‘দুঃখ তব যন্ত্রণায়’
আমাদের কৈশোরে রমা রলাঁ ছিলেন অতিশয় জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। বস্তুত এমনও একটা সময় গিয়েছে, যখন বাঙলা দেশে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় উপন্যাস বলতে রল্যার জ্যা ক্রিতই বোঝাত।
সে যুগে ঔপন্যাসিক ছাড়া অন্য কোনও রূপে র আত্মপ্রকাশ করেছেন কি না, সে সম্বন্ধে আমরা কোনও কৌতূহল প্রকাশ করিনি।
অথচ ইয়োরোপের ভাবুকজন মাত্রই রলাঁকে চেনেন আরও অন্য একটি রূপে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার বহু আগের থেকেই রলা ইয়োরোপে ক্রমবর্ধমান উকট জাতীয়তাবাদ (শভিনিজম) যে ভিন্ন ভিন্ন দেশকে অবশ্যম্ভাবী প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে সচেতন হয়ে যান এবং দেশবাসী ফরাসি তথা জরমনদের (রলা ছিলেন জরমন সঙ্গীতের আবাল্য একনিষ্ঠ ভক্ত) এ বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সাবধানবাণী শোনান। বলা বাহুল্য, এহেন পরিস্থিতিতেও সর্বত্র, সর্বকালে যা হয়ে থাকে, তাই হল। উভয় দেশই তাঁকে আপন আপন শত্রু বলে ধরে নিল।
বিশ্বযুদ্ধ লাগার সময় রলাঁ ছিলেন সুইজারল্যান্ডে। তিনি রেডক্রসে যোগ দিলেন এবং দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, প্রায় সমস্ত যুদ্ধকালটা ফ্রান্সের উদগ্র শভিনিজমের বিরুদ্ধে দৈনিকে মাসিকে প্রচার-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধশেষের সময় ভগ্নোৎসাহ ক্লান্ত রলা খুঁজলেন শান্তির সন্ধান। ডুব দিলেন তাঁর স্বদেশের শত্রু জরমন জাতের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতসৃষ্টিকার বেটোফেনের সঙ্গীতের আরও গভীরে। বেটোফেন জরমন হয়েও জরমনদের বহু উর্ধ্বে– তাঁর সঙ্গীত মানুষকে তুলে নিয়ে যায় নভঃলোকে, যেখানে ক্ষুদ্র-নীচ শভিনিজম পৌঁছতে পারে না। একদা তিনি তারই মতো মহামানব কবি গ্যোটেকে বলেছিলেন, আপনি-আমি দেবদূত : আমাদের কাজ– মাটির মানুষকে স্বর্গলোকের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া।(১)
রলাঁ যে বেটোফেনের আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটাকে মডার্ন উন্নাসিক ইসকেপিজম, পলায়নী মনোবৃত্তি নাম দিয়ে সস্তায় কিস্তিমাত করবেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, রল অবগাহন করতে নেমেছিলেন সুরগঙ্গায় ক্লান্ত দেহমন স্নিগ্ধ করে নিয়ে পুনরায় তার কর্তব্য-কর্মে মনোনিবেশ করার জন্য। তিনি গঙ্গা নদীর মীন হয়ে ইসকেপিজমের নদীগর্ভে বিলীন হতে চাননি।
***
আঁদ্রে জিদ-এর কপালে ছিল নিদারুণতর দুর্দৈব। তিনিও জাতি-ধর্ম-দেশের ঊর্ধ্বে বিরাজ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রলাঁ যেরকম আশু দুর্যোগের পূর্বাভাস সুস্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন তিনিও তেমনি পেয়েছিলেন দ্বিতীয়ের পূর্বাভাস। যুদ্ধ লাগার পর তাঁকে যখন বেতারে প্রোপাগান্ডা করতে বলা হল, তিনি অসম্মতি জানালেন। দেশকে ভালোবাসতেন রলাঁ, জিদ উভয়েই, কিন্তু যে স্থূল পদ্ধতিতে অশ্রাব্য কটু ভাষণে যুদ্ধের সময় এক জাতি অন্য জাতিকে গালাগাল দেয়, স্পর্শকাতর বিশ্ব-নাগরিক এবং সর্বোপরি বিদগ্ধ কলাকার জিদ তার সঙ্গে সুর মেলাবেন কী করে! জিদ তার জ্বরনালে (রোজনামচাতে) লিখছেন, ন! দেসিদেম, জ্য ন্য পারলরে পা আ লা রাদিয়োনা, আমার স্থির সিদ্ধান্ত, আমি বেতারে বক্তৃতা দেব না।…খবরের কাগজগুলো এমনিতেই যথেষ্ট দেশপ্রেমের ঘেউ-ঘেউয়ে ভর্তি। নিজেকে যতই ফরাসি বলে অনুভব করি ততই আমার ঘেন্না করে। এর পর জিদ বড় সুন্দর করে বলেছেন; তিনি নিজেকে যেভাবে ফরাসি মনে করে গর্ব অনুভব করেন, এই স্কুল পদ্ধতির সঙ্গে তো তার কোনও মিল নেই।
জিদের স্মরণে এল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার সময়কার কথা। তখন কিছু লোক এমনই হাস্যকর প্রচারকার্য আরম্ভ করে যে, তখনকার দিনের অন্যতম খ্যাতনামা লেখক সিআঁ জাক্ বলেন, চুপ করে থাকাটা কি তবে এমনই কঠিন? সে ক্ সি দিফিসিল দ্য স্য ত্যার?
তার পর জিদ বলছেন, কিন্তু হৃদয় যখন ফেটে পড়তে চায়, তখন নীরব থাকাটা যে বড়ই বেদনাময়। এটা স্বীকার করে তিনি শেষ করেছেন এই বলে, কিন্তু আমি তো চাইনে আজ এমন কিছু লিখতে, যার জন্য কাল আমাকে মাথা হেঁট করতে হয়!
এই সময় জিদ পড়ছেন জরমন কবি ও ঔপন্যাসিক আইসেনডরফের বই নিষ্কর্মা!
অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে যেতে লাগল জিদের চোখের সম্মুখে। অবিশ্বাস্য মনে হল বিশ্বজনের কাছে যে, নেপোলিয়নের দেশ ফ্রান্স মাত্র পাঁচ-ছয় সপ্তাহের একতরফা যুদ্ধের পর– বস্তুত ফ্রান্স একবার মাত্রও পুরো জোর হামলা করতে পারেনি!–বিজয়ী জরমনির পদতলে লুষ্ঠিত হল।
জিদ বলছেন, শত্রু যখন প্রচণ্ড শক্তিশালী, তখন তার কাছে পরাজিত হওয়াতে নিশ্চয়ই কোনও লজ্জা নেই; এবং আমিও কোনও লজ্জা অনুভব করিনে। কিন্তু যখন ভাবি আমরা কী সব স্তোকবাক্যের ওপর নির্ভর করে কর্তব্যকর্ম অবহেলা করে পরাজয় ডেকে এনেছি তখন যে গভীর বেদনা অনুভব করি সেটা ভাষাতে প্রকাশ করতে পারিনে, অস্পষ্ট মূর্খ আদর্শবাদ, প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে মোহাচ্ছন্ন অপরিচয়, অপরিণামদর্শিতা, মূর্খের মতো অর্থহীন এমন সব বাগাড়ম্বরে অন্ধবিশ্বাস– যার মূল্য আছে শুধু অপোগরে কল্পরাজ্যে।
নিরঙ্কুশ পরাজয়ের পরের দিন জিদ লিখেছেন :
একমাত্র গ্যোটের সঙ্গে কথোপকথনই আমাকে দুশ্চিন্তার এই মৃত্যু-যন্ত্রণা থেকে কিঞ্চিৎ মুক্তি এনে দেয়
Seules les Conversations avec Goethe parviennent a distraire un peu ma pensee de Pangoisse.
পাঠক লক্ষ করবেন, গ্যোটের সঙ্গে কথোপকথন Conversation with Goethe (মূল জরমনে Gaspraeche mit Goethe in den letzten Jahren seines Lebens)
গ্যোটে সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক অত্যুত্তম জীবিত জীবনী লিখেছেন গ্যোটের সখা এবং শিষ্য একেরমান (অনেকটা শ্রীম)। কথোপকথন হয়েছে গ্যোটে এবং একেরমানে। অথচ জিদ ইচ্ছে করে এমনভাবে বাক্যটি রচনা করেছেন যে মনে হয় তিনি, জিদ-ই, যেমন স্বয়ং কথাবার্তা বলছেন জরমন মহাকবি ঋষি গ্যোটের সঙ্গে, ইঙ্গিত করছেন, তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন ঋষির বাণী, তার কণ্ঠস্বর। দুশ্চিন্তার বিভীষিকায় যেটুকু সান্ত্বনা তিনি আদৌ পাচ্ছেন সেটি তারই কাছে থেকে।
জিদ ঋষি নন– গ্যোটের মতো। কিন্তু তিনি তখন ফ্রান্সের গ্রা ম্যাক্স–এ্যাড় মাস্টার অর্থাৎ ফ্রান্সের পথভ্রষ্টা সাহিত্যসম্রাট। সেই ফরাসি সম্রাট সঞ্জীবনী সান্ত্বনা নিচ্ছেন যে জরমনি নির্মমভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে গরবিনী ফ্রান্সকে, তারই ঋষি কবির কাছ থেকে!
***
মিশরের আড্ডা সম্বন্ধে পক্ষাধিককাল পূর্বে যখন লিখি তখন কল্পনাও করতে পারিনি, এই মিশরই দু-পাঁচ দিনের ভিতর লেগে যাবে জীবনমরণ সংগ্রামে। সেই আড্ডাতে যিনি ছিলেন আমাদের কবিম্রাট তাঁর কবিতা পড়লে মনে হত তিনি যেন ইসলাম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী যুগের বেদুইন ভাট। কথায় কথায় বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন, ছুটছে ঘোড়া উড়ছে বালি আর জাত ইহুদি ইব্রাহিমের পুত্র মিশররাজ ইউসুফ ও জোলেখার সাহারার উষ্ণশ্বাস-ভরা নীলনদের দু-কূলভাঙা প্রেম।(২) আলট্রা মডারন কাইরো শহরের শিক পশ কাফের বাতাবরণে আমাদের কবিরাজ আহমদ ইবন শহরস্তানি অল-মুকদদসি যখন তার সেই ফারাও যুগের প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত, তখন আমার মনে হত এ রস রোমানটিক, ক্লাসিক, এপিক, বৈদিক, প্রাগৈতিহাসিক সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়ে সোজা বেআনডারটালে পৌঁছে গেছে। কবিও তাই চাইতেন।
আমাদের মুকদৃদসি কিন্তু আর্ট কী, অলঙ্কার কাকে বলে, আর অনুভূতি-প্রধান না তাতে অন্য কোনও মনোবৃত্তি চিত্তবৃত্তি প্রবেশ করতে পারে কি না সে নিয়ে কোনও আলোচনা করতে চাইত না, পারতও না। এ কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। মা-ঠাকুরমার রূপকথা শুনে আমরা, হ্যাঁ, বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত বিমোহিত হয়ে ভাবি, রূপকথা কল্পনা করার, তাকে অনাড়ম্বর ভাষায় প্রকাশ করার রহস্যটা কোনখানে। প্রশ্ন শুধিয়ে দেখি ঠাকুরমা-ও জানেন না। মুকদদসির বেলাও হুবহু তাই।
শুধু একটি কথা মাঝে মাঝে মাথা দোলাতে দোলাতে বলত, কবি হওয়ার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে হে, কবি হওয়ার একটা বিশেষ মূল্য আছে। সে মূল্য কিন্তু অর্থ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি কোনওকিছুর মাপকাঠি দিয়েই বিচার করা যায় না। কোন এক ইরানি কবি নাকি পেয়েছিলেন লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, দাতে পেয়েছিলেন বেয়ারিচের কাছ থেকে একটি ফুল, কিংবা কী জানি, কার ঠোঁটের কোণে স্বীকৃতির একটুখানি স্মিতহাস্য, কী জানি।
কবি মুকদদসি বড় স্পর্শকাতর। সে আরব। ইহুদিদের কাছে তারা নির্দয়ভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছে। তাকে চিঠি লিখেছি, সখা তুমি ইহুদিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হাইনরিষ হাইনে পড়।
***
যে একেরমান গ্যোটের সঙ্গে কথোপকথনের বিবৃতি দিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হন তিনি ছাত্রাবস্থায় গ্যোটিঙেন শহরে হাইনের বন্ধুত্ব লাভ করেন। এক জহুরিকে চিনতে অন্য জহুরির বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়।
ছাত্রাবস্থাতেই হাইনের সরল মধুর কবিতা জরমানির সর্বত্র খ্যাতিলাভ করে। অতিশয় সাধারণ জন-দফতরের কেরানি, ম্যাটরিকের মেয়ে, ছাপাখানার ছোকরা তাকে যেন দুবাহু মেলে আলিঙ্গন করে নেয়। আর ওদিকে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত আলঙ্কারিক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ফন শ্লেগেল তো তাকে প্রথমদিনই বিজয়মুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন।
ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন একেরমান; ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪। তার পর সেটি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে।
গ্যোটিঙেন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের পথ– লানটুভের বিয়েরগারটেন। খোলামেলাতে বিয়ারের আড়া। রোববার দিন গ্যোটিঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সেখানে এসে জালা জালা বিয়ার খায়, হইহুল্লোড় করে, আর নৃত্যগীত তো লেগেই আছে।
একেরমান, হাইনে এবং কলেজের আরও কয়েকজন ইয়ার-বসি গেছেন সেখানে ফুর্তি করতে।
হাইনে আগের থেকেই মৌজে বোধহয় হামবুর্গের ব্যাঙ্কার কাকার কাছ থেকে বেশ কিছু পেয়েছেন।(৩) তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তার আনন্দোল্লাসের লাগাম– বাক্যস্রোত ছুটেছে তুরুক সোওয়ারের মতো। বিয়ার তাদের টেবিলে নিয়ে এসেছে পাব-এর খাবসুরুত কোমলাঙ্গি তরুণী লটে (Lotte), হাইনে ফুর্তির চোটে জড়িয়ে ধরেছেন সুন্দরী লটেকে। কিন্তু একেরমান ও অন্যান্য ইয়াররা পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে জানতেন, এই লটেটি বিয়ার-খানার আর পাঁচটা বার্গারুলের মতো ঢলাঢলির পাত্রী নয়। রাগে তার বাঁশির মতো নাকের ডগাটি হয়ে গেছে টুকটুকে রাঙা, চোখ দিয়ে বেরুচ্ছে আগুনের হলকা, আর সে এমনই ধস্তাধস্তি আর পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়তে আরম্ভ করেছে যে, ইয়ারগোষ্ঠী কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছেন। হাইনে ওটা মশকরা হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন গোড়ার দিকে, কিন্তু একটু পরেই কী যেন ভেবে অপ্রতিভ হয়ে চুপ মেরে গেলেন– যেন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।(৪)
পরের সপ্তাহে একেরমানরা যখন হাইনেকে তুলে নিতে এলেন, তখন তিনি তাদের সঙ্গে যেতে কবুল নারাজ। শেষটায় একরকম গায়ের জোরে জাবড়ে ধরে তাকে গাড়িতে তুলতে হল।
কাফেতে আসন নিয়ে হাইনে মাথা হেঁট করে রইলেন চুপ। ঘাড় তুলে মেয়েটির দিকে তাকাবার মতো সাহস পর্যন্ত তার নেই।
কিন্তু কী আশ্চর্য! লটে স্বয়ং এসে উপস্থিত হাইনেদের টেবিলে। মধুর হাসি হেসে হাইনের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালেন। এয়ার-দোস্তরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
লটে হাইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ওপর রাগ করবেন না, স্যার। আপনি অন্য ছাত্রদের মতো নন। আমি আপনার কবিতা পড়েছি। কী সুন্দর! কী সুন্দর!! আপনার যদি ইচ্ছে যায়, তবে এইসব ভদ্রলোকের সামনাসামনি আমাকে আলিঙ্গন করতে পারেন কিন্তু এইসব মধুর কবিতা আপনাকে রচনা করে যেতেই হবে।
বলেই লটে তার গাল বাড়িয়ে দিলেন হাইনের দিকে। আর হাইনে? কে জানত হাইনের মতো সপ্রতিভ লোকও লজ্জায় লাল হয়ে যেতে পারেন– লজ্জায় লাল হয়ে তিনি চুমো খেলেন।
একেরমান বলেছেন লক্ষ করলুম (নটবর) বন্ধু স্পিটা হিংসেয় একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে।
***
হাইনের চোখ দুটি ভিজে গিয়েছে। মৃদু কণ্ঠে বললেন, এ জীবনে এর চেয়ে সুখী আমি আর কখনও হইনি। এই আমি প্রথম হৃদয়ঙ্গম করলুম, কবি হওয়ার মূল্য আছে, কবি হওয়া সার্থক।
***
সখা মুকদদসি, কবি হওয়া সার্থক।
———–
১. দুঃখের বিষয়, মূল পাঠটি আমার কাছে নেই। উভয় মহাপুরুষের পরিচয় হয় কারলস বাড-এ (চেক নাম Karlovy Vary)। ছোট গলির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে উভয়ের দেখা হয় জনা দু-তিন রাজপুত্রের সঙ্গে। গ্যোটে সসম্মানে তাদের পথ ছেড়ে দেন। বেটোফেন পাগলা ষাড়ের মতো সোজা চলতে থাকলে রাজপুত্রেরা সবিনয় তার জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যান। গলির শেষে পৌঁছে বেটোফেন প্রতীক্ষা করেন গ্যোটের জন্য। তিনি পৌঁছলে পর রাজপুত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, এরা কারা? আপনি-আমি দেবদূত ইত্যাদি। সমস্ত ঘটনাটিই হয়তো কিংবদন্তিমূলক। এর একাধিক পাঠ (ভারসন) আমি কারলস বাডে বাসকালীন শুনেছি। তবে রাও তার বেটোফেন-গ্যোটে সম্বন্ধে পুস্তকে ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন।
২. আমরা যে গ্রন্থকে ওলড টেস্টামেন্ট বলি সেইটেই ইহুদিদের তৌরা ইত্যাদি। সেসব গ্রন্থে বর্ণিত অনেক পয়গম্বর কুরানেও বর্ণিত হয়েছেন। ইউসুফ তাদেরই একজন। নজরুল ইসলাম হাফিজের অনুবাদ করেছেন : দুঃখ কর না, হারানো ইউসুফ কিনানে আবার আসিবে ফিরে।
৩. টাকাকড়ি বাবদে হাইনে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন অত্যন্ত বেহিসেবি। তিনি স্বয়ং এক জায়গায় লিখেছেন, কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যখনই ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
৪. কনটিনেনটের ছাত্র-পাবে এ ঘটনা নিত্য নিত্য ঘটে। কেউ বড় একটা সিরিয়াসলি নেয় না। চেঁচামেচিটা অনেক ক্ষেত্রেই ন্যাকরা বলে ধরা হয়।