দি স্পাই হু লাভড মি (পার্ট ১)

দি স্পাই হু লাভড মি

আতঙ্কিতা

পালিয়ে যাচ্ছিলাম আমি আমার অক্ষমতা থেকে, যদিও পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে মাথা তুলে দাঁড়াবার সামর্থ্য থেকে আমার ভাগ্য আমাকে বঞ্চিত করেনি। ইংল্যান্ডেই আমার শৈশব, এই শীত, অপরিচ্ছন্ন আকর্ষণহীন আসবাবপত্র অপরিচ্ছন্ন আকর্ষণহীন প্রণয় ঘটনার এক অনুক্রম থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। আসলে আইনের চোখ ছাড়া আমার চারদিকের সবকিছুর কাছ থেকেই আমি পালিয়ে যাচ্ছিলাম।

পালিয়ে অনেক দূরেই গিয়েছিলাম। একটু বাড়িয়ে বলতে গেলে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার আধাআধি পথ। এখন সারাটা লন্ডন পেরিয়ে এসেছি দ্যা ড্রিমি পাই মোটর কোর্টে–যা অজস্র পাহাড়, হ্রদ আর নিউইয়র্ক রাজ্যের উত্তরাঞ্চল জুড়ে প্রসারিত, সেই বিশাল বন ঘেরা আমেরিকার বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র-আডিরোন ডাকসের লেক জর্জ থেকে দশ মাইল পশ্চিমে।

আজ শুক্রবার, ১৩ই অক্টোবর। রওনা হয়েছিলাম ১লা সেপ্টেম্বর। আমার আসার আগে বাগানের মেপল গাছের। সারিগুলি ছিল সবুজ, এখন কানাডার সীমানার কাতারে এগিয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ পাইন গাছের মধ্যে একেবারে আদিম বন্য মেপল গাছের শাখায় শাখায় যেন জলন্ত বিস্ফোরণের মত ফুলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে এখানে ওখানে। আমি অনুভব করলাম যে আমার রং বিরম নাড়ুর বর্ণ, যা লন্ডন বাসের ফলে পাওয়া, যা ফেলে বর্তমানে অঙ্গে তুলে নিয়েছে। এই মন মাতানো রং ও নিসর্গের ঝলমলে উজ্জ্বল্য আমার কাছে এটা যেন ধার করা একটা চামড়ার খোলস ছেড়ে নিজের আসল চামড়াটা ফিরে পাওয়ার মত। আয়নার মধ্যে নিজেকে দেখামাত্রই খুব একটা আত্মতৃপ্তি আছে এমন বলব না। আসলে গত পাঁচ বছরের অস্তিত্বটা থেকে পালাচ্ছিলাম। এখনকার ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং বলব, আমার আগের ব্যক্তিত্বটাকে আমি ঘৃণা করতাম, ঘৃণার চোখে দেখতাম, পশ্চাতের ঐ মুখখানা থেকে অব্যাহতি পেয়েই আমি আনন্দিত।

আমি যেখানে আছি সেখান থেকে ঠিক পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে নিউইয়র্কের রাজধানী আলবেনীর উয়োকো। বেতারে এইমাত্র ঘোষণা করা হল ঠিক ছ টা বেজেছে, তার পরেই আবহাওয়ার সংবাদ–তাতে প্রবল বাতাসসহ আসন্ন ঝড়ের সম্ভাবনার কথা জানাল। আলবেনীতে এই ঝড়ের প্রবাহ এসে পৌঁছাবে রাত আটটা নাগাদ, চলবে বারোটা পর্যন্ত। তার মানে সারাটা রাতই আমাকে এই ঝড়ের পাশাপাশি শুয়ে কাটাতে হবে। যতদূর জানি কাছাকাছি কোন জীবিত প্রাণী। বলতে আছে লেক জর্জে, খাবার মোটামুটি দ্বিতীয় উত্রাই পথ বেয়ে দশ মাইল গেলে পরে, তবু বাইরে বিদ্যুৎ বৃষ্টির মধ্যে পাইন গাছের আছাড়ি পিছাড়ি করার দৃশ্যটা ভেবে আমি ভেতরে ভেতরে ঋজু ও সুরক্ষিত অনুভব করছিলাম। আর অনুভব করছিলাম নিঃসঙ্গতা।

প্লেন ফলসের উত্তরে লেক জর্জ-এর মধ্যে মনোরম বিকল্প যোগাযোগ হিসাবে অরণ্যের বুক চিরে আনমনে চলে গেছে এই দু নম্বর রাস্তাটা। ড্রিমি ওয়াটারটা ঠিক এর মাঝামাঝি একটা হ্রদ, পিকনিক করার আদর্শ স্থান বলে জায়গাটা বরাবর বিখ্যাত। এই হ্রদের দক্ষিণ পাড়েই হোটেলটা বানানো হয়েছিল, রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধ। বৃত্তাকারভাবে। রান্নাঘর, গোসল খানা, খাবার ঘর, শোবার ঘর, প্রায় প্রত্যেকটি ঘরের পিছন থেকে হ্রদের কোন না কোন অংশ দেখা যায়। অতি আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি এই বাড়িটা। চকচকে পালিশ করা পিচ, পাইনের তক্তা দিয়ে বানানো সম্মুখভাগের বীমের উপর সুন্দর কাঠের ছাদ, তাছাড়া প্রত্যেকটি ঘরে টেলিভিশনও রয়েছে। ছোটদের জন্য। সুইমিং পুল, খেলার মাঠ, খেলার জায়গা আছে হ্রদের ওপারে। মানে ভাল বন্দোবস্তই আছে। দশ ডলার ভাড়ার একক শয্যার কোন ঘর, বা ষোল ডলার ভাড়ার মোড়া খাটের কোন ঘর ভাড়া করলেই দিনে দু বার মুদি আসে লেকজর্জ থেকে মদ সরবরাহ করতে, আর লবিতে আছে কাফেটেরিয়া। চৌদ্দই জুলাই থেকে মে ডে পর্যন্ত সময়টা মালিকদের ব্যবসাটা চালাতে অসুবিধা হয়। এই সময় তাই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় ঘর খালি নেই। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ তিরিশ ডলার মাসিক মাইনেতে রিসেপসনিস্ট হিসাবে আমাকে নিয়োগ করার সময় অন্তত তাই বলেছিল।

মিষ্টি একটা পরশ পেলাম মনের মধ্যে। প্লেন ফল্স থেকে ফিরে যাবার জন্য যে আপদ গুলি এসেছিল সেখানেই প্লেন ফল্স হয়ে ফিরে যাবার জন্য এখানে থেকে বিদেয় হল, সেদিন সকাল থেকে বুকে যেন স্বর্গের সব কটা সুর একসঙ্গে বেজে উঠেছিল, শেষবারের মত মিস্টার ফ্যান্সী আমাকে কবজা করতে চেয়েছিল আমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হলাম। আমার পায়ের হিল জুতাটা দিয়ে ওর পায়ের পাতাটা মাড়িয়ে দিলাম। আর ও মাড়িয়ে দেবার আগেই তার অবাধ্য হাত ছুটন্ত গিরগিটির মত আমার গায়ে বুলিয়ে নিতে পেরেছিল। তক্ষুণি আমাকে ছেড়ে দিল বাছাধন। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠা মুখখানা নরম গলায় আমাকে জানাল ঠিক আছে মোহিনী। আগামীকাল দুপুরবেলা পর্যন্ত যতক্ষণ না মালিক আসেন ততক্ষণ শুধু খেয়াল রেখ এই কুঠীর দেখাশুনা যেন ভালভাবে হয়। আজ রাতে তোমার জন্য মিষ্টি স্বপ্নের কামনা করছি। তারপর আপদটা একটা হাসি হাসল, যেটা আমার কাছে দুর্বোধ্য। ওদিনের ওর বৌ ঘটনাটা দেখে ওকে তীক্ষ্ণ গলায় ডাকতেই ও চলে গেল।

গাড়িতে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চলি তাহলে মিষ্টি সোনা। রোজ চিঠি লিখ–এই কথা ওর স্ত্রী আমাকে বলে একটা বিশ্রী কুটিল হাসি হাসল। আমার সামনে ওদের মুখটা শেষবারের মত ভেসে উঠল। উফ! কি একখানা দম্পতি! ঠিক যেন কোন বইয়ের দুটি চরিত্র নেমে এসেছে ধরাধামে–কিন্তু কোন বই। কিন্তু তারাও এত খারাপ হতে পারে না। যাকগে এখন চলে গেছে ওরা এখান থেকে। মানবজাতিকে নিশ্চয়ই উন্নত বলে মনে হবে, যেখানেই যাই না কেন।

ফ্যান্সীদের চলে যাবার পর আমি ওদের পথের দিকেই তাকিয়েছিলাম। আকাশটা বেশ পরিষ্কার তনকেটাবরের মাঝামাঝির দিক হবে।

একটু পরেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা আমার গায়ে এসে লাগল। দূরে একটা ধাতব বাতির কাঁচক্যাচ শব্দে একটা ফিসফিসানি কানে এল, এবং শোনামাত্রই আমার কানে শিরশিরানি খেলে গেল। হ্রদের পানির উপরিভাগ যা পেতলের মত দেখাত, হঠাৎ মৃদুমন্দ বাতাসে তা যেন মাঝে মধ্যে সাদা সাদা রেখা ফুটিয়ে তুলল। আক্রোশে ফুলে ওঠা লম্বা লম্বা গুলি ছাড়া বাতাস ছিল নিশ্চল এবং রাস্তার ওপারে আর হোটেলের পেছনে প্রহরী বৃক্ষের দল এলোমেলোভাবে ঘেষাঘেষি করে আমার পেছনের আলোকজ্জ্বল বাড়িটার আলোকোৎসবকে ঘিরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

বেশ মজা লাগছিল কিন্তু নিজেকে আঁকড়ে রাখলাম। একটু পরেই ঝড়ের তাণ্ডব লীলা যখন শুরু হয়ে যাবে তখন আমি আরামদায়ক আলোকিত ঘরের গহ্বরে ঢুকে যাব আমি। আরও মিষ্টি আরামের জন্য তৈরি করব একটা পানীয়, আর রেডিওটা চালু করে দেব।

রাত ঘনিয়ে আসে। পাখিদের কলকাকলি শোনা যায় না, কারণ ঝড়ের পূর্বাভাস তারা আগেই পেয়েছে। তারা যে যার বাসায় চলে যায়, বনে প্রাণীরাও চলে যায়। যেমন কাঠবেড়ালি আর হায়নের এই বিরাট বন্যভূমিতে একমাত্র আমিই আছি আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে। ফিরে যাবার আগে কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিলাম। বাতাসের গন্ধটা ছিল শ্যাওলার আর মাটির ভেতরের সোদা গন্ধ। এতে আমি অসম্ভব আনন্দ পেয়েছি। একটা পেঁচা এই নিস্তব্ধতার মধ্যে ডেকে উঠল হু, তারপরেই চুপ। আমি এই ধূলিধূসর পথটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই হাওয়ার ঝাঁপটা আমার গায়ে এসে লাগল। আমার চুল উড়িয়ে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রাতের পাহারাদার কুকুর জেগে উঠে যেমন করে ডাকে, ঠিক তেমন ভাবে মেঘ ডেকে উঠল।

তারপরই এল ঝড়।

বৃক্ষরাজির দল যেন নৃত্যরত হয়ে আছড়াতে লাগল, গ্যাস স্টেশনের ওপরের বাতিটা ঝাঁকুনি খেয়ে দুলছিল। আমার মনে হচ্ছিল ও আমাকে চোখ টিপে টিপে সতর্ক করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে বাতিটার দৃষ্টি ঝাপসা হল। কারণ আলোর পুঞ্জ এগিয়ে আসা বৃষ্টিধারার ধূসর আঁচলে যেন কুহেলী বিলীন হয়ে গেল। বড় কয়েকটি ফোঁটা আমার গায়ে পড়ামাত্র অমনি এক ছুট।

ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম, কি প্রচণ্ড বৃষ্টি, খুব ভাল সময়েই পৌঁছাতে পেরেছি। এত প্রচণ্ড বৃষ্টি, যেন মনে হচ্ছে মেঘের ধারাপাত ভেঙে পড়ছে। বৃষ্টির শব্দ মাদলের গম্ভীর ধ্বনির মত, এক লহমায় ছাদের জলনিকাশী পাইপ দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত পানি নামার তীব্র শব্দ একসঙ্গে যোগ করে দিল। আর এভাবেই ঝড়ের মুখর পটভূমিকা রচিত হয়ে গেল।

আমি তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ বোমা ফাটার মত কড়কড়ে শব্দে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল, বাড়িটাকে কাঁপিয়ে দিল। বাতাসে তার অনুরণন উঠেছিল, কয়েক গজ দূরে বিরাট একটা বিস্ফোরণে যে রকম শব্দ হয় অনেকটা সেইরকম। একটা কাঁচের জানালা ভেঙে পড়ল মেঝের উপর, ঝরঝর করে বৃষ্টির ছিটা আসতে লাগল।

আমার নড়বার শক্তি ছিল না। দু হাতে কান চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি, ব্যাপারটা এরকম হবে তা বুঝতে পারিনি। একটা অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ যা কানে অস্বস্তি ধরিয়ে দিচ্ছিল, তা এখন আকাশ বন্যার কল্লোলের সঙ্গে মিশে গেল। এই কল্লোল নিয়ে আসে স্বস্তিকে, এতটা খারাপ হবে তা ভাবতেই পারিনি। এই পরিস্থিতিতে একা থাকা যে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার তা তো বোঝাই যায়। একা থাকতে চাও তো ভাল, আর না চাইলে এই প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে জোরেছোটা অর্থাৎ দশ মাইল দূরে লেক জর্জের দিকে পালানো।

আবার ঘরের মধ্যে নীলাভ শ্বেত বিজলীর বিচ্ছুরণ ঝলসে উঠল। এবার আরো জোরে শব্দ, একেবারে ফাটল ধরা বিস্ফোরণের শব্দ। সবকিছু ছিটকে পড়ল হিংস্র গোলাবর্ষণের প্রক্রিয়ার মত, পাশের ঘরে মদের গ্লাস ও বোতলগুলি ঝনঝন করে শব্দ করে উঠল, আর কাঠের তৈরি বাড়িগুলি ক্যাচক্যাচ শব্দ করে উঠল।

আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। কোন রকমে টালমাটাল হয়ে গিয়ে হাতের উপর মাথা রেখে বসে পড়লাম, ভাবলাম কি করে এতটা নির্বোধ হলাম। যত দৌরাত্ম্য সব কি আমাকে কেন্দ্র করেই। এই সময় একটা কিছু করতে হবে এটা ভাবলাম। ভাবলাম কি করা যায়। ফ্যালীরা চলে যেতেই ফোনের লাইনটাও কেটে দিয়েছে। এখন একটাই আশা আছে যে বাড়ির সামনের গেটে ঘর ভাড়া দেওয়া হবে এই নিয়ন সাইনের তৈরি গ্যাসটা জ্বালিয়ে দিতে হবে। যদি কোন পথচারী এই দুর্বিপাকে পথে থাকে, সে বেচারীও এটা দেখে খুশি হবে আর আমারও ভাল হবে। কিন্তু যেই সুইচে হাত দিয়েছি, অদৃশ্য বিদ্যুতের নজর নিশ্চয়ই আমার উপর কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, তার দৈতের মত বিশাল এক হাত যেন আমাকে ছুঁড়ে দিল ঘরের মেঝেতে।

.

নানারঙের দিনগুলি

 মেঝেতে এসে অমন জোরে ছিটকে পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম কোথায় আছি, কি ঘটে গেছে। আর একবার আহত হবার ভয় থাকার জন্য নিচের মেঝের সঙ্গেই মিশে থাকলাম। প্রায় মিনিট দশেক শুয়েছিলাম, আর শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম এইরকম ইলেকট্রিক শক খাবার ফলে জন্মের মত আমার কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা, কি জানি। যদি এই ইলেকট্রিক শক খাবার জন্য গুঁড়িয়ে দেয় আমার শরীরের কোন অঙ্গ, কিংবা আমার সমস্ত কালো কেশগুচ্ছ একেবারে সাদা করে দেয় বা সব চুল যদি পুড়েই নিঃশেষ হয়ে যায়–আমি হাতটাকে আলতো করে মাথার পেছনে নিলাম, না, দেখলাম চুল ঠিকই আছে কিন্তু মাথার পেছনে একটা ঢিবির মত হয়েছে। যা প্রচণ্ড চোট তাতে মাথার আর কি দোষ, ভয় হয় আমার মা হবার সম্ভাবনাকে না নষ্ট করে দেয়। অবসন্ন মন্থরতায় একটু নড়লাম– না কোন ক্ষতিই হয়নি।

আমার ঘরের কোণের জি.ই.সি ফ্রিজটা ঠিক সেই মুহূর্তেই চালু হল। আমার মনে হল তার খুশিভরা গার্হস্থ কলরব শুরু করে সে আমাকে জানিয়ে দিল যে জগৎ সংসার ঠিকমতই চলছে। দূরে চলে গিয়েছে বিদ্যুত্বাহিনী।

খুব সামান্য শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই আগে ঘরের চারদিকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম। ভয় হচ্ছিল কি জানি কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে হবে। না, সবকিছুই প্রায় ঠিকঠাক রয়েছে। ঘরের মধ্যে গুরুগম্ভীর চেহারার সেই রিসেপশন ডেস্ক, পেপারব্যাক, পত্রপত্রিকা রাখার ম্যাগাজিন র‍্যাক, ক্যাফেটেরিয়ার লম্বা কাউন্টার, রামধনু রঙের প্লাস্টিক পাটাতন ওয়ালা গোটা বারো পরিচ্ছন্ন টেবিল, কিছু চেয়ার, বিশালাকার বরফ পানির জালা আর চকচকে কফি পার্কো লেটারটা–সবকিছুই নিজস্ব স্থানে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র জানালায় তৈরি হয়েছে একটা বড় ফোকর। আর সেই ফোকরের মধ্য দিয়ে অগাধ জলরাশি ঘরের মধ্যে অবাধে ঢুকে বয়ে চলেছে। মনে হচ্ছিল যেন ঘরের মধ্যে একটা প্রলয় তাণ্ডব চলছে।

ওহ! কি যেন বলছিলাম প্রলয়? আসলে আমার মাথায় প্রলয় কথাটাই বনবন করে ঘুরছে! বন্ধু বিদ্যুৎ সহ ঝড় ছিল, তাতেই ছোট বাচ্চাদের মত ভয় পেয়েছিলাম। আর বাচ্চাদের মতই কাজটা করেছিলাম। বিদ্যুৎ চমকের বিরতি পর্যন্ত ধৈর্য না ধরে কি যে একটা আহাম্মকের মত কাজ করেছিলাম ঐ ইলেকট্রিক সুইচটা টিপে। শাস্তিও পেয়েছি। মাথাটা ফুলে হয়েছে একটা ঢিবির মত। না সত্যি বড় বেয়াক্কেলে আমি। হঠাৎ মনে হল সত্যি আমার মাথার চুলগুলো সাদা হতে পারে? চট করে ঘরটা পেরিয়ে ব্যাগ থেকে আয়নাটা নিয়ে বিস্ফারিত নেত্রে নিজের প্রতিবিম্বটাকে নিখুঁতভাবে অন্বেষণ করতে লাগলাম। দেখলাম নীল, পরিচ্ছন্ন কিন্তু বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে চোখের মণি দুটি আমার দিকে তাকাল। পদ্মগুলি অটুট, একজোড়া খয়েরি জ পল্লব, ললাটের বিস্তৃতি বাদামী রঙের টিকোল নাক, আর গাঢ় বাদামী রঙের ঢেউ খেলানো চুলগুলি বুকের দুইপাশে দুই তরঙ্গের মত সুস্থ স্বাভাবিক ভাবেই অবস্থান করছে। সেই জন্য ব্যাগের ভেতর থেকে চিরুনি বের করে বার কয়েক ক্ষুব্ধ চুলগুলিকে নিজের হাতের মধ্যে এনে চুলগুলির উপর দিয়ে চিরুনি বুলিয়ে নিলাম। তারপরে চিরুনিটি ব্যাগে পুরে ব্যাগ বন্ধ করে দিলাম।

ঘড়িতে দেখি প্রায় সাতটা বাজে।

রেডিওটা চালিয়ে দিতেই কিছুক্ষণ পরেই সাতটার খবর শুরু হল। তাতে শুধু ঝড়ের খবর যা শুনলে শ্রোতাদের মনে ভয়ের উদ্রেক করবে। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, হডসন নদী বিপদসীমা অতিক্রম করেছে প্লেন ফসের কাছে। একটা এলুম গাছ পড়ে নয় নম্বর পথটাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে স্যাটাগোরা প্রস্রবণের কাছে। প্রবল বন্যার সংকেত দেওয়া হয়েছে মেকানিকাভিলে। আমি উঠে জানালার ভাঙা ফোকরটাকে বন্ধ করার জন্য একটা শক্ত কার্ডবোর্ড আটকে দিলাম। আর মেঝেতে পড়ে থাকা পানি একটা শুকনো কাপড় দিয়ে বালতির মধ্যে নিংড়ে ফেলতে লাগলাম। হাতের কাজটা সারামাত্রই পেছনের বারান্দার দিকে নয় নম্বর ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে একটু ঝর্ণায় গোসল করে নিলাম। মাটিতে পড়ার জন্য আমার টেরিলিনের জামাটায় ময়লা লেগেছিল, সেটাকে ভাল করে ধুয়ে শুকোতে দিলাম।

ঝড় যে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে তা এর মধ্যেই ভুলে গিয়েছিলাম।

একটা ছোট বোকা মেয়ের মত কাজ করছিলাম। এই নির্জনে আমার মন এখন এক মন্দার স্বপ্নের গীতিময়তায় উচ্ছল হয়ে উঠল, আগামীকাল ভোেরবেলায় বিভাসের জন্য আনন্দধ্বনি জেগে উঠল।

ঝোঁকের বশে আমি আমার ছোট্ট ওয়ার্ডরোবে অল্পসল্প যা জামাকাপড় ছিল, তার থেকে সবচেয়ে ভালটা নিয়ে পরে ফেললাম।

ড্রেসটা ঠিক বুকফাইটারদের মত। কালো ভেলভেটের প্যান্ট যার উপর সোনালি জীপ ফাসনারের গতি কোমর থেকে এমনভাবে নেমেছে, যেটা দৃষ্টিকটুকর ব্যাপার। সেটা বসলে পরে আরো ভালভাবে টের পাওয়া যায়। আর তাছাড়া প্যান্টটাও এমন বিশ্রীভাবে কামড়ে ধরেছে যে একটু উগ্রই হয়েছে।

তাই এর উপর আর ব্রা পরার ঝামেলা করলাম না। একেবারে গলাবন্ধ একটা সোনালি সোয়েটার পরে নিলাম।

আয়নার মধ্যে নিজেকে দেখলাম। ভালই লাগছে। সোয়েটারের হাতাটা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিলাম।

এরপর একটা নশা কাটা সোনালি স্যান্ডেল গলিয়ে সোজা বেরিয়ে এলাম লবিতে।

ভার্জিনিয়া জেন্টলম্যান ব্র্যান্ডের বুবদ মদের দু পাইটের ঠিক একটা বোতলে দু সপ্তাহ চলার পর আর কিছুটা বাকি ছিল। একটা পলককাটা সেরা কাঁচের গ্লাসে কয়েক টুকরো বরফ পুরে দিলাম তার মধ্যে বোতলটার শেষ ফোঁটা অবধি নিলাম। সবচেয়ে আয়েসী আরামকেদারাটা রিসেপশন লবির দিক থেকে, রেডিওটা কাছে টেনে এনে, পার্লামেন্ট সিগারেটের প্যাকেটের শেষ পাঁচটা থেকে একটা ধরিয়ে নিলাম। গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে, রেডিওটা চালিয়ে দিয়ে নিজেকে আরাম কেদারায় মেলে দিলাম।

বাইরে একটানা বৃষ্টির মধ্যেও রেডিওতে তার বেতার কার্যক্রম ঠিকমতই চলছিল। মার্জার সংবাদ, পোষা বেড়াল মাত্রেই গুসিফুড প্রাইম লিভার মিল খেতে কি ভালবাসে সেই সব তথ্য। মাঝে মাঝে তীব্র ছাট এসে ছররা গুলির মত শার্সির কাঁচে লাগছিল এবং বাড়িটা কেঁপে উঠেছিল। তখনই বৃষ্টির একটানা সুরের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছিল। আরামে বসে বসে ভাবছিলাম বাড়ির ভিতরে আমি রয়েছি আরামে, দুর্যোগের তাণ্ডব এড়িয়ে। মনের মত গান একটা আসরের অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করল উয়োকো বেতার কেন্দ্র থেকে। হঠাৎ ইষ্ক স্পটস সম্প্রদায়ের গলায় শোনা গেল আমার স্বপ্ন তরীটি দোলায় কে? গানটা শোনা মাত্রই পাঁচ বছর আগের একটা স্মৃতি আমার কাছে ভেসে উঠল। টেমস নদীর বুকে ছোট্ট একটা শালতিতে কিংস ইয়ট পেরিয়ে দূরে–উইন্ডসর ক্যাসেলকে বায়ে রেখে বেয়ে যাবার কথা মনে পড়ল। ডেরেক প্যাডল করে শালতিটা চালাচ্ছিল, আর আমি চালাচ্ছিলাম ছোট রেকর্ড প্লেয়ারটা। মোট দশটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। কিন্তু যখনই ইস্পটের লং প্লেয়িংটা চালাছিলাম, তখনই স্বপ্ন তরীর গানটা শেষ হতেই ডেরেক বলেছিল গানটার এই জায়গাটা আবার চালাও না ভিভ। আর আমাকে হাঁটুমুড়ে বসে, রেকর্ডে যেখানে গানটা আছে সেখানটা আন্দাজ করে গ্রামোফোনে একটা পিন বসিয়ে দিতে হচ্ছিল।

আমার দুটো চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল, তা ডেরেকের জন্য নয়। তা দুটি যুবক যুবতীর প্রেমের মূর্ত স্মৃতিগুলির জন্য। প্রথম প্রেমের সেই মধুর সঙ্গীতগুলি ক্যামেরায় তোলা অদৃশ্য মুহূর্তের ছবি, প্রণয় চুম্বনের ওষ্ঠাধর চিহ্নে সীলমোহর করা প্রেমপত্রগুলির জন্য।

হারানো শৈশবের অনুভূতি তার যবনিকা থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। আর তারই জন্য আমার চোখ থেকে পানি গাল বেয়ে পড়ছিল। ঠিক করলাম পানি না মুছে কিছুক্ষণ স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকব।

আমার নাম ভিভিয়েন মিশেল। এখন সুদূর অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করছি ড্রিম পাইলস হোটেলে বসে।

সেই সময় আমার বয়স তেইশ। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট; অ্যাস্টর হাইসের ইংরেজিনীদের মুখের ভাষায় আমার পাছা নাকি বেশ বড়, আর আমার নাকি আরো টাইট ব্রা পরা উচিৎ। এগুলিতো শুনতাম, তাছাড়া আমার নিজের ধারণাও যে আমার ফিগার বেশ ভাল।

আমি একটু আগেই বলেছি যে আমার চোখ নীল বর্ণের, মাথার চুল ঢেউখেলানো গাঢ় বাদামী বর্ণের।

গালের হাড় একটু উঁচু, তবে সেটা আমার পছন্দ। যদিও সেই ইংরেজিনীরাই আমাকে পরদেশী পরদেশী বলেছিল–আমার নাক ছোট্ট কিন্তু মুখ বেশ বড়। তাই আমাকে নাকি খুব সেক্সি দেখায়। এমন কি যে সময় আমি কোন যৌন চেতনা অনুভব করি না তখনও। আমার স্বভাব কিছুটা দুরন্ত প্রকৃতির, সেই জন্য কনভেন্টের মিস্টারদের চিন্তিত করে তুলেছিল। তারা আমাকে বলতেন মেয়েরা হবে উইলো গাছের মতন নরম ভিভিয়েন, ছেলেদেরই মানায় অ্যাস গাছের মত শক্তপোক্ত হওয়া।

