমরা বড় হয়ে উঠেছি, যেখানে কেউ আর ইচ্ছে করলেই সেটা হতে পারে না! বলে সে প্রায় ব্যাখ্যা করার মতো বলল, এই যে ধর যদি আমি চাইতাম বিদ্যাসাগর হব, কিংবা তোমার কোনো পরিচিত বন্ধু বিনুর কথাই ধর, সে তো কম সৎ ছেলে নয়, আমি ওকে জানি, কিন্তু বেচারা কী করবে, টাকার জন্য বস্তাপচা নোট লিখছে এখন। সে জানে এতে প্রকৃত শিক্ষা হয় না, কিন্তু ওর এতবড় সংসারে কে সাহায্য করবে? ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালে তোমরা ওকে আর চিনতেই পারবে না। আমাদের সবারই এখন ভয়—কাল ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াব। ন্যায় অন্যায় বুঝছি না, যা পারছি সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কে জমা রাখছি।

সোমা খুব মন দিয়ে শুনল। তুমি আজকাল ভালো কথাও শিখে গেছ মনীষ! একেবারে নেতাগোছের মানুষের মতো একটা বক্তৃতা করে ফেললে।

বক্তৃতা নয়। তোমাকে তো আমি জানি। তোমাকে আমি এ—সব কথা ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকেও বলতে শুনেছি। ফুটপাথে অথবা কোনো গ্রামে—গঞ্জে মানুষের অপমান দেখলেই তুমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে, বলতে এসব আর দেখা যায় না চোখে। সব ভেঙে ফেলা দরকার।

অসিত এসেছে ডাক্তারি করতে। এখন সে বুঝতে পারছে না কে রোগী। মনীষ না সোমা। সোমার মুখ হাসিতে সব সময় সপ্রতিভ। সে এতটুকু রাগছে না। মনীষ কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। এবারে অসিত নিজেই সোমার মুখে গোটা ঘটনাটা জানতে চাইল—কাল কী হয়েছে আপনাদের!

কিছুই হয়নি। কেবল আমি ভাবছিলাম ওকে আমি কোথায় দেখেছি।

মনে করতে পারছেন না?

না।

তার জন্য ভাবনার কী আছে।

আমি তো তাই বলছি ওকে।

সময় সময় মানুষের এটা হয়। খুব একটা প্রিয় ঘটনা, যা জীবনে সবচেয়ে মনে বেশি থাকার কথা, সেই ঘটনার নায়ক সামনে হাজির হলে, সাময়িক স্মৃতিবিভ্রম হয়। পরে সেটা আস্তে আস্তে কেটে যায় এবং যখন সব মনে পড়বে, তখন অদ্ভুত হাসি পাবে। আরে, এমন ঘটনা জীবনে ঘটেছে তা বেমালুম ভুলে গেছি। বলে সে সোমার দিকে তাকাল। এ নিয়ে বেশি ভাববেন না।

আমি আদৌ ভাবছি না। যে ভাবছে তাকে বলুন।

মনীষ কেমন হতাশার চোখে দেখল সোমাকে। এই যুবতীকে সে এত ভালোবাসে! ওর এতটুকু কিছু হলে ওর ঘুম আসে না। আর কাল সোমা যা দেখে রাতে ঘুমোল না ভাবলে ভিতরটা আগুন হয়ে যাচ্ছে। সে আধুনিক ছেলে। সে মেয়েদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবু এমন একজন রূপবান ছেলেকে সে চিনতে পারছে না, সে যে বলতে পারছে না, এই মুহূর্তে তার বিশ্বাস করতে কেন জানি কষ্ট হচ্ছে। সোমা ইচ্ছা করেই সব গোপন রাখছে। সে যখন এমন সুন্দরী, তখন তার কৈশোরে কেউ পাশাপাশি হেঁটে আসেনি, কেবল সে—ই ওকে ধরে নিয়ে এসেছে অথবা জয় করেছে —ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল।

সে বলল, সোমা আমার ঘাট হয়েছে। কিন্তু অসিত তুই জানিস, সকালে বের হয়ে দেখি শীতের বারান্দায় একটা সামান্য র‍্যাপার জড়িয়ে বসে রয়েছে। ডাকছি হুঁশ নেই।

সোমা বলল, ওটা কিছু না। তুমি তো জানো মনীষ, বাবা আমাদের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। মা খুব অনটনের ভিতর আমাকে সেই টাকাতেই মানুষ করেছেন। আমি সুন্দরী ছিলাম। কী অসিতবাবু এ—ব্যাপারে আপনার কী মত?

আপনি এখনও দেবীর মতো।

তা হলে বুঝতে পারছ মনীষ, দূরের পথ হাঁটতে গেলে কিছু হোঁচট খেতেই হয়। আর রূপবতী হলে তো কথাই নেই।

এখানেই অসিতের একটু গোলমাল ঠেকল। তৃতীয় ব্যক্তির সামনে সোমা কেমন বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে। সে অন্যদিকে কথা টানার জন্য বলল, দেখলে তো মনীষ, বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি থেকে কেমন জোর করে হারিয়ে দিল।

মনীষের এ—সব শুনতে ভালো লাগছে না। সে শুধু বলল, অসিত, তুই আয়।

অসিত বলল, তা হলে আসি।

সোমা বলল, কফি হচ্ছে।

আর একদিন হলে হয় না?

যা দিনকাল পড়ছে, আর একদিন যে আসতেই পারবেন ঠিক কি?

মনীষ কিছু বলছে না। নিজের এই আহাম্মুকির জন্য কেমন সে এবার নিজের ওপরই ক্ষেপে গেল। বলল, তোরা বোস, আমি আসছি।

তুমি গেলে চলবে কী করে? তুমি বোস।

মনীষ সোমাকে কেন যে চটাতে ভয় পায়। সে বসে পড়ল।

আজকাল এটা ওর হয়েছে অসিতবাবু। খুব সহজে চটে যায়। ভেঙে পড়ে। কিছুই ধৈর্য ধরে শুনতে চায় না।

অসিত বলল, দেশের যা অবস্থা, খুব ধৈর্য ধরে না শুনলে যে চলবে না।

মনীষ বলল, তাই বলে কি মানুষ দিনদুপুরে হত্যা করবে? বিচার থাকবে না? অসিত বলল, আজকাল বুঝি এসব খুনোখুনির ব্যাপার আপনাদের খুব হন্ট করছে? বলে সে সোমার দিকে তাকাল।

আমাকে করছে না।

কেন করছে না? মনীষ এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রক্তমাংসের শরীর হলে না করে পারে?

কী করব! বল তোমাকে এ—ব্যাপারে অনেক কথা বলতে পারি। তবে বলব না। অসিতবাবু এসেছেন, বলা ঠিক হবে না।

সোমা আর কোনো কথা বলতে চাইল না। সে কফির পট থেকে লিকার ঢেলে অসিতের দিকে তাকাল। বলল, পাতলা না ঘন? দুধ কম বেশি। চিনি দেব, না দেব না?

অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন এখন অসিত। সে বলল, আমি আজকাল সবরকমের খেতে অভ্যস্ত। যা দেবেন। তারপর সে মনীষের দিকে তাকিয়ে বলল, গিন্নি কি তার লেফট—মাইন্ডেড?

কী জানি ভাই, কী মাইন্ডেড সে—ই জানে। নারী—চরিত্র দেবতারা শুনেছি বুঝতে পারে না। আর শালা আমি তো মনুষ্য—জাতির অযোগ্য। হবু ক্যাপিটালিস্ট।

সোমা বলল, তুমি সব ব্যাপারে নিজেকে টান কেন?

টানব না? তুমি এমন এক—একটা ব্যাপার করবে যে মনে হবে সব বুঝি গেল। আমার ভাবনার অন্ত থাকে না। কী করতে যে শখ করে পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম!

পুরোপুরি হয়ে গেলে তোমার এসব আর থাকবে না।

তার মানে?

মানে তখন দেখবে তোমার সময়ই হবে না বউ কোথায় থাকছে, কী করছে।

তোমাকে আজ জার্মানি, কাল আমেরিকা। বউ এদিকে পার্টি দিচ্ছে, পার্টি করছে। এখনও হওনি। চুনোপুঁটি হলেও না হয় কথা ছিল।

অসিত চাইছে না সোমার এসব উক্তি ওর সামনে হোক। কিন্তু সোমার দিকে তাকিয়ে বুঝল, সোমা আদৌই মাইন্ড করছে না। এ—সব কথা ঘরের সে তা আদৌই ভাবছে না। কোথায় যেন একটা অসীম দুঃখ আছে, সোমা তার বদলা সুদে—আসলে নিতে চায়। সেটা কি নিজের কাছে? সে কী বলছে, তুমি বড় ভুল করেছ সোমা, তুমি কিছু কিছু সৎ ব্যাপার এ—পৃথিবীতে আশা করেছিলে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখছ আর্থিক অনটন তোমাদের সংসারকে কীভাবে তছনছ করে দিয়েছিল? তুমি বলেছিলে সবাইকে, তোমার বাবা মারা যাবার আগে কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রেখে গেছেন। তোমার মা—ও তোমাকে এমন বলেছে। তুমিও সবাইকে এমন সব বলেছ। কিন্তু তুমি বড় হতে গিয়ে জানতে পারলে, এই অর্থ মা তোমার কীভাবে আনছেন। তোমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। মানুষের ওপর বিশ্বাস তোমার হারিয়ে গেল। তখন তুমি একজন মানুষকে মনে মনে খুঁজছিলে। সে থাকলে কিংবা তাকে পেলে তুমি হয়তো আর তোমার বিশ্বাসকে এমনভাবে বিসর্জন দিতে পারতে না। সমাজকে বদলে দেবার শপথ নিয়ে তুমিও হয়তো বের হয়ে পড়তে।

আচ্ছা, সোমা, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি কি ওকে সত্যি চিনতে পারনি?

না। চিনতে পারিনি। মিথ্যা বলে লাভ নেই।

মনীষের চিৎকার করে বলার ইচ্ছা—তোমার পূর্বপ্রণয়ী। আমি ঠিক জানি। তুমি আমার কাছে সব গোপন করছ।

সোমা মনীষের মুখ—চোখ দেখে বুঝতে পারল, মনীষ এ—ব্যাপারে সেন্টিমেন্টে ভুগছে। সে বলল, অসিতবাবু, মানুষটা কে আমার নিশ্চয়ই মনে পড়বে। আমি আজ তাকে আবিষ্কারের জন্য সারাদিন ভাবব। তবে দোহাই আপনাদের, আমার কোনো অসুখ আছে ভাববেন না। অসুখটা মনীষের। ওর টাকা করার বাতিক। একের পিছনে সে পর পর কেবল শূন্য বসিয়ে যেতে চায়। এটা মানুষের বড় রোগ। এ—রোগে পেলে মানুষ তার মায়া—মমতা হারিয়ে ফেলে। সমাজের যা কিছু সুন্দর সে হরণ করে নিতে চায়। চারপাশে এত কদর্য জীবনযাপন, সে চোখে কিছুতেই তখন তা দেখতে পায় না।

অসিত উঠে গেলে সোমা কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকল। তার কোনো কোলাহল যেন ভালো লাগছে না। এমনকি মনীষকেও তার ভালো লাগছে না। সে চোখ বুজে থাকলে টুকরো টুকরো ঘটনা মনে করতে পারে। একা ব্যালকনিতে পায়চারি করলে বাবার মুখ মনে করতে পারে। কী নিরীহ ছিল তার বাবা। সামান্য তার প্রত্যাশা। সে তার স্ত্রী এবং কন্যাকে সামান্য সুখে রাখার জন্য যৎকিঞ্চিৎ অর্থ এদিক—ওদিক থেকে রোজগারের চেষ্টা করত।

বাবা সামান্য কেরানি। জেলা অফিসে সে টেন্ডার ফাঁস করে কিছু অধিক রোজগার করত।

সোমা বাবার মুখ এ—সময় আর ভাবতে পারল না। কারণ বাবা তার কাছে সব সময়ই নিরীহ মানুষ। বাবার আত্মহত্যার পর এ—সব খবর যেন কানাঘুষা শুনেছে। তার এখনও বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সে জানে, সমাজে যারাই আছে, তারা এটা না করে বাঁচতে পারছে না। বাবাও পারেননি। সে তার বাবাকে এজন্য সব সময়ই ক্ষমা করে দেয়। তার বাবা মাঝে মাঝে তার জন্য তেলেভাজা কিনে আনত। বাবা এবং সে, মাকে গোপন করে কতদিন তেলেভাজা খেয়েছে। মা দেখলে বড় রাগ করত।

যেন চোখ বুজেই বলল, বাবা তুমি বড় বোকা। যে লোকটার হয়ে এসব করতে, সে কিন্তু বড় মান্য ব্যক্তি সমাজের। সে মাকে এখনও ভালো মাসোহারা দেয়। এটা ওর কী বদান্যতা! মাকে এত বলেও সোমা মাসোহারা নিতে বন্ধ করাতে পারেনি। মা—র এক কথা—এমন দুর্দিনে তিনি আমাদের দেখেছেন।

যত সে বড় হচ্ছে তত মনে হচ্ছে সংসারে তার মা—ও এক পাপে লিপ্ত। সে জানে না, কী যে যথার্থ কারণ। প্রথম যেদিন সে জেনেছিল, বাবার ব্যাঙ্কে কোনো ব্যালেন্সই নেই, বাবা সব তেলেভাজা খেয়ে উড়িয়ে গেছেন, এবং এই টাকা এক মহামান্য ব্যক্তির, তখন সোমার কী যে ঘৃণা হয়েছিল মায়ের ওপর! কিন্তু মা—র চোখমুখ দেখে সে কিছু বলতে পারেনি! মা—র মুখে বড় বিষণ্ণতা ছিল সেদিন। কার জন্য আমি এটা করেছি সোমা? তোর জন্য। আমার আর কী আছে! তোর বাবার বড় ইচ্ছা ছিল তুই বড় হবি। লেখাপড়া শিখবি। তোর বাবা বি.এ. পাস ছিল না। তুই বি.এ. পাস করবি। তোর বাবা থাকলে আজ কী যে তিনি সুখী হতেন।

সোমার ভাবলে অবাক লাগে তার বাবা টিপিক্যাল ছাপোষা মানুষ ছিলেন।

সোমা এখন উঠবে ভাবল। রসুলকে গাড়ি বের করতে বলল। সে অযথা ঘুরবে আজ। সে মনীষকে বলল, আমি একটু বের হচ্ছি মনীষ।

মনীষ তার ঘরে বসে কিছু ফাইলপত্র দেখছিল। আর একটু বেলা বাড়লেই অফিসের বড়বাবু এসে মনীষকে কী বোঝাবে। তখন সোমার সারা বাড়িটার ওপর রাগ হয়। সংসারে একমাত্র মানুষটার টাকা বাদে অন্য চিন্তা নেই। সে সেই বড়বাবুকে দেখলেই বলবে, আপনাদের কী বাজার—টাজার করতে হয় না? সকালে এসে সারাক্ষণ কী যে এত আপনাদের কাজ। বলার পরই মনে হয় সে মনীষের বউ। মনীষ এ—ব্যাপারে রাগ করতে পারে। তার অযথা কথা বলা উচিত হচ্ছে না। সে একেবারে চুপ করে যায়।

এই সকালে কোথায় যাবে?

একটু গঙ্গার ধারে যাব।

মনীষ চাবিটা ছুঁড়ে দিল সোমাকে।—কখন ফিরবে?

তোমার অফিসের আগেই ফিরব।

সোমা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে দেখল চারপাশে শীতের রোদ। রাস্তায় এখনও ভিড় বাড়েনি। সে যে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবল কাল সে যেখানে ওকে দেখেছিল, সেখানে যাবে। সে যদি আবার আসে।

সোমা খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। আঁচল পড়ে যাচ্ছিল, সে সেটা গুঁজে দিল। হালকা রোদের ভিতর নীল রঙের গাড়ি, সোমা লাল সিল্ক পরেছে। পায়ে আলতা। সে চোখে আজ কাজল দিয়েছে। এই প্রথম সে কাজল দিয়েছে। সেই কত কাল আগে কাকে যেন জীবন থেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। সে বুঝি আবার ফিরে এসেছে। সে তাকে আজ খুঁজে বের করতে যাচ্ছে।

সোমার মাঝে মাঝে নানা দৃশ্য মনে আসে। মানুষটা কী অনিমাসির ভাশুরপো সমর? সমর কী এত সুন্দর ছিল? সে সমরকে বেশিদিন দেখেনি। মাত্র বিয়ের ক’দিন দেখেছে। সে নানাভাবে তাকে দেখল, সমর সুন্দর ছিল না। ভ্রূ সমরের এত টানা নয়। সে এ—ভাবে তাকাতে জানে না। সুতরাং সে কেন হবে। সে হলে ওর সঙ্গে উঠে দেখা করে যেত। এ—সুসময়ে আমাদের কথা তোমার মনে হয় তো? সে এ—সব জিজ্ঞাসা করত।

অনিমাসির মেয়ের বিয়ের দিনের কথা। জলি ওর বয়সি। অনিমাসি বারবার বলে গেছে, তুই যাবি সোমা। তুই না গেলে জলি খুব দুঃখ পাবে। সোমা তখন অনার্স নিয়ে পড়ছে। কোথাও কেউ যেতে বললে ওর বড় ভালো লাগে। সে যে সোমা দত্ত, তখন অবশ্য দত্ত ছিল না সে, গাঙ্গুলি, সে সুন্দর করে শাড়ি পরতে জানে, খোঁপা বাঁধতে পারে, চোখে কাজল না দিলেও মনে হয় কাজল দিয়েছে, আর তা ছাড়া প্রথম সে কলেজে ঢুকেছে, আবার তার অনার্স আছে, সে ভালো ছাত্রী, নাম—ডাক, সে যে কত ভালো এবং মেধাবী, কান পাতলে ফিসফিস কথায় সে যেন তা টের পায়।

সোমার মনে হত তখন সে আছে বলেই চারপাশে এত হাসি গান আনন্দ। সে ভালোভাবে তাকাতে পারে না চোখ চুলে। তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যায়। সব যুবকেরা তার চারপাশে যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে। সে হাত তুলে দিলে সব সারি সারি যুবকের মিছিল, সামান্য তৃষ্ণার জল পান করবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

সে গিয়েছিল সকালে। তখন অনিমাসি ছাদের ঘরে ভাঁড়ার সামলাচ্ছে। বোধহয় সেটা ফাল্গুন মাস ছিল। ফাল্গুন মাসই হবে। কারণ তখন আকাশ বড় পরিষ্কার ছিল। খুবই পরিষ্কার। সে, সমর, এবং আরও চার—পাঁচজন যুবক ছাদে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে নক্ষত্র গুনত। কে ক’টা নক্ষত্র নির্ভুলভাবে গুনতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলত। সবাই পরস্পরের সততায় বিশ্বাস করত। সোমা বারবার গুনতে গিয়ে দেখছে সে ঠিকমতো গুনে যেতে পারে না। আকাশে এত নক্ষত্র, সে গুনবে কী করে! একদিক থেকে একটা দুটো পাঁচটা গুনলেই মনে হয় ভিতরে অজস্র নক্ষত্র রয়ে গেছে তার গোনা হয়নি। সে বলেছিল, না সমর, আমি গুনতে পারছি না।

সমর বলেছিল, যা, গুণতে পারবে না কেন? সবাই সব গুনতে পারে।

তুমি পার সমর?

পারি।

কত নক্ষত্র আকাশে বল?

দু হাজার তিনশো ছত্রিশ।

গুল।

গুল না সোমা। আমার আকাশে দু হাজার তিনশো ছত্রিশই আছে। যারা বাদ গেছে তারা আমার আকাশে নেই।

সোমা বলেছিল, তুমি বড় গুল মারতে পার সমর। আমার গুল মারতে ভালো লাগে না।

তুমি তবু গুল বলছ!

বলব না?

বলা উচিত না সোমা। কারণ—

কী কারণ? ছাদের ওপর সোমা আলগা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে আকাশ দেখছে। সমরের মুখ দেখে মনে হয়েছে সত্যি বুঝি আকাশের নক্ষত্র গোনা যায়। সে বলল, আমি যে পারছি না সমর। ক’টা গুনেই দেখছি তার চারপাশে অজস্র, আবার গুনতে গেলে দেখছি তার ভিতর আরও অজস্র। আমি গুনে শেষ করতে পারছি না, হাঁপিয়ে উঠছি।

বোকা। ও—ভাবে কী কেউ আকাশের তারা গুণে শেষ করতে পারে! বলে সমর ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি গুনছি তোমার হয়ে।

গোনো।

সে গুনতে থাকল। খুব সন্তর্পণে যেন সে গুনছে। একেবারে নিবিষ্ট মনে। আর যারা ছিল, তারা একে একে নেমে গেছে। আকাশে ওদের তারা গোনা বুঝি শেষ। কেবল বাকি সোমার। সোমারটা হয়ে গেলেই সমর নেমে যাবে।

সোমা নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় তাকিয়ে ছিল সমরের দিকে। সে গুনে কত নক্ষত্র বলবে সেই আশায়। নিশ্চয়ই বলবে সেই দু হাজার তিনশো ছত্রিশ। কিন্তু যখন বলল তখন দেখা গেল মাত্র একটা বলছে সমর, মাত্র একটা নক্ষত্র আকাশে!

কী বাজে বকছ?

হ্যাঁ ঠিক বলছি সোমা। তোমার আকাশে একটাই নক্ষত্র।

সোমা হেসে দিয়েছিল, বলেছিল, থাক মশাই, আপনাকে আর নক্ষত্র গুনতে হবে না। নিচে চলুন। বর এসে গেছে। এ—ভাবে দুজনকে ছাদে দেখে ফেললে নির্ঘাত প্রেম করছি ভাববে।

সমর এতবেশি স্মার্ট কথাবার্তা আশা করেনি। সে বলেছিল, তাহলে মেয়েরা প্রেম—ফেম করে আজকাল?

মেয়েরা করে না তো ছেলেরা করে?

কারা যে কী করে সোমা বুঝি না। তবে সত্যি বলতে কি, তোমাকে দেখলে প্রেম না করে পারা যায় না। কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

আর আমার তখন ইষ্টনাম জপতে ইচ্ছা হয়।

কিছু ইচ্ছা—টিচ্ছা হয় না সোমা?

হবে না কেন? সবই হয়।

আমারও যে কী ইচ্ছা হয়! হলে পরে ভালো লাগে না! একা দাঁড়িয়ে তখন নক্ষত্র গুনি। তবে কী জান, আমার আকাশে সব সময় সেই দু হাজার তিনশো ছত্রিশ। কেউ আমার দিকে তাকায় না। বড় কষ্ট হয় সোমা। সমর সত্যি কেমন বলতে বলতে সিরিয়াস হয়ে গেল।

এই রে খেয়েছে। এবারে আর রক্ষা নেই। ঠিক অরণ্যদেবের পাল্লায় পড়ে যাব। সোমার জন্য ঝড় জল, নদী সমুদ্র এবার সাঁতরে পার হয়ে যাবে মানুষটা।

সমর বলেছিল, তা তুমি ঠাট্টা করতে পার। তুমি কী তেল মাখো সোমা?

আমি তেলই মাখি না।

এমন সুন্দর চুল।

চুলে তেল মাখলে আজকাল চুল উঠে যায়।

কেন? কী কারণ?

তোমাকে আমাদের ফার্মে নিয়ে যেতে পারি। কী করে বাংলাদেশে টাকা তৈরি হচ্ছে দেখাতে পারি। ভেবেই তার মনে হল কী যে ভাবছে! সমরকে সে এখন পাবে কোথায়? তার ফার্ম তখন ছিল কোথায়? সে তো তখন বেঙ্গল কেমিক্যালের কী একটা তেল মাখত। এখন সে তেলের নাম মনে করতে পারছে না।

সোমা এবার চারপাশে লক্ষ্য রাখল। মাঝে মাঝে সে এ—ভাবে একা বের হয়। কলকাতার ফুটপাথে এবং গাছের নিচে অথবা গাড়ি বারান্দার নিচে অজস্র দুঃখী মানুষের ছবি দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। যেন বাংলাদেশের সব মানুষ চোখ বুজে আছে। এত বড় অসাম্য কারও চোখে পড়ছে না। সে মাঝে মাঝে কোনো যুবতী, হয়তো পাগল কিংবা অভাবে অনটনে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, ফুটপাথে দেখতে পায়। একা একা হেঁটে যাচ্ছে। গায়ে কোনো জামা—কাপড় নেই। অথবা কোনো কোনো রাতে সে বাড়ি ফেরার সময় দেখে ফুটপাথে উলঙ্গ মানুষ, অথবা এক বৃদ্ধ দীর্ঘদীন না খেতে পেয়ে মরে আছে। সে বাড়ি ফিরেই কেমন চুপচাপ বসে থাকে।

এ—সব দেখলেই সোমার মনে হয়, চুলে যে কোনো তেল মাখে না সেই মানুষটার মুখ উঁকি দেয় মনে! সে কে? সে কেন সহসা এসেছিল সেখানে? সে কেন তাকে এ—ভাবে টানছে? তার তো এখন কোনো অভাব নেই। সে বিরাট প্রাচুর্যের ভিতর দিনযাপন করছে। সময় কাটছে না বলে কোনো মিশনারি কলেজে অধ্যাপনা। গাড়িতে যায়, গাড়ি চালিয়ে নিজে ফিরে আসে। এই যে সে বলে এসেছে অফিসের আগেই সে বাড়ি ফিরবে, ফিরতে সে নাও পারে, তাতে মনীষের কোনো অসুবিধা হবে না, কারণ অফিসে তার কয়েকটা গাড়ি। নিজের নামে কোনো গাড়ি নেই। সে হাত ফাঁকা করে বসে রয়েছে। বড় চালাক মনীষ। এবং সেই মানুষের মুখ মনে পড়লেই সোমার কেন জানি মাঝে মাঝে মনীষকে বড় ধূর্ত মনে হয়।

কই, তুমি বললে না—তো সোমা, কী তেল মাখো?

কী তেল মাখি আমি জানি না সমর।

সে কী হয়! তুমি তেল মাখো তার নাম জানো না?

তুমি কী আমার মাথায় তেলের গন্ধ পাচ্ছ?

খুব সুন্দর তেলের গন্ধ।

ওটা তেলের গন্ধ নয় সমর। ওটা আমার শরীরের গন্ধ।

সমর বলল, সোমা, তোমার শরীরের এমন সুন্দর গন্ধ ভাবা যায় না।

কী করি বল। থাকলে তাকে তো ফেলে দিতে পারি না।

সমর ছাদে দাঁড়িয়ে আরও গল্প করতে চেয়েছিল। সোমার কেন জানি আর গল্প করতে ভালো লাগছিল না। নিচে মানুষজনের কোলাহল। কেউ কেউ উঠে দেখে গেছে সমর সোমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কী করছে। একবার সোমার মা সোমাকে ডেকেও গেছে। ও—ভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করলে চলবে? নিচে কত কাজ!

সমর বলেছিল, যাই মাসিমা।

সোমা বলেছিল, যাচ্ছি। তুমি কি এখন নামবে না সমর?

না। আমার এখানে কেন জানি আজ একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

সোমা আর দেরি করেনি। সে নিচে নেমে গিয়েছিল। আয়নার ভিতর সে নিজেকে দেখেছিল। খুব সে তেমন সাজেনি। মুখে সামান্য পাউডার! এবং পোশাকে সে সবসময় সাধারণ। অথচ সে বুঝতে পারছে এই পোশাকই ওকে আজ এ—বাড়ির সবচেয়ে দামি এবং নামি মেয়ে করে রেখেছে। সে লক্ষ্য করেছে, সে একবার যেখানেই গেছে, মৃদুগুঞ্জন। মাইরি ভাই, আমি আর থাকতে পারছি না। কী রে, খপ করে ধরে ফেলব? আহা কী যে হেরিনু! সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে! আসলে কী যে অন্ধকার! আমি জানি না, আমার আজ কী হবে! কত রকমের সে কথা শুনতে পায়। আগে সে এ—সব কথায় মনে মনে রাগ করত, কিন্তু কেন জানি তার এ—সব দিনে দিনে গা—সওয়া হয়ে গেছে। এবং সে যত বড় হচ্ছে, মানুষেরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকলে তার ভালো লাগে। সে ওদের কথায় রাগ করে না। মুচকি হাসে। এই হাসিটুকু কী যে রহস্যময়ী করে রাখে সোমা বুঝি জানত না। আর এই রহস্যময়তাই সোমাকে এত বেশি দামি করে রেখেছে। মনীষ কিছু বলতে পারে না। কিছু বললেই যেন সোমা তার ঘরে আর থাকবে না। সে সারা শৈশবে এবং সে যখন তরুণী ছিল, যে সব স্বপ্ন দেখত, সেই সব স্বপ্নের ভিতর ডুবে যাবে অথবা হারিয়ে যাবে।

সোমা সারাক্ষণ কাজ করেছিল তারপর। সে সমরের কথা ভুলে গিয়েছিল। সবাই ওকে ডেকে যেন কিছু বলতে চায়। কিছু যেন জিজ্ঞাসা করতে চায়। সে আর চারপাশে তাকাতেই পারে না। চোখ তুলে তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে তার ভারী লজ্জা লাগে।

সে চারপাশে তাকিয়ে কাজ করেনি বলেই জানে না সমর তখন কোথায়। যখন বরযাত্রীরা খেয়ে চলে গেল তখন ওর হুঁশ হয়েছিল সে অনেকক্ষণ সমরকে দেখছে না। এ—বাড়িতে একমাত্র সমরই সাহস করে ওর সঙ্গে আলাপ জমিয়েছে। আর যারা ওর মতো তরুণী অথবা যুবক পাশাপাশি, তারা কেউ আসেনি আলাপ করতে। পরিচয় করিয়ে দিলে কেমন নাবালকের মতো ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। ভীতু কাপুরুষ মনে হয়েছিল সবাইকে। বরং সমরই বলেছিল, তোমার হাতে কী কাজ?

কিচ্ছু না।

চল ছাদে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করি।

কী গল্প করবে?

যে গল্প করতে তুমি ভালোবাসবে।

এমন কথায় সোমা সাড়া না দিয়ে পারেনি। চল। তারপরই আকাশের নক্ষত্র দেখা! সেই মানুষটাকে সারা বাড়িতে সে কোথাও আর দেখতে পেল না। রাত গভীর হয়ে গেছে। সবাই খেয়ে চলে গেছে। জলিকে নিয়ে সে কিছুক্ষণ মেতে ছিল। ওর বরকে নানারকম ঠাট্টা—রসিকতা করেছে। জলির বরটা যে কি! সে কথা বলতে পর্যন্ত পারে না যেন। ওর মনে হয়েছিল, মানুষটা দেখাচ্ছে এমন, যেন সে কিছু জানে না। তুমি যে সব জানো মশাই সে আমার জানতে বাকি নেই। আজ রাতে সবুর সইবে তো? এই জলি, আজ রাতে কিছু করেছিস তো খুব খারাপ হবে।

জলির বর এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন সে সোমাকেই খপ করে পাশে বসিয়ে ঠেলে ফেলে কী যে করে ফেলবে! সোমা চোখ দেখলেই মন দেখতে পায়। মানুষটা বড় বজ্জাত। সব জানে, অথচ নাবালকের মতো মুখ করে রেখেছে। এ মশাই, মুখ তুলুন। আপনাকে দেখে কে বর কে কনে বোঝা মুশকিল।

নানারকম সুবাস, এবং বাসর জেগে সোমার ক্লান্তি এসেছিল। ঘুম এসেছিল। সে উঠে বাইরে গেল। সমর গেল কোথায়? সমর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছিল ঠাট্টা করে। সে কী সেখানেই আছে? সে কি কিছু খায়ও নি? ওর কেন জানি মনে হল ওকে খুঁজে দেখা উচিত। এ—বাড়িতে একমাত্র সমরই নিজের মানুষের মতো ব্যবহার করেছে। সবাই যখন কোনোরকমে জায়গা করে নিচ্ছে শোবার, যখন মাসিমা—মামিমারা ঘরে গোল হয়ে বসে আছে, জায়গা নেই বলে ঘুমাতে পারছে না, ওদের বিয়ের দিনের গল্প বলে হাসাহাসি করছে, তখন সোমা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙছিল। সে কোথায়? সমর, সে ধীরে ধীরে ডাকল, সমর তুমি আছ?

ছাদে উঠেই সোমা দেখেছিল সমর সেই একভাবে ছাদের কার্নিসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সোমা যে ডাকছিল, তা পর্যন্ত ওর খেয়াল নেই। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে আকাশ দেখছে। কী সুন্দর আকাশ, কত নক্ষত্র, নিচে দুই তরুণ—তরুণী। কাছাকাছি, অথচ ওরা কতদূরে। সোমা সমরের পাশে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না। নিচে বাসর। সবাই ঘুমিয়ে গেলে হয়তো মানুষটা জলিকে জিজ্ঞাসা করবে, তুমি আমার দিকে ও—ভাবে তাকালে কেন? জলি বলবে, কীভাবে?

সে বলবে, এই যে যেন আমি একটা চাষা মানুষ, তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।

জোর করেই তো নিয়ে যাচ্ছ!

জোর করে না নিয়ে গেলে তোমাকে পেতাম কোথায়? বলে হয়তো জলির হাতটা দুহাতের ভিতর রেখে জলির শরীরের উষ্ণতা মাপছে এখন। জলি শিউরে উঠছে। ওর ভিতরটা কাঁপছে। মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তুমি আমাকে নাও। আর পারছি না। কতদিন এই এক অপেক্ষাতে ছিলাম।

সোমা ডাকল, সমর।

বল।

এ—ভাবে সারাক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে?

থাকতে ভালো লাগল সোমা।

খেলে না?

খেতে ইচ্ছে হল না।

না খেলে শরীর খারাপ করবে।

একদিন না খেলে কিছু হয় না।

কী দেখছিলে এতক্ষণ?

আকাশ দেখছিলাম।

আকাশে এত কী?

কী যে জানি না। সারা আকাশে সোমা বিশ্বাস কর তোমাকে দেখেছি।

আমাকে তোমার সত্যি ভালো লাগে?

সমর হাসল।

সোমা ওর আরও কাছে গেল। জান কী যে হল, বাসর জেগে আমারও ভালো লাগছিল না। কেবল তোমার কথা মনে হচ্ছিল।

সত্যি?

সত্যি।

আর কিছু লাগে না সোমা। আমার আর কিছু লাগে না। বলে সে কাছে এসেছিল। এবং ওর কপালে চুমু খেয়েছিল।

গালে খাও।

সমর ওর গালে চুমু খেয়েছিল।

ঠোঁটে।

সমর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল।

তারপর সমর সম্মতি পেয়ে আরও দূরে হাত দিতে চেয়েছিল। সোমা বলেছিল আজ আর না। প্রথম রাতে এর চেয়ে বেশি দিতে নেই।

সোমা পরদিন সকাল না হতেই বাড়ি ফিরে এসেছিল। সেই মধুর ঘটনার আর বাড়াবাড়ি সে চায়নি। তাকে কত বড় হতে হবে। তার সামনে কী সুন্দর ভবিষ্যৎ। আর এক জায়গায় আটকে থাকলে চলে না।

সোমা এবার গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল।

ছয়

সোমা গাড়ি থেকে নামল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হল দরজা বন্ধ কফি হাউসের। সে ঘড়ি দেখল। ন’টা বাজেনি। সে উত্তেজনার মাথায় খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। সে এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর দিকে সে এগিয়ে গেল। সে দুটো একটা বই হাতে নিয়ে দেখছে। পছন্দ হলে কিনে ফেলবে। অনেকদিনের অভ্যাস এটা। সে এখান থেকে বহু দুর্মূল্য বই কিনে নিয়ে গেছে একসময়। তার পড়ার বাতিকের চেয়ে সংগ্রহের বাতিক বেশি।

কিন্তু কী যে মনের ভিতর হচ্ছে। একটা দুটো বই দেখেই তার কেমন হাঁপ ধরে গেল। সে এবার গাড়িতে এসে বসল। মাথাটা ধরেছে মনে হয়। মাথা ধরা আজকাল নানা কারণে ঘটছে। সকালে কোনোদিন মাথা ধরেনি। আজ এই প্রথম। সে কফি হাউস খুললে, প্রথমেই এক গেলাস জল চেয়ে নেবে। এবং একটা অ্যাসপ্রো খেয়ে ফেলবে। সে ব্যাগে অ্যাসপ্রো খুঁজতে থাকল। কেন যে সকালে মাথা ধরা—বিকেলে হলে সে বুঝত যেমন ঘটে তাই ঘটছে। তারপরই মনে হল, সে এখানে কেন এসেছে? সেই মুখ এবং উদাসীনতা লক্ষ্য করবে বলে? মনে হয়! সে কি এখানে এখন আসবে? এলে সে বিকেলে আসতে পারে। নাও আসতে পারে। তাকে সে আবার দেখলে যেন ঠিক চিনে ফেলতে পারত। তাহলে মনের ভিতর যে কষ্টটা, ওকে কোথায় যেন দেখেছি, সে আমার মনের মানুষ যে রে, গানের কলির মতো একটা মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে ভেসে হারিয়ে যাচ্ছে।

যাক, তবে একটা অ্যাসপ্রা পাওয়া গেল। সে অ্যাসপ্রোটা হাতের দু আঙুলে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নিরাময় হবে সে এবার। সংসারে মাঝে মাঝে এমন ট্যাবলেট খেলে মানুষ ভাবে নিরাময় হয়ে যাচ্ছে, বস্তুত কেউ নিরাময় হয় না। অসুখ তার ভেতরেই থাকে। সে তাকে নিয়ে শুধু বড় হয়।

ঘড়িতে ন’টা বাজল। সোমা ওপরে উঠে গেল। একগেলাস জল চেয়ে নিল। সে ট্যাবলেটটা ঘুমের বড়ির মতো মুখের ভিতরে ফেলে দিল। তারপর চারদিকে তাকাতেই মনে হল কফি হাউস ফাঁকা। কেউ আসেনি। এত বড় হলঘরটায় কেউ নেই। তাদের এবার কাজ আরম্ভ হবে। এক দুই করে এসে সবাই বসবে। ওরা সোমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এই সকালে এমন মেয়ে, মুখ—চেনা, একসময় এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মেরে গেছে। সুতরাং ওরা কেউ কাছে এসে দাঁড়াল। কী দেব?

সোমা বলল, আচ্ছা আবদুল, তোমার মনে আছে কাল ঐ কোণের টেবিলে পুল—ওভার গায়ে একজন বসেছিলেন? এই তোমার তখন সাতটা কী সাড়ে সাতটা হবে হয়তো।

আবদুল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। কত মানুষ আসে, সে কী করে জানব।

আচ্ছা ঐ কোণের টেবিলে কাল বিকেলে কে সার্ভ করেছিল বলতে পার?

আবদুল কাউন্টারে গিয়ে কী ফিসফিস করে বলল। ভিতরে তখন একটা কাচের গেলাস ভেঙে পড়ার শব্দ। ঝনঝন। বুকটা কেঁপে উঠল সোমার। সে বুঝি এল। তুমি জান সে লোকটাকে?

সে বলল, না দিদিমণি। আমি ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।

কেন মনে নেই তোমার? সে পিছন ফিরে বসেছিল।

সে বলল, না। তারপর সে আর দাঁড়াল না। উত্তরের দিকে দুজন ভদ্রলোক এসে বসেছে। ওরা রোজই এ—সময় এখানে আসে। এক কাপ করে কফি এবং এক প্লেট স্যান্ডউইচ খেয়ে ওরা কোথায় একসঙ্গে কাজে যায়। ওদের কাছ থেকে এখন আর অর্ডার নেবার প্রয়োজন হয় না। এলেই কফি আর স্যান্ডউইচ দিয়ে আসে। ওটা ওর টেবিল বলে, সে চলে গেল।

সোমা এখন একা। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। সুভাষ বসুর ছবি। কিছুদিন আগে গান্ধী এবং নেহরুর দুটো ছবি ছিল। এখন আর সে ছবি দুটো নেই। নামিয়ে রাখা হয়েছে। অথবা চারপাশে যে সব তরুণেরা সমাজকে বদলে দেবার নেশাতে মেতে উঠেছে, তাদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য, নিরাপদ জায়গায় বোধহয় সরিয়ে রেখেছে।

ওর যে এখন কী করণীয়! সে বসে বসে এক কাপ কফি খেল। চোখে—মুখে ভীষণ দুশ্চিন্তার ছাপ যেন। এত বড় শহরে একজন অপরিচিত মানুষকে খুঁজছে। সে কোথায় পাবে তাকে। সে কাকে জিজ্ঞাসা করবে, করতে পারলে যদি কোথাও তার ঠিকানা মিলে যায়। ওর পাশাপাশি যেসব মুখ ছিল, সে যে কী বোকা, যদি একটা মুখ ভালো করে দেখে রাখত তবে আর একজন সাক্ষী থাকত তার, আচ্ছা আপনি বলতে পারেন, আপনার টেবিলে পিছন ফিরে যিনি বসেছিলেন তার নাম কী, কোথায় থাকেন?

সোমা কাউকে দেখেনি। একমাত্র চুরি করে টেবিলের সেই মানুষটিকে সে দেখেছে। ওর উচিত ছিল, টেবিলের সব মুখগুলো একবার ভালোভাবে দেখে রাখা। তবে সে অন্তত আজ অথবা কাল কাউকে কফি হাউসে পেয়ে যেত। পেয়ে গেলেই সে তার সন্ধান পেতে পারত। বোকার মতো তাকে এ—ভাবে বসে থাকতে হত না।

সুতরাং সে উঠে পড়ল। এই সকালে এখানে একা বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বস্তুত সে যে কী চায়, তার কী পাওয়ার কথা ছিল, সে যেন নিজেও জানে না। কেবল সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা হলেই যেন বলে দিতে পারত, তুমি সোমা এই চেয়েছিলে, এখন তুমি সব ভুলে গেছ। আর কী করা। সে ধীরে ধীরে নেমে গেল। তারপর বাড়ি। এবং দীর্ঘ সময় বসে থাকা। শুয়ে থাকা। এই যে দীর্ঘ সময় সে একা বাড়ি থাকবে তখন তার মনে হয় সব প্রাচুর্য অহেতুক মনীষ দুটো মানুষের জন্য আটকে রেখেছে। এত দরকার কী? সেই মানুষটাকে দেখার পর থেকেই এমন মনে হচ্ছে তার।

সোমা ভাবল, সে আবার বিকেলে আসবে ওকে খুঁজতে।

সে বিকেলে এসেছিল। রাতে চুপচাপ কোণের একটা টেবিলে বসেছিল। বিনুর সঙ্গে দেখা। বিনু অবাক। তুমি এখানে?

তোমাদের কাছে এলাম।

ওরে বাপস! কী বলছ!

আচ্ছা বিনু, কাল তুমি লক্ষ্য করেছিলে একজন যুবক হবে হ্যাঁ বেশ লম্বা—চওড়া মানুষ, সাদা পুল—ওভার গায়ে, কালো প্যান্ট পরনে ঐ কোণের টেবিলটায় বসেছিল, এবং আমাকে মাঝে মাঝে চুরি করে দেখছিল!

বিনু পাশে একটা চেয়ার টেনে আনতে আনতে বলল, আমি যেদিকে তাকিয়েছি দেখেছি সব চোখ তোমার দিকে। চুরি করে সবাই তোমাকে দেখছিল, এবং তোমার দেখা মানুষটি যে কে কী করে বলব!

সোমা কথা বলল না আর। বিনু বলল, কফি খেয়েছ?

আমি খাব না, তুমি খাও।

আমি মটন ওমলেট নিচ্ছি সঙ্গে।

নাও।

বিনু বলল, মনীষ এল না?

সোমা তাকাল বিনুর দিকে, সে এখানে আসে না বিনু।

কাল যে এল!

কাল এল, সেই ছবিটা দেখে ওর অতীত দিনের কথা মনে পড়ে গেছিল।

খুব আবেগের বশে এসে গেছে। আর আসবে না।

তুমি এলে?

আমি এসেছিলাম ওর সঙ্গে আমার দরকার ছিল।

কী দরকার?

কী যে দরকার আমি ঠিক জানি না। ওর সঙ্গে দেখা হলেই সে বলে দিতে পারত আমার কী দরকার।

তুমি নিজে তোমার দরকারের কথা জান না, তার সঙ্গে দেখা হলে তোমার কী দরকার সে বলে দিতে পারত—কেমন কথা?

ঠিক কথা বিনু। আমরা যে কী চাই নিজে বুঝে উঠতে পারি না। আর একজন মানুষের দরকার হয়, সে বলে দিতে পারে, তোমার এটা দরকার সোমা, তোমার ওটা দরকার নয়। অনর্থক তুমি ছুটে মরছ।

ওসব তত্ত্বকথায় আমি নেই সোমা। তাহলে আমি খাচ্ছি।

খাও।

বিনু বলল, তুমি এলে মাঝে মাঝে ভালো—মন্দ খাওয়া যায়।

তুমি আরও কিছু খাবে?

না, আর না। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু পেটে সহ্য হয় না। পেটে বোধহয় আলসার হবে। মাঝে মাঝে ব্যথা হয়।

তবে এসব ছাইপাঁশ খাওয়া কেন?

খেতে খুব ভালো লাগে। আজ জান, আমাদের ওখানে আবার গণ্ডগোল। টু উইকেট ডাউন।

সোমার মুখটা ব্যথায় নীল হয়ে গেল।

কী সুন্দর ছেলে দুটো। তাজা। একেবারে ফুলের মতো তাজা। গলগল করে রক্ত পড়ছে। পুলিশ গলায় গুলি চালিয়েছে।

সোমা আর কথা বলতে পারল না।

ওদের কে যে এমনভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে বুঝি না। ওরা দুজন একজন সার্জেন্টের গলা কেটে ফেলেছিল।

সোমা বলল, তুমি খাও। আমার ভালো লাগছে না ওসব শুনতে।

বিনু বলল, আমি তাড়াতাড়ি চলে যাব। তুমিও তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। কখন কোথায় কীভাবে গণ্ডগোল বেধে যাবে বুঝতে পারবে না।

সোমা এবারও কোনো কথা বলল না। সে চারপাশে কাকে খুঁজছে। সোমা উঠছে না বলে সে—ও উঠতে পারছে না। সোমা কথাবার্তা আরম্ভ করল। সুধীর, অশোক এল না?

সবাই তো ভয়ে মরছে। এদিকে আসা সবাই এখন ছেড়ে দেবে। সাতটার পর রাস্তা ফাঁকা। তোমার কী মনে হয় এদেশে সিভিল ওয়ার শুরু হবে?

জানি না। ওর সঙ্গে দেখা হলে তোমাকে সব বলে দিতে পারতাম। সে বলল, অবশ্য মনে মনে। বিনু, আমার স্বামী মনীষ। সে এখন কত বড় ঘুষে কত বড় ইমপোর্ট লাইসেন্স দিল্লির উদ্যোগভবন থেকে বের করতে পারে তার মুসাবিদার জন্য ছুটোছুটি করছে। সে সংসারের এই অমঙ্গলের দিকটা দেখতে পাচ্ছে না।

বিনু বলল, তুমি কিছু ভাবছ সোমা?

কী ভাবব?

এই যে লক্ষ লক্ষ বেকার, আমার ভাইটা আজ চার বছর এঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বসে আছে। এখন বাড়ি থাকে না। রাত করে ফেরে। আমরা বাড়ির সবাই ওর জন্য রাত জেগে থাকি।…কেবল মনে হয় আমার ভাইটাকে কেউ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে কে সোমা?

সোমা বলল, তুমি উঠবে বলেছিলে, চল উঠি।

তুমি একা এতদূর যাবে? সঙ্গে যাব তোমার?

না। বরং চল আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই।

না, সে কী করে হয়।

কী করে হয় দ্যাখো। বলে জোর করে সে বিনুকে গাড়িতে তুলে নিল। বলল, জান বিনু, আমাদের দেশের এই অবস্থা চোখে দেখা যায় না।

তুমি এমন কথা বলছ!

খুব খারাপ লাগে। রাতে একটা ভিখারি মেয়ে আমাদের বাড়ির নিচে রোজ পড়ে আছে দেখতে পাই।

তা খেতে না পেলে কী করবে? আশ্রয় না থাকলে যাবে কোথায়?

সে আজ হোক কাল হোক মরে যাবে।

তা যাবে।

মনীষকে মাঝে মাঝে বলি, এত দিয়ে আমাদের কী হবে?

কী কথায় কী কথা! বিনু বলল, মনীষের সঙ্গে তোমার রাগারাগি হয়েছে সোমা? আমি কাল যাব।

আমি রাগ করি না। কারণ রাগ করে আর লাভ নেই। আমরা দিন দিন একচক্ষু হরিণ হয়ে যাচ্ছি।

তারপর সোমা আর কথা বলল না। মানুষজন পাতলা। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। একটা বস্তির মতো জায়গার কাছে সোমা বিনুকে নামিয়ে দিল। বস্তির ভিতর দিয়ে বিনুকে যেতে হয়। সে যেতে যেতে মানুষের অসন্তোষ চারপাশে ফেটে পড়ছে দেখতে পেল। কারণ একটা কলের গোড়ায় আট—দশ তরুণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটি খুঁড়ছে। বিনুর মনে হল ওর ভাইটা ওদের ভিতর আছে। তাকে ডাকতে পর্যন্ত বিনুর সাহসে কুলাল না।

সোমা একা একা যাচ্ছে। এত বড় কলকাতা নগরী, ট্রাম বাস অজস্র মানুষ, আর তাদের সেই অসন্তোষ, যেন সবাই ফেটে পড়বে—বলবে, আমরা এ চাই না, আমরা অজস্র এই তরুণের মৃত্যু চাই না—তখন সোমা জানে, তার স্বামী, মনীষ, বাজারে তেলের অভাব, সে হোয়াইট অয়েল প্যাক করে কেমিক্যাল ঘ্রাণ মিশিয়ে বাজারে নারকেল তেল বলে চালাচ্ছে। মনীষের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকা হাওয়ায় উড়ছে। কেবল কুড়িয়ে নিতে জানা চাই।

মনীষ কিছুতেই কেন জানি সংসারের অমঙ্গলের দিকটা দেখতে পাচ্ছে না। সোমার চোখে জল চলে এল।

সাত

কে যেন হেঁকে যাচ্ছিল তখন, গ্রামে গ্রামে আজ নতুন দিনের ফসল উঠছে, যে যার ফসল ঘরে তুলে নিন।

সোমা গাড়ি চালাতে চালাতে সেই হাঁক শুনতে পেল। কে হাঁকছে। সে গাড়ি চালাতে চালাতে লক্ষ্য করল না, কেউ হাঁকছে না। রাস্তার মানুষের ভিতর তেমন কেউ মানুষ নেই যে এমন হাঁকতে পারে। সবাই বাড়ি যাবার জন্য ছুটছে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। চারপাশে কী হচ্ছে দেখছে না। বাড়ি পৌঁছে গেলেই যেন রক্ষা। তার তাকে কিছুতে পাবে না। সোমা এ—সময় মনে মনে না হেসে পারল না। আটটা না বাজতেই আবার গাড়ি—বারান্দায়, ফুটপাথে, গাছের নিচে সব অসহায় মানুষদের শুয়ে পড়ার দৃশ্য। সোমার মনে হল, সেইসব জায়গায় মানুষটা এখন অদৃশ্য হয়ে আছে, এবং হাঁকছে, যে যার ফসল ঘরে তুলে নাও।

সে একবার কুলু উপত্যকাতে বেড়াতে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে সোমা মোটরে যেতে যেতে কত সরাইখানা, নদী, মাঠ, পাহাড় দেখেছে। দেখেছে মাথার ওপর নীল আকাশ আর অজস্র পাখি এবং শীতের রোদ। সেই রোদে কত হাজার লক্ষ অসহায় মানুষের মুখ। দেখলে মনে হবে যেন কতদিন ওরা কিছু খায়নি। সোমার তখন আর উপত্যকার ফুল ফল নজরে আসেনি। বাবার মুখ মনে হয়েছে। বাবার আত্মহত্যার পরের মুখ। অসৎ মানুষের পাল্লায় পড়ে বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। যেন বাবার মুখে সোমা পড়তে পেরেছিল, এমন এক সমাজে আমরা আছি সোমা, যেখানে আমাকে চুরি করে তেলেভাজা খেতেই হয়। তুই আর কী করবি।

সোমা যেতে যেতে চারপাশে লক্ষ্য রাখছে। খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। কলকাতায় জোরে সে কখনও গাড়ি চালাতে পারে না। পায়ে হেঁটে গেলে বুঝি আগে চলে যাওয়া যায়। ফলে যত মানুষ আছে তাদের মুখ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। আবছা তাদের মুখ। আবছা বলেই সে যেন বুঝতে পারে—মানুষেরা কত উদ্বিগ্ন। ওর মায়া হয়।

বাড়ি ফিরতে বেশ রাত করে ফেলেছিল সোমা। সে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। মনীষ ব্যালকনিতে পায়চারি করছিল—এবং ভীষণ উদ্বিগ্ন সে। সোমা এখনও ফিরছে না। রসুল সোমার সঙ্গে যায়নি। একা বের হয়ে গেছে। তখনই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মনীষ বলল, ওকে সামান্য আঘাত দেবার জন্য যেন বলল, ওকে পেলে?

না।

গাড়িতে চড়ে ওসব মানুষের নাগাল পাওয়া যায় না সোমা।

মনীষ সোমাকে ঠাট্টা করছিল অথবা বিদ্রুপ। সোমা গায়ে মাখল না। মনীষ স্ত্রীর কাছে গেল। বলল, সোমা তুমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছ?

সোমা সোজা তাকাল মনীষের দিকে।

আমার তাই মনে হচ্ছে। তোমার কী হয়েছে বল? তুমি এমন করলে আমি বাঁচি কী করে!

আমার তো কিছু হয়নি মনীষ। তুমি অনর্থক চিন্তা করছ।

যদি তুমি তাকে খুঁজে পাও, তবে কী করবে?

কিছুই করব না।

তবে তাকে খোঁজার কী দরকার এত?

সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।

সোমা! মনীষ চিৎকার করে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, কাল থেকে আর বের হবে না। বলে দিলাম।

সোমা এ—কথা শুনে কী ভাবল মুখ দেখে বোঝা গেল না। সে যেমন অন্যান্য দিন স্নান করে রেকর্ড—প্লেয়ার নিয়ে বসে তেমনি বসেছিল। এবং গত রাতে যে—সব রেকর্ড বাজিয়েছে একা একা, সে সব বাজাল। সে মনীষের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত পারছে না। মানুষটার মুখ তাকে এত বেশি হন্ট করছে।

খাবার পর অন্তত মনীষ ভেবেছিল সোমা সহজ হবে। সে রাগ করলে খায় না। না খেয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু আজ মনীষ ডাকতেই সে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। বেশ পেট ভরে খেল। পেট ভরে খেলে মনীষের মনে হয় সোমার কোনো রাগ থাকে না। সে একটা দামি চাদর সোমাকে জড়িয়ে দিল। বলল, চল তুমি গান গাইবে, আমি শুনব।

সোমা বস্তুত সেই গানগুলিই ফিরিয়ে ফিরিয়ে গাইল, গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে….।

মনীষ জানে সোমার এই গান সেই এক মানুষকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া। সে যেন এ—সব গান মনীষকে শোনাচ্ছে না, সেই নিবেদিত প্রাণকে শোনাচ্ছে। মনীষ ভিতরে ভিতরে ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। তবু কিছু করতে পারছে না। সোমা যখন নীল চোখে তাকায় তখন মনীষের সব রাগ দুঃখ কেমন গলে যায়। মনীষ ওকে জড়িয়ে ধরল। সোমা কিছু বলছে না। ওকে শুইয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। সোমা কিছু বলছে না। মনীষ বলছে, এ—ভাবে ভালো লাগছে না। আজ তুমি লাল রঙের গাউন পরো। লাল রঙের নাইটি পরে এল সোমা। নিচে কোনো বাস নেই। সেই এক মোমের মতো নরম হাত—পা। সোমা হাত—পা বিস্তার করে দিল। মনীষ কেমন কুকুরের মতো শুঁকে শুঁকে ওর শরীরের দিকে এগুচ্ছে। অন্তস্তলে ডুব দেওয়া মাত্রই সোমা আর্তনাদ করে উঠল, মনীষ, চারপাশে কারা ঘিরে ফেলেছে বাড়িটা দ্যাখো। ওরা আমাদের পুড়িয়ে মারবে। বলেই মনীষকে শরীর থেকে ঠেলে ফেলে দিল সোমা।

মনীষের মুখে এ—শীতের রাতেও ঘাম। সে স্ত্রীকে জোর করে সাপ্টে ধরল ফের। সোমা এলোপাথাড়ি হাত—পা ছুঁড়ছে। না, না। আমি পারব না। আমাদের ওরা আজ হোক কাল হোক পুড়িয়ে মারবে। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমাদের ওরা কোনোদিন ক্ষমা করবে না।

কিন্তু মনীষ শুনছে না। কী যেন এক অমানুষিক লোভ ওকে তাড়া করে ফিরছে। আজ তিনদিন সোমা ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, নানারকমের অজুহাত সোমা দাঁড় করায়। সে কিছু শুনবে না। জোর করে বাঘ যেমন শিকার নিয়ে পালায় তেমনি সে সোমাকে পাঁজাকোলে করে নিজের খাটের দিকে এগুচ্ছে। আর সোমা, এক অবোধ বালিকার মতো হাত—পা ছুঁড়ে বাধা দিচ্ছে। ওর নাইটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। বলছে, মনীষ, ওরা এসে গেছে। ওরা আমাদের পুড়িয়ে মারতে এসে গেছে।

মনীষ কিছু শুনল না। সে তার স্ত্রীকে উলঙ্গ করে ফেলে রাখল। বলল, তুমি উঠবে না। উঠলে আমি তোমাকে হত্যা করব। মনীষ ওকে এবার যথার্থই ভয় দেখাল। উত্তেজনায় ওর হাত—পা কাঁপছে। কে এমন মানুষ, যে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে! একেবারে উঠবে না। আমি তোমার পাশে শোব। তোমাকে ধর্ষণ করব।

সোমা শক্ত হয়ে থাকল। কিন্তু মনীষের যতটা ইচ্ছা ছিল আজ ওকে ছিন্নভিন্ন করে দেবার, নীল চোখ দেখে সে আর তা করতে পারল না। শিয়রে বসে থাকল। এবং সহসা দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল, বল তোমার কী হয়েছে। খুলে বল। আমি তোমার জন্য সব করব।

সোমা পাশ ফিরে শুল। ঘরে আর কেউ আছে সোমার যেন মনে নেই। মনীষ বলল, তুমি উঠে দেখো কেউ আমাদের বাড়ির চারপাশে নেই। কেউ আমাদের পুড়িয়েও মারতে আসছে না।

সোমা ঘুমিয়ে পড়েছে।

মনীষ একা একা একটা মৃদু আলো জ্বালিয়ে পায়চারি করতে থাকল। তার ঘুম আসছিল না। গত রাতে সোমা যেমন শীতের রাতে ব্যালকনিতে চুপচাপ বসেছিল, আজ সে তেমনি নিজে সেখানে চলে গেছে। তার ভিতর সোমা কী করে যেন এক মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। সকালের কাগজ পড়ার পর সেই মৃত্যুভয় তাকে অনেকক্ষণ কাজের ভিতর ডুবতে দেয় না, তবু সে সারাক্ষণ কাজ—পাগলা মানুষের মতো অফিসে থাকে। আজ এখন সেই মৃত্যুভয় ওকে এমন জড়িয়ে ধরেছে যে একা একা ব্যালকনিতে পায়চারি করতে সে ভয় পেল। ওর কেন জানি মনে হল সত্যি কারা চারপাশে, মাঠ ঘাট অথবা গ্রাম থেকে মশাল জ্বালিয়ে শহরের দিকে উঠে আসছে। হাতে ওদের মশাল। এবং বর্শার ফলাতে মানুষের মৃত্যু নাচছে। ওর মনে হল ওরা সব অন্নহীন ভূমিহীন মানুষ। সে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবার যে ষড়যন্ত্র করেছিল, একা পেয়ে তাকে বর্শায় গেঁথে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ সোমার কেমন ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল শিয়রে কেউ বসে রয়েছে। তাকে ডাকছে। ওর প্রথম মনে হয়েছিল সেই মানুষটা তার শিয়রে বসে রয়েছে। তাকে ডাকছে। বলছে, ওঠ, চল, আমরা নতুন ফসল তুলতে যাই। এসো দ্যাখো, চারপাশে মানুষের ভিতর কী উল্লাস! স্বাধীন মানুষের কী আনন্দ! কিন্তু চোখ মেলে তাকালে দেখল, মনীষ হাঁটু গেড়ে বসে আছে পাশে। ওকে ভয়ার্ত কণ্ঠে ডাকছে—সোমা ওঠ।

সে উঠে বসল।

দ্যাখো একটা চিঠি। উড়োচিঠি।

কৈ দেখি।

এই দ্যাখো। বলে সে একটা চিঠি দেখালে।

কে দিল তোমাকে?

কে দিল জানি না। রসুল বলল, একটা লোক ওর দরজায় কড়া নেড়ে দিয়ে গেল।

সদর খোলা ছিল?

না। সদর খোলা ছিল না।

সোমা অবাক হয়ে গেল। দেখতে কেমন? রসুল ওর মুখ দেখেছে?

রসুলকে ডাকব?

না না। এখন থাক। চিঠিটা পড়।

মনীষ ভয়ে চিঠি পড়তে পারল না। তুমি পড়। আমার গলা শুকিয়ে উঠছে।

সোমা আলোর নিচে চিঠি রেখে পড়তে গিয়ে কেমন ভীত হয়ে পড়ল। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা। এমন যার হস্তাক্ষর, সে নিজে না কত সুন্দর। সে পড়ল, পড়তে পড়তে গলা শুকিয়ে গেল তার। সব খুঁটিনাটি তথ্য দেওয়া। এত খবর ওরা কী করে রাখে! শেষে লেখা, গণ—আদালতে আপনার বিচার হওয়া দরকার। আপনিই বলুন, যেভাবে আপনার ব্যবসা হাজার মানুষকে জাহান্নমে ঠেলে দিচ্ছে তার কী শাস্তি?

সোমা বলল, আমি জানি সে আসবে।

সোমা! মনীষ আর্তনাদ করে বলল, তুমি কী বলছ!

কী বলব বল? এমনই তো হবার কথা। আমাদের আইন তোমার এই ভেজাল ব্যবসা রুখতে পারছে?

তার জন্য জুলুম? ভয় দেখাবে?

আর কী করা। সোমা হাসতে থাকল। আমি তোমাকে ভালোবাসি মনীষ। আমার বাবা লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করল! কী সামান্য ছাপোষা মানুষ ছিলেন তিনি। রসুলকে তাড়াতাড়ি ডাকো। অনেক কথা জিজ্ঞাসা করার আছে।

রসুল এলে বলল, মানুষটা দেখতে কেমন রে?

রসুল বলল, বড় ভালোমানুষ। সে এসে ডাকল আমাকে, বলল, রসুল ভালো আছ?

তুই কী বললি?

বললাম, ভালো আছি কর্তা।

কর্তা বলছ কেন? আমার নাম অঞ্জন। তুমি আমাকে অঞ্জন বলেই ডাকবে।

নাম অঞ্জন বলল। অঞ্জন নাম তার! বলতে বলতে সোমা কেমন মূর্ছা গেল।

আমাকে তার নাম বলতে বারণ করেছে দিদিমণি। এই, এই, কী হল! দাদাবাবু কী হল?

কিছু না।

ডাক্তার ডাকি?

না। মনীষ, সোমাকে শুইয়ে দিল। আর শোয়ানোর সময়ই মনে হল তার সেই ছিন্ন—ভিন্ন নাইটি ওর গায়ে। রসুল এমন পোশাকে দিদিমণিকে কখনও দেখেনি। কিন্তু মানুষটার কথাবার্তায় কী জাদু আছে! সে একেবারে তার কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল! এবং সেটুকু না বলাতেই রসুলকে ডেকে এনেছে ওরা যে ঘরে বসে, সে ঘরে। সে কী করে জানবে, দুজনেরই তখন মূর্ছা যাবার মতো চেহারা। সে বলতে বলতে সব দেখছিল আর অবাক হয়ে যাচ্ছিল। মনীষ তাড়াতাড়ি বলল তুই বাইরে দাঁড়া। ওর চোখে—মুখে জল দিচ্ছি।

মনীষ এখন অঝোরে ঘামছে। এটা যে শীতের রাত মনেই হচ্ছে না। সে পর্দা তুলে বাইরে এসে বলল, রিভলবারটা ঠিক আছে তো?

সব ঠিক আছে দাদাবাবু। কিন্তু ও তো রিভলবারের মানুষ নয়। ওর চোখ—মুখ দেখলে আপনারও মায়া হবে।

রাখ তোর মায়া। বলে সে এক ধমক লাগাল। তারপর ঘরে ঢুকে দ্রুত পালটে ফেলল সোমার পোশাক। ওর চোখে—মুখে জল দিল সামান্য এবং চোখ খুললে বলল, তুমি ওকে চিনতে পারনি।

সোমা বলল, না।

আট

সোমা ডায়াল ঘোরাল। বলল, এটা কী থ্রি ফাইভ ফোর এইট টু ফোর?

ইয়েস। আপনার কাকে চাই?

অসিতবাবু আছেন? ওকে একটু ডেকে দিন না।

অসিতকে? অসিতের বাবার গলা সোমা বুঝতে পারল। আপনি কোত্থেকে বলছেন?

আমি সোমা, মেসোমশাই।

অ সোমা, তোমার কী খবর? কতদিন তোমাকে দেখি না।

আমার খবর ভালো মেসোমশাই! একদিন আপনাকে দেখতে যাব। তাড়াতাড়ি অসিতবাবুকে একটু ডেকে দিন না। ওর শরীরটা ভালো না। একবার এক্ষুনি আসতে হবে।

সোমা বুঝল অসিতবাবুর বাবা এবার ফোন ছেড়ে অসিতবাবুকে ডাকতে গেছে। সোমা এবার পাশের খাটের দিকে তাকাল। দেখল মনীষ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নিশ্বাস ফেলতে ওর কষ্ট হচ্ছে কেন জানি।

আমি সোমা বলছি অসিতবাবু। তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আপনার বন্ধুর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে ভয়ংকর ব্যথা।

যাচ্ছি।

সোমা রসুলকে বলল, সদর খুলে বসে থাক। অসিতবাবু আসছে।

মনীষ বলল, ওর বলতে কষ্ট হচ্ছে তবু বলল, না সদর খুলবে না। দরজায় এসে গাড়ি থামলে দেখে খুলবি। অন্য যে—কোনো লোক এসে ঢুকতে চাইলে গুলি করবি।

সোমাকে মনীষ অবিশ্বাস করছে। কারণ সোমা অঞ্জন, অঞ্জন এসেছিল বলতে বলতে মূর্ছা গেছে। বস্তুত সে একজনকে হয়তো চিনে ফেলেছে। ওর নাম অঞ্জন কিনা সে জানে না। অঞ্জন এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখ মনে পড়েছিল, সে মুখটার সঙ্গেই যেন বেশি মিল আছে কফি হাউসে সে যাকে দেখেছিল তার। কারণ সোমার নাম ছিল একসময় অঞ্জলি। সোমা ওর পোশাকি নাম। অঞ্জলি এবং অঞ্জু এই নামে কেউ তাকে ডাকত। একজন তাকে ডেকেছিল অঞ্জনা বলে। সেই মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সুন্দর মুখ ভেসে উঠল। দাড়ি—গোঁফ ওঠেনি তখনও, অথচ কী দুর্ধর্ষ সে, তার ভিতরটা, মনে হল এখনও কেঁপে ওঠে।

সোমা এবার মনীষের পাশে গিয়ে বসল।—একটু জল গরম করে সেঁক দিচ্ছি।

আরে ধুত্তোর তোমার সেঁক। আমি কথা বলতে পারছি না।

এতটুকু কম মনে হচ্ছে না?

মনীষ কথা বলতে পর্যন্ত পারছে না।

হঠাৎ তোমার এমন কেন হল?

মনীষ উপুড় হয়ে আছে। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। কেবল ঘামছে। সোমা যে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে চোখ মেলে দেখেছিল মনীষ অপলক ওকে দেখছে। ওর গলার কাছে হাত। যেন সোমার গলা টিপে মেরে ফেলবে। সোমারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। মরে যাবে এই ভেবে কষ্ট না। মনীষ তাকে অবিশ্বাস করে অযথা কষ্ট পাচ্ছে এই ভেবে। সে বলল, মনীষ, আমি তোমাকে কিছু লুকাচ্ছি না। অঞ্জন বলে আমি কাউকে চিনি না।

নয়

অসিত এসে দেখল, মনীষ শুয়ে আছে। সোমা পাশে চিন্তিত মুখে বসে রয়েছে। এবং অসিতকে দেখেই সোমা প্রাণ পেল যেন। বলল, আসুন। কী বিপদ দেখুন।

অসিত কথা না বলে মনীষের শিয়রে গিয়ে বসল। কী, কোথায় কষ্ট হচ্ছে?

মনীষ চিত হয়ে শুয়ে আছে। সে মাথা ঘোরাল না। কেমন চুপচাপ ছাদ দেখছে। হলুদ রঙের ছাদ এবং এটা বেডরুম নয়। এখানে সবাই আসতে পারে। এখানেও দুটো খাট আছে দুজনের। এখানে অসিত কেমন একটা নিরীহ গোছের ছবি দেখতে পাচ্ছে। গোটা বাড়িটা ভয়ে কেমন চুপচাপ।

সে বলল, কোথায়? এখানে? সে বুকে হাত রাখল।

বুকটা কেমন করছে অসিত।

এখানে লাগছে?

না।

সে চিন্তিত মুখে বলল, ওকে কাল একবার ভালো করে দেখতে হবে। এখন ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলাম।

সোমা ভাবল সেই চিঠিটা ওকে দেখাবে কিনা। চিঠিটা পাবার পরই ওর এমন হয়েছে। অসিতবাবু ঘরের লোক। ওর ছেলেবেলার বন্ধু। সুতরাং সে মনীষকে না বলেই চিঠিটা দেখাবে ভাবল। বলল, কী যে করি। ওকে কে একজন থ্রেটনিং চিঠি দিয়ে গেছে। ওটা পাবার পর থেকেই ওর এমন হয়েছে।

অসিত বলল, আপনাদের আপত্তি না থাকলে চিঠিটা দেখাতে পারেন।

আপত্তি থাকলে বলব কেন?

চিঠিটা লকার খুলে আনার সময় অসিত বলল, পুলিশে খবর দিয়েছেন?

পুলিশে খবর দেব কিনা ভাবছি।

কেন? অসুবিধা কী?

ওর ভয়—এতে ঝামেলা আরও বাড়ে। কাজের কাজ কিছু হয় না।

অসিত চিঠিটা পড়ে কেমন নিজেও বিব্রত বোধ করল। যা চিঠি এতে কার যে অপরাধ সে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। এগুলো যদি সত্যি হয়, তবে মনীষের স্বপক্ষে বলার কিছু নেই।

সে সোমাকে চিঠিটা ফিরিয়ে দেবার সময় একবার মনীষের খাটের দিকে তাকাল। মনীষকে কেমন বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সে সোমাকে বলল, চিঠিটা পড়ে মনে হয় কোনো মধ্যযুগীয় নাইট রাতের আঁধারে পাপ অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।

সোমা বলল, কেন যে হচ্ছে এমন!

মনীষ বলল, আর কাজ করা যাবে না। দেশের বেকারি বাড়বে।

ওর দিকে তাকিয়ে অসিত হাসল। তুই এখন ঘুমো।

আর কী ঘুম আসে! বলে সে পাশ ফিরে শুল। সে ভাবছিল সোমার কথা বলবে কিনা। কিন্তু পারিবারিক প্রেস্টিজ, সে কিছু বলল না। সোমা অঞ্জন অঞ্জন বলে মূর্ছা গিয়েছিল, সে কথা বললে যেন মনে হবে সব ব্যাপারটার সঙ্গে সোমা জড়িত।

অসিতই বলল, ওকে খুঁজে পেলেন?

কাকে?

ঐ যে বলেছিলেন খুব পরিচিত কাকে একবার দেখে মনে করতে পারছিলেন না কোথায় তাকে দেখেছেন?

তাঁকে খুঁজে পেয়েছি। সে ঠাট্টার সুরে বলল।

তাহলে আপনার অসুখ সেরে গেল বলতে হবে।

কীসের অসুখ?

এই যে মানুষের মাঝে মাঝে অসুখ হয়। সে চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না কী করছে। তবু করে যায়, খুঁজে যায়।

মনীষ আর পারল না। সে উঠে এল। তুই একটু বুঝিয়ে যা সোমাকে। সোমা বড় ছেলেমানুষ। চারপাশে এত যে দরিদ্র আর অন্নহীন মানুষ আছে তাতে আমরা কী করতে পারি?

কিছু পারি বইকি।

আপনি বলুন—আমরা পারি না? ইচ্ছা করলে পারি না?

অসিত! কী বলছিস আজে—বাজে! তুই যদি টাকা কুড়িয়ে না নিস, তবে অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে। টাকা পড়ে থাকবে না।

অসিত বলল, আমি জানি না, বুঝিও না এসব। তবে এ—ভাবে বেশিদিন চলে না। কলকাতার চারপাশে নজর দিলে যা চোখে পড়ে, সাধারণ মানুষের মাথা ঠিক থাকার কথা না। যদি কেউ এখন মনে করে থাকে, আর যখন কিছু করণীয় নেই, সব হাতের বাইরে, তখন মধ্যযুগীয় নাইট হয়ে যাওয়াই ভালো, যেখানেই পাপ সেখানেই ওদের তরবারি ঝলসে উঠবে।

তুই কী মনে করিস, ভয় দেখিয়ে আমাদের কাজ গুটিয়ে দিতে পারবে?

অসিত আবার হাসল। তুই উঠে এসেছিস কেন? শুয়ে থাক। উত্তেজনা এ—সময় খারাপ।

আমার ঘুম আসবে না অসিত।

সোমা বলল, লক্ষ্মী মনীষ, তুমি যা বলবে শুয়ে শুয়ে বল, আমরা শুনছি।

মনীষ বলল, আমরা যে—ভাবেই টাকা কামাই, ওতে করে তো দশটা লোকও কাজ পাচ্ছে। ওটা না করলে ওরাও কাজ পাবে না, খেতে পাবে না।

ঠিক আছে, তোর সঙ্গে এ—ব্যাপারে পরে আমি আলোচনা করব। এখন আর কোনো কথা নয়।

কথা বললে সে আরও উত্তেজিত হবে। এবং এতে খারাপ হবে। ওর যা মনে হচ্ছে—হার্ট ওর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। চিঠি পাওয়ার পরই হার্ট কারও দুর্বল হয়ে যায়। এবং ভয়ে সে মরে যায়। মনীষ ভয়ে মরে যাবে, স্বভাব ওর যাবে না। এ—সব তর্ক বৃথা। সোমাকে স্বপক্ষে সে টেনে নিতে পারত, কিন্তু কথায় কথা বাড়ে, সে ডাক্তার মানুষ, সে সমাজ—সংস্কারক নয়। সে রুগির যাতে ভালো হয় তাই করবে। এবং সেইমতো উপদেশ দিয়ে গেল সোমাকে।

অসিত যাবার সময় সোমাকে বলল, আপনার সেই ভয়টা গেছে তো?

কোন ভয়? ভয় কোথায় আবার!

এই যে রাস্তায় গরিব দুঃখী মানুষ অথবা ভিখারি মানুষ দেখলে আপনার ভয় হত। মনে হত ওরা হাজার লক্ষ হলেই ছুটে আসবে। যা কিছু সুন্দর, যাকে আপনারা এখন শিল্প বলছেন, একে একে ভেঙে তছনছ করে নতুন সমাজ তৈরি করবে।

এভাবে আমরা চললে, ওরা আজ হোক কাল হোক আসবেই। বলে সে সিঁড়ির দরজার কাছে এল। ওর মুখে অদ্ভুত কমনীয়তা। সে ডাক্তার মানুষ। মনীষ শুয়ে আছে। মনোরমা এখানে নেই। রসুল নিচে জেগে আছে। সে সারারাতই জেগে থাকবে। অসিত বলল, ভয় নেই কোনো। কাল এসে সব চেক করে যাব। আমার যা মনে হচ্ছে চিঠি পেয়ে এটা হয়েছে।

অসিত চলে গেলে সোমার মনে হল, এই এক ভয় নিরন্তর এখন কাজ করবে। তবু ওর কেন জানি মনে হল, সে যা চায় তা পায় না। কে সেই মানুষ? ওর বড় ইচ্ছা হচ্ছিল সেই মানুষটাকে দেখবে। সে ভিতরে ঢুকে দেখল মনীষ ঘুমিয়ে পড়েছে। মনীষ নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। দামি ইটালিয়ান সিল্ক এবং চোখে কাজল দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল। যেখানে রসুল আছে, সেখানে গেল। সে রসুলকে বলল, চিঠি দিয়ে কোনদিকে গেছে বলতে পারিস?

রসুল সদর খুলে দিল ভালো করে। দিদিমণিকে দেখেই আদাব দিল। বাইরে এসে ঠিক যেখানে অজস্র বোগেনভেলিয়ার গাছ একটা ঝোপের মতো সৃষ্টি করেছে সেখানে দাঁড়াল। ঐ দিকে নেমে গেছে।

ওটা তো মাঠ।

হ্যাঁ, তিনি মাঠের অন্ধকারেই নেমে গেছেন।

ও—মাঠের গাছগুলোর ছায়ায় যারা রাত কাটায় তুই তাদের কাউকে চিনিস?

না দিদিমণি।

আমার সঙ্গে আয়।

এত রাতে!

আয় না।

সদর খোলা থাকবে?

থাকুক।

কিন্তু তিনি যে বলেছেন সারারাত জেগে পাহারা দিতে।

কিচ্ছু হবে না। তুই আয়, আমি বলছি আসতে।

রসুল একটা পাগড়ি বাঁধল মাথায়। সে কোমরে বড় একটা ভোজালি ঝুলিয়ে ওর সঙ্গ নিল।

তিনি যদি রাগ করেন। রসুল কেমন আমতা আমতা করল।

তিনি ঘুমোচ্ছেন।

ওরা সদর খুলে ফের বন্ধ করে দিল। মনীষের অযথা ভয়। যারা আজ চিঠি দিয়ে সাবধান করে যায়, তারা সে রাতে আসে না। শোধরাবার একটা সময় দেয়। সে জানে মনীষ কোনোদিন আর শোধরাবে না। ওর অসুখ করবে। অসুখ নিয়েই সে বড় একটা অসুখের ব্যবসা চালিয়ে যাবে এই দেশে। দেশের মানুষকে সব নেড়ামাথা করে দিয়ে মনীষ নিজে কষ্ট পাবে।

সোমা দেখল গাছের নিচে অন্ধকার, বড় প্রশস্ত পথ। শোরুমে ইতস্তত আলো জ্বলছে। কিছু রাতের পোকা উড়ছিল। দু—একজন মানুষের সাড়া পাচ্ছে সে। সোমা রসুলকে নিয়ে বড় মাঠে ঢুকে গেল। এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে বরং ভয়। মাঠে অজস্র গাছ, এবং গাছের নিচে কারা চুপচাপ শীতের রাতে জেগে আছে মনে হল। কাছে গেলে অবাক, দেখলে সব কাতারে কাতারে মানুষ, ওদের পোশাক ময়লা, ছেঁড়া, শুকনো ঘাসের ওপর ছেঁড়া কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। ওরা কী গভীর ঘুম যাচ্ছে! দুঃখ বেদনা আছে মুখে। ফাঁক ফোকরে যে সামান্য আলো বড় রাজপথ থেকে ভেসে আসছে তাতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সকাল হলে এরাই এই বড় শহরে, অথবা রেল—ব্রিজের মাথায়, কখনও সূর্য অস্ত গেলে, বড় লাল বাড়িটার দিকে কেন জানি প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। সে রসুলকে বলল, তুই চলে যা। আমি এই মাঠে এক একা ঘুরব। আজ সে আসবে।

রসুল জানে মাথা খারাপ আছে দিদিমণির। সে কাছে থাকলে চিৎকার করতে পারে। বাড়ি গেলে বলতে পারে, রসুল তুমি বিদায় হও। কর্তাসাহেব যতই হামবড়া ভাব দেখান—এই দিদিমণির কাছে একেবারে বাচ্চা শিশুটি। কী যে করে রেখেছে! সে বলল, আচ্ছা যাচ্ছি।

বস্তুত সে গেল না। সে দূরে অস্পষ্ট আলোর ভিতর দাঁড়িয়ে দেখল দিদিমণি একা একা মাঠে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সোমা দেখল বেশ জ্যোৎস্না উঠেছে। শেষ রাত এখন। এখন রাতে এ ভাবে একটা মাঠে পায়চারি করা ঠিক না। কিন্তু সোমা জানে, রসুল পাশে ঠিক কোনো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছে। এবং সে রসুলকে যে—ভাবে জানে, তাতে রসুল সোমার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে যে—কোনো ভাবে। সে বেশ নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছে। কী যে সে খুঁজছে, মাঝে মাঝে ভুলে যায়। আসলে সে তাকেই খুঁজতে এসেছে। যদি সে এই মাঠে নেমে এসে থাকে, তবে ঠিক কোনো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং সোমার জন্য অপেক্ষা করবে। এটা কেন হয়, সে বোঝে না। সেই চোখ দুটো কী যে মায়াবী। হয়তো ওরা সেদিন বাড়ি ফিরে গেলে, সব খোঁজখবর নিয়েছে গোপনে। এবং সে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেখেছে, সদরে রসুল, হয়তো তাকে টপকে যাবার ক্ষমতা মানুষটার নেই। চিঠি দিয়ে চলে গেছে।

মানুষটার সঙ্গে তার খুব দেখা হওয়া দরকার। যেমন সে দেখা হলে বলতে পারত, এটা একটা মানুষের কঠিন অসুখ। সেই প্রথমদিন থেকে, যেদিন থেকে মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করতে শিখল, সেদিন থেকে মানুষের লোভ এ—ভাবে মানুষকে তাড়না করছে। যেটা হাজার হাজার বছরের অসুখ তাকে তুমি কী করে দু দণ্ডের ভিতর আরোগ্য করবে।

আর তখনই দলে দলে মাঠের ভিতর কারা আগুন জ্বেলে দিয়েছে। শেষ রাতে এ—সব মাঠে যারা গাছের নিচে শুয়ে থাকে, শীতে তাদের ঘুম আসে না। ওরা বিকেলে ঘাসপাতা সংগ্রহ করে রাখে। শেষ রাতে যখন হাত পা বরফ হয়ে যায়, শীত নিদারুণভাবে কষ্ট দেয়, এবং মনে হয় মরে যাবে, তখন এরা আগুন জ্বেলে সকালের রোদের জন্য অপেক্ষা করে। সোমার কিন্তু মনে হল, মানুষটা চিঠি দিয়ে বেশিদূর যেতে পারেনি। কারণ মানুষটা তো জানে, এ—বাড়িতে সোমা দত্ত আছে, সে ছিল সোমা গাঙ্গুলি, উদ্বাস্তু মেয়ে সোমা গাঙ্গুলি কী করে যে সোমা দত্ত হয়ে গেল, এবং কিছু ছবি সে মনে করতে পারে, স্মৃতির মতো খেলা করে বেড়ায়, সেই কবে যেন তাকে তার মা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, বোধহয় এটা বাবার মৃত্যুর পর। সেই লোকটা—কেমন চুপচাপ ভালোমানুষের মুখ করে ওর বড় বৈঠকখানায় বসেছিল, কী সদাশয় মানুষ, বাবার বিনিময়ে লোকটা লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছে, সোমার এটা তখন মনে হয়নি, পরে সে সবটা জেনেছে মার কাছ থেকে, এবং মা যখন লোকটার রক্ষিতা হয়ে গেল, বাবা তখন আত্মহত্যা না করে বোধহয় পারেননি।

সব সে মনে করতে পারে না। এই শীতের রাতেও সে কেমন শীত অনুভব করছে না। মাথার ওপর বড় আকাশ আর অজস্র নক্ষত্র, সব রাস্তার আলো এসে মাঠে পড়েছে। এখানে পাশাপাশি সব বড় বড় গাছ, পাশেই একটা বড় হাসপাতাল। দুটো একটা অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। যার কিছু দূর হেঁটে গেলে দুর্গের র‍্যামপার্ট। সে সেদিকে গেল না। সে গাছের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে গেল। আগুনের দিকে হেঁটে গেল। ওখানে হয়তো সে আছে। সে কে? সে অঞ্জন! অঞ্জন বলে কে আছে তার! কাল একবার বিনয়ের কাছে যেতে হবে, বিনয় যদি বলতে পারে, কলেজ—জীবনে অঞ্জন বলে কোনো বন্ধু যদি থেকে থাকে। সে এমন একটা নাম শুনে মূর্ছা গেল! ভাবতে পারছে না এমন কেন হল! সহসা কী হল মনের ভিতর অঞ্জন বলে কোনো যুবক অথবা কিশোর অথবা বালকের মুখ আবিষ্কার করে ফেলেছিল, যে ছিল তার কাছে রাজার মতো। ওর মা এবং বাবাকে যা কিছুর বিনিময়ে ছোট হতে হয়েছে, সব কিছুর বদলা নেবার মতো এক মানুষ সে। সে শিশু বয়সে, কিংবা আরও বড় হয়ে বুঝতে পারত, ওর এমন একজন মানুষের দরকার যে মধ্যরাতে নাইটদের মতো পাপ অন্বেষণ করে বেড়াবে, সেই যে লোকটা, দুটো চোখ যার শয়তানের মতো ঘোরাফেরা করত, এবং মাকে দেখলেই চোখ দুটো জ্বলে উঠত, তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের অনিবার্যতা ভাবলে সে স্থির থাকতে পারত না। সোমা ভাবত, একদিন—না—একদিন সে আসবেই।

কিন্তু সোমা সেই আগুনের পাশে গেলে দেখল, মাত্র একজন বুড়ো মতো লোক বসে আছে। শীতে হাত পা চোখ সাদা হয়ে গেছে। পাশে নানারকমের পোঁটলা—পুঁটলি, ভাঙা টিনের বাক্স, মগ, পুরনো টিনের কৌটা, সে বেশ এই নিয়ে আগুন পোয়াচ্ছে। এমন একজন দেবীর মতো সহসা মানুষের ছবি দেখে, চোখের পলক ফেলতে পারল না। হয়তো বনদেবী—টেবি হবে, অথবা এই মহানগরীর দেবী, যে রাতে বুড়ো মানুষটার কষ্টের কথা ভেবে না—এসে থাকতে পারেনি। সে বলল, মা—জননী!

সোমা বলল, খুব শীত না!

খুব মা—জননী।

কোথায় থাক?

এই ফুটপাতে মা—জননী।

তোমার কষ্ট হয় না?

কষ্ট! ওর মুখ এত ছোট, আর এত রেখা মুখে এবং এত বেশি শীর্ণ যে বোঝাই যায় না, কষ্টের কথা শুনে হাসছে, কী অবাক হচ্ছে, অথবা কষ্টের কথা শুনে কেঁদে ফেলছে। দাঁত না থাকলে বোধহয় মানুষের মুখ শিশুর মতো হয়ে যায়। সোমা পাশে বসে দুটো একটা পাতা আগুনে ফেলে দিতে থাকল।

তোমার নাম কী?

আমার নাম! ভুলে গেছি!

ভুলে গেছ মানে!

বিশ—বছরের ওপর মা জননী, আমার কী নাম কেউ জিজ্ঞেস করে না। কেউ ডাকে না আমার নামে। আমি যে কী এখন জানি না।

সোমা ওর কথা সব বুঝতে পারছে না, কথা বললে থুথু ছড়াচ্ছে।

সোমা সামান্য সরে বসল। আগুন জ্বলছে, এবং এমন একটা নিরিবিলি মাঠে, কেউ শেষ রাতে ঘুমোতে না পেরে আগুন জ্বেলে জ্বেলে বসে থাকবে ভাবা যায় না। এবং এ—ভাবে দূরে দূরে সে দেখল পর পর গাছের নীচে আগুন, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সব মশালের আগুন, ধীরে ধীরে এত বড় শহরের ধার্মিক নাগরিকদের অজ্ঞাতে এটা জ্বলে উঠছে। সকাল হলে, ট্রাম বাস চললে কেউ টেরই পায় না, গাছের নীচে, অথবা ওদের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা আছে, সেখানে ওরা শীত থেকে বাঁচবার জন্য আগুন জ্বালায়।

সোমা বলল, এখানে আগুন পোহাতে কেউ আসে নি?

বুড়ো লোকটা কি দেখল সোমার চোখে। বলল, দুটি ছোড়া আসত। চোখে—মুখে বদজাতি, ওরা আমার পাতাগুলো একসঙ্গে আগুনে ফেলে দিত। দাউদাউ করে জ্বলেই নিভে যেত আগুন। আবার শীত। আমি এখন লাঠি নিয়ে বসে থাকি। ওরা আসতে সাহস পায় না।

সোমা বলল, তাহলে কেউ আসে না আগুন পোহাতে?

আসে। সে আসে।

সে আসে!

সে আসে। কি নাম জানি না। সন্ধ্যার পর সে আমাকে, কিছু খড়কুটো দিয়ে যায়। কখনও খাবার।

কখন আসে?

ঠিক থাকে না। দুদিন তিনদিনের খড়কুটো দেয়। খাবার পাঠিয়ে দেয় কখনও। সে নিজেও আমার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খায়।

দেখতে কেমন?

খুব ভাল। চোখ বড় বড়। লম্বা মানুষ, কালো রঙের প্যান্ট পরতে ভালবাসে। সাদা হাফশার্ট।

চোখে কেমন একটা মায়া আছে তার, তাই না?

খুব। সে এলেই আমার আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়!

আজ সে এসেছিল?

এই কিছুক্ষণ আগে সে এসেছিল। সে ডেকে আমাকে উঠতে বলে দিল। শরীরে হাত দিয়ে বুঝেছিল, ঠাণ্ডায় মরে যাব, সে আগুন জ্বেলে বসে থাকতে বলল, শীতে আমার মরে যাবার কথা। আগুন জ্বেলে রাখলে শীতে আমি মরে যাব না। সে এমন বলল।

তুমি ওর নাম জান না?

না।

নাম বলে না?

না।

সোমা কেমন আশ্চর্য হয়ে যায়। পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে। সে এক হাতে গায়ের চাদরটা কাঁধে তুলে নিল। এখন মনে হচ্ছে সত্যি ভীষণ হিম ঠাণ্ডা। সে গলায় চাদর জড়িয়ে দিল। হাত পা ওরও যেন ক্রমে অবশ হয়ে যাবে, শীতে খোলা আকাশের নীচে বসে থাকলে এমন হবারই কথা। সাদা জ্যোৎস্না ক্রমে মরে আসছে। বোধহয় নদীতে একটা জাহাজ নোঙর তুলে তখন সমুদ্রে যাবে বলে সিটি দিচ্ছে। এবং দূরে দূরে, এই যেমন নদীর ওপারে সব চটকলের চিমনি থেকেও সাইরেন বাজছে। চারটা বেজেছে। সে ঘড়ি দেখে বুঝল, ঠিক তাই। রসুল কোথায়? সে পিছন ফিরে দেখল, একটু দূরে মাঠের ভিতর রসুল ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে আর বসবে না ভাবল, যেন কী একটি সূত্র পেয়ে গেছে, তাকে সে ঠিক খুঁজে পাবে না। না পেলে শান্তি পাবে না, এই সেই লোক হবে, যে কফি—হাউসে অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়েছিল। ওর নাম কি অঞ্জন!

সোমা বলল, একটা কথা তুমি আমার হয়ে ওকে বলবে?

কি কথা মা—জননী?

ওর নাম অঞ্জন কিনা জানবে তো!

আমি তো কারো নাম জিজ্ঞাসা করি না মা—জননী।

কেন কর না?

নাম মানুষের একটাই থাকে।

সে আবার কেমন?

নাম মানুষের দুটো হয় না।

সে কেমন?

না মানে সে মানুষ, আর কিছু নয়।

তাকে তুমি নাম জিজ্ঞাসা করেছিলে কোনোদিন?

না।

তবে একবার বলতে আপত্তি কী?

আপনি মা—জননী, ওর নাম বললেই কী চিনবেন?

চিনব না কেন? অঞ্জন বলে কেউ আছে কিনা জানতে চাই।

কেন আপনার এমন জানতে ইচ্ছা হয় মা—জননী?

সে যে আমাকে খুঁজছে।

সে না আপনি?

সে একই কথা।

আচ্ছা এবার দেখা হলে বলব।

বলবে কিন্তু। সোমা উঠে দাঁড়াল।

আপনি আবার কবে আসবেন?

আসব।

আসার সময় কিছু খড়কুটো নিয়ে আসবেন। ওর অনেক কাজ। কিছু কাজ আপনি করে দিলে, সে বেশি আমাদের জন্য সময় পাবে।

বুড়ো লোকটার কথা খুব স্পষ্ট নয়। সোমা সব না বুঝলেও মোটামুটি কথাবার্তা বলে বুঝেছে, এখানে কেউ আসে। বুড়ো লোকটা নিজের সম্পর্কে কিছু বলেনি। সে বুড়োমানুষ এই পর্যন্ত বলেছে। না বললেও কোনো ক্ষতি ছিল না, বুড়ো মানুষের রকমফের আছে, তার যেন তাও নেই। সে একেবারেই বুড়ো। বুড়ো হলে যা হয়। শীত করে, মানুষের অবহেলা তখন বাড়ে। বুড়ো হলেই নদীর পাড়ে বসে থাকতে হয়। কেউ আসবে কথা থাকে।

বুড়ো মানুষটা তাকে এসব বলতে পারত। কিন্তু সে তা না বলে, কিছু খড়কুটো আনতে বলছে! খড়কুটো আনলে লোকটা আরও বেশি কাজ করার সময় পাবে।

সোমা কেমন ঝোঁকের মাথায় হাঁটছে। এই বড় শহরের মাঠে, রাত শেষ হতে থাকলে একটা আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা দেখা দেয়। সোমা দেখতে পাচ্ছে, ঘাসের জলে ওর চটি ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। এবং ওপরের নক্ষত্রেরা একে একে আকাশ থেকে কেমন ক্রমে লুপ্ত হয়ে গেল। ওরা ক্রমে সেই অবলুপ্তির পথে, সোমা বোধহয় টের পাচ্ছে অজস্র শিশিরকণা হয়ে এইসব ঘাসে ঘাসে অথবা কোনো কুটিরের মাথায় ঝরে পড়ছে। কুটিরে কী অঞ্জন থাকে!

এই যে এক কথা, অঞ্জন, অঞ্জন, কে সে? কেন সে মনে করতে পারছে না, কে আসে এই মাঠে, সেই মানুষটা কী আসে, অথবা সে কী জানে, কাছাকাছি জায়গায় সোমা থাকে, সে কী কোনো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সোমাকে দেখতে ভালোবাসে।

আবার মনে হয় অকারণ খোঁজা। এত রাতে ও—ভাবে ওর বের হয়ে আসা উচিত হয়নি। মাথা ঠিকঠাক আছে তো! কেমন সে নিজের কাছেই বোকা হয়ে গেল, সে এটা কী করছে! গোপনে এ—ভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি! ছিঃ মনীষ জেগে গেলে কী ভাববে। মাঝে মাঝে এ—জন্য মনে হয় মাথার ভিতরটা কেমন করছে। কেন যে সে কফি—হাউসে মরতে গিয়েছিল।

একটু পা চালিয়ে হেঁটে গেল। সে এখন দেখতে পাচ্ছে, দুটো একটা শেষ রাতের ট্রাম বড় শহরের ওপর দিয়ে কেমন মায়াবী হরিণের মতো চলে যাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে অজস্র ঠান্ডায়, এক শীতকাতুরে বুড়ো তখনও একটু একটু করে আগুন জ্বেলে যাচ্ছে বাঁচবে বলে। আর সেই সব মহামহিম নাইটগণ পাপ অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে।

ওরা টের পেয়েছে, এরা থাকলে, পৃথিবীতে পাপ বেড়ে যায়। মধ্য রাতে ওরা চলে আসে। অথবা দুপুরে, কোনো শিমুল গাছে ফুল ফুটলে বোঝা যায় সকালে সেই মহামহিম নাইটগণ, গাছের নিচে আগুন জ্বেলেছিল, এবং এ—পথেই তারা পাপ অন্বেষণে চলে গেছে।

এ—সব যে কেন মনে হয় সোমার। সে দেখল, একটু দূরে রসুল। সে পরেছিল খাকি শার্ট। ওর পায়ে বুট জুতো, এবং সে প্রায় সিপাইর মতো মুখে একটা হামবড়া ভাব নিয়ে হাঁটছে। সে আছে, ভয় নেই, কার এমন হিম্মত আছে, কী যে বিশ্বাসী মুখ রসুলের। ওর বয়স খুব বেশি নয়, চল্লিশও বোধ হয় হয়নি, ওর কী মনে হয় না সোমার শরীরে তাপ আছে, ওর কী বিশ্বাস হয় না, সোমার অনেক কিছু ইচ্ছা হয়। এমন একা মাঠে মানুষ এত বিশ্বাসী থাকে কী করে! এবং এসব মনে হলেই সে বুঝতে পারে পৃথিবীতে কিছু—না—কিছু সবাই ভালো কাজ করতে চায়। সবার লোভ একরকমের না। মনীষ কেন যে এমন হয় না, অথবা অঞ্জন কে! সে যে কেন মূর্ছা গেল!

সদরে এসে মনে হল, গাড়ি বারান্দার ওপরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এখন কাক জ্যোৎস্না। চারপাশের আলো নেভানো। কেবল সদরে আলো জ্বালা থাকে, মনে হল তার মনীষ হয়তো জেগে গেছে। জেগে গিয়ে বিছানায় দেখতে না পেলে ভেবে থাকে, বাথরুমে গেছে। অবশ্য সে খুব কুঁড়ে লোক, বিছানা থেকে উঠে দেখার ইচ্ছা হয় না ভিতর থেকে দরজা বন্ধ আছে কিনা, এটা ওর স্বভাব, শুয়ে শুয়ে সব ভেবে ফেলবে, এবং আবার ঘুমোবার চেষ্টা করবে।

কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় সে দেখল মনোরমা দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় উঠে এলেই মনোরমা আলো জ্বেলে দিল। আলো না জ্বাললেও হয়তো হত। সে ঠিক উঠে যেতে পারত। চারপাশে সকাল হবার আগে যেমন রোজ পাখিরা ডাকে, কীটপতঙ্গের আওয়াজ পাওয়া যায়, এবং যা শুনলে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবা যায় সকাল হয়ে যাচ্ছে, তেমনি সব শব্দ, বাগানে, আতাফল গাছটার পাশে এবং মনে হয় সকাল হবে বলেই মনীষ হয়তো গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আর তারপরই যা মনে হল, এটা শীতকাল, শীতকালের এমন ঠান্ডায় মনীষ কিছুতেই গাড়ি বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, ওর ভিতরটা এমন মনে হতেই কেমন কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল, তারপর আর যা সে ভাবতে পারে, হয়তো সে লক্ষ্য রাখছে, কোথায় যায় সোমা, কখন আসে, এবং অলক্ষ্যে এসব হলেই চেপে যাবার কথা।

সোমা নানাভাবে ভাবছিল, সে কেন গেল, অথবা সেই মাঠে কে আসে, গাড়ি বারান্দায় কে দাঁড়িয়েছিল, যে কেউ আসতে পারে—যা সময়, কোনো নাইট কী আবার অলক্ষ্যে এমন একটা বাড়ির ভিতর পাপ অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। সে এমন ভেবেই নিজের মনে হেসে দিল। কীসব আজেবাজে চিন্তা। আসলে মনীষই দাঁড়িয়েছিল। হয়তো মনোরমার মুখে শুনেছে, রসুলকে নিয়ে দিদিমণি কোথায় বের হয়ে গেল, গাড়ি নেয়নি। পাশাপাশি ওর কোনো বান্ধবীর কাছে, বিপদের কথা জানাতে যেতে পারে, অথবা ওর মায়ের কাছে, সে ঘুমিয়েছিল বলে সোমা ডাকেনি। এবং এ—সব ভাবতে ভাবতে সে একসময় মনোরমাকে বলল, দাদাবাবু কখন জেগেছে রে!

উনি তো জাগেননি। সেই থেকে ঘুমোচ্ছে।

মানে!

ঘুমোচ্ছে। আমার ঘুম এল না। আপনার জন্য ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।

তুই জানিস না?

কি জানি না?

ও উঠেছে। গাড়ি বারান্দায় ছাদে দাঁড়িয়েছিল!

কখন!

এক্ষুনি। ভিতরে ঢোকাবার সময় দেখলাম।

কী বলছেন দিদিমণি!

সোমা ভিতরে ঢুকে অবাক। মনীষ শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে। ঘুমের ওষুধ ভীষণ কাজ দিয়েছে। সে, কী দেখল তবে! ওর মনে হল, মনীষই দাঁড়িয়েছিল, ওকে ঢুকতে দেখে ফের এসে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমের ভান করছে। সে এবার পাশে বসল। মাথায় ওর হাত রাখল। ওর চুল ঘন। এবং নুয়ে যখন দেখল, না এটা অভিনয়ের মুখ নয়, সত্যি সত্যি ঘুমোচ্ছে, তখন কেমন সে গুম হয়ে গেল।

মনোরমা বলল, লোকটা কেমন দেখতে?

মনোরমার এত উৎসাহ সোমার ভালো লাগছিল না। সেতো মনোরমাকে জানে। সে বলেই ভুল করেছে। এখন মনোরমা কথায় কথায় এটা কতদূর যে নিয়ে যাবে!

সোমা ধমকের সুরে বলল, চুপ করতো! কিছু ভালো লাগছে না।

তাতো ভালো না লাগবারই কথা দিদিমণি! কী যে হবে! ঐ তো শুনলাম, মাঠের ধারে দুজন ছেলেকে কারা মেরে ফেলে গেছে!

কবে?

কবে আবার, দু তিনদিন আগে।

সোমা বলল, তাতে তোমার কী?

বা আমাদের কিছু নয়। যখন তখন যাকে তাকে মেরে ফেলবে! বিচার নেই!

সোমা আর কথা বাড়াল না। সে ভাবল বলে দেবে, তুমি বাপু আমাদের কথা দু কান করবে না। তোমার যা স্বভাব। তুমি এ—সব কথা দু কান করলেই দাদাবাবুর কানে উঠবে। মানুষটা ভয়ে এমনিতে ঘুমোতে পারছে না, আর এ—সব শুনলে একটা ফ্যাসাদ হয়ে যাবে। সোমা এবার খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, কী দেখতে কী দেখেছি!

তা বলে কী একটা ভালো মানুষ খুন হয়!

হয় না?

কী করে হয়। আঁধারেও যে দিদিমণি বেড়ালকে বেড়ালই মনে হয়।

তুই চালাক বলে মনে হয়। তোর মতো সবাই অত চালাক নাও হতে পারে।

মনে হল না, মনোরমা খুব একটা বিশ্বাস করছে। ওর ধারণা, যা দিনকাল, যেভাবে চিঠি দিয়ে গেছে, ঠিক একটা কিছু হবে। এবং কারও ক্ষমতা নেই দাদাবাবুকে রক্ষা করতে পারে। এই যে চারপাশে এখন এত নিরাপত্তা, দাদাবাবুর বালিশের নিচে কী একটা থাকে, কিন্তু দাদাবাবু জানে না, ওরা এমন লোক যে, কী করে কখন মনোরমাকেই ফুসলে ফাসলে হাত করে ফেলবে, এবং দাদাবাবু তখন দেখবে, ওর সামনে মনোরমা বীরাঙ্গনা হয়ে গেছে। ওরা কীভাবে কী করবে কেউ বলতে পারে না, আর তখন কী না দিদিমণি সব উড়িয়ে দিচ্ছে!

সোমা দেখল, মনোরমা নিচে নেমে গেল। ঠিক নেমে গেল, না, এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে কিছু খুঁজছে বোঝা গেল না।

আর সোমা নিজেও অবাক, কেমন নিশ্চিন্তে, বসে রয়েছে। ঘুরে ফিরে দেখা দরকার। ওটা মানুষ, না তার ছায়া, না কোনো মরীচিকা, অথবা চোখের ভুল, সে যে কী করবে এখন বুঝতে পারছে না। কেবল নিচে নেমে রসুলকে ডেকে পাঠাল। রসুল এলে বলল, কেউ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে?

নাতো।

খুঁজে দ্যাখ তো। মনে হয় কেউ দাঁড়িয়েছিল। ওর কানে যেন কথাটা না ওঠে।

কখন দেখলেন?

যখন ঢুকলাম।

কোথায়?

গাড়ি বারান্দার ছাদে। রসুল আর সোমা যেতে যেতে কথা বলছিল। সকাল হয়ে গেছে। এখন ঘরের দরজা জানালা খুলে দেওয়া যায়। রোদ আসবে। অথবা শীতের বাতাস বয়ে গেলে ফুল ফুটে থাকার কথা, কিন্তু কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। সব ফাঁকা।

আমি তো কিছু দেখলাম না।

হয়তো লক্ষ্য করনি।

দাদাবাবুর ঘর থেকে আলো এসে পড়ছিল।

তা আলো আর মানুষ কখনও এক হয় রসুল!

তা অবশ্য হয় না।

ওরা এ—ভাবে বাগানের ভিতর ঢুকে গেল। বাগানটা খুব বড় নয়। ছোট। জ্যোৎস্নারাতে বড় ইউকালিপটাস গাছের নিচে মাঝরাতে দুজনে ওরা কত যে চুপচাপ বসে থেকেছে! চারপাশে উঁচু পাঁচিল। মাধবীলতার ছায়া কোথাও ঘন। লালবর্ণের গোলাপ কোথাও ফুটে আছে। শীতে গোলাপের পাপড়ি ভারী হয়। কুয়াশার জলে পাপড়িগুলো কেমন কুমারী মেয়ের মতো পবিত্র থাকে। সে দেখল, না, কোথাও সে নেই। সেই গাড়ি বারান্দার কাছে যে মানুষটা দাঁড়িয়েছিল, কেমন ভোজবাজির মতো বাড়ি থেকে উধাও। সোমার ভীষণ শীত করছে। ভিতরে ওর ভয় আদৌ ছিল না। অথচ সে নিজেই কেমন তখন শীতকাতুরে ভীতু মুখ করে ওপরে উঠে গেল। জানালায় রোদ এলে দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরেই কাগজ আসবে। রেডিয়ো ভয়ে খোলা হয় না। কাগজটাও আজ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। সে কাগজটা না খুলেই ভাবল, ক উইকেট ডাউন?

সে জবাব দিল, একটাও না। ঈশ্বর, যেন একটিও না হয়।

কিন্তু খুলে দেখল, বহরমপুরে তিন, ডেবরাতে চার, কলকাতা এবং তার চারপাশে চোদ্দ। সে কাগজটা বন্ধ করতে গিয়েও পারল না। একটা ছবি ছাপা হয়েছে। ওকে পুলিশ খুঁজছে। ছবিটায় চোখ দুটো, কফি—হাউসের চোখ দুটো আরও কী যেন…সে বোধহয় ফের সংজ্ঞা হারাত। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি জানালা ধরে ফেলল।

দশ

বাড়িটা কেমন নিঝুম লাগছে। মনীষ ঘুম ভেঙে গেলে দেখল, জানালায় চুপচাপ সোমা দাঁড়িয়ে আছে। কী দেখছে যেন। অপলক। ঘুম ভাঙলে শরীরে ভীষণ জড়তা থাকে। এবং চিঠি পাবার পর থেকে জড়তা কেমন ভীষণ বেড়ে গেছে, উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সবকিছু ফাঁকা, নিরিবিলি, এ—ভাবে বেঁচে থাকার মানে হয় না, এবং কেমন সবকিছুর ওপর বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা হয়, দেশের মানুষ, পুলিশ, সরকার সবকিছুর ওপর। সাংঘাতিক সাংঘাতিক ঘটনা, এবং সে নিজের গলায় হাত দিল। আর এ—ভাবেই বোধহয় মনে পড়ে যায়, কী কী ঘটেছে, কীভাবে সব হত্যা, অর্থাৎ কীভাবে সব মানুষের গলা কেটে দেওয়া হচ্ছে। কেউ কিছু করতে পারছে না। দিনদুপুরে হাজার মানুষ যাচ্ছে, তার ভিতর তিনজন ওরা অথবা চারজন, সবাইকে বলছে সরে যান, আমরা এর গলা কেটে দেব। আর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের জানালা দরজা বন্ধ, রাস্তা ফাঁকা। যে যার মতো পড়িমরি ছুটছে। ভাবলেই চোখমুখ ঘোলা ঘোলা হয়ে যায়। চিঠির কথা মনে হয়। কথা আছে ওরা আসবে। ওরা আসবে কথা থাকলে আসেই।

ওর এখন যা যা করণীয়, সে উঠে পড়ে ঠিক করে নিল। অন্য দিন সোমা জানলায় দাঁড়িয়ে থাকলে, তাকে পাশে নিয়ে সেও দাঁড়াত। কথা বলত। বাগানের সব নানাবর্ণের ফুলের সঙ্গে সোমার অঙ্গ—প্রত্যঙ্গের তুলনা দিতে ভালোবাসত। যেমন একটা লাল তাজা গোলাপের মতো ওর সুন্দর সুষম জায়গা, নরম তাজা, এবং লাল গোলাপ চটকালে যে মধুর ইচ্ছা কাজ করে বেড়ায় তেমন ইচ্ছায় কথা বললে, সোমা বলত, তুমি ভারি অসভ্য।

এ—মুহূর্তে সে আর সোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না। বুকের ভিতরে সেই একটা কষ্ট, কেমন থেকে থেকে ধক করে উঠছে। এমন তো ওর কখনও ছিল না। সে, সোমাকে আজও প্রশ্ন করতে পারত, কিন্তু করে লাভ নেই। বরং সে ভেবেছে, এখন যে যে জায়গায় তার পরিচিত ব্যক্তিরা হত্যা হয়েছে, সব জায়গায় সে এক এক করে জিজ্ঞাসা করবে, প্রত্যেকে চিঠি পেয়েছিল না চিঠি পায়নি, চিঠি পাবার পর ওরা কতদিন সাধারণত দেরি করে থাকে, অথবা যারাই চিঠি পেয়েছে, তারাই নিহত হয়েছে, না কেউ কেউ রেহাই পেয়েছে, এবং সেটা শতকরা কী দাঁড়ায়, সেজন্য সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেল। কিন্তু বাথরুমে ঢুকেই মনে হল, সোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি, সে আবার দরজা খুলে বের হয়ে এল! কিন্তু সোমা তখনও জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। এটা কেন হবে, সে সোমার পাশে গিয়ে ডাকল। কেমন অহেতুক একটা জড়তা শরীরে সোমার। সর্বনাশ এটা কী! সোমা, সোমা! আশ্চর্য তো, সোমার হুঁশ নেই।—এই সোমা!

সোমা বলল, হুঁ।

তুমি কী দেখছ?

কিছু না।

তুমি এমন শক্ত হয়ে যাচ্ছ কেন?

আমি শক্ত হয়ে যাচ্ছি!

হ্যাঁ। তোমার কী হয়েছে?

কিছু না।

এ—ভাবে কেউ দাঁড়ায়। এসো, বসবে।

সোমাকে ও খাটের দিকে ধরে ধরে নিয়ে গেল।—কী হয়েছে?

কিছু না।

ঠিক করে বল!

কিছু না।

তুমিও শেষে এমন করলে আমি কী করি!

আমি কী করেছি!

তুমি আয়নায় এসো, চোখ দেখবে।

আমার চোখ, কী!

চোখ ঘুরছে না!

কী যে বল!

সত্যি। একেবারে স্থির।

এটা হয়েছে বুঝি!

অ মাই গড। আমি কী করব।—অসিত, অসিত, সে জোরে চিৎকার করে উঠল ফোনে।

এই সকালে! কী হয়েছে?

শিগগির আয় ভাই!

অ্যাকসিডেন্ট!

না, তার চেয়েও বেশি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ডাকল, মনোরমা, চিৎকার করে উঠল, মনোরমা! মনোরমা এলে দেখল, কেমন স্থির চোখে শুয়ে আছে দিদিমণি। চোখ দেখেই টের পেয়েছে, ভীষণ ভয় পেলে মানুষের এমন হয়ে থাকে। সে তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল এনে, চোখে পরপর ঝাপটা দিতেই কেমন, চোখ ঘুরতে থাকল। সোমা দেখল পাশে দাঁড়িয়ে আছে মনীষ। সে কেমন বোকার মতো বলল, আমার কী হয়েছিল, চোখে জলের ঝাপটা দিলে কেন!

মনীষ বলল, শুয়ে থাক। উঠতে হবে না। কিছু হয়নি।

কিছু হয়নি তো শুয়ে থাকব কেন! জোর করে শুইয়ে রাখতে চাও?

না, জোর করে না। তোমার শরীরটা ভালো না। তোমার বিশ্রামের দরকার।

সে হবে। সারাদিনই তো তার জন্য আছে। রাত্রিটা আছে। আমাকে একবার বের হতে হবে।

সোমা উঠে বসল।

প্লিজ সোমা। আমার কথা রাখো।

আমাকে এক্ষুনি একটু বিনুর কাছে যেতে হবে।

লোক পাঠাচ্ছি বিনুর কাছে। ওকে নিয়ে আসুক।

শুধু বিনুর কাছে গেলেই হবে না। অন্য অনেক জায়গায় যেতে হবে। আমার অনেক কাজ মনীষ।

সোমা!

সত্যি বলছি। তুমি ভাববে না।

তোমার চোখ কোথায় চলে গেছে!

সে তোমারও।

আমার আবার ঠিক হয়ে যাবে।

আমারও।

সোমা, অসিতকে অন্তত আসতে দাও।

কিন্তু ততক্ষণে বিনু যদি বের হয়ে যায়।

বিনুকে বাড়ি থাকতে বলে পাঠাচ্ছি।

সোমা বুঝতে পারল, অসিত না আসা পর্যন্ত সে বের হতে পারছে না। ঘরের দামি আসবাবপত্রের মতো আর সোমাকে মনে হচ্ছে না। কেন যে এক রাতেই শ্রীহীন হয়ে গেছে। সে যে রসুলকে নিয়ে শেষ রাতের দিকে মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছে, মনীষ জানে না। জানলে আরও ঘাবড়ে যাবে।

আর মনীষ পাশের একটা ডিভানে বসে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। রাতের পোশাক এখনও শরীরে। অসিত আসার আগে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অসিত না এলেও কোনো ক্ষতি নেই। যে—ভাবে সোমা এখন স্বাভাবিক, তাতে অসিত হয়তো এসে বলতে পারে, আমাকে তুই কী এপ্রিল ফুল করলি। এখন সে এলে কী যে বলবে! তবু ওর মনে হল সব খুলে বলাই ঠিক। অঞ্জনের কথা সে খুলে বলবে। সারারাত সে কাল ঘুমিয়েছে বলবে, তারপরই মনে হল, না ঘুম ঠিক হয়নি, কেমন তন্দ্রার মতো, যেন অসাড় অবশ, শুধু শুয়ে থাকা চোখ বুজে, চারপাশে কী হচ্ছে সব সে বুঝতে পারে, কেবল কথা বলতে পারে না, চোখ খুলতে পারে না, এবং এক সময় মনে হল শেষ রাতের দিকে সোমা নিচে নেমে গিয়েছিল, কেমন সে অনায়াসে এ—সব মনে করতে পারে, একটু মনের ভিতর ডুবে গেলেই যেন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুমের ভিতর এই বাড়িতে কী হয়েছে, কটা কীটপতঙ্গ ডেকেছে, একটা বেড়াল কখন ম্যাউ ম্যাউ করে গেছে সে সব বলতে পারে এবং এমন ভাবলেই কেমন সোমার জন্য এসব হচ্ছে টের পায়। কী দরকার ছিল, সেই লোকটার দিকে তাকানো, সে লোকটা কে! সোমা কি শেষ পর্যন্ত মনে করতে পারছে, সে কে? কোথায় তাকে দেখেছে!

মনীষ বাথরুম থেকে ফিরে ভাবল, সোমাকে বলবে, সোমা, তুমি চিনতে পারলে তাকে। কিন্তু সোমা এই অবসরে, ভীষণ সেজেছে। ওর নখে সাদা নেল পালিশ। বোধহয় সকালেই সেসব পোশাক পালটে কী পরবে ঠিক করে রেখেছিল। সে মুখ গালে এমন রঙ মেখেছে যে একসময় মনে হল মনীষ নিজেই হেসে দেবে। সোমা এমনিতেই ভারি সুন্দর, তাকালে মনে হয় সে সব দেখে ফেলছে মানুষের। মানুষেরা তাকালে মনে হবে, এক নদী বয়ে যায়। নিরন্তর গাছপালার ভিতরে সেই নদীর নীল জল ভারি গভীর। তবু এমন সাদা কেন। সেই যে মানুষটা, সে কী জেনেছে, সোমার এই ভারি চোখ, অথবা স্পষ্ট বাহু, এবং নাভিমূলে যে আশ্চর্য নীল জলের খেলা সব তার চেনা। নতুন কিছু সোমা তাকে দিতে পারে না। দিতে না পারলেই যা হয়, জ্বালা, ভিতরে জ্বালা কী যে মনে হয় নিজেকে, যেন সংকোচের শেষ নেই, নানাভাবে সেজেও মনে হয় ঠিক সাজা হল না, হয়তো সে দেখে তার দিকে তাকাবেই না। মনীষ বলল, এই সাত সকালে এমনভাবে সানফ্লাওয়ারের মতো ফুটে থাকলে!

সোমা বলল, সত্যি।

মনীষ পাশে গিয়ে বলল, ভীষণ খারাপ লাগছে।

ভীষণ খারাপ লাগছে কেন!

আর একটু হলে হেসে দিতাম। বলেই সে ঠোঁটে চুমু খেল। লক্ষ্মী মেয়ে, অসিত আসছে। মুখের রঙ ধুয়ে ফেল, তোমার নিজের এমন সুন্দর রঙ থাকতে কেন যে ছাইপাঁশ মাখা বুঝি না। ভীষণ ভালো তুমি। তুমি পরিষ্কার হয়ে এসে বোসো।

আর তখনই মনে হল কেউ উঠে আসছে। নিচে কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মনীষ বাইরে বের হয়ে সিঁড়ির মুখে দাঁড়াল। সিঁড়ির মুখে পার্লারে বসাল অসিতকে এবং তারপর ডেকে যখন সাড়া পেল সোমার, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে, সোমা এল সাধারণ বেশে। সোমাকে মনীষের আবার সুন্দর লাগছিল। আসলে সোমার চারপাশে থাকে বর্ণময় এক গন্ধ। ছুঁয়ে দিতে পারলেই যেন লাভ, কী যে মিহি শরীর, অথচ কী দেখে এমন হয়ে গেল! এবং মনীষ অসিতকে সকালের ঘটনা বলে কী ভাবল, তারপর সোমাকে ছেড়ে দিল। সিঁড়ি ধরে নামার সময় অসিত বলল, হিস্টিরিয়ার মতো কিছু একটা হচ্ছে।

তুই একবার ডাক্তার অমিতাভ চৌধুরীকে দেখাতে পারিস। মন—টনের ব্যাপারটা তিনি ভালো বোঝেন। বলেই বলল, তুই কেমন আছিস?

ভালো।

আর চিঠি এল?

না।

সব বাজে। আজকাল অনেক উড়ো চিঠি আসছে। তবে সময় খারাপ। বড় খারাপ। সে তারপর বলল, যাই হোক, সাবধানে থাকিস। আর নামতে নামতেই যেন মনে পড়ে গেল। বলল, সোমা লোকটাকে চিনতে পারল?

না।

কিছু বলছে না?

কী বলবে। সকালে মূর্ছা যাবার আগে কিছু একটা নিশ্চয় দেখেছিল।

সেটা কী?

আমি জানি না।

তুই জানিস না মানে! তুই তখন কোথায় ছিলি?

ঘরেই।

তবে?

আমি কী করে বুঝব, দাঁড়িয়ে সোমা মূর্ছা যেতে পারে। কী করে বুঝব বাজ—পড়া মানুষের মতো সোমা দাঁড়িয়ে আছে।

দেখে বুঝতে পারিসনি?

সকাল বেলাতে রোদ আসার আগে ওর তো অভ্যাস, জানালায় দাঁড়ানো। আজও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ভাবলাম। ঘুম থেকে উঠেই ভাবলাম, একবার শান্তিবাবুর কাছে যাব। তারপর যাব সমরজিতের কাছে। ফোনে এ—সব কথা হয় না। গরজ আমার, নিজেই যাব ভাবছি।

ওরা গাড়ি বারান্দায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। পাশে একটু দূরে ড্রাইভার। মনীষ আস্তে আস্তে মুখোমুখি কথা বলছে। অসিত সময় দিয়ে শুনছে। যেন কেউ শুনতে না পায়, শুনলে আবার দুকান হবে, সে সন্তর্পণে বলছে, শান্তিবাবুদের নাকি একটা লিস্ট টানিয়ে দিয়েছে!

কীসের লিস্ট?

কীসের লিস্ট আবার। লাল কালির লিস্ট।

কে কে আছেন?

প্রায় একুশ জনের নাম আছে।

—সবাই অধ্যাপক!

সবাই। কেউ আরও উঁচুতে।

এইসব নিরীহ মানুষদের মেরে কী হবে!

জানি না।

তুই এখন ওখানে যাবি?

না গিয়ে উপায়! এখন কাউকে কিছু বিশ্বাস করে বলাও যায় না। কে যে কার লোক! আর জানিস সবসময় ভয় হয়, কেউ আমাকে ফলো করছে।

অসিত কিছু বলতে পারল না। কারণ সে সঠিক বলতে পারবে না কী ঘটনা। সে শুধু সাবধান করে দিতে পারে। সে আর বলতে পারে না, শুধু মিথ্যা ভয় দেখানো। বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হয়তো শান্তিবাবুরা যাবেন। ওদের তিন মাসের সময় দেওয়া হয়েছে।

অসিত একটু ভেবে বলল, তোকে কোনো সময় দেয়নি?

না।

পুলিশে চিঠিটা দিয়ে দে।

কী হবে! ওরা তো তবে আরও ক্ষেপে যাবে। আমি চেষ্টা করছি ভালো হবার। যারাই পুলিশে কেস দিয়েছে কেউ বাঁচেনি। ওদের ভিতরও লোক আছে। তাছাড়া ওরা নিজেরাই তো নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না।

চেষ্টা করছিস?

কী করব! ভেবেছি আজই গিয়ে সব চর্বিটর্বি নষ্ট করে দিতে বলব। মিনারেল অয়েল আর ব্যবহার করতে বারণ করব। তারপর কপালে যা হয়। মুশকিল কী জিনিস, ঠিক মাপ দিলে দামে পড়তা আসে না। এত লোক কাজ করে, ওদের পয়সা তবে দেব কোত্থেকে!

অসিত বলল, হ্যাঁ ভাববার কথা।

—ভাববার কথা না! কেউ এখন প্রকৃতিস্থ নেই। কেন যে এমন হল!

অসিত বলতে পারত, আমরা নানাভাবে অধার্মিক হয়ে গেছি। তবে এভাবে কী এর সমাধান! এটাও সে ভাবল। সুতরাং মনীষকে সে কিছু বলতে পারল না। কিছু বলতে না পারলে যা হয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, ওরা চুপচাপ কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে যখন বুঝল আর কোনো এখন কথা হতে পারে না, তখন অসিত গাড়িতে বসে বলল, যা ওপরে যা।

অসিত চলে গেলে সে কেমন একা হয়ে গেল। রসুল এখন থাকে না, রাম অবতারের বোধহয় গেটে ডিউটি। কিন্তু সে এত সতর্ক থেকেও কেমন অসহায় বোধ করছে। সে এটা কাউকে বুঝতে দেয় না। সে যেমন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে থাকে তেমনি করার চেষ্টা করছে। এবং এটা যে হচ্ছে, ওর ধারণা, রসুল মনোরমা আর অসিত বাদে পৃথিবীর আর কেউ জানে না। সে ভাবল, কোনোরকমে গাড়ি করে অপরিচিত জায়গায় চলে যেতে পারলে এতটা ভয় থাকবে না। কারণ ওর মনে হচ্ছে, এই বাড়ির যেখানে সে থাকুক না, ওরা ঠিক টের পেয়ে যায়। যেন ওরা চারপাশে ওর সতর্ক নজর রেখেছে, সে কী করছে। সে আর মুহূর্ত দেরি করল না। লাফিয়ে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে গিয়ে দেখল, সোমা খুব সাধারণ পোশাকে নেমে যাচ্ছে। মনীষকে বলার পর্যন্ত সময় দিল না, যেন কতকটা সে পালিয়ে চলে যাচ্ছে।

মনীষ এবার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ডাকল, সোমা।

নিচ থেকে সোমা বলল, বিনুর কাছে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হলে ভাববে না।

সোমা গ্যারেজের ভিতর ঢুকে গেল। গাড়ি বের করার শব্দ হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো গাড়িটা নিয়ে বের হচ্ছে। বের না হলেই যেন খারাপ হত। সে ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে থাকল। সকালের কাগজে কী আছে আজ, বাড়িতে সবাই ওকে কাগজ পড়তে দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই সোমা কাগজ লুকিয়ে রেখে গেছে। আজকে কী ঘটেছে, অথবা এ—ভাবে অকারণ হত্যা, অথবা কোথাও কি মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছে না, এমন খবর কি কোথাও নেই—সে কেবল তেমন একটা খবরই দেখতে চায়। চারপাশের জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে না, এ—ভাবে একজন সাধারণ পুলিশ, সাধারণ সুদখোরের জীবন নিয়ে কী যে হচ্ছে, অথবা ওর কথাই ধরা যাক না, সে তো সবই নিজে নিয়ে নিচ্ছে না, সবই তো যারা কাজ করে তাদের জন্য, তা বলে একটা লাভের অঙ্ক থাকবে না, ক্যাপিটেল তৈরি হবে কী করে, ক্যাপিটেল তৈরি না হলে নতুন নতুন কারখানা হবে কী করে, বেশি লোক কাজ পাবে কী করে।

গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নিচ্ছে সোমা। ডিমের মতো গাড়ির আকার। সাদা, ডিমের মতো রঙ, রঙ কখনও মলিন হয় না। অনেক চেষ্টার পর সে গাড়িটা পেয়েছে। অথবা দাম অনেক বেশি দিয়েছে, তবু সোমা যখন এ গাড়িটা চড়ে সুখ পায় তখন আর টাকার দুঃখ থাকে না। গাড়িটা অর্ধেক দামে কেনা যেত। এত বেশি মাঝখানে দালাল পড়ে গেল যে সবার মুখ বন্ধ করার জন্য সে টাকার মায়া করেনি। এবং এ—গাড়িটায় চড়ে কোনো রাস্তায় বের হলে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষেরা গাড়িটার ভিতর আছে সহজেই মানুষেরা ভেবে ফেলতে পারে। সে এটা অস্বীকার করে না, সে নানাভাবে রাজার মতো যখন বেঁচে ছিল, তখন এক অতীব বিষাক্ত কীটের উপদ্রব। একটা জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। ওকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। সে এমন শক্ত মানুষ, তাকে কীভাবে যে দুর্বল করে ফেলেছে!

সোমা বের হয়ে গেল। গেট খুলে যাচ্ছে। সোমা, হাত নাড়ল, এটা সোমার স্বভাব। সোমা পথের ওপরে পড়েই সাঁ সাঁ করে বের হয়ে গেল। এবং মনীষ দেখল, এসময় সে ভীষণ একা, এবং ঘরের ভিতর ঢুকতে পর্যন্ত ভয় করছে। ঘর ফাঁকা পেয়ে যদি কেউ পাঁচিল বেয়ে উঠে এসে থাকে। ব্যালকনি থেকে সে নড়তে পারল না। সে এই শীতেও ঘামছে। ভিতরে ঢুকেও যদি দেখে কেউ চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে!

সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টা করছে। প্রথমে সে মৃত্যু একটি অতি সহজ ঘটনা, সে, যে—কোনো মুহূর্তে আসতে পারে। সে তারপর ভাবল, ভাগ্য। ভাগ্যে লেখা থাকলে ঘটবে। কেউ রুখতে পারবে না। তারপরই ভাবল, সে কী যা তা ভাবছে। ভাগ্য আবার কী! সে তো এতদিন সোমাকে বুঝিয়েছে, পুরুষকার। সে তার বুদ্ধি এবং কৌশলের দ্বারা এমন এক অপূর্ব মণি—কাঞ্চনের ব্যবস্থা করেছে। সবাই পারে না। সবাই সে—জন্য গাড়িও চড়তে পারে না। সবার গাড়ি চড়া ঠিক না। সবাই গাড়ি চড়লে কাজ করবে কে। পৃথিবীতে কাজের লোক না থাকলে মণি—কাঞ্চন সংগ্রহ হয় না।

তারপরই মনে হল, এসবও ওর ভাবার কথা না। সে সাহসের সঙ্গে সবকিছুর সম্মুখীন হবে ভাবল। সে এক পা এগোচ্ছে আর সাহস কথাটা ভাবছে। সাহস কথাটা ওর কাছে আশ্চর্য একটি শব্দ মনে হচ্ছে। সাহস কথাটার ভিতর খুব বড় একটা ব্যাপার আছে। না হলে এমন সামান্য শব্দ, যা সে ভাবত, এমন কিছু না, এখন তাকে একেবারে গলা শুকিয়ে দিচ্ছে। সে এবার যেন না ডেকে পারল না, মনোরমা! সে ডাকল, রসুল। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ওরা কি কেউ নেই! সে ডাকল, রাম অবতার। না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সে করিডোরে ঢুকে গেল। ওর পা এগুচ্ছে না। দুপাশে দেয়ালে সব ছবি। নানাবর্ণের ছবি। সে ছবির এগজিবিশান হলেই ভালো ভালো ছবি কিনে ফেলে। একটা ইঁদুরকে ঈগলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অথবা কোনো বনের ভিতর র‍্যাটেল সাপের ভয়ংকর মূর্তি, এসব মিলে সে ভাবল, আর ঢোকা যাবে না। ভিতরে কী আছে কে জানে!

তখনই মনীষ অবাক হয়ে গেল ভেবে, সারা বাড়িটা এ—ভাবে কখনও কখনও ভূতুড়ে হয়ে যায়। সে মরে যাবে ভাবতেই কী আশ্চর্য, এ বাড়ির চারপাশে যেন এক অতিকায় নৈঃশব্দ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় মোটরের হর্ন, মানুষজন এত, তবু মনে হচ্ছে, এখানে কিছুক্ষণের ভিতরই এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটবে। সে দ্রুত সিঁড়ি ধরে নেমে বলল, কৈ হায়।

জি হুজুর।

কেউ রয়েছে?

কোথায় হুজুর?

এই দ্যাখো তো বাগানের দিকে।

রাম অবতার বাগানের চারপাশে ঘুরে এসে বলল, কৈ, না।

মনীষ বলল, রসুল কাঁহা?

রসুল! রসুল কাহারে! হুজুর বলাতা হ।

রসুল এলে মনীষ বলল, এসো।

সে রসুলকে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল। রসুল কখনোই এত ভিতরে ঢুকতে পারে না। সে দেখে অবাক, মানুষেরা এ ভাবে বাঁচে! বেহেস্তের শামিল। তিনি ভিতরে খুট খুট করে কী করছেন। এবং কিছুক্ষণের ভিতর বের হয়ে এলে রসুল বুঝতে পারল, হুজুর কোথাও বের হচ্ছে। মনীষ একটা চাবি ওকে ছুড়ে দিল। এবং সে নিচে নেমে যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে গেল, মনে হল মুক্তি। এত বড় মুক্তি সে কখনও পাবে ভাবেনি। তাকে এখন কেউ চেনে না। যেন একটা বড় বাড়ির ভিতরই তাকে চেনা যায়, তার নাম মনীষ দত্ত। হবু ক্যাপিটালিস্ট। হবু ক্যাপিটালিস্টদের ওরা বোধহয় বেশি খুঁজছে। সে প্রায় পালাবার মতো গাড়ি নিয়ে এ—গলি সে—গলি করে যেন তাকে কেউ ফলো করতে না পারে, এবং সে এ—ভাবে কখন কোথায় কোথায় কীভাবে সে ঘুরে ঘুরে শান্তিবাবুর ফ্ল্যাটে কড়া নাড়ল, নিজেও বলতে পারল না। যখন শান্তিবাবু দরজা খুলে দিলেন, সে দেখতে পেল দেয়াল ঘড়িতে এগোরোটা বাজে। সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সাতটায়। শান্তিবাবুর বাড়ি পৌঁছাতে খুব বেশি চল্লিশ মিনিট। বাকি সময় ভয়ে সে কেবল একটা ইঁদুরের মতো এ—গলি সে—গলি করেছে।

এগারো

বিনু, তুই এ—ছবিটা চিনতে পারিস?

বিনু ছবিটার ওপর ঝুঁকে দেখল। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর চোখ বুজে কী ভাবল, বেশ কিছু সময় চোখ বুজে থাকলে সোমা ভাবল, বিনু হয়তো খুঁজে পেয়েছে। ওর মুখে হাসি দেখা দেবে, সে বলবে, ইউরেকা, এবং এ—ভাবে যখন দেখল বিনু চোখ বুজেই আছে খুলছে না, খুলবে কিনা তাও ঠিক নেই, তখন সোমা না বলে পারল না, কিরে চিনতে পেরেছিস?

বিনুর মনে হল, কেউ তাকে ডাকছে। সে চোখ খুলে বলল, কেউ আমাকে ডাকছে?

কে আবার ডাকবে! আমি বললাম, বিনু চিনতে পেরেছিস?

অঃ তুই। আচ্ছা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

তা হলে দে। বলেই সোমা উঠে দাঁড়াবে ভাবল।

ছবিটার জন্যে এখানে ছুটে এসেছিস!

সে তুই বুঝবি না!

আচ্ছা এ—ছবিটার সঙ্গে কী সেই মানুষটার মিল আছে?

হুবহু এক।

কী যে মিস করলাম!

মিস করলি মানে!

তোকে দেখছিল, আমরা দেখলাম না, তোকে কে এত দেখছিল! মিস করলাম না!

এখন আজে—বাজে কথা রাখ। কী করি বলত!

তোর আবার কী করার আছে! সুন্দরী মেয়েদের অনেকেই দেখে থাকে। তোকেও দেখেছে। অঞ্জনের খোঁজখবর করতে পারলি?

না।

তোর যে কী হয়েছে! অবশ্য এমন হয়েছে আজকাল। সব মানুষই পাগল হয়ে যাচ্ছে। বিভীষিকা! আমাদের বাড়িতেই দেখ না, একটা আতঙ্ক সব সময়। কখন খবর আসবে, রমু হাসপাতালে, অথবা সে কী বলতে গিয়েও থেমে গেল। বলল, না থাক। ও—সব ভাবলে মাথা ঠিক থাকে না। আমার মতে এখন কারও সঙ্গে কথা বলা ঠিক না। চুপচাপ থাকা ভালো। মাও বোধহয় কিছু দেখতে পায়। রমুরা সবুজ মাঠে শুয়ে আছে দেখতে পায়।

সোমা বলল, চিনতে পারলি না?

না।

তবে যাচ্ছি।

বোস। গরিবের বাড়িতে একটু চা খেয়ে যা।

সোমা কী ভেবে বলল, তাড়াতাড়ি। আমি বসব না।

কোথায় যাবি?

দেখি, আর কেউ চিনতে পারে কি না!

কেউ চিনতে পারবে না। অনর্থক ঘুরে মরবি।

কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস, অঞ্জন আর এ লোকটি একই ব্যক্তি। জায়গায় জায়গায় নাম ভাঁড়াচ্ছে।

তা হতে পারে।

সে আবার কবে আসবে লিখেছে?

কবে আসবে কিছু লেখেনি।

বেশ ফাজিল ছোকরা।

মানে!

মানে, আমার যা মনে হয়, বড়লোকের এমন সুন্দরী বউ দেখেই একটু মসকরা করছে। আর এমন সুন্দর মেয়ের স্বামীকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।

তুই কী আজেবাজে বকছিস!

আজেবাজে নারে। আমি তো মানুষ চিনি। সবাই তো তোদের মতো জায়গায় যেতে চায়। যেতে ভালোবাসে। যেতে না পারলে আক্রোশ হয়। তখন সব ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। কিন্তু একবার পৌঁছে গেলে, আর মায়াবী ছবির মতো তোর মুখ দেখে ফেললে কেউ আর নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতে পারে না। মনীষের কিছু হবে না। তোরা অনর্থক উদবিগ্ন হচ্ছিস!

সোমার ইচ্ছা হচ্ছিল, ভোর রাতের ঘটনা খুলে বলে। সব খুলে বললে, বিনু বুঝতে পারবে, কেন সে এমন অসহায় বোধ করছে। কিন্তু বিনুকে সে আর কিছু বলতে উৎসাহ পেল না। কারণ বিনু খুব সিরিয়াস না এ—ব্যাপারে। চারপাশে এমন হচ্ছে, বড়লোকের শখের ব্যাপার, একটু ভয় পাওয়া। ওদের গায়ে তো কেউ হাত দিচ্ছে না, এটা পাড়ার কোনো ফাজিল ছোকরার কাজই হবে, কারণ বিনুর কথাবার্তায় মনে হয় ফাজিল ছোকরাটি সোমার জন্য ঘুমোতে পারে না। বড় বড় শ্বাস উঠে আসে। এমন একটা দুঃসময়ে ভয় পাইয়ে দিতে পারলে বেশ মজা। এবং এ—ভাবে এক চিঠি, সুতরাং সোমার এ—সব ভয় বিনু খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভেবে নিচ্ছে।

সোমা বলল, যাই রে।

চা এসেছে। চা না খেয়ে যাবি!

শুধু চা।

শুধু চা—ই দেওয়া হচ্ছে।

সোমা চা খেতে খেতে বলল, সবকিছুই বিনু হালকাভাবে নিলি?

না নিলে ভীষণ দুঃখ পেতে হয়।

তাহলে সবই তুই ভুলে গেছিস?

দুম করে সোমা এমন কথা তুলে ফেলবে সে ভাবতে পারেনি। বিনু বলল, ও—বয়সে এমন হয়। ওটা কিছু না।

চার বছরে তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ ভাবছ।

সত্যি অনেক বড়। চার বছরে কত কিছু জেনে ফেলেছি। তুই কিন্তু আজও চোখে কাজল দিলি না। কাজল দিলে তোকে বড় ভালো লাগত।

সোমা ওকে এখন তুমি তুমি করছে। বিনু সোমাকে এখনও তুই—তুকারি করছে।

সোমা বলল, কে যেন আমাকে বলেছে, সোমা তুমি কাজল পোরো না, কাজল পরলে আমার ভালো লাগে না।

সে কে!

কখনও মনে করতে পারি, কখনও পারি না। একসময় মনে হয়, যাদের ভালো লাগত, তারা সবাই আমাকে এ—কথাটা বলেছে।

তা হলে তুই বলছিস, আমাকে তোর ভালো লাগত না!

কী জানি, বুঝতে পারি না।

আমি তোকে কাজল পরতে বলতাম। কাজল পরলে তোকে খুব মায়াবী দেখাত।

সোমা বলল, কাজল না পরলে আমাকে খুব ইননোসেন্ট দেখায়, কে যেন বলত!

আমরা কেউ ইননোসেন্ট নই সোমা।

এখন মনে হচ্ছে।

অথচ দ্যাখ, কলেজ লনে আমরা কত সব বড় বড় আদর্শের কথা বলতাম!

সবাই না।

সবাইর মনে কিন্তু একটা স্বপ্ন ছিল। যেন, পৃথিবী এক আশ্চর্য জায়গা, যাও, বড় হও, ধর্মপ্রচার করো।

এখনও তো তাই আছে।

ঠিক বলছিস তাই আছে!

মনে তো হয়।

তবে তাকে খুঁজছিস কেন?

তাকে মানে?

এই যে কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস। অঞ্জন না কী নাম!

কী যে বাজে বকিস না! আবার সোমা তুই—তুকারিতে ফিরে এল। চিঠি দিয়ে যে ভয় দেখিয়েছে, সে তো সেই লোকটা।

তোর কী মনে হয়, কফি—হাউসের লোকটাই অঞ্জন হবে।

হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।

যদি খুঁজে পাস, কী করবি?

সোমা এ—কথার জবাব দিতে পারল না। সত্যি তো খুঁজে পেলে কী করবে! সে তো এটা ভাবেনি। সে তো ভেবেছে, যে লোকটা ওর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যে চোখ দুটো ভীষণ চোখ, এবং ছবির চোখের সঙ্গে হুবহু এক, আর নাম লেখা আছে অনিমেষ, সেই কী অঞ্জন, সে কি সেই, যাদের সে ভাবত, পৃথিবীতে তারা অনেক বড় হবে। সে ভাবত, সে থাকবে, ওদের পাশে। এখন যদি খুঁজে পায়, তবে তার সঙ্গে সে কতদূর যেতে পারবে! সোমা বিনুকে কোনো জবাব দিতে পারল না।

বিনু বলল, একটা কথা বলব সোমা?

কী কথা?

আমি জানতাম, তুই কিছু জবাব দিতে পারবি না। তুই বড় হতে হতে অনেক কিছু চেয়েছিলি—মনে হয় সব পাসনি।

সে তো সবাই চায়, কেউ পায় না।

তোর না পাওয়াটা একটু বেশি।

তা বলে, তুই কী বোঝাতে চাস!

এ—ভাবে আর কাউকে খুঁজিস না। এতে বিড়ম্বনা বাড়বে।

সোমা মনে মনে রাগ করতে পারত। সে রাগ করল না। সে জানে বিনু আন্তরিকভাবেই সব বলে যাচ্ছে। সোমার মতো মেয়ের এ—ভাবে ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। সোমা বলল, আমার যে কী হয়েছে।

—কিছুই হয়নি। আসলে তুমি ভয় পেয়ে গেছ। ভিতরে ভিতরে মনীষের কাজকর্ম তুমি অনেকদিন থেকেই অপছন্দ করছ। তুমি দেখতে পাচ্ছ, যা তুমি ঘৃণা করতে, এখন মনীষ তাই করছে। যার বিরুদ্ধে লড়বে বলে তুমি মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখেছ, ঠিক সেই পাপ মনীষ করছে।

না। মনীষ কোনো পাপ করেনি।

এমন কথায় কি তুমি রাগ করছ!

রাগ, নিশ্চয়ই। তুমি কী বলতে চাও এ—সব।

ভুল হলে ক্ষমা করে দেবে! বিনুর চোখ দুটো কেমন ছলছল করতে থাকল। সে কেমন থেমে থেমে বলল, আসলে আমারও মাথা ঠিক নেই, রমুর জন্য আমাদের সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কত আশা ওকে নিয়ে। সে এখন বাড়ি আসে না। পুলিশ ওকে খুঁজছে। যেখানে পাবে, শেষ করে দেবে।

সোমা কেন যে বিনুর দিকে সহজভাবে আর তাকাতে পারছে না। বিনুর সেই চঞ্চল চোখ দুটো আর খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে বিনুই কী কখনও তাকে বলেছিল, কাজল পরলে তোমাকে ভালো লাগে না, বিনু আর মনে করতে পারছে না কথাটা, উলটো কথা বলছে, এ—ভাবে যা হয়ে থাকে মাথা গণ্ডগোল হয়ে যায়, যার কথা মনে হয়, সেই শয়তান ব্যক্তির কথা মনে হয়, বাবার তেলেভাজা খাবার নিদারুণ ইচ্ছার কথা মনে হয়, এবং সারাক্ষণ যেন বাবা সেই লোকটার ভয়ে হে হে করে হেসে যাচ্ছে। কান্না পেলেও কাঁদতে পারছে না, বিনুই কী তখন বলেছিল, আমাদের এ—সমাজ বদলে দিতে হবে। না অশোক, না সেই নিতাই! কে? কে বলেছিল! এবং সে এখন কিছুই মনে রাখতে পারছে না, এবং সেই চোখ দুটো, অথবা অঞ্জন, অথবা কাগজের ছবি সব মিলে কেমন সত্যি ওর মাথাটা গণ্ডগোল করে দিচ্ছে। ভোর রাতে সে কাকে যে দেখল গাড়ি বারান্দার ছাদে। সে সম্পর্কে বিনুকে আর কেন জানি কিছু বলতে ইচ্ছা হল না। সে উঠে পড়ল। সে বিনুকে বলতে পারল না, মনীষ পাকা কাজ করছে। কোথায় যে তার অহংকারে লাগছে। বলতে পারলে যেন হালকা বোধ করত।

সে গাড়িতে এবার কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়াল। যেমন সে বিনুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে, সোজা মাণিকতলা, তারপর বড় রাস্তা ধরে কাঁকুড়গাছি, উল্টোডাঙা, লেক—টাউন, দমদম পার্ক পার হয়ে যাচ্ছে এবং জোরে গাড়ি চালাতে ইচ্ছা হচ্ছে। অথচ সে ঠিক বুঝতে পারছে না কিছু। এমন সুন্দর বাড়িটা কেন যে ক্রমে একটা রহস্যময় বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এখন তো মনীষ বাড়ি নেই। সে ভয়ে হয়তো দু—একদিনের ভিতর বাড়ি ছেড়েও দিতে পারে। যেমন ভয় পেয়ে অনেকে, দিল্লি অথবা এলাহাবাদ, কেউ আবার পুণা, অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতের কোনো নিরিবিলি জায়গায়, আত্মগোপন করে থাকছে। এবং যেভাবে মনীষ ত্রাসের ভিতর পড়ে গেল, সেও ঠিক পালাবে শেষ পর্যন্ত। সে গেলে তাকেও যেতে হবে, কিন্তু সেই লোকটাকে তো কলকাতার বাইরে গেলে পাওয়া যাবে না, সে তো কথা আছে, বড় মাঠে আসে। বুড়ো মানুষটাকে আগুন জ্বালাবার জন্য খড়কুটো সংগ্রহ করে দেয়।

ওর চুল উড়ছিল। সে খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে না। ওর পাশ দিয়ে বাসগুলো বেশ জোরে বের হয়ে যাচ্ছে। এমনকি, সব গাড়ি ওকে ফেলে সামনে চলে যাচ্ছে। সে কিছু ভাবছে না। সে দেখছে চারপাশে সব বাড়ি ঘর, এবং বড় বড় ইলেকট্রিক পোস্ট, অথবা কখনও বিজ্ঞাপনের বড় বড় ছবি, সে এ—ভাবে কেন যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আসলে সে বোধহয় ঘুরে বেড়াচ্ছে না, সে নিজের ভিতর ডুবে যেতে চাইছে, এবং অন্যমনস্ক হলে ভীষণ কেলেঙ্কারি, একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। অঞ্জন বলে সে কাউকে চেনে না, অঞ্জন বলে তার কেউ জানা নেই, সে অহেতুক ঘুরে মরছে। তার চেয়ে বরং সে ভাবল, বিকেলে, ভালো একটা ছবি দেখবে, মিডনাইট কাউ বয়, খুব আশ্চর্য ছবি, এমন ছবিতে বসে থাকলে, অহেতুক সে ভাবে না। ছবিটার নাম সে শুনেছে, বেশিদিন থাকছে না। টাইগারে হচ্ছে। টাইগার হলটা বাজে। সেখানে সে যেতে পারে না। সে যে কী করে। সে বড় বড় সব হাউসে ছবি দেখে থাকে। সাধারণ ছবি—ঘরগুলো সম্পর্কে আজকাল কোনো খবর রাখে না। কিন্তু টাইগার ভীষণ বাজে ব্যাপার। সে একবার লুকিয়ে, কে কে সঙ্গে ছিল, বোধহয় নিতাই, অবনী এবং অন্য অনেকে। বিনু ছিল না, মনীষও ছিল না, এটা সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে। দলটা ভারী ছিল। একমাত্র মেয়ে সোমা। ওর প্রতি সবাই মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল এটা মনে আছে। সেখানে কী অঞ্জন নামে কেউ ছিল! যে একবার এসেই চলে গেছে, আর আসেনি। ওর উজ্জ্বল চোখ দুটো কেবল সে মনে করে রেখেছে। মনের ভিতর চোখ দুটো এতদিন আত্মগোপন করেছিল, কফি—হাউসে তাকে দেখার পর আবার সে ভেসে উঠেছে!

কী যে হয় তারপর। কপাল ঘামতে থাকে। সে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে হাওয়া ঢুকছে। চুল ফুরফুর করে উড়ছিল। সে খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। সাদা রঙের গাড়ি, আর ভেতরে একমাত্র যুবতী সোমা। চুল এলোমেলো। খোঁপা বাধা নেই। খোলা। উদাসীনতা চোখে মুখে। কী অঞ্জনকে যথার্থই খুঁজে বেড়াচ্ছে, না মনের ভিতর এমন একজন মানুষ থাকে, যে রাজার মতো, যাকে সবসময় ঠিক খুঁজে পাওয়া যায় না—এবং এ—ভাবে কী যে হয়ে যায়, সোমার সুন্দর চোখে এক অপার্থিব করুণা ভেসে ওঠে। চারপাশে এত সব গরিব মানুষেরা রাস্তায় শুয়ে থাকে, ওর মনে হয়, এটা একধরনের পাশবিকতা, এ—ভাবে এদের চোখের ওপর গাড়ি চালিয়ে যাওয়া সত্যিই বড় বেমানান। সে সোজা বাড়ির দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। চারপাশের এমন সব দৃশ্য ওর কেমন অসহ্য লাগছে।

অথচ বাড়ি ঢুকেও সে কেমন শান্তি পাচ্ছিল না। সে সোজা সিঁড়ি ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল না। গাড়ি সদরে এলেই গেট ধীরে ধীরে খুলে গেল। সে সাধারণত গাড়ি সদরে রেখেই সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যায়। রসুল অথবা রাম অবতার সেলাম দেয়। গাড়ির দরজা খুলে দিলে সে বের হয়ে আসে। আজ একেবারে অন্যরকমের। সে সোজা গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। নিজেই গ্যারেজ করল গাড়ি। চারপাশে কী যেন খুঁজল। বোধহয় সে ও—পাশের গ্যারেজ দেখছে। গ্যারেজ বন্ধ। গাড়ি ভিতরে আছে না বাইরে, সে বুঝতে পারছে না। রসুলকে সে বলল, সাব ফিরেছে?

না দিদিমণি।

এখনও কেন ফিরল না! তারপর আর কিছু বলল না সোমা। সে ঘড়িতে সময় দেখল, বারোটা বেজে গেছে। ওরা একটায় খায়। একসঙ্গে খায়। কলেজ বন্ধ বলে সোমাকে এখন আর আগে খেতে হয় না। মনীষ অপিস থেকে টিফিনে ফিরে এলে একসঙ্গে খায়। সে হয়তো অপিসে আজ যাবে না। হয়তো শরীরটা ভালো নেই বলে ফোনেই সব কাজটা সেরে নেবে। দরকারি সইটই—এর জন্য ফাইল পাঠিয়ে দিতে বলবে।

সোমার ধারণা, মনীষ এক্ষুনি এসে যাবে। বরং এ—ফাঁকে স্নান সেরে ফেললে হয়। কিন্তু সিঁড়ির মুখে ওঠার সময় মনে হল ওদিকে একটা ফুলের টব কাত হয়ে পড়ে আছে। বিশ্রী লাগল। মনটা তিক্ত হয়ে গেল। বাগানের মালিরা কী যে করে। এখানে সদানন্দ কাজ করে, এই সব ফুলের টব সদানন্দের দেখাশোনা করার কথা। এ—ভাবে কিছু অবহেলায় পড়ে থাকলে ওর মাথাটা কেমন গরম হয়ে যায়। কিন্তু মনীষ ফেরেনি, সে না ফেরা পর্যন্ত ওর ভিতরের চিন্তাটা যাচ্ছে না। কাঠের সিঁড়ি বলে শব্দ হয়। সিঁড়ি ধরে কেউ উঠে গেলেই টের পাওয়া যায়। একসময় এই কাঠের সিঁড়িটার জন্য ভীষণ রাগ ছিল সোমার! কেমন পুরোনো সাবেকি ব্যাপার? সে, যা কিছু পুরোনো সাবেকি ব্যাপার সব সেকেলে ভেবে থাকে। কাঠের সিঁড়িটা না থাকলেই যেন ভালো হত।

কিন্তু এখন সে তেমন ভাবে না। এটা না হলেই খারাপ হত। কাঠের সিঁড়িটায় কেউ পা দিলেই বোঝা যায়, কেউ উঠে আসছে। যদি অঞ্জন অথবা অন্য কেউ উঠে আসে তবে ঠিক টের পাওয়া যাবে। শব্দ শুনলেই টের পাবে কেউ উঠে আসছে। আর এ—কাঠের সিঁড়িতে উঠে আসে মনোরমা। মনোরমা উঠে এলে টের পাওয়া যায় মনোরমা উঠে আসছে। রসুল উঠে এলেও টের পাওয়া যায়, রসুল উঠে আসছে, ওদের পায়ের শব্দ এক—এক রকম। আর উঠে আসতে পারে কারখানার বড় বাবু। সে লোকটা মনীষের সব। লোকটা মনীষকে পাতালে নেমে যাবার সোজা রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছে। কাঠের সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ একেবারে আলাদা। কেমন ঘষটে ঘষটে একটা শব্দ। একটানা, উঠছে তো উঠছে। বাতে পঙ্গু হলে মানুষ যেমন হয়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, শব্দটাও তেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সারা বাড়িতে বলে দেয়, খোঁড়া লোকটা এখন কাঠের সিঁড়ি ভাঙছে। আর কারও উঠে আসার নিয়ম নেই। কেউ ওখানে পা দিতে পারে না। আর পারে অসিত। অসিত উঠে এলেও সোমা টের পায় অসিত উঠে আসছে। সুতরাং এ—সব শব্দ বাদে অন্য কোনো শব্দ হলেই মনীষ সাবধান হয়ে যেতে পারবে। সিঁড়িটা না থাকলে মনীষের পক্ষে এটা সম্ভব হত না।

সোমা এখন বাথরুমে। সে নানাবর্ণের সব সুগন্ধ জলে গুলে নিয়েছে। সে মুখে এবং হাতে পায়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে বেশ খোলামেলা আয়নার সামনে বসে রয়েছে। এই কাঠের সিঁড়িটা যা হোক একটা কানের কাজ করছে। মনীষের হয়ে বলে দিচ্ছে কে আসছে, এমন বিশ্বস্ত কাঠের সিঁড়ি। এখন আর তাকে সে সেকেলে অথবা পুরোনো আসবাবপত্রের মতো ভাবতে পারে না। বরং এ—বাড়িতে রসুল, রাম অবতারের মতো, বিশ্বাসী সৎ, ওরা নিদারুণভাবে গেটে থাকছে। যদিও সোমা জানে, যাদের আসার কথা, তারা গেট দিয়ে আসে না। গেট দিয়ে এলেও কেউ তাদের আটকাতে পারে না। সে কাগজে এমন কত খবর পড়েছে। ওর কেমন এই বাথরুমে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, আসলে সোমার বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় এমন একটি সুন্দর জায়গা। প্রায় চারপাশে লালবর্ণের কাজ করা পাথর বসানো দেয়ালে, আর দেয়াল জুড়ে আয়না। হেঁটে বেড়ালে বেশ লাগে। একটা শোবার ঘর এখানে ঢুকে যেতে পারে। আসলে সোমা এখানে এলেই নিজেকে চিনে ফেলতে পারে। সে তার শরীর চারপাশ থেকে তখন আয়নায় দেখতে পায়। শরীরে কী আছে, এবং সুন্দর স্তন, জঙ্ঘা কী যে পুষ্ট আর মনোরম, সে নিজের ছবিতে নিজেই কেমন তন্ময় হয়ে যায়—সেখানে দুটো মাত্র চোখ, এবং সহসা সে এটা কী দেখে ফেলছে, আয়নায় ওর, মাঝে মাঝে সেই চোখ দুটো, হুবহু, সেই পত্রিকার মুখ, হুবহু এক, এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে। সোমা চিৎকার করে উঠল, মনীষ, সে আসছে, সে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ ঘোলা হয়ে গেল। সে চারপাশে অন্ধকার দেখতে থাকল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

বারো

শান্তিবাবু দরজায় কেউ কড়া নাড়লেই কেমন হয়ে যায়। অবিবাহিত মানুষ। মা আছেন। আর একটা চাকর। তিন তলার ফ্ল্যাট। ইতিহাসের অধ্যাপক। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসটা বোধহয় খুব ভালো পড়া ছিল না, হলে একটা লিস্ট টানিয়ে দিতেই এত ভয় পাবার কথা না। প্রথমে নামটা দেখে ভেবেছিল, ভুল, ছাত্ররা তাকে ভীষণ ভালোবাসে, কিন্তু চোখ মেলে ফেরতাকালে বুঝেছিল, না ভুল নয়, ওরা ঠিকই ওর নাম লিখেছে, তবে ভালোবাসে বলে, একেবারে শেষে বোধহয় নামটা রেখেছে।

কড়া তখনও নড়ছে। এই এগারোটায় কে আসবে? হুট করে দরজা খোলার নিয়ম নেই। চাকরটাও সেয়ানা হয়ে গেছে। সে যে ভয়ে ভয়ে আছে, চাকরটা বুঝে ফেলেছে। সে দরজায় খট করে কড়া নাড়ার শব্দ পেলেই দৌড়ে আসে। দরজা খোলার আকুলতা। আগে দরজা ভেঙে ফেললেও ওর সাড়া পাওয়া যেত না। যেন জোর করে পাঠাতে হত। এখন আর সে—সব নেই, একেবারে কান খাড়া। এবং দরজা খোলার কথা বলেই বোধহয় বাবুর মুখ শুকিয়ে যায়, আর চাকরটি তাতে বেশ মজা পেয়ে যায়। শান্তিবাবু এখন নানাভাবে চেষ্টা করছে, মুখ স্বাভাবিক রাখার। যেন ওটা কিছু নয়, যেমন আগে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সে অনায়াসে চুরুট টানতে পারত, কপাল ঘামত না, এখনও তেমনি চোখ মুখ করতে গিয়ে বুঝতে পারে সে, বোকা বোকা মুখ। এ—মুখের মানে হয় না।

চাকরটা বলল, খুলব বাবু?

খুলবি!

অনেকক্ষণ থেকে কড়া নাড়ছে।

তা নাড়ুক। দ্যাখ না কে?

একজন বাবু মতো মানুষ।

সঙ্গে আর কেউ নেই তো?

না।

সঙ্গে কিছু নেই তো?

না।

বয়স কেমন?

আপনাদের বয়সি।

তা বল। বলেই শান্তিবাবু দরজায় এসে হোল দিয়ে মানুষটাকে দেখল। মানুষটাকে সে চিনতে পারল আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বলল। হ্যাল্লো। তুমি! কী খবর! হঠাৎ আমার এমন সৌভাগ্য!

মনীষ ঢুকেই বলল, দরজা বন্ধ করে দাও।

মানে!

মানে, তুমি কিছু জানো না!

সে যেন কিছু জানে না, এমন মুখে তাকাল।

মনীষ বলল, শুনলাম তোমার লিস্ট তৈরি!

ও একটা ঝুলিয়েছে। ওটা কিছু না।

তুমি কলেজে বের হচ্ছ?

তা হব না কেন। মা, দ্যাখো কে এসেছে!

মনীষ বুঝতে পারল না, লিস্ট টানিয়ে দিলে মুখ কেউ এমন করে রাখতে পারে।—সে ওর পেছনে পেছনে ভিতরে ঢুকে গেল। শান্তিবাবু দরজা বন্ধ করে দেবে ভাবল, কিন্তু ফিরে দেখল, বাড়ির ছোকরা চাকরটা আগেই দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। সে আর দাঁড়াল না। ভিতরে ঢুকে বসার ঘরটার চারপাশটা দেখল। ভালো করে দেখল সে। এখানে যদি ওরা এসে আগেই লুকিয়ে থাকে। মনীষ ফিসফিস করে বলল, ক’দিন আগে!

তা আজ ন দিন হবে।

ন দিনের ভিতর কোনো এটেমপট হয়নি!

না। সময় লাগবে। সতেরো জনের লিস্ট। যার নাম প্রথমে আছে তার আগে যাবার কথা।

তার কোনো ঠিক নেই। সে তারপর কী ভাবল। শরীরে একটা কী রকমের কষ্ট। এমন কষ্ট, অথচ সে বুঝতে পারছে না, কষ্ট কেন। সে বুঝল, ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। বোধহয় গলা শুকিয়ে গেছে। সে শান্তিকে দেখে কেমন একটু সাহস পাচ্ছে। নিজের কষ্টের কথা বলতে পারছে না। এটা আর কিছু নয়, জলের জন্য কষ্ট। সে এতক্ষণে বুঝতে পারল, ওর ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। সে বলল, আমি জল খাব।

শান্তি জলের জন্য ছোকরা চাকরটাকে ডাকল। বলল, ক্ষেত্র, বাবুকে শরবত করে দাও।

শরবত খেলে জল তেষ্টা যায় না। আমি জল খাব শান্তি।

এখন জল খাবে কী শরবত, এ—নিয়ে শান্তির মাথা ঘামাবার কথা না। সে বুঝতে পারছে না, মনীষ হঠাৎ এখানে কেন। ওর কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হবার কথা না মনীষের। মনীষ এ—জন্য ছুটে আসেনি। সে বলল, তোমার দিকে কোনো গণ্ডগোল নেই। পাড়াটা ভালো।

মনীষ জল খেল। জল না খেলে বোধহয় সে ভালো করে কথাই বলতে পারত না। চোখে মুখে ভীষণ আতঙ্ক। শান্তিবাবু মনীষের জল খাওয়া দেখে এটা বুঝতে পারছে। সে ফের বলল, সোমা কেমন আছে? ওর কিছু হয়নি তো?

ওর কিছু হতে যাবে কেন! মনীষ বুঝতে পারল না সোমার কথা এ—সময় আসে কী করে! পৃথিবীর সবাই যদি সোমার জন্য ভাবে তবে সে ভাববে কখন। সে জল খেয়ে যেন কিছুটা সাহস পেয়েছে। এখন সে সহজভাবে কথা বলতে পারছে। সে বলল, তোমার খবরটা পেয়ে কেমন মন খারাপ লাগছিল। ছুটে এলাম।

তা যদি হয়েই যায়, কী করা!

কিন্তু তোমার অপরাধ কী?

ওরা তো অপরাধের কথা জানায় না।

কেউ কেউ শুনেছি অপরাধের কথা জানিয়ে চিঠি দেয়। সে যে এমন একটা চিঠি পেয়েছে তা বলল না। কেউ পেয়েছে, এমন ভাবে কথা বলল। আসলে ওরা এখন দুজন, দেশের কে কোথায় কখন কীভাবে চিঠি পেয়েছে এবং তার ফলাফল সম্পর্কে কথা বলতে উৎসাহী। যদিও শান্তি খুব একটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখাচ্ছে। এটা একটা রোমান্টিক ব্যাপার। কিছু তো করতে হবে। দেশ উদ্ধারের কাজটা যদি গান্ধী না করে যেতেন, তবে বোধহয় এমনটা হত না। ওদের হাতে আর কোনো কাজ নেই। কিছু লোক খুন করে ওরা শোষণ বন্ধ করবে ভাবছে।

তুমি শোষণের কে? মনীষ পায়ের ওপর পা রেখে কথা বলছে। সে একটা চুরুট ধরাল, চুরুট ধরালে মুখে যে আতঙ্কের ছাপ আছে সেটা মুছে যায়। মনীষের চুরুট মুখে চেহারা অন্য রকমের। বরং ওকে তখন খুব চিন্তাশীল মানুষ দেখায়। সে বলল, কী যে এ—সব হচ্ছে!

এটা চলবে। আজ তো আঠারো উনিশটা গেছে।

পত্রিকা তুমি পড়!

না পড়লে শান্তি পাই না।

সোমা আমাকে পড়তে দেয় না। পত্রিকা এলে লুকিয়ে রাখে।

তুমি না পড়ে থাকতে পারো!

পারি না। লুকিয়ে যে আনাব তার উপায় নেই।

কেন আজকাল অফিসে যাচ্ছ না?

শরীরটা ভালো নেই। বাড়িতেই সব করছি।

দেখবে নাকি পত্রিকাটা?

মনীষ কী বলবে ভেবে পেল না। সে বলল, তুমি কি কাগজ পড়তে পছন্দ কর?

স্টেটসম্যান। এটাতে সঠিক খবর পাওয়া যায়।

একটু দেখলে হত।

এখন শান্তি কাগজটা খুঁজছে। আসলে কাগজটা সেও লুকিয়ে রাখে। একা পড়তে ওরও বোধহয় ভয় হয়। কোনোরকমে কিছুটা পড়েই রেখে দেবার স্বভাব। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে ভালো লাগে না। সে পত্রিকা খুলেই একটা খবর শুধু খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু খবরের শিরোনাম দেখলেই সে কেন সে সবটা পড়তে সাহস পায় না, শিরোনামটা পড়েই সে রেখে দেয়। তারপর সে ভাবে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের ওপর একটা বড় রকমের বক্তৃতা দেওয়া যাক। সে জানালায় দাঁড়িয়ে, কিছু পাহাড়—জঙ্গলের ছবি দেখতে পায়, একটা ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছে কারা দেখতে পায়, তখন মনে হয়, ব্রিজ উড়িয়ে দিলে দুটো—চারটে লাশ পড়বে, মরে থাকবে জঙ্গলের ভিতর, এবং এ নিয়মেই বিপ্লব সব জায়গায় হয়েছে। সে খানিকক্ষণ পায়চারি করতে থাকে, তারপর মনে হয় মৃত্যু একসময় হবেই, সে এ—জন্য বড় বেশি ভাবছে। এক কাপ চা দিতে বলে, সে আবার পত্রিকাটা খুলে পড়বে ভাবে, না, থাক, চা আসুক, চা খেতে খেতে পড়া যাবে। এবং এভাবে সে সেই একটা শিরোনামার সংবাদ যখন শেষ করে ফেলে তখন ঘড়িতে দশটা বাজে। কাগজ আসে সকাল সাতটায়। একটা শিরোনামা শেষ করতে ওর হয়ে যায় দশটা। সে একটা খবরই তারপর সারাদিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়ে। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যায়। নানাভাবে সে দেখতে চায় মৃত্যুগুলোর সঙ্গে ওর জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক কতটুকু। যেমন বিজ্ঞান কলেজের একজন অধ্যাপকের গলা কেটে দেওয়া হয়েছে, সবটা কাটাতে পারেনি, ঘাড়ে রেজার চালিয়েছে। ঘাড়ে রেজার চালাতে কতটা গভীর ক্ষত হতে পারে, একটা না দুটো, কবার, এবং সে যদি এমন একটা সমস্যার সম্মুখীন হয় তবে কীভাবে সে ওদের সঙ্গে যুঝবে, ওর তো ইচ্ছা, সে সময়ই দেবে না। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেবে, না তার চেয়ে পেছন দিক থেকে লাথি, সে এ—ভাবে বসে থাকবে যাতে করে ওর গলাটা কেউ কাছে না পায়। সব হত্যাই এ ভাবে যখন হচ্ছে তখন একটা পাতলা লোহার চাদরে মোড়া বর্ম জামার নিচে থাকলে কেমন হয়, কোনো বিজ্ঞাপনদাতা এমন একটা বিজ্ঞাপনও কেন যে দিচ্ছে না, মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো সে তবে বর্মের পোশাক পরে থাকত। সে মাঝে মাঝে পত্রিকার ভিতর বোধহয় এমন একটা বিজ্ঞাপনের খবরও পেতে চেষ্টা করে। আর এ—ভাবে এগারোটা বাজলে সে বুঝতে পারে, খবরটি শুধু ওর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়াই হয়নি, সেটা সে মুখস্থও করে ফেলেছে, তারপর সারাটা দিন, ঐসব নিহত মানুষের ছবি ওর চারপাশে ঘোরাফেরা করলে সে কেমন নিজেই পাগলের মতো জোরে জোরে কাকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা দিতে থাকে। এই এগারোটায় তার এক নম্বর বক্তৃতখানা আরম্ভ হবার কথা। মনীষ এসে কিছুটা অসুবিধা ঘটিয়েছে।

মনীষ বলল, কাগজে কী দেখছিস?

কিছু দেখছি না!

তবে এ—ভাবে ঝুঁকে আছিস কেন?

খুঁজছি।

কী খুঁজছিস?

বিজ্ঞাপন।

ধুস! বলে মনীষ কাগজটা জোর করে কেড়ে নিল।

মনীষ প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে দেখল সব হত্যাকাণ্ডের কথা লেখা আছে। বেশ জ্বল—জ্বল করছে লেখাগুলো। ছেলেছোকরা বয়সের হত্যাকাণ্ডে সে বেশ মজা পায়, কোনো মজুতদার অথবা পুলিশের হত্যাকাণ্ডে সে কেমন বিবর্ণ হয়ে যায়। পাঁচ—মেশালি হত্যাকাণ্ড কাগজটা জুড়ে, ছোট বড় সব রকমের। আর তাছাড়া সব হত্যাকাণ্ডের কথা লেখা হয় না, যেমন ওদের বাড়ির সামনে, ঠিক সামনে বলা যায় না, একটু পেছনে, রাস্তার ওপর একজন মানুষের গলাকাটা। কে খুন করল, কখন, কারা, কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। খবরটা পর্যন্ত কাগজে বের হয়নি। আর এ—ভাবে, চারপাশে যে হত্যাকাণ্ড চলছে, তার ঠিক হুবহু ছবি কেউ দিতে পারে না। বারাসতে আটটা না আটশো কে বলতে পারবে। কীভাবে যে মাটির নিচে সব চাপা দিয়ে কেমন হাত সাফসোফ করে ভালো মানুষ সেজে যাচ্ছে সবাই।

শান্তি বলল, কী দেখলে?

মনীষ কোনো জবাব দিচ্ছে না।

কী দেখবে! আমার কাছে শোনো। আমি না দেখেও সব তোমাকে হুবহু বলে দিতে পারি।

মনীষ বলল, তোমাদের এক নম্বর যিনি তার খবরাখবর তুমি রাখো?

হ্যাঁ।

তিনি কোথায় আছেন?

তিনি এখন এখানে নেই। ওর শ্যালক থাকে গোণ্ডাতে। সেখানে চলে গেছে।

গোণ্ডা! সে আবার কোথায়?

উত্তরপ্রদেশে বোধহয়।

বেনারসের কাছে একটা খুন হয়েছে।

তাতে তোমার কী মনে হয়?

দ্যাখো এক নম্বর কিনা তোমাদের!

এক নম্বর হতে যাবে কেন?

হতেও তো পারে।

শান্তিবাবুর মনে হচ্ছে, না হওয়াটাই শ্রেয়। হলেই, ওর নম্বর কমে আসবে। বুকটা কেমন করতে থাকল। মুখে ভয় ধরা পড়ুক, সে চাইল না। সে বেশ সোজাসুজি তাকিয়ে থাকল। কিছু বলতে পারল না।

মনীষ বলল, তোমাদের এক নম্বরের ঠিকানা জান না?

তা জানি।

ফোন টোন আছে?

তা আছে।

তোমার কলিগ! ফোন করে খবর নেওয়া উচিত।

শান্তি উঠে দাঁড়াল। ফোন করা ঠিক হবে কিনা, কীভাবে ফোন করবে, কী বলবে এ—সব ভাবল। অধীরবাবুর মা আর বোন আছে। এক ভাই আছে। সে বাড়ি থাকে না। বাড়িতে সে ঢুকতে পারে না। সে ভাবল, ফোন করে বলবে, অধীরবাবুর কোনো চিঠি এসেছে কিনা! অধীরবাবুর স্ত্রী এখন কোথায়! যেন পারিবারিক কুশল নেওয়া। ফোনে যে স্বর ভেসে এল, অচেনা। কোনোদিন এমন স্বরে কেউ কথা বলতে পারে সে ভাবতে পারে না। সে বলল, তাহলে…।

হ্যাঁ।

ওটা ঠিক খবর।

বউদির ভাই টেলিগ্রাম করেছেন।

সত্যি খবর।

ও—পাশের কণ্ঠস্বর ভাঙা কিছু আর বলতে পারছে না, কান্নায় ভেঙে পড়ছে। এবং শান্তি একেবারে কেমন সাদা ফ্যাকাশে, দাঁড়াতে পারছে না, কোনোরকমে এসে সোফাতে হেলান দিয়ে বসে বলল, মনীষ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের এক নম্বর গেছে।

তারপর ওরা দুজনই চুপচাপ। চা রেখে গেছে। শান্তিবাবুর মা এ—বাড়িতে আছে টের পাওয়া যাচ্ছে না। নিঝুম, নিরিবিলি, কেবল চাকরটা ভীষণ দর্পের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করছে। কড়াইয়ে সে কিছু ভাজছে, সে এত জোরে জোরে খুন্তি চালাচ্ছিল যে মনে হয়, বাবুদের মজা দেখে সে খুন্তি নেড়ে তামাশা দেখাচ্ছে। আর ওরা দুজন মুখোমুখি। কীভাবে যে সব হয়ে যাচ্ছে! মনীষ বলল, উঠি।

বোসো।

মনীষ এখন উঠি বললেই উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে যখন নেমে যাবে সিঁড়ি ধরে, তখন দু—পাশ থেকে ওরা জড়িয়ে ধরবে। গলার শ্বাসনালিটা টুক করে কেটে দেবে। সে টেরও পাবে না। সে, নিজের গলাকাটা, অর্থাৎ শ্বাসনালি কাটা, রক্ত ওগলাচ্ছে, শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে এমন একটা দৃশ্যের কথা ভাবলেই কেমন চোখে ঘোলা ঘোলা দেখতে থাকে। কেমন তখন নিজেকে কবন্ধের মতো মনে হয়। সে একটা হত্যাকাণ্ডের হুবহু বর্ণনা দিয়েছিল। ভোজালি দিয়ে সাঁই করে মাথাটা কেটে দিলেও মানুষটা মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে। হাওয়ায় হাত দুটো যেন খুঁজে বেড়ায় শ্বাস—প্রশ্বাসের কারুকার্য। তারপর ধপাস করে পড়ে যায়। পৃথিবীতে এমন একটা দৃশ্য মনীষ যে—কোনো সময় তৈরি করে ফেলতে পারে। আর তৈরি করতে পারে ভেবে ফেললেই, সে পায়ে আর শক্তি পায় না। সিঁড়ি ধরে কীভাবে নেমে যেতে হবে সে যেন বুঝতে পারে না।

তবু সে উঠে পড়ল। এখানে আর তাকে কে চেনে। কিন্তু সেই সুদূর গোণ্ডাতে শান্তিদের এক নম্বরকে কে চিনত। এক নম্বর গেছে, এখন দুনম্বর যেখানেই পালাক না রক্ষা নেই। শান্তির সতেরো নম্বর। সতেরো না সাতাশ, না সাত। এত কম সময়ে সে সব গুলিয়ে ফেলছে। সে সতেরো হোক, সাতাশ হোক, আসে যায় না, শান্তি তুমি যাবে। আমিও যাব। তবে শালা আমি আর এখানে থাকছি না। ভেবেই সে সটান উঠে দাঁড়াল। শান্তিকে কিছু বলল না। যারা চিঠি পায় তারা বাঁচে না। লিস্টে নাম উঠে গেলে রক্ষা থাকে না। এখন একমাত্র বিদেশে পাড়ি দেওয়া, আর না হলে অগত্যা একটা শান্তির মতো বর্ম তৈরি করে নেওয়া। শান্তি ওকে চুপি চুপি ভিতরে একটা বর্ম পরতে বলেছিল। লোহার অথবা ভালো বিদেশি ইলেকট্রনিক টিনের প্লেট দিয়ে বর্ম। ফুল হাতা গেঞ্জির মতো ভিতরে পরে থাকবে। গলায় চোপ বসাতে পারে, তা গলাটা ঢাকা থাকবে। চারপাশ থেকে ঢাকা গলার নতুন পোশাক, অথবা সে বলবে এটা প্যাটার্ন এখন পোশাকের, পরে থাকলে, তা গুলি বারুদ এবং হাত চালাচালি সব নিরর্থক হয়ে যাবে।

শান্তিবাবু বলল, আমি আর নামছি না। শরীরটা ভালো নেই।

মনীষ জবাব দিল না। শান্তি এক নম্বর গেছে শুনে নিচে নেমে যেতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু দরজার কাছে গেলে ফের শান্তিবাবু ডাকল, মনীষ শুনতে পাচ্ছ?

কী?

কেমন জোরে জোরে খুন্তি নাড়ছে?

তা শুনতে পাচ্ছি।

স্পাই নাতো!

কী করে বলব!

কিছু বলতেও পারি না! যা খুশি করছে!

রাখছ কেন? লাথি মারতে পারছ না?

মারব। সময় আসুক। এমন লাথি মারব না, একেবারে উলটে পড়বে। নাক থেঁতলে যাবে। গল গল করে মুখ দিয়ে রক্ত বের হবে।

আর তখনই চাকরটা এদিকে আসছে দেখে মনীষ চোখে আঙুল রেখে ইশারা করল। তারপর বলল, যাচ্ছি।

যাও।

ছোকরা চাকরটা এদিকে এসেই আবার বাঁই করে ঘুরে গেল। যেন কী আনতে ভুলে গেছে। সেটা নিয়ে সে নিচে নেমে যাবে। এখন মনীষ ভাবতে পারছে না, আসলে ওর মতলব কী! সে দ্রুত দু লাফে সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। এবং সেও বাঁই করে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। এলোমেলো চালিয়ে যখন গাড়ি নিয়ে বাড়ি ঢুকল তখন এক কঠিন কাণ্ড। মনোরমা হাই হাই করছে। অসিত নেমে যাচ্ছে। ওর ভিতরটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। সে বোকার মতো অসিতকে দেখল, কিছু বলতে পারল না। অসিত বলল, ভিতরে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

তেরো

সোমার মনে হল কেউ ডাকছে। অনেক দূর থেকে ডাকছে। সে চোখ খুলে তাকালে দেখল, পাশে মনীষ দাঁড়িয়ে। সে মনীষকে ঠিক চিনতে পারছে না বোধহয়। একটা অসীম শূন্যতার ভিতর সোমা ডুবে যাচ্ছে। ঠিক ডুবে যাচ্ছে কিনা বলা যায় না, কেমন ডুবে যেতে তার ভালো লাগছে। এবং চোখ বুজলেই কেমন সে হালকা, বাতাসে ভর দিয়ে সে যেন অনেকদূর চলে যেতে পারে। তার দুটো হাত এখন পাখির ডানার মতো। অথবা বাতাসে সাঁতার কাটার মতো সে এগিয়ে যায়, আর এখন কেউ ডাকলে মনে হয়, অনেক দূর থেকে, যেন কেমন অনন্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ছোট একটা নক্ষত্রের মতো তাকে বলছে, সোমা, তোমার তো কাজল পরার কথা ছিল না। চোখে কেন যে কাজল পরতে গেলে।

সোমা বলল, আমি কাজল পরি না। কখনও পরি না। সেই যে তুমি বললে, তারপর থেকে পরি না।

মনীষ দেখল সোমা চোখ বুজেই বিড়বিড় করছে। এমন দেখলে কে আর স্থির থাকতে পারে। অসিতের সঙ্গে পরামর্শ দরকার। সে এখন কী করতে পারে। আসলে ভয়ে এমন হয়েছে। ওর চেয়ে সোমা বেশি ভয় পেয়ে গেছে। সে এ—ভাবে এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। সে এবার চিৎকার করে ডাকল, মনোরমা মনোরমা!

মনোরমা ছুটে এল। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

মনীষ বলল, কী হয়েছিল!

কে একজন এসেছিল! বলল সোমা আছে?

সোমা! সোমার কথা বলল!

হ্যাঁ। বলল, ওকে ডেকে দেবে তো।

নাম কী বলল?

নাম বলল না। বলল, এলেই আমাকে চিনতে পারবে।

মনীষ নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে পারলে যেন বেঁচে যেত। সে ব্যালকনিতে ছুটে এসে ডাকল, রসুল! রসুল!

রসুল ছুটে এলে বলল, কে এসেছিল।

কেউ নাতো সাব।

কেউ না!

না।

মনোরমা। সে আকাশ ফাটিয়ে বলল, এসব বাড়িতে কী হচ্ছে! আমি সবাইকে তাড়িয়ে দেব। তোমরা সবাই নেশা করছ।

না দাদাবাবু নেশা করছি না। আমি বললুম, বসুন। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দিদিমণিকে দেখতে পেলাম না। বাথরুম বন্ধ। ডাকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। এসে বললাম, বসুন। দেরি হবে।

মনীষ বলল, তুমি বসতে বললে!

মনোরমা দরজার পাশ থেকেই বলল, কিন্তু তিনি বসলেন না। বললেন, ঠিক আছে আমি আবার আসব। হাতে আমার অনেক কাজ। দেরি করলে ক্ষতি হবে।

ইস! কী যে সুযোগ গেল! তারপরই মনে হল সে ছেলেমানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে। রসুল, রাম অবতার এরা কী যে করল, ওরা দেখতে পেল না কেন! না কী রসুল, রাম অবতার সবাই একসঙ্গে ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যেমন, শান্তির চাকরটা খেতে পেত না, ফুটপাথ থেকে তুলে এনে খেতে দিয়েছিল শান্তি, এখন সেই বেশ বড় বড় পা ফেলে হাঁটে। বাবুরা ভয় পেলে সে মজা পায়। এরা কী শান্তির চাকরের মতো এখন ওর বিপদে তামাশা দেখাচ্ছে। এখন কিছু করা যাবে না। সেই যে সময় এলে এক লাথি, শালা সব তখন উলটে পড়বে। মনীষ খুব নরম গলায় মনোরমাকে বলল, দেখতে কেমন!

রাজপুরুষের মতো দাদাবাবু। খুব লম্বা। চোখ বড়। চুল ঘন। রং একেবারে দুধে আলতায়। চোখে না দেখলে মানুষ এমন সুন্দর হয় কেউ বিশ্বাস করবে না।

মনীষ বলল, ও তারপর চলে গেল!

চলে গেল।

কীভাবে গেল।

কাঠের সিঁড়ি ধরে!

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেছিলে!

হ্যাঁ।

মানুষের পায়ের শব্দ!

একেবারে মানুষের মতো। মনোরমা দেখল, কেমন বলতে বলতে দাদাবাবু ভেঙে পড়ছে। অথবা অন্ধকার রাতে কোনো নিরিবিলি জায়গায় ভূত দেখলে যেমন মানুষ ভয় পায়, তেমনি ভয় পেয়ে যাচ্ছে। চোখমুখের অবস্থা দেখে মনোরমার ভীষণ কষ্ট হতে থাকল। এত যার দাপট, নিমেষে, কী করুণ চোখ মুখ হয়ে যাচ্ছে। একেবারে গলা নামিয়ে কথা বলছে, যেন কেউ শুনতে না পায়।

মনীষ বলল, তুমি মানুষের পায়ের শব্দ চেনো!

চিনি বাবু।

শব্দটা হালকা ছিল, না দুপদাপ।

হালকা ছিল। খুব চিন্তিত মনে মানুষ সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমনি।

মনীষ বলল, তখনও বাথরুম থেকে সোমা বের হয়নি!

না।

তুমি তখন কোথায় ছিলে!

রান্নাঘরে।

রান্নাঘর থেকে শোনা যায়!

যায় বাবু।

লোকটা সিঁড়িতে নামতে নামতে তুমি রান্নাঘরে যেতে পার!

পারি দাদাবাবু।

কোথায় বসেছিল!

মনোরমা পার্লারে ঢুকে নীল রঙের একটা সোফা দেখাল।

মনীষ বলল, তুমি এখানে বসো।

মনোরমা ভেবে পেল না, দাদাবাবু এমন বলছেন কেন! ঠাট্টা করছেন না তো! তিনি তো কখনও ওর সঙ্গে ঠাট্টা করেন না, সে কেমন হতভম্ব। সে তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল।

কী বললাম!

দাদাবাবু আপনি এ—সব কী বলছেন!

ঠিক বলছি। তুমি বসো!

আমি কবে ওখানে বসেছি।

এখন থেকে তোমরাই ওখানে বসবে।

মনোরমা এখন কী যে করে! সে খুব সংকোচের সঙ্গে এগিয়ে গেল। দাদাবাবু পাগল হয়ে যাচ্ছে, সে ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বসল।

মনীষ বলল, লোকটা আগে বের হয়েছিল পার্লার থেকে, না তুমি।

তিনি ভিতরে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল, আমি গেলাম।

ঠিক আছে। এবারে তুমি আমায় পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটো।

মনোরমা পাগলের পাল্লায় পড়ে গেছে! নতুবা বাড়িটাতে এমনভাবে একটা উপদ্রব দেখা দেবে কেন। এঁরা কী যে হাসিখুশি ছিল, ক’দিনে বাড়ির চেহারা কী হয়ে গেল! যেন চেনা যায় না, কেউ কাউকে চেনে না। সবসময় কী এক ভয়াবহ দৃশ্য ঝুলে থাকে। সবসময় মনে হয় কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। কেবল সময় গুণে যাচ্ছে। যে—কোনো সময় দেখা যাবে, পার্লারে অথবা করিডোর অথবা বাগানে কেউ মরে পড়ে আছে। মনোরমা কথামতো পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল। সে সিঁড়ির দিকে গেলে সে দেখতে পেল, দাদাবাবু রান্নাঘরের দিকে ঠিক একজন মেয়ের যেভাবে হেঁটে যাবার কথা তেমনি হেঁটে যাচ্ছেন। সে এমন দেখে হাসবে কী কাঁদবে ভেবে পেল না। সে শুধু যেমন একজন লোক এসে নেমে যায় সিঁড়ি ধরে তেমনি নেমে গেল।

এটা রান্নাঘর না বলে প্যান্ট্রি বলাই ভালো। প্যান্ট্রিতে ঢুকে মনীষ খুব সন্তর্পণে সেই পায়ের শব্দ শুনতে থাকল। নেমে যাচ্ছে। প্যান্ট্রিতে দাঁড়িয়ে সত্যি তবে শোনা যায়। মনোরমা কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। মনোরমা হুবহু ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ভাঙা রেকর্ডের মতো ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, সে দু—কানে হাত রেখে একেবারে সোজা ঘরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, মনোরমা নিচের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দাও। বাগানের দিকে রসুলকে পাহারা দিতে বল। রাম অবতার গেটে থাকুক। কেউ যেন ভিতরে ঢুকতে না পারে!

এবং এমন চেঁচামেচিতে মনে হয় সোমা জেগে গেছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, মনীষ এমন করে চিৎকার করছে কেন। সহসা ঝড় উঠলে, যেমন ঘরের দরজা জানালা ছুটে ছুটে বন্ধ করে দিতে হয়, তেমনি মনীষ দরজা জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, এটা করছে কেন মনীষ। এখন তো বেশ পরিষ্কার শীতের আকাশ। মনীষ এতক্ষণ কোথায় ছিল, সে কোথায় ছিল! সে তো বাথরুমে ছিল, তারপর, তারপর, হ্যাঁ মনে পড়ছে দুটো চোখ, তারপর তারপর, সে কী ভেবে বলল, তারপর কী মনীষ?

মনীষ দেখল সোমা একেবারে তাজা মেয়ের মতো বিছানায় হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। কে বলবে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। কে বলবে, বাড়িতে এমন তুমুল কাণ্ড ঘটে গেছে। কেউ এসেছিল, সোমার জন্য। সে কে! সোমা কি কাউকে আসতে বলেছিল!

মনীষ বলল, তুমি খাওনি সোমা!

তুমি খেয়েছ?

না।

দরজা জানালা বন্ধ করে রাখছ কেন!

একটা লোক এসেছিল। তুমি তখন বাথরুমে ছিলে।

সে কোথায়!

চলে গেছে।

তাকে চলে যেতে দিলে কেন!

আমি কি বাড়ি ছিলাম! এসে শুনলাম।

দরজা জানালা খুলে দাও। লক্ষ্মী আমার। দরজা জানালা বন্ধ করে রাখলে শ্বাস ফেলতে পারি না, কেমন কষ্ট হয়।

কিন্তু সে যদি আসে!

এলে তাকে বসতে বলবে।

মাই গড। পুলিশে খবর দেব না?

পুলিশে খবর দিতে নেই। শোনো।

মনীষ কাছে এগিয়ে গেলে সোমা বলল, তুমি ভালো হয়ে যাও। ভালো হলে আমাদের কোনো আর ভয় থাকবে না। না হলে তুমি পাগল হয়ে যাবে মনীষ। আমিও।

মনীষ বলল, আমি কি ভালো হব?

মানুষের অনিষ্ট করে টাকা কামিয়ো না।

মনীষ হাসল। মেয়েমানুষের মতো কথা। সে অবশ্য খুলে কিছু বলল না। কেবল বলল, ভাবা যাবে। এখন তো আমরা দরজা জানলা বন্ধ করে থাকি।

সোমা কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মনীষের ভিতর এক পাপ, টাকার পাপ, অথবা লোভ, চারপাশ থেকে এই বাড়ি, ফুল ফল বাগান ঘিরে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, মনীষ আর ইচ্ছে করলেও বোধহয় সরে আসতে পারে না। কিন্তু সোমা বুঝতে পারে এ—ভাবে বাঁচা যায় না। সে উঠে দরজা জানালা খুলে দিতে থাকল। বলল, হাওয়া আসতে দাও।

মনীষ বুঝতে পারল না কী করবে। সে খুব একটা জোরজারও করতে পারে না। সেদিন কেন যে মরতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, আর সেই থেকে এক এক করে উপদ্রব। এবং মনে হয় এ—ভাবে চললে, ভয়ে সে নিজেই আত্মহত্যা করে বসবে। সে বলল, সোমা, আমরা কিন্তু কেউ খাইনি।

এই খাবার নাম শুনলে, অথবা মনীষ খায়নি শুনলে একটু স্বাভাবিক মুখ হয়ে যায় সোমার। সে টেবিলে বসে বলল, এসো।

ওরা দুজনে মুখোমুখি চুপচাপ খেতে থাকল। আজ যত টেলিফোন এসেছে সবার কাছে এক জবাব, মিস্টার দত্ত বাড়ি নেই। মিসেস দত্ত বাড়ি নেই। ওরা বাড়ির ভিতরই ক্যামোফ্লাইজ করে থাকবে ভাবল। কিন্তু বিকেলের দিকে একটা ফোন এল, ফোনে কে একজন কথা বলবেই। যত রসুল বলল, সাহেব বাড়িতে নেই, তত জেদ। বলছে, আমি জানি আছে, তুমি দাও। লাইনটা ওপরে দেবে কী না ভাবছে রসুল। সে যত বলছে, সাহাব নেই, তত সে বলছে, আছে, আমি জানি আছে। আমার সঙ্গে নেই বলে কী হবে!

আর লাইনটা দিয়েই রসুল, সাহাব, বাবুজী বলছে, আপনি আছেন ওকে নেই বলে কিছু হবে না!

মনীষের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। হাত ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে কথা বলতে পারছে না দেখে তাড়াতাড়ি ফোন সোমা কেড়ে নিল। বলল, হ্যালো, কে আপনি।

বিনু বলছি।

বিনু! কেমন কিছুক্ষণ ফোনের ওপর সোমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কিছু বলতে পারল না। বিনুর গলা, যেন অনেক দূর থেকে কেউ অভয় দেবার মতো কথা বলছে। এবং বিনু খুব সহজে বলে গেল, মনীষের শরীর কেমন!

সোমা ভেবে পেল না, এমন সব কথা বিনু বলছে কেন? সে বলল, ভালো। ভালো বলেও নিস্তার নেই, আর ভেবে পেল না বিনু কুশল নিচ্ছে কেন! বিনু তো কতদিন হয়ে গেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর আর মনীষের কুশল নেয়নি। বিনুর ভাই, কী যেন নাম, এখন সুখী রাজপুত্র, স্বপ্ন দেখছে, পৃথিবী পালটে দেবে, সেই কী খবর দিয়েছে, দাদা তোমার বন্ধুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে খবর নেবে। সোমা বলল, হঠাৎ এ—কথা বললি কেন?

হঠাৎ নয়তো! মনে হল তোদের কিছু হয়েছে। আমাদের খুলে বলছিস না। তুই চলে যাবার পর এটা আমার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, তোর কথাবার্তা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। তারপরই ভাবলাম তোকে একটা ফোন করি, তুই কেমন আছিস, মনীষ কেমন আছে?

সোমা বলল, ও! আমরা ভালোই আছি।

বিনু বলল, আমরা ভালো নেই। ভাইটি আমার ধরা পড়েছে। তবে ভাগ্য আমাদের, গুলি করেনি পুলিশ। তবে যা মেরেছে, ওর আর জীবনে কিছু করে খেতে হবে না।

কবে হল এটা।

তুই যাবার পরই খবর এল। আমরা গেলাম। আসলে সে বেশ ক’দিন আগেই ধরা পড়েছে। আমরা জানতাম না। দেখামাত্রই গুলি—এই নির্দেশ ছিল পুলিশের। যখন জানতে পারলাম, না তা হয়নি, প্রাণে বেঁচে গেছে, তখন সোমা, তোকে কী বলব, কী যে আনন্দ আমাদের। মা এখন আর দুঃখী না। জেলে আছে, আর কিছু হবে না এমন ভেবেছে। জেলেও অবশ্য ঠিক নেই। ওদের মেডিকেল ওয়ার্ডে আছে। দেখে এলাম। পাশ ফিরতে পারছে না। তবে বাঁচবে, মরবে না। ওরা তো এত সহজে মরে না!

কেন মরে না!

মরবে কী, ওরা তো বারবার এ—ভাবে মার খায়।

মার খেয়েও বাঁচে।

তা বাঁচে বোধহয়। না হলে এ—সব হচ্ছে কী করে!

সোমার ভালো লাগছিল না! মনীষ বুঝতে পারছে না এমন অন্তরঙ্গভাবে সোমা কার সঙ্গে কথা বলছে! একবার বলছিল সোমা, বিনু! বিনুর সঙ্গে তবে কথা বলছে! কিন্তু বিনুর সঙ্গে কথা বললে, সোমার তো এ—ভাবে কথা বলার স্বভাব না। কেমন অপরিচিতের মতো কথা বলছে, আসলে কী সেই লোকটা কখনও সোমার কাছে বিনু হয়ে যায় অথবা অশোক, অথবা অঞ্জন। সেই লোকটা কী পৃথিবীর সব ভালো কথা বলে বেড়ায়। সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র এবং আবাসের ব্যবস্থা থাকবে। সেটা তো ভালো কথা। সেটা তো সেও চায়। সব মানুষ সুখে থাকুক। কিন্তু সব মানুষ যখন সুখে থাকতে পারে না, তখন সে একা কী করতে পারে। সব মানুষের জন্য যখন সব থাকে না, কিছু কিছু মানুষের জন্য যখন সব থাকে, তখন তাকে বাধ্য হয়ে কিছু মানুষের দলে ভিড়ে যেতে হয়। সে বলল, কার সঙ্গে কথা বলছ?

বিনুর সঙ্গে।

বিনু কথা বলছে!

হ্যাঁ।

কী বলছে?

বলছে, তুমি কেমন আছো?

তবে আমাকে দাও, আমি কথা বলছি।

সোমার হাত থেকে মনীষ ফোন তুলে নিল। বলল, কীরে ব্যাটা বিনু! খুব উৎফুল্ল দেখাতে চাইল। সেদিন দেখা হবার পর যে ওদের বাড়িতে একটা ভয়ংকর কাণ্ড রাতদিন জেঁকে বসেছে, সেটা সে কথাবার্তায় একেবারে বুঝতে দিল না।

বিনু বলল, সোমা সেই লোকটাকে খুঁজে পেয়েছে!

মনীষ কী বলবে বুঝতে পারল না। সে সোমার দিকে তাকাল। সোমা চোখ টিপে বলল, বলে দাও, পাওয়া গেছে।

মনীষ বলল, পাওয়া গেছে!

যাক তবে নিশ্চিন্ত সোমা।

মনীষ তাকাল সোমার দিকে। সোমা বুঝতে পারছে না কী বলবে। ফোনের মুখে হাত রেখে বলল, বলছে, যাক তবে নিশ্চিন্ত!

বলে দাও, নিশ্চিন্ত।

মনীষ বলল, নিশ্চিন্ত।

বিনু এবার বলল, কে লোকটারে?

মনীষ কী বলবে! সে বলল, দাঁড়া জিজ্ঞেস করি! সে সোমার দিকে তাকিয়ে বলল, কে লোকটা জিজ্ঞেস করছে!

সোমা বলল, সে আছে।

মনীষ বলল ফোনে, সে আছে।

বিনু বলল, জিজ্ঞেস কর তো আমরা তাকে চিনি কি না?

মনীষ বলল, বিনু জিজ্ঞেস করছে, আমরা তাকে চিনি কি না!

সোমা বলল, না।

মনীষ বলল, না। আমরা কেউ তাকে চিনি না।

বিনু বলল, ভালো কথা না।

নিশ্চয়ই না।

বিনু বলল, সেই লোকটাই যত নষ্টের গোড়া।

আমারও তাই মনে হচ্ছে।

সোমা কেন যে এ—ভাবে ঘুরে বেড়ায় বুঝি না!

আমিও না।

তারপর দুজনই চুপচাপ।

বিনু বলল, শুনেছিস!

কী!

বড়বাজারে হুজুরিমল আগরওয়ালের গলা কেটে দিয়েছে। একেবারে দিনের বেলা হাজার লোকের সামনে। তিন চারটি ছেলে এল। বলল, আপনারা যে যার কাজ করে যান। এদিকে তাকাবেন না। লোকটিকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করেছি। বলে গোটা চারেক বোমা। ব্যাস ট্রাম বাস বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা। দেখা গেল হুজুরিমল রাস্তায় চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। অত বড় ভুঁড়ি নিয়ে পড়ে আছে যে দেখলে পর্যন্ত কুৎসিত লাগে। পৃথিবীর সবকিছু বেনামিতে লোকটা গিলতে চেয়েছিল। ওরা ঠিক টের পায়। ভালোই হচ্ছে। একদিকে এটা তার কাম্য ছিল। না হলে শালা এই ভারতবর্ষের লোক মানুষ হবে না। এমন অসাম্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে জানি না। কিছু লোক কেবল ক্রমাগত বড় লোক হচ্ছে,…হচ্ছে…হচ্ছে। সেই ভাঙা রেকর্ডের মতো গলা। কিন্তু আশ্চর্য বিনু ফোনে হাঁ হুঁ শুনতে না পেয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। বলল, এই শুনছিস!

হ্যাঁ।

শুনতে পাচ্ছিস। আমি কী বললাম, শুনতে পাচ্ছিস!

হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।

কিছু বলছিস না কেন?

কী বলব!

তোর কী মত!

আমার মত, এভাবে কি সমস্যা সমাধান হবে!

সমস্যা সমাধান কথাটা যেন ভীষণ লম্বা কথা। ভাগে ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। অনেক লম্বা অঙ্ক। অনেকবার, বারবার কষে কষে দেখতে হবে ব্যাপারটা কী। এবং এ—জন্য বোধহয় ওরা দুজনই চুপচাপ ফোনের দু প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না।

সোমা আর থাকতে না পেরে বলল, বিনু এত কী বলছে!

মনীষ বলল, একদিন আসিস।

যাব।

ছাড়ছি।

আচ্ছা।

ওরা দুজনেই ফোন ছেড়ে দিল।

কিছু বলছ না যে?

মনীষ সোফাতে গা এলিয়ে দিল। আসলে ও আর দাঁড়াতে পারছিল না। ওর হাত—পা কাঁপছিল। সে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বোধহয় পড়ে যেত। সে বলল, কিছু না।

কিছু না মানে।

কিছু না মানে কিছু না।

সোমা অধৈর্য গলায় বলল, এতক্ষণ কেউ কিছু না বলে থাকে না।

এখন এ—সব কথা ওর বলতে ভালো লাগছে না। সব ব্যাপারটাই ভীষণ গণ্ডগোলের। সে অবিশ্বাসের চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

এমনভাবে কী দেখছ আমার!

আচ্ছা সোমা, সত্যি কি তুমি সেই চোখ দুটোর খবর পেয়েছ!

সোমা হেসে দিল। বলল, বলতে হয় বলা।

মনীষ তবু বিশ্বাস করতে পারল না সোমাকে। সবাই কী তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই বলল, সোমা, সে ওকে দেখেছে। সে বুঝতে পেরেছে লোকটা কে! অথচ এখন বলছে, বলতে হয় বলা। সেও আর ধৈর্য রক্ষা করতে পারছে না। হুজুরিমল কি সব জেনে ফেলেছিল। ওর সংসারেও কি এমনভাবে একটা লুকোচুরি খেলা, ঠিক ডেথ ডেথ খেলার মতো ব্যাপার ঘটেছে! সে চিৎকার করে বলল, ঠিক তুমি ওকে খুঁজে পেয়েছ। আমার কাছে এখন তুমি মিথ্যা কথা বলছ!

কীসে কী যে হয়ে যায়! সোমা বলল, সত্যি বলছি, আমি জানি না। বিনুর এত ঔৎসুক্য আমার ভালো লাগছিল না। এ—জন্য বলছি সে আছে।

মনীষ আর পারছে না। সে আবার চিৎকার করে বলে উঠল, এখানে আর থাকছি না। আমি ঠিক পালাব।

এবং সে রাতেই মনীষ কলকাতা ছেড়ে একা পালাল। কাউকে কোনো ঠিকানা দিয়ে গেল না। সোমা সকালে সবাইকে ফোনে জানাল, গতকাল থেকে মনীষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এখন কী যে করি!

চৌদ্দ

সুতরাং সকালের দিকে বাড়িতে একটা থমথমে ভাব। সোমা সবাইকে ফোনে খবরটা দিয়েছে। পুলিশে এখনও খবর দেওয়া হয়নি। মনীষ একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। শুধু লিখেছে, আমি যাচ্ছি। কলকাতায় থাকলে, আমি পাগল হয়ে যাব। কাউকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। সংসারে এ—সব যখন হচ্ছে, তখন তাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। পরিচয়হীনভাবে কিছুদিন থাকছি। এ—সময়ে বোধহয় এর চেয়ে আর বড় উপায় আমার জানা নেই। আমার জন্য চিন্তা করবে না। বড়বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে কারখানা চালাবে। আর মনে রেখো, ইচ্ছা করলেই সব একদিনে পালটানো যায় না। তুমি হলেও পারতে না। আমরা সবাই ভীষণ অসহায়। অসহায় হলে প্রত্যেক মানুষই নিজের নিরাপত্তার জন্য যে—ভাবে হোক টাকা রোজগার করে যাবে। এখন তুমি যা ভালো মনে কর করবে। সোমা চিঠিটা বারবার পড়ে অনেক ভেবেছে। এখন কার কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়, বিনুকে ডাকলে হয়, সুধীর অথবা অশোক এবং অসিতবাবু, এরাই তাকে কী করা দরকার পথ বাতলে দিতে পারে।

প্রথম ওর দরকার বিনুর সঙ্গে। প্রথমে সে বিনুকেই ফোন করছিল।

বিনুর পাশের বাড়িতে ফোন আছে। ওর নেই। দরকার—টরকার পড়লে ডেকে দেয়। এমন সকালে কে ফোন করছে সে বুঝতে পারল না। সে ভাবল, বোধহয় পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে। কারণ হাসপাতালে ওর ভাই। ওর ভাই কি তবে মারা গেছে! ফোন যখন কিছু আরজেন্ট ব্যাপার। না হলে এমন সাতসকালে কেউ ফোন করে না। ওর বুকটা ফোনের খবর পেয়েই ধক করে উঠেছিল। মা ছুটে এসেছিল, ফোন, ফোন কেন রে!

এমন সময়ে বাড়ির সবাই খুব সতর্ক থাকে। যেন যে—কোনো সময়ে ফোনে একটা দুর্ঘটনার খবর আসবে। পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, এবং অসুস্থ সে, হাসপাতালে আধমরা হয়ে পড়ে আছে শুনে মা যেন খুব নিশ্চিন্ত ছিল। যা—হোক এখন আর তত ভয় নেই। বাইরে থাকলেই ভয়। কে কখন কোনদিক থেকে আক্রমণ করবে ঠিক কী। এখন তো শোনা যাচ্ছে, দলের ছেলেরাই দলের ছেলেদের খুন করছে। অবিশ্বাস দানা বাঁধলে যা হয়। আর তখনই কিনা সাতসকালে ফোন। মার উদবিগ্ন মুখ দেখে বিনু বলেছিল, যাচ্ছি। এত উতলা হলে চলবে কেন!

বিনু সাহস পাচ্ছিল না ফোনের কাছে যেতে। এটা আজকাল তার নিজেরও হয়েছে। বাবা মারা যাবার পর সেই ছোটভাইদের মানুষ করার ভার নিয়েছিল। সে নিজে আর বেশি পড়াশোনা না করে, সংসারের রোজগার কী করে বাড়বে এবং ভাইয়েরা কী করে মানুষ হবে এই ছিল তার একান্ত দায়িত্ব। আসলে সে ওদের মানুষ করছিল নিজের ছেলের মতো। এদের নিয়েই তার সব কিছু। এদের ছাড়া সে নিজেকে ভাবতে পারে না। এবং কোনো ফোন এলেই কী যেন ভয়াবহ একটা খবর রয়ে গেছে মনে হয় ফোনে।

সে কোনোরকমে ফোন ধরলেই শুনল, সোমা কথা বলছে। সে আর ভয়ের কিছু ভাবছে না। বোধহয় কোনো পিকনিক টিকনিকের খবর দেবে সোমা। ওদের তো কোনো চিন্তাভাবনা নেই তাকে সেটা জানাতে চায়। সে বলল, কিরে কেমন আছিস!

সোমা কেমন কথা বলতে পারছে না। ওর গলা জড়িয়ে আসছে। সে তবু যেন কোনোরকমে বলল, আমার সর্বনাশ হয়েছে! তুই শিগগির চলে আয়।

বিনু বলল, কী বলছিস যা তা।

কী আর বলব, আয়।

কী হয়েছে বলবি তো!

না এলে বলতে পারছি না। তুই আয়। আমি মরে যাব বিনু একা থাকলে আমি মরে যাব।

যাচ্ছি। বিনু বাড়ি ফিরে দরজায় দাঁড়িয়েই বলল, মা সোমা আমাকে ডেকেছে। ফোনে আমাকে যেতে বলেছে। সে সোমার সর্বনাশের কথা বলল না। বলল না এইজন্য যে, বললে, আরও দশটা কথা বলতে হবে। ওর তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। তা ছাড়া যে—কোনো ঘটনাতেই মা এমন করতে থাকেন যে, নিজের হোক পরের হোক, একেবারে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যান। মাকে এ—সময়ে আর দুঃখে ভাসিয়ে কাজ নেই।

মা বলল, কিছু খেয়ে যাবি না? এই সাতসকালে বের হচ্ছিস!

ওখানে খাব। তুমি ভেবো না।

সে যখন চলে যাচ্ছিল, রাস্তায় হনহন করে হাঁটছিল, মা তখন জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, কখন ফিরবি!

হয়ে গেলেই ফিরব।

এখন এমন একটা সময় যে, বের হয়ে গেলে কেউ আর ফিরবে কি না ঠিক থাকে না। কেউ ওকে, সোমা ডাকছে বলে, ডেকে নিয়ে গেল না তো! আজকাল তো এ—ভাবেও অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। বিনু চলে গেল। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে এমন অরাজকতার ভিতর বিনু কেন যে এত সকালে বের হয়ে গেল। জানলায় মার মুখ দেখলে এ—ছাড়া এখন আর কিছু মনে হবে না। সংসারে বিনুই ওদের পারাপারের কড়ি। সে না থাকলে সংসারের কী হতে পারে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

বিনু সোমাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। সব ঠিকঠাক আছে। রসুল গেটে পাহারা দিচ্ছে। সেই মাধবীলতার গুচ্ছ গুচ্ছ নীলাভ পাতাসকল চারপাশে দেয়ালের, সেই মারবেল বিছানো পথ, সেই ইউক্যালিপটাসের গাছ আর সেই কামিনী ফুলের গাছ, শীতের সময়, এবং শীতকালীন রোদে একটা ভারি মনোরম আমেজ আছে। একটা শীতের কাক পর্যন্ত ডাকছে দেয়ালে। দুটো একটা শালিক পাখিও সে দেখতে পেল। কেবল মনে হচ্ছিল, দু’জনের পক্ষে এটা সত্যি খুব বড় বাড়ি। ও—পাশে গ্যারেজ। সে ভেবেছিল, কোনো একটা খুন—টুনের ব্যাপার হবে। কিন্তু এমন নিরিবিলি এতবড় বাড়িটা দেখে, সে বুঝতে পারছে না, কী হয়েছে! সে ভিতরে ঢুকল, রসুল উঠে সেলাম দিল। বিনু ভাবল একবার রসুলকে জিজ্ঞাসা করবে, কিন্তু এ—বাড়ির আভিজাত্যের খবর সে রাখে। ভিতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, ওরা সহজে জানতে পারে না। জানতে পারলেও না—জানার ভান করে থাকে। খুব নিজের লোক না হলে কিছু প্রকাশ করে না। বিনুকে রসুল দুবার কী তিনবার বেশি হলে দেখেছে। সুতরাং রসুলের কাছেও কোনো খবর সে পেতে পারে না। সে প্রায় ছুটে নুড়ি—বিছানো পথের ওপর দিয়ে বের হয়ে গেল এবং কাঠের সিঁড়ি প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেল। কিন্তু লম্বা করিডোরে কেউ নেই। খাঁ খাঁ করছে যেন। সে দেখেছে এখানে এই করিডোরে এলেই কেউ—না—কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ওকে ভিতরে নিয়ে যাবার জন্য। এবং এমন অবস্থায় পড়লে ঘাবড়ে যাবার কথা। সে এখন কী করবে ভেবে পেল না।

আর তখনই দেখল, সোমা শীতের চাদর গায়ে কেমন পীড়িত চোখে মুখে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এতবড় বাড়িতে এভাবে না হাঁটলে বুঝি সৌন্দর্য বাড়ে না। সোমা এই সকালেও সুন্দর করে সেজে বসে আছে, ওর চুলে কোনো অন্যমনস্কতা নেই, পরিপাটি করে চুল বাঁধা। সোমা কী সকালে উঠেই চুল বাঁধতে বসেছিল। সোমা যে গতকাল খুব সুন্দর করে সেজে বসেছিল, মনীষ ফিরলেই অনন্ত জলরাশি আছে পৃথিবীতে, সেই জলরাশিতে অবগাহন কী যে আরামের এবং লম্বা বিছানায়, সাদা চাদরে সোনালি ফুল ফল আঁকা চাদরে কেবল সাঁতার কাটা এবং নরম বিছানার সঙ্গে কেবল মিশে যাওয়ার জন্য এ—মেয়ে যে গতকাল সেজে বসে থেকে সারারাত প্রতীক্ষায় ছিল, মনীষ ঠিক ফিরবে, ফিরছে, অনেক রাতে ওর মনে হল মনীষ ফিরছে না, টেবিলে একটা চিঠি, চিঠিটা আবিষ্কারের পর সে চুপচাপ সারারাত একই জায়গায় বসেছিল। নিথর। টেবিল থেকে এই সকালে মাত্র সে ফোন তুলে এক এক করে সবাইকে ফোন করছে। প্রথমে বিনুর পালা।

বিনুকে দেখে সোমা বলল, আয়।

বিনু পার্লারে ঢুকে গেল সোমার সঙ্গে।

বিনু বলল, কী ব্যাপার বলতো!

বোস।

বিনু বসল। সোমাও ধীরে ধীরে বসল। সোমা বিনুকে অপলক দেখছে। এত বেশি বিনুকে দেখছে, যে বিনুর ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল। যেন এই যে সর্বনাশ ঘটেছে, কী সর্বনাশ সে এখনও জানে না, তবু একটা কিছু যখন ঘটেছে, তার জন্য দায়ী বিনয়, এবং বিনয়ের দিকে এমন একটা চোখেই যেন তাকিয়ে আছে সোমা। কিছু বলছে না।

বিনু বলল, মনীষ কোথায়?

সোমা বলল, বোস বলছি।

সোমা, মনে হয় কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, অথবা কোথা থেকে আরম্ভ করবে বুঝতে পারছে না। সে বলল, আমি কীভাবে আরম্ভ করব ঠিক বুঝতে পারছি না।

বিনু বলল, কী হয়েছে বলবি তো!

সোমা ধীরে ধীরে বলল, মনীষ চলে গেছে।

কোথায়!

জানি না।

কিছু বলে যায়নি!

না।

কবে গেল?

কাল!

কাল কখন!

রাতে। আর ফিরে আসেনি। টেবিলে চিঠি। আমি চলে যাচ্ছি। বলে চিঠিটা বিনুকে পড়তে দিল।

বিনু চিঠিটা পড়ল। বিনু পাজামা পাঞ্জাবি পরেছিল। সে সেই পরে চলে এসেছে। দুদিন পরেছে বলে খুব চাকচিক্য নেই জামাকাপড়ে। তবু বিনুর চোখেমুখে কী যেন আছে, যা দেখলে খুব নিজের মানুষ মনে হয়। সব সহজেই বলা যায়। বিনু পড়ে বলল, খুব ছেলেমানুষ তো!

তুই বল বিনু, এটা ছেলেমানুষী না!

আপাত তাই মনে হচ্ছে। ওকে কী কেউ ভয়—টয় দেখিয়ে ছিল?

সোমা ভাবল বলবে কী বলবে না। কিন্তু একজনকে তো বলতেই হবে। বিনু বাদে তার এ—মুহূর্তে নিজের কে আছে! বিনু অথবা অসিতবাবুর পরামর্শমতো চলা দরকার। পুলিশে খবর দিতে হবে কিনা তাও পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। অসিতবাবু মনীষের বন্ধু। মনীষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কম। মানুষটাকে মনীষ যত জানে, সে ঠিক ততটা জানে না। বরং বিনুকে সোমা অসিতের চেয়ে ভালো জানে। বিনু কখনও অপকার করতে পারে না। তাকেই সব খুলে বলা যেতে পারে।

বিনু বলল, সেই লোকটার খবর পেলি!

সোমার যেন খুব শীত করছে। সে চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল। কিন্তু তাতেও শীত যাচ্ছে না। সে বলল, বিনু আয় আমরা সামনের করিডোর পার হয়ে পুবের ছাদে গিয়ে বসি। সেখানে বোধহয় এতক্ষণে রোদ এসে গেছে।

সোমা এবং বিনু সোমার শোবার ঘর অতিক্রম করে ছাদে চলে এল। এতবড় শোবার ঘর কেউ ব্যবহার করে পৃথিবীতে! এবং এমন সব ছবি, ছবিগুলো সব অদ্ভুত ধরনের, ছবিগুলো সব ন্যুড এবং ছবিগুলো দেখলে মাথায় রক্ত উঠে আসে অথবা এক লহমায় উত্তেজনা। এ—সব ছবি দেখলে তো মানুষের ভেতর এমনিতেই সবসময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার কথা, ওরই তো শরীর কেমন করছে, অথচ সোমা নির্বিকার! যেন ওতে কিছু নেই। ব্যবহারে ব্যবহারে সোমা কিছুটা ভোঁতা হয়ে গিয়ে থাকবে! তা না হলে, সোমা কিছুতেই এ—ভাবে এখানে নিয়ে আসতে পারত না। অথবা মনীষের জন্য মাথা ঠিক নেই। ওর খেয়ালই নেই, এ—ঘরে পৃথিবীর দুজন মানুষ ঢুকতে পারে, মনীষ দত্ত এবং সোমা দত্ত তাদের নাম। আর ঢুকতে পারে মনোরমা।

সোমা বলল, পেলাম না।

বিনু বলল, আসলে তোর মনের ভুল এটা।

এখন আমারও মনে হয়।

তুই কাউকে ও—ভাবে জানিস না।

কিন্তু চোখ দুটো যে বড় চেনা!

তাই হয়। আসলে কী জানিস! বলে বিনু বেতের চেয়ারে বেশ আরামে হেলান দিল। চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিল শরীরে। সামনে একটি টিপয়। সাদা ঝালরে ঢাকা এবং মীনা করা, মনে হয় হাতির দাঁতের কারুকার্য আছে ওতে। সে চায়ে চুমুক দিল।

সোমা চায়ে চুমুক দিল না। হাতে নিয়ে বসে থাকল। আসলে কী জানিস—তারপর বিনু কী বলবে শোনার প্রতীক্ষাতে সে উদগ্রীব। বিনু কিছু না বলা পর্যন্ত সে চা খেতে পারছে না।

বিনু বলল, আসলে কী জানিস, আমরা মনে মনে যা ভাবি তা পাই না।

সোমা বলল, মানে!

মানে এই দ্যাখ না, কত আশা ছিল আমার। পৃথিবী জয় করব আশা ছিল, কিন্তু হল কোথায়! এখনও কিন্তু ভাবি, ঘরে ফিরেই একটা চিঠি পাব। মনে হয় কেউ আমাকে একটা চিঠি দেবে, তা পেয়ে আমি আঁৎকে উঠব, এবং সেখানে আমার রাজ্য জয়ের খবর থাকবে। প্রতিদিন এভাবে কেটে যাচ্ছে, চিঠি আসছে না, তবু রোজ ভাবি চিঠি আজ হোক কাল হোক আসবে।

সোমার এতসব কথা ভালো লাগছিল না। সে সোজা বুঝতে চাইছিল। রহস্যটা কোথায়! কিন্তু বিনু এমনভাবে নিজের কথা বলছে যে, সে যেন তার নিজের কথা শোনাতে এসেছে এখানে। সোমার যে এমন একটা বিপদ তা আমলই দিচ্ছে না। মনীষের এটা ছেলেমানুষী ভাবছে। সেও কথার পিঠে কথায় সায় দিয়ে গেছে, ছেলেমানুষী বলে। কিন্তু পর পর যা ঘটনা একে একে ঘটে গেছে, এবং যেভাবে ওরা ক্রমে অস্থির হয়ে উঠেছিল, তাতে যে—কোনো মানুষের পক্ষে পাগল হয়ে যাওয়া সম্ভব। সে বলল, তোকে সব বলিনি বিনু। শুনলে কিন্তু আর সমাধান খুঁজে পাবি না।

বিনু বলল, সমাধান নেই এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না। বলে কেমন দার্শনিক চোখে তাকিয়ে থাকল বিনু।

সোমা তারপর সব ঘটনা খুলে বলে একে একে প্রশ্ন করে গেল, চিঠিটার ব্যাপারে কী মনে হয়!

বিনু বলল, চিঠির ব্যাপারে তোকে আগেও বলেছি।

সবই এত সরল তুই ভাবিস! এত সহজে সমাধান! সোমা ভাবল, আসলে বিপাকে পড়েছে সোমা, কাজেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। যে—ভাবেই হোক ওকে বোঝানো যত সহজ ভাবছে বিনু, ব্যাপারটা, তত সহজ নয়। সে বলল, জানিস একরাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে!

বিনু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল, কী!

মনে হল, আমার সেই মানুষটি, বড় মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং সোমা সে রসুলকে নিয়ে এক রাতে বের হয়েছিল সে কথাও বলল। তারপর সেই বৃদ্ধ মানুষের খবর, তার আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকা, কেউ তার কাছে আসে, খড়কুটো দিয়ে যায় তাও বলল। সোমা বলল, আমার মনে হয়েছিল, সেই লোকটাই অঞ্জন।

বিনু খুব অনায়াসে বলে ফেলল, তা হতে পারে।

কিন্তু তারপরের ব্যাপারটা কী হবে!

সেটা আবার কী?

এসে দেখলাম গাড়ি বারান্দার ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

তা থাকতে পারে!

কী করে!

অন্য কেউ কি গাড়ি বারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না?

ভোর রাতে কে আসবে।

তোমার বাড়িতে মানুষের তো অভাব নেই।

কেউ তো স্বীকার করল না।

স্বীকার না করলেই দাঁড়াবে না সে কথা কে বলল!

এমন সহজ কথা স্বীকার করতে ক্ষতি কী!

সোমা ভাবল কত অনায়াসে সমাধান বিনুর। আসলে বিনু মানুষটাই এ—স্বভাবের। সহজে সবকিছু ভেবে নেওয়ার স্বভাব। সে বলল, বাড়িতে এতসব ঘটনা একের পর এক ঘটছে, আর কেউ আর একটা নতুন ঘটনা ঘটিয়ে ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুলবে আমার বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস সহজে কিছু হয় না। তোমার বাড়িতে মনোরমা আছে, রসুল আছে, রামঅবতার না কে আছে, মালিরা আছে। মনোরমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক যে তোমাদের অগোচরে কেউ ঘটায়নি সে কে বলবে।

বুঝতে পারছি না। বলে সোমা তার চাদর দিয়ে শরীর যেন আরও ঢেকে দিল। পুবের বারান্দার মতো ছাদের এ অংশটা। বেশ শীতের রোদে ওরা দুজনই বেশ উষ্ণতা ভোগ করছে। কারও এখন বিশেষ শীত করছে না। সোমা বলল, অবাক!

অবাক হবার কিছু নেই। তুমি বাড়ি নেই, মনীষ ভয়ে কাতর, রামঅবতার অথবা তোমাদের মালিদের কেউ সে—সময় মনোরমার ঘরে যায়নি এবং তোমার ফিরে আসার খবর পেয়ে বের হয়ে আসেনি, গাড়ি বারান্দায় একপাশে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে নিজেকে গোপন করেনি কে বলবে।

সোমা কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারেনি। হতে পারে। এমন একটা ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ স্বীকার করবে না বুঝতে পারে। সে বলল, তবে সেই বাথরুমে….।

বাথরুমে মানে!

বাথরুমের আয়নায় দেখলাম, ঠিক সেই চোখ দুটো, আমি যেমন যেমন ভাবে অঞ্জনকে ভেবেছি, ঠিক হুবহু সেই মানুষটা আয়নায় দাঁড়িয়েছিল।

তা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বইকি!

এবারে সোমা ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। সে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ ঝুঁকে বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে পারে মানে! কী বলছিস সব!

তুই ভীষণ উত্তেজিত সোমা। তোর মাথায় সবসময় সেই চোখদুটো, সেই মানুষের হুবহু ছবি চলাফেরা করছে। তোর একটা ইলিউসান দেখা অস্বাভাবিক না।

সোমা বলল, তুমি কি আমাকে গ্রাম্য বালিকা ভেবেছ বিনু! তুমি কী বলতে চাও বুঝি না। ওরা এখন তুমি তুমি করে কথা বলছে। গুরুত্বপূর্ণ কথার সময় এটা বোধহয় হয়।

আসলে সোমা, এবার বিনুও উঠে দাঁড়াল, আমরা সবাই শৈশবে নানাভাবে স্বপ্ন দেখে থাকি। তোমার শৈশবেও স্বপ্ন ছিল। সব মানুষের স্বপ্ন এক রকমের থাকে না। তোমার শৈশবে কী স্বপ্ন ছিল বললে, ব্যাপারটা আরও সহজ করে বোঝানো যেতে পারে।

শৈশবে আমি একটা প্রতিশোধের কথা ভাবতাম কেবল। বাবার আত্মহত্যার কথা মনে হলেই এটা মনে আসত।

বিনু বলল, তোমার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন!

সোমা এমন গোপন পারিবারিক কথা এত অনায়াসে বলে ফেলে অবাক। কেউ জানে না, কেবল শৈশবে সেই দুঃখের দিনে যারা তার চারপাশে ছিল ওরা জানত। সে যে বিনুকে কোনোদিন কথাটা বলেনি, কেবল বিনু কেন, মনীষও জানে না, সেই আত্মহত্যারখবর, তার মা একজন ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা, এ—সব খবর সে কাউকে বলেনি, বলেছে বলে অন্তত এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না, সে বলল, বিনু তুমি যখন সব জেনেছ এটা না জানলে বাকিটুকু বুঝতে পারবে না। আসলে বাবা আমার খুব দুঃখী লোক ছিল। মা ছিলেন ভীষণ সুন্দরী এবং বাবার আত্মহত্যার মূল কারণ ছিল সেই ধনী ব্যক্তির লোভ এবং মার নিদারুণ অসহায় মনোভাব। তুমি জানো না হয়তো আমার মাকে পাবার জন্য নানাভাবে একটা সামাজিক চাপ ছিল বাবার প্রতি। সেই অসাম্য চাপের বিরুদ্ধে আমার ভীষণ বিদ্রোহ ছিল। আমি চাইছিলাম কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে, সে আমার সঙ্গে একটা জয়েন্ট কমান্ডো তৈরি করবে। একজন সৎ মানুষের কথা সবসময়ই ভাবতাম। এবং মনে হত, সেই মানুষ আমাকে বারবার বলেছে, তুমি সোমা কাজল পর না। আমি এতদিনে মনে করতে পারছি কে আমার মনের মানুষ। কাজল পরলে সঠিকভাবে পৃথিবীকে চেনা যায় না। বলতে বলতে সোমা কেমন হাঁপিয়ে উঠল। সে আর বোধহয় দাঁড়াতে পারছিল না। সে সোফাতে নিদারুণ দুঃখী যুবতীর মতো বসে থাকল। মাথার ওপর এতবড় আকাশ রয়েছে, শীতের সময় বলে বাগানে কত রক্ত—গোলাপ, আর চারপাশে নিরিবিলি সব গাছপালার ভিতর এক আশ্চর্য মহিমা আছে সে বুঝতে পারছে না।

বিনু বলল, তাহলে তোমার নিজের কথাতেই আসা যাক। তুমি এ—ভাবে একজন মনের মানুষ চেয়েছিলে পাওনি। বরং উলটো এমন একজন তোমার কাছে হাজির যাকে তুমি চাওনি। বলে একটু থামল। কী ভাবল।—আচ্ছা সেদিন যাকে বাথরুমে দেখেছিলে সে দেখতে কেমন।

ভারি সুন্দর।

তুমি সোমা এমন একজন মানুষকেই চেয়েছিলে সঙ্গে। কিন্তু মানুষের দোষ কতভাবে যে থাকে। তাকে তুমি পাওনি, না পেয়ে ভালোই হয়েছে। পেলে তার দাম থাকত না। সারাদিন তুমি তবে আরও একাকী থাকতে। সে একাকিত্ব আরও মারাত্মক।

সোমা কিছুক্ষণ কথা না বলে একটু নিজের ভিতর ফিরে আসতে পেরে বলল, তবে চিঠিটা!

চিঠিটার কথা তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি ভয় পাইয়ে দেওয়া।

তবে তুমি বলছ, এই যে হত্যাকাণ্ড সব ঘটছে এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

আমার মনে হচ্ছে, না।

আর ঠিক সে—সময়ই ফোনে কে যেন সোমাকে চাইছে।

সোমা উঠে গিয়ে ফোনে কী শুনতে শুনতে টেবিলে মূর্ছা গেল। বিনু ছুটে গেল টেবিলের কাছে। সে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, কে? সোমা টেবিলের ওপরই পড়ে আছে। সে ফের বলল, হ্যালো, কে বলছেন! এবং সে বুঝতে পারল পুলিশ অফিস থেকে ফোন। কেউ যেন বলছে, মনীশ দত্তের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, আপনি কে!

সে বলল, মনীশ দত্তের স্ত্রী মূর্ছা গেছে।

তবে শুনুন। একটা লাশ পাওয়া গেছে। ব্যান্ডেলের কাছে রেললাইনের ধারে পাওয়া গেছে। ওর ডায়রি থেকে সব খবর জেনে ফোন করছি।

বিনুর হাত কাঁপছিল। সেও বোধহয় মূর্ছা যেত। সে বলল, আপনাদের ঠিকানা!

লালবাজার, স্পেশাল স্কোয়াডে খবর নেবেন।

বিনু এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। সে প্রথমে সোমাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, রসুল! মনোরমা!

পনেরো

বিনু প্রথমে অশোককে ফোন করে বলল, সুধীরকে নিয়ে শিগগির চলে আয়। সোমাদের বাড়িতে চলে আয়। মনীষ খুন হয়েছে।

ও—পাশ থেকে কথা বলার আগ্রহ ছিল, কিন্তু বিনুর এক ধমক। —যা বলছি কর। এসে সব শুনতে পাবি।

অশোক বের হয়ে সুধীরের খোঁজে গেল। সুধীর সকালে বাড়ি থাকে না। রোববার, বাড়ি না থাকারই কথা। সকালের দিকে ক্লাবে আড্ডা দেবার স্বভাব। ক্লাবে গিয়ে দেখল সেখানেও নেই। ক্লাবের একটা ছেলে বলল, বীরেনবাবুদের বাড়িতে গেছে। ও—পাশের গলিতে ঢুকে একটা নীল রঙের সাইনবোর্ড দেখবেন, তার পাশের বাড়িটা বীরেনবাবুদের। এবং এ—ভাবে, অশোক ঠিকঠাক পেয়ে গেল সুধীরকে। সুধীরকে সে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে পড়ল। কিছু বলছে না, সুধীর সব শুনলে নাও যেতে পারে। ও যা স্বভাবের মানুষ! কিন্তু সোমার এমন বিপদে সে স্থির থাকতে পারছে না। সোমার বিয়ের পর মনে মনে সে সোমা অসুখী হোক চাইছিল, মনীষের কিছু একটা হয়ে যাক, কিছু একটা হয়ে গেলে, সোমা ওর কাছে আবার ঘুর ঘুর করতে পারে অথবা অসম্মান করে সোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে, কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর সে নিজেই ভারি দুঃখী লোক হয়ে গেছে! আসলে বিপদটা তার নিজের যেন। সে ট্যাক্সিতে উঠে বলল, মনীষ খুন হয়েছে!

সুধীর বলল, কী বলছিস যা তা!

সত্যি বলছি।

কোথায় খুন হয়েছে!

জানি না।

কখন খুন হয়েছে!

জানি না। বিনু সোমাদের বাড়িতে। সে তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।

সুধীর বলল, আমি এ—সব খুন—টুনের সঙ্গে জড়াতে চাই না। আমাকে নামিয়ে দে। ও—সব আমার সহ্য হয় না। সহসা খুন—টুন ভালো ব্যাপার নয় এমন বুঝে বলে ফেলল।

অশোক বলল, তুই কী বলছিস!

সুধীর বলল, আগে বলবি তো। দিনকাল যা যাচ্ছে, এখন এ—সবে কেউ মাথা গলায়!

সোমার কথা ভাব!

ধুস সোমা। বড়লোক খুন—টুন হবে বেশি কী! সোমা আবার একটা বিয়ে করে নেবে। আমাকে ছাড়, আমি যাব না।

অশোক বলল ঠিক আছে। তুই নেমে যা। আমাকে যেতেই হবে।

এবং ট্যাক্সি কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে থামলে অশোক বলল, বিনু একা সব দিক সামলাতে পারবে না, বোধহয় এ—জন্য তোকে নিয়ে যেতে বলেছিল।

সুধীর কী ভাবল। এ—ভাবে নেমে যাওয়াও যেন ঠিক হচ্ছে না। অশোকের ওপর রাগ হচ্ছিল খুব। খুন—টুনের ব্যাপারে জড়ালে শেষ পর্যন্ত কী হয় তার জানা আছে। কার দায় কোথায় গড়ায় কে জানে। ওর এ—ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞতা হয়েছে। রাস্তায় কে মেরে গেল, আর কেউ রাস্তা ধরে চলে গেল, পুলিশ তাকেই তুলে নিল, সে একবার এ—ভাবে থানায় চলে গিয়েছিল। তার মা বাবা থেকে চোদ্দ গুষ্টির কথা জেনে ছেড়েছিল। মারধোর করেনি এই যা রক্ষে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে ভেবে ফেলে, অশোক এবং বিনু যাচ্ছে, অশোক ঠিক বিনুকে বলবে, বিনু ভাববে, সুধীর কাপুরুষ, সোমা হয়তো কোনোদিন তার কথা আর ভাববে না। সোমার কথা ভেবে বলল, চল।

অশোক বলল, অসুবিধা হলে থাক।

সুধীর বলল, বুঝিস না কেন? আমরা ছা—পোষা লোক। কোর্ট—কাছারি করতে পারি না।

এখানে কোর্ট—কাছারির কী হল!

ট্যাক্সি যাচ্ছে। একটু জোরে চালাতে বলেছে অশোক। এবং সুধীর শেষ পর্যন্ত কিন্তু বরং অশোকের চেয়ে বেশি করিতকর্মা মানুষ হিসেবে প্রায় সোমাদের বিশাল বাড়ির সদর দরজায় নেমে একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুকে গেল। কোর্ট—কাছারি কথাটা তার মনে থাকল না। এবং নিঝুম এই বাড়িতে পুলিশের এক গাড়ি। কালো রঙের পুলিশের গাড়ি। মৃতদেহ শনাক্ত করার কথা। মনীষের ব্যবহারিক সব, এই যেমন সুটকেস, মানি ব্যাগ ডাইরি সব দেখানো হচ্ছে। সোমা সকাল বেলাটায় বোধহয় সংজ্ঞা হারানো অবস্থায় কাটিয়েছে। এখনও ঠিক হুঁশ নেই তার। তবু দেখে দেখে বুঝে নিচ্ছে সবই মনীষের, তারপর ওদের যেতে হবে গাড়িতে। দুটো গাড়ি বিনু ঠিকঠাক করতে বলেছে। একটা গাড়িতে অশোক, সুধীর এবং অসিতবাবু। একটা গাড়িতে মনোরমা, রসুল, বিনু, সোমা। সামনে পুলিশের গাড়ি। এবং শীতের সকালে রোদ বেশ, ছুটির দিন বলে চৌরঙ্গি পাড়ায় ভিড় নেই। সকালে সব ছেলেমেয়েরা নিত্যদিনের মতো খেলা করছে। এবং গাছে গাছে তেমনি বাতাস, আর সেই বুড়ো লোকটা আগুন জ্বেলে ঠিক বসে রয়েছে। পুলিশের রিপোর্টে তার সব বর্ণনা থাকবে। সোমাকে সবই খুলে বলতে হবে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।

কখনও মনে হয় ওরা মিছিল করে যাচ্ছে। আগে পুলিশের গাড়ি, পরে সোমাদের গাড়ি, পেছনে অশোকদের গাড়ি। ওদের দুটো গাড়িই দামি। বড়লোক খুন—টুন হলে এমনি হয়ে থাকে। অবশ্য পুলিশ থেকে এটা খুনের ঘটনা বলতে পারছে না। আবার আত্মহত্যার ঘটনাও বলতে পারছে না। ট্রেনে কাটাও বলতে পারছে না। ট্রেনে কাটা পড়েছে। প্রথম শ্রেণীর রিজারভেশান দূরপাল্লার গাড়ি। এবং ব্যান্ডেল ছাড়তে না ছাড়তেই ঠিক মগরার গুমটি ঘরের কাছে লাশ পাওয়া গেছে। তার যেহেতু পকেটে ছোট্ট ডাইরি ছিল, খোঁজখবর নিতে সময় লাগেনি। মনীষ দত্ত যে মর্গে চালান যাবে এবং লাশের পাশে ডোম হোমরাজ সাহনি দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশের গাড়িতে কাক, এ—সব বিনু সোমার মুখ দেখতে দেখতে মনে করতে পারল। সোমাকে সে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে।

ওরা বেশ বড় বাড়িটার সদর গেটে ঢুকে গেল। তারপর আরও ভিতরে। একদল পুলিশ দূরের মাঠে প্যারেড করছে, ঠিক প্যারেড না করলেও প্যারেডের মতো মনে হয়, কারণ ওরা প্যারেড করে বের হয়ে গেছে। এবং গাড়িতে একদল সাদা ইউনিফর্ম পরা পুলিশ বের হয়ে গেল, আর মোটর বাইকের শব্দ, সার্জেন্ট, সাব—ইন্সপেক্টর এবং আরও বড় অফিসারদের ওরা দেখতে পেল করিডোর দিয়ে যাচ্ছে! ওদের গাড়ি এবং সোমাকে দেখেই পুলিশের চোখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ওরা বুঝতে পারছে একজন বড়লোকের বউ এসেছে স্বামীকে শনাক্ত করতে। ওরা যে যার সিটে অথবা গাড়িতে বসে থাকতে পারছিল না। খুন—টুন হওয়া মানুষের বউ এত লম্বা এবং চাকচিক্যময় অথবা সুন্দরী হতে নেই।

এবং এ—সময়ে বিনু দেখল, দুজন অফিসার, সে একজনকে চেনে মনে হল। কিন্তু এইসব পোশাকে সঠিক বোঝা যায় না। সে সাহস পেল না কিছু বলতে। অফিসারটিই বলল, তুই বিনয় না। আমাদের ক্লাসের বিনু। আমি তোদের সবাইকে চিনি।

বিনু বলল, আমিও চিনি। লাশটা তোর….

অজিতেশ বলল, তোরা কার লাশ দেখতে এসেছিস! সে খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

মনীষের।

মানে মনীষ দত্ত।

মনীষ দত্ত মানে সোমা গাঙ্গুলীর স্বামী।

হ্যাঁ।

লাশ মনীষ দত্তের! দেখতে হয়! আমি তো আর দশটা লাশের মতোই চটের থলে দিয়ে বেঁধে রাখতে বলেছি। খুব আগলি সিন হবে। সোমা কী সহ্য করতে পারবে!

তুই দেখিসনি!

ভোর রাতে এসেছে। এখনও যাইনি। দেখে লাভ নেই! মরা মানুষ দেখতে ভালো লাগে না। তবু দেখতে হয়। কাজকর্ম চালাতে হলে কাজ করতেই হয়। সোমা কোথায়।

পাশের ঘরে আছে।

অজিতেশ ওর জুনিয়র অফিসারকে ডেকে বলল, হোমরাজকে ডেকে পাঠান।

হোমরাজ এলে বলল, রঘুবাবুকে বল একটা সাদা চাদর দিতে। আর তুই দেখবি, লাশের মুখটা শুধু যেন বের করা থাকে। যেন শুয়ে আছে মতো। চাদরটা ভালোভাবে গুঁজে রাখবি। বাতাসে উড়ে—টুড়ে গেলে নাড়ি—ভুঁড়ি দেখে ফেললে আর একটা দুর্ঘটনা হতে পারে। বুঝলি, অজিতেশ বিনুর দিকে তাকিয়ে বলল, পেটের ভিতর যে এতসব নিয়ে আমরা ঘোরাফেরা করি বুঝতে পারি না। ট্রেনে কাটা লাশ—টাস দেখলে এটা হয়। নিয়ম একেবারে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া। অথবা মর্গে। তবে বড়লোকের ব্যাপার তো। সোজা এখানেই।

অশোক দেখল, দূরে করিডোরে বিনু কার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওরা এলে বিনু ওদের পরিচয় করিয়ে দিল। চিনতে পারছিস তো!

খুব। অশোক বলল।

সুধীর বলল, তুই যে আমাদের মনে রেখেছিস!

আরে যা! আয় চা খাবি।

বিনু বলল, সোমার সঙ্গে পরিচয় করবি না?

অজিতেশ বলল, না। সোমা এখন নিজের ভেতর নেই। খুব খারাপ লাগছে সোমার জন্য। বলেই অজিতেশ তিনজনের দিকেই তাকাল, তোদের কী মনে হয়?

বিনু বুঝতে না পেরে বলল, কী ব্যাপারে!

এই যে মনীষ ট্রেনে কাটা পড়ল, আসলে এটা আত্মহত্যা না খুন না অন্য কিছু!

সে তো তোরা বলতে পারবি।

অজিতেশ হাসতে হাসতে বলল, অনেক সময় পুলিশের চেয়ে যারা চারপাশে থাকে তারা ভালো জানে। তারা ভালো বলতে পারে।

সুধীর মনে মনে গজগজ করতে থাকল। এবারে ঠ্যালা সামলাও।

অজিতেশ বলল, আয়। আমার এটা ঘর। এখানে বসি, কোনো অসুবিধা হলে বলবি। একটু চা খা। ওদিকে ঠিকঠাক করুক; তারপর আমরা একসঙ্গে যাব।

ওরা তারপর একসঙ্গে বের হল। সোমাকে নিয়ে যাওয়া হল। সরু মতো গলি। দুদিকে উঁচু বাড়ি, এবং অন্ধকার মতো জায়গায় শ্যাওলা ধরা মতো ঘরের তালা খুলে ফেলা হল। অন্ধকার ঘর। দিনের বেলাতেও আলো আসে না। একটা আলো জ্বেলে দেওয়া হল। হোমরাজ কোর্তা পরে আছে। ছেঁড়া পেন্টালুন। কালো লম্বা দস্যুর মতো মানুষ। ছেঁড়া চটি এবং চুল রুক্ষ, কোঁকড়ানো, মাথাটা ফেট্টি বাঁধা। লম্বা গোঁফ দু গালে ঝুলে পড়েছে। দেখলেই মনে হবে জ্যান্ত যম, যমের মতো পাহারাদার লাশকাটা ঘরে। সে বলল, এই যে বাবু। ওই যে মেমসাব। স্যার দেখুন কী চোখ মুখ। গোটা শরীর চাদরে ঢাকা চটে বাঁধা এখন নেই। খোলামেলা। কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। মনোরমা ধরে রেখেছে সোমাকে। সোমা উপুড় হয়ে পড়ে যেতে পারে। চারপাশে ওরা পাহারাদারের মতো। যেন সোমা উপুড় হয়ে পড়লেই কে পড়তে দিচ্ছে। সোমা দেখে হাহাকার করে উঠল।

ব্যাস হয়ে গেছে। এই তবে মনীষ দত্ত। এখন আর কিছু করণীয় নেই। পুলিশের করণীয় কাজ আছে তারপরও। তারপর মর্গে। মর্গ থেকে খালাস পেতে আরও সময়। ওরা এখন ফিরে যাবে।

বিনু বলল, পুলিশ কিনারা করতে পারবে কিছু।

অজিতেশ বলল, পুলিশের পক্ষে আমারই তদন্ত করার ভার। তবে পুলিশ কিছু করতে পারবে না। এখন তো হামেশা এ—সব হচ্ছে।

তার মানে! আমাদের বন্ধু। তুই ওকে চিনতিস। তুই একটা এর কিনারা করতে পারবি না।

হয় না। কিনারা হয় না। তবে চেষ্টা করা হবে।

বিনু, সোমাকে নিয়ে চলে যেতে বলল অশোককে। সুধীর বিনুর সঙ্গে থাকবে। অজিতেশের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে যেতে হবে।

এবং কথাবার্তা হওয়ার পর অজিতেশ বলল, আমাদের একদিন বসতে হবে। তুই যা যা বললি শুনলাম। দুটো চোখ সোমাকে বিভ্রান্ত করছে। দু—একদিন না গেলে সোমাকে কিছু বলা যাবে না। এখন সোমা ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারবে না। সময় দিতে হবে। এমনকী একটা রহস্য আছে বুঝতে পারিনি। আচ্ছা চিঠিটা পাওয়া যাবে তো।

কোন চিঠিটা?

ঐ যে মনীষকে ভয় দেখিয়ে একটা লাল কালিতে চিঠি দিয়েছিল।

অঃ। কিন্তু ওটা তো সাদা চোখেই বোঝা যায় ছেলেছোকরাদের কাজ। দেশ উদ্ধার করবে বলে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের কাজ।

অজিতেশ ওর চেয়ারে বসে একটা চুরুট টানছিল। ওর টেবিলটা ভীষণ বড়। এ—পাশে শুধু বিনু আর সুধীর বসে রয়েছে। করিডোরে পুলিশের বুটের শব্দ। মাঝে মাঝে সৈন্য—সামন্ত নিয়ে ফিরে আসার মতো পুলিশের গাড়ি ফিরে আসছে। অজিতেশ কাগজে কী সব লিখে দিচ্ছে, আর আবার গাড়ি উধাও হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একজন ছোটোখাটো অফিসার ঢুকে নির্দেশ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা চালাচ্ছে ওরা। মনীষের মৃতদেহ এখন চটের ভিতর পুরে হোমরাজ একটা ভাঙা হাতল গাড়িতে ঠেলেঠুলে তুলে দিচ্ছে। এর পাকস্থলী বের হয়ে পড়েছে। সেটা ঠেলেঠুলে একপাশে রেখে দিচ্ছে আর তখন সোমা যাচ্ছে গাড়িতে। ওর মুখে রক্তশূন্যতা, বিবর্ণ, চুলে আর বাহার নেই। একদিনেই তাকে অনেক বয়স্ক করে দিয়েছে।

অজিতেশ বলল, সেদিন কফি—হাউসেই প্রথম লোকটাকে দেখে?

সোমা তো তাই বলছে।

আগে কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না!

না। অনেক চেষ্টা করেও পারেনি।

ভারি ইন্টারেস্টিং! সে ফাঁকে ফাঁকে কিছু নোট নিচ্ছিল। সুধীরের ভালো লাগছিল না। যা হবার হয়ে গেছে। এ—সব কেসের কিনারা হয় না। অনর্থক এ—ভাবে বিনু নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।

অজিতেশ বলল, আমার চিঠিটা দরকার।

দেব। বিনু বলল, সোমা নিশ্চয় ওটা তোকে দেবে।

যদি থাকে। সুধীর কথাটা যোগ করল।

থাকবে না কেন?

মনীষ কোথায় রেখেছে, যদি রাখে, যদি সোমাকে না বলে কোথাও রেখে দেয়, অথবা রাগে ছিঁড়ে ফেলতে পারে…এসব হলে সোমা চিঠি দেবে কী করে!

তা ঠিক। অজিতেশ কিছুক্ষণ কী ভাবল।

সুধীর ভাবল, আহাম্মুকি। সে নিজেও জড়িয়ে যাচ্ছে। এ—সব ব্যাপারে যত চুপচাপ থাকা যায় তত মঙ্গল।

অজিতেশ বলল, সোমা সেদিন কী বই দেখেছিল?

বিনু বলল, বোধহয় এ—সময়ের যুব বিদ্রোহের ওপর কোনো বই। বড় পরিচালকের নাম বলে সে বলল, এমনই যেন বলেছিল।

চিঠিটা সম্পর্কে যাতে কোনো ভয় না থাকে সেজন্য বিনু সোমাকে অন্য কথা বলেছে। প্রেমটেমের ব্যাপার অথবা ফাজিল ছোকরার কাজ এমন বলেছে। এখন সে খুব জোর দিয়ে সহজ মনে যা ভেবেছিল তাই বলল। চিঠিটা যে—ভাবেই হোক দিতে হবে অজিতেশের কাছে।

অজিতেশ বলল, দশ তারিখের সকালে তুই ফ্রি আছিস!

সকাল কটায়?

এই নটা নাগাদ।

ফ্রি।

আমার এখানে চলে আয়। এখানে চা খাবি। তারপর তুই আমি সোমার বাড়িতে যাব। আগে থেকে সোমাকে কিছু বলতে হবে না।

দশ তারিখের সকালে বিনু এবং অজিতেশ একটা ট্যাক্সিতে সোমার বাড়িতে হাজির। তখন দশটা বেজে গেছে। সোমা সারা সকাল শুয়ে আছে। বিছানা থেকে উঠছে না। আচমকা বিনু এবং অজিতেশ আসায় সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। সে হেঁটে যাচ্ছে পার্লারের দিকে। রাতে একা ভয়ে ঘুমোতে পারে না অথবা খুব কেঁদেছে, চোখের নিচটা ফুলে গেছে সেজন্য। সে একটা সুন্দর জ্যাকেট গায়ে দিয়েছিল, ওর আসার ভিতরই এমন একটা তন্ময়তা আছে যে অজিতেশ অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকে দেখল। তারপর কেমন সহসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সোমা, তোমাদের শোবার ঘরটা একবার আমার দেখা দরকার।

সোমা বলল, একটু দেরি কর। সে বেল টিপল।

অজিতেশ বলল, এখুনি দেখা দরকার।

সোমা বলল, আমার শোবার ঘরে কিছু বাজে ছবি আছে, ওগুলো মনীষ এনে রেখেছিল, ওগুলো তোমার দেখা ঠিক না।

ওসব অনেক দেখেছি, সয়ে গেছে। ওজন্য ঘাবড়াবার কিছু নেই।

তবু কেমন বে—আব্রু ব্যাপার, এটা বাইরের লোক কেউ দেখুক সে চায় না। শোবার ঘরে এসব ছবি না হলে মনীষের লীলা খেলা জমত না। অজিতেশ ওসব দেখলে টের পাবে মনীষ দত্ত সোমা দত্তকে খুব নিত। সে এটা চায় না বলেই নিজের বোকামির জন্য ভিতরে ভিতরে রেগে যাচ্ছে। এমন একটা শোকের সময় মাথা ঠিক রাখা দায়। মনোরমার উচিত ছিল ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া। পুলিশ যে—কোনো সময় যা কিছু দেখে যেতে পারে। এবং যখন অজিতেশ দেখতে চাইছে, অজিতেশকে খুব ভালো লোক মনে হল না। চালাক ধূর্ত। পুলিশে কাজ করলেই এটা হয়! সে বলল, চল। সে বুঝতে পারল, পৃথিবীতে সে আর কিছু আজ থেকে গোপন রাখতে পারবে না।

শোবার ঘরটা খুবই বড়। বড় হলঘরের মতো ব্যাপার। দুটো বড় খাট। দুটো ছোট মেহগনি কাঠের পুরোনো টেবিল। কাচের বাতিদান। ছাদে ঝুলছে কাচের ঝালর। রকমারি কাঠের কাজ দেয়ালে। এবং মীনা করা দেয়ালের বর্ডার। নীল হলুদ রঙের মেঝে। মনে হয় দামি পাথর বসানো, এবং খুব সন্তর্পণে হাঁটতে হয়। এত মসৃণ মেঝে যে পা সহজেই পিছলে যাবার কথা থাকে। ওরা সন্তর্পণে হাঁটছিল। অজিতেশ নানা কারণে বহু বড়লোকের শোবার ঘর দেখেছে। এতবড় আয়না, মাথা সমান জাপানি ঝালরে ঢাকা আয়না। দুদিকে এমনভাবে স্ক্রীনের মতো বাঁধা যে দড়ি ধরে টান দিলে থিয়েটারের স্ক্রিন উঠে যাবার মতো উঠে যায়। অজিতেশ সেই সিল্কের দড়ি ধরে টান দিল। না এটা স্ক্রিনই। তারপর সে মুখ উঁচু করে দেখল। টেবিলের চকচকে কাঠের উপরে যে সিল্কের ঢাকনা সবই এত দামি যে সে আর দেয়াল দেখার অবকাশ পাচ্ছে না। এবং তারপরই সব ছবি, দেয়ালে অজস্র ছবি। রঙবেরঙের, পৃথিবীর যাবতীয় পুরুষ রমণীর সহবাসের ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি। ছবিগুলো খুব বড় শিল্পীর আঁকা। ন্যুড অথচ কোথায় যে এইসব ছবিতে একটা বিরাট মহত্ত্ব রয়ে গেছে, যার জন্য একসময় অজিতেশ না ভেবে পারল না, মনীষ দত্তের রুচি ছিল।

সে বলল, সোমা তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

সোমা পাশে পাশে হাঁটতে পারছে না, সে ঠিক ঘরের মাঝখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়েছিল। ওর আস্তে কথা অজিতেশ শুনতে পায়নি। কাছে এসে বলল, তোমাকে চিঠিটা দিতে হবে।

কীসের চিঠি?

মনীষকে যে চিঠিতে থ্রেটনিঙ করেছিল।

সোমা বলল, দিচ্ছি।

অজিতেশ বলল, আর একটা কাজ করতে হবে!

কী কাজ!

কাল আমরা সবাই আসব।

বিনু বলল, সবাই বলতে কী বোঝাতে চাইছিস!

সোমার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা সবাই। কিছু হিল্লে করা যায় কিনা। জটিল ব্যাপার। মনীষ ভয় পেয়ে পাগল হয়ে যেত। পাগল যে হয়ে যায়নি তাই বা কে বলবে! সেজন্য ওর আত্মহত্যা করা স্বাভাবিক। যাই হোক। আমরা সবাই। আমি, বিনু, সুধীর, অশোক, অসিতবাবু এবং তুমি। বড় টেবিলটা থেকে আয়না খুলে নেবে। সাতটা চেয়ার। ঘরে আর কিছু থাকবে না।

ষোলো

সোমা পরদিন ফোন করে বলল, অজিতেশ আছে।

ধরুন দিচ্ছি।

অজিতেশ বলল, হ্যাঁ, আমি অজিতেশ বলছি।

শোন, আমি সোমা।

বুঝতে পারছি।

আমার ঘর ঠিক। কখন আসছ?

রাতে।

রাত কটায়?

এই ধর আটটায়।

সবাইকে তো জানিয়ে দিতে হবে।

তোমায় ব্যস্ত হতে হবে না। বিনু সব করছে।

বিনু না থাকলে কী যে হত!

কেউ কেউ এ—ভাবে থেকে যায়। মানুষ কখনও একেবারে নির্বান্ধব হয় না।

সোমা উত্তরে কিছু বলতে পারল না। কেবল অজিতেশ বলল, সোমা, তোমরা সামান্য স্ফুলিঙ্গ দেখেই ভয় পেয়ে গেলে!

সোমা হঠাৎ অজিতেশ এমন কথা বলছে কেন বুঝতে পারছে না।

সে বলল, স্ফুলিঙ্গ মানে!

আরে এই যে ছেলে—ছোকরারা বিপ্লব করছে না!

তা করছে।

যাক শোনো, আটটা।

আচ্ছা, ফোন ছেড়ে দিল সোমা।

বিকেলে ফোন করল ফের অজিতেশ। আচ্ছা তোমার আত্মীয়স্বজন কে কে তোমাদের বাড়িতে রেগুলার আসত।

রেগুলার কেউ আসে না। আসলে মনীষ এত বেশি ব্যস্ত ছিল নিজেকে নিয়ে, আমি কলেজ নিয়ে, এবং সন্ধ্যায় মনীষ বাড়িতে থাকতেই ভালোবাসত।

তবু কে কে আসত জানতে পারলে ভালো হয়।

সোমা বলল, যে গেছে তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আমার ইচ্ছে নয় এজন্য অন্য কেউ হ্যারাস হোক।

হ্যারাস হবে কিনা জানি না, তবে এটা আমি যা ভেবেছি, এক আজগুবি ঘটনা। এমন হয়, সুতরাং এমন যখন হয়, তখন ভীষণ হাসি পায়।

সোমা আর কিছু বলল না। ফোন রেখে দেবে ভাবল। তখনই অজিতেশ বলল, আমাদের সিটিং অনিবার্য কারণে আজ বন্ধ। সিটিং হচ্ছে চারদিন পর। বিনুকে ফোন করে দিচ্ছি। সেই খবর দিয়ে দেবে।

সোমা কী বলবে ভেবে পেল না। সে শুধু বলল, আচ্ছা।

এবং রাতে সোমা আর মনোরমা একঘরে। সারারাত সোমার কেমন ভয় ভয় করতে থাকল ফের। সারারাত মনীষের সেই মরা মুখ কেমন বাতাসে ভেসে ভেসে কাছে চলে আসছিল। আর সোমা ঢেউ দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল। সোমা ভয়ে ঘামছিল। শীতেও সে ঘামছিল। সে একবার ডাকল, মনোরমা। মনোরমা উঠলে বলল, জল। তারপর বলল, তুই কিছু দেখতে পাচ্ছিস।

মনোরমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, না তো!

কোনো শব্দ?

সে বলল, না তো!

আমার কেবল কী যে মনে হয়!

মনোরমা বলল, ও কিছু না! মনের ভুল!

এ—ভাবে রাত কেটে যেত, সোমা রাতে ঘুমোতে পারত না। একটা কী যে রহস্য থেকে গেল। এখন আর কিছু মনে হয় না। এখন এ—বাড়িতে কেউ এসে মনীষকে খুন করতে পারে মনে হয় না। সব কেমন মনীষের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল। এখন বদলে মনীষ বাতাসে ভেসে ভেসে চলে আসে। এবং একটা মমির মতো ঠিক ওর সামনে নাকের ডগায় ভেসে থাকে। সে ছুঁয়ে দিতে পারে না, ছুঁয়ে দিলেই যেন সোমাও মমি হয়ে যাবে। সোমা কিছুতেই মমি হতে চায় না। সে বাঁচতে চায়। সে কখনও রাতে চিৎকার করে ওঠে, আমাকে বাঁচতে দাও তোমরা। আমাকে এ—ভাবে ভয় দেখিও না।

তারপর যেমন কথা ছিল, সেই বড় হলঘরের মতো ঘরে লম্বা টেবিলের চারপাশে চুপচাপ বসে পড়ার, যেমন কথা ছিল যার যার আসার এবং যেভাবে ঠিকঠাক ছিল ঘর রাখার, সেভাবে ঘর রেখে এখন একটা অদ্ভুত নির্জনতা এই ঘরে। নীল রঙের আলো জ্বলছে ঘরে। ঝাড়বাতিগুলোতে ছোট ছোট আলোর চুমকি। সোমা পরেছে খুব সুন্দর সাদা সিল্ক। তার গায়ে জোনাকি পোকার মতো চুমকি বসানো। সে বসেছে টেবিলের ঠিক মাঝখানে। একে মাঝখানে ঠিক বলা যায় না অবশ্য, কারণ বড় টেবিলটা ডিনার টেবিলের মতো, অনেক বড়, খুব বড় এবং ডিমের মতো আকৃতি টেবিলের। সূচলো ডিমের আকৃতি বলে, সোমা সূচলো দিকটায় বসে রয়েছে। তার মুখ দক্ষিণ—মুখো। তার ডান পাশে সরে সরে বসেছে অশোক, সুধীর, অসিত। আর বাঁ পাশে আছে বিনু, অজিতেশ। অজিতেশ পুলিশের ইউনিফরমে এসেছে। অজিতেশের এটা পাগলামি, বিনু এবং অন্যান্যরা এমন ভাবছে। অন্য সময় হলে ওরা এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা করত, কিন্তু খুন—টুনের গন্ধ এর সঙ্গে আছে, তার ওপর অজিতেশ পুলিশের একজন মোটামুটি বড়কর্তা, তাকে অবহেলা করা যায় না। অজিতেশের কথাবার্তায় মনে হয়, ওরা কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং এখন এই অজিতেশ ব্যক্তিটি যা যা করবে, তাতে সায় রাখতে হবে, না থাকলেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, এটা বেশি প্রমাণিত হবে।

আর এ—ছাড়া কী—যে বড় মনে হচ্ছে এখন এই হলঘরটা। নীল আলোতে দেয়ালে মোমের প্লাস্টার বেশি চকচক করছে, দেয়ালে সব ছবি, এবং ছবিগুলো সেই রুপো বাঁধানো ফ্রেমে অবিকল মানুষের মতো হঠাৎ সহবাসের ছবি পরিত্যাগ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা এখন কী বলছে যেন ছবিগুলো শুনতে চায়। আর মাথার ওপরে হলঘরের ছাদটা এত বেশি লম্বা হয়ে গেছে যে মনে হয় দ্রুত বাতাসে লম্বা হয়ে যাবে ছাদটা, এবং ঠিক এই ছাদের শেষ যেন অনেকদূরে এক অন্ধকার নির্জনতায় মিশে গিয়ে নক্ষত্রের দেশে ঢুকে গেছে। ফলে এইসব মানুষগুলোকে টেবিলের পাশে খুব ছোট এবং আকাশের নিচে কোনো সৌরলোক থেকে আসা গ্রহান্তরের মানুষের মতো মনে হচ্ছিল। ওরা টেবিলের চারপাশে বসে রয়েছে। ওদের দেখলে এখন মনে হবে, ওরা কেউ কাউকে চেনে না। ওরা মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো মহাকাশযানে ওরা নীল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।

কেউ কিছু বলছে না। এ—ভাবে তো চুপচাপ বসে থাকার কথা না। বিনু একবার ঘাড় তুলে তাকাল। সবাই কেমন শোকে মুহ্যমান এমন দেখাচ্ছে। বিনু ফিক করে হেসে দেবে ভাবল, এটা যেন প্রহসনের মতো মনে হচ্ছে, অথবা ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে অলৌকিক উপায়ে মনীষের আত্মা এখানে নিয়ে আসা হবে। অজিতেশ কী পুলিশের কাজ করতে করতে পরলোকচর্চা করে থাকে! বিনুর কেমন সন্দেহ হল। আসলে কী অজিতেশের মনে মনে খারাপ মতলব আছে। সে কী দেখাতে চায়, আর একটা যে খালি চেয়ার রাখা হয়েছে, রাত গভীর হলে চেয়ারটা খালি থাকবে না। সেখানে যে বসে থাকবে, সে মনীষ। মনীষের মুখ দেখা যাবে না হয়তো। ওর অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পাবে সবাই। বিনু ভীষণ ঘাবড়ে গেল। বলল, আমরা এ—ভাবে কতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকব অজিতেশ?

অজিতেশ কোনো কথা বলল না। ওর হাতের ব্যাটনটা মাথার ওপর তুলে দিল শুধু। অর্থাৎ বলতে চাইল যেন, চুপ। অজিতেশের মোটা গোঁফ কিছুটা ঝুলে পড়েছে মনে হল। অজিতেশের খাটো চুল, খাড়া চুল আরও খাড়া হয়ে গেছে। বিনু ভাবল, মাথা নিচু করে দেখবে মুখটা।

কিন্তু বিনুর তখন মনে হল, সোমা উঠে দাঁড়িয়েছে। সে কেমন এক অপার্থিব চেহারায় ওদের দেখছে। যেন সোমা ইচ্ছে করলেই বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে এখন। এটা কী অজিতেশ কোনো মন্ত্রতন্ত্র আওড়ে এমন করছে, না কী সে শালা ভয় পেয়ে চোখে গণ্ডগোল দেখছে। সে বলল, সোমা, তুমি এ—ভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।

অজিতেশ বলল, চুপ। কথা না। শব্দ!

শব্দ!

হ্যাঁ শব্দ!

কীসের শব্দ!

কেউ কাঠের সিঁড়ি ধরে উঠে আসছে!

হ্যাঁ। তাইতো। কাঠের সিঁড়ি!

তুমি শুনতে পাচ্ছ সোমা?

না তো!

অজিতেশ বলতে বলতে উত্তেজনায় উঠে পড়েছিল। কিন্তু সোমা শুনতে পায়নি ভেবে সে কেমন হতাশ গলায় দুস বলে বসে পড়ল। হল না।

অসিত বলল, অজিতেশবাবু, আর যাই করুন আমাদের ভয় পাইয়ে দেবেন না। ঘরের এমন চেহারা হয়, আর সোমাকে যা দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন কোনো পরলোক—টরোলোকে চলে এসেছি।

অজিতেশ বলল, বুঝলেন অসিতবাবু, পৃথিবী ভারী আশ্চর্য জায়গা। মানুষ আরও আশ্চর্য। বলতে বলতে ওর গোঁফটা এবার সোজা হয়ে গেল।

বিনু বলল, তুই কী বলতে চাস বুঝতে পারছিনে!

বলছি, এই মৃত্যুর জন্য তোমরা সবাই দায়ী।

তার মানে! অশোক লাফিয়ে উঠল। যেন ভিতরে একটা চোট খেয়েছে।

অজিতেশ বলল, রাগ করছিস কেন! যা ঘটনা তাই বললাম।

সুধীর বলল, অ্যাবসার্ড ঘটনা। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত নই।

যুক্ত আছিস। এসব নানাভাবে জানতে হয়। সোমাও কিছুটা দায়ী।

বিনু বলল, কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে তোর বুঝি এটা মনে হয়েছে।

অজিতেশ বলল, সোমা, প্রথম দিন থেকে আরম্ভ করা যাক।

সোমা ফের বসে পড়ল। চারপাশের দরজা বন্ধ। ঘরটাকে সামান্য উষ্ণ রাখার আর দরকার হচ্ছে না। শীতকাল চলে যাচ্ছে। সোমা কিছু বলল না। সে শুনে যাচ্ছে। সে অজিতেশের গোঁফ নড়তে দেখল শুধু।

অজিতেশ বলল, প্রথম দিন থেকে মানে, সেই ছবি দেখার দিন থেকে, ছবিটা ছিল, বলে ছবির নাম এবং পরিচালকের নাম বলল। তোমরা সোমা সেই ছবিটাই তো দেখেছিলে!

সোমা মুখ তুলে তাকাল। ওর শরীর কাঁপছিল যেন। চোখ দুটো মায়াবী, এবং যেন জলছবির মতো নিরুপায় মুখ। সে বলল, হ্যাঁ। আর তখনই মনে হল ওর সাদা সিল্ক থেকে একটা চুমকি সত্যি জোনাকি হয়ে বাতাসে উড়ে গেল।

অজিতেশ বলল, তোমরা বুঝতে পারছ আমার খবরাখবর ঠিক।

বিনু হঠাৎ ক্ষেপে গেল। বলল, ধুস শালা, তুই একটা চারশো বিশ। তোকে তো আমি বলেছিলামরে, সোমা কী বই দেখার পর মনীষকে নিয়ে কফি—হাউসে গিয়েছিল। এর আবার খবরাখবর ঠিক বেঠিক কী।

অজিতেশ বেশ অবিকল নকল করে বলল, পৃথিবীটা ভারি মজার জায়গা হে বাপু। অত সহজে ক্ষেপে গেলেই চলে! বলেই সে বলল, ওটাতে একটা দৃশ্য ছিল, সোমা তুমি মনে করতে পার কিনা দ্যাখো। আমি বলার চেয়ে এখানে দেখ। প্রজেকটার দিয়ে তোমাকে সেই রিলটা দেখিয়ে দিচ্ছি বরং। বলে সে ওর লম্বা ব্যাগ থেকে সব টেনে টেনে বের করতে থাকল। সে বেশ নুয়ে থাকল ব্যাগের ওপর। ক্যানভাসের ব্যাগ, কিছুটা জাদুকরের মতো ওকে এখন দেখাচ্ছে। ক্যানভাসের ব্যাগ থেকে টেনে নামানোর চেয়ে সে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ উপুড় হয়ে থাকল। সাপুড়ে ওঝার মতো সে যেন বের করেই জিনিসটা সবার ওপর ছুঁড়ে দেবে। সাপ—টাপের মতো কিছু একটা ছুঁড়ে দেবে—এমন মনে হচ্ছে ওর আচার—আচরণ দেখে। এবং সবার এতে ভয় পাবার কথা। চারপাশের মানুষ জনের ভিতর একটা এখন বিস্ময়কর সতর্কতা। সাপটা কার ওপরে এসে পড়বে কেউ বলতে পারে না। তবু নিজেদের রক্ষা করার জন্য সবাই সতর্ক থাকছে। যেন ছুঁড়ে দিলেই দুহাতে ঠেলে ফেলে ছুটতে পারে। কেবল সোমা এসব কিছু ভাবছে না। সাত আট দিনের মাথায় অজিতেশ এতদিনের একটা রহস্যকর ঘটনার সমাধান করতে চায়। ওর মনে মনে হাসি পেল।

অজিতেশ হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়াল। সবার দিকে চোখ ঘোরাল। কী দেখল চোখ ঘুরিয়ে। তারপর বলল, এই দেখুন। সে টেবিলে স্ট্যান্ড বসিয়ে সামনের সাদা রঙের দেয়ালে আলো ফেলে ছবির রিলটা দেখাবে বলে বোতাম টিপে দিল। এবং তখনই দেয়ালে এক তরুণের ছবি। সে একটা মরুভূমির মতো বালিয়াড়ির ওপরে ছুটছে। চারপাশ থেকে পুলিশের রাইফেল, বেয়নেট চার্জ করার জন্য ওরাও ছুটছে। এবং সেই তরুণ এই বয়স তেইশ—চব্বিশ হবে, মুখে সামান্য দাড়ি, চোখ বড়, সে সব কিছু অন্যায় শোষণ দূর করার জন্য শহরের রাস্তায়, গ্রামের নির্জনতায়, চারপাশের মাঠে, সুন্দর সূর্য উঠলে শারীরিক কৌশলে এবং এক আশ্চর্য দৃঢ়তায় সে যখন পৃথিবীতে সুখী রাজপুত্র, তখনই অজিতেশ অনেক দূরে থেকে বলার মতো বলে চলল, সোমা তুমি ওকে ভালো করে দেখ। শৈশবে অথবা যখন তুমি নানাবর্ণের স্বপ্নের ভিতর বড় হয়ে উঠেছিলে, তখন তোমার বাবার আত্মহত্যা, তোমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তুমি জানতে কেন তোমার বাবার এই আত্মহত্যা, তুমিও স্বপ্ন দেখতে, কোনো সকালে ঠিক এই ধরণিতে আশ্চর্য এক সকাল আসবে। সব মানুষ সুখী, তোমার বাবাকে সেখানে তেলেভাজা চুরি করে খেতে হবে না, তোমার মাকে…বলে সে থামল কিছুক্ষণের জন্য। আজীবন এমন একটা সকাল আসবে ভেবেছিলে। এবং এমন একজন তোমার পাশে কেউ থাকবে যার চোখ বড়, যে সুখী রাজপুত্রের মতো স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে।

রিলে তখন সেই তরুণ অথবা বলা যায় যুবাকে দেয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বর্তমান অসাম্যের জাগ্রত প্রহরী এই পুলিশের গুলি, ওর মাথায় বুকে পেটে, জঙ্ঘায় তুমি দৃশ্যটি দেখে কেঁদে ফেলেছিলে। সে কেমন সারমন দেবার মতো বলতে বলতে শেষে বলে ফেলল, তুমি কেঁদেছিলে কী না!

সোমা ঘাড় নিচু করে সম্মতি জানাল।

অজিতেশ বলল, মুখটা দেখ। চোখ দেখ। ফের সে রিল ঘুরিয়ে দিল।

সবাই ফের ছবিটা দেখল।

অজিতেশ বলল, আমি চাই মুখটা সোমা মুখস্থ করে ফেলুক।

সোমা বলল, আমার মনে থাকবে।

অজিতেশ বলল, মুখটা কিন্তু যুবার আসল মুখ নয়। মেক—আপ নেবার পর।

বিনু বলল, তারপর কী!

এবং সঙ্গে সঙ্গে অজিতেশ রিল বন্ধ করে দিল। তারপর বসে পড়ল। এখন ওরা আগের মতো বসে রয়েছে। টেবিলে স্ট্যান্ড তিনটে পা যেন। জিরাফের মতো গলা উঁচু করে রেখেছে। এবং দেখলে মনে হবে এই নীল অন্ধকারে এ প্রজেকটারও একটা জীবের মতো। যেন ওরা এখন সাত জন। ওর জন্যও আলাদা একটা চেয়ার দরকার।

অজিতেশ বলল, এবারে সোমা তোমাকে বলতে চাই, সেই অভিনেতাকে তুমি কফি—হাউসে দেখেছিলে। তুমি এত সুন্দর, সবাই তোমাকে দেখছে, অথচ তুমি ওকে দেখছ, বারবার ওকে দেখছ, সেও এমন সুন্দরী যুবতী ওকে এত দেখছে ভেবে অবাক হয়নি, কারণ সে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছে, এবার থেকে অনেকেই ওকে দেখবে তাতে বেশি কী। আসলে ব্যাপারটা সেখানেও নয়। সে তোমার মতো মেয়ের রূপ ভুলতে পারছিল না। ওর চোখে ছিল উদাসীনতা। যেন এসব কিছু না। আরও সে ওপরে উঠবে। বহু সুন্দরীদের সে ক্রমে লোভনীয় বস্তু হয়ে যাবে।

সোমা বলল, অজিতেশ, তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিও না।

অজিতেশের গোঁফ আবার লম্বা হয়ে গেল। বলল, সেই অভিনেতার গালে দাড়ি না থাকলে কেমন দেখায়! তুমি ভাবছিলে ওকে যেন কোথায় দেখেছ! কত কালের চেনা, কিন্তু ঠিক কারও সঙ্গে মেলাতে পারছ না। ছবির মতো ওর মুখে দাড়ি গোঁফ ছিল না। কিন্তু চোখ দুটো ছিল একরকমের। তুমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলে না।

সোমা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, না না! মিথ্যে কথা।

অজিতেশ বলল, সোমা, তুমি বসো। উত্তেজিত হবে না।

সোমা একেবারে বসে গেল। সে চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে ছাদে যেন কী দেখছে। আসলে কিছুই দেখছে না। শূন্য দৃষ্টি। সে বলতে পারত, তুমি ঠিক বলেছ অজিতেশ। এতদিনে আমি ওকে চিনতে পেরেছি।

অজিতেশ বলল, চারপাশে যখন দুর্ঘটনা, যখন হত্যাকাণ্ড, সুখী রাজপুত্রেরা পৃথিবীতে সু—সময় আনবে বলে যখন বাজি ধরেছে তখন তোমরা নিশ্চিন্তে ছবি দেখবে, কোনো ভাবনা থাকবে না, এটা তোমার বন্ধুদের কেউ চাইল না। বলেই সে আবার ঘাড় নিচু করে দিল। সেই ক্যানভাসের ব্যাগ থেকে বের করল একটা খাতা। বলল, এখানে সবাই যদি একটা চিঠি লিখে দেন মনীষ দত্তকে। লিখবেন, যে যেভাবে পারবেন লিখবেন। চিঠিটা মনীষ দত্তকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ওর নাম ঠিকানা থাকবে। লাল কালিতে লিখবেন।

বিনু আর এখন কিছু বলতে পারছে না। সে দেখল অজিতেশ এখন বাজিকরের মতো ভারি সব সুন্দর সুন্দর খেলা দেখাচ্ছে। সে খাতাটা নিয়ে লিখল, মনীষ দত্ত…।

সুধীর লিখল, আরও কিছু।

অসিত বলল, আমিও কিছু লিখে দিচ্ছি।

অশোক বলল, কী লিখব বুঝতে পারছি না।

তারপর অজিতেশ লেখাগুলো বের করে একটা লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দিল। দ্যাখ তো দুটো লেখাতে মিল আছে কিনা।

একেবারে এক। হাতের লেখা এক।

অজিতেশ এবারে দু হাতের ওপর টেবিলে ঝুঁকে দাঁড়াল। বলল, অশোক তুমি থ্রেটনিঙের চিঠি দিয়েছিলে! ছেলেমানুষী। আসলে তোমার কোনো মতলবই ছিল না খুন—টুন করার। সেদিন কফি—হাউসে এমন একজোড়া পায়রা আকাশের নিচে খুব বকম বকম করে উড়ে বেড়াচ্ছে বলে হিংসে হয়েছিল। কী করে জব্দ করা যায় ভেবেছিলে। কত উড়ো চিঠি আসছে, ভয়ে পুলিশে উড়ো চিঠি জমা দিচ্ছে না এসব ভালো করে জানতে। মনীষকে একটু ঘাবড়ে দিয়ে কাপুরুষের মতো প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে! চিঠিটা তুমি নিজের হাতেই রসুলকে দিয়ে গেছিলে। নাম বলেছিলে অঞ্জন? ঠিক?

অশোক বলল, আমি কিছু বলব না।

সুধীর বলল, কিন্তু ও তো একচুয়েলি খুন করেনি!

অজিতেশ হাসল। খুব প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসল। বলল, না। অশোকের ঐ চিঠি লেখাই সার। ওর আর কিছু করার ক্ষমতা নেই।

অসিত বলল, তাহলে!

সোমা তখন বাধা দিয়ে বলল, হঠাৎ কেউ কেউ আসত দেখা করতে। কিন্তু দেখা হত না।

সুধীর বলল, আমি একদিন এসে দেখা পাইনি তোর! কেবল নাম জানতে চায়। যত বলি, এলেই চিনতে পারবে, নাম বলার দরকার হবে না, ততই তোমার লোকেরা ক্ষেপে যায়। রাগ করে শেষে চলে গেছি। হাতের কাছে ফোন থাকলে একচোট নিতাম। তারপর মনে হয়েছে, যাকগে বড়লোক হয়ে গেলে এমনি হয়ে থাকে। নালিশ করার প্রয়োজন মনে করিনি। আগেই বলেছিলাম, না হলে এ—থেকে তোমরা একটা ক্লু বের করার চেষ্টা করবে।

অজিতেশ বলল, ওটা একদিনই হয়েছে। অথচ এমনভাবে একটা ভয়ের ভিতর তোমরা পড়ে গেলে যে মনে হত বারবার এটা তোমাদের জীবনে ঘটছে। নতুবা বাথরুমে কেউ ঢুকে যাবে না। আয়নায় কারও ছবি ভেসে ওঠে না। কীভাবে এইসব সুখী রাজপুত্রেরা যে তোমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, বুঝতে পারছ না! ভয়ংকর একটা ইলুসানের ভিতর ডুবে গেছিলে।

সোমা বলল, চিঠিটা পাবার পর আমি কেন যে ওকে বললাম, জানি সে আসবে!

মনীষ তখন কী বলেছিল? অজিতেশ প্রশ্ন করল।

মনীষ আর্তনাদ করে উঠেছিল। বলেছিল, কী বলছ সোমা!

বিনু বলল, ওভাবেই তুমি ওকে আরও বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।

অজিতেশ বলল, সোমার সেই যে শৈশবে স্বপ্ন ছিল, সুখী রাজপুত্রেরা এসে ওর বাবার মৃত্যুর শোধ নেবে, এবং সে কোনোদিন যেজন্য কাজল পরল না, অথচ বড় হতে হতে সে সুখী রাজপুত্র ভেবে মনীষকেই বিয়ে করে ফেলল, তারপর দেখা গেল, না মনীষ ঠিক সুখী রাজপুত্র নয়। বরং সে শহরের সেই সেরিফ ভদ্রলোকটির মতো, যার কাণ্ডজ্ঞান একেবারেই নেই—আর আমরা এ—ভাবে সবাই তরুণ বয়সে এমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, বয়স বাড়ে, ক্রমে আমরা কঠিন রাস্তায় হেঁটে হেঁটে স্বপ্নের কথা ভুলে যাই। মনীষও ভুলে গিয়েছিল। সোমার তখন মনে হত, কেউ আসবে। আর এ—পথেই সোমার সংসারে গণ্ডগোল এমনভাবে দানা বেঁধে গেল যা মনীষের মৃত্যুর কারণ।

অসিত বলল, মনীষবাবু তো পালাচ্ছিল। অথচ ট্রেনের নিচে পড়ে গেল পালাতে গিয়ে।

আমরা এর আগে বিনুকে কিছু জিজ্ঞাসা করব। আচ্ছা বিনু, তুমি কি কোনো ভয় দেখিয়েছিলে!

সে বলল, না তো।

মনে করে দ্যাখো।

বিনু বলল, যেদিন সে পালিয়েছিল, সেদিন বিকেলের দিকে ওকে একবার ফোন করেছিলাম।

ফোনে কী বলেছিলে?

ফোনে…ফোনে! সে মনে করার চেষ্টা করল।—অঃ। মনে পড়ে গেল কথাটা। বলেছিলাম, কে এক জহুরিমল না হুজুরীমলের গলা কেটে দিয়েছে। ঘটনাটা চিৎপুরে ঘটেছিল।

একটা লোক ভয়ে মরে যাচ্ছে, তুমি ওকে আরও ভয় পাইয়ে দিলে। ওতো পালাবেই।

আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।

কেউ আমরা বুঝতে পারিনি। অসিত বলল।

অজিতেশ বলল, আপনারা এখন বুঝতে পারছেন, ভয় কখনও কী ভয়ংকর হয়ে যায়। এবং অহেতুক মৃত্যুকে টেনে আনে! আমরা মনীষের কাছে কিছু শুনতে চাই। আসুন না আমরা ভাবি ঐ যে খালি চেয়ারটা রাখা হয়েছে সেখানে মনীষ বসে আছে। আপনারা সবাই ভাবুন খালি চেয়ারটাতে মনীষ বসে রয়েছে। ওকে সবাই আপনারা প্রশ্ন করুন। তারপর কী! তুমি কোথায় কীভাবে পড়ে গেলে, না কেউ তোমাকে কামরায় মেরে ট্রেনের চাকার নিচে ফেলে গিয়েছে। আপনারা সবাই কায়মনোবাক্যে প্রশ্ন করে যান। যান। বলুন। নিবিষ্ট হোন। দেখুন নীল অন্ধকারে খালি চেয়ার এবং সোমার সাদা সিল্কে একটাও চুমকি আর নেই, সব জোনাকি হয়ে গেছে। ছাদটাকে ছাদ আর মনে করবেন না, নীল আকাশ ভেবে ফেলুন। দেখুন সেখানে সব জোনাকি পোকারা একে একে সব নক্ষত্র হয়ে গেছে। আপনারা সবাই কোনো মহাকাশযানে চড়ে আত্মার অন্য স্তরে চলে যাচ্ছেন। ভাবুন, এ—ভাবে ভাবুন! দেখুন ঐ তো, ঐ তো মনীষ ঘাড় নিচু করে বসে আছে। চেয়ারটা আর খালি নেই। অন্ধকারের ভিতর থেকে চেয়ারটায় অস্পষ্ট কিছু যে দেখছেন, ঐ মনীষ। সে এবার আপনাদের মানুষের অধম চরিত্রহীনতার কথা বলবে। মানুষ যে কখনও সম্পূর্ণ নয় তার কথা বলবে। তাকে এবার চুপচাপ বলতে দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *