দীন কুটির
আমার তখন তেরো বছর বয়েস, ক্লাস নাইনে পড়ি। সেবার শীতকালে পুরো আড়াই মাস আমরা ছিলাম মধুপুরে। আমার বাবার খুব অসুখ ছিল, সবাই বলেছিল, মধুপুরের জল-হাওয়ায় শরীর ভালো হয়ে যায়।
আমরা একটা মস্ত বড়ো বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। মধুপুরে তখন অনেক বাড়িই সারা-বছর খালি পড়ে থাকত, খুব কম টাকায় অনেক বড়ো বড়ো বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত।
আমাদের সেই বাড়িটার নাম ছিল ‘দীন কুটির’। দোতলা বাড়িটাতে অন্তত দশখানি ঘর, সামনে আর পেছনে বিরাট বাগান, তাতে অন্তত একশোটা আম আর পেয়ারা আর আতা গাছ। আমরা গাছে উঠে পেয়ারা পাড়তাম, পেয়ারাগুলির ভেতরটা টুকটুকে গোলাপি রঙের। এমন একটা চমৎকার বিশাল বাড়ির নাম ‘দীন কুটির’ ছিল বলে আমরা খুব মজা পেতাম।
ঘুম ভেঙে যেত খুব ভোরবেলা। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বড়ো কাচের জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ত চোখে, আর কতরকম পাখির ডাক! কলকাতায় তো এত রকম পাখির ডাক শোনা যায় না।
ঘুম থেকে উঠেই আমি একটা চাদর মুড়ি দিয়ে ছুটে চলে আসতাম বাগানে। যদিও খুব শীত, তবু ঘাসের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে খুব আরাম লাগত। এক জায়গায় ছিল দশ-বারোটা গোলাপ ফুলের গাছ। সদ্য ফোটা গোলাপ ফুলের ওপর টলটল করে শিশির। ফুল না ছিঁড়ে, আমি মুখটা নীচু করে এনে একটা চোখ চেপে ধরতাম সেই গোলাপ ফুলের ওপর। কী দারুণ সুন্দর যে সেই স্পর্শ! তা ছাড়া সেই ভোরের শিশির লাগালে চোখ ভালো হয়।
একদিন ভোরবেলা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আমি একটা সাংঘাতিক দৃশ্য দেখতে পেলাম।
আমাদের বাড়িটার পেছন দিকের বাগানের পাঁচিল এক জায়গায় খানিকটা ভাঙা। পাঁচিলের ওপাশেই ধু-ধু করা মাঠ, দিগন্তের কাছে কয়েকটা ছোটো ছোটো পাহাড়। মাঠের মধ্যিখানে একটা সরু নদীও আছে।
আমি দেখলাম, আমাদের বাগানের মধ্যে, ভাঙা পাঁচিলের কাছেই একটা লোক পড়ে রয়েছে। লোকটার সারাগায়ে রক্ত মাখা। একটা খালি ফুল প্যান্ট আর শার্ট পরা, সেগুলিতেও চাপ চাপ রক্ত। মাটিতে শুয়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে। চোখ দুটো বোজা।
দেখেই আমার বুক কাঁপতে লাগল। বইতে অনেক মারামারির গল্প পড়েছি। কিন্তু চোখের সামনে এরকম একটা মরা লোক আমি দেখিনি কখনো। ভয়ে আমি চিৎকারও করতে পারলাম না, সোজা ছুট দিলাম বাড়ির দিকে।
তখন মা শুধু ঘুম থেকে উঠেছিলেন। মা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পাখিদের ছোলা খাওয়ান। আমাদের বাড়ির সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোলা ছিটিয়ে দিলেই কোথা থেকে একঝাঁক পায়রা উড়ে এসে বসে।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মা, মা, একটা লোক মরে পড়ে আছে… আমাদের বাগানে…’
মা আঁতকে উঠে বললেন, ‘সে কিরে? বলিস কী! কী সর্বনাশ!’
তক্ষুনি আমার ছোটোকাকাকে ডেকে তোলা হল। আমাদের চ্যাঁচামেচি শুনে মালিও ছুটে এল তার ঘর থেকে। মালি আর ছোটোকাকাকে আমি সেই জায়গাটায় নিয়ে এলাম।
কিন্তু সেখানে সেই মৃতদেহটি নেই।
ছোটোকাকা বললেন, ‘কোথায় গেল? কিছু নেই তো! তুই চোখে ভুল দেখিসনি তো?’
আমি বললাম, ‘না, ঠিক এই জায়গায় চিৎপাত হয়ে পড়ে ছিল। এই দেখো না, মাটিতে রক্ত লেগে আছে।’
সত্যিই মাটিতে খানিকটা রক্ত। তাহলে লোকটা গেল কোথায়? লোকটা তা হলে মরেনি?
একটু খোঁজাখুঁজি করতেই দেখা গেল, একটা আতা গাছের নীচে বনতুলসীর ঝোপের মধ্যে উবু হয়ে বসে আছে একটা লোক। সেই খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরা।
ছোটোকাকা বললেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো চোর কিংবা ডাকাত। সাবধান, কাছে যাসনি!’
ছোটোকাকা একটা বড়ো পাথর তুলে নিয়ে ঝোপের কাছে গিয়ে বললেন, ‘এই, বেরিয়ে আয় শিগগির। নইলে মাথা ফাটিয়ে দেব।’
ছোটোকাকা ব্যায়াম করেন, খুব গায়ের জোর। লোকটা কোনো সাড়াশব্দ করল না দেখে ছোটোকাকা পাথরটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘এই মাথা ফাটিয়ে দিলাম কিন্তু, এখনও বেরিয়ে আয়।’
তখন লোকটা বলল, ‘মারবেন না, আমি চোর নই। আমি বেরুচ্ছি।’
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল লোকটি।
ছোটোকাকা বললেন, ‘আরে, এ তো দেখছি ভদ্দরলোক। তুমি… মানে… আপনি ওখানে কী করছিলেন?’
লোকটির রং খুব ফর্সা, মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। মাথার বাঁদিকে চুলে চাপ বেঁধে আছে রক্ত।
…আমাদের বাগানের মধ্যে,ভাঙা পাঁচিলের কাছেই একটা লোক পড়ে রয়েছে…
লোকটি উঠে দাঁড়াল না, বসে-বসেই খানিকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমি কাল রাত্তিরে মাঠের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম…তারপর কয়েকটা কুকুর আমাকে তাড়া করে… খুব জোর কামড়ে দিয়েছে… এই বাগানে আশ্রয় নিতে এসে… পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম…’
ছোটোকাকা বললেন, ‘কুকুর? মাঠের মধ্যে কুকুর? খুব জোরে কামড়ে দিয়েছে? শেয়াল নয় তো? মালি, এখানে শেয়াল নেই?’
মালি বলল, ‘হাঁ বহুত আছে।’
লোকটি বলল, ‘আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি একটু বাদেই চলে যাব। একটু জিরিয়ে নিচ্ছি।’
ছোটোকাকা বললেন, ‘কেন, চলে যাবেন কেন? এই অবস্থায় যাবেন কী করে? চলুন, বাড়ির মধ্যে চলুন, ওষুধ লাগিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছি।’
লোকটি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও পারল না, ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি ছোটোকাকা ধরে ফেললেন। তারপর মালি আর ছোঢো কাকা দুজন মিলে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে এনে লোকটিকে শুইয়ে দিলেন আমাদের বাইরের ঘরে।
মা চোখের ইশারায় আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে রে? আমাদের বাগানে কী করে এল?’
আমি বললাম, ‘তা জানি না! শেয়ালে কামড়েছে।’
মা বললেন, ‘কী সাংঘাতিক কথা। কাদের ছেলে? রাত্তিরে মাঠে ঘুরছিল কেন?’
ছোটে কাকা লোকটিকে বললেন, ‘দেখি আপনার পায়ের কোন জায়গায় শেয়ালে কামড়েছে। প্যাণ্টটা গোটান।’
লোকটি বলল, ‘হাত দেবেন না, হাত দেবেন না! ভীষণ ব্যথা, এখন থাক।’
কিন্তু ছোটোকাকা সেকথা শুনলেন না। জোর করে রক্তমাখা প্যান্টটা গুটিয়ে ফেললেন। লোকটির পায়ে শেয়াল বা কুকুর কামড়াবার কোনো দাগ দেখা গেল না কিন্তু বাঁ-পায়ের গোড়ালিতে দুটো বড়ো বড়ো কাচের টুকরো গেঁথে আছে। একটা টুকরো তো একেবারে ঢুকে গেছে ভেতরে। এখন রক্ত বেরুচ্ছে সেখান থেকে।
দরজার কাছ থেকে মা বললেন, ‘ঈস!’
ছোটোকাকা বললেন, ‘এ কাচ না বার করলে সেপটিক হয়ে যাবে। এক্ষুনি ডাক্তার দরকার।’
লোকটি বলল, ‘না না, ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। আমি নিজেই ঠিক করে নেব।’
ছোটোকাকা বললেন, ‘তা কখনো হয়! এই নীলু, মাধবী কুঞ্জ বাড়িতে একজন ডাক্তারবাবু থাকেন, তাঁকে নিয়ে আয়।’
আমি তক্ষুনি ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনার জন্য যাচ্ছিলাম, লোকটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, ‘না, ডাক্তার দরকার নেই। একটু গরম জল পেলেই হবে।’
সেকথায় আমি থেমে গেলাম।
মা বললেন, ‘গরম জল দিচ্ছি। কিন্তু তুমি মাঠের মধ্যে ঘুরছিলে কেন রাত্তিরে? তুমি কোথায় থাকো?’
লোকটি বলল, ‘আমি…ইয়ে… জসিডিতে থাকি।’
মা বললেন, ‘জসিডি? সে তো অনেক দূর। সেখান থেকে মধুপুরে এলে কী করে? হেঁটে আসছিলে?’
লোকটি বলল, ‘না, আমি এক্সপ্রেস ট্রেনে এসেছি মাঝ রাত্রে। তারপর হেঁটে আসতে-আসতে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম…’
ছোটোকাকা বললেন, ‘দেখি, মাথার কাছে কতটা কেটেছে?’
লোকটির কপালে হাত দিয়েই ছোটোকাকা বললেন, ‘ঈশ, আপনার যে সাংঘাতিক জ্বর এসেছে দেখছি! সেপটিক হয়ে গেলে এরকম জ্বর আসে…’
লোকটি বলল, ‘না, আমার সেপটিক হয়নি। আপনারা ভাববেন না…’
‘আপনার নাম কী?’
‘বিজন গুপ্ত।’
অতবড় বাড়িটার সব ক-টা ঘর আমাদের কাজে লাগত না। আমরা থাকতাম দোতলায়, একতলার ঘরগুলি খালিই পড়ে থাকে। সেই রকম একটা ঘরে বিছানা পেতে দেওয়া হল। একটা ছুরি আগুনে গরম করে তারপর নিজেই সেটা পায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে বিজন গুপ্ত কাচ দুটো বার করলেন। তাঁর ভীষণ ব্যথা লাগছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনি একটুও চিৎকার করলেন না। গরম জলে রক্ত-টক্ত ধুয়ে পায়ে আর মাথায় দুটো ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিলেন ছোটোকাকা। বিজন গুপ্তর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, খুব জ্বর এসেছে বোঝা যায়।
আমাদের সকালের জলখাবার হয়েছিল লুচি আর হালুয়া। মা সেই এক প্লেট লুচি-হালুয়া আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘যা, ওই ছেলেটিকে দিয়ে আয়।’
আমি ওঁর ঘরে এসে দেখলাম, উনি ঘুমোচ্ছেন। দু-বার ডাকলাম, কোনো সাড়া নেই। তারপর গায়ে একটু ধাক্কা দিতেই উনি চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘কে? কে?’
আমি বললাম, ‘আপনার খাবার।’
উনি বিরক্তভাবে বললেন, ‘খাব না।’ তারপর আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
বাবা দোতলা থেকে নীচে নামেন না। তবু একসময় তাঁর কানেও কথাটা পৌঁছে গেল। বাবার ঘরে তখন একটা মিটিং বসে গেল। মা, ছোঢো কাকা, দিদি, ছোটোকাকিমা—সবাই উপস্থিত।
বাবা বললেন, ‘জানা নেই শোনা নেই, একটা অচেনা লোককে তোমরা হুট করে বাড়িতে থাকতে দিলে?’
মা বললেন, ‘অসুস্থ হয়ে এসে পড়েছে, তাকে কী তাড়িয়ে দেওয়া যায়?’
‘যদি চোর-ডাকাত হয়?’
‘না, না, ভদ্রলোকের ছেলে।’
‘কী করে বুঝলে ভদ্রলোক?’
‘তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।’
‘ছাই বোঝা যায়। কত চোর-ডাকাত আজকাল ভদ্রলোক সেজে ঘুরে বেড়ায়! তা ছাড়া ভদ্দরলোকের ছেলেরা বুঝি চুরি-ডাকাতি করে না? প্রায়ই তো দেখি কাগজে—’
‘তা বলে একটা লোক অসুস্থ হয়ে এসে পড়লে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়?’
‘আমাদের বাগানে এল কী করে?’
‘কুকুর না শেয়ালে যেন তাড়া করেছিল।’
‘কিন্তু যাচ্ছিলটা কোথায়? কোন বাড়ির ছেলে, মধুপুরে চেনা কেউ আছে কিনা, সে খোঁজ নিয়েছ?’
এবার ছোটোকাকা বললেন, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না মেজদা। সে-সব খবর আমি বার করে নেব। কোনো বাজে মতলব থাকলে আমি ঠিক ঠাণ্ডা করে দেব ওকে।’
কিন্তু ছোটোকাকাও খুব বেশি খবর আদায় করতে পারলেন না। বিকেলবেলা বিজন গুপ্তর ঘুম ভেঙেছিল। ছোটোকাকা তাঁকে এক কাপ চা দিয়ে নানারকম গল্প করতে লাগলেন। সেই সময় আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
বিজন গুপ্ত মধুপুরে কারুকে চেনেন না। তবে ‘শিব নিবাস’ নামে একটা খালি বাড়ির চাবি ওঁর কাছে আছে, উনি সেখানে যাচ্ছিলেন। ‘শিব নিবাস’ বাড়িটা যে কোথায় তা ছোটোকাকাও জানেন না, আমিও জানি না। জসিডিতে ওঁর বাড়ির লোকদেরও খবর দেবার দরকার নেই, তাঁরা কালই ফিরে গেছেন কলকাতায়।
ছোটোকাকা বললেন, ‘কিন্তু আপনার এখনও জ্বর আছে। পা-টা বেশ ফুলে গেছে। ডাক্তার দেখানো উচিত। ডাক্তার ডেকে আনব?’
উনি বললেন, ‘না না, কোনো দরকার নেই। আপনাদের আর কষ্ট দিতে চাই না। পা-টা একটু ঠিক হলেই আমি চলে যাব।’
বেরিয়ে এসে ছোটোকাকা মা-কে ফিসফিস করে বললেন, ‘চোর-ডাকাত হোক আর যাই হোক, ওর এখন এক পা-ও নড়বার ক্ষমতা নেই। তাহলে আর ভয়ের কী আছে? একটু সেরে উঠুক, তারপর ওকে আমি আরও জেরা করব!’
আমার বুকের মধ্যে দারুণ কৌতূহল জমে রইল। কোথা থেকে এল এই রহস্যময় লোকটি? আমিই একে আবিষ্কার করেছি। সত্যিই চোর কিংবা ডাকাত? আমি কোনো জলজ্যান্ত চোর বা ডাকাত আগে দেখিনি। কথা শুনে তো একদম কিছু বোঝা যায় না। ওঁকে যদি শেয়াল বা কুকুরে কামড়ে দেয়, তবে তার দাগ নেই কেন? কেন উনি ডাক্তার দেখাতে চান না? কেন বাড়ির লোককে খবর দিতে চান না? পা খোঁড়া হয়ে, জ্বর গায়ে কেউ অন্য লোকের বাড়িতে শুয়ে থাকে? কিন্তু আমারও খুব ইচ্ছে হল, একদিন আমি একদম অচেনা কারুর বাড়িতে খুব অসুখ নিয়ে আশ্রয় চাইব। আমাকে তারা চোর কিংবা ডাকাত ভেবে যদি সন্দেহ করে, তাহলে খুব মজা হবে।
আমাদের উল্টো দিকের বাড়ি ‘অনন্তধামে’ রোজ সকাল বিকেলে খুব কীর্তন হয়। বিখ্যাত কীর্তন-গায়ক গোবর্ধন ভট্টাচার্য তাঁর দলবল নিয়ে ওই বাড়িতে উঠেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার বাবার চেনা আছে বলে তিনি রোজ একবার করে আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
সেদিন সন্ধেবেলা গোবর্ধন কাকা খড়ম ঠকঠকিয়ে উঠে এলেন দোতলায়। গোবর্ধন কাকার গায়ে নামাবলি, মাথায় মস্তবড়ো টিকি। তাঁর ডান বাহুতে প্রায় একটা পানের ডিবের সাইজের রুপোর তাগা।
গোবর্ধন কাকা বাবার কাছে সব ঘটনা শুনে একেবারে আঁতকে উঠলেন। চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, ‘করেছেন কী? আজকাল কেউ অচেনা-অজানা লোককে বাড়িতে ঢোকায়? জানাশুনো লোকেরাই কত রকম সর্বনাশ করে যায়। পায়ে চোট লেগেছে তো হাসপাতালে যাক।’
বাবা বললেন, ‘মধুপুরে হাসপাতাল আছে?’
গোবর্ধন কাকা বললেন, ‘তাহলে অন্তত থানায় খবর দেওয়া উচিত। জসিডিতে হাসপাতাল আছে, ট্রেনে চাপিয়ে দিলেই সেখানে চলে যেতে পারবে। আজকের কাগজ দেখেছেন?’
কলকাতার খবরের কাগজ একদিন দেরি করে আসে বলে গোবর্ধন কাকা হিন্দি কাগজ পড়েন। হাতের সেই কাগজটার এক জায়গায় আঙুল দিয়ে বললেন, ‘এই দেখুন।’
বাবা প্রাণপণে হিন্দি বুঝবার চেষ্টা করলেন। তখন গোবর্ধন কাকা নিজেই বলে দিলেন, ‘এই দেখুন; পরশু দেওঘরে এক বিরাট ডাকাতি হয়ে গেছে। সাত-আটজন লোক এক মাড়োয়ারির বাড়িতে জোর করে ঢুকে সব কিছু নিয়ে চলে গেছে। এ ছেলে যে সেই ডাকাত দলের কেউ নয়, কী করে জানলেন!’
মা বললেন, ‘এ তো পরশুর কথা। ছেলেটি তো কাল রাত্রে ট্রেনে চড়ে এখানে এসেছে।’
গোবর্ধন কাকা বললেন, ‘সত্যি বলেছে না মিথ্যে বলছে তা কী করে বুঝলেন? কোথাও বোধ হয় ঘাপটি মেরে লুকিয়েছিল একটা দিন। নিশ্চয়ই ডাকাতি করার সময় পাঁচিল টপকাতে গিয়ে পায়ে কাচ ফুটেছে।’
মা বললেন, ‘না না, কাচ ফুটেছে আজ। পরশু কাচ ফুটলে কী তার থেকে আজও রক্ত বেরোয়?’
গোবর্ধন কাকা বললেন, ‘সে আপনারা বুঝে দেখুন!’
বাবা সব দোষ মায়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন না, উনি লোকটার মুখ দেখেই বুঝে গেছেন যে, সে ভদ্দরলোক, সে কোনো দোষ করতে পারে না।’
মা বললেন, ‘সে-যাই হোক, কেউ অসুস্থ হয়ে এলে আমি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি না। ছেলেটা মাটিতে পা ফেলতেই পারছে না, যাবে কী করে?’
নীচে নেমে এসে গোবর্ধন কাকা চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কোথায়?’
আমরা ঘরটা দেখিয়ে দিলাম। গোবর্ধন কাকা জানালা দিয়ে একবার উঁকি মেরেই ঠোঁট উলটে মুখটা এমন বিকৃত করলেন যেন তিনি একটা খুব বিচ্ছিরি খারাপ জিনিস দেখেছেন। তারপর বললেন, ‘কোনো বিশ্বাস নেই।’
গোবর্ধন কাকাই পুলিশে খবর দিয়েছিলেন কিনা জানি না।
পরদিন ভোরবেলা তখন আমি ছাড়া আর কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি বাগানে গিয়ে একটা পেয়ারা গাছে উঠব কিনা ভাবছি, এমন সময় আমাদের গেটের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থামল। গেট খুলে দেবার জন্য কারুকে ডাকলও না, দুজন পুলিশ টপ করে গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলতে এল।
আমি তক্ষুনি বুঝলাম, পুলিশ বিজন গুপ্তকেই ধরতে আসছে। আমাদের বাড়িতে আগে কোনোদিন পুলিশ আসেনি। তক্ষুনি তাঁকে সাবধান করে দেবার জন্য আমি বাড়ির মধ্যে দৌড়ে গেলাম।
কিন্তু বিজন গুপ্ত তাঁর ঘরে নেই। এত ভোরেই তিনি উঠে পড়েছেন! বাথরুমের দরজাও তো খোলা। তাহলে কোথায় গেলেন? আমি গোটা একতলাটা খুঁজে দেখলাম। কোথাও পেলাম না। দোতলায় সব ঘরের দরজা বন্ধ। তখন আমি উঠে এলাম ছাদে।
ছাদে পাঁচিলের এক কোণে বসে আছেন বিজন গুপ্ত! এই শীতের মধ্যেও কপালে ঘাম। হাঁপাচ্ছেন। একটা পা সাংঘাতিক ফুলে গেছে। নিশ্চয়ই খুব ব্যথা। তবু এই পা নিয়ে তিনি কী করে ছাদ পর্যন্ত উঠে এলেন, সেটাই আশ্চর্য!
উত্তেজনায় আমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে। আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘পুলিশ এসেছে।’
উনি বললেন, ‘জানি!’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুলিশ আপনাকে ধরতে এসেছে কেন? আপনি কী করেছেন?’
উনি দাঁতে দাঁত চেপে ভীষণ ব্যথা সহ্য করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একটুখানি দম নেবার পর বললেন, ‘শোনো খোকা, আমি চোর কিংবা ডাকাত নই। আমি একজন বিপ্লবী। এই কথাটার মানে তুমি বড়ো হয়ে বুঝবে।’
আমার গা ঝিমঝিম করে উঠল। বিপ্লবী কথাটার মানে তো আমি তখনই জানি। বিপ্লবী মানে যাঁরা দেশের জন্য কাজ করেন। দেশের মানুষের ভালো করবার জন্য যাঁরা অনেক কিছু বদলে দিতে চান। ইনি সেই রকম একজন লোক! ইনি ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করতে নেমেছেন!
তিনি ছাদের পাঁচিলের ওপর ওঠবার চেষ্টা করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কী করছেন?’
‘আমি পালিয়ে যাচ্ছি।’
‘কিন্তু আপনি পড়ে যাবেন যে। আপনার পায়ে ব্যথা!’
‘আমি পড়ে যাই কিংবা মরে যাই, তাতে কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু বিপ্লবীরা কক্ষনো ইচ্ছে করে ধরা দেয় না।’
তারপর জলের পাইপ বেয়ে উনি সরসর করে নেমে গেলেন নীচে। আমি মুখ ঝুঁকিয়ে দেখলাম, বাগানের মধ্য দিয়ে উনি এক পায়ে লাফিয়ে দৌড়োচ্ছেন। ভাঙা পাঁচিলটার কাছে পৌঁছোবার আগেই দু-জন পুলিশ তাঁকে দেখতে পেয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে তাড়া করল। উনি এক লাফ দিয়ে পাঁচিলটা পার হয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলেন।
তারপর কী হল, আমি আর দেখতে পাইনি। পুলিশ ওঁকে ধরতে পেরেছিল কিনা আমি জানি না। আমার বাড়ির সব লোকের ধারণা, পুলিশ ওঁকে ঠিকই ধরে ফেলেছিল। কিন্তু আমি সেকথা বিশ্বাস করিনি।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। বিজন গুপ্তর আর কোনো খবর পাইনি। উনি কোথায় হারিয়ে গেছেন, কে জানে। আমার ছোটোকাকা এখান লোকজনের কাছে গল্প করেন, ওরে বাবা, সেবার মধুপুরে… একটা সাংঘাতিক ডাকাত… লুকিয়েছিল আমাদের বাড়িতে…।
কিন্তু আমি জানি উনি ডাকাত নন। ওরকম বেপরোয়া সাহসী লোক আমি আর কখনো দেখিনি। এখন তাঁর মুখটা আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। আর কানে ভেসে আসে ওঁর সেই শেষ কথাটা—‘আমি পড়ে যাই কিংবা মরে যাই, তাতে কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু বিপ্লবীরা কক্ষনো ইচ্ছে করে ধরা দেয় না!’ সেই সময় তাঁর গলার আওয়াজটা কী শান্ত আর গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।
কেন জানি না, এখন সেকথা মনে পড়লে আমার কান্না পেয়ে যায়।