ফরাসি ক্যানাডীয় রক্ত আমার। কুইবেকের বাইরের চর ইল দর্লিয়ানের উত্তর উপকূলে সঁাৎ ফাঁসিয়ে নামে একটি ছোট্ট চরে আমার জন্ম হয়েছিল। সেন্ট লরেন্স নদী যেখানে কুইবেক প্রণালীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানের নদীর মাঝ বরাবর এই লম্বা চরটা জেগে উঠেছে বিশাল একটা নিমজ্জিত জাহাজের মত।

এই নদীর পাড়েই বড় হয়েছি আমি। কাজেই আমার শখ সাঁতার কাটা, মাঝধরার তাঁবু নিয়ে বেড়ানো আরো অনেক বহিরঙ্গ।

মা বাবাকে আমার ঠিক মনে পড়ে না। খুব ছোটবেলাতেই তারা দুজন মারা যান। খুব সামান্য মনে পড়ে আমি বাবাকে খুব ভালবাসতাম, মার সঙ্গে ঠিক বনিবনা হত না। আমার যখন আট বছর বয়েস তখন একটি বিয়ে বাড়ির নেমন্তনে যাবার পথে প্লেনক্র্যাশে তারা মারা যান। কোর্ট থেকে আমার বিধবা ফুফু আমার অভিভাবিকা নিযুক্ত হয়ে আমাকে মানুষ করার দায়িত্ব নেন। খুব ভালভাবেই আমরা পরস্পরকে চিনেছিলাম। আমার ফুফু প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাকে ক্যাথলিক মতেই মানুষ করেন। পাকা পনেরো বছর পর্যন্ত আমি উরুসুলিন কনভেন্টে পড়াশুনা করি। এরপর ঠিক করলাম যে, আমি ষোল বছর বয়সেই ইংল্যান্ড যাব। আমার এই মতটি আমাদের অঞ্চলে বেশ সোরগোল তুলেছিল।

ভিক্টোরীয় যুগের শেয়ার বাজারের মত দেখতে মানিংডেন এলাকার মিড ফ্রেডগোন্ডের অ্যাস্টর হাউসটা। বাড়িটার ওপরের তলাগুলি পঁচিশ জোড়া মেয়ের শোবার ঘর বানাবার জন্য আস্টার বোর্ড দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। পরদেশী হবার জন্য বাহমূলে প্রচুর চুলের গুচ্ছ জনৈকা লেবানন দেশীয়া পরদেশীকে আমার রুমমেট হিসাবে চিহ্নিত করা হল। তার দুটি বিষয়ের প্রতি উৎকট আকর্ষণ ছিল একটি চকলেট ভক্ষণ আর অন্যটি একজন মিশরীয় চিত্রতারকা বেন সৈয়দের প্রতি।

আমি ঐ লেবানন কন্যাটির জন্যই বেঁচে গিয়েছিলাম। সে ছিল প্রচণ্ড খিটখিটে বদমেজাজী প্রকৃতির। নিজের টাকার ব্যাপারে এমনি সে ছিল মত্ত, যে স্কুলের প্রায়ই সবাই সহানুভূতি দেখিয়ে যেত, আবার অনেকে দেখাতোও না। বিশেষ করে কানাডার মেয়ে হবার জন্য, তাছাড়া ভুল উচ্চারণের জন্য, ভুল শিষ্টাচারের জন্য আমার চালচলন আদবকায়দার অভাবের জন্য আমাকে যন্ত্রণায় ভুগতে হত।

পরিবেশ মানুষকে বিভিন্নভাবে শিক্ষা দেয়। আমার স্বভাব ছিল যা কিছু করব তা চট করে করব। কাজেই বেশি মাত্রায় অনুভূতিশীল হবার জন্য কিছুতেই পেছনে লাগা ব্যাপারটাকে বরদাস্ত করতে পারতাম না। প্রথম প্রথম কয়েকজনকে এমন শিক্ষা দিয়েছি যে ওরা কেউ আর একা আসতে সাহস পেল না। তখন কয়েকজন মিলে দল পাকিয়ে রোজ রাত্রে এসে আমাকে চেপে ধরে ঘুষি খামচি, পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানাভাবে আমাকে বিব্রত করতে লাগল। আমি তখন ঠিক করলাম আর একা লড়াকু হরিণের মত লড়ব জনা। তাই একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা হবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে চুপচাপ মনমরা হয়ে বসে থাকতে শিখলাম। ছুটির দিনগুলি সবকিছুর ক্ষতিপূরণ করে দিত। ঠিক আমারই মত খোলা আকাশের নিচে পায়চারি করে অবসর যাপন করত স্কটল্যান্ডের একটি মেয়ে সুমান ডাফ। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করলাম। সে ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য ওর বাবা মা আমার উপর বেশ খুশিই হয়েছিলেন। শেষে স্কুল থেকে বেরোবার পর অ্যান্টি ফোরেন্স পার্ক হোটেলে যুগল নৃত্য পাঁচশ পাউন্ড দিয়ে প্রযোজনা করলাম, সেই সময় আমি ওর সঙ্গে ছিলাম তখন কতগুলি অর্থহীন নৃত্য দেখেছিলাম। কানাডার যেসব। যুবকদের দেখেছিলাম, তারা ছিল রুক্ষ্ম ও অপুরুষোচিত।

এই সময়েই ডেরেকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

আমার বয়স সাড়ে সতের বছর। আমি তখন সুমানের সঙ্গে কিংস রোডের ওল্ডচার্চ স্ট্রিটে একটা তিন ঘরের ফ্ল্যাটে বাস করছিলাম। সময়টা জুনের শেষ, কাজেই নাচ গানের পক্ষে সময়টা অনুকূল নয়, তাই আমরা ঠিক করেছিলাম যে পরিচিতদের মধ্যে যাদের অনুষ্ঠানটা ভাল লেগেছিল তাদের নিয়ে সত্যি একটা পার্টি করব। আমাদের ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের লোকজন সেই সময় ছুটি কাটাতে বিদেশে যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল ফ্ল্যাটটা ব্যবহারের জন্য পাব, যদি ফ্ল্যাটটার উপর খেয়াল রাখি তাহলে।

আমরা যে সব পার্টিতে যেতাম সেইগুলির উপযুক্ত হতে গিয়ে আমাদের হাত প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল। অ্যান্টি ফ্লোরেন্সকে জানাতে উনি আমাকে একশ পাউন্ড পাঠালেন আর সুমানও সব ঝেড়েঝড়ে প্রায় পঞ্চাশ পাউন্ড জোগাড় করল, বেশ ভাল করেই পার্টিটা দেব ঠিক করলাম। জনা তিরিশ জনকে বললাম আমরা ভেবেছিলাম এর মধ্যে কুড়িজন হয়ত আসবে, তাই আঠারো বোতল শ্যাম্পেন কিনলাম–গোলাপী। কারণ, ওটাই সব থেকে উত্তেজক।

পার্টিটা দারুণ সাফল্য এনেছিল। তিরিশ জনের সবাই এসেছিলেন, এমন-কি এক ভদ্রমহিলাকে দেখলাম, তিনি একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সিঁড়িতে বসেছেন। গাদাগাদি করে অনেককেই সিঁড়িতে বসতে হয়েছিল সেদিন। কিন্তু সব থেকে বাজে ব্যাপারটা ঘটল ঠিক সেই সময়েই। উন্মাদনা যখন চলছিল পুরোমাত্রায় ঠিক সেই সময় পানীয়ের সবকটা বোতল শেষ হয়ে গেল। এর মধ্যে একজনের গলা থেকে বেরিয়ে আসল পানি পানি! না পেলে ইংল্যান্ডকে আমি আর দেখতে পাব না।

আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম, বোকার মত বলে উঠলাম তাইতো পানি যে আর একটুও নেই।

দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক তা শুনতে পেয়ে এসে বলল নিশ্চয়ই আছে, আপনি নিশ্চয়ই ভাড়ারটা দেখতে ভুলে গেছেন। এই কথা বলেই আমার কনুইটা ধরে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এল। বলল, চলুন এমন আসরটাকে পস্তাতে দেওয়া যায়? কাছের বার থেকে আরও দুটো কিনে আনি।

তাড়াতাড়ি গিয়ে দু বোতল জিম আর হাত ভর্তি লেমন নিয়ে ফিরলাম। আমার সঙ্গী জোর করে লেমনের দাম দিয়ে দিলেন। কাজেই বাধ্য হয়েই লেমনের দাম আমি নিলাম। আমার সঙ্গীটি বেশ আনন্দেই ছিলেন। তিনি সুমানের নর্মান বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন জানাল। আরও জানায় তার নাম ডেরেক ম্যালাবী।

আমি ওর কথায় কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটছিলাম আসরে কখন পৌঁছব। বাইরে থেকেই উল্লাসের ধ্বনি শুনতে পেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলন মেলা ভেঙে গেল। সেই সুন্দর নর্মান দম্পতিরাও চলে গেল, যাবার সময় ডেরেককে বলে গেল, ঘরের চাবি কোথায় আছে।

ডেরেক আমার চুলগুলোকে সরিয়ে কানের সামনে মুখটা এনে ফিসফিসে ভরাট গলায় বলল, আমি তার সঙ্গে বেরোব নাকি? সুমানটাও ঠিক সেইসময় রাস্তার ওদিকে গেপোটে আছে যেখানটা সম্পর্কে কোন কৌতূহলই আমার ছিল না। যাই হোক আমরা বেরিয়ে গেলাম।

একটা ট্যাক্সিভাড়া করে দা বায়ু নামে একটা স্পটোটি হাউজে নিয়ে গেল। সেখানে খেতে খেতে সে জানাল তার বয়স আঠার। স্কুলের এটাই তার শেষ বছর। উইন্ডসরের কাছেই সে থাকে।

ক্রিকেটে একাদশ টিমের মধ্যে ও আছে। ও জানাল ওর খালা মারা গেছেন, তিনি মারা যাবার সময় কিছু অর্থ ওর নামে রেখে গেছেন। সেগুলিকে উদ্ধার করার জন্য আজ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই তাকে লন্ডনের বড় বড় উকিলদের পিছনে দৌড়ে বেড়াতে হবে। ওর বাবা মা সকালটা ওর সঙ্গে কাটিয়ে এম. সি. সি.-র খেলা দেখতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে নর্মানদের কাছে ওকে রেখে উইন্ডসরে ফিরে গেছেন।

ডেরেকের আসলে থিয়েটার দেখতে যাবার কথা ছিল তারপরে ঘুম। কিন্তু আমার দেওয়া পার্টিটা এসে জোটায় সবকিছুই অন্যরকম হল। হঠাৎ আমাকে বলে বসল, এখন ফোর হানড্রেড-এ গেলে হয় না?

আমি তো অবাক, ফোর হানড্রেড লন্ডনের সেরা নাইট ক্লাব। আমি নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা বললাম, অ্যাস্টর হাউজকে নিয়ে হাসাহাসি করলাম। রেস্তোরাঁর বিল আসার পর দেখলাম ও ঠিক জানে কত বকশিস দিতে হবে। মনে হল স্কুলের ছাত্র হবার জন্য বড় বেশি লায়েক হয়ে গিয়েছে। ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলের ছাত্ররাই বড় তাড়াতাড়ি। লায়েক হয়ে ওঠে। ট্যাক্সিতে উঠে ও আমার হাতটা ধরল, ঘটনাটা আমার কাছে তেমন আজব বলে মনে হয়নি।

ফোর হানড্রেডের লোকেরা দেখলাম অনেকেই ওকে চেনে। ও দিন টনিক দিতে বলল। আধ বোতল জিন দিয়ে যায় টেবিলে। মনে হচ্ছিল বাকি অর্ধেকটা ওই আগে খেয়ে গেছে এখানে।

মঞ্চ থেকে একটা মিষ্টি কোমল সুরের বাজনা আসছিল ভেসে। আমরাও নেচে উঠলাম আনন্দে। নাচে তাল মেলাতে কোন অসুবিধাই হল না। মনে হল যেন একেবারে নিজেরই তৈরি সুর।

সত্যি সত্যি প্রমোদে ভরে উঠেছিল আমার হৃদয়, ওর কালো চুল সুন্দর কপালের পাশে, ওর হাসিভরা মুখ সুন্দর হাত দুটি সবই আমার কাছে আনন্দের অনুভূতির কারণ হয়েছিল।

ভোর চারটে পর্যন্ত আমরা নিশিকুঞ্জে ছিলাম, তারপর বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় যখন পা দিলাম তখন বুঝতে পারলাম আমি হাঁটতে পারছি না, আমার ওকে ধরে চলতে হচ্ছে। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলাম। ট্যাক্সিতে ও আমাকে আবেগে একটু চুম্বন দিল, প্রতিদানে আমিও দিলাম, গোটা ব্যাপারটাই ছিল স্বাভাবিক।

আমার বুকের উপর ও দু বার হাত রাখল আর আমি দু বারই ওর হাত সরিয়ে দিলাম। তৃতীয়বারে এরকম প্রত্যাখ্যান করাটা ভারি অস্বস্তি হত আমার পক্ষে।

ও তৃতীয়বার যখন হাতটা ছোঁয়াল, তা নামিয়ে আনল আমার শরীরের নিচের দিকে। ওকে সেই সময় আমি বাধা। দিলাম। না এ আমি দিতে পারি না। যদিও আমার সারা শরীর আকাক্ষার উত্তাপে উষ্ণ হয়ে উঠেছিল।

সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, কারণ সেই সময়ই পৌঁছে গেলাম আমার ফ্ল্যাটের সামনে। ও বেরিয়ে এসে দরজা পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেল।

আমি বললাম আবার দেখা হবে। ও বলল চিঠি লিখবে।

ও যখন আমাকে বিদায় চুম্বন দিচ্ছে তখন ওর হাত দুটো আমার পিঠে ঘুরে নেমে আসে শ্রোণীদেশে। আর আমার শরীরের মাংসল স্তূপটাকে দুটি হাতের মুঠোর মধ্যে আনার চেষ্টা করে। ওর ট্যাক্সি চলে যাবার পরও মনে হচ্ছিল ও আমাকে ঐরকমভাবে আবেগে নাড়িয়ে ধরে রয়েছে।

কিছুক্ষণ বিছানায় গুঁড়ি মেরে পড়ে থাকার পর বেসিনের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখলাম। আমার মুখ চোখ যেন ভীষণভাবে কোন জ্যোতিতে জ্বলজ্বল করছে। খুব সম্ভব জনের প্রভাবটাই এরজন্য দায়ী। তবুও সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, আমি সত্যিই প্রেমে পড়েছি। এ আমার প্রেম।

.

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

 এসব স্মৃতি মনে করতে সময় লাগে মাত্র তিন মিনিট কিন্তু লিখতে অনেক সময়ই লাগে। উয়োকো বেতার কেন্দ্রে তখনও মনের মতন গানের আসরটি শেষ হয়নি।

বরফগুলি শেষ হয়নি, বরফগুলি গলে গিয়েছিল, উঠে পড়ে বরফের বাক্স থেকে কিছু চৌখুপী নিয়ে গ্লাসের মধ্যে। নিলাম। অনেকক্ষণ বসে থাকব বলে খুব সাবধানে একমুখ ভর্তি করে বুরব নিলাম গ্লাসে চুমুক দিয়ে। আর একটা সিগারেট ধরালাম।

ডেরেকের শেষ বছরটা অতিক্রান্ত হল। আমরা দুজনে দু জনকে চারটে করে চিঠি লিখেছিলাম।

ওর চিঠিগুলো প্রথমে থাকত প্রিয়তমাসু আর শেষে থাকত ভালবাসা অনেক চুমু দিয়ে। ওর প্রত্যেকটা চিঠির বিষয় ছিল খেলার কথা, খেলায় কত রান করেছে। এবার কত রান করবে এইসব। আর আমি লিখতাম কোন নাচ দেখেছি কিনা, কোন সিনেমা দেখেছি কিনা। বাড়িতেই কাটাবে ও গরমের ছুটিটা। ওর বাবা ওকে একটা এম. জি. গাড়ি কিনে দেবে। সেই নিয়ে ও খুব উত্তেজিত। আমার কাছে জানতে চেয়েছে গাড়ি করে কবে ওর সঙ্গে বেড়াতে যাব।

আমি ওর সঙ্গে স্কটল্যান্ডে না গিয়ে কয়েকদিনের জন্য হলেও আমি ওর সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকতে চাই। কথাটা শুনে অবাক হল সুমান। সুমানকে ডেরেকের কথা আমি জানাইনি। আমাদের মধ্যে আমিই আগে ঘুম থেকে উঠি। সেইজন্য ও জানে না চিঠির কথা, কোন জিনিস গোপন করা আমার স্বভাব নয় তবু এইটাকে আমি গোপন করেছিলাম। ডেরেকের বান্ধবীদের সারিতে আমার স্থান জনৈকার। ডেরেকের প্রতি আকর্ষণের জন্য আমি স্কুলের ছাত্রী হয়েও লন্ডনের সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত মেফেয়ার এলাকায় মেয়েদের মত মেয়েরা অর্গান্ডির পোশাক পরে লম্বা একটা সারি দিয়ে ওর হুকুম তামিল করার জন্য একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সুমানকে শুধু বললাম একটা চাকরির খোঁজে বেরোব। নির্দিষ্ট সময়ে সুমান উত্তরাঞ্চলে চলে গেলেই ডেরেকের চিঠি এল। তাতে লেখা ছিল পরের শনিবার আমি উইন্ডসর স্টেশনে যেতে পারব কিনা? আর সেই সময় থেকেই শুরু হয়। একটা মিষ্টি সাপ্তাহিক সাক্ষাতের পালা।

 প্রথমদিন ও এসে আমাকে অভ্যর্থনা করল। আমিও লাজুক লাজুক হয়ে উঠলাম। পরে ও গাড়িটার কাছে নিয়ে যায়। গাড়িটা সত্যি খুব সুন্দর। গাড়ির ভেতরে লালকালো চামড়ার গদি আঁটা। এ ছাড়া প্রায় সবকিছুই অত্যাধুনিক উন্নত মানের। গাড়িতে আমাকে নিয়ে ডেরেক মনের আনন্দে গাড়ি চালাতে শুরু করল। ছোটখাট গলি থেকে বেরোবার মুখে এমন ভাবে বাঁক নিচ্ছিল যেন মনে হচ্ছিল কোন রেসের মাঠে নেমেছে। ঘণ্টায় প্রায় পঞ্চাশ মাইল জোরে ও ছুটে চলেছে, আমি ভাবছিলাম ভালোয় ভালোয় যাত্রাটা শেষ হোক, তবে সারথিতে ভালো পেয়ে ভরসা হচ্ছিল।

ডেরেক হোটেল দ্যা প্যারিস নামে খুব সুন্দর একটা কেতাদুরস্ত জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানে মৈকা স্যামন মাছ, মুরগির রোস্ট আর আইসক্রিম নিলাম। এর কাছে নৌকা। আমরা বিদ্যুৎচালিত একটা শালতি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। ডেরেক একটা পথচলতি গ্রামোফোন এনেছিল। শালতিটায় প্রথমে বসেছিলাম, পরে আমরা পাশাপাশি দু জনে শুয়ে পড়লাম। খুব সুন্দর ছিল সেই অপরাহ্ন বেলা। আমরা চুমু খেলাম। কিন্তু বেশি এগোলাম না। এটা ভাল লাগল ডেরেক আমাকে সহজলভ্য ভাবেনি। শালতিতে করে স্রোতের পিছনে পিছনে চলতে লাগলাম। কিছু পরে ডাঙ্গায় উঠে দ্যা থাচেস হাউস নামে একটি পান্থশালায় কফি আর ডিমের ঝুরিভাজা খেলাম। খাবার পর ডেরেক বলল। এখন সিনেমায় গেলে বেশ হয়।

দ্য রয়্যালটি সিনেমা হলে আমরা ঢুকলাম। বারো শিলিং দিয়ে ওকে বক্স টিকিট কাটতে দেখলাম। প্রোজেকশন রুমের দু পাশে দুটো বক্স। এক একটা বক্সে ছ ফুট পরিমাণ জায়গায়। পাশাপাশি দুটো চেয়ার। ওর চেয়ারটা আমার চেয়ারের কাছে নিয়ে আসল, কাছে বসে চুমু খেতে খেতে সারা শরীরে ওর হাতের ছোঁয়া ছড়িয়ে দিতে লাগল।

প্রথমে খুব খারাপ মনে হল ও কি ওর সব মেয়ে বন্ধুদের এখানে নিয়ে আসে, তারপর যাকে বলে দ্রবীভূত হওয়া তাই হলাম।

ওর হাত তখন আমাকে আবিষ্কার করে চলছিল। ওর স্পর্শ ছিল মৃদু এবং ওয়াকিবহাল। কিন্তু নেহাত্র একটি অপরিচিত জায়গা আমার ভীষণ লজ্জা করছিল। আমি ওর কাঁধে মুখ লুকালাম। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলাম মধুর একটা শিরশিরানীতে, ব্যস ওর কাজ শেষ। শরীরের সমস্ত কোষগুলি যেন উত্তাপে ভরে গিয়েছিল। চোখের পানিতে ওর কলার ভিজে গেল। আমাকে মিষ্টি একটা চুমু দিয়ে বলল ও আমাকে খুব বেশি ভালবাসে। সিনেমার বিরতির সময় ও একটা আইসক্রিম নিয়ে আসে আর আমি ভাবি যে কৌমার্য আজ হারিয়েছি তাতে সে আর কখনো সম্মান করবে না। যাক পুরুষদের কথায় আর ভুলব না। ফেরার ট্রেনের জন্য ও আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিল। ঠিক হল পরের শনিবার ঠিক সময়ে আমরা দেখা করব। এরই মধ্যে এসে গেল সেপ্টেম্বরের শেষ শনিবার।

সোমবার সুমান ফিরে আসবে আর আমাদের সম্পর্কের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করবে। আমার একটা চাকরির কথা হয়েছে। ডেরেক অক্সফোর্ডে পড়তে যাবে! আমরা ঠিক করেছিলাম ব্যাপারটা যেমন চলছে তেমনই চলবে। হয়। আমি অক্সফোর্ডে যাব নতুবা ডেরেক লন্ডনে আসবে।

ডেরেক সারা সপ্তাহের বৈচিত্র্যহীন দিনগুলির মধ্যে শুধু শনিবারের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে। সেদিন ডেরেক একটু বেশি করেই অনুরাগরঞ্জিতভাবে এসেছিল। ও আমাকে ব্রিজ হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানে তিন রাউন্ড জিন টনিক খেলাম, এরপর ডিনারের সঙ্গে শ্যাম্পেন খেলাম। তারপর সিনেমা হলটায় গিয়ে পৌঁছালাম। আমাদের দু জনেরই একটু ধরেছে। এটা ভাবলাম যে আগামীকাল থেকে আবার ছকবাধা জীবন কাটাবে হবে। কিন্তু নিয়মমত ও আমাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল না, আমি ওর হাতটা ধরলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে, কি ব্যাপার।

পর মুহূর্তে জেদী গলায় ও বলল, আমি তোমার সঙ্গে শুতে চাই। শোয়া বলতে যে অর্থ বোঝায় সেই অর্থের কথাটা বলেছি।

কণ্ঠস্বরের রুক্ষতায় চমকে উঠলাম। এই ব্যাপারে আগে কথাবার্তা হয়েছিল। প্রতিবারেই এটা আমরা মেনে নিয়েছিলাম যে, এই ব্যাপারটা পরবর্তী সময়ে আসবে। কিছুটা হতভম্ব হয়ে আমি আগেকার যুক্তিগুলি ব্যবহার করলাম। আমাদের শেষ সন্ধ্যাটিকে কেন সে নষ্ট করে দেবে? সে পাল্টা তর্ক করল। আমি নাকি পোক্ত কুমারী এটা ওর পক্ষে খারাপ। প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে কেন আমরা প্রেমিক প্রেমিকার মত আচরণ করব না। আমি বাচ্চাকাচ্চা হবার ভয়ের কথাটা বলাতে সে নির্ভয়ে বলল, সে ব্যাপারে সোজা পথ আছে। এখানকার অসুবিধার কথা বলে আমি আটকাতে চেষ্টা করলাম। এখানে কোন মতেই কাজটা করা সম্ভব নয়।

সে বলল এখানেই সম্ভব, এখানেই বেশ জায়গা রয়েছে।

অক্সফোর্ডে যাবার আগেই কাজটা সমাধা করে যেতে চায় ও। এটা এক ধরনের বিয়ের মত।

কথাগুলি ভাবতে ভাবতে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ভালবাসার ওপরে এটা হবে সীলমোহরের মত। আমার ভয় করছিল।

ইতস্তত করে বললাম, সে সব জিনিস সঙ্গে আছে নাকি? সে বলল না। তবে এখানে একটা ওষুধের দোকান সারা। রাত খোলা থাকে, সেখানে থেকে কিনে আনবে। আমাকে চুমু খেয়ে আগ্রহের সঙ্গে উঠে বক্স থেকে বেরিয়ে গেল।

অর্থহীনভাবে পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর ফেরানোর উপায় নেই। সে এই এল বলে। এই নোংরা সিনেমার নোংরা বক্সে সেটা হবে সাংঘাতিক কেলেঙ্কারী। পিছিয়ে যাওয়ার জন্য হয়ত পরে আমাকে ঘেন্না করবে ও আঘাত পাবে। একটা ঝোঁক এল এখান থেকে উঠে পালিয়ে গিয়ে স্টেশন থেকে পরের ট্রেন ধরে লন্ডনে ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু তার ফলে ও দারুণ খেপে যাবে। ওর অহমিকা ক্ষুণ্ণ হবে। খেলার নিয়মভঙ্গ হবে। দু জনের রঙ্গ যা আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি, তার ছন্দ তরঙ্গ বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে।

ওকে এ থেকে বঞ্চিত রাখাটা কি সঙ্গত? হয়ত পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাপারটা না পাওয়ার, ওর পক্ষে সত্যি খারাপ হচ্ছে। সম্ভবত ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলা ভাল, ওকে রাগিয়ে না তোলার জন্য আমি ভাবতে লাগলাম।

দরজাটা ফাঁক হল এবং লবি থেকে একটা আলোক রেখা এসে ঢুকল। একটু পরে আমার পাশেই ও এসে হাজির। ফিসফিস করে জানাল পেয়ে গেছে। কাউন্টারে একটা মেয়ে বসেছিল। অনেক চিন্তা করে মেয়েটাকে বাচ্চা না হবার একটা জিনিস দিতে বললাম, কোন ধরনের জিনিসের দরকার, সে জানতে চাইল। আমি বললাম সবচেয়ে দামীটা। অন্য কিছু সে জিজ্ঞাসা করে বসবে আমার চিন্তা হল।

হেসে উঠে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ও।

উত্তরে আমি শুধু দুর্বলভাবে হাসলাম।

 খেলা হিসাবে নেওয়াই ভাল, এ নিয়ে নাটক না করাই ভাল।

এমন তাড়াহুড়ো করা যে আমাকে তো প্রায় কাঁদিয়ে ফেলল। তারপর বক্সের পেছনে ওর চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে দিল, গায়ের কোট খুলে মেজেতে বিছানা পাতল। আমাকে তার পাশে শুতে বলল।

আমার সমস্ত প্রবৃত্তি তখন যে কোনভাবে ওকে সাহায্য করল। হঠাৎ এক রাশ হলুদ আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, আমার সিনেমাটাকে তোমরা কি একটা নোংরা জায়গা পেয়েছ?

ডেরেকের মুখ কাগজের মত সাদা। উঠে দাঁড়ালাম। বক্সের দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা লেগে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

দাঁড়ানো ছায়ামূর্তি আমার ব্যাগ আর তার পাশে আমার প্যান্টির দিকে নির্দেশ করল।

মাথা নিচু করে মার খাওয়া লোকের মত সেগুলো তুলে নিলাম।

 ছায়ামূর্তি আবার তীব্রস্বরে নির্দেশ দিল, এবার দূর হয়ে যাও।

ম্যানেজার আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। বিশ্রামকক্ষ থেকে কয়েকজন লোক তাকিয়ে দেখল। ভয়ে আমি আঁতকে উঠলাম।

ম্যানেজার সাহেব স্থুলকায়, বাদামী রঙের মানুষ।

আমাদের অবলোকন করতে করতে তার মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল।

-নোংরা খুদে বাচ্চারা।

আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি বাজারের মেয়েছেলের বেশি কিছু নও। পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল। অশ্লীলভাবে Mr-বে শান্তি ভঙ্গ করা।

তোমাদের নাম কি?

তোতলাতে তোতলাতে ডেরেক বলল, জেমস্ গ্রান্ট ছবিটা ক্যারী গ্রান্ট অভিনীত। চব্বিশ অ্যাকাসিয়া রোড়, নেটলবেড।

নেটলবেডে হেনলে অক্সফোর্ড রোড ছাড়া তো কোন রাস্তার নাম নেই।

 হ্যাঁ, আছে পেছনের দিকে।

ডেরেক জোর দিয়ে বলল। মানে অনেকটা লেনের মতই।

সন্দেহের চোখে ম্যানেজার আমার দিকে তাকাল। আমার মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল। কোন রকমে বলে ফেললাম।

– মিস টমসন, আড্রে টমসন, চব্বিশ ডেরেকের ঠিকানাই যে নম্বরটা বলেছিল এটা তার সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে তবু অন্য নম্বর মনে এল না

আর কি- রোড লন্ডন।

–ডিসট্রিক্ট? শব্দটা দিয়ে সে কি জানতে চায় বুঝতে না পেরে হতাশ ভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।–পোস্টাল ডিসট্রিক্ট অধীরভাবে সে জিজ্ঞেস করল।

-এস ডব্লু। ড।

নোট বইটা বন্ধ করেই ম্যানেজার বলল–ঠিক আছে–বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তোমরা দু জনেই। ত্রস্তভাবে আমরা তার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।

আর কখনো আমার হলে আসবে না। তোমাদের দুটোকেই আমি চিনি। আবার যদি এখানে দেখি পুলিশে খবর দেব।

উজ্জ্বল আলোর ভিতর দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। নিজের থেকেই যেন ডানদিকে মোড় নিয়ে পাহাড়ী পথে নামতে লাগলাম যাতে দ্রুততর বেগে পা চালাতে পারি। একটা শাখা পথ না পাওয়া পর্যন্ত এক নাগাড়ে হেঁটে গেছি।

গাড়ি পর্যন্ত ডেরেক একটাও কথা বলেনি।

এখন ভারিক্কী গলায় বলল, গাড়ির নম্বর নিতে ওদের দেব না। আমি একাই গাড়িটা নিয়ে এসে উইন্ডসর হিল এ ফুলের এর দোকানের উল্টো ফুটপাথ থেকে তোমাকে তুলে নেব। মিনিট দশেকের মধ্যে।

ওর হাত মুক্ত করে রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠে গেল।

ওর অপসৃয়মান দীর্ঘকায় সুপুরুষ আকৃতি দেখলাম–যা একদা ছিল গর্বিত ও ন্যায়বান।

একটা লাইট পোস্টের নিচে থেমে ব্যাগ থেকে আয়নাটা বের করলাম।

 কি বিচ্ছিরি চেহারা হয়েছে আমার।

আমার সারা গা অপরিচ্ছন্ন, অপবিত্র, পাপে মাখা। আমাদের কি হবে? লোকজন আমাদের নোংরা বলছে। পেছনের চুলগুলো এলোমেলো অগোছালো, মুখের উপর ডেরেকের চুম্বন চিহ্ন। দেখে আঁতকে উঠলাম।

নোংরা শুয়োর একেবারে সঠিক বর্ণনা। লোকটা কি পুলিশ লাগিয়ে দেবে আমাদের পেছনে। গত শনিবার বা আজ। শনিবার নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আমাদের মনে রেখেছে। গাড়ি নম্বর মনে রেখেছে। অপরাধমূলক প্রতিটা ঘটনাতেই গাড়িরক্ষক এসে হাজির হবেই।

হ্যাঁ তাই তো। রক্ষণশীল ইংল্যান্ডের পক্ষে তো নারকীয় অপরাধ যৌনতা, নগ্নতা, অশ্লীলভাবে গা বেআব্রু করা। আমি কল্পনা করে আঁতকে উঠলাম, এই ভেবে ডেরেক আমার শরীরের ওপরে উঠেছে এই দৃশ্য ম্যানেজার দেখেছে।

কিন্তু এর মধ্যেও আমার হাত দুটো সক্রিয়ভাবে মুখটাকে পরিষ্কার করার জন্য কাজ করছিল। যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে পাঁচিলের দেওয়াল ঘেঁষে উইন্ডসর হিলের দিকে রওনা দিলাম। আমার মনে হচ্ছিল লোকেরা এক্ষুনি আঙুল তুলে দেখিয়ে বলবে ওই তো যাচ্ছে নোংরা শুয়োর দুটি।

.

প্রিয় ভিড

সেই নিদাঘ রজনী আমার পক্ষে তখনো শেষ হয়নি।

ফুলারের দোকানের উল্টোদিকের ফুটপাথে পুলিশের একজন সার্জেন্ট ডেরেকের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিল। ডেরেক ফিরতেই আমাকে দেখতে পেল।

-এই যে উনি এসে গেছেন, সরে, কেমন আমি বলিনি, এক মিনিটের মধ্যে উনি এসে পড়বেন। এই বাথরুম টাথরুম খুঁজে দেখার জন্য, মানে এই আর কি। তাই না লক্ষ্মীটি?

আরো ঝঞ্ঝাট! আরো মিথ্যার ঝুড়ি। আমি দমবন্ধ করে বললাম, হ্যাঁ। তারপর গাড়িতে উঠে ডেরেকের পাশের সিটে বসে পড়লাম। সার্জেন্ট ভদ্রলোক চতুর দৃষ্টিতে আমাকে দেখে দত্ত পাটি বিকশিত করে হাসলেন-ঠিক আছে। তবে পরের বার মনে রাখবেন এই উহভসর হিলে গাড়ি দাঁড় করাবার নিয়ম নেই। এমন কি ওরকম জরুরী কাজের অজুহাতেও নয়।

ডেরেকের উদ্দেশ্যে কথাগুলি বলে তিনি গোঁফে আঙুল বুলাতে লাগলেন। সার্জেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং একটা বাজে রসিকতার রস পেয়েছে এমনভাবে চোখ টিপে, ও গাড়িতে গিয়ার দিল। শেষ পর্যন্ত আমরা রেহাই পেলাম।

একেবারে নিচের আলোকমালার ওখানে গিয়ে ডানদিকে মোড় না নেওয়া পর্যন্ত ডেরেক একটাও কথা বলেনি। প্রথমে ভেবেছিলাম যে ও আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে; কিন্তু দেখলাম ও ডাচেট রোড ধরেই এগিয়ে চলেছে! স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল–ফুঃ! একেবারে কানের পাশ দিয়ে তীর গেছে। ভেবেছিলাম একটা ঝামেলায় পড়ব। আগামীকালের কাগজে বাবা-মার পড়ার মত চমৎকার একখানা খবর বটে। আর অক্সফোর্ডেও অনায়াসেই এটা যেতে পারত।

-মারাত্মক, ভয়ঙ্কর ব্যাপার!

বলতে গিয়ে আমার গলায় এত বেশি আবেগ ফুটল যে ও আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। তা বেশ। সত্যিকারের ভালবাসার পথ এবং অন্যদিকে ওই সব কাঁটা। ওর কণ্ঠস্বর বেশ সহজ ও হাল্কা শোনাল।

ও সামলে নিয়েছে। আমি যে ছাই কখন পারব ও কথার কথা বলছে এমনভাবে বলল, ধ্যাত্তেরী, লজ্জার নিকুচি করেছেবল? এখন আমরা সব ঠিকঠাক করে নেব।

গলায় বেশ উৎসাহ ঢেকে বলল, তোমাকে যা বলছি। ট্রেন আসতেই তো এখন একঘণ্টা দেরি আছে। এ সময়টা নদীর পাড়ে বেড়াই না কেন। উইন্ডসরের যুগলদের বেড়াবার জন্য এই জায়গাটা বেশ নামকরা। সম্পূর্ণ গোপন ও ব্যক্তিগত। সবকিছু এবং সময়, ওসব নষ্ট করতে মায়াই লাগে। আর আমুরা তো এখন মন স্থির করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমার মনে হল ওসব মানে সেই জিনিসটা যেটা ও কিনে এনেছিল।

আমি একেবারে থ মেরে গেলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, ওঃ। কিন্তু আমি আর পারি না, ডেরেক! সত্যিই, পারি। যা হয়ে গেল তা যে আমার কি ভয়ানক ভাবে লেগেছে, সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই।

চট করে আমার দিকে তাকিয়ে ও বলল, কি বলতে চাইছ? ভয়ানক শরীর খারাপ লাগছে, না অন্য কিছু হয়েছে?

–ওঃ তা না! এটা শুধু এই, যে ঘটনাটা বিশ্রী। শুধু ধোঁকাবাজি।

–ও তাই বল। ওর গলা বিদ্রুপাত্মক শোনাল। আমি তো সেটা কাটিয়ে উঠেছি; তাই না? এস। আরে মজা নিতে পারছ না!

আবার?

কিন্তু আমি চাইছিলাম সান্তনা পেতে, ওর বাহুবেষ্টনের মধ্যে স্বস্তি পেতে। যদিও ওর সবকিছুই গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তবে ও আমাকে ভাল যে বাসে সেটা ঠিক। তবু আবার আগের মত সব কিছু করতে হবে, এটা ভাবতেই আমার পা কাঁপতে শুরু করল। আমি দুহাত দিয়ে দু হাঁটু চেপে ধরলাম। সেই কাঁপুনি থামাতে। দুর্বল গলায় বললাম, আচ্ছা, বেশ…।

-ওই তো আমার লক্ষ্মীটি!

আমরা সেতু পেরিয়ে গেলাম; ডেরেক গাড়িটাকে এক পাশে এনে রাখল। বেড়া টপকাতে আমাকে সাহায্য করল। বেড়ার ওপাশের মাঠে নেমে ও আমাকে বাহু বেষ্টনে জড়িয়ে নিয়ে চলল নদীর ধার ঘেঁষে গুন টানার সরু পথ দিয়ে, উইলো গাছের নিচে নোঙর করা কয়েকটা বজরা পেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমাদের যদি এ-রকম একটা থাকত। একটার মধ্যে ঢুকে পড়লে কেমন হয়? তুলতুলে নরম জোড়া বিছানা। কাবার্ডে সম্ভব কিছু মালও আছে।

এই ডেরেক, না! অনেক ঝঞ্ঝাট হয়ে গেছে। আমি কল্পনায় একটা চড়া গলা শুনতে পেলাম…কি হচ্ছে ওখানে? এই বজরাটা কি তোমাদের সম্পত্তি নাকি, আঁ? বেরিয়ে এস, চেহারাটা একটু দেখাও দেখি চাঁদেরা।

ডেরেক হেসে উঠল, হয়ত তুমিই ঠিক বলেছ। যাই হক ঘাসও তো একই। দেখ, চমৎকার লাগবে। তখন আমরা সত্যিকারের প্রেমিকা হব।

-হ্যাঁ সেই ভাল, ডেরেক। তবে একটু বুঝেসুঝে, আস্তে। কেমন, মনে থাকবে তো? প্রথম বার অনভিজ্ঞতার জন্য আমি তো আর ভাল পারব না।

ডেরেক মুঠো চেপে আমাকে ধরল, মোটেও ভেব না। তুমি দেখ।

আগের চেয়ে ভাল লাগছিল। শক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম। চাঁদনী রাতে ওর সঙ্গে বেড়াতে ভারি ভাল লাগছিল। মাথার উপর ঝুপসী হয়ে কয়েকটা গাছ রয়েছে। আমার মন বলল ওখানেই কাজটা করা হবে। ওর জন্য আমি অবশ্য অবশ্যই কাজটাকে এবার সহজ এবং তৃপ্তিকর করে তুলব। আমি কিছুতেই উজবুকের মত হব না! কান্নাকাটি করব না।

ওই বৃক্ষপুঞ্জের মাঝখান দিয়ে পথটা চলে গেছে। ডেরেক চারপাশটা দেখে নিল তারপর বলল, ওর ভেতরেই, বুঝলে। আমি আগে যাচ্ছি। মাথা নিচু করে আমার পেছন পেছন এস। ডালপালার নিচ দিয়ে আমরা গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলাম। যাবার জন্য ছোট্ট একটা জায়গা পরিষ্কার রয়েছে। অন্যেরা আগে এসেছে এখানে। একটা সিগারেটের প্যাকেট, একটা কোকাকোলার খালি বোতল পড়ে রয়েছে। শ্যাওলা ও পাতাগুলি দলিত পিষ্ঠ। আমার মনে হল যে ওটা যে বেশ্যা বাড়ির বিছানা, যেখানে শয়ে শয়ে, হয়ত হাজারে হাজারে প্রেমিক প্রেমিকারা দেহভার স্থাপন করে। সুরভি দ্বৈরথে লিপ্ত হয়েছে। এখানে আর ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। এই ব্যাপারের জন্য অন্তত কুঞ্জটি নিশ্চয়ই ভাল।

ডেরেক অধীর হয়ে পড়েছিল। সে তার কোটটা খুলে আমার জন্য পেতে দিল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে দিল। প্রাণ জ্বরগ্রস্তভাবে তার হাত দিয়ে আমাকে যেন গোগ্রাসে গিলছিল। আমি একটু পিছন হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু স্নায়ু তখনো জমাট বেঁধে ছিল। আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাঠ কাঠ হয়েছিল। ভারি ইচ্ছা হচ্ছিল যদি কিছু শুনতাম, কিছু মিষ্টি প্রণয় প্রলাপ। কিন্তু ও একাগ্র হয়ে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে চলছিল, আমাকে যাচ্ছেতাই ভাবে, প্রায় পাশবিকভাবে, পীড়ন করে, যেন আমি একটা বয়স্কা ধুমসো যুবতী।

হে সৃষ্টিকর্তা, কি সব ঘটছে।

তারপরেই সূচিমুখ এক ঝলক যন্ত্রণা…একটুখানি ঝাঁকিয়ে ওঠা…আমি চট করে দম বন্ধ করে রইলাম। দেখি সে আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়ছে।

আমি দুহাত দিয়ে ওকে বেষ্টন করলাম। হাতে ওর ভেজা শার্টটি লাগল।

ওভাবে আমরা অনেকক্ষণ শুয়েছিলাম।

গাছের শাখা প্রশাখার ভিতরে দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জ্যোত্সা ঝরে পড়ছিল। আমি অশ্রুজল থামাতে চেষ্টা করলাম।

 তবে এই ব্যাপার?

মহান মুহূর্ত–যাকে আর পাওয়া যাবে না। এখন আমি নারী–অনাঘ্রাতা বালিকাটি রূপান্তরিত হয়েছে।

কই সুখ কোথায়–ওরা যেমন বলে, শুধু কষ্ট পাওয়া। কিন্তু কিছু থেকে যায়। আমার বাহুপাশে ধরা দেওয়া এই পুরুষটি। আমি তাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলাম। আমি তার, সম্পূর্ণভাবে তার, সে আমার, সে আমার। সে আমার ভার নেবে। আমরা দুজনে দুজনার। আর নিঃসঙ্গতা আমাকে পীড়ন করবে না। আমরা এখন থেকে যুগলবন্দী। ডেরেক আমার গালে চুমু খেল। আস্তে উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে দিল, স্কার্টের ঘাগরা নামিয়ে দিলাম। ও আমার হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। আমার মুখের দিকে তাকাল। ওর অল্প অল্প হাসিতে অস্বস্তি মাখা ছিল।

তোমার লাগেনি তো?

না। তোমার ঠিকঠাক হয়েছে তো?

ও হ্যাঁ, তাতো বটেই!

সে ঝুঁকে পড়ে কোটটা তুলে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল।

আরে, ট্রেন আসতে আর পনের মিনিট মাত্র বাকি। এখন রওনা হওয়াই ভাল।

স্থলিত পায়ে হেঁটে রাস্তায় এলাম। চলতে চলতে চুলে একটা চিরুনি চালিয়ে নিলাম। স্কার্টটা ঝেড়ে নিলাম। আমার পাশে পাশে ডেরেক নিঃশব্দে হাঁটছিল। চাঁদের আলোয় ওর মুখ এখন স্তব্ধ। ওর হাত জড়িয়ে ধরলেও সে কোন সাড়া দিল না আমার হাতে চাপ দিয়ে। আহা! যদি একটু ভালবাসার কথা এখন বলে, আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে কিছু। কিন্তু বুঝলাম সে যেন হঠাৎই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, কি শীতলতা! এ সব ব্যাপারের পরে পুরুষদের মুখে অভিব্যক্তি সম্পর্কে আমার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। নিজেকেই দোষারোপ করলাম, যথেষ্ট উপভোগ্য হয়নি ব্যাপারটা। আমি চেঁচিয়ে ছিলাম, ব্যাপারটা একেবারে নষ্ট করেই দিয়েছি।

গাড়ির কাছে এসে উঠে আমরা নিঃশব্দে স্টেশনের দিকে চললাম। প্রবেশ পথের কাছে ওকে থামাতে বললাম। হলদে আলোয় ওর মুখের রেখাগুলি টানটান ও ক্লিষ্ট দেখাচ্ছিল। আধখোলা চোখে ও আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, তুমি ট্রেনের কাছে যেও না। আমি দেখে যেতে পারব। পরের শনিবার কি হবে? আমি অক্সফোর্ড যেতে পারি। নয়ত একটু ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে নাকি।

ভিড়, মুশকিল হচ্ছে এই যে, অক্সফোর্ডে সব আলাদা ব্যাপার। দেখি কি হয়। আমি তোমাকে চিঠিতে জানাব।

নিজেকে বাঁচিয়ে ও বলল।

ওর মুখের অভিব্যক্তির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। সচরাচর আমাদের বিদায় মুহূর্তগুলি যেমন ছিল, তা থেকে এবারেরটা একেবারে আলাদা ধরনের। হয়ত সে ক্লান্ত। সৃষ্টিকর্তা জানেন আমিও তো! আমি বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তবে লক্ষ্মীটি, চিঠি দিতে দেরি করো না যেন। তুমি কেমন আছ জানার জন্য চিন্তা করব। কাছে গিয়ে ওকে চুমু খেলাম। ওর ঠোঁটে কোন সাড়া জাগল না। ও মাথা ঝাঁকাল, ভিড় তবে ততদিন…

এক ধরনের কষ্টকর হাসি মুখে ফুটিয়ে ও ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠল।

দু সপ্তাহ পরেই আমি সেই চিঠি পেলাম। দু-দুবার চিঠি দিয়েছি। উত্তর পাইনি। মরিয়া হয়ে একবার টেলিফোন করেছিলাম কিন্তু যে লোকটি ধরেছিল সে একটু পরেই এসে বলল যে মিস্টার ম্যালাবী বাড়ি নেই। 

চিঠিটা শুরু হয়েছিল এভাবে ও প্রিয় ভিড়, এই চিঠি পড়তে অন্য রকম লাগবে। এই অবধি পড়ে আমি শোবার ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি এটে, বিছানায় বসে সাহস সঞ্চয় করলাম। চিঠিতে তারপর ছিল–এই প্রথম চমৎকার ভাবে কেটেছিল গ্রীষ্মটা। সে আমাকে কোনদিন ভুলবে না। কিন্তু এখন তার জীবনের গতি বদলে গেছে। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ কম। ওর বাবা মাকে আমার কথা বলেছে। কিন্তু এই প্রণয়ের ব্যাপার তারা অনুমোদন করেননি। তারা বলেছেন যে, যদি কোন মেয়েকে বিয়ে করবে না বলে ঠিক কর, তবে তার সঙ্গে মাখামাখি করাটা ন্যায়সঙ্গত নয়। তারা ভয়ঙ্কর দ্বীপকেন্দ্রিক মনোভাব পোষণ করেন। আশঙ্কা হয় পরদেশীদের সম্পর্কে তাদের হাস্যকর ধারণা রয়ে গেছে, যদিও সৃষ্টিকর্তা জানেন যে তোমাকে আমি ঠিক অন্য যে কোন ইংরেজ মেয়ের মতই মনে করি আর তুমি জান যে তোমার জীবনের স্বরসত আমি ভীষণ পছন্দ করি। ওঁদের গ্রামের বাড়ির জনৈক প্রতিবেশীর কন্যার সঙ্গে ওর বিয়ে ওঁরা ঠিক করে রেখেছেন। আমি যে এ ব্যাপারে তোমাকে কিছুই বলিনি সেটা আমার পক্ষে ভারি দুষ্টুমি হয়ে গিয়েছিল। আসল ব্যাপার হল এই আমরা প্রণয় বাগদত্তাই ছিলাম। একসঙ্গে আমাদের সময়টা এমন চমৎকার কাটছিল এবং এমন সুচাৰু লীলাসঙ্গিনী তুমি ছিলে, যে এই সব কিছুকে নষ্ট করে দিতে আমি চাইনি। সে লিখেছিল যে সে আশা রাখে আবার একদিন আমরা দুজনে দুজনের মধ্যে ডুব দেব ইতিমধ্যে আমাদের প্রথম দেখার স্মারক হিসাবে সে ফরচুন কে বলেছে যাতে আমাকে এক ডজন সর্বোকৃষ্ট গোলাপি শ্যাম্পেনের বোতল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং আমি আশা করি যে, এই চিঠি তোমাকে খুব বেশি বিচলিত করে তুলবে না ভিড়, কারণ আমি প্রকৃত অর্থেই মনে করি যে, তুমি এক আশ্চর্য মেয়ে সবচেয়ে আশ্চর্য মেয়ে, আমার মত কোন লোকের পক্ষে অনেক অনেক ভাল। মনোহর স্মৃতিপুঞ্জ ও অজস্র ভালবাসার সঙ্গে–ডেরেক।

তা আমার হৃদয়কে খান্‌খা করে ভেস্তে দিতে মাত্র ঠিক দশ মিনিট লেগেছিল এবং তাকে সারিয়ে তুলতে ছ-মাস।

অপরের যন্ত্রণা ও বেদনার কাহিনী সবাইয়ের কাছেই এক রকম মনে হয়–যে তা কাউকে আগ্রহী করে তোলে না। তাই আমি খুঁটিনাটি বাদ দিয়ে যাচ্ছি। এমন কি সুমানকেও বলিনি। যা দেখছি তা হচ্ছে এই যে প্রথম দিনের সেই সন্ধ্যাটিতেই আমি ভবঘুরে পথিকের মত আচরণ করেছিলাম এবং সে ভাবেই আমাদের দেখা হয়েছে। ইংল্যান্ডের এই সঙ্কীর্ণ অনুদার জগতে আমি ছিলাম ক্যানাডীয় আর সেজন্য পরদেশী, বহির্দেশীয়–চমৎকার লীলাখেলা। এটা যে ঘটতে যাচ্ছে এই অঙ্কটা আমি দেখিনি। সেটাই আমার পক্ষে বেশি নির্বুদ্ধিতার কাজ। সেদিনের মেয়ে! দুনিয়াকে চিনে নাও, নয়ত আবার তুমি আছাড় খাবে। এই চক্ষুষ্মন উত্থিত সুখ খুশি পরায়ণতার মধ্যেও আমার ভেতরের মেয়েটা বিনীতভাবে গুমরে গুমরে কাঁদতে। একটা সময় রাত্রিতেও আমি কাঁদতাম যেন তিনি ডেরেককে ফিরিয়ে দিন। আমার কাছে, প্রার্থনা সফল হয়নি। আর তার চিঠির সংক্ষিপ্ত কোন প্রাপ্তিস্বীকার পাঠাতে বা ফরচুনের দোকানে শ্যাম্পেনের বোতলগুলি ফেরৎ দিতে আমার সম্মানে লাগল। যা যা পড়ে ছিল তা হল ইস্পটি সম্প্রদায়ের সুরলহরীর তীব্র স্মৃতি আর উইন্ডসর হিলের সিনেমার সেই দুঃস্বপ্ন, যার স্মৃতি, মনে হয়, সারাজীবন ধরেই আমাকে ভারাক্রান্ত করে রাখবে।

কপালটা ভাল ছিল। যে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলাম, বন্ধুর বন্ধু তস্য বন্ধুর মারফৎ সেটা পেয়ে গেলাম। কাজটা চেনসী ক্ল্যারিয়ন নামে একটা ছোট্ট স্থানীয় পত্রিকায়। ছোট ছোট বিজ্ঞাপন ছাপত কাগজটা। লন্ডনের দক্ষিণ পশ্চিমে এলাকার মানুষদের বাড়ি-ঘর-ফ্ল্যাট ভাড়া বা গৃহভৃত্য সংক্রান্ত কর্মখালি ও কর্মপ্রার্থীদের বিজ্ঞাপনের একরকম বাজারের কাজ করত কাগজটা। নতুন বালবের বিদ্যুটে মান। এগার নম্বর রোডে বাসের স্বল্পতা, দুধের বোতল চুরি–এসব স্থানীয় সমস্যা নিয়ে লেখা সম্পাদকীয় কয়েক পাতা জুড়ে থাকত।

আর থাকত একটা পুরো পাতা ভর্তি স্থানীয় গুজব সমাচার-চেলাসী সম্পকেই বেশির ভাগ খবর থাকত এবং এটা অনেককেই আকর্ষণ করত। কোন রকম মানহানির মামলা মোকদ্দমা এড়িয়ে চলত পত্রিকার ওই বিভাগটি। এ ছাড়া সাম্রাজ্যের অনুগত শ্ৰেণী, যা আশেপাশের আঞ্চলিক রাজনীতিক ধারার সঙ্গে হুবহু খাপ খেয়ে যেত, প্রভৃতি বিষয়ে চোখাচোখা সম্পাদকীয় লিখত। পিমলিকোতে বাষ্পীয় যুগের মান্ধাতা আমলের ছাপাখানায় যে সব পুরানো ধাঁচের অক্ষরের ছাঁচ রয়েছে সেগুলি থেকে হারলিং বলে একজন কারিগর প্রত্যেক সপ্তাহেই (কাগজটি ছিল সাপ্তাহিক) নতুন নতুন কায়দায় অক্ষরের ছাঁচ তৈরি করত। মোটের ওপর ছোটর মধ্যে কাগজটা ছিল বেশ ভাল, সেজন্য কর্মীরাও একে এত পছন্দ করত যে যৎকিঞ্চিত মাসোহারার বিনিময়ে বা কিছু ছাড়াই, আগস্ট মাস ছুটির দিনগুলির (যখন বিজ্ঞাপন ভাল পাওয়া যেত না) মত সময়েও কাজ করে চলত।

আমার মাইনে ঠিক হল সপ্তাহে পাঁচ পাউন্ড তৎসহ যেসব বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পারব তার ওপর কমিশন (গুরুত্বপূর্ণ না হলেও উল্লেখযোগ্য যে ওখানে ট্রেড ইউনিয়ন বলে কিছু ছিল না)। কাজেই আমি নিঃশব্দে ভগ্ন হৃদয়কে একত্র করে নিলাম পাঁজরার খাঁচায় এবং নিঃসঙ্গ ভাবেই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলার জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম। বুদ্ধির সাহস এবং জুতার সুকতলার উপরই নির্ভর করে এই ইংরেজ উন্নাসিকদের দেখিয়ে দেব যে যদি জীবনে ওদের সঙ্গে চলতেও আমি পারি, তবু ওদের সমাজ থেকে আমি আমার জীবিকা অন্তত উপার্জন করে নিতে পারি। তাই আমি দিনের বেলা কাজ করতে যেতাম এবং রাত্রিবেলা কাঁদতাম। এভাবে আমি কাগজের খুব সক্রিয় কর্মচারি হয়ে উঠলাম।

কর্মীদের জন্য চা তৈরি করতাম, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতাম। শোকাহতদের তালিকা ঠিকঠাক করতাম। গুজব সমাচারের জন্য সূচিমুখ অনুচ্ছেদগুলি লিখতাম, প্রতিযোগিতার কলমগুলি চালাতাম, এমন কি শব্দছকের সূত্রগুলি পর্যন্ত কম্পোজ হবার আগে দেখে দিতাম। এর ফাঁকে ফাঁকে আশেপাশের এলাকা চষে কাটখোট্টা দোকানী, হোটেলওয়ালা, রেস্তোরাঁগুলির কাছ থেকে চমৎকার চমৎকার বিজ্ঞাপন জোগাড় করে এনে দিয়ে বুড়ো স্কচ অ্যাকাউন্টেন্টের কাছে। আমার কমিশনের শতকরা কুড়িভাগ জমাতে লাগলাম। শিগগিরই ভাল আয় হতে লাগল–সপ্তাহে বার থেকে কুড়ি পাউন্ড এবং সম্পাদক ভাবলেন যে আমাকে সপ্তাহে পনের পাউন্ড করে মাইনে দিয়ে পাকাপাকিভাবে নিয়োগ করলে কাগজের আর্থিক দিকেই সাশ্রয় হবে, তাই তিনি নিজের ঘরের পাশে ছোট একটা কুঠুরিতে আমার বসার বন্দোবস্ত করে তার সম্পাদকীয় সহকারী হিসাবে আমাকে বহাল করলেন। এই পদে কাজ করার অন্যতম সুবিধা ছিল তাঁর শয্যাসঙ্গিনী হতে পারার সুযোগ পাওয়া। কিন্তু শরীরের পশ্চাদ্ভাগে প্রথম চিমটি কাটা বুঝতে পেরেই আমি তাকে সাফসুফ বলে দিয়েছিলাম যে কানাডায় একজন ভদ্রলোকের আমি বাগদত্তা। শুনে তার চোখের চেহারা পালটে ভীষণ হয়ে গেল এবং গটমট করে বেরিয়ে গেলেন।

তা সে যাই হোক, সম্পাদকের সহকারী হিসাবে নতুন চাকরিতে আমি স্থিতি হয়ে বসলাম। ছুটোছুটি করার কাজের চেয়ে লেখার কাজই আমাকে বেশি দেওয়া হতে লাগল। এখানে কাজ করার এক বছর পরে যথাসময়ে অন্য একটি শাখায় চলে গেলাম এবং ভিভিয়েন মিশেল একজন গন্যমান্য লোক হয়ে গেল। আমার মাইনে বেড়ে হল বিশ গিনি। যেরকম নির্ভীকভাবে আমি মানুষের বিচার করতাম ও যেভাবে সব কিছুর সঙ্গে চলতাম, তা যেন ভারি পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে লেখা সম্পর্কে অনেক কিছু কৌশল শিখিয়েছিলেন, পাঠককে প্রথম অনুচ্ছেদ থেকেই তীব্রভাবে আকৃষ্ট করতে হয়, ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করা, চালচুলোহীন নিকৃষ্ট কথ্য ভাষা পরিহার করা, এবং সর্বোপরি জনসাধারণ সম্পর্কে লেখা। এটা তিনি এক্সপ্রেস কাগজ থেকে শিখেছিলেন এবং সব সময় আমার মাথায় ঢোকাবার জন্য আউড়ে চলতেন।

এগার নম্বর রোডের কন্ডাক্টরেরা অভিযোগ করেছেন যে ভিড়ের সময় তাদের অনেকক্ষণ ধরে কাজ করতে হয়। তার পেন্সিল দিয়ে এটা কেটে দিয়ে বললেন, জনসাধারণ, জনসাধারণ ও জনসাধারণ, জনসাধারণ! যেভাবে এই খবরটা পরিবেশন করা উচিৎ, তা হল এই রকম?

ফ্র্যাঙ্ক ডোনাল্ডসন, উৎসাহী যুবক, বয়েস সাতাশ। স্ত্রীর নাম ঘেনী। এদের দুটি ছেলেমেয়ে; বিল, বয়েস ছয় এবং এমিলি, বয়েস পাঁচ। এর একটা অভিযোগ রয়েছে। দেখা হতেই বললেন, গরমের ছুটির পর থেকে কোনদিন আর বিকালবেলা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হয় না। ৩৬ নম্বর বোল্টন লেনের পরিচ্ছন্ন বসবার ঘরে বসে ভদ্রলোক বলে চললেন আজকাল যখন ডিউটি থেকে ফিরি, ওরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। দেখুন, আমি এগার নম্বর রোডের একজন কন্ডাক্টর এবং নতুন সময় তালিকা চালু হওয়া যাবৎ আমাদের নিয়মিত একঘণ্টা বেশি খাটতে হয়।

বলে লেন থামলেন।

-কি বোঝাতে চাইছি, দেখেছ? বাসগুলি চালাচ্ছে জনসাধারণ। বাসগুলির চেয়ে তারা অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। এখন বেরিয়ে পড়ে একজন ফ্রাঙ্ক ডোনাল্ডসনকে খুঁজে বার কর এবং ওই গল্পটাকে প্রাণ দাও।

সস্তা জিনিস। মামুলী দৃষ্টিভঙ্গি! কিন্তু এই হচ্ছে সাংবাদিকতা–যা আমার জীবিকা। আর তিনি যা বলতেন, আমি তাই করতাম এবং আমার লেখা সম্পর্কে চিঠি লিখতেন কাছে পিঠের এলাকা থেকে ডোনাল্ডসনরা, তাঁদের স্ত্রীরা, তাদের সঙ্গীরা। সম্পাদকরা চিঠিপত্র আসাটা ভালবাসেন। এরাই একটা কাগজের ব্যস্ত চেহারা ফুটিয়ে তোলে, পাঠক বাড়ায়।

আরও দু বছর, একুশ পূর্ণ হয়ে যাবার কিছু পর অবধি, আমি ক্ল্যারিয়নে কাজ করলাম। এর মধ্যে আমি ন্যাশনাল এক্সপ্রেস মেল প্রভৃতি কাগজের পক্ষ থেকে চাকরি নেবার আমন্ত্রণ পাচ্ছিলাম। আমারও মনে হচ্ছিল সে সাউথ ওয়েস্ট ৩ এলাকার বাইরে বেড়িয়ে জগতে এবার পর্দাপণ করা উচিৎ। তখনও সুমানের সঙ্গে থাকি। বিদেশ দপ্তরে যোগাযোগ বিভাগে সে কাজ করে। কাজটা সম্পর্কে বা ওই বিভাগের যে ছেলেটি ওর বন্ধু তার সম্পর্কে সুমান গোগাপনীয়তা বজায় রেখে চলে। তবে আমি জানি যে খুব শিগগীরই ওরা বাগদত্ত হবে এবং পুরো ফ্ল্যাটটাই চেয়ে বসবে।

আমার ব্যক্তিগত জীবন শূন্য–ভেসে যাওয়া বন্ধুত্ব এবং প্রেম প্রেম ভাব–যা থেকে বরাবর আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। একটি পোত্ত, হয়ত সফল, জীবিকায় উন্নতিকামী মেয়েতে পরিণত হবার আকাঙ্ক্ষা করা চলত আমার সম্পর্কে যে খুব বেশি সিগারেট খায়, অনেক ভদ্কা ও টনিক গেলে আর একা একা বসে টিনের খাবার খায়।

তারপর মিউনিকের বাবোক উৎসবের সাহায্যার্থে আয়োজিত একটি প্রেম শোতে আমার সঙ্গে ভি, ডরু, জেড় এর রাইনার সঙ্গে আলাপ হল।

.

ডানাভাঙা পাখি

 ভি, ডব্লু, জেড বা ফেরারবান্ট ভেডয়টচার জাইটুঙ্গেন হল পশ্চিম জার্মানির সংবাদপত্র সমূহের একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অর্থ সাহায্য প্রাপ্ত রয়টরের মতই একটি সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠার। লন্ডনে কুরর্ট রাইনার এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রতিনিধি এবং আমার সঙ্গে আলাপ হবার সময় দ্বিতীয় এমন একজনকে সে খুঁজছিল যে স্থানীয় সংবাদপত্র ও সাপ্তাহিক থেকে জার্মানির স্বার্থ সংক্রান্ত খবরাখবর জোগাড় করতে পারে, যাতে সে উচ্চ স্তরের কূটনীতিক তথ্যগুলির দিকে নজর দিতে পারে। বাইরের দায়িত্বগুলি নির্বাহ করতে পারে।

সেদিন রাত্রিবেলা সে আমাকে শার্লট স্ট্রিটে স্মিৎ-এ-ডিনার খেতে নিয়ে গেল। নিজের কাজের গুরুত্ব সম্বন্ধে এবং জার্মান সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কাজের ভূমিকার বিষয়ে সে বেশ সুন্দরভাবে সচেতন। শক্তসমর্থ রোদ বৃষ্টি সওয়া চেহারার একজন যুবক, যার সুন্দর চকচকে চুল, নির্ভীক দুই নীল চোখের জন্য তাকে তার তিরিশ বছর বয়েসের চেয়ে কম মনে হত।

সে আমাকে বলেছিল যে মিউনিকের কাছে ওগসবার্গ-এ তার বাড়ি; সে বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তার বাবা-মা দু জনেই ছিলেন ডাক্তার; নাৎসীদের বন্দীশিবির থেকে আমেরিকানরা তাদের দু জনকে উদ্ধার করেছিল। মিত্রশক্তির বেতার শোনার জন্য এবং তরুণ কুরর্টকে হিটলারের যুব আন্দোলনে যোগ দিতে না দেবার জন্য তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার শিক্ষা মিউনিক উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর সাংবাদিকতায় স্নাতক হয়ে, পশ্চিম জার্মানির শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্র ডি ভেল্ট এ যোগ দেয়, সেখান থেকে ইংরাজিতে তার ভাল দখল থাকায় লন্ডনের এই কাজটার জন্য তাকে মনোনীত করা হয়।

আমার কাজ সম্বন্ধে জানতে চাওয়ায় পরদনি চ্যান্সেরী লেন-এ-তার দু কামরার অফিসে গিয়ে আমার কাজের কিছু নমুনা তাকে দেখালাম। নিজস্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ ধরনের, তার প্রেস ক্লাবের বন্ধুদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় খবর টবর ইতিমধ্যে জোগাড় করে নিয়েছিল, এবং এক সপ্তাহ পরে দেখলাম যে, তার পাশের কামরায় আমি বসে আছি, সঙ্গে রয়েছে একজন ব্যক্তিগত সহকারী–আমার টেবিলের পাশে রয়টার এবং এক্সচেঞ্জ টেলিগ্রাফের দূরমুদ্রণী অনবরত টকটক করে খবর পাঠিয়ে চলেছে। মাইনেটা দারুণ–সপ্তাহে ত্রিশ পাউন্ড। শিগগিরই এই নতুন কাজটাকে আমি পছন্দ করে ফেললাম, হামবুর্গে আমাদের সদর দপ্তরের সঙ্গে দিনে দু বার টেলেক্সে যোগাযোগ কর, যাতে প্রভাতী ও সান্ধ্য জার্মান দৈনিকগুলির প্রকাশের আগেই বার্তা প্রেরণ করা যায়। জার্মান ভাষায় আমার অজ্ঞতা প্রায় কোন অসুবিধারই সৃষ্টি করত না, কারণ টেলিফোনে কুরর্টের কাছ থেকে প্রেরিতব্য যে সব বার্তার অনুলিপি পেতাম। তাছাড়াও আমার কর্মচারিরা টেলিফোনে খবর পাঠাত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে, যা অপর প্রান্তের ভারপ্রাপ্ত অপারেটার অনুবাদ করে নিত। হামবুর্গে দূর মুদ্রণীয় কর্মীরও ইংরেজি ভাষার জ্ঞান ততটুকু ছিল, যাতে আমি এ প্রান্তে যন্ত্রটা চালাবার সময়, তারা আমার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা চালাতে পারত। কাজটা নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক হলেও এতে খুব ক্ষিপ্ত ও নির্ভুল হওয়া দরকার; আর প্রকাশের কয়েকদিন পর, বিভিন্ন জার্মান সংবাদপত্র থেকে আমার প্রেরিত সংবাদগুলির কর্তিত অংশের সঙ্গে মূল পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে কাজের সাফল্য ব্যর্থতার একটা চেহারা দেখতে পাওয়াও বেশ মজার। ব্যাপার ছিল।

শিগগিরই আমার উপর কুরর্টের এতটা আস্থা জন্মাল যে, একা আমার ওপর অফিসের সব ভার ছেড়ে গিয়ে যেতে লাগল। তখন দারুণ উত্তেজনা, জরুরী বিষয়গুলি নিজের হাতে করতে গিয়ে আমার জেনে রোমাঞ্চ হত, জার্মানিতে বসে কুড়িজন সম্পাদক দ্রুত ও নির্ভুল হবার জন্য আমার ওপর নির্ভর করে আছেন। ক্ল্যারিয়নের আঞ্চলিক অকিঞ্চিৎ করতার চেয়ে এটা অনেক বেশি গুরুত্ব ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হত আর তাই আমি কুরৰ্টের, নির্দেশ ও সিদ্ধান্তের, কর্তৃত্বের পাশাপাশি সংবাদ সরবরাহ সংস্থার জড়িত সেই জরুরী গন্ধটা বেশ পছন্দ করতাম।

যথাসময়ে সুমান বিয়ে করল আর আমি বুমবারি স্কোয়ারে একখানা আসবাবপত্র সজ্জিত ফ্ল্যাটে উঠে এলাম, ওই বাড়িরই ফ্ল্যাটে কুরর্ট থাকত। একবার মনে হয়েছিল যে এখানে বাসাভাড়া নেওয়াটা কি সমীচীন হল! তবে সে দিনের আচরণ ছিল এমন সঙ্গত এবং আমাদের দুজনের মধ্যেকার পরিস্থিতি বোঝাতে সে সর্বদা অস্পষ্ট শব্দগুলি ব্যবহার করত–যে আমি মনে করতাম আমার অন্তত যথেষ্ট বিচার বিবেচনা হয়েছে।

আমার দিক থেকে কাজটা ভারি বোকার মত হয়ে গিয়েছিল। একই বাড়িতে ফ্ল্যাট নেবার জন্য ওর প্রস্তাব অত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করাতে কুরর্ট আমাকে ভুল বুঝতে পারত, এ ছাড়া এটা যখন খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল যে ছুটির পর আমরা দুজনে একসঙ্গে হেঁটে অফিসের কাছেই এই বাড়িটায় ফিরে আসব। এক সঙ্গে নৈশভোেজ সমাধা করাটাও নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল। শেষদিকে খরচ বাঁচবার জন্য সে তার গ্রামোফোনটা আমার বসবার ঘরে নিয়ে আসত আর আমি আমাদের দুজনের জন্য কিছু রান্নাবান্না করে নিতাম। অবশ্যই আমি বিপদের আশঙ্কা করতাম এবং কয়েকজন কাল্পনিক বন্ধুর সঙ্গে বিকেলটা কাটাবার ওজর দেখাতাম। এর মানে হত একা একা রাত্রির খাওয়া দাওয়া সেরে কোন সিনেমা হলে গিয়ে বসে থাকা, সেখানেও রাতের বেলা একলা যুবতী মেয়ে দেখলেই পুরুষেরা তাকে তোলবার চেষ্টা করবে।

তবে কুরট ছিল এত সঙ্গত ও শালীনতা সম্পন্ন এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল এমন সোজাসুজি ও উচ্চস্তরের যৌথ মানসিকতার যে আমার আশঙ্কাগুলি ক্রমশ নির্বুদ্ধিতাসূচক বলে মনে হতে লাগল। আর যতই আমি মিত্ৰতাপূর্ণ জীবনকে গ্রহণ করতে লাগলাম, সেটা শুধু পুরোপুরি সম্ভ্রান্ত কালেই নয়, আধুনিক রীতির প্রাপ্তমনস্ক বলেও মনে হচ্ছিল, আমি আরও বেশি আস্থা ফিরে পেলাম যখন এরকম মাস তিনেক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পর একবার জার্মানি ঘুরে এসে কুটি আমাকে জানাল যে সে বাগদত্ত হয়ে এসেছে। মেয়েটির নাম ক্রুদ, ওর বাল্যসখী। সে আমাকে যা বলল, তাতে বুঝলাম যে একেবারে রাজযোটক হতে যাচ্ছে। মেয়েটির বাবা হাইডেলবার্গে দর্শনের অধ্যাপক। কুরর্টের হাতে একটা ফটোগ্রাফে তার দুই শ্রান্ত নয়ন, চকচকে দুই লতানো বেনী এবং সুবিন্যস্ত সাজগোজ জীবন্ত দেখাচ্ছিল।

ক্রুদ এর চিঠিগুলি আমাকে তর্জমা করে শুনিয়ে, তাদের ক টি সন্তান হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করে লন্ডনের পোস্টে তিন বছরের সীমা পেরোলেই যখন তার হাতে বিয়ের খরচার জন্য যথেষ্ট জমবে তা দিয়ে হামবুর্গে যে ফ্ল্যাটটা তারা কিনবে বলে ঠিক করেছে তার অলঙ্করণ সম্পর্কে আমার পরামর্শ চেয়ে কুরর্ট আমাকে গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ফেলল। ওদের দুজনের কাছে আমি হয়ে গেলাম একটি সার্বজনীন খালা র মতন কেউ। পেল্লায় দুটি পুতুল নিয়ে বিয়ে বিয়ে খেলার মত, এই নতুন ভূমিকাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অথবা মজার বলে মনে না করলে, আমি একে হাস্যকর বলে মনে করতে পারতাম।

কুরর্ট এমনকি তাদের জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে, হতে পারে হয়ত কিছুটা বিকৃতভাবেই আমার সঙ্গে পরিকল্পনা করত। এই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে প্রথম প্রথম আমার বেশ অস্বস্তি হত, কিন্তু পুরো বিষয়টা সম্পর্কে তার দৃষ্টিকোণ ছিল এমন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর মত যে, ওই আলোচনার শিক্ষাগত মূল্যের দিকটা ছিল উঁচুস্তরের। মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে ওরা ভেনিসে (সব জার্মানিরাই ইটালীতে যায় মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে) যাবে এবং প্রত্যেক রাতেই মিলিত হবে, কারণ কুর্ট বলল সে সহবাস ক্রিয়া প্রয়োগের ব্যাপারে নিখুঁত করে তোলার জন্য প্রচুর অনুশীলন করা প্রয়োজন। এই জন্য তারা রাত্রিবেলা হালকা খাবার খাবে, কারণ ভরপেটে থাকাটা বাঞ্চনীয় নয়।

রাত এগারটার বেশি দেরি করবে না শুতে যেতে, কারণ কর্মোদ্দম ফিরে পেতে আট ঘণ্টা ঘুম খুব দরকার। সে বলত ক্রুদ্ এর যুবতী সত্তার জাগরণ হয়নি, ফলে যৌনতার ব্যাপার নিরুত্তাপ হয়ে যাবার প্রবণতাই বেশি, সে ক্ষেত্রে সে নিজে ছিল তীব্র যৌনবোধ সম্পন্ন। এজন্য তাকে সংযত থাকতে হবে। এই বিষয়ে নিজেকে সামলাতে হবে। কঠোরভাবে। কারণ, তার কথা অনুসারে সুখী দম্পতি হতে গেলে দুজনের যৌন আবেগের চরম শিখরে দু জনকেই উঠতে হবে একসঙ্গে। এ সব কিছুই কুরর্ট অত্যন্ত প্রাঞ্জল বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় পরিবেশন করত এবং এমনকি টেবিল ক্লথের ওপর কাঁটা চামচের কাঁটা দিয়ে নক্সা ও ছবি এঁকে বোঝাত।

এই বক্তৃতামালা এমন সারগর্ভ ছিল যে আমি স্থির নিশ্চিত হয়েছিলাম যে প্রেমিক হিসেবে কুরর্ট ছিল অত্যন্ত অসাধারণ সূক্ষ্মতা সম্পন্ন। কবুল করতে ভাষা নেই-, ক্রু এর জন্য সুনিয়ন্ত্রিত ও পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত পুলকরাজি প্রস্তুত হয়ে আছে। তা শুনে আমি চমৎকৃত ও কিছুটা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়েছিলাম। অনেক রাত্রিই এমন কেটেছে যখন ওই সব অভিজ্ঞাগুলি নিজস্বভাবে পেতে চেয়েছি, চেয়েছি এমন কাউকে, কুরর্টের ভাষা অনুসরণ করে যাকে বলতে পারি এক মহান যৌন শিল্পী যার হাতে দেহ সঁপে দিয়ে বলব, আমারে করো তোর বীণা। আর মনে হয় এটাঅনিবার্য ছিল যে আমার স্বপ্নে ওই ভূমিকায় কুরই অবতরণ করত–অতি নিরাপদ, অতি সুভদ্র, নারীর শরীরের আকুতি সম্পর্কে অতি গভীর রসজ্ঞ। কয়েকমাস অতিবাহিত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রু-এর চিঠিগুলির সুর ও সংখ্যা পরিবর্তিত হতে শুরু করল। আমিই প্রথমে এটা লক্ষ্য করি; তবে কিছুই বলিনি। প্রতীক্ষার সুদীর্ঘ সময় নিয়ে ঘন ঘন তীক্ষ্ণ অনুযোগ। আসতে শুরু করল। চিঠির নিবিড় মধুর অনুচ্ছেদগুলি হয়ে উঠতে লাগল যেমন তেমন করে শেষ করা। টিগারসীর গ্রীষ্মবকাশের সুখস্মৃতি গুলি, যা এর সঙ্গে কুরট এর প্রথম দেখার পর আর উল্লিখিত হল না। তারপর একবার। ক্রুদ এর তিন সপ্তাহব্যাপী নীরবতার পরে একদিন বিকেলবেলা ফ্যাকাশে মুখে অশ্রুসিক্ত আননে কুরর্ট আমার ঘরে এসে হাজির হল।

সোফায় শুয়ে শুয়ে কিছু পড়ছিলাম; সে আমার কাছে এসে হাঁটুর উপর ভর রেখে আমার বুকে মুখ গুঁজে থাকল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলল, সব শেষ হয়ে গেছে। টিগারসীতেও মিউনিকের একজন বিপত্নীক ডক্টরের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন আর সেও তাতে সম্মতি দিয়েছে। এটা ওদের প্রথম দর্শনে প্রেম। কুরর্টের অবশ্যই বোঝা উচিৎ যে এ-রকম ঘটনা কোন মেয়ের জীবনে মাত্র একবারই ঘটে। ক্রুকে তার ক্ষমা করা। উচিৎ এবং ভুলে যাওয়া উচিৎ। সে তার যোগ্যা নয় (আঃ! আবার সেই বিচ্ছিরি কথাটা বলতে বল)। সম্মানিত বন্ধু হিসাবে তারা থাকবে। পরের মাসে বিয়েটা হয়ে যাবে। কুরর্ট চেষ্টা করে তাদের জন্য শুভ প্রার্থনা জানাবে। তোমার অতিদীন ক্রু বিদায় দাও।

কুরর্টের বাহু আমাকে বেষ্টন করেছিল। সে আমাকে মরিয়ার মত আঁকড়ে ধরেছিল। 

–এখন তুমি ছাড়া আর আমার কেউ নেই। মৃদু কান্না ভেজা গলায় সে বলল, আমাকে দয়া করো। আমাকে শান্তি দাও।

যতটা সম্ভব বাৎসল্য সহকারে তার চুলে হাত বোলাচ্ছিলাম। এই শক্ত সমর্থ মানুষটার হতাশা এবং আমার ওপর। তার ওই নির্ভরতায় আর্দ্র হয়ে ভাবছিলাম যে কিভাবে ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নিরেট গদ্য গলায় বললাম, আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর তো বলব যে নেহাৎ বরাত জোরে বেঁচে গেছ। ওই রকম অস্থির মতি কোন মেয়ে বৌ হিসেবেও ভাল হতে পারত না। খুঁজলে জার্মানিতে ওর চেয়ে ঢের ভাল মেয়ে পাওয়া যাবে। যেতে দাও, কুরর্ট।

উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, আমরা বাইরে কোথাও ডিনার খেয়ে, একটা সিনেমা দেখে আসি। এতে ও সব চিন্তা থেকে মনটা বাঁচবে। গতস্য শোচনা নাস্তি। নাও ওঠ কুরর্ট। বেশ কিছুটা জোরে আমি নিজেকে মুক্ত করে নিলাম এবং দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম।

মাথা ঝাঁকিয়ে কুরর্ট বলল, ওঃ ভিড়, তুমি যে কি ভাল! তুমি দুঃসময়ের প্রকৃত বন্ধু–আইনে এইটে কামরাডিন– এক সত্যিকারের সুহৃদ। আমি অমন দুর্বলের মত ভাব করব না। তোমার তাহলে লজ্জা লাগবে আমার জন্য। সেটা আমি সহ্য করতে পারব না।

যন্ত্রণাময় একটা হাসি হেসে সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। এর মাত্র দু সপ্তাহ পরেই আমরা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে গেলাম। এটা ছিল অনিবার্য। আমি কিছু কিছু বুঝেছিলাম যে এটা কোথায় গিয়ে গড়াবে, তবু নিয়তিকে কোন ছল করে এড়াতে যাইনি। আমি যে ওর প্রেমে পড়েছিলাম, তা নয়, তবে অন্য দিক দিয়ে আমরা পরস্পরের এত কাছে এসেছিলাম যে পরের ধাপে সহবাস ছিল-অবধারিত ও অপ্রতিরোধ্য বাস্তব। তার খুঁটিনাটি বিবরণ নীরস। গালের ওপর সহোদর সুলভ যে হালকা চুম্বনগুলি মাঝেমধ্যে উড়ে আসত, সেগুলি ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল ঠোঁটের দিকে, এবং একদিন মুখের মধ্যে উড়ে এল। এরপর অগ্রসর হওয়ার স্বল্প বিরতি, যে অবকাশ এই জাতীয় চুম্বন আমি মোটামুটি মেনে নিয়েছে। তারপর এল আমার বুকের ওপর মৃদু হস্তক্ষেপ; তারপর শরীরে

সব কিছুই গাঢ় সুখদায়ক, নিবিড় শান্ত ও সম্পূর্ণ নাটকীয়তা বিবর্জিত ছিল; এবং একদিন সন্ধ্যায় আমার বসবার ঘরে ধীরে সুস্থে আমার বস্ত্রহরণ করে আমার দেহকে নিরাবরণ করা হল

–না, তুমি কত সুন্দর তা আমি দেখব। প্রাথমিক দুর্বল নিস্তেজ প্রতিবাদের পরে, ক্রু এর জন্য যে বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকলাপ প্রস্তুত করা হয়েছিল তা আমার ওপর প্রয়োগ করা হল।

আমার নিজের ঘরের আশ্চর্য গোপনীয়তায়, কি সুস্বাদু যে তা লেগেছিল। কি নিরাপদ!

কেমন ব্যস্ততাবিহীন, মন্থর! সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলি কি স্বস্তিকর! আর কুরৰ্টের গায়ে কি জোর, তবু কত ধীর স্থির আর সর্বোপরি সহবাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কি স্বর্গীয় নম্রতা।

প্রতিবারের শৃঙ্গার–ক্ষতির পরে একটি করে পুষ্প উপহার। প্রতিটি তীব্র বাসনাত মিলনের পরে ঘর গুছিয়ে পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া। অফিসে এবং অন্য লোকের সামনে অনুশীলিত নিখুঁত আচরণ, একটুও বেজাল না–এ যেন একজন শল্যচিকিৎসক শয্যাকালের শ্রেষ্ঠ আচরণ বিধি মেনে, অসাধারণ রমণীয় অস্ত্রোপচারগুলি সম্পাদন করে চলেছেন। অবশ্য এ সমস্ত কিছুই ছিল নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু আমার তা ভাল লাগত।

তারপর অনিবার্যভাবে ঘটনাটি ঘটল। ঠিক যখন থেকে আমরা নিয়মিত সহবাস করতে শুরু করেছি তার কিছু পরেই।

কুরর্ট আমাকে একজন নির্ভরযোগ্য মহিলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল যিনি আমাকে গর্ভনিরোধ সম্পর্কে একটি প্রজ্ঞান বক্তৃতা দিলেন, এবং আনুষঙ্গিক বন্দোবস্ত করে দিলেন। কিন্তু তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, এসব সাবধানতাও বেঠিক হয়ে যেতে পারে। আর ঘটেছিলও তাই। প্রথমে, চেপে থাকাই সব চেয়ে ভাল হবে আশা করে, কুরকে কিছুই বলিনি। তারপর, নানান দিক থেকে ভেবে–এই গোপনীয়তাকে এককভাবে বহন করতে চাই না, একটা ভীষণ আলোর আশায় যে সে খুশি হতেও পারে এবং আমাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিতে পারে, আমার নিজের অবস্থা সম্পর্কে সত্যি সত্যি আশঙ্কাপোষণ করে–তাকে সব বললাম। তার ওপর এর কি প্রতিক্রিয়া হবে সে সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা ছিল না। তবে আমি ভেবেছিলাম তার কাছ থেকে কোমলতা, সহানুভূতি ও অন্তত একটা ওপর ওপর ভালবাসার ছোঁয়া পাওয়া যাবে। বিদায় নেবার আগে সেদিন রাত্রিবেলা আমরা আমার শোবার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার গায়ে এক টুকরো কাপড়ও ছিল না, সে ছিল দস্তুর মত পোশাক-আষাক পরা। কথাটা বলা শেষ হতেই সে নীরবে তার গলা থেকে আমার দুই বাহুর বেষ্টনী খুলে দিল। আমার আপাদমস্তক রাগ আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল এবং দরজার হাতলে হাত রাখল। ঠাণ্ডা চোখে আমার চোখের ওপর চোখ রেখে মৃদুস্বরে বলল, তাহলে? বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা আস্তে বন্ধ করে দিল।

ফিরে এসে দেয়ালের দিকে মুখ করে বিছানার কিনারে বসলাম। আমি কি করেছি কোন অন্যায়টা আমি বলেছিলাম? কুরর্টের ব্যবহারের অর্থ কি? তারপর অমঙ্গলের ছায়াপাত দেখে নির্জীব হয়ে বিছানায় উঠে একা একা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাদাটা ঠিকই হয়েছিল। পরদিন সকালবেলা যথারীতি এক সঙ্গে হেঁটে অফিস যাবার জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি যে, সে আগেই বেরিয়ে গেছে। অফিসে গিয়ে দেখি, তার ঘর আমার ঘরের মাঝখানে যোগাযোগকারী দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, মিনিট পনের পরে দরজাটি খুলে সে যখন বলল যে, আমাদের কিছু কথাবার্তা বলতে হবে, তখন তার মুখাকৃতি তুষার তুহিন ভালেশহীন। তার ঘরে গিয়ে তার টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসলাম, যেন মালিকপক্ষ ছাঁটাই করা হবে এমন কোন কর্মচারির ইন্টারভিউ নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হলও তাই। ভাবাবেগ বর্জিত নৈব্যক্তিক সুরে যে বক্তৃতা সে দিয়েছিল তার সারাৎসার ছিল এই

মিত্রতার যে বন্ধনে আমরা আবদ্ধ ছিলাম, যা ছিল অত্যন্ত-উপভোগ্য, তার পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় শর্ত ছিল, যে সব কিছু মসৃণ ও সুশৃঙ্খলভাবে চলবে। আমরা দুজনে ছিলাম (হ্যাঁ, ছিলাম) চমৎকার বন্ধু, এবং আমি স্বীকার করব যে কখনোই বিয়ের কথা হয়নি, দুজন মিত্রের (আবার সেই শব্দটি!) মধ্যে সন্তোষজনক সমঝতার চেয়ে বেশি স্থায়ী কিছু নয়। এটা ছিল খুব সুখকর সম্পর্ক, কিন্তু এখন একজন মিত্রের দোষে (মনে হচ্ছে, কেবল আমার একার) এটা ঘটেছে; কাজেই এই সমস্যা, যার মধ্যে আমাদের জীবন পথের প্রতিকূল, অস্বস্তি ও বিপদের উপাদান রয়ে গেছে, একটা সমাধান অবশ্যই খুঁজে দেখা কর্তব্য। বিয়ে-হায়–যদিও আমার গুণাবলী ও শারীরিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে তার খুব উচ্চশ্রেণীর ধারণা–তা ছিল বিবেচনার বাইরে।

অন্যান্য বিবেচ্য বিষয় ছাড়াও সঙ্করগোষ্ঠীর (শানিত ও বৈষম্য জয়তু হিটলার) সম্পর্কেও তার বেশ দৃঢ় মতামত আছে এবং যখন সে বিয়ে করবে, পাত্রী হবেন খাঁটি জার্মান রক্তের বংশসস্তৃতা। অতএব, আন্তরিক দুঃখের সঙ্গে সে কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি তা হল যে আমি অবিলম্বে একটি অস্ত্রোপচার করিয়ে নেব। তিনমাস অতিক্রান্ত হতে দেওয়াটা বিপজ্জনক ধরনের দেরি হয়ে যাওয়া।

ব্যাপারটা ভারি সরল। আমি প্লেনে জুরিখ চলে গিয়ে হন্টবানোফের কাছে কোন একটা হোটেলে উঠব। বিমান বন্দর থেকে যে কোন ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে ওই অঞ্চলের একটা হোটেলে তুলে দেবে। হোটেলের দারোয়ানের কাছে হোটেলের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারের নাম জেনে নিয়ে তার পরামর্শ নেবে, জুরিখে চমৎকার সব ডাক্তাররা রয়েছেন। তিনি পরামর্শ দেবেন যে, আমার রক্তচাপ হয় খুব উচ্চচাপ গ্রস্ত নয়ত নিম্নচাপ গ্রস্ত এবং আমার স্নায়ু সন্তানের জন্ম দেওয়ার মত সঠিক অবস্থায় নেই। তিনি একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলবেন।

সুইজারল্যান্ডের চমৎকার সব স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। আমি সেই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করব। তিনি হোটেলের ডাক্তারবাবুর অভিমত সমর্থন করবেন এবং সেই ফর্মে কাগজ পত্রে সই করবেন।

ওই বিশেষজ্ঞ কোন একটা ক্লিনিকে কেবিন সংরক্ষিত রাখবেন। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই গোটা সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ সুবিবেচনার সুবিধা রয়েছে। এ সব পদ্ধতি সুইজারল্যান্ডে পরিপূর্ণ আইনসিদ্ধ। আমাকে এমনকি পাসপোর্ট দেখাতেও হবে না। ওখানে আমি যে নাম ইচ্ছে–স্বাভাবিক কারণেই কোন সধবা নাম ব্যবহার করতে পারি। তবে খরচাটা একটু বেশি পড়ে যাবে। হয়ত একশ, আবার দেড়শ পাউন্ডেরও হতে পারে। সেটাও সে ভেবে দেখেছে। টেবিলের দেরাজ টেনে একটা খাম বার করে টেবিলের এধারে ঠেলে দিল। ন্যায়ই হবে এটা, প্রায় দু-বছর যোগ্যতার সঙ্গে চাকরি করার পর কোন নোটিশ ছাড়াই এক মাসের বেতনসহ বরখাস্ত হওয়া। তা ছিল একশ কুড়ি পাউন্ড। নিজের পকেট থেকে টুরিস্ট ক্লাসে বিমান ভাড়া ও জরুরী অবস্থান বাবদ আরক্ত পঞ্চাশ পাউন্ড এতে যোগ করার স্বাধীনতা সে গ্রহণ করেছে। অর্থের সমস্ত অঙ্কটা জার্মান মুদ্রায় দেয়া হয়েছে যাতে বিনিময় করার ঝক্কি না পোহাতে হয়।

কুরর্ট পরীক্ষামূলকভাবে অল্প একটু হাসল; তার কর্মকুশলা ও উদারতার জন্য আমার ধন্যবাদ ও অভিনন্দনের জন্য যেন একটু অপেক্ষা করল। আমার মুখের শূন্যময় আতঙ্কের অভিব্যক্তি দেখে সে নিবে গিয়ে থাকবে কারণ সে মিত্রতা এনে ফেলল কথাবার্তায়, মোটের ওপর কোন দুশ্চিন্তা করব না। এসব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা জীবনে ঘটেই থাকে। এসব খুবই বেদনাদায়ক, বড় অপরিচ্ছন্ন। সে নিজেই এত সুখদায়ক একটা সম্পর্কের, তার অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে বেশি সুখদায়ক গুলির অন্যতম, সমাপ্তি ঘটবে বলে খুব বিমর্ষ। হায়! যেহেতু এটা ঘটতেই হবে। উপসংহারে সে বলল যে, সে আশা করে যে আমি বুঝব।

মাথা ঝাঁঝিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। খামটা তুলে নিয়ে শেষ বারের মত সেই সোনালি চুল, অধরোষ্ঠ, যা আমি ভালবাসতাম, শক্তিশালী স্বদেশ, দেখে নিলাম এবং চোখে পানি আসছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা আস্তে বন্ধ করে দিলাম।

কুরর্টের সঙ্গে দেখা হবার আগে আমি ছিলাম একটি ডানা ভেঙ্গে যাওয়া বিহঙ্গ। এবার আমার অন্য ডানাটাও গুলিতে জখম হল।

.

হে পাখি পশ্চিমে যাও

অগাস্টের শেষে, যখন এসব ঘটেছিল, সে সময় জুরিখের মত–গোমড়ামুখো শহর যতটা হর্ষোফুল্ল থাকা সম্ভব ততটাই ছিল। হ্রদের হিমবাহ গলা পরিষ্কার পানি, পালতোলা নৌকা ও শী –করিয়রদের সমাবেশে বর্ণোজ্জ্বল রূপ ধারণ করেছে। সর্বজনীন সৈকত ভূমিগুলি স্বর্ণকায় আনার্থীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর ও ছন্দময় ক্যার্নিভালের মেলা মেলা আবহাওয়া আমার সদ্য চোট খাওয়া স্নায়ুকে যেন পীড়া দিচ্ছিল এবং আমার অসুস্থ মনে পাঁচমিশেলী দুঃখ কষ্ট এসে জমছিল।

হোটেলের দ্বাররক্ষক, অন্য অনুরূপ দ্বার রক্ষকদের মত জগৎ অভিজ্ঞ চোখে আমাকে অবলোকন করে বলল যে, হোটেলের ছুটিতে গেছেন কিন্তু আরেকজন আছে তিনিও ভারি দক্ষ। সে কি জেনেছিল? সে কি অনুমান করতে পেরেছিল?

ডাঃ সুসকিন্ড আমাকে পরীক্ষা করে দেখে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার প্রয়োজনীয় টাকাকড়ি আছে কিনা। হ্যাঁ আছে বলতে দেখলাম যে ডাক্তারবাবু একটু নিরাশ হলেন বলে মনে হল। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তারবাবু আর একটু ভোলা করে বললেন। মনে হল, পাহাড়ে তার একটা গ্রীষ্মকালীন কুটির আছে। জুরিখের হোটেলগুলি এত ব্যয়বহুল। অস্ত্রোপচারের আগে কি আমি কিছু সময় বিশ্রাম নিতে চাইব না? আমি তার দিকে পাথুরে চাউনিতে তাকিয়ে বললাম যে, আমার কাকা স্থানীয় ব্রিটিশ কন্সাল; রোগমুক্তির পর তাঁর পরিবারে থেকে অবকাশ যাপনের জন্য তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এবং আর একটুও দেরি না করে ক্লিনিকে ভর্তি হতে পারলেই আমি খুব খুশি হব। তিনিই আমাকে ডাঃ সুসকিন্ডের নাম সুপারিশ করেছেন। নিঃসন্দেহে ডাঃ মিঃ ব্রনস্কভেইগ কনসালকে চেনেন?

আমার এই ধাপ্পাটায় বেশ কাজ হল। আমার নবলব্ধ স্থির নিশ্চিত ভাঙ্গতে কথাটা বলেছিলাম। এই কায়দায় চালটা আগে ছকে রেখেছিলাম। বাইফোকাল লেন্সের ভেতর ডাক্তারের চোখ দুটি আহত বলে মনে হল। এরপরই শান্ত ভাষাতে আগের প্রস্তাবের ঐকান্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হল এবং দ্রুত টেলিফোন করা হল ক্লিনিকে।

হ্যাঁ, বটে। আগামীকাল অপরাহ্নে। শুধু আমার এক রাতের উপযুক্ত জিনিসপত্র নিলেই চলবে।

যেমন ভেবেছিলাম, এই শল্যচিকিৎসক শরীরের পক্ষে যতটা যন্ত্রণারহিত করে–করা হল, মনের পক্ষে ছিল ততটা বেদনাদায়ক। তিনদিন পরে হোটেলে ফিরে এলাম। আমার মন প্রস্তুত হয়েছিল। প্লেনে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলাম। বিমানবন্দরের কাছে নতুন বৃত্তাকার এরিয়েল হোটেলে উঠে আমার যৎসামান্য জিনিসপত্রের একটা গতি করে হোটেলের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে হ্যাঁমারস্মিথে নিকটতম ভেসপা স্কুটারের বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল অন্তত বছর খানেকের জন্য একা একা বেড়িয়ে পড়ে বাকি অর্ধেক জগতটাকে দেখা। লন্ডন আমারই ছিল। সেখানের জীবন আমাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। আমার পা টলছে। এই সিদ্ধান্তেই এসেছি যে আমি এখানকার কেউ না। ডেরেকের পরিশীলিত পৃথিবীকে আমি বুঝতে পারিনি আবার কোন কায়দায় যে কুরর্টের দেওয়া নিস্তাপ ও বৈজ্ঞানিক আধুনিক প্রেম সামলাতে হয় তাও জানতাম না। নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে, আমি যে পারিনি তার কারণ আমাকে যেটা বেশি ছিল তা হল হৃদয়। এদের দুজনের কেউই। আমার হৃদয়কে পেতে চায়নি। তারা শুধু আমার শরীরটাকেই পেতে চেয়েছিল। আমার ব্যর্থতাকে ব্যাখ্যা করে বলার জন্য এই দু জনকে দায়ী করে, বাতিল করা নারীদের আবহমান কালের আত্মবিলাপের এই যে গলা মেলাচ্ছি তা হৃদয় ঘটিত ব্যাপারের থেকে আমার ব্যর্থতারই গুরুত্বপূর্ণ হদিশ দেবে। এই ঘটনাবলী থেকে নিষ্কাশিত সত্য এই যে আমার সরলতা বড় শহরের জটিল অরণ্যে টিকতে পারে না। সহজেই আমি লুণ্ঠনের শিকার হয়ে পড়ি। আমি নিজে এত বেশি ক্যানাডীয় ছিলাম যে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারতাম না। তবে তাই হোক!

আমি যখন সরল, তখন সরল এক দেশেই যাব চলে। উদ্দেশ্যহীন নিস্তেজ অবস্থায় বসে বসে ভাবার জন্য নয়। সেখানে আমি যাব আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে, দুঃসাহসিকতাপূর্ণ অভিযানের যাত্রা হিসেবে। গোটা শীতের সময়টা আমি সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াব কখনো রেস্তোরাঁর পরিচারিকা, কখনো বাচ্চা সামলানোর কাজ, কখনো রিসপশনিস্ট হিসাবে কাজ করে গিয়ে, যতদিন না আমি ফ্লোরিডা পৌঁছাই। সেখানে কোন খবরের কাগজের অফিসে একটা কাজ জুটিয়ে নেব এবং ঋতুরাজ বসন্ত না আসা পর্যন্ত রোদ পোহাব সেখানে।

মনটাকে প্রস্তুত করে ফেলা মাত্রই, আমার পরিকল্পনা খুঁটিনাটি বিষয়গুলি আমাকে গ্রাস করে নিল। আমার দুঃখকে তাড়িয়ে না হক দূরে সরিয়ে দিয়ে আমার পাপবোধ, আমার লজ্জা, আমার ব্যর্থতাকে অসাড় করে দিয়ে পলমল-এ আমেরিকান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন-এর অফিসে গিয়ে সদস্য হলাম এবং যে মানচিত্র প্রয়োজন তা পেলাম। তাদের সঙ্গে আমি যানবাহনের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করলাম। আমেরিকায় পুরানো মোটর গাড়ির দাম ও চালানোর খরচ খুব বেশি। হঠাৎ একটা মোটর স্কুটার কেনার চিন্তা আমাকে খুব পেয়ে বসল। আন্তদেশিক বিরাট বিরাট সড়কগুলিতে এরকম এক ক্ষুদে দু চাকার যান নিয়ে যাত্রা করার চিন্তাটা প্রথম দিকে হাস্যকর লেগেছিল। তারপর মুক্ত আকাশের নিচে থাকা, গ্যালনে একশ মাইল যাবার ক্ষমতা, গ্যারাজের জন্য দুশ্চিন্তার কিছু না থাকা, হালকা মালপত্র নিয়ে বেড়ান, আর স্বীকার করতেই হবে যে যেখানেই যাব, সেখানেই একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে চলব, এটা ভাবতেই। হ্যাঁমারষ্টিথের স্কুটার বিক্রেতার কাছে গেলাম, বাকিটা উনিই করে দিলেন।

যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে কিছু জানতাম–উত্তর আমেরিকার প্রতিটি শিশুই মোটর গাড়ির সঙ্গে বড় হয়। এবং আমি ১২৫ সি সি মডেলের তুলনা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত শেষোক্ত মডেল সম্পর্কেই মনস্থির। এই স্কুটারটায় স্পীড ওঠে চমৎকার আর এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ষাট মাইল। এক গ্যালনে পাড়ি দেবে আশি মাইল রাস্তা। অন্য স্কুটারটা চলত গ্যালনে একশ মাইলের মত। আমি মনে মনে বললাম যে আমেরিকায় পেট্রোল খুব সস্তা, আমাকে বেশি গতিবেগ সম্পন্নটিই নিতে হবে; না হলে দক্ষিণে গিয়ে পৌঁছাতে মাসের পর মাস লেগে যাবে। হোটেলে ফিরে এসে মানচিত্র খুলে কুইবেক থেকে শুরু করে আমার যাত্রা পথের প্রথম পর্ব দেখতে লাগলাম। এরপর ফ্লোরেন্স খালাকে টেলিগ্রাম করলাম, সবচেয়ে সস্তার ট্রান্স ক্যানাডা বিমানপথে মন্ট্রিলে যাবার টিকিট কিনলাম এবং কোন এক পয়লা সেপ্টেম্বরের সুন্দর সকালে আমার যাত্রা হল শুরু।

ছ বছর পরে এই প্রত্যাবর্তন ছিল একই সঙ্গে মনোহর ও বিস্ময়কর। আমার খালা বললেন যে, তিনি আমাকে চিনতেই পারতেন না। আমিও কুইবেককে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যখন চলে যাই তখন কেল্লাটাকে মনে হত বিশাল ও রাজকীয়; এখন এটাকে মনে হল ডিসৃনিল্যান্ডের খেলাঘর থেকে কোন একটা বাড়ির অনুকরণে তৈরি বিরাট খেলনা। অবাক হবার কিছু নেই এই ভূমির সন্তান হবার দরুন বাইরের বিশাল জগতে অবতরণের ফলে আমি ছিলাম অপ্রস্তুত, অস্ত্রহীন। তা স্বত্ত্বেও যে আমি বেঁচে ফিরতে পেরেছি সেটাই পরমাশ্চর্য!

খালার কাছ থেকে খুব সাবধানে এই সব চিন্তাগুলি গোপন করে রাখতাম। তবে সন্দেহ হয় যে, তিনিও ইউরোপে অর্জিত আমার সমাপ্তির র ছটা দেখে সমপরিমাণেই চমকিত এবং সম্ভবত একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থাকবেন। তিনি নিশ্চয়, আমি যতই ভেতরে ভেতরে সোজা সরল অনুভব করি না কেন, আমাকে একটি শহুরে ইঁদুর বলেই চিনতে পেরেছিলেন। তাই তিনি একগাদা প্রশ্নাবলী নিক্ষেপ করে আবিষ্কার করতে চাইলেন কেন আমার চেহরার সহজ লাবণ্য চলে গিয়েছিল। দ্রুতগতির জীবনযাত্রা আমার জীবনকে কতটা নোংরা করেছে (খালা ধরেই নিয়েছিলেন যে ওদেশে আমি দ্রুতগামী জীবনই যাপন করেছি)।

সত্যি কথা শুনলে তিনি মূচ্ছা যেতেন। কাজেই আমি সতর্কতার সঙ্গে বলেছি যে, যদিও ছেলেদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ইত্যাদি হয়েছে তবুও আমি অভগ্ন হৃদয় ও ক্ষগ্রিস্ত না হয়েই কালাপানির ওপারের রক্তিম শহরগুলি থেকে ফিরতে পেরেছি। না, কোন সাময়িক অর্থের কারো সঙ্গে কোন ইয়ে টিয়ে হয়নি। সম্ভ্রান্ত কোন লর্ড তো দূরের কথা সাধারণ মানুষও আমাকে বিবাহের জন্য প্রস্তাব দেয়নি–এটা আমি সত্যি সত্যিই বলতে পারি তাই কোন ছেলে বন্ধু। রেখে আসিনি পেছনে।

আমার মনে হয় না যে, তিনি এগুলি বিশ্বাস করেছিলেন। আমার চেহারা সম্পর্কে তিনি প্রশংসাই করলেন। আমি একটি সুন্দরী–বিড়ালীতে পরিণত হয়েছি। মনে হচ্ছিল যে, আমার মধ্যে গড়ে উঠেছে সেই লাস্য যার মূল ফরাসি শব্দটির অর্থ যৌন আবেদন অথবা অন্ততপক্ষে সেরকম ভাবসাববিশিষ্ট। এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল যে তেইশ বছর বয়সেও আমার জীবনে কোন পুরুষ্যের আগমন ঘটেনি। আমার দেশ পর্যটনের পরিকল্পনা শুনে তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং পথে যে-সব সর্বনাশা বিপদ ওঁৎ পেতে আছে তার জীবন্ত ছবি আঁকলেন। আমেরিকা তো ডাকাত গুণ্ডায় ভর্তি। রাজ্যে রাজ্যে প্রসারিত আন্তনগর সড়কগুলিতে আমি নিশ্চয় আক্রান্ত হব; আমার যথাসর্বস্ব লুঠ করে নেওয়া হবে। যাইহোক স্কুটারে চেপে এরকম অভিযানে বেরানোটা নারীজননাচিৎ কাজ নয়। বসবার সীটটা যেন এমন হয় যাতে একই দিকে দুই পা ঝুলিয়ে বসতে পারি। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমার ভেসপা রীতিমত খানদানি স্কুটার এবং যখন মন্ট্রিলে ডেলিভারি নিতে গিয়ে মাইলের পর মাইল নব নব রোমাঞ্চের মধ্যে দিয়ে রাজকীয়ভাবে সেই স্কুটার একা চালিয়ে ফিরে এলাম তখন মাসি সন্দেহের গলায় বললেন, তাহলে তো খুব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে দেখছি। তারপর একদিন পনেরই সেপ্টেম্বর, আমেরিকান এক্সপ্রেস -এ আমার যৎসামান্য অ্যাকাউন্ট থেকে এক হাজার ডলারের ট্রাভেলার্স চেক কেটে নিয়ে, স্কুটারের বসবার আসনের দু পাশের থলি দুটোতে অতি প্রয়োজনীয় পরিচ্ছদের নূন্যতম সম্ভার ভরে নিয়ে, ফ্লোরেন্স মাসিকে বিদায় চুম্বন দিয়ে সেন্ট লরেন্সের পাশাপাশি দু নম্বর প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে চললাম। যুদ্ধের পর থেকে এর লম্বা তীর জুড়ে যে বাড়ি ও গোসল করার কুটিরগুলি ব্যাংয়ের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে, সেগুলি না থাকলে কুইবেক থেকে দক্ষিণে মন্ট্রিলের দিকে এগিয়ে যাওয়া এই দু নম্বর সড়ক পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রাজপথগুলির অন্যতমা হতে পারত। এই মহান নদীর ঠিক উত্তর পাড়ে পাড়ে চলেছে এই প্রধান সড়ক। ছোট বেলার গোসল-চড় ইভাতির জন্য জায়গাটা চিনতাম। তখনই সেন্ট লরেন্স দিয়ে সমুদ্রপথে যাবার জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং ক্রমাগত বড় বড় জাহাজের ইঞ্জিনের ঝুপঝুপ শব্দ। তাদের ভোঁ বাজা, সিটির শব্দ ছিল এক নতুন রোমাঞ্চ।

বেশ মেজাজে গুঞ্জন করতে করতে ঘন্টায় চল্লিশ মাইল জোরে ছুটে চলেছিল ভেস্পা। দৈনিক গড়ে দেড়শ থেকে দু শ মাইল যাব বলে ঠিক করেছিলাম; অর্থাৎ রোজ ছ ঘণ্টা করে চালানো, তবে কাঁটায় কাঁটায় এই ছক মেনে চলবার তেমন কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি সব কিছু দেখতে চাইছিলাম। যদি কোন গুপ্ত রহস্যময় শাখাপথ বেরিয়ে গিয়ে থাকে, সেটা আমি ধরে যাব; তখন যদি কোন নয়নাভিরাম উল্লেখযোগ্য জায়গা চোখে পড়ে আমি তবে সেখানে থেমে চোখ ভরে তা দেখে নেব।

ক্যানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলে পিকিন এরিয়া বা চড় ইভাতির এলাকা গুলির উদ্ভাবনটা বেশ ভাল হয়েছে। জঙ্গল সাফ করে নদী বাহ্রদের ধারে খানিকটা জায়গা নিয়ে। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য গাছের ফাঁকে ফাঁকে গাছের ডাল কেটে কেটে প্রচুর বেঞ্চি ও টেবিল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি না হলে এই সব টেবিল বেঞ্চিতে বসেই দুপুরের খাওয়াটা রোজ সেরে নেব ভাবলাম।

দোকান থেকে দামী দামী খাবার না কিনে হোটেলের নৈশবাস ছেড়ে আসার আগেই সেখান থেকে ডিম আর গোমতা শুকনো মাংস দিয়ে টোস্টারে স্যান্ডউইচ তৈরি করে নেব। এর সঙ্গে ফল ও এক ফ্লাস্ক কফি হবে আমার মধ্যাহ্ন ভোজনের খাদ্যতালিকা। তবে সন্ধ্যেবেলায় নৈশ্য ভোজের সময় এটা পুষিয়ে নেব। আমার রোজকার খরচের বাজেট রেখেছিলাম পনের ডলার। বেশির ভাগ হোটেলে একজনের থাকার খরচ আট ডলার করে, এর ওপর আবার সরকারি কর। তাই আমি এ বাবদ নয় ডলার ধরলাম। এ ছাড়া ভোরবেলা খাবার জন্য কফি এবং একটা মাংসের প্যাটিস। পেট্রোলের জন্য রোজ এক ডলারের বেশি লাগবে না। এতে দুপুর ও রাত্রে খাবার ও এক আধবার পানও কিছু সিগারেটের জন্য আমার হাতে থাকবে দিনে পাঁচ ডলার। আমি এর মধ্যেই কুলিয়ে নেবার চেষ্টা করব।

এসো কোম্পানি ও আমেরিকান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের যে পথনির্দেশ ও মানচিত্র আমার কাছে ছিল, তাতে সীমান্ত পেরোবার পর অসংখ্য দর্শনীয় জায়গার তালিকা দেওয়া ছিল। যেমন, ফেনিশোর কুপার রেড ইন্ডিয়ানদের রাজ্য, তারপর মার্কিন বিপ্লবের অনেক যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা, আসার পথে পড়বে। এদের অনেক জায়গাতেই প্রবেশ মূল্য এক ডলারের কাছাকাছি। তবে ভাবলাম যে এতেই চলে যাবে। যদি কোনদিন খরচ বেশি হয়ে যায় তবে অন্যান্য দিন না হয় খাওয়ার খরচটা কমাব।

ভেসপাকে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দেখলাম অনেক বেশি পোক্ত এবং চালানো আশ্চর্যজনক সোজা। যতই হাতের মুঠোয় গিয়ার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভালভাবে আসতে লাগল, ততই এই ক্ষুদে যন্ত্রটার ওপর শুধু চড়ে না গিয়ে, এটাকে ইচ্ছামত চালাতে লাগলাম। বিশ সেকেন্ডের মধ্যে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত গতিবেগ ওঠানো যে কোন মার্কিনী গাড়িকে হতচকিত করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। পাখির মত পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে যেন উড়ে উঠছিলাম; এগজস্ট দিয়ে মধুর একটা কলরব উঠছিল সীটের নিচে থেকে। তবে অল্পবয়সীদের মুহুর্মুহু সিটি দিয়ে ইশারা করা এবং বয়স্কদের হেসে হেসে হাততালি দেওয়া, আমাকে যথেষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। হয়ত খালার ভবিষ্যদ্বাণীর মত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারে, আমি এই সব অপ্রীতিকর ঘটনাও উপভোগ করতে পেরেছি। সবাইয়ের দিকে তাকিয়েই আমি শুধু মাধুর্যের তারতম্য ঘটিয়ে স্মিত হাসি জুড়ে দিয়েছি।

উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ পথের আস্তরণই খারাপ। আশঙ্কা ছিল যে জাতীয় সড়কগুলিতে খোবলানো খোবলানো গর্তগুলির জন্য স্কুটার চালাতে আমাকে ভারি বেগ পেতে হবে এবং দূরপাল্লার স্কুটার যাত্রিনী দেখতে বহু লোকের ভিড় হবে। কিন্তু দেখলাম এ পথের অন্যান্য ড্রাইভাররা আসলে ছোট কোন পুতুলের মত ভেবেছিল; তারা আমাকে পথের এমন চমৎকার চওড়া অংশ ছেড়ে দিয়ে যেতে লাগল যে প্রায় সময়ই রাজপথের মধ্যবর্তী একটি আংশিক সরণী আমার একার ব্যবহারের জন্যই পেতে লাগলাম।

প্রথম দিনটা এত সুন্দর উৎরে গেল যে আমি মন্ট্রিল পার হয়ে গেলাম সন্ধ্যা নামার আগেই, তখন আমি ননম্বর জাতীয় সড়কে বিশ মাইল এগিয়েছি; পরদিন সকালে সীমান্ত পেরিয়ে নিউইয়র্ক রাজ্যে ঢুকব। দা সাদার্ন ট্রেল মোটেল -এ উঠলাম রাতের অতিথি হয়ে। সেখানে আমাকে এমনভাবে দেখা হল যেন আমি আসোশিয়া ইয়ারহার্ট অথবা অ্যামি মলিসন। যেভাবে এ যাবৎ চলছিল, তার তুলনায় খুবই দারুণ এই অভ্যর্থনা। কাফেটেরিয়াতে ভরপেট খেয়ে, হোটেলের মালিকের প্রচণ্ড এক গ্লাস পানীয় সঙ্কোচের সঙ্গে বসে পান করে, আমি শুতে গেলাম সুখ ও চাঞ্চল্য নিয়ে। দীর্ঘ কিন্তু আশ্চর্য দিন ছিল সেটি। ভেসপা ছিল আমার স্বপ্ন, আমার সমস্ত পরিকল্পনা সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়ে চলছিল।

প্রথম দশ মাইল পাড়ি দিতে আমার একটা দিন লাগল। এর পরের আড়াইশ মাইল পেরোতে লাগল প্রায় দু সপ্তাহের মত। এতে কোন রহস্যের ব্যাপার নেই। মার্কিন সীমান্তরেখা ভেদ করে ঢুকতেই অ্যাডিরোনডাসের আশেপাশে আমি বেড়াতে লাগলাম, যেন বিলম্বিত গ্রীষ্মবকাশ উপভোগ করতে বেরিয়েছি। ভ্রমণ কাহিনী লিখতে যাচ্ছি না, তাই খুঁটিনাটি বিবরণ দেবার দরকার নেই। তবে ওই অঞ্চলে এমন কোন পুরানো দুর্গ, জাদুঘর জলপ্রপাত, গুহা বা উঁচু পাহাড় ছিল না, যা আমি দেখিনি। স্টেরিল্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার টাউন এবং নকল রেড) ইন্ডিয়ান সংরক্ষণ প্রভৃতি জায়গাতেও দর্শনী হিসেবে এক ডলার করে খরচ হয়েছিল। হৈ-চৈ করে দর্শনীয় বস্তুগুলি দেখতে যাবার মধ্যে প্রকৃত কৌতূহল থাকলেও আমার আর একটা বিশেষ গুঢ় উদ্দেশ্য ছিল। তা হল রাতের জন্য একটা আস্তানা খুঁজে বের করা; যখন এইসব হ্রদ নদী বন ছেড়ে দক্ষিণের দিকে যাব জাতীয় সড়কগুলির দুর্গম কমডোলারেডো সসেজের দোকান এবং নিওনের ফিতের মত আলো সেখানে ঝরে পড়ছে।

এই দু-সপ্তাহের শেষদিকেই আমি লেকজর্জের কাছে এলাম। অ্যাডিরোনডাকলে পর্যটনের দুরন্ত কেন্দ্র যা কোন রকমে বনভূমি এবং অরণ্যচরদের একটা বন্য আশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল। এখান থেকেই ন নম্বর জাতীয় সড়কের ভয়ঙ্কর ব্যস্ততা থেকে কেটে পড়েছিলাম এবং বনের বুক চিরে যে ধুলিধুসর পথটা গেছে, তা ধরেই দা ড্রিমি পাইনস মোটর কোর্টে পৌঁছে আরামকেদারায় বসে এখন মনে করে চলেছি কিভাবে এখানে এলাম।

.

ওরা এল বসার ঘরে

আগের মতই মুষলধারে তীব্র বৃষ্টিপাত হচ্ছিল।

বৃষ্টির পানি বেরুবার জন্য বাড়িটার ছাদের চারতলায় চারটি মুখ রয়েছে তা দিয়ে কলস্বরে জমা পানি বের হবার শব্দের নেপথ্য সঙ্গীত হিসাবে ওই ধারাপাতের অবিশ্রান্ত গর্জন বেশ মিলে গিয়েছিল। আমি বিছানার দিকে তাকালাম। আমার ছোট্ট কুঠুরিতে কি নিবিড় ঘুমেই না আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ব–ওই চমৎকার পার্কেল চাদরের ওপর, যা দিয়ে হোটেলের বিজ্ঞাপনে আগন্তুক অতিথিদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিলাসবহুল, এলিয়েট ফ্রে মার্কা বিছানা, ম্যাজি কাস্টমের নক্সা করা কার্পেট, ফিলকো কোম্পানির তৈরি টেলিভিশন এবং বাতানুকূল ব্যবস্থা, আইস ম্যাজিক যন্ত্রে তৈরি বরফ, অ্যাক্রিন কম্বল, সিম ভিভ্যার তৈরি আসবাবপত্র। (আমাদের কেসেলিক ল্যামিনেটরে তৈরি দেরাজ ও টেবিলের ওপরটা, সিগারেটের পোড়া ও মদের দাগ প্রতিরোধক)-অ্যাক্রিলাইটের তৈরি ধারা স্নানাগারের বন্ধনী, অলসোনাইট পার্লেমেন্টের তৈরি শৌচাগারের পাদানি এবং তথাকথিত টয়লেট পেপারের বদলে বাথরুম টিসু (সমকালীন গৃহবর্নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শৌচাগারে ব্যবহার কাগজগুলি আধুনিক নানারঙে রঞ্জিত)–এসবই আজ রাতে আমার, একলা আমার!

এই সব সাজ-সরঞ্জামসহ একটা সুন্দর জায়গাতে অবস্থিত হওয়া স্বত্ত্বেও, মনে হয়, দা ড্রিমি পাইনস তেমন একটা ভাল চলছিল না। দু সপ্তাহ আগে যখন আমি এখানে এসেছিলাম তখন গোটা বাড়িটায় মাত্র দুজন রাত কাটানোর অতিথি ছাড়া আর কোন খদ্দের ছিল না। মরশুম শেষ হতে মাত্র দু-সপ্তাহ বাকি, এই দু সপ্তাহের জন্য কোন কক্ষই কেউ সংরক্ষণ করেনি।

সেদিন বিকেলে যখন আমি এখানে এলাম, তখন মিসেস ফ্যান্সি তিক্ত, অবিশ্বাস্যপূর্ণ, গম্ভীর মুখ, সদ্য ঢালাই করা লোহার মত ধূসর রং-এর ত্বক নিয়ে রিসেপশনিস্টের টেবিলে বসে। উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। একা একটি মেয়ে, সঙ্গের ঝুলিতে যৎসামান্য জিনিস নিয়ে তার ভেসপা স্কুটারে? নম্বর সড়ক থেকে এদিকে আসছে; আমার কার্ডটা হাতে ধরে তিনি খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখলেন যে আমার ড্রইভিং লাইসেন্সটা ভুয়া কিনা।

মহিলার স্বামী জেড় এদিকে অনেক বেশি উদার; কিন্তু পরে যখন কাফেটেরিয়াতে লোকটির হাত আমার বুকে ঘটে গেল তখন বুঝতে পারলাম ওই উদারতা কেন। পরে অবশ্য তিনি আমার জন্য কফি বয়ে আনলেন। দেখা যাচ্ছিল তিনি ছোটখাট ফাইফরমাসের কাজ এবং টুকটাক রান্নার কাজ এই দ্বৈত ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গ ধীরে ধীরে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ঘুরে ফিরে ঘ্যানঘ্যান করছিলেন যে মোটল বন্ধ করার আগে চারদিকে কত কাজ তার পড়ে রয়েছে। এরই মধ্যে যারা মালপত্র নেবার কাজ করছে তাদের ডিম ভেজে দেবার জন্য ঘন ঘন তার ডাক পড়ছিল। মনে হল যে মালিকের এই দু জন ম্যানেজার। হোটেল মালিক থাকতেন ট্রয় শহরে। নাম মিস্টার সানগুইনেত্তি।

-মালদার আদমী। কোহেস রোড বেয়ে নেবে গেলে একটা জায়গায় প্রচুর সম্পত্তির মালিক, নদীর ধারেই। এ ছাড়া আলবেনীর পরে ননম্বর সড়কে পেল্লায় সে বাড়িটা ট্রোজান হর্স –তার কথা শুনেছেন? শুনিনি বলতে মিস্টার ফ্যান্সি ধূর্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন, যদি কখনো মজা করতে হয় তো হর্সের কাছে চলে যান। তবে একা না। যাওয়াই ভাল। আপনার মত সুন্দরী একটু ঝামেলায় পড়তে পারে। পনের তারিখের পরে যখন আমরা এখান থেকে চলে যাব, তখন একবার ফোনে যোগাযোগ করবেন। আমার নাম ফ্যান্সি, টেলেফোন ডিরেক্টরীতে পেয়ে যাবেন। আপনার সঙ্গী হতে পারলে খুশিই হব। মজার অন্ধি সন্ধি বাৎলে দেব। — ধন্যবাদ। তবে এখন তো শুধু এসব অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার গন্তব্য দক্ষিণের দিকে যাবার জন্য। হলদে দিকটা ওপরে রেখে কয়েকটা ডিম ভাজা মাংস দিয়ে যদি আমাকে দেন আপাতত?।

শুনেও মিস্টার ফ্যান্সি আমাকে একা ছেড়ে যাবেন না, যাবার সময় আমার ছোট টেবিলটার সামনে বসে ওর নিজের এক ঘেয়ে জীবন কাহিনীর টুকরো ও তার অনেক ঘটনা শোনাতে শোনাতে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বাভাবিক কৌতূহলেই প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন, বাবা মার কে কে আছেন, বাড়ি ছেড়ে এতদূর এসে মন খারাপ লাগছে কিনা, মার্কিন দেশে আমার কোন বন্ধু আছে কিনা–এইসব।

মোটের ওপর লোকটির বয়েস পঁয়তাল্লিশের ধারে কাছে, প্রায় আমার বাবার বয়সী হবে। এর স্ত্রীও এর জাতেরই। ঘরের অন্য সীমা থেকে অভ্যর্থনা কেন্দ্রের টেবিলের ওপাশে বসে তিনি আমাদের লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত মিস্টার ফ্যান্সি আমাকে ছেড়ে ওর স্ত্রীর কাছে গেলেন। আমি কফির দ্বিতীয় কাপ (এর জন্য কোন দাম লাগবে না দিদিমনি। দা ড্রিমি পাইনস এর শুভেচ্ছা জানাবার জন্য এটা) শেষ করতে করতে সিগারেট খাচ্ছিলাম বসে। নিচু গলায় কোন বিষয় নিয়ে ওদের কথা বলতে শুনছিলাম যা, মাঝে মাঝে হাসির শব্দ ওঠায়, মনে হচ্ছিল, ওদের কাছে বেশ সন্তোষজনক হচ্ছে। শেষে মিসেস ফ্যান্সি আমার কাছে উঠে এলেন। আমার দুঃসাহসী অভিযান। সম্পর্কে মা-খালার মত উকণ্ঠা। (ও মাগো! তোমরা আধুনিক মেয়ে এরপর কি করবে গো) জানালেন। তারপর ঝেকে বসলেন এবং যতটা মনোরম ভাব ফোঁটানো সম্ভব ফুটিয়ে বললেন যে, আমি আরও কয়েকদিন ওখানে থেকে জিরিয়ে নিয়ে সঙ্গে কিছু ডলার রোজগার করে নেই না কেন। ওদের রিসেপশনিস্ট চব্বিশ ঘণ্টা আগেই চলে গেছে। এজন্য সব কিছু দেখা, গোছগাছ করা, মরশুমের শেষে হোটেল বন্ধ করার হ্যাপা–এসব সামলে ওই কাজ কে দেখে? আমি কি শেষ দু-সপ্তাহের জন্য কাজটা চালিয়ে নেব? খাওয়া-থাকা ছাড়া সপ্তাহ তিরিশ ডলার হিসেবে।

দেখলাম, বিনা পয়সায় খাওয়া থাকা এবং ওই ষাট ডলার দক্ষিণা রোজগার করতে পারলে তো ভালই হয়। এর মধ্যে ট্যুরিস্টের মেজাজে আমি গোটা পঞ্চাশ ডলার বাড়তি খরচা করে ফেলেছি। এই রোজগার আমার ওই খরচার ক্ষতিপূরণ করবে। ফ্যান্সিদের হাবভাবে ততটা আমল দিলাম না। ভেবে নিলাম যে পথে বেরিয়ে সব শ্রেণীর লোকের দেখা পাব বলে তৈরি ছিলাম, এরা তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট কিছু নয়। তাছাড়া, এটাই প্রথম চাকরি যা আমাকে সেধে দেওয়া হচ্ছে; তাই কেমন করে এটা করি দেখার জন্য কৌতূহলও ছিল। সম্ভবত, আমার কার্যকাল শেষ হলে এরা একটা কিছু সার্টিফিকেটও দেবেন যা দেখিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যাবার পথে অন্য কোন হোটেলে কাজ পেতে পারি। কাজেই নম্র ভাবে কিছু খবরাখবর নিয়ে আমি বললাম যে প্রস্তাবটা বেশ চমৎকার। ফ্যান্সীরা মনে হল খুব খুশি হয়েছে এবং মিলিমেন্ট (মহিলার নাম) আমাকে পুঞ্জীভূত করার বা রেজিস্টার লেখার পদ্ধতি দেখিয়ে দিলেন। বলে দিলেন, যে সব আগন্তুকরা কম মালপত্র ও বড় স্টেশন ওয়াগন নিয়ে আসবে, তাদের ওপর যেন নজর রাখি। এরপর আমাকে তাড়াতাড়ি করে গোটা প্রতিষ্ঠানে ঘরদোর দেখিয়ে দিলেন।

সব কিছু বেশ ভালয় ভালয় উৎরে গেল; কাজটায় কোন সমস্যাই দেখা দিল না। বাস্তবিক করণীয় কাজ এতই যৎসামান্য ছিল যে আমার ভেবে অবাক লাগত যে কেন ফ্যাশীরা আমাকে আদৌ বহাল করল। তবে দুজনেই ছিল রাম কুঁড়ে, আর নিজেদের টাকায় তো আর মাইনে দিচ্ছে না এবং নিয়োগের আংশিক কারণ সম্পর্কে আরেকটা অনুমান এই যে জেড় ভেবেছিল সে একজন অনায়াস শয্যাসঙ্গিনী পেতে পারবে। ওর আগ্রাসী হাতকে এড়িয়ে এবং দৈনিক গড়ে একবার করে শীতলভাবে ওকে প্রতিরোধ করে, ঘুমোবার আগে দরজার হাতলের নিচে একটা চেয়ার আটকে রাখে, যাতে ওখানে আমার দ্বিতীয় রাত্রিতে চাবি দিয়ে যেমন দরজা খোলার চেষ্টা করেছিল, তা না করতে পারে, এসব করে, ওর সে মতলবও কোন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারেনি।

প্রথম সপ্তাহে আমাদের গুটি কয় অতিথি এল রাত্রিবাস করার জন্য। দেখা গেল যে গেরস্থালির দেখার দিকটাও আমার কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে। যাই হোক মক্কেলরা খসে পড়ল এবং দশই অক্টোবরের পরে আর একজনও রইল না।

দৃশ্যতঃ এই বিশেষ অবকাশকালীন জগতে পনেরই অক্টোবর যেন এক ধরনের জাদুকরী তিথি। ওই তারিখে সব কিছুর ঝাঁপ ফেলা হয় শুধু বড় বড় জাতীয় সড়কগুলির আশপাশটা–এর ব্যতিক্রম। শিকারের মরসুম আসছে। ধনী শিকারীরা পাহাড়ে নিজেদের মৃগয়া সমিতি বা মৃগয়া শিবিরে উঠবেন। যাদের অত টাকা পয়সা নেই তারা চড় ইভাতির এলাকাগুলির একটা না একটাতে গাড়ি রেখে ভোর সময় গর্বতগাত্রের জঙ্গলে ঢুকে পড়বেন হরিণের সন্ধানে। সে যাই হ ক অক্টোবরের পনেরই পেরুতে দৃশ্যপট থেকে পর্যটক-ভ্রমণার্থীরা অন্তর্হিত হন এবং অ্যাডিরোনডালে অনায়াসে অর্থোপার্জনের সুযোগও সেইসঙ্গে উধাও।

মুরসুমের শেষের বন্ধ করার দিনটি যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই ট্রয়ের মিস্টার সান্গুইনেত্তি ও ফ্রান্সীদের মধ্যে ঘনঘন টেলিফোনে কথাবার্তা হতে লাগল; এবং এগার তারিখে মিসেস ফ্যালী আমাকে কথায় কথায় বললেন যে, তিনি ও জেড তের তারিখেই ট্রয়ে ফিরে যাচ্ছেন, তাই সে রাতটার জন্য হোটেলের ভার নিয়ে চৌদ্দ তারিখে দুপুর নাগাদ যখন মিস্টার সানুগুইনেত্তি প্রতিষ্ঠানটি পাকাপাকিভাবে বন্ধ করার জন্য আসবেন তখন তার হাতে চাবিটি হস্তান্তর করে দিতে আমার অসুবিধা আছে কিনা।

প্রথমত, একটি অচেনা মেয়ের হাতে এত মূল্যবান সম্পত্তি ছেড়ে যাবার ব্যাপারটা কিছুটা অনির্দিষ্ট ধরনের বন্দোবস্ত বলেই মনে হল। তবে পরে বিশদ করে বুঝিয়ে দেওয়া হল যে, ফ্যাশীরা টাকাকড়ি, রেজিসটার খাতা, খাবার ও পানীয়ের মজুত মাল ওদের সঙ্গে নিয়ে যাবে; যা আমাকে করতে হবে তা হল শোবার আগের দিকেই অস্থাবর বাকি যা রইল সেগুলি নিয়ে যাবার জন্য মিস্টার সাল্গুইনেত্তি ট্রাক নিয়ে আসবেন। আমি আবার নিজের কার্যসূচি শুরু করতে পারব। আমি তাই বললাম, বেশ, রাজি।

খুব উল্লসিত হয়ে মিসেস ফ্যান্সী বললেন যে, আমি দারুণ লক্ষ্মী মেয়ে। যখন বললাম যে তিনি আমাকে কোন সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন কিনা তখন যেন কেমন অস্বস্থি প্রকাশ করে বললেন যে, সে ব্যাপারটা তাকে মিস্টার সাল্গুইনেত্তির ওপরই ছেড়ে দিতে, তবে তিনি নিশ্চয় উল্লেখ করবেন যে, আমার কাছ থেকে কত সাহায্য পাওয়া গেছে।

কাজেই শেষ দিনভর, আমার এবং যারা ট্রাক নিয়ে আসবে তাদের জন্য প্রচুর শুকনো মাংস, ডিম, কফি এবং রুটি রেখে কাকটোরিয়া ও মালগুদাম থেকে জিনিসপত্র বেঁধে হেঁদে ওদের স্টেশন ওয়াগনে বোঝাই করা চলতে লাগল।

ওই শেষ দিনটা ভেবেছিলাম ফ্যালীরা অন্তত আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে। মোটের ওপর আমরা একত্রে আমার কাজের এক্তিয়ারের বাইরে এসে সব বিষয়ে ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে সাহায্য করতে লাগলাম। কিন্তু ভারি অদ্ভুত ঠেকল ওদের ঠিক বিপরীত ধরনের ব্যবহারের রীতি দেখে। মিসেস ফ্যান্সি আমাকে এমন ভাবে হুকুম করতে লাগলেন যেন আমি ওদের ঝি। আর জেড ও বেপরোয়া লম্পটের মত, ওর বৌ শুনতে পায় এমন জায়গা থেকে ও নোংরা সব কথা বলতে লাগল এবং বেশ প্রকাশ্যে হাতের আওতার মধ্যে এলেই গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করতেও লাগল। এই পরিবর্তনের কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। মনে হল আমার কাছ থেকে যা যা কাজ আদায় করা দরকার তা উশুল হয়ে গেছে তাই এখন তারা আমাকে অসম্ভব ও এমনকি প্রায় ঘেন্নার সঙ্গে উপেক্ষা করতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত আমি এমন রেগে গেলাম সে মিসেস ফ্যান্সির কাছে গিয়ে বললাম, যে আমি চলে যাব, আমার পাওনাটা কি এখন পেতে পারি? তিনি শুধু হেসে বললেন, ওঃ না। মিস্টার সানুগুইনেত্তি এসে আমার পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেবেন। যদি কাঁটা চামচের সংখ্যা তখন গুনতি মিলিয়ে কম হয়ে দেখা যায়, তাতে তারা সে দায়িত্ব নেবে না। এর পরে এবং অপরাহ্নের যাবার সময় আর ওদের মুখদর্শন করার প্রবৃত্তি না হওয়ায়, আমি নিজের জন্য কিছু জ্যাম দিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিয়ে ঘরে এসে চাবি আটকে বসে যে সকালবেলা ওরা চলে যাবে। তার আগমনের জন্য প্রার্থনা করতে লাগলাম। প্রার্থনা অনুসারেই অবশেষে এক সময় ঘড়িতে ভোর ছ টা বাজল এবং দানবদানবী যুগল বিদায় হল।

আর এখন দা ড্রিমি পাইনসে আজই আমার শেষ রজনী, আগামীকাল থেকে আমি আবার মুক্ত। জীবনের একটা অংশ এখানে পেলাম যা ফ্যান্সীরা থাকা সত্ত্বেও পুরোপুরি অপ্রীতিকর নয়, বরং এখানে একটা কাজের প্রাথমিক দিকটা আমি শিখতে পেরেছি যা থেকে পরে ভালই হবে। ঘড়ি দেখলাম। নটা বাজল, আলবেনীর জয়াকো বেতার কেন্দ্রের নিয়তি নির্দেশ শুরু হল। অ্যাডিরোনডালের আবহাওয়া আজ মধ্যরাত্রের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

কাজেই কপাল যাই হোক সকালবেলা রাস্তাটা শুকনোই পাচ্ছি। কাফটেরিয়া বারের পেছনে গিয়ে বৈদ্যুতিক উনুনটা জ্বালালাম তারপর তিনটে ডিম এবং ছ-টুকরো মাংস নিয়ে তাতে চড়িয়ে দিলাম, ক্ষিদেয় পেট জ্বলছিল। আর ঠিক তখনই দরজার ওপর তুমুল করাঘাত শোনা গেল।

.

ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন

 আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার দাখিল। কার আসার সম্ভাবনা? তখন মনে পড়ল। বাজ পড়ার সময় ঘরখালি আছে লেখা নিওন-বিজ্ঞাপনের সুইচটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। পরে আর সেটা নেভাতে ভুলে গেছি। কি আহাম্মকী! আবার দরজা ধাক্কানো শুরু হল। যাকগে, আমাকে ব্যাপারটা সামলাতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে, আগন্তুকদের লেক জর্জে ফেরত পাঠাতে হবে। এস্ত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে চেন দিয়ে দরজাটা সামান্য ফাঁক করা। অবস্থায় আটকে রাখলাম।

কোন গাড়িবারান্দা ছিল না। নিওন আলোর বিজ্ঞাপনটা একটা লাল দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছিল বৃষ্টির মধ্যে। আগন্তুক দু জনের চকচকে বর্ষাতি এবং শিরস্ত্রাণে তার আভা পড়ে চিকমিক করছিল। তাদের পেছনে একটা কালো রঙের বড় গাড়ি। সামনের লোকটি নম্রভাবে বলল, মিস মিশেল? হ্যাঁ আমারই নাম। তবে ঘর খালির নিওনের বিজ্ঞাপনটা ভুলে জ্বালানো হয়েছে। এই হোটেল এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি বললাম।

-নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার মিস্টার সাইনেত্তির কাছ থেকে আসছি। তার বীমা কোম্পানি থেকে। কাল মালপত্র সরাবার আগে আমরা সব কিছুর একটা লিস্ট বানাব। বৃষ্টি থেকে ভেতরে আসতে দেবেন? ভেতরে গিয়ে আপনাকে পরিচয় পত্র দেখাচ্ছি। কি ভয়ঙ্কর রাত্রি, লোকটি বলল। সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে দু জনকে নিরীক্ষণ করলাম একে একে। কিন্তু বর্ষাতির শিরস্ত্রাণে তাদের মুখ এমন আবৃত ছিল যে মুখের কিছুই প্রায় দেখতে পেলাম না। কথাটায় তেমন কোন গলতি ছিল না ঠিকই, কিন্তু আমার ভাল লাগছিল না। একটু ভয় ভয় ভাবে বললাম, নিশ্চয়, মিস্টার টমসন। বলে সে আবার হাসল।

-ঠিক আছে মেমসাহেব। আমরা কি ভেতরে আসতে পারি? বাইরে একেবারে দোজয়ের পানি ঝরছে।

–আমি জানি না। কাউকে ভেতর ঢুকতে দেবার কথা আমাকে বলা হয়নি। তবে যেহেতু আপনারা মিস্টার সাল্গুইনেত্তির কাছ থেকে…

আমি ত্রস্তভাবে চেনটা খুলে দরজা খুললাম।

তারা ঠেলে ঢুকল আমাকে অভদ্রভাবে পাশ কাটিয়ে। তারপর দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বড় ঘরটাকে দেখতে লাগল। যাকে মিস্টার টমসন বলে ডাকা হল সে হাঁচল। শীতল, ধূসর, মুখ থেকে কালো চোখ দুটো আমাকে দেখছিল।

-সিগারেট খান?

— সামান্য সামান্য। কেন?

-মনে হয় আপনি সঙ্গ পেতে পারতেন। আমার হাত থেকে দরজার হ্যান্ডেলটা নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চেন আটকে দিল। ওরা দু জনে জলসিক্ত বর্ষাতি খুলে বিচ্ছিরিভাবে মেঝের ওপর ছুঁড়ে দিল। এখন দু জনকেই দেখতে পেলাম। অনুভব করলাম আমি চরম বিপদের মধ্যে পড়েছি।

মিস্টার টমসন।

নিশ্চয়ই দলপতি। লম্বা, পাতলা, প্রায় কঙ্কালসার, ধূসর চামড়া, কোটরে ঢাকা চোখ, যেন সব সময়ে ঘরের ভেতরেই থাকে। কৌতূহলহীন কালো চোখ ধীরে ধীরে নড়ে। এবং লাল পাতলা ঠোঁট দুটি সেলাই না করা ক্ষতস্থানের মত ফাঁক হয়ে রয়েছে।

গায়ে একটা ছাই ছাই রং-এর শার্ট। গলা অবধি বোম আটকানো। টাইনেই। পায়ে ছুঁচালো ইটালিয়ান ধাঁচের ছাই রঙ সুয়েডের জুতা। সব কিছুই আনকোরা নতুনের মত দেখাচ্ছিল। একটা ভীতিকর গিরগিটির মত দেখতে তাকে। ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল।

এই লোকটাকে দেখতে যেমন মারাত্মক, এর সঙ্গী সেক্ষেত্রে বরং শুধু অপ্রীতিকর। বেঁটে খাটো গোল গোল মুখ, ভেজা-ভেজা ফ্যাকাশে নীল রং-এর চোখ, পুরু রসসিক্ত অধর। গায়ের চামড়া ধবল শ্বেত রং-এর। তার বোধহয় কোন অসুখ ছিল যাতে গায়ের চামড়া নির্লোম হয়ে গিয়েছিল। ভুরু কিংবা চোখের পালক ছিল না। মাথায় এক গাছি চুলও না। টাকটা একেবারে বিলিয়ার্ড বলের মত চকচকে পালিশ করা। অমন ভয় না পেয়ে গেলে, ওর জন্য আমার দুঃখই হত। বিশেষ করে ওর ঠাণ্ডা লেগেছিল এবং বর্ষাতিটা ভোলা মাত্র নাক ঝাড়তে শুরু করেছিল। তার গায়ে একটা কালো চামড়ার কোট, পরনে হদ্দ নোংরা একটা প্যান্ট আর স্ট্র্যাপ ওয়ালা মোটা চামড়ার মেক্সিকান জুতা। আমার ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছিল। হায় রে, যদি নগ্নতাকে মুখর করে তোলার মত এই সাংঘাতিক আঁটসাট পোশাকের বদলে বেশি ঢাকাটুকি দেওয়া কোন পোশাক আমি সেদিন পরতে পারতাম।

নিশ্চয়ই ওর নাকঝাড়া পর্ব সমাপ্ত করে প্রথমে আমার দিকে মনোযোগ দিতে এখন উদ্যোগী হল। দন্তপাটি বিকশিত করে উফুল্লভাবে আমাকে অবলোকন করল। আমার চারপাশে চক্কর মেরে নিয়ে, সামনে এসে লম্বা একটা শিষ দিল। সঙ্গীকে চোখ টিপে বলল, হরর বস্ খাসা ডবকা মাইরী! ক্যায়সা মাল বো–জবাব নেই!

-এখন ওসব নয়, স্নগৃসি। পরে হবে। আগে চল কেবিন-টেবিন দেখে নিই। ততক্ষণে ও হুঁড়ি আমাদের জন্য কিছু রান্না বান্না করে ফেলুক। ডিমের কি খাবি বল?

স্লাগসি নামের লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল, ডিমের এলোঝেলো ভাজা বানাবে খুকু, বেশ নরম-নরম ধোয়া হবে, বুঝলে? মা যেমন বানায়। ঠিকঠাক না হলে বাবা কিন্তু চড় লাগাব কষে!

বলে সে মুষ্টিযোদ্ধাদের মত পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি দরজার দিকে পেছোতে লাগলাম। যতটা ভয় পেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি ভয় পাবার ভান করলাম এবং নাগালের মধ্যে আসতেই ওর মুখে সর্বশক্তি দিয়ে কষে এক চড় লাগালাম। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই ধারে সরে গিয়ে একটা টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে একটা লোহার চেয়ার তুলে তার পায়াগুলি ওর দিকে তাক করে ধরলাম।

রোগা লোকটা অল্প হেসে উঠল।

-কেমন স্লাগসি, বলিনি! বলিনি, পরে হবে ওসব। বুষ্টুমি ছোড় ইয়ার। গোটা রাতটা পড়ে আছে ওর জন্য। যেমন যেমন বলছি তেমন তেমন কাজ করে যাও, দোস্ত।

ফ্যাকাশে গোল-গোল মুখে চোখ দুটো উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছিল। লোকটা একবার গাল ঘসে নিল হাত দিয়ে। ভেজা ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে হাসির রেখা দেখা দিল, জান কি খুকুমনি, তুমি কেবল তোমার জন্য রাতভর চমৎকার সময় তৈরি করে নিলে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে, অনেক অনেকবার ঘুরে ফিরে। বুঝেছ? উঁধোনো চেয়ারের পেছন থেকে দু জনকেই দেখলাম। ভেতরে ভেতরে আমার কান্না বার হচ্ছিল। এ দু জন যেন দুঃস্বপ্ননের দেশ থেকে আগন্তুক। কোন রকম গলার স্বরটা অবিকৃত রেখে বললাম, তোমরা কে? এ সবের মানে কি? তোমাদের পরিচয় পত্র দেখাও। পরে একটা গাড়ি আসছে শুনলেই, জানালা ভেঙে সাহায্য চাইব। এখন আমার কোন ক্ষতি করলেই, কাল তোমরা মজা টের পাবে।

স্লাগসি হেসে উঠ, কালকের কথা কাল। আজ তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন খুকুমনি? হরর আমার দিকে তাকাল। তার মুখের অভিব্যক্তি শীতল, ঔৎসুক্যহীন।

-স্লাগ্‌সিকে মারাটা আপনার উচিত হয়নি। ও বড় শক্ত লোক। মেয়েরা ওকে অপছন্দ করুক, এটা ও অপছন্দ করে। ওর মুখের চেহারার জন্য এটা হতে পারে, সানুকেটিন-এ কিছুদিন একা কাটানোর জন্য ওটা হতে পারে। নার্ভের অসুখ। স্লাগৃসি, ডাক্তারবাবুরা যেন ওটাকে কি বলেছেন।

স্লাগসিকে বেশ গর্বিত দেখাল। সে খুব সযত্নে ল্যাটিন শব্দগুলি উচ্চারণ করল, আলোপসিয়া টোটালীস। যার মানে নির্লোম বুঝলে। একগাছি চুলও না। সে ইঙ্গিতে তার সব অবয়ব দেখাল।

-এখানে না, এখানে না বাবা, ওখানে না। তুমি এর কতটুকু জান লেড়কী?

হরর আবার শুরু করল, তাই স্লাগসি সহজেই ক্ষেপে যায়। মনে করে সমাজ থেকেও সুবিচার পাচ্ছে না। তোমার সম্বন্ধে তাই ধারণা। হয়ত তুমিই তাই করেছ। তাই ট্রয়ে ওকে আমরা বলি মাস্তান। লোকেরা অন্য লোককে কিছু শিক্ষা দিতে হলে ওকে ভাড়া করে। ও মিস্টার সান্গুইনেত্তি ভেবেছিলেন যে, আমরা দুজনে এখানে এসে ট্রাক ওয়ালা না আসা পর্যন্ত সব কিছুর ওপর নজর রাখব। মিস্টার সাল্গুইনেত্তি চান না যে, তোমার মত একটা বাচ্চা মেয়ে সারারাত এখানে একা থাকুক। তাই সঙ্গে থাকার জন্য আমাদের পাঠিয়ে দিলেন। তাই না স্লাগসি?

–সাচ্চা বাৎ। আলবৎ তাই। বলে সে চাপা হাসি হাসল। শুধু তোমাকে সঙ্গ দেবার জন্য বিম্বো নেকড়েগুলোকে খেদিয়ে দেবার জন্য। সেই সঙ্গে শরীরের মাপ টাপ ঠিক রাখার জন্য। নিশ্চয় এমন সময় আসে যখন তোমার পাহারা দরকার হয় খুব। ঠিক না?

টেবিলের ওপর হাত ধরা চেয়ারটা নিচু করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের নাম কি? পরিচয় পত্রের কি হল? বার কাউন্টারের ওপারের তাকে শুধু একটিন ভর্তি ম্যাক্সওয়েস হাউস কোম্পানির কফি ছিল। স্নাগুসি হঠাৎ নড়ে উঠল এবং যদিও কোন পিস্তল বের করতে দেখলাম না, তবু ওর ডান হাত থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে এল। পিস্তল ছোঁড়ার শব্দ হল। টিনটা লাফিয়ে উঠে পড়ে গেল। শূন্যে থাকতে থাকতেই আবার টিনটার গায়ে গুলি করল স্লাগসি। কফির বাদামী বঁড়োর বিস্ফোরণে ঘর ভরে গেল। তারপর অসহ্য নীরবতা নেবে এর ঘরে, মেঝেতে খালি কৌটোটা গড়াতে গড়াতে গেল। স্লাগসি আমার দিকে তাকাল, হাতে পিস্তল ছিল না। তার চোখ লক্ষ্যভেদের কৃতিত্বে আচ্ছন্ন। নরম গলায় সে বলল, পরিচয় পত্তর হিসাবে এটা কেমন খুকুমনি? নীল ধোয়ার পাতলা মেঘটা আমার কাছে ভেসে। এল। তাতে ধোয়াহীন যে বিস্ফোরক আছে, তার গন্ধ পেলাম। আমার পা কাঁপছিল। ঘৃণার স্বরে আমি বললাম, তাতে অনেক কফি নষ্ট হল। এখন তোমাদের নাম কি?

রোগা লোকটা বলল, ইনি ঠিক বলেছেন। ওই কৌটাটা নষ্ট করা তোমার উচিৎ হয়নি, স্লাগসি! তবু দেখুন, ওই জন্যই সবাই ওকে স্লাগসি বলে ডাকে। কারণ লোহার অন্ত্রের ব্যাপারে ও খুবই তুখোড়। স্নগুসি মোরন্ট। আমি, আমি হলাম হরউহজ্ব। ওরা আমাকে ডাকে হরর বলে। কেন জানি না। স্লাগসি তুমি বলতে পার?

স্লাগসি চাপাস্বরে হাসল, হরর-মানে ভয়। হয়ত কখনো তুমি কাউকে বেজায় ভয় দেখিয়েছিলে। হতে পারে একদল লোককে। তাইত সবাই আমাকে বলল।

হরর কোন মন্তব্য করল না। সে শান্তভাবে বলল, ঠিক আছে। চল যাই। স্লাগসি যেমন বলেছি কেবিন টেবিনগুলো দেখে নাও। আর আপনি ঘাবড়াবেন না। আমাদের কিছু খাবার বানিয়ে দিন। সাহায্য করুন। গায়ে আঁচড়টি লাগবে না। ঠিক আছে।

স্লাগসি লোভীর মত আমাকে দেখছিল। সে বলল, বেশি না ওইটুকুই। আঃ বিষো? তারপর ডেস্কের পেছনে চাবির র‍্যাক থেকে সবগুলি চাবি নিয়ে পেছনের পথ দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হল। আমি চেয়ারটা নামিয়ে রাখলাম এবং সুস্থির ভাবে,

আমার ওই গা কামড়ানো আঁটসাট প্যান্ট পরাটা সচেতনভাবে বুঝে, ঘর পেরিয়ে কাউনটারের পেছনে গিয়ে ঢুকলাম। হরর নামে লোকটা আমার থেকে দূরে, কাফেরিয়ার টেবিলের কাছে ধীরে সুস্থে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে একটা চেয়ার নামিয়ে নিয়ে, হাতে ঘুরিয়ে নিয়ে, দুপায়ের মাঝখানে রেখে বসে দু হাত ভাঁজ করে পেছনের হেলানটার ওপর রেখে, তার উপর চিবুক রেখে আমাকে একাগ্র কিন্তু উৎসুক্যহীন চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। শুধু আমি শুনতে পাই এমনভাবে বলল, আমার জন্যও ডিমের এলোমেলো ভাজা বানাবেন। আর বেশ করে শুকনো নোনতা মাংস। টোস্ট করা রুটিতে মাখন লাগিয়ে দেবেন। কফির কি হবে?

-দেখি কিছু বেঁচেছে কিনা? বারের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলাম, টিনটার গায়ে চারটে ফুটো হয়ে গেছে। ইঞ্চিখানেক কফি পড়ে আছে তলায়। বাকিটা মেঝেতে ছড়ানো। টিনটা সরিয়ে রেখে মেঝে থেকে যতটা সম্ভব হেঁকে তুলতে লাগলাম একটা রেকাবিতে। কতটা ধুলো ওর সঙ্গে উঠেছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। টিনের ভাল কফিটা নিজের জন্য রাখব।

ওখানে পাঁচ মিনিট কাটালাম। ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করবার জন্য সময়টা কাজে লাগালাম। এই লোক দুটি গুপ্তা। মিস্টার সানুগুইনেত্তির লোক এরা। সেটা নিশ্চিন্ত। কারণ তার কাছে থেকে অথবা ফ্যাশীদের কাছ থেকে এরা আমার নাম শুনে থাকবে। এদের গল্পের বাকি অংশটা মিথ্যে। ঝড়ের মধ্যে এদের এখানে পাঠানোর পেছনে নিশ্চয়ই একটা অভিসন্ধি আছে। সেটা কি? ওরা জানে যে, আমি ক্যানাডার লোক, বিদেশী এবং সহজেই পর দিন পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ করলে ওরা মুস্কিলে পড়বে। স্লাগসি নামে লোকটা সাকেনটিন-এ ছিল। অন্যজন? আলবৎ। তাই তার চেহারা অমন পাঁশুটে মরা মরা। সেও সম্ভবত সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে।

এই দু জন এখানে কি চায়? সাধারণ একটা গাড়ি চেপে ওরা এসেছে। মালপত্র নিতে হলে তো ট্রাক আনা উচিৎ ছিল। হয়ত সত্যি সত্যি জায়গাটা পাহারা দেবার জন্যই ওদের পাঠানো হয়েছে। যেরকম ব্যবহার আমার সঙ্গে ওরা করেছে তা ইতর গুণ্ডাদের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু আর কত খারাপ ওরা করতে পারে? আজ রাতে আমার কপালে কি আছে। আমি উঠে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ওরা যা চায় তা করে দেওয়াই মঙ্গল। আমার পেছনে লাগার কোন অজুহাত তখন থাকবে না। জেড় এর অ্যাপ্রনটা গুটি পাকিয়ে এক কোণে পড়ে ছিল। সেটাকে তুলে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে নিলাম। একটা অন্ত্র? কাঁটা চামরের দেরাজে একটা বরফ তোলার চিমটে ছিল, আর একটা লম্বা ধারাল বাঁকানো ছুরি। ওগুলো নিয়ে অ্যাপ্রনের নিচে প্যান্টের সামনের দিকে ও দুটো গুঁজে রাখলাম। হাতলটা ওপরে রইল। বাসন ধোয়ার বেসিনের কাছে ডিশ মোছার তোয়ালে জড়িয়ে ছুরিটা রাখলাম। দেরাজটা খুলে রেখে, ওর পাশে সারি দিয়ে গ্লাস কাপ সাজিয়ে রাখলাম। যাতে ছুঁড়ে মারা যায় চটপট। ছেলেমানুষী? আমার হাতে এই-ই শুধু ছিল।

ঘনঘন ঘরের দিকে চোখ রাখছিলাম। রোগা লোকটার নজর বরাবর আমার ওপর ছিল। অপরাধ জগতের ঘুঘু, অপরাধ ও তার বদলার ব্যাপারে ভাল ওয়াকিবহাল। আমার মনে কি ছিল, আমার আত্মরক্ষার প্রস্তুতি পর্ব সবই বুঝে থাকবে। এটা বুঝেও আমার নিরাপত্তার প্রস্তুতি করে গেলাম। কারণ ইংল্যান্ডের স্কুলে শিখেছিলাম যে ওরা যখন হানবে, তখন ঠিক জানি আঘাত করার জন্যই সেটা করবে। আমাকেও তখন সেই আঘাত ফিরিয়ে দিতে হবে। ওরা যদি আমাকে কাবু করতে পারে তবে ধর্ষণ করতে পারে, খুন করতে পারে–সেটা যেন বিনা বাধায় না করতে পারে। ধর্ষণ? হত্যা? যা ভাবছি তা কি আমার জীবনে ঘটতে যাচ্ছে জানি না। আমি শুধু জেনেছিলাম যে, আমি চরম বিপদের মধ্যে পড়েছি। ওদের মুখ–ঔৎসুক্যহীন লোভী মুখগুলি তাই বলছিল। ওরা দু জনেই আমাকে বিপন্ন করতে পারে। কেন? জানি না। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি স্থির নিশ্চিত।

বড় বাটিটার মধ্যে আটটা ডিম ভেঙ্গে দিয়ে, কাঁটা দিয়ে সেটা ফাটাতে লাগলাম। সসপ্যানে বড় একদলা মাখন গলে গিয়েছিল। এছাড়া সসপ্যানে মাংসটা চড়বড় করতে শুরু করেছিল। আমি সসপ্যানে গোলা ডিম ঢেলে দিয়ে নাড়তে লাগলাম। আমার হাত যেমন ব্যস্ত, আমার মনও তেমন পালাবার উপায় করতে ব্যস্ত ছিল। সবটাই নির্ভর করছে ওই স্লাগসির উপর। সে বাইরেটা দেখেশুনে এসে যদি দরজাটা লক করতে ভুলে না যায়। যদি যায়, তবে ওখান দিয়ে দুম করে বেরিয়ে যেতে পারি।

ভেসপা ব্যবহার করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। গত সাত দিন ওটাতে চড়িনি। কারবুরেটোর তৈরি করে তারপর ঠাণ্ডায় চালাবার জন্য তিনটে লাথি লাগতে পারে, তাতে খুব দেরি হয়ে যাবে। আমার জিনিসপত্র ফেলে রেখে যেতে হবে। আমার পয়সা-কড়ি ফেলে রেখে শুধু খরগোশের মত ছুটে গিয়ে ডানদিকে অথবা বাদিকে দৌড়াতে হবে। দৌড়িয়ে ঘরের সারিগুলি পেরিয়ে বৃক্ষসারির মধ্যে চলে যেতে হবে। ভাবলাম, অবশ্য দক্ষিণ দিকে দৌড়াব না। ঘরের সারির পেছনে হ্রদটা থাকায়, তা আমার নির্গম পথকে সংকীর্ণ করে দেবে। বদিকেই ছুটব। ওদিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু গাছের সারি

দরজা পেরিয়ে কয়েক হাত যেতে না যেতে বৃষ্টিতে একদম জবজবে ভিজে যাব, বাকি রাতটা ঠাণ্ডায় জমে যাবে। পায়ে স্যান্ডেল থাকায়, পায়ে অনেক আঁচড় পড়বে। কাজেই সুযোগটা নিলে লাভের চেয়ে। ক্ষতি হবে বেশি। তবে এই সমস্যাগুলিকে বাগে আনতে হবে। প্রধান কাজ হল এই লোকগুলির কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া। অন্য আর কিছুতেই এসে যায় না।

ডিমের এলোমেলো ভাজা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বেশ নরম থাকতে থাকতেই একটা রেকাবিতে সেগুলি স্কুপ করে তুলে নিলাম; ধারে ধারে মাংসের বেকন সাজিয়ে দিলাম গোল করে। আরেকটা রেকাবিতে টোস্টমাস্টার থেকে টোস্টগুলি নিয়ে সাজালাম, পাশে কাগজের মোড়ক শুধু এক টাই মাখন। তারপর একটা ট্রেতে রেকাবি দুটো তুলে সাজালাম। কফির ওপর ফুট বা পানি ঢালার সময়, মেঝের সেই ধুলোর কথা উড়তে দেখে বেশি খুশি হলাম; আসা করলাম ওদের গলায় গিয়ে এই ধুলো আটকাবে। তারপর, অ্যাপ্রন পরা অবস্থায় সম্ভ্রান্ত হয়ে ট্রেটা হাতে নিয়ে বারের পেছন থেকে বেরিয়ে রোগা লোকটা যেখানে বসে আছে সেখানে নিয়ে গেলাম।

ট্রেটা নামিয়ে রাখতেই, শুনতে পেলাম পেছনদিকের বাইরের দরজাটা খুলল, তারপর দুম করে বন্ধ হল। লক করার। ক্লিন আওয়াজ পেলাম না। চারদিকে তাড়াতাড়ি ঘুরে তাকালাম। গৃসির হাত দুটো খালি। আমার হৃৎস্পন্দন দুর্দান্ত জোরে হতে লাগল। স্নাসির টেবিলের কাছে এল। আমি ট্রে থেকে রেকাবি টেকাবিগুলি নামিয়ে রাখছিলাম। ঝুঁকে পড়ে আহার্যগুলি সে দেখল তারপর ছিটকে আমার পেছনে এসে, দু হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার। ঘাড়ে ওর বীভৎস মুখটা চেপে চেপে ধরতে লাগল, ঠিক মা যেমন করে বানায়, তেমনি হয়েছে খুকু। তুমি আমি দুজনে মিলে এবার ঘর বাধলে কেমন হয়? যেরকম রান্না করেছ এরকম যদি রাঁধতে পার, তবে তুমিই আমার স্বপ্নের। রাণী। কিছু বলছ না কেন? এটা কি একটা কথা হল না?

আমার হাতে কফির পট ধরা ছিল। ওর ভেতরের গরম তরল পদার্থটা স্লাগসির কাঁধের ওপর ঢেলে দেবার চেষ্টা। করছিলাম, হরর আমার মতলব আঁচ করে থাকবে। সে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ওকে ছেড়ে দাও। স্নগৃসিআমি তো বলছি পরে হবে।

কথাগুলি কষাঘাতের মত বেরিয়ে এল। স্লাগসি তক্ষুনি আমাকে ছেড়ে দিল। রোগা লোকটা বলল, তুমি তো চোখ দুটো করমচার মত লাল করেছ। খালি এই মেয়েটার দিকে নজর। বুন্ধুর মত ঘুরছ। বসে পড়। আমরা একটা কাজে এসেছি।

স্লাগসির মুখে ভয়লেশহীন ভাব থাকলেও বাধ্যতার ছাপও ছিল সেখানে, একটু দিল দিয়ে ভেবে দ্যাখো, গুরু! এই জওয়ানীর এক চাকলা আমার চাই, আর এখনই!

তবে, সে চেয়ার টেনে বসল এবং আমি চটপট সরে গেলাম।

বড় রেডিও-টেলিভিশনটা পেছনের দরজার কাছে একটা উঁচু বেদীর ওপর ছিল। এতক্ষণ আস্তে আস্তে চলছিল যন্ত্রটা। আমি আদৌ বুঝতে পারিনি। যন্ত্রটার কাছে গিয়ে, চাকতি ঘরিয়ে তার স্বরগ্রাম খুব উঁচু পর্দায় তুলে দিলাম। লোক দুটো নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। কাঁটা চামচের শব্দ হচ্ছিল। এখনই; নইলে আর হবে না।

দরজার হাতল থেকে আমার দূরত্ব মনে মনে মেপে দেখলাম। তারপর বাঁ দিকে ঝাঁপ দিলাম।

.

আর্তনাদ

দরজার কাঠের ফ্রেম বিদীর্ণ করে একটা বুলেট ঢুকে যেতে শুনলাম। আমি হাত দিয়ে বরফ তোলার চিমটেটা ঠিক করে রাখতে গেলাম। যাতে গায়ে ওটা না বসে যায়। ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে আমি প্রাণপনে আশ্রয়ের জন্য। ছুটছিলাম। অশেষ অনুগ্রহ বৃষ্টিটা ধরে গিয়েছিল, কিন্তু ঘাস তখনও শুকোয়নি। আমার জুতোর তলার সমতলদেশ তাই পিছলে পিছলে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম যথেষ্ঠ জোরে ছুটছি না। পেছনের দিকে সশব্দে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। স্লাগসি চেঁচিয়ে বলেছিল, থাম নইলে ঠাণ্ডা লাশ ফেলে দেব! আমি ছুটতে লাগলাম। তখনই মাপা মাপা দূরত্বে গুলি এসে পড়তে লাগল। বুলেটগুলি আমার পাশ কাটিয়ে ঘাসের মধ্যে পড়তে লাগল। আর দশ গজ যেতে পারলেই আমি আলোকিত দিকটা থেকে কেবিনের কোনায় অন্ধকারে আত্মগোপন করতে পারব। মাথা নিচু করে, একেবেঁকে ছুটতে ছুটতে চলছিলাম, যে কোন মুহূর্তে বুলেট এসে বিধবার আশঙ্কায় আমার গা শিউরে শিউরে উঠেছিল। কেবিনের একটা কাঁচের জানলা বুলেট লেগে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। আমি ততক্ষণে কোনটায় গিয়ে পড়েছি। ভিজে গাছগুলির মধ্যে যেতে যেতে, একটা মোটর গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন শুনলাম, ওটা কি জন্য?

কি ভয়ঙ্কর এইভাবে এগোনো। বৃষ্টিসিক্ত পাইনের সারি গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে ছিল। একের শাখা প্রশাখার মধ্যে অন্যের ডালপালা জড়াজড়ি করেছিল, মুখের ওপর হাত দুটো দিয়ে আড়াল করেছিলাম বলে, সেই হাত দুটো ওই ডালপাতার খোঁচায় আঁচড়ে যাচ্ছিল। ঘুরঘুট্টে আলকাত্রার মত অন্ধকার; দু হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম গাড়ির উজ্জ্বল দুই হেডলাইটের আলো গাছের ধার থেকে আমাকেই খুঁজছে, বুঝে কান্না পেয়ে গেল। আলোটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতেই শুনতে পেলাম আবার গাড়ি চালু করার শব্দ, আমাকে লক্ষ্য করে আলো ফেলার জন্য এবং তৎক্ষণাৎ ওরা আমার জায়গাটা পেয়ে গেল। পাশ কাটাবার মত কোন জায়গাই ছিল না। গাছের শ্রেণীর ভেতর দিয়ে যেমন যেমন পথ পাওয়া যাচ্ছিল, তা ধরেই এগোতে হচ্ছিল। আবার কখন গুলিবর্ষণ শুরু হবে? বনের মধ্যে আমি মাত্র ষাট হাত গিয়েছি। এখন যে কোন মুহূর্তে। হাঁ করে গিলে গিলে নিশ্বাস নিচ্ছিছিলাম। আমার। জামাপ্যান্ট ছিঁড়তে শুরু করেছিল। পা চিড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে উঠছিল। বুঝলাম আর বেশিক্ষণ এভাবে এগোনো যাবে না। আমাকে একটা ঘন পত্ৰত গাছ বেছে নিয়ে গুঁড়ি মেরে তার তলায় গিয়ে সন্ধানী আলোর চোখকে এড়িয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু গুলিবর্ষণ হচ্ছে না কেন? ডানদিক দিয়ে যেতে একটা হোঁচট খেলাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট্ট একটা জায়গা দেখলাম। হাঁটু মুড়ে ভিজে পাইন গাছের পাতার নিচে লুকোলাম। এর মত আরেকটা আভূমি নত ঝকড়া গাছ ছিল। আমি হামাগুড়ি দিয়ে তার তলায় গিয়ে গাছটার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে হাঁফ ধরা নিশ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে নিতে চাইলাম।

শুনতে পেলাম ওদের একজন আমার সন্ধানে এগিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে না, কারণ সেটা সম্ভব ছিল না, তবে অবিচলিত গতিতে, মাঝে মাঝে কান পেতে শুনছিল। সন্ধানকারী যেই হোক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই কোন শব্দ না পেয়ে বুঝতে পেরেছে যে আমি মাটিতে রয়েছি। যদি অরণ্য পথে চলার অভ্যাস থেকে থাকে তবে সে শীগগিরই ভাঙা ডালপালা আর মাটিতে ঘটানোর চিহ্ন দেখে বের করতে পারবে আমার নিশানা। তারপর শুধু সময়ের প্রশ্ন। আমি ধীরে ধীরে বেড় দিয়ে ঘুরে গাছের পেছনে চলে গেলাম ওর সঙ্গে দুরত্ব বাড়াতে। দেখতে পেলাম গাড়ির সন্ধানী আলো আমার মাথার ওপরে গাছের ডালপালা উদ্ভাসিত করে তুলেছে।

আগন্তুকের পায়ের শব্দ ক্রমেই কাছে আসছিল। ভারি নিশ্বাসের শব্দ পেলাম। স্লাগসির গলা খুব কাছে, খুব ধীরে ধীরে বলছিল, বেরিয়ে এস খুকুমনি। নইলে বাপজান খুব চড়চাপড় খাবে। লুকোচুরি খেলাটা এখন খতম। এখন বাপজানের কাছে খুকুমনির বাড়ি ফেরার সময়।

ফ্ল্যাশলাইটের ছোট আলোর বৃত্ত এখন গাছের তলায় তল্লাসি করছে। একটার পর একটা গাছ ধরে ধরে। সে জানত আমি মাত্র কয়েক হাত দূরে আছি। তারপর আলোর বৃত্তটা আমার গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। স্লাগসি হৃষ্টচিত্তে আস্তে আস্তে বলল, হেই খুকু, বাবা দেখে ফেলেছে!

সত্যিই কি দেখে ফেলেছে। আমি নিঃসাড়ে শুয়েছিলাম। নিশ্বাস পর্যন্ত টানছিলাম না ভাল করে।

দুম করে একটা গুলি এল অগ্নিবিন্দুর মত। আমার মাথার পেছনে গাছের কাণ্ডে বুলেটটা বিধে গেল। ওটা তোমাকে তাড়া দেবার জন্য খুকুমনি। পরের বার, এটা তোমার খুলিতে বিধবে।

তবে দেখতেই পেয়েছে! ভয়ার্ত স্বরে বললাম, ঠিক আছে, আসছি। গুলি ছুঁড়ো না যেন! চার হাত পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। প্রায় অপ্রকৃতিস্থ ভাবে ভাবলাম, নিজের প্রাণদণ্ডের জন্য এগিয়ে যাবার মক্কার ধরন এটা, ভিড়।

লোকটা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর ফ্যাকাশে টাকের ওপর হলুদ আলো ও কালো ছায়া এসে পড়েছে। ওর হাতের পিস্তর আমার পেটের দিকে তাক করা ছিল। সে পাশের দিকে পিস্তলটা দিয়ে ইঙ্গিত করে বলল, ঠিক আছে আমার আগে আগে চল। আর যদি না যাও তবে তোমার নরম পিঠে মাংস ছিদ্র করে ঢুকে যাবে এটা।

মাথা নুইয়ে গাছের ভেতর দিয়ে দূরের গাড়িটার চোখ ধাঁধানো আলোর দিকে তাকালাম। হতাশায় আকণ্ঠ ভরে উঠেছিল, আত্মশোচনায় ব্যথিত হয়ে উঠেছিল মন। কি করেছি যার জন্য এসব সইতে হবে আমাকে? এই দু জন অচেনা লোকের করাল গ্রাসে ফেলবার জন্য কেন আমাকে সৃষ্টিকর্তা বেছে নিলেন? এবার তো ওরা সত্যি সত্যি ক্ষেপে যাবে। ওরা আমাকে মারধোর করবে আর শেষে নির্ঘাৎ খুন করবে। আমার দেহ থেকে পুলিশ বুলেট গুলি বের করতে পারে! কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকায় আমার মৃতদেহের সাক্ষ্য ওরা উপেক্ষা করবে কি করে? তা সে যে কোন অপরাধই হোক না কেন তারা স্থির নিশ্চিন্ত হবে যাতে কোন সাক্ষ্য না থেকে যায়। আমি তো আর থাকব না। ওরা আমাকে পুঁতে ফেলতে পারে, আমার মৃতদেহের গলায় পাথর বেঁধে হ্রদের পানিতে ডুবিয়ে দিতে পারে।

বৃক্ষরাজির ধার ঘেঁষে ঘেঁষে বেরিয়ে এলাম। রোগা লোকটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্লাগসিকে ডেকে সে বলল, ঘরে নিয়ে যা। কোন ঝামেলা নয়। ওকে আমি পাহারা দেব। বলে গাড়িটার মুখ ঘুরিয়ে নিল।

স্লাগসি আমার পাশে এসে আমার শরীর কামুকের মত হাত দিয়ে চটকাতে লাগল। আমি শুধু বললাম, হে সৃটিকর্তা! প্রতিরোধ করার ইচ্ছে যেন বিদায় নিয়েছিল। সে বেশ আস্তে আস্তে বলল, বহুৎ বিপদে পড়ে গেছ, সখী। হরর খুব বদমিজ আছে। তোমাকে জোর ধোলাই দেবে। আজকের রাতটার জন্য আমাকে বোল রাজি আছ কিনা। আমার সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বল। আমি ওকে ঠাণ্ডা করে দেব। কি রাজি আছে?

আমি সংগ্রামের শেষ বিন্দু ইচ্ছা সঞ্চয় করে বললাম, তুমি যদি আমার গায়ে হাত দাও তবে তার আগে আমি বরং মরতেও রাজি।

–বহুৎ আচ্ছা, তাহলে দিতে রাজি নও। বেশ, আমাকেই আদায় করে নিতে হবে তবে। মনে হচ্ছে আজকের রাতটা খুব বদখৎ বানিয়ে নিলে, বুঝেছ? বলে এমন ভীষণ জোরে সে চিমটি কাটল যে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। হৃষ্টচিত্তে স্লাগসি হাসল। ওই ঠিক হয়েছে। গান গাও খুকুমনি যতটা পার রেয়াজ করে নাও। সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে পেছনের খোলা দরজাটা দিয়ে বসবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে আটকে দিল লক করে। ঘরটা অবিকল আগের মতই দেখাচ্ছিল–আলো জ্বলছে, রেডিওতে ফুর্তিভরা একটা নাচের বাজনা বাজছে।

প্রত্যেকটা জিনিস ঝকঝকে পালিশ করা, আলোর মধ্যে তাদের ঝলমলানি এখন যেন চোখ টিপে চলেছে। মনে পড়ল, কয়েক ঘণ্টা মাত্র আগে এই ঘরে আমি কত সুখেই না ছিলাম। মনে পড়ল আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে কত

মধুর, কত বিষণ্ণ স্মৃতির রোমন্থন করছিলাম। আমার সেই ছেলেমানুষী ঝামেলাগুলো কত তুচ্ছ! যখন আমার জীবনের একদিকে অন্ধকার থেকে এই দু জন লোক এগিয়ে আসছে তখন ভগ্ন হৃদয় ও হৃত যৌবনের কথা বলা কত হাস্যকর, উইন্ডসর-এ সেই সিনেমা? একটা নাটকে, বলা ভাল প্রহসন, সে তো ছোট্ট একটা অঙ্কনমাত্র। জুরিখ, সে ছিল যেন স্বর্গ। পৃথিবীর আদিম অরণ্য, তা থেকে বেরিয়ে আসা দুই দানব এমন কুচিৎ দেখা দেয় পথচারী কোন লোক বা মেয়ের জীবনে। কিন্তু এরা সর্বত্র হাজির রয়েছে। পা ফেলতে ভুল কর, নিয়তির খেলায় ভুল তাস চাল-তবেই এদের কবলে পড়ে যাবে, তুমি তখন হারিয়ে যাবে হারিয়ে যাবে এমন এক জগতে যা তোমার অকল্পনীয়, যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য নেই তোমার কোন দিগদর্শন যন্ত্রও, যা পথের ইঙ্গিত দেবে।

হরর নামে লোকটি দু হাত ঝুলিয়ে অলস ঢিলেঢালা ভাবে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে তার ঔৎসুক্যহীন চোখে আমাকে লক্ষ্য করছিল। ডান হাত তুলে আঙুল দিয়ে আমাকে কাছে আসতে ইঙ্গিত করল। আমার ক্ষতবিক্ষত পা জোড়া আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওর কাছে। ওর কাছে যেতে যখন কয়েক পা বাকি তখন যেন আমি অর্ধচেতন। আচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠলাম। হঠাৎ মনে পড়ল ও বাস্তবিকই ছুঁয়ে দেখলাম যে বরফ তোলার চিমটেটা অ্যাপ্রনের তলায় আমার প্যান্টের কোমরের পটির মধ্যে গোঁজা রয়েছে। হাতলটা ধরে ওটাকে বের করে আনা খুব শক্ত হবে। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম ওর ডান হাত সাপের মত উঠে এল। আমার গালে ডানে বায়ে চড় পড়তে লাগল চটচট করে। আমার চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। আমার মনে পড়ে গেল। আর একটা চড় থেকে আত্মরক্ষা করেছি এরকম ভান করে ঝুঁকে পড়লাম। এই ঝুঁকে পড়ার সুযোগ নিয়ে ডান হাতটা কোমরের পটির মধ্যে হাত দিয়ে জিনিসটা বের করে নিয়ে মাথা উঠিয়ে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওর মাথা লক্ষ্য করে বেধড়ক মারতে লাগলাম। জিনিসটা লাগছিল ওর গায়ে, তবে তা কেবল কান্নি মেরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমার হাত ধরে পিছমোড়া করে চেপে রাখল।

লোকটার ফ্যাকাশে ধূসর মুখে রক্তের ধারা নেমে আসছিল গালের ওপরে একটা ক্ষত থেকে। আমি দেখছিলাম রক্তের ধারা চিবুকের কাছে গড়িয়ে নেমে এল। ওর মুখের অভিব্যক্তি চাঞ্চল্যহীন। সেখানে যন্ত্রণার কোন চিহ্ন ছিল না; কেবল উদ্দেশ্য সাধনের ভয়াল দৃঢ়তা। চোখের কালো মনির পাশে কেবল একটা লাল ছিটে। রোগা লোকটা পায়ে পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমার হাতের মুঠো খুলে চিমটেটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। অবচেতন মনে যেন এর অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। শিশুরা যেমন অস্ত্র ফেলে দেয়, আমি ফেলে দিলাম! আত্মসমর্পণ করলাম। যুদ্ধবিরতি!

এবার সে আস্তে আস্তে প্রায় সোহাগ করার কায়দায়, সূক্ষ্ম কেরামতি দেখিয়ে শরীরের জায়গা বেছে বেছে কখনো হাতের তালু দিয়ে, কখনো ঘুসি ছুঁড়ে আমাকে মেরে চলল। প্রথম দিকে আমি শরীর মুচড়ে, নিচু হয়ে ঝুঁকে লাথি ছুঁড়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলাম। তারপর আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ওই ফ্যাকাশে ধূসর শোনিত রেখায় চিহ্নিত মুখের কোটরাগত দুই চক্ষু আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল আর সমান তালে হাত চালিয়ে যাচ্ছিল।

আমার ঘরে ধারা গোসলের টবে আমি এখন শোয়া। টালি পাতা মেঝের ওপর বিবস্ত্র অবস্থায় শুয়ে রয়েছি। আমার সুন্দর পোষাকটার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অপরিচ্ছন্ন অবশিষ্ট অংশ আমার পাশেই রয়েছে। একটা খড়কে কাঠি চর্বনরত স্লাগসি দেয়ালে হেলান দিয়ে, ঠাণ্ডা পানির কলের ট্যাপ ধরে আছে। তার চেরা চোখ ঝিকমিক করছিল। সে কল বন্ধ করে দিল। আমি কোন রকমে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠলাম। বুঝতে পারছিলাম বমি পাচ্ছে। তার আর পরোয়া করি না। আমি একটা পোষা রোরুদ্যমান প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছিলাম। বমি করে ফেললাম।

স্লাগসি হাসল। ঝুঁকে পড়ে আমার পেছনে চাপড় দিতে লাগল, চালিয়ে যাও খুকুমনি। ধোলাই খাবার পরে সবাই ই বমি করে। নিজেকে সাফসুৎরো করে, চমৎকার একটা নয়া পোশাক পরে বেরিয়ে এস দিকিনি। তোমার পালানোর জন্য ওই ডিমভাজাটা একেবারে খাজা হয়ে গেছে। আর কায়দা করতে যেও না! অবিশ্যি মালুম হচ্ছে, তোমার আর কিছু করার ক্ষমতাও নেই। ঘরটা আমি পেছনের দরজা থেকে নজরে রাখব! নাও জামা কাপড় পরে নাও। রক্ত-টক্ত কিছু বেরায়নি। মাত্র কয়েকটা আঁচড়। মেয়েদের ব্যাপারে হরর খুব মোলায়েম। খুব বরাতজোর তোমার। ও তো আমার হিপি। যদি ও সত্যি সত্যি ক্ষেপে উঠত, তবে এতক্ষণে তোমার জন্য আমরা কবর খুড়তাম। সৃষ্টিকর্তার দয়া দেখ। আচ্ছা, পরে দেখা হবে।

ঘরের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। এখন আমার শরীরের ক্ষমতা ফিরে পাওয়া, মোটামুটিভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে আধঘণ্টা লাগল। বারে বারে ইচ্ছে করছিল যে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় লুটিয়ে পড়ি। ওরা আসুক। গুলি করে শেষ করে দিক এই প্রাণটা। কিন্তু বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা ফিরে এল আমার মধ্যে, অতি পরিচিত ভঙ্গিতে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। জীর্ণ, শক্তিহীন, ব্যথাভরা শরীর ঠিক ঠাক করছিলাম যদিও ভেতরে ছিল গভীরতর যন্ত্রণার অনুভূতি। আস্তে আস্তে আমার মনে একটা সম্ভাবনার কথা উদয় হল, হয়ত সবচেয়ে খারাপ অংশটা পার হয়ে এসেছি। তাই যদি না হয়, এই লোক দুটি আমাকে এখানে রাখতে চায়, নজরের মধ্যে রাখতে চায়। স্নগুসি তো গুলি দিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে সিদ্ধহস্ত। যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলাম তখন সে ঠিকই আমাকে মারতে পারত। ওর নিক্ষিপ্ত গুলি আমার খুব কাছে এসে পড়েছিল; সেটা কি ভয় দেখিয়ে আমাকে থামাবার জন্য নয়?

আমি আমার সাদা পোশাক পরে নিলাম। সৃষ্টিকর্তা জানেন, এই পোশাকটা খুব নৈর্ব্যক্তিক। একটা পকেটে টাকা পয়সা নিয়ে নিলাম যদি তেমন সুযোগ আসে। তেমন কিসের সুযোগ আর পালানো চলবে না। বেড়ালছানার মত ক্লান্ত অশক্ত শরীরটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলাম বসবার ঘরে।

এগারোটা বেজেছিল। তখনও বর্ষণ বিরতি চলছিল। এয়োদশীর চাঁদ মেঘের মধ্যে দ্রুত সাঁতার কেটে যাচ্ছিল; অরণ্যভূমি থেকে থেকে রূপালি আলোয় ভরে উঠেছিল। হলুদ রং এর দরজার ফ্রেমের মাঝখানে স্লাগসি নিশ্চলভাবে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই খড়কে কাঠি চর্বণরত। আমি আসতেই পথ ছেড়ে দিল।

-এই তো আমার খুকুমনি। একেবারে আনকোরা রং করা। এখানে ওখানে দু এক জায়গায় হয়ত ছড়ে গেছে। তাই না, সোনামনি?

কোন জবাব দিলাম না। সে এসে তখন আমার বাহু ধরল, হেঃ হেঃ সহবৎ জান না খুকুমনি। তোমার দেখছি। উল্টোপিঠেও কিছু ধোলাই খাওয়া দরকার। তা সেটারও বন্দোবস্ত করে দেওয়া যাবে।

হাত ছুঁড়ে সে ভয়াবহ চোখা ডাটা করল।

–আমি দুঃখিত।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে।

সে আমাকে ছেড়ে দিল।

-এখন হড়িকুঁড়ির ওখানে যাও, ভাজাভুজি বানাতে লেগে যাও! আর আমাকে বা আমার সাক্ষাৎ হররকে তাক করে কিছু ছুঁড়ো-ছুঁড়ো না। দ্যাখ তো ওর অমন সুন্দর মুখটার কি দশা করেছ।

রোগা লোকটা আগে যে টেবিলটায় বসেছিল সেখানেই বসে আছে। ওর সামনে কাস্টএইড বাক্সটা খোলা রয়েছে। ডান গালের ওপর স্টিকিং প্লাসটারের ফিতে কেটে ক্রসের আকারে লাগানো। ভয়ে, ভয়ে তার দিকে এক নজর দেখে নিয়েই কাউন্টারের ওপাশে চলে গেলাম। স্নগৃসি ওর কাছে গিয়ে বসল। তারপর দু জনে নিচু গলায় ফুসুর ফুসুর করে কি সব আলোচনা করতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে ওরা আমার দিকে তাকাচ্ছিল।

ডিম ভাজা ও কফি তৈরি করতে করতে ক্ষিদে পেয়েছে অনুভব করলাম। কারণটা বুঝতে পারলাম না। এই দুটি লোক ঘরে ঢুকেছে অবধি, আমি এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম, মনটা এমন চাপের মধ্যে থাকছিল যে, এক কাপ কফি খাবার ইচ্ছেটাও লোপ পেয়েছিল। অবশ্য বমি করে ফেলার ফলে পেটটা খালিই ছিল। কিন্তু বেশ কৌতূহলদ্দীপক এবং বলতে পারি, লাজুকের ভাবেই আমি অনুভব করলাম যে ওই নিদারুণ প্রহার যেন কোন রহস্যময় কৌশলে আমার মনে ভার লাঘব করে দিয়েছে। আমাকে ওরা মারবে, আমাকে ওরা মারবে–এই ভয় ভয় ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করার মানসিক যন্ত্রণাকে বহুগুণ ছাপিয়ে গিয়েছিল। আসলে মার খাবার দৈহিক যন্ত্রণা হয়ত বা আমার স্নায়ুকেন্দ্রকে ভারমুক্ত করেছিল। আমার সর্ব অবয়বের আশ্চর্য কেন্দ্রে কবোষ্ণ শক্তির অনুভূতি। ভয়টা তবু ছিল। নিশ্চয়ই আতঙ্ক। তবে এখন অনেকে অনুগ্র এবং সমর্পিতা ধরনের। একই সময়ে আমার শরীর বলল, সে ক্ষুধার্ত সে তার শক্তি ফিরে পেতে চাইছিল। বেঁচে থাকতে, বেঁচে থাকতে চাইছিল সে।

তাই আমি আমার খাবার জন্যও ভাজা, কফি এবং মাখন মাখানো গরম টোস্ট তৈরি করলাম। ওদের খাবার দিয়ে এসে কাউন্টারের পেছনে ওদের চোখের আড়ালে বসে বসে শান্তভাবে আমার খাবার খেয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ধরিয়েই বুঝলাম কাজটা বোকামী হয়ে গেছে। এতে আমার দিকে ওদের নজর পড়বে। তার যেটা খারাপ তা হচ্ছে। এই যে এতে প্রমাণিত হবে যে আমি মারের ধাক্কা সামলে উঠেছি এবং ফের মারধোরের চোট নেবার উপযুক্ত শারিরীক অবস্থায় এসেছি। সম্ভবত এক মিনিট পরে ওদের কণ্ঠস্বরের গুঞ্জন থেমে এল। রেডিওতে ভিয়েনার অরণ্য কাহিনী আস্তে আস্তে চলছিল, তারই মধ্যে চেয়ার সরাবার শব্দ পেলাম। এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম যে কফির তলানির মধ্যে ডুবিয়ে সিগারেটের শেষটা নিভিয়ে দিলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, কল খুলে বেসিনের মধ্যে থালা রেকাবিগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম যে স্লাগসি এদিকে আসছে। সে কাছে এসে কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। অবাক হয়ে গেছি এমনভাবে তাকালাম। যে তখনও খড়কে কাঠি চিবিয়ে চলছিল। মাঝে মাঝে তার ডিম্বাকৃতি মুখের পুরু ঠোঁটের মধ্যে এপাশ ওপাশ চালাচ্ছিল কাঠিটা। তার হাতের পাতলা কাগজভর্তি একটা বাক্স কাউন্টারের ওপর রাখল। কয়েকটা পাতলা টিসু পেপার তা থেকে বের করে নিয়ে নাক ঝেড়ে কাগজটা মেঝেতে ফেলল। ভাল মানুষের মত গলায় বলল, তুমি আমাকে ঠাণ্ডা লাগিয়ে দিয়েছ খুকুমনি, বনের মধ্যে ছোটাছুটি করার জন্য। আমার তো একটা ঝামেলা, মানে এই আলোপেনিয়া অসুখটা আছেই যাতে সব চুল উঠে যায়। জান তাতে কি হয়? তাতে নাকের মধ্যেকার চুল পড়ে যায় অন্যান্য জায়গার সঙ্গে সঙ্গে। আর জান তার ফলে কি হয়? তার ফলে ঠাণ্ডা লাগলে সর্দি হাঁচিতে নাজেহাল হয়ে পড়তে হয়। হেই বিষো, তুমি মাইরি আমাকে ঠাণ্ডা লাগিয়ে দিলে। তার মানে চব্বিশ ঘণ্টায় এ-রকম এক বাক্স পাতলা কাগজ। বেশি লাগতে পারে। এটা ভেবে দেখেছ? নাকের ফুটোর মধ্যে একদম চুল নেই, এরকম লোকদের কথা ভেবে দেখেছ? হাঃ! পক্ষহীন দুই চক্ষু হঠাৎ ক্রোধে কঠিন হয়ে উঠল। তোমরা মেয়েরা। সবারই এক ধারা। খালি নিজের দিকটা দেখবে। যারা মুস্কিলে আছে তারা চুলোয় যাক! তোমরা কেবল লক্কা পায়রাগুলোর সাথে বকম বকম করবে।

রেডিওর শব্দ লহরীর মধ্যে শান্ত স্বরে বললাম, তোমার অসুবিধার জন্য আমি দুঃখিত। আমার অসুবিধার জন্য তুমিও কেন দুঃখিত হচ্ছ না। বেশ জোর দিয়ে তাড়াতাড়ি কথাটা ছুঁড়ে দিলাম। তোমরা দুজনে কেন এখানে এসে আমাকে নিয়ে পড়েছ? আমি তোমাদের কি করেছি। আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? যদি ছেড়ে দাও, তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে কাউকে কিছু বলব না। আমার সামান্য কিছু পয়সা আছে। তা থেকে কিছু তবে তোমাদের দিতে পারি। ধরো দু শ ডলার। এর চেয়ে বেশি দেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। বাকি পুজির ওপর ভরসা করেই আমাকে ফ্লোরিডা অবধি সমস্তটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাকে ছেড়ে দেবার মত দয়াটুকুও কি আশা করতে পারি না?

স্লাগসি বেশ কিছু হেসে নিল। মুখ ফিরিয়ে রোগা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, হেই হরর, কান্না মোছর তোয়ালেটা দাও, গুরু। হুঁড়ি বলে কিনা দু শ ডলার দেবে যদি ওকে আমরা চলে যেতে দিই। শুনে রোগা লোকটা শুধু কাঁধ নাচাল, কোন মন্তব্য করল না। স্লাগসি এবার আমার দিকে ফিরে তাকাল, করুণাহীন কঠোর সেই দৃষ্টি। একটু বুঝদার হও, খুকুমনি। এ খেলায় তুমিও সামিল হয়ে গেছ। তোমাকে একটু-আধটু সুড়সুড়ি দেওয়া উচিত যাতে আমারও দোস্ত হররের মত বড়া আদমী ঔর মিস্টার সাল্গুইনেত্তির মত বহুৎ বড়া ওস্তাদ তোমাকে নিয়ে কাজ করতে মজা পায়।

-কি কাজ? কোন কাজের জন্য আমাকে দরকার তোমাদের?

 কাল সকালে সব বুঝতে পারবে। স্নাসি বেখেয়ালে বলল।

ততক্ষণ তোমার কিচির মিচির বন্ধ রাখ। তোমার আওয়াজে আমার কানের পোকা বেরিয়ে আসছে। এখন গায়ে ঝাড়া দিয়ে কিছু কাজ করতে চাই আমি। দেখ না কেমন মিঠা বাজনা হচ্ছে। আমরা দুজন ওর তালে তালে পা মিলিয়ে নেচে হররকে দেখাই, এস। দু হাত প্রসারিত করে বাজনার তালে তালে আঙুল নেড়ে সে দ্রুত কয়েক পা নেচে নিল। দুঃখিত। আমি খুব ক্লান্ত। গৃসি কাউন্টারে ফিরে এল। রেগেমেগে বলল, অতবড় গতর থেকে আমাকে একটুখানি দিলে কি তা খয়ে যাবে? যতসব বাজে ব্যাগারবাই দেখাচ্ছ। এমন কিছু তোমাকে দেব যাতে সত্যি সত্যি ক্লান্ত হয়ে পড়। হঠাৎ তার হাতে বিদ্ঘুটে দেখতে একটা চামড়ার আঙটাওয়ালা চাবুক খেলে গেল। কাউন্টারের ওপর সেটাকে আছড়াল সে। ফরমাটার ওপর বেশ দাগ বসে গেল। কাউন্টারের কিনারা বরাবর সে নিঃশব্দে পায়ে এগিয়ে। আসতে লাগল আমার চোখে চোখ রেখে, নিজের মনে গুনগুন করতে করতে। আমি কাউন্টারের শেষ প্রান্ত অবধি পিছিয়ে গেলাম। এটাই আমার শেষ চেষ্টা। আমার ওপর মার শুরু হওয়ার আগেই বদলা মারটা, যে ভাবেই হোক, দিতে হবে। হাতড়ে হাতড়ে কাঁটা চামচের খোলা দেরাজটা খুঁজছিলাম। হঠাৎ তা পেয়ে গিয়ে হাতে দুবিয়ে দিয়ে প্রাণপণ জোরে ছুঁড়তে লাগলাম। মাথা নিচুতে নামিয়ে নামিয়ে কাটাবার চেষ্টা করলেও কাঁটা চামচের বর্ষণ চলতে লাগল তার মাথার উপর দিয়ে। একহাত দিয়ে মুখ ঢেকে শাপ শাপান, করতে করতে সে পিছু হটছিল। আর এক পশলা ছুঁড়ে দিলাম তারপর আরো, কিন্তু তার নোয়ানো মাথার ওপরে তা জোর কোন আঘাত হানতে সমর্থ হল না। রোগা লোকটা এবার দ্রুত এগিয়ে এল। বেকানো ছুরিটা হাত ধরে স্লাগসির দিকে আমি তেড়ে গেলাম। কিন্তু সে আমাকে আগেই লক্ষ্য করে টেবিলের নিচে সেঁধিয়ে গেল, আদৌ ক্লান্তভাব না ফুটিয়ে হরর তার কোট খুলে সেটা। মুড়ে তার বাঁ হাতের বগলদাবায় নিল। তারপর দুজনেই দুটো চেয়ার তুলে নিয়ে, তার পায়াগুলো আমার দিকে ষাড়ের শিং-এর মত বাগিয়ে ধরে, দু দিক থেকে আমাকে চেপে এগিয়ে এল। আমি একটা হাত চালিয়ে ব্যর্থ একটা প্রচেষ্টা করলাম ওদের থামাবার জন্য কিন্তু একটু পরেই আমার হাত থেকে ছুরিটা খসে পড়ে গেল। এ অবস্থায় আমার একমাত্র করণীয় ছিল কাউন্টারের প্রাকারের পেছনে অবস্থান গ্রহণ করা।

তখনও চেয়ার বাগিয়ে স্লাগসি এগিয়ে আসছিল আমার দিকে আর আমি দুহাতে দুটো রেকাবি নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। নোগা লোকটা ক্ষিপ্তভাবে কাউন্ডার ডিঙিয়ে পেছনে এসে আমার চুলের গোছা চেপে ধরল; আমি পাশ দিয়ে রেকাবি দুটো ছুঁড়ে মারলাম কিন্তু সে দুটো মেঝের ওপর গড়িয়ে চলে গেল। এরপর আমার মাথা কাউন্টারের ওপর টেনে নামানো হল, স্লাগসি আমার ওপর এসে পড়ল।

-হরর ঠিক আছে, ছেড়ে দাও। এবার আমার দেখার পালা। ম্যায় দেখুঙ্গা।

 আমার দেহ বেষ্টন করে ওর শক্তিশালী বাহুর পীড়ন যেন আমাকে পিষে ফেলতে চাইছিল। ওর মুখ আমার মুখের কাছে এনে বর্বরের মত নির্মমভাবে আমাকে চুমু খেতে খেতে হাত দিয়ে আমার ঘাড়ের নিচে জামার জিপ ফাস্নারের মাথাটা খুঁজে নিয়ে এক টানে কোমর অবধি নামিয়ে দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে সামনের দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। শব্দটা শুনতেই সবাই নিশ্চল নিথর হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *