দি লিভিং ডেলাইটস 007 — জেমস বন্ড
বড়কর্তা M জরুরী তলব দিলে জেমস্ বন্ড তার অফিসে এসে দেখা করে। কিন্তু বড়কর্তা M তাকে অন্যান্য দিনের মতন সেদিন সামনের চেয়ারে বসতে বলেন না। গম্ভীরভাবে জানালার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে থাকেন।
কিছুক্ষণ পরে বড়কর্তা M তার রিভলবিং চেয়ারে ঘুরে জেমস্ বন্ডের দিকে ভাল করে দেখে নিয়ে তাঁকে সামনের চেয়ারে বসতে বলেন।
জেমস্ বন্ড চেয়ারে বসার পর বড়কর্তা M তার টেবিলের ওপর ঝুঁকে বসলে তার কপালের রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে বন্ডকে বলেন, তিনি যার কথা বলবেন তাঁকে সে চেনে না, সে হল ২৭২। লোকটা একজন ভাল কাজের লোক ছিল। আগের যুদ্ধে সে শত্রুপক্ষের কাছে ধরা পড়েছিল। দীর্ঘ দিন বন্দী থাকার পর বহু কষ্টে বন্দীদের শিবির থেকে পালিয়ে সে ঐ শহরেই লুকিয়ে আছে? এবং আমাদের খবর পাঠিয়েছে আগামী তিনদিনের কোন দিন সন্ধে ছটা-সাতটার মধ্যে সীমানা পেরোবে।
২৭২-এর পিছনে KGB ও পূর্বজার্মানির গুপ্তচরেরা ঘুরছে, তাকে পেলে হত্যা করবে। ২৭২-এর এখন আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন।
২৭২-এর কাছে রাশিয়ার পারমাণবিক বোমা, রকেট এবং বার্লিনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার খবরও আছে।
এসব খবর ঠিক হলে রাশিয়ার দম্ভ ধূলিসাৎ তো হবেই তার সাথে পশ্চিমী দেশগুলোতে শান্তি ফিরে আসবে।
কিন্তু আমরা যার মারফত খবর পেয়েছি সে ডবল এজেন্ট। যদিও সে আমাদের W.B.-এর কাছে ধরা পড়েছে। তার ব্যবস্থাও হবে। তবে মুস্কিল হল KGB জানতে পেরেছে, ২৭২ কবে কোন পথে পেরোবে।
আমাদের W.B.-র লোকেরা KGB-এর সংবাদ পাঠোদ্ধার করে ২৭২-কে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মাঝামাঝি যে রাস্তা গেছে সেই চৌরাস্তায় তাদের নতুন এক্সপোজ অভিযানে তাকে গুলি করা হবে।
২৭২-কে হত্যার জন্য ট্রিগার নামে একজন ঘাতককে ভার দেওয়া হয়েছে। সে এক গোপনীয় স্থান থেকে এক টিপেই তাকে হত্যা করবে।
দেশের সীমানার কাছাকাছি কোন এক গুপ্ত জায়গায় মেশিনগান বসাবে। সেখান থেকে গুলি ছোঁড়া হবে, কারণ বার্লিনে শান্তি বিরাজ করছে। এই শান্তি বজায় রাখার জন্যই এই কৌশল।
বড়কর্তা M চুপ করলে বন্ড প্রশ্ন করে, 00 বিভাগের কাজ কি?
অন্য বিভাগের কাজ ফিরিয়ে দিতে পারেন না বলেই বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে এই কাজ করতে হয়।
জেমস বন্ডের প্রশ্নে M-এর স্বচ্ছ নীল চোখের দৃষ্টি বরফের মত শীতল হয়ে জেমস বন্ডের মুখের ওপর স্থির হয়।
M আস্তে আস্তে বলেন ২৭২-এর হত্যার ট্রিগারকে হত্যা করে সীমানা পেরোবার কাটা পরিষ্কার করতে হবে।
বন্ড জানে M-এর বেশি কিছু বলবে না। তাই সে দাঁড়িয়ে চীফ অফস্টাফের কাছ থেকে বাকি খবর সংগ্রহ করবে বলে M-এর ঘর থেকে চলে আসে।
বেরিয়ে এসে চী অফ স্টাফের ঘরে আসে। সেও এ জাতীয় কাজ জেমস বন্ডকে দেওয়ার দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু বন্ড কে নির্বাচন করার কারণে বলেন যাকে তাকে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো যাবে না বলে বন্ডকে নির্বাচন করা হয়েছে। জেমস বন্ডের লক্ষ্যভ্রষ্ট না হওয়ার জন্য তাকে বন্দুক চালান অভ্যাস করানো হচ্ছে।
তারপর বন্ডকে প্লেনে বার্লিন গিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে নির্দিষ্ট হোটেলে উঠতে হবে। হোটেলের চারতলায় সে থাকবে। ট্যানকোয়েরে দুই নম্বর তার জন্য অপেক্ষা করবে। একদিনে যদি কাজ না হয় তাহলে তিন দিন ওখানে বসে থাকতে হবে। রাইফেল দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানো হবে।
ঠিক সময়ে নির্দেশ মত পূর্ব বার্লিনে আসে বন্ড। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি করে বস্ত্রাস ও উইল হেডস্ট্রাস-এর এক কোণে একটা পুরানো ছয়তলা বাড়ির সামনে নামে। বাড়িটা জঙ্গলে ভর্তি এবং তাতে যুদ্ধের বোমার চিহ্ন স্পষ্ট।
কলিং বেলের ফ্লিক আওয়াজটার সাথে সাথেই দরজা খুলে যায়, জেমস্ এন্ড ঢুকে গেলে দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
বাড়ির ভেতরকার গলি পার হয়ে সেখানে সেকেলে লিফটের কাছে আসে এবং চড়ে চারতলায় যায়। সেখানে সিক্রেট সার্ভিসের W.B.-র একজন দুনম্বর কর্তা তাকে অভ্যর্থনা জানায়।
W.B.-র দু নম্বর লোকটিকে বন্ডের একদম ভাল লাগে না, কারণ মাঝবয়সী ঢিলে ঢালা পোষাক পরা লোকেরা সাধারণত উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়। এদের সাথে প্রাণ খুলে মেশা যায় না।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারকে নির্বাচিত করা হয় বন্ডকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু পল সেন্ডার এই কাজে খুশি নন। তবু কর্তব্য স্বরূপ বন্ডকে তার ফ্লাটে নিয়ে যায় এবং কি কি করতে হবে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার ঘরের একমাত্র খাটটাকে রাস্তার ধারের জানালার কাছে টেনে নেয়। খাটের ওপর তিন থাক পুরু বিছানা। পল সেভার বন্ডকে প্রশ্ন করে, এখানে আপনাকে কি করতে হবে তা এখন বুঝে নিতে হবে।
পথকষ্টে জেমস বন্ড ভীষণ ক্লান্ত ছিল। তবুও কর্তব্যের খাতিরে সম্মতি জানায়।
ক্যাপ্টেন পল জানালার পর্দা না তুলেই বলেন শত্রুপক্ষের লোকেরা যদি ২৭২-কে রক্ষা করছে জানতে পারে তবে তাদের পরিকল্পনা নষ্ট করে দেবে। পল সেন্ডার ফ্লাটের আলো নিভিয়ে দিয়ে খাটের উপর উবু হয়ে শুয়ে জানালার পর্দা দিয়ে সাবধানে মাথাটা জানালার রডের কাছে নেয়, এবং ফিসফিস করে বন্ডকে বলে রাস্তার ওপারের জানালা দিকে তাকান। ওখানে কোন জানালারই পাল্লা নেই। জানালায় যে কাঁচের পাল্লা দেওয়া আছে, সেগুলো প্রয়োজনে ওপর নিচ করা যায়। বন্ড সামনের বাড়ির পাশে ঝোঁপ ঝাড়ের ওপর দিয়ে শ দেড়েক গজ দূরে দেখল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সীমানা।
পল সেন্ডার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, চারদিকে যুদ্ধের নিদর্শন হিসেবে জমি এবড়ো খেবড়ো হয়ে গেছে। তাদের বাড়ি থেকে সীমানার দূরত্ব দেড়শ গজ। সেই জন্যই ২৭২-এর এই জায়গাটা পছন্দ।
যদিও দিনের বেলা ৩০ গজ রাস্তা পার হওয়া খুবই কষ্টকর। রাত্রেও সাবধান না হলে সহজে রাস্তা পেরোন খুবই বিপজ্জনক।
সে জন্যই রাশিয়ান ঘাতকেরা এখানে ওৎ পেতে থাকবে। যাতে ২৭২ জিনারস্ত্রাসের রাস্তা পার হবার সময় ওদের গুলিতে নিহত হয়। কারণ রাশিয়ানরা চায় না যে এই হত্যাকাণ্ড লোকদের মধ্যে জানাজানি হোক।
বন্ড মাথা নেড়ে ক্যাপ্টেন সেন্ডারকে সায় দেয়। বন্ডের সম্মতিতে উৎসাহিত হয়ে তাকে রাস্তার ওপারে দশ তলা বাড়িটার দিকে তাকাতে বলে। ঐ বাড়িটাকে পূর্ব জার্মানির মগজ বলা যায়। ওখানে ২৪ ঘণ্টা কাজ হয়। আলো দেখা যাওয়া জানালা গুলো নয়, অন্ধকার জানালা গুলোই লক্ষ্য বস্তু। ঐ সব ঘরগুলো থেকেই, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার সময় শত্রুদের হত্যা করা যাবে। কেউ জানতেও পারবে না, আবার কাজও হাসিল হবে।
ক্যাপ্টেন পল একটু সময় দশ তলার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হিসেব করে বলে এখান থেকে দশ তলা বাড়ির জানালাগুলোর দূরত্ব হবে তিনশ থেকে তিনশ দশ গজ।
রাত্রে রাস্তাটা জনমানব শূন্য হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে দু-একটা টহলদার সাজোয়া গাড়ি যাতায়াত করে।
কিন্তু গতকাল অবশ্য সন্ধ্যের মধ্যেই কিছু লোক বাড়িতে ঢোকে এবং বেরিয়েও যায়। তবে ঐ বাড়িটায় সরকারী সাংস্কৃতিক মন্ত্রকের মেয়েদের অর্কেস্ট্রা পার্টি আছে। তাদের গানের শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম হয়।
কিন্তু আশ্চর্য এখান থেকে KGB-র কোন ঝানু গোয়েন্দাকে দেখতে পাচ্ছি না। এ বিষয়ে কারুরই ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না।
পল সেন্ডার চুপ করলে বন্ড মনে মনে সব জিনিসটা ছক করে নেয়। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। তাকে রাখা ঔষুধের মধ্যে থেকে টুইনাল -এর দুটো বড়ি খায়। নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
দুপুর বেলা ঘুম থেকে উঠে বন্ডের শরীরটা বেশ ঝরঝরে হয়ে যায়। জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়, কারণ বন্ড আলো আসাটাকে ভালবাসে।
পল কালকের যে সব কথাগুলো বলেছে সেগুলো বন্ড একবার ভাল করে ঝালিয়ে নেয়। তারপর বন্ড রান্না ঘরে গিয়ে দেখে একটা পাউরুটির প্যাকেটের গায়ে লেখা, ইচ্ছা করলে বাড়ির বাইরে যেতে পারে তবে বিকেল পাঁচটার মধ্যে অবশ্যই ফিরতে হবে। যন্ত্র ঠিক সময় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেটা আর্দালি দিয়ে আসবে।
বন্ড গ্যাসের আগুনে পাউরুটির কাগজটা পুড়িয়ে ফেলে। বেকন আর ডিম ফাটিয়ে মাখন লাগানো পাউরুটির ওপর পুরু করে লাগিয়ে দেয়। মদ মেশানো বিনা দুধের কফির সঙ্গে খেয়ে ফেলে। অল্প সময়ের মধ্যে সাধারণ জামা কাপড় পরে ফ্লাট থেকে বেরিয়ে যায়।
তারপর একটা কফির দোকানে গিয়ে এসপ্রেসো কফি পান করে। রাস্তার প্রত্যেকটি লোকই ব্যস্তভাবে চলাফেরা, করছে। কারও এদিকে ওদিকে তাকাবার সময় নেই।
পায়ে পায়ে বন্ড লেকের ধারে আসে। সেখানকার পাতাগুলো যেন সেজেগুজে বন্ডকে অভ্যর্থনা জানায়। বন্ড শুকনো পাতা মাড়িয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকে। সেখানে পেট ভরে খায়। এবার তার বেশ ভাল লাগে। তারপর নিজের বাড়ির দিকে যায়। বাড়ির কাছে এসে দেখে একটা যুবক গাড়ি ঠিক করছিল। সে একমনে ছিল, এদিক ওদিকে কোন মন ছিল না।
বন্ড হাসে এবং মনে মনে ভাবে লোকটাকে সে চেনে। সে WB বিভাগের ট্রান্সপোর্ট শাখার কর্পোরাল। পল। সেন্ডারের কাছ থেকে ইঙ্গিত পাবার সঙ্গে সঙ্গে সে গুলির শব্দকে ঢাকার জন্য পরপর কয়েকটা ইঞ্জিনের ব্যাক ফায়ার করবে, তা না হলে গুলির শব্দ শুনে আশেপাশের লোকেরা পুলিশকে টেলিফোন করবে। তার জন্য ঝামেলাও বাড়বে। বড়কর্তা M এ ধরনের ঝামেলায় জড়ানোকে মোটেই পছন্দ করে না। রাশিয়ান গুপ্তঘাতকরাও এরকম ঝুট ঝামেলাকে এড়িয়ে চলে।
ফ্লাটে ঢুকে বন্ড দেখে তার আসার আগেই খাটের উপর দিয়ে জানালার ধারে গোবরাটের গোড়ায় কাঠ ও ধাতুর তৈরি একটা স্ট্যান্ড দাঁড় করানো হয়েছে এবং তার উপর বসানো আছে তার প্রিয় রাইফেল। যদিও রাইফেলের মুখটা পর্দা থেকে খুব সামান্যই বেরিয়ে আছে। তাছাড়া কোমর পর্যন্ত লম্বা একটা কালো জামার সঙ্গে কালো রঙের একটা মুখোশ বিছানায় আছে। সে মুখোশে শুধু দুটো চোখ ও মুখের দিকে ফুটো আছে। এগুলো শত্রুপক্ষের চোখ এড়ানোর জন্যই করা। ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারের বিছানার উপরেও সে রকমই কালো পোশাক। এক জোড়া দুরবীণ ও ওয়াকিটকির মাইক্রোফোন। গোয়েন্দা স্টেশন থেকে পরিস্থিতি অদল বদলের কোন খবর না পাওয়ায় সেন্ডারকে বেশ গম্ভীর দেখায়।
ক্যাপ্টেন পল বন্ডকে কিছু খাবার খেতে বলে। জেমস্ বন্ড ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারকে ধন্যবাদ জানায়। নিজের মনের উত্তেজনা কমানোর জন্য হালকা বই পড়তে থাকে। বইয়ে মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করে।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার উত্তেজনা বশে বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকায়, পায়চারি করে, সিগারেট খায়।
দেখতে দেখতে বিকাল পাঁচটা বাজে।
জেমস বন্ড একসাথে দুটো চুইংগাম ফেলে মুখোশ পরে নেয়। ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারও জেমস বন্ডের মত কালো মুখোশ পরে ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়। ঘরটা অন্ধকার হলে সে জেমস্ বন্ডের পাশে বিছানার উপর উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে।
বাইরেটা অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঠের স্ট্যান্ডের গায়ে লাগানো স্কুর প্যাঁচ ঘুরিয়ে রাইফেলের স্নাইপার স্কোপটাকে আস্তে আস্তে এদিক ওদিক করতে থাকে।
সেদিনও দশ তলার আগে অন্ধকার-ঘরগুলো অন্ধকারই দেখা যায়। সেই অন্ধকারেই ঘর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়ে ২৭২-কে যে হত্যা করা হবে, তা ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার ও জেমস বন্ড সে বিষয়ে একমত হয়। কারণ প্রত্যেকটি অন্ধকার ঘরের জানালার পর্দা গোটানো এবং তালার শার্সিগুলোও ওপর দিকে তোলা।
সে সময় দশ তলা বাড়ি থেকে কুড়িটা সুন্দরী যুবতী বিভিন্ন বাজনা বাজনা বাজাতে রাস্তায় নেমে আসবে। পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়ে রাস্তার মধ্যেই যুবতীদের বাজনা শুনতে থাকবে।
জেমস বন্ড যখন নানান কথা ভাবতে থাকে তখন স্নাইপার স্কোপের লেন্সে অর্কেস্ট্রার এক যুবতী ধরা পড়ে, তার হাতে ছিল একটা বড় বেহালার বাক্স।
যুবতীটি অন্যান্য যুবতীদের থেকে আলাদা, বেশ লম্বা, একরাশ চুল হাওয়ায় দুলছে, তার পোশাকও হাওয়ায় দুলছে, যুবতীটি সম্ভ্রান্ত বংশের।
দু পাশের দুটি যুবতীর সঙ্গে কিছু সরস মন্তব্য করায় তারা হেসে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছে।
জেমস বন্ড বুঝতে পারল এটা যুবতাঁকে রক্ষা করার পরিকল্পনা। রাস্তার আলোয় জেমস বন্ড যুবতীটির মুখটা ভাল করে দেখতে পেল। জেমস্ বন্ড স্বীকার করল যুবতীটি সত্যিই সুন্দরী।
জেমস বন্ড নিজের হাত ঘড়িতে দেখে, তখন সন্ধ্যা পাঁচটা পঞ্চাশ।
জেমস বন্ড তার মন থেকে সব চিন্তা দূর করে দেয়।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার জেমস বন্ডের কাছে এসে ফিসফিস করে জানায় সময় হয়ে এল। এবার অন্ধকার চারটে জানালার নিচেরটার দিকে লক্ষ্য করতে বলে। জেমস বন্ড তখনই স্নাইপার স্কোপের ফোকাস ফেলল জানালার দিকে।
তারপর ঘরের মধ্যে কিছু নড়তে চড়তে দেখতে পেল। একটা কালো রকমের অস্ত্রের মত কিছু জানালা দিয়ে অল্প। বেরিয়ে আসতে দেখল। সেই কালো জিনিসটা একবার ওপরে, একবার নিচের দিকে নামতে থাকে। তারপর ডান দিকে বাদিকে নড়া চড়া করে। অস্ত্রটার মুখটার হিমারস্ট্রাস রাস্তার দিকে তাক করান। তারপর আর অস্ত্রটাকে নড়াচড়া করতে দেখা যায় না। জেমস বন্ডের মতন করে সেও অস্ত্রটাকে একটা স্ট্যান্ডের উপর বসিয়ে রেখেছিল। ক্যাপ্টেন পল। সেন্ডার মনের উত্তেজনাকে আয়ত্তে রাখতে না পেরে ব্যস্ততার সঙ্গে মিঃ বন্ডকে প্রশ্ন করে, আগ্নেয়াস্ত্রটা কোন জাতীয়।
জেমস্ বন্ড তখন স্নাইপার স্কোপ দিয়ে ভাল করে দশ তলা বাড়িটার অন্ধকারটাকে দেখছিল।
জেমস বন্ডের মনে হয়েছিল আয়োস্ত্রর মাথায় বসানো ফ্লাট এলিমিনেটের টেলিস্কোপ ও নিচের দিকে ঝুলে থাকা গুলির ম্যাগাজিনই রাশিয়ানদের সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্র।
জেমস্ বন্ড কিছুক্ষণ পরে বলে এ যন্ত্রটা গ্যাসে চালান মেশিনগান। ঐ মেশিনটাকে ৭.৬২ মিলিমিটারের তিরিশটা গুলি ধরে এবং দূরে পাল্লার কাজই ভাল হয়।
দু দিকে নজর রাখা বিপজ্জনক বলে জেমস্ বন্ড ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারকে দশ তলা বাড়ির পাশের আগাছা জঙ্গলের উপর নজর রাখতে বলে। আবার তার মনে হয় বাকি অন্ধকার ঘর থেকে কেউ হয়ত রাস্তার উপর নজর রাখছে। সেই জন্যই পল সেন্ডারকে সাবধানে বাড়ির উপর নজর রাখতে বলল।
জেমস বন্ডের কথাই ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার মেনে নিয়ে সেই মত কাজ করে।
জেমস্ বন্ডও স্নাইপার স্কোপাটার স্কু ঘুরিয়ে অন্ধকার ঘরের শত্রু পক্ষের মেশিনগানের বাটের দিকে ফিট করে রাখে।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার মিঃ বন্ডকে ফিসফিস্ করে বলে, মাথায় গুলি করতে বা সোজা ট্রিগারের বুকে গুলি করে ভবতরী পার করার অনুরোধ করে।
জেমস বন্ডের হাত ও মুখের ঘাম মুছতে মুছতে অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও ২৭২-এর দেখা পায় না।
জেমস্ বন্ড তার দেহের ইন্দ্রিয়গুলোকে সারাক্ষণ সজাগ রাখার জন্য দেহে অলসতা আসে এবং তার চোখেও টনটন করতে থাকে।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার যখন সাতটার সময় নিজের ঘড়ি দেখল তখনও রাস্তার ওপারের জঙ্গল থেকে কোন কিছু নড়াচড়া করার লক্ষণ পেল না। তাদের দিকে অল্পসল্প যা হচ্ছিল সেটা ছিল তাদের W.B. স্টেশনের দু জন পাকা গোয়েন্দা। ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার বলল, যতক্ষণ শত্রুপক্ষ সতর্ক থাকবে ততক্ষণ জেমস বন্ডকেও সতর্ক থাকতে হবে।
এক সময় লক্ষ্য করল KGB দলের সঙ্গে মেশিনগানটা জানালা থেকে যখন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন প্রত্যেকটি জানালার নিচের শাসিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।
জেমস বন্ড মনে মনে বলে উঠেছিল এজেন্ট ২৭২-কে সেদিনের মত রেহাই দিয়েছে।
জেমস্ বন্ড রাইফেলের ওপরে পর্দাটা এমন ভাবে ফেলে দেয় যে ঘরের বাইরে থেকে আর সেটা দেখা যায় না। তারপর জেমস বন্ড মুখোশ খুলে গোসলখানা গিয়ে প্রাণ ভরে গোসল করে বরফ দিয়ে দু পেগ হুইস্কি খেল বটে, কিন্তু তখন তার কানটা সজাগ ছিল দশ তলার বাড়ির মেয়েদের অর্কেস্ট্রার দিকে। সেই অর্কেস্ট্রা থামে রাত্রি আটটায়।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় জেমস বন্ড আগের দিনের মতই কালো মুখোশ পরে তৈরি থাকলেও তার কোন কাজই হয়নি।
তৃতীয় দিন সকাল থেকে জেমস্ বন্ড মিউজিয়াম, আর্টগ্যালারী, চিড়িয়াখানা, সিনেমা ইত্যাদি অনেক জায়গায়। ঘুরলেও তার আনন্দ হয়নি। কারণ সবসময় তার চোখের উপর ঘুরতে থাকে দশ তলার অন্ধকার ঘরটা; যেখানে একটা জানালার উপর একটা কাঠের স্ট্যান্ডেতে ট্রিগার এজেন্ট ২৭২-কে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।
আগের দিনের মতনই মুখে কালো মুখোশ পরে জেমস্ বন্ড পাঁচটার সময় তার ফ্ল্যাটে আসে।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার চোখে দুরবীণ লাগিয়ে আগাছার মধ্যে কিছু নড়তে দেখল, একটু থামতে দেখল বটে, কিন্তু আবার নিচু হয়ে এগোতেও দেখল। আগাছাগুলোর নড়া চড়ায় ২৭২-এর উপস্থিতি বুঝতে পারল। কিন্তু প্রতিপক্ষরা যদি ঐ নড়াটাকে বাতাসের সাহায্য মনে করে তবেই রক্ষা।
একটু পরে ক্যাপ্টেন পল সেভার মনে মনে বলে ওঠে, তারা আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে আত্মরক্ষার জন্য উপুর হয়ে শুয়ে পড়েছে। জেমস বন্ডকে জিজ্ঞাসা করল শত্রুপক্ষের কোনরকম প্রস্তুতি হচ্ছে কিনা।
জেমস্ বন্ড শত্রুপক্ষের উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেই বলে বিশেষ কিছু না। কিন্তু জেমস্ বন্ড ক্যাপ্টেনকে তাদের চলাফেরা বা তারা সীমানার থেকে কতদূরে আছে তা রিলে করার অনুরোধ করে।
ক্যাপ্টেন বলে, তারা পঞ্চাশ গজ দূরে আছে। রাস্তার ধারে ভাঙ্গা প্রাচীর, ভাঙ্গাচোরা জমি পার হবার সময় তারা শত্রুপক্ষের নজরে আসবে। ক্যাপ্টেন বলে উঠল, ওরা দশ গজের মধ্যে এসে গেছে এবং মুখে ও হাতে কালো রঙ মেখেছে। মিঃ বন্ডকে তৈরিও থাকতে বলল কারণ ওরা যে কোন মুহূর্তে রাস্তা পার হতে পারে।
মিঃ বন্ডের সারা শরীর ঘামলেও নিশানা ঠিক রাখার জন্য চেষ্টা করছেন, যেন তার হাত না ঘামে।
জেমস বন্ড দশ তলা বাড়ির সেই অন্ধকার ঘরে মেশিনগানের পিছনে চঞ্চলতার আভাস পেয়ে গাড়িটাকে স্টার্ট দিয়ে বিকট আওয়াজ করানোর জন্য ক্যাপ্টেনকে বলে।
ক্যাপ্টেন পল মাইক্রোফোনে গাড়ির ড্রাইভারকে সবুজ সংকেত দেওয়ার সাথে সাথে ড্রাইভারও বিকট শব্দ করে গাড়িতে স্টার্ট দেয়।
ওদিকে শত্রুপক্ষ একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলে কালো দস্তান। পরা একটা হাত আস্তে আস্তে সাব মেশিনগানের তলায় আসে।
সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার বলে তারা দেওয়ালের দিকে আসছে। দেওয়ালের উপর উঠছে এবং যে কোন সময়ে রাস্তায় লাফিয়ে পড়বে।
জেমস্ বন্ড তখন স্নাইপার লেন্সের ভিতর দিয়ে শত্রুপক্ষের মেশিনগান চালাবার লোকটার মুখটা দেখে চমকে উঠল এবং ভাবল সেই অর্কেস্ট্রা দলে বড় বাক্স বয়ে নিয়ে যাওয়া সুন্দরী মেয়েটা।
ঐ দূরত্বে নিশানা লাগান মিঃ বন্ডের জলভাত হওয়ায় মেয়েটির প্রাণ তখন তারই হাতে।
সেইজন্য মিঃ বন্ড নিজের স্কু ঘোরাতে শুরু করলে সাব মেশিনগান থেকে একটা হলদে রঙের আলোর শিখা বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে তার রাইফেল গর্জে ওঠে এবং গুলিটা সাব মেশিনগানের গোড়ায় বিস্ফারিত হবার সাথে সাথে। যুবতীটির হাতটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গুলির ধাক্কায় সাব মেশিনগানটা রাস্তায় পড়ে যায়।
তারপর ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার, পার হয়ে গেছে বলে চাপা স্বরে আনন্দ প্রকাশ করলে জেমস বন্ড তাকে তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়তে আদেশ করে।
তারপর জেমস বন্ডও কথা বলতে বলতে মেঝেতে লাফিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে সেই দশ তলা বাড়ি থেকে একটা সার্চলাইট রাস্তা ঘুরে তাদের বাড়ির জানালার সামনে আসে। তারপরই এক ঝাঁক গুলি জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়লেও দরজাটা ক্ষত-বিক্ষত হয়।
WB বিভাগের গাড়িটা বিকট শব্দ করে সামনের দিকে যাবার সময় অর্কেস্ট্রার মৃদু আওয়াজও শোনা যায়। কারণ গাড়িটার মতনই ট্রিগারের সাব মেশিনগানের শব্দ কাউকে শুনতে না দেবার জন্যই ঐ অর্কেস্ট্রা বাজানো হচ্ছিল।
KGB দলের লোকেরা অর্কেস্ট্রার বাক্সগুলোয় বাজনার সাথে আগ্নেয়াস্ত্রও নিয়ে আসত।
ক্যাপ্টেন পল মাথার চুল থেকে কাঁচের টুকরো ঝাড়তে ঝাড়তে খাটের নিচে থেকে বেরিয়ে ছুটে রান্না ঘরে চলে গিয়ে সাবধানে আলো জ্বালে।
মিঃ বন্ড ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারকে কোথাও লেগেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে, সে বলে তার বিশেষ লাগেনি কিন্তু মিঃ বন্ড আহত হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে না উত্তর পায়।
মেশিনগানের বুলেটে ঘষা লাগায় জ্বালা করছে বলে তখন সে একটু ইলাস্টাপ্লাস্টার চায়। তারপরে বন্ড বাথরুমে গোসল করতে যায়।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার তখন ওয়াকিটকি নিয়ে মাইক্রোফোনে কথা বলতে থাকে।
সেখানকার সমস্ত ঘটনা জানায় এবং ২৭২ নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেছে বলে চিন্তা করতে বারণ করে। কিন্তু তাদের জন্য আর্মড কারের ব্যবস্থা করতে বলে। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি গিয়ে বড়কর্তা M-এর কাছে মিঃ বন্ডকে রিপোর্ট লিখে পাঠাতে হবে। ওভার অ্যান্ড আউট বলে ওখানেই শেষ করে দেয়।
জেমস বন্ড বাথরুম থেকে বেরুলে ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার বলে ট্রিগারকে হত্যা না করার জন্য বড়কর্তা কৈফিয়ৎ চেয়েছেন। স্কু ঘুরিয়ে নিশানা পাল্টানো এবং ট্রিগারকে গুলি করার অনেক সময় দেওয়ার জন্যও অভিযোগ করে এবং ২৭২-এর প্রাণ বাঁচানোর জন্য তার কোন অবদান নেই, তাও বলে দেয়।
জেমস বন্ড এ সব কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু বলে ট্রিগারটা মেয়ে ছিল।
ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার বলে KGB দলের মেয়েরাই গুপ্তচর। তারা নিখুঁত রাইফেলও চালাতে পারে, কারণ রাশিয়ার আগের অলিম্পিকে মেয়েরাই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে।
তারপর বাড়ির দরজায় গাড়ির শব্দ ও দু বার কলিং বেল বাজার পর ক্যাপ্টেন পল সেন্ডার জেমস বন্ডকে আর্মড। কার এসে গেছে জানায় এবং সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার অনুরোধ করে। জেমস্ বন্ড তখন ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারের সাথে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।