দুঃস্বপ্নের যুগ
তারপর শেষ হয়ে এলো ওই উভচরদের যুগ। সে আজ প্রায় ৩০ কোটি বছর আগেকার কথা। খাটি উভচর বলতে আজকাল ব্যাঙ-ট্যাঙ ধরনের শুধু দু-একরকম প্রাণী চোখে পড়ে। বেশিরভাগই গিয়েছে মরে। তবে, উভচরদের একরকম বংশধর আজো আমরা দেদার দেখতে পাই। এই বংশধরদের নাম দেওয়া হয় সরীসৃপ! সরীসৃপ কাদের বলে জানো? যারা বুকের ওপর ভর দিয়ে চলে তাদের বলে সরীসৃপ। যেমন ধরো, আজকের দিনের সাপ, কিম্বা টিকটিকি। কারুর বা পা নেই, কারুর বা পা আছে। কিন্তু ওদের বেলায় এইটাই বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, বুকের ওপর ভর দিয়ে হাঁটবার কথা।
তার মানে, উভচরের একদল বংশধর বদলাতে বদলাতে, বদলাতে বদলাতে, শেষ পর্যন্ত সরীসৃপ হয়ে গেল। সরীসৃপরা কিন্তু পুরোপুরি ডাঙার জীব, উভচরদের মতো এক-পা জলে নয়। তার মানে, উভচররা যা পারে নি সরীসৃপরা তা পারলো।—জলের মায়া একেবারে কাটিয়ে আসতে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেমন করে পারলো? তার আসল কারণ হলো সরীসৃপদের ডিমগুলো। এদের ডিমের ওপর শক্ত খোলস, উভচরদের মতো তুলতুলে নরম ডিম নয়। আর তাই ডিম পড়বার জন্যে। জলে ফিরে যেতে হয় না। ডাঙার ওপরেই ডিম পাড়তে পারে, ডিমের ওপর তা দিতে পারে।
সরীসৃপদের শরীরে এ-ছাড়াও আরো কয়েক রকম সুবিধে। ঘোরাফেরা করবার ব্যাপার নিঃশ্বাস নেবার ব্যাপারে, নানান ব্যাপারে সুবিধে। তাই দেখতে দেখতে পৃথিবীর বুক অনেক অজস্র রকম সরীসৃপে ভরে যেতে লাগলো। তার মানে, উভচরদের বংশধররা নানানভাবে বদলাতে বদলাতে নানান রকমের সরীসৃপ হয়ে দাঁড়াতে লাগলো। কারুর-বা পাগুলো খুব মজবুত, দিব্যি হেঁটে বেড়াতে পারে। কারুর-বা শরীর থেকে পায়ের চিহ্ন বেবাক মুছে গেল। যেমন ধরো সাপ। কারুর-বা পাগুলো বদলাতে বদলাতে নৌকার দাঁড়ের মতো হয়ে গেল। তারা ফিরে গেল জলের ভেতর। আবার কারুর শরীরে গজালো চামড়ার ডানা। আজকালকার বাদুড় দেখেছে তো? তাদের যেরকম ডানা আছে অনেকটা সেই রকম। এই সব সরীসৃপের চামড়ার ডানা দিয়ে আকাশে উড়তে শুরু করলো। অবশ্য তাই বলে এই উড়ো-সরীসৃপরাই আজকালকার পাখির পূর্বপুরুষ নয়। আজকালকার পাখি সরীসৃপদেরই বংশধর, কিন্তু অন্য আর এক রকম সরীসৃপদের—ওই চামড়ার ডানাওয়ালা উড়ো সরীসৃপদের নয়।
এতো রকম সরীসৃপদের মধ্যে সবচেয়ে জমকালো গল্প যাদের নিয়ে তাদের নাম দেওয়া হয় ডাইনোসার; এমনসব অতিকায় জানোয়ার পৃথিবীর বুকে আর কখনো জন্মায় নি। আজকালকার হাতিগুলোও তাদের পাশে ছেলেমানুষ যেন। মূর্তিমান দুঃস্বপ্নের মতো এক একটি চেহারা! অনেকদিন ধরে চললো এই ডাইনোসারদের যুগ, এক দুঃস্বপ্নের যুগ যেন! দু-চার রকম ডাইনোসরের নমুনা দিই! এক রকম ডাইনোসরের নাম হলো ডিপলোডোকাস। লম্বায় ৫৮ হাত। কিন্তু নিরামিষ খায়। বুদ্ধিটাও নেহাত মোটা ধরনের কেননা এমন বিরাট চেহারা হলেও মাথার মগজটা ছোট্ট, একটা মুরগির ডিমের মতো। মানুষের সঙ্গে তুলনা করো, তাহলেই বুঝতে পারবে মগজটা কতোটুকু। মানুষের শরীর মাত্র সাড়ে তিন হাত লম্বা, কিন্তু মগজের ওজন প্রায় দেড় কেজি। তার মানে গোটা তিরিশ ডিপলোডোকাসের মগজ এক করলে একটি মানুষের মগজের সমান ওজন হবে। কিন্তু তাই বলে বুদ্ধিতে মোটেই সমান হবে না। তারা যে বোকা সেই বোকাই থাকবে। আর একরাম ডাইনোসরের নাম হলো ব্রাসিওসরাস। তাদের ওজন কতো জানো? প্ৰায় সতের হাজার কেজি। গলাটা এতো লম্বা যে মাটিতে দাঁড়ায়ে আজকালকার যে-কোনো তিন-তলা বাড়ির ছাদটা উঁকি মেরে দেখে নিতে পারতো!
আর একরকম ডাইনোসর-এর নাম হলো টিরেনোসরাস। এ যেন স্বয়ং যমদূত। লম্বায় উনিশ ফুট, সামনের পা দুটো ছোটো ছোটো, পেছনের পা দুটো থামের মতো। দাঁতগুলো মূলোর মতো, এতোখানি হাঁ, ল্যাজের ঝাপটায় জঙ্গল কাঁপে। এতো বিরাট মাংসখেকো জানোয়ার পৃথিবীতে আর কখনো জন্মায় নি। তাই টিয়েনোসরাস যখন শিকারে বেরোত তখন অন্যসব অতিবড় ডাইনোসরাও ভয়ে একেবারে থরহরি কম্পমান।
এই রকম অনেক রকমের ডাইনোসর। অনেক লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর ওপর এদেরই দুৰ্দান্ত দাপট।
কিন্তু অমন বিরাট বিরাট দৈত্যের মতো চেহারা হলে কি হয়, শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে ওরাও আর টিকতে পারলো না। শুধু পড়ে রইলো ওদের কঙ্কালগুলোর কিছু কিছু ফসিল।
কিন্তু কেন? কেন ওরা টিকতে পারলো না?
সে আজ প্রায় আট কোটি বছর আগেকার কথা। পৃথিবীর বুকের ওপর শুরু হলো এক রসাতল তলাতল কাণ্ড। মস্ত মস্ত জলাভূমিগুলো শুকিয়ে গিয়ে খা-খা করতে লাগলো, মাথা তুলে দাঁড়াতে আরম্ভ করলো বিরাট বিরাট পাহাড়ের চূড়ো! উত্তর শিয়ার থেকে বইতে শুরু করলে শুকনো আর ঠাণ্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ায় শুকিয়ে মরে যেতে লাগলো গরম জায়গার গাছপালাগুলো।
পৃথিবীর চেহারাটাই গেল বদলে। এর আগে পর্যন্ত যে-রকম অবস্থা ছিল ডাইনোসরদের পক্ষে সেইটেই খাসা। কেননা, এই সব বিভীষিকার মতো বড় বড় জানোয়ারদের অনেকেই থাকতো জলার মধ্যে গা-ডুবিয়ে, খেতে জলা জায়গার গাছপালা, বাঁচতো ভিজে আর গরম হাওয়ায়। পৃথিবীর চেহারা বদলে গিয়ে নতুন যে চেহারা হলো তার মধ্যে এরা বাঁচবে কেমন করে? নতুন অবস্থার সঙ্গে ওরা নিজেদের খাপ খাওয়াতে আর পারলো না।
আর তাই শেষ হলো ওই দুঃস্বপ্নের দিন, শেষ হলো সরীসৃপদের যুগ। তারপর?