1 of 2

দুঃসময়

দুঃসময়

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভারটা তুলে বললাম, বলছি।

অনিমেষ বলছিস?  

শুভ্রর গলা। শুনেই বুঝেছিলাম। ওরা টাঙাইলের বাঙাল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় উচ্চারণেই শুধু নয়, একেবারে ঠাকুরবাড়ির উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু উচ্চারণটা অস্পষ্ট। শুনলেই বোঝা যায় যে, এক কেঠো বাঙাল আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কলকাতার ঘটি হওয়ার। এই প্রচেষ্টার মধ্যে এক ধরনের গভীর হীনম্মন্যতা আছে বলেই মনে হয় শুভ্রর।

বাঙালরা কোন অংশে ঘটিদের চেয়ে নিকৃষ্ট তা বুঝে উঠতে পারি না আমি। বললাম, বল শুভ্র, কী ব্যাপার? এত রাতে?

আর বলিস না। হরিপদকে বোধ হয় আর বাঁচানো যাবে না।

কী হল? হঠাৎ–

ব্যাপারটা হঠাৎ হয়নি। জানিসই তো, ওর স্ত্রী চলে যাওয়ার পর থেকে ও বড়োই একা হয়ে গেছে। রিটায়ারও করেছে বছর তিনেক। ছোটো ভাইয়ের সংসারে থাকে বৈষ্ণবঘাটা, পাটুলিতে। একমাত্র মেয়ে থাকে লখনউতে, শিবাজি নগরে। তাঁর কাছে বছরে একবার করে গিয়ে থাকে মাসখানেক। জামাই মস্ত বড়ো কাজ করে। একটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে। দু-খানা গাড়ি, লনওয়ালা বাড়ি…।

আরে! এত রাতে হরিপদর জামাই-এর ইতিহাস শুনে কী হবে? মোদ্দা কথাটা বল না।

হ্যাঁ। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে হরিপদ আজই লখনউ থেকে এসেছে, শয্যাশায়ী হয়ে, হাঁটা-চলার ক্ষমতাও নেই। হাওড়াতে স্টেশনের স্টাফ ওকে ওয়েটিং রুমে শুয়িয়ে রেখে তাঁর ভাইকে মোবাইলে খবর দেয়। ট্রান্সপোর্টেশন ম্যানেজার অনেক করেছেন। তিনি নিজে এবং তাঁর। অফিসের দুজন ভদ্রলোককে নিয়ে ওকে সোজা পার্ক ভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করে, হরিপদর ভাই শ্যামাপদর নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জোগাড়। রাইটার্স-এর কাকে নাকি ধরে পিজি-তে ট্রান্সফার করে। ঘন্টাখানেক হয়েছে।

আরে হরিপদর কী হয়েছে তা তো বলবি।

কী হয়নি তাই বল? ওর দুটো কিডনিই ফেইল করে গেছে। হার্ট আর লাংস-এর যা অবস্থা তাতে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টও করা যাবে না। ডাক্তাররা বলছেন, কাল থেকে ডায়ালিসিস শুরু হবে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা গেলেও তার যা খরচা, তা তো জানিসই। ডায়ালিসিসও কতদিন করতে হবে, কে জানে। ওর ছোটো ভাই সামান্য একটা চাকরি করে রাইটার্সে। তবে ছেলেটা ভারি ভালো। কে জানে, অত টাকা আসবে কোথা থেকে?  

মেডিক্লেম ছিল না ওর?

ধুস, নামই শোনেনি।

তুই আর একটু ছোটো করে বলবি শুভ্র? আমাকে কাল সকাল আটটার মধ্যে অফিসে পৌঁছোতে হবে।

কী আর বলব? এখন বন্ধুবান্ধবদেরই খরচ জোগাতে হবে। ওর দেখাশোনাও করতে হবে। তুই কি কাল আসতে পারবি হাসপাতালে?  

সকালে তো পারব না। অফিসে তো আগে বলা নেই তবে অফিস ছুটির পরে অবশ্যই যাব।

সব বন্ধুদেরই খবর দিচ্ছি একেক করে বাড়িতে ফিরে। তা ছাড়া, কাল রাতে আমার বাড়িতে একটা মিটিংও ডেকেছি। ভবানীপুর, সেন্ট্রাল জায়গা, হাসপাতালেরও কাছে, সকলেরই সুবিধা হবে। সকলকেই ফোন করে করে জানাচ্ছি। সেই মিটিং-এ কী করা যায় না যায়, তা নিয়ে সকলে আলোচনা করব। তুই কাল হাসপাতালে না আসতে পারলেও আমার বাড়িতে অবশ্যই আসিস।

জামাই এত বড়ো কাজ করে, তা ছাড়া একমাত্র জামাই, সে কী করছে?  

সবই বলব, কাল আসিস কিন্তু।

২.

দিল্লি থেকে ডিরেক্টর এসেছিলেন একদিনের জন্যে। সারাদিনই খুব ব্যস্ত ছিলাম অফিসের সকলেই, লাঞ্চ খাওয়ারও সময় পাইনি। তাঁকে এয়ারপোর্টে ছাড়তেও যেতে হয়েছিল। শুভ্রর বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে ন-টা বেজে গেল। তখন সকলেই প্রায় চলে গেছে। শুধু হারিত আছে।

হরিতও ভবানীপুরে শাঁখারিপাড়া রোড-এ থাকে, পথের নাম বদলে এখন কী ঘোষ রোড হয়েছে যেন।

শুভ্রর স্ত্রী সীতা খুব ভালো মেয়ে। হাসিখুশি, বাচ্চাদের একটি স্কুলে বাংলা পড়ায় কিন্তু তারপরও সংসারের সব কাজ হাসিমুখেই করে। কাজের একটি মেয়ে আছে বছর পনেরোর। তাঁকেই নিজের সন্তানজ্ঞানে দেখে। ওদের সন্তান নেই।

কিছু খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করল সীতা। আমি বললাম, এত রাত হয়ে গেছে, একেবারে বাড়ি ফিরে চান করে খেয়ে নেব। সারাদিন খুব হুজ্জোত গেছে।

শুভ্র সব বলল সংক্ষেপে। তবে সংক্ষেপে বলাটা ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ। বলল, বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম আমাদের জন্যে নয়। কী সাংঘাতিক খরচ। একবেলা থেকেই যা বিল হয়েছে তাতেই হরিপদর ছোটো ভাই শ্যামাপদর অবস্থা কাহিল। আমার অবস্থাও তো অনিমেষের চেয়ে কিছু ভালো নয়। আমারও তো মেডিক্লেম পলিসি নেই। হারিত বলল, থাকলেও খুব সুবিধা হত না। আমার বড়ো বউদির হঠাৎ প্রচণ্ড শ্বাসের কষ্ট হওয়াতে বড়দা নার্সিংহোমে ভরতি করেছিল। বউদির মেডিক্লেম পলিসি ছিল। কভারেজ ছিল তিন লাখ টাকার। তাতেও কত হ্যাপা।

কেন? তাতেও হ্যাপা হবে কেন?

আরে হ্যাপাই হ্যাপা। ক্যাশলেস পলিসি। হাসপাতালে ভরতি করেই কার্ডটা জমা দিয়ে দিতে হয়। তাতে পেশেন্টের কোনো টাকাই দিত হয় না যদি খরচ পলিসিতে কভার করে যায়। সব বড়ো বড়ো হাসপাতালেই এই ব্যবস্থা আছে। সরাসরি সব খরচ পেশেন্টের নামে চার্জড হতে থাকে। পনেরো দিনে তিন লাখের আড়াই লাখ বেরিয়ে গেল। দাদা বলছিল, এ বছরে বউদির পলিসি রিনিউ করার সময়ে তেইশ হাজার টাকা প্রিমিয়াম নিয়েছে।

কোন কোম্পানি?

ঠিক জানি না। সব ইন্সিয়য়ারেন্স কোম্পানিই নাকি বয়স্ক মানুষদের বেলাতে প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দিয়েছে এই বছর থেকে। অথচ উলটোটাই হওয়ার ছিল। তাই নয়? মানুষের বয়স যখন কম। থাকে তখন তো আর তেমন অসুখ বিসুখ করে না। সারাজীবন ধরে প্রিমিয়াম গুনে যখন অসুখের চিকিৎসাতে সাহায্যের দরকার তখনই প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দিচ্ছে কোম্পানিরা।

যত বড়োলোকই হোক না কেন, বুড়ো হলে তো তাঁর রোজগার কমেই যায়। তা ছাড়া, বড়োলোকও তো কেউ কারো দয়াতে হয় না, নিজেরাই প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কামাতে হয়–কারোরই তো পড়ে-পাওয়া ধন নয়। ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানির দয়াতেও তো আর কেউ বড়োলোক হয় না।

শুভ্র বলল, শুধু তাই নয়। হাসপাতাল বা নার্সিং হোম থেকেই নার্স ঠিক করে দেয় অথচ পোস্ট অপারেটিভ বা পোস্ট-ইলনেস পিরিয়ডের ওষুধপত্র এবং নার্সিং-এর সব খরচ রিইমবার্স করতেও প্রচুর ঝামেলা করে।

শুভ্র বলল, এটা অত্যন্ত অন্যায় না? বল?

আমি বললাম, নামি হাসপাতালে বা ইন্সিয়য়ারেন্সের স্বীকৃত বড়ো নার্সিংহোমে বা হাসপাতালে ভরতি না হলে টাকা দেয় না। হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাড়িতেও তো প্রচুর খরচ হয়, ডাক্তারদের ফিজ, ওষুধপত্রের খরচ, তা নিয়েও কম টালবাহানা করে না ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানিরা।

শুভ্র বলল, ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানিদেরও তেমন দোষ নেই। আসলে লুটেপুটে খায় ডাক্তারেরা আর হাসপাতাল এবং নার্সিং হোমেরা। তাঁরা যে খরচ আদায় করে ইন্সিয়োরেন্স-এর কাছ থেকে, সেই সব ক্লেমই খুব ভালো করে অডিট করা প্রয়োজন। এই ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত হওয়া খুবই উচিত জরুরি ভিত্তিতে। সব বোঝাটাই অসুস্থদের ঘাড়ে এসে পড়ে। তা ছাড়া, ডাক্তারদের কেমন রবরবা হয়েছে দেখিস না? এখন ডাক্তারদের অবস্থা দেখেছিস? কার গাড়িবাড়ি নেই বল তো? কে প্রতিবছর বিদেশে যাচ্ছে না বেড়াতে, কার ছেলে-মেয়ে পড়ছে না বিদেশে? স্কলারশিপের টাকায় নয়, অধিকাংশই বাবার টাকাতে।

হারিত বলল, তা ছাড়া প্রফেশনাল এথিকস বলেও কিসসু নেই। আগেকার দিনের ডাক্তারদের নেমপ্লেট হত চার ইঞ্চি লম্বা আর ফুট খানেক চওড়া। সাদা বা কালো কাঠের প্লেটের উপরে কালো বা সাদা দিয়ে লেখা থাকত ডাক্তারের নাম। আর এখনকার ডাক্তার এবং সার্জনরা মস্ত বড়ো বড়ো সাইনবোর্ড টাঙান। যেন মুরগি পালিয়ে যাবে অন্যের কাছে। লাজ-লজ্জা সব গেছে।

শুভ্র বলল, আমার অফিসের বড়োসাহেব ক্যালকাটা ক্লাবের পুরোনো মেম্বার। ক্লাবের যে নিউজ বুলেটিন আসে তাতে এ মাসে আর পি মারিকের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছে। বড়সাহেব। বলছিলেন, মারিক সাহেব ডোভার রোড আর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মোড়ের দ্বারকানাথ মিত্তিরের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন একসময়ে। লাগান জুট কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ছিলেন। পরে ওল্ড বালিগঞ্জ রোডের হিমাদ্রি বিল্ডিং-এ ফ্ল্যাট কিনে থাকত, তাও প্রায় পঁচিশ বছর হল। ওই বুলেটিনে তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পেরে উনি মিসেস মারিককে ফোন করেছিলেন

আমার সামনেই। জিজ্ঞেস করলেন, বউদি, দাদার কী হয়েছিল? প্রতিদিন ভোর চারটেতে উঠে ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাবের মাঠে হাফ-প্যান্ট পরে পাঁচ চক্কর হাঁটতেন, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। দারুণ ফিট ছিলেন। সি সি এফ সি এবং ক্যালকাটা ক্লাবে নিয়মিত যেতেন। কী হল হঠাৎ।

মিসেস মারিক যা বললেন, তা হল, কলকাতাতে রবিবারে কোনো ডাক্তারকে পাওয়া যায় না। যদি কাউকে পাওয়া যেত তবে এমন ঘটত না। দুপুরে বুকে ব্যথা হয়েছিল। আমরা যখন বি এম বিড়লাতে নিয়ে গেলাম বিকেলে, তখন ওঁরা বললেন, কিছুক্ষণ আগে আনলেও বাঁচানো যেত। কলকাতাটা গ্রামেরও অধম হয়ে গেছে।

হারিত বলল, উনি যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ব্যতিক্রম কিছু আছেন হয়তো কিন্তু তাঁরা অতি সামান্য। অধিকাংশ ডাক্তারই হায় টাকা, হায় টাকা করে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন।

আগেকার দিনে ডাক্তারেরা, এলএমএফ ডাক্তারেরাও ডাক্তারিকে জীবনের একটা ব্রত বলে মনে করতেন। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সব উপন্যাসের নায়কেরা হতেন হয় ডাক্তার, নয় মাস্টার। আর সেই কারণেই সমাজের সব শ্রেণির অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ও ভক্তি তাঁদের জুটত। ডাক্তারেরা কি। মার্কেন্টাইল ফার্মের কেরানি? না অফিসার? তাঁরা জীবনের কারবারি-তাঁদের যে চোখে আমরা দেখে এসেছি, ঈশ্বরের মতো, তাঁরা সেই আসন থেকে নিজেরাই নিজেদের টেনে নামিয়েছেন। ধুলোতে। বলার কিছুই নেই।

বললাম, আজ আমি উঠলাম রে। কালকে যাওয়ার পথেই হরিপদকে দেখে যাব। আমার কী করণীয় তা জানাস। আমার সাধ্যমতো নিশ্চয়ই করব।

বলে বেরিয়ে এলাম।

রাতে ভালো ঘুম হল না। হরিপদ আমার স্কুলের বন্ধু। তখন আমরাও ভবানীপুরেই থাকতাম। সব পাড়াতেই তখন অনেক ফাঁকা মাঠ ও বড়োবড়ো বাড়ির মধ্যে মাঠ ছিল। আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলেছি। ও রাইট-ইন এ খেলত। চমত্তার হেড করত। বিপক্ষের গোলের সামনে কর্নার পেলে ও হেড করে অবশ্যই গোল করত। ড্রিবলও করত চমৎকার। ড্রিবল মাস্টার চুনী গোস্বামী একদিন কলেজে ওর খেলা দেখে খুবই সুখ্যাতি করেছিলেন।

স্কুলের পর্ব শেষ করে আমি প্রেসিডেন্সিতে গেলাম আর হরিপদ আশুতোষে। আশুতোষ কলেজের হয়েও ও ফুটবল খেলেছে। ছেলেবেলা থেকেই ভারি সুন্দর স্বভাব ছিল ওঁর। খুব পরোপকারীও ছিল। ওঁদের অবস্থা খুবই সাধারণ ছিল। হরিপদর বাবা দেশভাগের পরে বরিশাল থেকে কলকাতাতে এসে একটি সলিসিটর্স ফার্মে টাইপিস্টের চাকরি করে সংসার পালন করতেন।

অধিকাংশ সলিসিটর্স, চাটার্ড অ্যাকাউন্টস ফার্মের মালিকেরা তখন খুব বড়োলোক হলে কী হয়, কর্মচারীদের খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। জানি না, এখন অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা। কিন্তু চরম দারিদ্র্য হরিপদর মুখের হাসিকে কোনোদিনও ম্লান করতে পারেনি। অসম আর্থিক। অবস্থার মানুষদের মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা খুব মুশকিল। বন্ধুত্বও। তাতে দু-পক্ষের হৃদয়ের প্রশস্ততার প্রয়োজন হয়। যার অবস্থা খারাপ তার তো আরও বেশি। দেখি, হরিপদর এই বিপদে কতটুকু করতে পারি। শুভ্রর মতো মানুষও আজকাল কম দেখা যায়। সেও ভবানীপুরে থাকে। বলেই যেন সব দায় তাঁরই। আসলে দায়িত্ব যে নেয়, সব ঝামেলা তার কাঁধেই এসে পড়ে। কিন্তু সেজন্য শুভ্রর আনন্দই হয় যেন। বন্ধুর জন্যে টাকাপয়সা দিয়ে তেমন করতে না পারলেও গতর দিয়ে যা করছে, সব বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও যা করছে তার কোনো তুলনা এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আজকাল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।

ড্রাইভারকে বলেই রেখেছিলাম তাড়াতাড়ি আসতে। ড্রাইভারই বাজার করে। কী বাজার হবে তা অবশ্য প্রতিমাই বলে দেয়। ও আটটাতে আজ এসে বাজারে গেছে। আমিও তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করে ঠিক পৌনে ন-টাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক ন-টার সময়ে পিজি-র উডবার্ন ওয়ার্ডে পৌঁছে গেলাম। কোনোদিনও আসিনি আগে। মস্ত চওড়া বারান্দা-বড়ো বড়ো কাঠের ইজিচেয়ার বারান্দাতে, যাতে পা তুলে দিয়ে ঘুমোনো যায়। আগেকার দিনের ডাকবাংলো ও বন-বাংলোতে যেমন ছিল, আজকাল দেখা যায় না।

গিয়ে দেখি, হরিপদ বাইরের বারান্দাতে লুঙ্গি পরে ইজিচেয়ারে বসে আছে। হারিত আমার আগেই পৌঁছে গেছে। হরিপদর পাশেই একটি চেয়ারে বসে আছে। আমি যেতেই হারিত বলল, তোর জন্য ঘর থেকে আরেকটা চেয়ার নিয়ে আসি।

আমি বললাম, বসে বসেই তো জীবনটা গেল। হাঁটা-চলাও তো হয় না একটুও। আমি দাঁড়িয়েই থাকি–একটু ক্যালরি বার্ন করি।

হরিপদকে বললাম, কী রে! কী বাধালি।

ও বলল, ক-দিন পরেই তো ছুটি হবে। বাড়ি চলে যাব তার পরে। বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলিতে শ্যামাপদ আর আমি যাওয়ার পরে তুই আর প্রতিমা তো একদিনও আসতে পারলি না। হাসপাতালে এসেছিস এই।

ক্ষমা চাওয়ার গলাতে আমি বললাম, কী করব বল? আমি তো মাসের মধ্যে কুড়িদিন কলকাতার বাইরে থাকি। অনেক ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখতে হয়।

তারপর বললাম, তোর কোনো চিন্তা নেই। আমরা সবাই আছি। তা ছাড়া শুভ্রর স্ত্রী সীতা তোর জন্য দু-বেলাই রান্না করে পাঠাবে। দুপুরে সীতা নিজে নিয়ে আসবে, রাতে শুভ্র।

কী দরকার ছিল কষ্ট করার। হাসপাতালের খাবার তো খারাপ নয়। তা ছাড়া সবাই তো খায়।

সবাই তো হরিপদ নয়। তুই আমাদের কত প্রিয়জন তা কি জানিস?

জানি।

কী করে এমন হল?  

দ্যাখ লখনউ যাওয়ার আগে পরীক্ষা করে গেছিলাম শুধু ক্রিয়োটিনি করিনি। আর দ্যাখ।

তা ওখানে করলি না কেন গিয়েই। তোর জামাই এমন কেওকেটা।

আরে ও যা ব্যস্ত থাকে। ভারতেই তো থাকে না বলতে গেলে। তা ছাড়া স্ত্রী বা স্বামী ছাড়া তেমন। কাছের মানুষ আর কেউই হয় না রে। আমার ঝগড়া করার মানুষটা চলে যাওয়ার পর থেকে বড়ো অসহায় আর একলা হয়ে গেছি।

জামাই না হয় ব্যস্ত। মেয়েও তো ছিল।

মেয়ের সময় কোথায়? জামাইয়ের দেখাশোনা করে, তার স্যুট-টাইয়ের দেখভাল করে, বেয়ারা, বাবুর্চি, ড্রাইভার সকলকে সামলে ওঁরও উদবৃত্ত সময় নেই কোনো। যখনই যাই তখনই লনওয়ালা বাংলোর একটি ঘর ছেড়ে দেয়, চারবেলা দারুণ খাওয়া-দাওয়া, একজন বেয়ারা আমার দেখভাল করে–আর কী করবে? তা ছাড়া কাছেই বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, তাদের ভালো লাইব্রেরি আছে। প্রবাসী বাঙালি মানুষরাও খুবই ভালো। ওখানে দু-বেলা করে যেতাম। অরুণ ব্যানার্জি সেক্রেটারি, এনাক্ষী সিনহা লিটারারি সেক্রেটারি খুবই সাহিত্য-মনস্ক মানুষ। আমার লিটল ম্যাগ সম্বন্ধেও ওরা জানেন। অথচ তেমন বিখ্যাত কাগজ তো নয়।

বলেই, হারিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনার কথা অনিমেষকে বলেছিস?

কী ঘটনা?

আরে ঘটনার মতো ঘটনা। চিফ মিনিস্টার হরিপদর অসুস্থতার কথা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে অন্য ওয়ার্ড থেকে উডবার্ন ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করেছেন। চিকিৎসার সব খরচের ভারও সরকার নিয়ে নিয়েছে।

বললাম বাঃ। এটা তো দারুণ খবর!

হরিত বলল, খরচের মধ্যে নার্স-এর খরচ আর ওষুধপত্র। থাকা এবং ডায়ালিসিসের খরচ লাগবে না। ডা. পান্ডের আন্ডারে আছে। নেফ্রোলজি ডিপার্টমেন্টের হেড এসে দেখে গেছেন। আমাদের গোবিন্দগোপালবাবুর ছেলে দিব্যনারায়ণও আছে।

বললাম, কষ্ট আছে কিছু?

কষ্ট তো থাকবেই। সকালে ডায়ালিসিস হয়েছিল। বেশ কষ্ট। তবে পয়সা লাগলে কষ্টটা আরও বেশি লাগত। মনের উপর থেকে মেঘ সরে যাওয়ায় কষ্ট অনেকই কমে গেছে। টাকা লাগলে, অনির্দিষ্টকাল ডায়ালিসিসে কী সাংঘাতিক খরচ হত বল? আর আমার নিজের তো সামর্থ্য নেই। সব তো তোদের ঘাড়েই পড়ত।

হরিপদকে দেখে কে বলবে যে ওঁর এত যন্ত্রণা। বরং মনে হচ্ছে পোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের স্কুলের কেষ্টধন কর্নার কিক করবে এক্ষুনি। খুব ভালো কিক করত, আর হরিপদ মিটিমিটি হাসছে, বল উড়ে এলেই লাফিয়ে উঠে হেড করে বলটাকে বিপক্ষের গোলে ঢুকিয়ে দেবে। ওকে ঠেকায়, এমন সাধ্য কারোরই নেই।

আরও কিছুক্ষণ থেকে, ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, আজ চলি রে হরিপদ।

ও হেসে বলল, আয়।

হরিতও বলল, আমিও চলি। কালকে বড়োবাবু খুব ঝেড়েছে। তবে বিকেলে অনেকে আসবে। শনিবার যে আজ। আর সীতা আসবে তোর খাবার নিয়ে। আর রাতে শুভ্র নিজে আসবে। আমি অফিস ফেরতাই আসব।

উঠে আসার সময়ে হরিপদ আমার হাতে হাত রেখে বলেছিল, ডা. পান্ডেকে জিজ্ঞেস করিস তো কবে বাড়ি যেতে পারব। আমার পত্রিকা দিগন্তর পূজোসংখ্যা আমি ভালো হয়ে বাড়ি না যেতে পারলে কে বের করবে বল?

বলেছিলাম, বলব।

নীচে নামতে নামতে, হারিতকে জিজ্ঞেস করলাম, হরিপদর মেয়ে কলকাতায় আসবে না?

কারোকে বলিস না। গলা নামিয়ে বলল হারিত। শ্যামাপদ লখনউতে ফোন করেছিল। হরিপদর মেয়ে সোমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছে ওঁর স্বামী এক পয়সাও দিতে পারবে না। নতুন মাল্টিপ্লেক্সে বারো তলার উপরে চারহাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট বুক করেছে। তার দাম প্রায় কোটি টাকা। সেই টাকা জোগাড় করতে রাতের ঘুম চলে গেছে জামাইয়ের। তবে সোমা বলেছে, কাকা, তোমরা কেউ আগে জানিয়ে এখানে আসতে পারলে আমি আমার গয়না বিক্রি করে যা পারি তার হাতে তুলে দেব। বাবাকে বোলো আমার অসহায়তার কথা। আমি তো স্বাবলম্বী নই। আমার রূপ দেখেই তো বিয়ে হয়েছিল। রুপো তো বাবা দিতে পারেনি বিয়ের সময়। কাকা, পড়াশোনাতে দারুণ ভালো হলেই সবাই শিক্ষিত হয় না।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, বলিস কী রে হারিত। এমনও হয়?

–এমনই তো হয় আজকাল।

৩.

টাকা পয়সা যে দিতে হবে না সেজন্যে খুব হালকা লাগছে। আগামীকাল রবিবার। বহুদিন পর কালকে তাস খেলতে যাব দুপুরে। হরিপদর খবর শুভ্র অথবা হারিতকে ফোন করে জেনে নেব। ইচ্ছা আছে সোমবার অফিস ফেরত যাব পিজি-তে।

সোমেনের বাড়ি গিয়ে সকলের খপ্পরে পড়ে অনেকগুলো হাত খেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়। তিনটে। রবিবার অফিসের ড্রাইভার থাকে না। ট্রাক্সি নিয়ে সোমেনের বাড়ি গেছিলাম।

লিফটে উঠে ফ্ল্যাটে পৌঁছোলাম প্রতিমার প্রচণ্ড রাগারাগির জন্যে প্রস্তুত হয়ে। কিন্তু বেল টিপতেই ছোটু দরজা খুলল। খুলেই বলল, মেমসাহাবসে মিলিয়ে সাব। গালাগালি খাওয়ার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছি, তা আবার ঘরে ডেকে গালাগালি কেন?

মেমসাহাব খানা খায়ী?  

নহি।

ভয়ে ভয়ে প্রতিমার ছবি আঁকার স্টাডির দরজা খুললাম। ঝিরঝির শব্দ করে এয়ার কন্ডিশনারটা চলছে। প্রতিমা ইজেলের সামনে তুলে হাতে বসে আছে।

বললাম, কী ব্যাপার? খাবে না?

প্রতিমা আমার উপরে একটুও রাগ করছে না দেখে অবাক হলাম।

আর কিছু বলার আগেই প্রতিমা বলল, হারিতবাবু ফোন করেছিলেন, শুভ্রবাবু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন আড়াইটার সময়ে। তোমাকে মোবাইলে ফোন করেছিলাম। মোবাইল বন্ধ ছিল।

বল কী? আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

খেয়ে গেলে পারতে না?  

না। খাওয়ার ইচ্ছে নেই।

আমি লিফটে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে শুভ্রর বাড়ি পৌঁছে দেখি অনেকেই পৌঁছে গেছে।

সীতা বলল, সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ বলছিল। তাও হরিপদবাবুকে দেখতে গেল। ফিরে আসার পরে বুকের মধ্যিখানে ব্যথা হতে লাগল। ও কখনও ডাক্তারের কথা বলে না, আজ নিজেই বলল শিগগিরি ডাক্তার ডাকো।

আমাদের পাড়ার ডাক্তারবাবুকে ফোন করলাম। তাঁর স্ত্রী বললেন, রবিবার তো উনি রোগী দেখেন না। চেম্বারও করেন না। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আমার স্বামীর বুকে খুব ব্যথা হচ্ছে।

উনি বাড়ি নেই। মোবাইল বন্ধ।

অন্য কোনো ডাক্তারের কথা বলতে পারেন?

আজ রবিবার। সব ডাক্তাররাই ছুটি কাটান আজকে।

তারপর শুভ্রর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরের দিকে চেয়ে সীতা বলল, একজনও জেনারেল প্রাকটিশনারকে পাওয়া গেল না।

হারিত বলল, জি পি-রা আজকাল উধাও। আজকাল সব স্পেশালিস্ট পাবে। নানা রোগের স্পেশালিস্ট। প্রয়োজনে জেনারেল প্র্যাকটিশনার একেবারেই পাবে না।

অনন্তও এসে পৌঁছেছে। ও ইনকাম ট্যাক্সের অ্যাডিশনাল কমিশনার। বলল, ওই ব্যাপারে একটা গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। ডাক্তারেরা যে মাছের ব্যবসায়ী নয়, স্মাগলার নন, নার্সিং হোমের আর ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরির অর্থগৃধু জন্তু জানোয়ার নন, তাঁদের যে এক মহৎব্রত। থাকার কথা ছিল, তাঁদের যে মনুষ্যত্ব থাকার কথা ছিল, একথা তাঁরা ভুলে গিয়ে থাকলে তাঁদের ঘাড় ধরে বোঝাতে হবে। যাঁরা আত্মবিস্তৃত তাদের ধোলাই দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে হবে।

সীতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কলকাতা শহরে বাস করেও চারঘন্টা সময় পেয়েও কিছু করতে পারলাম না। কোনো ডাক্তার না পেয়ে রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালে নিয়ে গেলাম দেড়টার সময়ে। ওঁরা বললেন দু-ঘন্টা আগে আনলে বাঁচাতে পারতাম।

অনন্ত বলল, কলকাতা শহরে আমরা স্রেফ ঈশ্বরের দয়াতে বেঁচে আছি। কী গরিব, কী বড়োলোক, সকলেরই সমান অবস্থা। সরকারের এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত। কেন রবিবারে, কী রাতে, কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না?

হারিত বলল, এর চেয়ে মফসসল শহরের ডাক্তারেরা অনেক ভালো। তাঁদের বিবেক এখনও মরেনি। টাকার লোভ এখনও তাদের সকলকে অমানুষ করেনি।

ডাক্তারেরা যে আমাদের শ্রদ্ধার মানুষ, আমাদের প্রণম্য মানুষ একথা কি ওঁরা বোঝেন না। কলকাতা শহরে বাস করেও কি আমাদের প্রত্যেককে ঈশ্বরের দয়াতেই বেঁচে থাকতে হবে?

সীতার অসহায় বিলাপ মনকে এই সময়ের উপরে বড়োই বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করে তুলল। সায়েন্স নিয়ে পড়লে আমিও হয়তো ডাক্তার হতাম। হলে কি আমিও আজকালকার অধিকাংশ। ডাক্তারদের মতোই বিবেকরহিত হতাম? আর যদি তাই-ই হতাম, তাহলে ডাক্তার আদৌ হতামই-বা কেন?

যে সময়টা পেরিয়ে এসেছি, আমাদের ছেলেবেলার সময়, তা সত্যি অনেকই ভালো ছিল। মানুষের মনুষ্যত্ব ছিল, মূল্যবোধ এমনভাবে নষ্ট, ভ্রষ্ট হয়ে যায়নি আজকের মতো।

খবর পেয়ে একে একে আরও অনেকে আসছেন। আমি ঘর ছেড়ে বারান্দায় এলাম। যে, সকলের বিপদে সবচেয়ে আগে দৌড়ে এসেছে চিরদিন তাকেই একটু পরে সাদা ফুলের তোড়া আর মালা দেওয়া কাচের গাড়ি করে নিয়ে যাব আমরা কেওড়াতলায়। আজকে হরিপদকেও কেউই হয়তো দেখতে যেতে পারবে না। কী করা যাবে? হরিপদ নয়, শুভ্রই আজকে প্রায়োরিটি নাম্বার ওয়ান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *