দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি

দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি

টুনি আজকে বিকাল চারটা একত্রিশ মিনিটে বাসায় সব বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে একটা মিটিং ডেকেছে। বড়দের মাঝে আছে শুধু ঝুমু খালা। ঝুমু খালা অবশ্য বলে দিয়েছে সে চারটা একত্রিশ মিনিটে থাকতে পারবে না। তার অন্য কাজ আছে, তাই আসতে দেরি হবে। তবে যখনই আসে সবার জন্য নাশতা নিয়ে আসবে। মিটিং বেশি জরুরি না নাশতা বেশি জরুরি, সেটা নিয়ে ঝুমু খালার অনেক সন্দেহ আছে।।

যখন সবাই শুনেছে আজকের মিটিংটা হবে চারটা একত্রিশ মিনিটে তখন সবাই সেটা নিয়ে কিছু না কিছু বলেছে। টুম্পা জানতে চেয়েছে, কেন চারটা ত্রিশ মিনিটে না হয়ে চারটা একত্রিশ মিনিটে। টুনি বলেছে, “চারটা ত্রিশ বললে সবাই ধীরে সুস্থে আসবে। কেউ একটু আগে কেউ একটু পরে। কিন্তু চারটা একত্রিশ বললে সবাইকে ঠিক সময়ে আসতে হবে। ঠিক চারটা একত্রিশ মিনিটে।”

‘যদি কেউ না আসে?”

“আসবে না কেন? কেউ যদি বলে তার মিটিং চারটা একত্রিশ মিনিটে শুরু হবে, তাহলে কেউ না আসলেও তাকে ঠিক সময়ে মিটিং শুরু করতে হবে।”

“কেউ না আসলেও?”

“হ্যাঁ।”

কেউ নাই টুনি একা একা বসে মিটিং করছে দৃশ্যটা কল্পনা করে টুম্পা হি হি করে হাসল।

মিটিং চারটা একত্রিশ মিনিটে শুনে শান্ত কেন জানি রেগে উঠল। রীতিমতো চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ? এটা কোন ধরনের ঢং? চারটা একত্রিশ? চারটা একত্রিশ আবার কী?”

টুনি শান্ত গলায় বলল, “চারটা ত্রিশ মিনিটের এক মিনিট পরে হচ্ছে চারটা একত্রিশ!”

শান্ত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “চারটা একত্রিশ মিনিটে কেন মিটিং করতে হবে? সাড়ে চারটায় করলে কী হয়? কবে দেখেছিস কেউ চারটা একত্রিশ মিনিটে মিটিং করে?”

শান্তর কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই তাই টুনি কোনো উত্তর দিল না। মুখটা হাসি হাসি করে রাখল। সেটা দেখে মনে হয় শান্ত আরও রেগে গেল। বলল, “এরপরে কয়টার সময় মিটিং করবি? চারটা একত্রিশ মিনিট সাড়ে তেতাল্লিশ সেকেন্ড? হ্যাঁ?”

টুনি এবারেও কিছু বলল না। শান্ত বলল, “তুই যখন ইচ্ছা মিটিং ডাক

আমি কখনো সময়মতো আসব না। আমার যখন ইচ্ছা তখন আসব।”

টুনি এবারে কথা বলল, “তোমার যখন ইচ্ছা আস। আমি চারটা একত্রিশ মিনিটে আমার কথা বলা শুরু করে দেব।”

“কী বলবি তুই?”

“চারটা একত্রিশ মিনিটে তুমি জানতে পারবে।” বলে টুনি শান্তকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।

দেখা গেল চারটা একত্রিশ মিনিটের আগেই সবাই মিটিংয়ে এসে হাজির হয়েছে। শান্ত পর্যন্ত চলে এসেছে, ইচ্ছা করে মুখটা রাগ রাগ করে রেখেছে।

টুনি ঘড়ি ধরে অপেক্ষা করে ঠিক চারটা একত্রিশ মিনিটে বলল, “আমাদের মিটিং শুরু হয়ে গেছে।”

শান্ত বলল, “এখন আমরা কী করব? নাচব?”

শাহানা বলল, “এখনই নাচিস না। যদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। থাকে তখন নাচিস।”

মুনিয়া দৃশ্যটা কল্পনা করে হি হি করে হাসল, বলল, “শান্ত ভাইয়া নাচবে হি হি হি।”

শান্ত বলল, “চুপ কর। দেব একটা থাবড়া।”

প্রমি বলল, “কাউকে কারো থাবড়া দিতে হবে না। টুনি তুই কী বলতে চাস বলা শুরু কর।”

টুনি একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “থ্যাংকু প্রমি আপু। আমি আসলে কীভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমাদের কাউকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।”

শান্ত বলল, “আঠারো বছরের আগে বিয়ে করা বেআইনি জানিস তো? যাই হোক করে যখন ফেলেছিস এখন তো আর কিছু করার নাই। ছেলে কী করে?”

মুনিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “টুনি আপু! তুমি বিয়ে করে ফেলেছ?”

টুনি বলল, “না আমি বিয়ে করি নাই।”

টুম্পা বলল, “তাহলে কী করেছ?”

টুনি বলল, “আমি সেইটা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু চান্স পাচ্ছি না।”

শাহানা এবারে সবাইকে ধমক দিয়ে বলল, “সবাই চুপ। একটা কথা বলবি তো দাঁত ভেঙে দেব। টুনি তুই বল।”

টুনি বলল, “থ্যাংকু শাহানাপু। আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমি সরফরাজ কাফীকে একটু টাইট করে দিয়েছি।”

এবারে একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল।

“সরফরাজ কাফীকে? সত্যি? খোদার কসম? কী রকম টাইট? কবে করেছিস? কীভাবে করেছিস? পেলি কোথায়? কী আশ্চর্য! কী অসাধারণ। কী ফাটাফাটি।”

সবার চিৎকার হইচই একটু থামার পর টুনি বলল, “আসলে ঠিক প্ল্যান করে করি নাই। বলতে গেলে হঠাৎ করে হয়ে গেছে সে জন্য তোমাদের জানানো হয়নি। তা ছাড়া যেটা করেছি সেটা আসলে কাজ করবে কিনা আমি সেটা জানতামও না, সেইজন্য আগে থেকে তোমাদের জানাই নাই।”

শাহানা বলল, “কীভাবে কী করেছিস বল। শুনি।”

টুনি তখন সালমাকে নিয়ে গিফট কিনতে বের হওয়ার পর হঠাৎ করে কীভাবে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসের সামনে চলে এসেছে, সালমা কীভাবে তাকে নিয়ে সেই অফিসে ঢুকেছে, কীভাবে সরফরাজ কাফীকে চার-পাঁচ হাজার মগ কেনার লোভ দেখিয়েছে, তারপর কীভাবে একটা ভুয়া চিঠি দিয়েছে, সেই চিঠি ভালো করে না পড়েই কীভাবে সরফরাজ কাফী চার হাজার মগ নিয়ে চলে এসেছে, স্কুলের ছেলেমেয়েরা কীভাবে সেই মগ নিয়ে চলে গেছে–সরফরাজ কাফীর কীভাবে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে সবকিছু খুলে বলল।

সব শুনে শান্ত পর্যন্ত টুনির পিঠে থাবা দিয়ে বলল “সাব্বাশ টুনি! সাব্বাশ! এরপরের বার আমাকে বলবি দেখিস আমি তোকে কত হাইফাই ভুয়া চিঠি বানিয়ে দেব!”

শাহানা বলল, “তোরা স্কুলে কোনো ঝামেলায় পড়িসনি?”

“নাহ্! এখনো পড়ি নাই। আমাদের হেড মিস্ট্রেস সরফরাজ কাফীকে একেবারে পাত্তা দেন নাই।”

“কেন?”

“যেই মানুষ মাথার মাঝখানে সিঁথি করে কে তাকে পাত্তা দেয়?”

সবাই হি হি করে হাসল। শাহানা বলল, “টুনি তোর এই কাজের জন্য তোকে একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার।”

মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ পুরস্কার পুরস্কার।”

প্রমি বলল, “আমরা সবাই মিলে চাইনিজ খেতে যেতে পারি।”

শান্ত বলল, “ছোটাচ্চুকে বললেই আমাদের চাইনিজ খেতে নিয়ে যাবে।”

টুনি বলল, “উঁহুঁ। ছোটাচ্চুকে বলা যাবে না।”

শাহানা অবাক হয়ে বলল, “কেন না? শুনে ছোটাচ্চুই তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।”

টুনি বলল, “আসলে আমি আজকে মিটিংটা যে জন্য ডেকেছি সেটা এখনো তোমাদের বলি নাই। সেটা বললে তোমরা বুঝতে পারবে।”

সবাই তখন একসাথে বলল, “কী জন্য মিটিংটা ডেকেছিস?”

“অন্য একটা জিনিস বলার জন্য।”

“কী অন্য জিনিস? বল। বল।”

টুনি গলা পরিষ্কার করে বলল, “যেদিন সালমা জানতে পারল সরফরাজ কাফী ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি দখল করে নিয়েছে তখন সে আমাকে বলল, আমরা সবাই মিলে এজেন্সিটা সরফরাজ কাফীর হাত থেকে উদ্ধার করে ছোটাচ্চুকে ফিরিয়ে দিই না কেন?”

প্রমি বলল, “ছোটাচ্চুর নিজের কোনো উত্সাহ নাই”

টুনি বলল, “আমিও সালমাকে সেটাই বলেছি! সালমা বলেছে কিন্তু এত বড় চোট্টামি আমরা কেন মেনে নিচ্ছি–”

শান্ত বলল, “সরফরাজ কাফী এত বড় ক্রিমিনাল–তার সাথে কে পারবে?”

টুনি বলল, “হ্যাঁ সেটা সত্যি। কিন্তু সালমা বলেছে সে যত বড় ক্রিমিনালই হোক আমরা চেষ্টা করলে নাকি তাকে কাবু করতে পারব। বড় মানুষেরা পারবে না কিন্তু আমরা বাচ্চারা পারব।”

টুনি একটু থামল, প্রথমে কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর প্রথম মুনিয়া কথা বলল, “পারব। পারব। সরফরাজ কাফীকে খিঁচে ফেলব।”

শাহানা ভুরু কুঁচকে বলল, “খিঁচে ফেলবি? খিঁচে ফেলা মানে কী?”

মুনিয়া বলল কোনো কথা না বলে দুই হাত দিয়ে অদৃশ্য কিছু একটাকে টেনে লম্বা করে সেটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো করে পা দিয়ে পিষে ফেলল। সবাই তখন খিচে ফেলা মানে কী বুঝতে পারল।

শান্ত বলল, “তোর বন্ধু সালমা ঠিকই বলেছে। আমরা ইচ্ছা করলে কাফী ব্যাটাকে সাইজ করে ছেড়ে দিতে পারব। হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে থাকবে ছয় মাস!”

টুনি বলল, “আমি আসলে মারপিট করার কথা বলছি না। আমি বলছি তার হাত থেকে ছোটাচ্চুর অফিসটা উদ্ধার করার কথা। উদ্ধার করে আবার ছোটাচ্চুকে দেওয়ার কথা।”

শাহানা বলল, “কীভাবে উদ্ধার করবি?”

“এখনো জানি না। এই জন্য তোমাদের ডেকেছি। আমরা সবাই মিলে চিন্তা করলে একটা বুদ্ধি বের হয়ে যাবে।”

প্রমি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। মনে নাই যখন ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুর ব্রেকআপ হয়ে যাচ্ছিল তখন আমরা চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করেছিলাম?”

টুম্পা বলল, “সেইটা ছিল ঝুমু খালার বুদ্ধি!”

টুনি বলল, “আমি সেইজন্য ঝুমু খালাকেও আজকে মিটিংয়ে ডেকেছি। ঝুমু খালা বলেছে তার আসতে একটু দেরি হবে। আসার সময় নাশতা নিয়ে আসবে।”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “ভালো বুদ্ধির জন্য ভালো খাওয়া দাওয়ার দরকার। দেরি করলে হবে কেমন করে?”

টুনি শান্তর কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমারও মনে হয় সালমা ভুল বলে নাই। সেইদিন সরফরাজ কাফীর অফিসে গিয়ে আমি তিনটা জিনিস দেখেছি।”

প্রমি জিজ্ঞেস করল, “কোন তিনটা জিনিস?”

টুনি বলল, “প্রথম যে জিনিসটা দেখেছি সেইটা হচ্ছে সরফরাজ কাফীর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিটা মোটেও ভালো চলছে না। কোনো কেস নাই, স্যুভেনির বিক্রি করে চালায়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। এখন সেখানে একটা কাফেটেরিয়া দিবে।”

“কী আজব!” প্রমি জিজ্ঞেস করল, “আর বাকি দুইটা জিনিস?”

“দুই নম্বর জিনিস হচ্ছে মানুষটার অনেক লোভ।”

টুম্পা গম্ভীরভাবে বলল, “লোভে পাপ। পাপে মৃত্যু।”

টুনি বলল, “ঠিকই বলেছিস, তিন নম্বর জিনিসটা আসলে তাই। লোভের জন্য সে ক্রাইম করে ফেলতে রাজি আছে। আমাকে আর সালমাকে কমিশন পর্যন্ত দিতে চাইছিল, বললাম না।”

শাহানা বলল, “তার মানে সে এর মাঝে নিশ্চয়ই অনেক ক্রাইম করে ফেলেছে। কিন্তু আমরা তাকে ধরব কেমন করে?”

টুনি বলল, “সেই জন্য ফাঁদ পাততে হবে। স্টিং অপারেশন।”

শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

টুনি বলল, “কীভাবে কী রকম স্টিং অপারেশন করা যায় সেটা নিয়ে আলাপ করার জন্য তোমাদের ডেকেছি।”

প্রমি বলল, “আমাদের একটা বড় সমস্যা।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা?”

“আমাদের সাথে কোনো বড় মানুষ নাই। আমরা বাচ্চারা গিয়ে সরফরাজ কাফীকে কিছু বললে সে বিশ্বাস করবে না।”

শাহানা বলল, “ফারিহাপুকে বললে মনে হয় আমাদের সাথে থাকবে।”

টুনি বলল, “কিন্তু ফারিহাপু অনেকবার সরফরাজ কাফীর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে গেছে, তাকে ধামকি ধুমকি দিয়েছে। কাফী ব্যাটা ফারিহাপুকে নিশ্চয়ই ভালো করে চিনে।”

টুম্পা বলল, “তাহলে বাকি থাকল খালি ঝুমু খালা।”

টুনি বলল, “হ্যাঁ, ঝুমু খালা ছাড়া বড় মানুষ নাই।”

ঠিক এই সময় ঝুমু খালা সবার জন্য নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকল। মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “ঝুমু খালা তুমি অনেকদিন বাঁচবে।”

“কেন?” ঝুমু খালা চোখ পাকিয়ে বলল, “আমি কেন অনেকদিন বাঁচব?”

“আমরা যখন তোমার কথা বলছিলাম ঠিক তখন তুমি এসে গেছ। এর মানে তুমি অনেকদিন বাঁচবে।”

ঝুমু খালা নাশতাগুলো টেবিলে রেখে বলল, “পেটের মাঝে খিদা লাগলে খালি আমার কথা মনে পড়ে?”

টুম্পা বলল, “না ঝুমু খালা এইবার নাশতার জন্য না, এইবার অন্য কিছু।”

কথা শেষ না করেই অবশ্য সবাই নাশতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেখলে মনে হয় তারা বুঝি বহুদিন থেকে না খেয়ে আছে।

ঝুমু খালা বলল, “অন্য কিছু কী?”

টুনি বলল, “তুমি বসো ঝুমু খালা। তোমার সাথে ইম্পরট্যান্ট কথা আছে।”

“আমার সাথে ইম্পরট্যান্ট কথা? কী হইছে? নতুন কেউ আবার নতুন কোনো ঝামেলা পাকাইছ?”

টুনি হাসল, “এখনো পাকাই নাই। পাকাতে চাচ্ছি।”

“ঝামেলা পাকাইতে চাচ্ছ? ব্যাপারটা কী?”

টুনি বলল, “তুমি আগে বসো। বলছি।”

ঝুমু খালা বলল, “এতদিন ঝামেলা পাকানোর পর আমার কাছে আসছ। এখন পাকানোর আগে–ব্যাপারটা কী?”

টুনি বলল, “তোমার সরফরাজ কাফীর কথা মনে আছে? যে মানুষটা ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ এজেন্সি দখল করে নিয়েছিল–”

“মনে নাই আবার?” ঝুমু খালা ফোঁস করে উঠল, “সেই বাদাইমার বাচ্চারে দুইটা গালি না দিয়া আমি কুনোদিন মুখে ভাত

তুলি না–”

“আমরা চিন্তা করছি ঐ মানুষটার কাছ থেকে অফিসটা কেড়ে নিব। ছোটাচ্চুকে ফিরিয়ে দেব।”

ঝুমু খালা টেবিলে একটা কিল দিল, টেবিলের ওপর নাশতার ট্রে, প্লেট, গ্লাস সবকিছু ঝনঝন করে উঠল! ঝুমু খালা বলল, “এইটা একটা কামের কাম হইব। একশবার।”

টুনি বলল, “কিন্তু একটা সমস্যা।”

“কী সমস্যা।”

“কাজটা কীভাবে করতে হবে জানি না, সেই জন্য তোমাকে ডেকেছি।”

ঝুমু খালা টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বলল, “সেইটা আমার উপর ছাইড়া দাও।”

টুম্পা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করবে তুমি?”

“আমার শলার ঝাড়টা লইয়া একদিন ওই কাফিরের বাচ্চার অফিসে যামু, তারপর সেই ঝাড়ুর বাড়ি দিয়া যদি তার চৌদ্দ গুষ্টির নাম আমি না ভুলাই–”

শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

শাহানা বলল, “ঝুমু খালা মানুষটা ঝাড়পেটা করলে আমাদের সবার আনন্দ হবে সত্যি কিন্তু তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে না। আমাদের তাকে অন্যভাবে ধরতে হবে। যেন অফিসটা তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায়।”

টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা যদি ঝাড় দিয়ে পিটা দেয় তাহলে এমনিতেই অফিস থেকে পালাবে।”

টুনি বলল, “মনে হয় না। মনে নাই আমাদের শান্তশিষ্ট ছোটাচ্চু সরফরাজ কাফীকে ঘুষি মেরেছিল? মার খেয়ে সে পালায় নাই। উল্টা ছোটাচ্চুকে হাজতে পাঠিয়েছিল।”

শাহানা বলল, “মারপিট না করে কাজ করতে হবে।”

ঝুমু খালা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “মাইরের উপর ওষুধ নাই।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে সেটা মানলাম। কিন্তু তুমি চিন্তা করে আমাদের বলো অন্য কিছু করা যায় কিনা।”

ঝুমু খালা কিছুক্ষণ মুখ সুচালো করে উপরের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই কাফিরের বাচ্চা আসলে এক নম্বর চোরা। তারে কিছু একটা চুরি করতে দিবা। তারপর যখন চুরি করব সেই সময় হাতেনাতে ধইরা মাইর দিবা।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী চুরি করতে দিবে?”

“এই ব্যাটা ছ্যাচড়া, দুইটা মুরগি চুরি করতে দিলেও চুরি করব মনে হয়।”

শাহানা বলল, “যাই হোক সেইটা চিন্তা করে বের করতে হবে।”

টুনি বলল, “তোমাকে আসলে অন্য আরেকটা কাজের জন্য ডেকেছি।”

“কী কাম?”

“আমরা তো ছোট, আমাদের সাথে কোনো বড় মানুষ নাই। তাই যখন বড় মানুষের দরকার হবে তখন তুমি আমাদের জন্য কাজ করবে।”

ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে তাকালো, “আমি?”

“হ্যাঁ তুমি। চোখে চশমা আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে যাবে।”

শান্ত যোগ করল, “শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে–”

ঝুমু খালা শান্তর দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, “তোমাগো ধারণা আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারি না?”

টুম্পা চোখ বড় বড় করে বলল, “পার?”

“পারমু না কেন? একশবার পারি।”

“তাহলে বল না কেন?”

ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “আমার কি মাথা খারাপ হইছে যে আমি মুখ বেঁকা কইরা দিন রাইত চব্বিশ ঘণ্টা শুদ্ধ ভাষায় কথা কমু? আমি কি টেলিভিশনে খবর পড়ি?”

টুম্পাকে স্বীকার করতে হলো ঝুমু খালার দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কোনো দরকার নেই। তারপরও বলল, “এখন একটু বলবে?”

ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, “নাহ্। দরকার না থাকলে আমি আলতু ফালতু শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি না।”

টুম্পা একটু অবাক হয়ে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। কুমু খালা বলল, “তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলা না? ঠিক আছে শোনো”, ঝুমু খালা তখন তার ঠোঁট সুচালো করে মোটামুটি ঢং করার ভান করে টেলিভিশনের নাটকের মতো করে বলল, “না না না টুম্পা, তুমি এমন করে কথা বলো না, তাহলে আমার হৃদয়টা ভেঙে খান খান হয়ে যাবে”

ঝুমু খালার কথা আর কথা বলার ভঙ্গি দেখে সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে হাততালি দিতে থাকে। ঝুমু খালা নিজেও হাসল।

মুনিয়া বলল, “ঝুমু খালা তুমি কি সরফরাজ কাফীর সাথেও এই রকম মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলবে?

ঝুমু খালা হুংকার দিল, “না।”

“তার সাথে কীভাবে কথা বলবে?”

“তারে বলব”, ঝুমু খালা মুখ শক্ত করে থমথমে গলায় বলল, “কাফিরের বাচ্চা কাফির আমি যদি ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে তোমার হোতা মুখটা ভোঁতা করে না দিই তাহলে আমার নাম ঝুমু না!”

ঝুমু খালার কথা বলার ভঙ্গি দেখে সবাই আবার হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ঠিক তখন দরজায় একজন মানুষের ছায়া পড়ল, সবাই তাকিয়ে দেখে ছোটাচ্চু  দাঁড়িয়ে আছে।

সাথে সাথে সবাই হাসি থামিয়ে ফেলল, তাদের এই মিটিংয়ে ছোটাচ্চু এসে পড়বে কেউ ভাবে নাই। ছোটাচ্চু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো? এখানে কিসের মিটিং? এত হাসাহাসির কী হয়েছে?”

টুনি বলল, “নাহ্। কিছু না।”

“কী নিয়ে হাসছিলি?”

“এই তো।”

“এই তো আবার কী? আমাকে বলতে চাস না?”

টুম্পা বলল, “তুমি বুঝবে না।”

ছোটাচ্চু  চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি বুঝব না? আমাকে নিয়ে হাসছিলি?”

শান্ত বোকার মতো বলে ফেলল, “তোমার সাথে সম্পর্ক আছে কিন্তু তোমাকে নিয়ে না।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “আমার সাথে সম্পর্ক আছে? তাহলে তো জানা দরকার ব্যাপারটা কী? আমাকে নিয়ে কী ষড়যন্ত্র করছিস? তোদেরকে কোনো বিশ্বাস নাই।”

ছোটাচ্চু এবারে একটা চেয়ার টেনে বসে গেল। ঝুমু খালা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নাও। তোমরা কথাবার্তা বলো। আমার কাম আছে, আমি গেলাম।”

ঝুমু খালা চলে গেল। ছোটাচ্চু তখন আবার সবার মুখের দিকে তাকালো, বলল, “বল! তোরা কী ষড়যন্ত্র করছিস?”

কোনো একটা উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত ছোটাচ্চু নড়বে না তাই টুনি বলল, “আমরা যেটাই করি তাতে তোমার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।”

“তাহলে বলতে ঝামেলা কী?”

প্রমি বলল, “আমরা সারপ্রাইজ দিতে চাই। তাই বলা যাবে না।”

এইবারে ছোটাচ্চুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। খুশি খুশি গলায় বলল, “বুঝেছি, আমার জন্মদিনে সারপ্রাইজ পার্টি করবি?”

ছোটাচ্চুর জন্মদিনের তারিখটা কেউ জানে না, তাই সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “ঠিক আছে! আমি তো জেনে গেলাম, তবু ভান করব সারপ্রাইজ! খালি একটা কেক আর মোমবাতি দিয়ে সারপ্রাইজ করার চেষ্টা করিস না! ভালো দেখে একটা গিফট কিনিস!” কথা শেষ করে ছোটাচ্চু হা হা করে হাসতে হাসতে উঠে গেল। সবাই মিলে ছোটাচ্চুর জন্মদিনে তাকে সারপ্রাইজ দিবে সেটা চিন্তা করে ছোটাচ্চুর অনেক আনন্দ হচ্ছে।

ছোটাচ্চু উঠে যাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর শাহানা জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চুর জন্মদিন কবে? কেউ জানিস?”

প্রমি বলল, “দাদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “দাদিকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। দাদি বলবে, বড় বন্যার আগের বছর আশ্বিন মাসের রাতে–না হলে এ রকম কিছু।”

“তাহলে?”

“ফারিহাপুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।”

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ ফারিহাপু বলতে পারবে।”

টুনি বলল, “জন্মদিন যেদিনই হোক আমাদের তার আগে সরফরাজ কাফীর কাছ থেকে ডিটেকটিভ এজেন্সি কেড়ে নিতে হবে।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “কেন? তার আগে কেন?”

“তাহলে আমরা সত্যি সত্যি তার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে পারব।”

সবাই মাথা নাড়ল, মুনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছোটাচ্চুর মাথায় বেশি বুদ্ধি নাই। তাই না?”

সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালো, কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু টুনি বলল, “এর পরে আমরা কী করব সেটা ঠিক করতে হবে। আজকের মতো মিটিং শেষ।”

.

আরও দুইটা চারটা একত্রিশ মিনিটের মিটিং এবং ঝুমু খালার অনেকগুলো ডালপুরি শেষ করে বাচ্চারা তাদের প্ল্যান ঠিক করল। টুনিকে যেহেতু সরফরাজ কাফী দেখে ফেলেছে তাই সে তার সামনে যেতে পারবে না। সবকিছু চিন্তা করে শান্তকে আসল দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঠিক করা হলো। শান্ত তার স্বভাবমতো হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “আমি? আমি কেন?”

প্রমি বলল, “তার কারণ সরফরাজ কাফী হচ্ছে ক্রিমিনাল। তার সাথে কথা বলার জন্য এমন একজন মানুষ দরকার যার মাইন্ড হচ্ছে ক্রিমিনাল, আমাদের মাঝে তুই হচ্ছিস সে রকম একজন মানুষ।”

শান্ত চোখ লাল করে বলল, “আমি ক্রিমিনাল?”

টুনি তাড়াতাড়ি বলল, “না না, প্রমি আপু মোটেও বলে নাই তুমি ক্রিমিনাল।”

“তাহলে কী বলেছে?”

“বলেছে তুমি ক্রিমিনালদের মনে কী আছে সেটা বুঝতে পারো–”

“একই তো কথা হলো।”

“মোটেও এক কথা না। যারা বড় ডিটেকটিভ তাদের সবার মাইন্ড এ রকম।”

শান্ত শেষ পর্যন্ত শান্ত হলো। তখন তার ট্রেনিং শুরু হলো। সে কী বলবে, কীভাবে বলবে কখন বলবে সবকিছুর রিহার্সাল দেওয়া হলো। সরফরাজ কাফীর সাথে সব কথা রেকর্ড করার জন্য ভালো একটা স্মার্টফোন তার শার্টের ভেতরে সেলাই করে রেখে দেওয়া হলো। আরেকটা স্মার্টফোন দেওয়া হলো দেখানোর জন্য। সে খুব বড়লোকের একজন বখে যাওয়া টিনএজার হিসেবে যাবে, তাই বড় লোকের বখে যাওয়া টিনএজার ছেলে কী রকম কাপড় পরে, কীভাবে হাঁটে, কীভাবে কথা বলে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করে শান্তকে শিখিয়ে দেওয়া হলো। তারপর একদিন খোঁজখবর নিয়ে শান্ত আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে হাজির হলো। রওনা দেওয়ার আগে ঝুমু খালা তিনবার কুলহু আল্লাহ্ পড়ে শান্তর বুকে ফুঁ দিয়ে দিল। ছোটরা একটা সিএনজিতে এসে শান্তকে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাছাকাছি নামিয়ে দিল।

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া এখন থেকে বাকি কাজ তোমার।”

শান্ত বলল, “জানি।”

“তাহলে তুমি যাও।”

মুনিয়া বলল, “সরফরাজ কাফীকে খিঁচে আস।”

শান্ত নার্ভাসভাবে একটু হেসে রওনা দিল।

শান্তর বুক একটু ধুকপুক করছিল, কিন্তু সে বেশ ভালোভাবেই অফিসে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “এটা ডিটেকটিভ এজেন্সি?”

রিসেপশন সেন্টারে বসে থাকা মহিলা মাথা তুলে শান্তকে দেখে বলল, “হ্যাঁ। কাকে চাও?”

শান্ত একটা চিউয়িংগাম চিবুতে চিবুতে বলল, “একজন ডিটেকটিভকে।”

মহিলা ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন?”

“কনফিডেনসিয়াল। আমি সেটা শুধু ডিটেকটিভকে বলব। আছে । কেউ কথা বলার জন্য?”

“কে কথা বলবে?”

“আমি। আবার কে!” শান্ত মুখ বাঁকা করে হাসল। মুখ বাঁকা করে হাসাটা আলাদাভাবে প্র্যাকটিস করে এসেছে। ঠিকমতো কাজে লাগাতে পেরে শান্ত খুশি হয়ে উঠল। মহিলাটা চোখ ছোট ছোট করে শান্তকে দেখল, তারপর বলল, “একটু অপেক্ষা কর। আমি দেখি।”

মহিলা সরফরাজ কাফীর অফিসে ঢুকে তার সাথে কথা বলে বাইরে এসে বলল, “যাও ভেতরে যাও।”

রিহার্সাল করা পার্ট অনুযায়ী শান্ত তার স্মার্টফোন বের করে এবারে তার কাল্পনিক ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে বলতে সরফরাজ কাফীর অফিসে ঢুকল। তার কাল্পনিক ড্রাইভারকে তখন বলছে, “কালাম ভাই আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আপনি গাড়িটা এই অফিসের সামনে রাখবেন না, একটু দূরে নিয়ে পার্ক করেন। (কিছু একটা শোনার ভান করল তারপর বলল) আমার জন্য চিন্তা করবেন না, আমি বের হয়ে আপনাকে ফোন দিব। (হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়েছে ভান করে) ও আরেকটা কথা, আমার ঘড়িটা মনে হয় গাড়িতে ফেলে এসেছি–একটু বের করে রাখেন-হা রোলেক্সটা–এইটাও যদি হারাই আব্বু খুব রাগ করবে। ঠিক আছে?”

শান্ত ফোনটা হাতে নিয়ে সরফরাজ কাফীর দিকে এগিয়ে যায়। ফোনটা টেবিলে রাখে যেন সেটা নিয়ে সরফরাজ কাফী কিছু সন্দেহ না করে। তারপর একটা চেয়ারে বসে সরফরাজ কাফীর দিকে সরু চোখে তাকালো, বলল, “আপনি ডিটেকটিভ?”

সরফরাজ কাফীও সরু চোখে শান্তর দিকে তাকালো, শান্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? কী চাও?”

শান্ত বলল, “আমি ভেবেছিলাম ডিটেকটিভরা ইয়াং হয়। স্মার্ট হয় আর হ্যান্ডসাম হয়।”

সরফরাজ কাফী অপমানটা সহ্য করে মুখ কালো করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী চাও?”

শান্ত কলল, “আমি কি আপনার সাথে খুব কনফিনডেনসিয়াল একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি? আপনারও লাভ হবে, আমারও লাভ হবে এ রকম একটা বিষয়? মানে যাকে বলে উইন উইন সিচুয়েশান।”

“কী বিষয়!”

“আমাদের কথা আর কেউ শুনবে না তো? কথাটা খুবই গোপনীয়।”

“না। কেউ শুনবে না। বল।”

“আমার আব্ব এই দেশের অনেক বড় একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট–”

“কী নাম?”

“নাম বললে আপনি চিনবেন কিন্তু আমি এখন নাম বলব না। আপনি যদি আমার সাথে একটা ডিল করেন তাহলে বলব।”

সরফরাজ কাফী বাঁকা করে হেসে বলল, “তুমি একটা বাচ্চা ছেলে তোমার সাথে আমি কী ডিল করব?”

শান্ত তার প্র্যাকটিস করা বাঁকা হাসিটা দিয়ে বলল, “আমাকে যত বাচ্চা ভাবছেন আমি তত বাচ্চা না। আর আমি বাচ্চা দেখেই তো আপনার সাথে ডিল করতে এসেছি। বড় হলে তো আমি নিজেই করে ফেলতাম। আপনাকে দরকার হতো না। তাছাড়া–” শান্ত খুবই কায়দা করে কথা থামিয়ে ফেলল।

সরফরাজ কাফী জিজ্ঞেস করল, “তাছাড়া কী?”

“আমি বাচ্চা হলেও আমার ডিলটা কিন্তু অনেক টাকার ডিল হতে পারে। আমার আব্বুর অনেক টাকা। সেই টাকা দিয়ে আব্বু কী করবে জানে না।”

সরফরাজ কাফীর চোখ প্রথমবার লোভে চক চক করে ওঠে। জিব দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “ঠিক আছে বল, কী বলতে চাও।”

শান্ত একটু ঝুঁকে কথা বলতে শুরু করে, “আমার আব্বুর টাকার অভাব নাই কিন্তু আন্ধু আমার হাত খরচের জন্য মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে একটুও বেশি দিতে চায় না। আপনি বলেন আজকালকার দিনে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কিছু হয়? আমি বন্ধুবান্ধবের সামনে মুখ দেখাতে পারি না।”

সরফরাজ কাফী মাছের মতো চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত বলতে থাকে, “আব্বর পকেট থেকে কিছু টাকা বের করার জন্য আমি একটা বুদ্ধি বের করেছি। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনাকে বলি।”

“কী বুদ্ধি?”

“আমি আব্বুর খুব দরকারি কিছু কাগজ গাপ করে দিব।”

সরফরাজ কাফী ভুরু কুঁচকালো, “কী করে দেবে?”

“গাপ করে দিব। মানে হাওয়া করে দিব। আব্লু কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে আপনার কাছে আসবে।”

“আমার কাছে কেন আসবে?”

শান্ত খুবই অর্থপূর্ণভাবে হাসল। বলল, “সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। যারা অনেক বড়লোক তারা কখনো পুলিশের কাছে যায় না। আপনাকে আমি বলছি আমার আব্ব আপনার কছে আসবে। আপনার কাছে যেন আসে সেটা আমার দায়িত্ব।” শান্ত আবার থামল।

সরফরাজ কাফী বলল, “ঠিক আছে।”

“আপনি আমার আব্বুর সাথে টাকা পয়সার ডিল করবেন । তারপর তার কাগজপত্র খুঁজে বের করে দিবেন। আব্বুর কাছ থেকে যত টাকা পাবেন সেটা ফিফটি ফিফটি ভাগ হবে। অর্ধেক আপনার অর্ধেক আমার।”

সরফরাজ কাফী কিছুক্ষণ শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

শান্ত বলল, “রাজি?”

সরফরাজ কাফী বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না।”

শান্ত ষড়যন্ত্রীর মতো বলল, “বোঝার কিছু নাই। আপনার কিছুই করতে হবে না। আপনাকে আমি গোপন একটা ফাইল এনে দেব, আপনি সেটা আপনার কাছে রাখবেন। আমার আব্বু যখন সেই ফাইলটা খুঁজে বের করতে বলবে আপনি সেটা বের করে দিবেন। তারপর যত টাকা পাবেন তার অর্ধেক আপনার অর্ধেক আমার!”

সরফরাজ কাফী মাথা চুলকাল। শান্ত বলল, “আপনি যখন ইচ্ছা কাজ বন্ধ করে দেবেন। আপনার ইচ্ছা!”

সরফরাজ কাফী বলল, “ঠিক আছে। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।”

শান্ত আনন্দে চিৎকার করে হাত তুলে বলল, “হাই ফাইভ!”

সরফরাজ কাফী হাই ফাইভ বিষয়টা জানে না তাই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। শান্তকে হাই ফাইভ করা শেখাতে হলো, তখন সে খুবই অনিচ্ছার সাথে একবার হাই ফাইভ করল।

***

এক ঘণ্টা পর বাচ্চারা বাসায় বসে বসে শান্তর শার্টে সেলাই করা স্মার্টফোনে সরফরাজ কাফীর সাথে তার কথাগুলো শুনতে শুনতে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তারা বেশি জোরে জোরে হাসতেও পারছিল না, তাহলে বড় মানুষেরা এসে জানতে চাইবে কী হয়েছে। পুরোটা শুনে সবাই শান্তর সাথে হাই ফাইভ করতে লাগল। শাহানা হাসতে হাসতে বলল, “শান্ত! তুই এত বড় ধড়িবাজ আমি কোনোদিন চিন্তাও করি নাই!”

প্রমি বলল, “অনবদ্য অভিনয়।”

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, সত্যি করে বলো দেখি তুমি কি আসলেই অভিনয় করেছ নাকি সত্যি কথা বলেছ?”

টুম্পা আর মুনিয়া হাততালি দিয়ে বলতে লাগল, “শান্ত ভাইয়া ক্রিমিনাল! শান্ত ভাইয়া ক্রিমিনাল।”

তাকে ক্রিমিনাল বলার পরও শান্ত আজকে রাগ হলো না। খুশিতে দাঁত বের করে হাসল। বলল, “প্রথম প্রথম একটু নার্ভাস লাগছিল, তারপরে আমার মনে হতে লাগল আমি শান্ত না–আমি আসলেই বড়লোক বাপের পাজি ছেলে! তখন সবকিছু সোজা হয়ে গেল!”

শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “এখনো কি পাজি আছিস নাকি আবার নরমাল শান্ত হয়েছিস?”

শান্ত হাসল, “মনে হয় নরমাল হয়েছি!”

টুনি বলল, “আমাদের কাজ কিন্তু এখনো শেষ হয় নাই। শান্ত ভাইয়াকে আবার যেতে হবে। এখন নাটকের সেকেন্ড পার্ট হবে।”

টুম্পা অবাক হয়ে বলল, “এখনো নাটকের শেষ হয় নাই!”

টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু। এখন মাত্র নাটক শুরু হয়েছে। কালকে প্রথমে হবে সেকেন্ড পার্ট। তারপরে থার্ড পার্ট। থার্ড পার্ট হচ্ছে আসল পার্ট, সেইখানে ঝুমু খালা থাকবে।”

মুনিয়া হাততালি দিল, “কী মজা! কী মজা!”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “আমরা সেই নাটক দেখতে পারব না?”

“নাহ্।” টুনি মাথা নাড়ল, “খালি শুনতে পারবি।

প্রমি বলল, “ঠিক আছে, এখন তাহলে আমরা সেকেন্ড পার্টের জন্য রিহার্সাল শুরু করে দিই।”

টুনি বলল, “আমার মনে হয় আমাদের এখন ঝুমু খালাকেও লাগবে।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “আমি কি ডেকে আনব?”

“যা, দেখ ঝুমু খালা এখন আসতে পারবে কিনা।”

টুম্পা প্রচণ্ড উৎসাহে তখনই ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

***

পরেরদিন আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি অফিসের কাছাকাছি একটা স্কুটার থেকে বাচ্চাকাচ্চারা নেমেছে। এবারে তাদের সাথে ঝুমু খালাও আছে। তবে আজকে ঝুমু খালার চেহারাটা দেখার মতো। তার চুলগুলো খোলা এবং মাথা ঝাঁকুনি দিলেও সেগুলো একদিক থেকে অন্যদিকে যায়। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক এবং চোখে কালো গগলস। ছোট ব্লাউজ (অনেক ধস্তাধস্তি করে ঝুমু খালাকে পরানো হয়েছে) এবং আগুন রঙের শাড়ি। কপালে বিশাল সবুজ রঙের টিপ। যেই ঝুমু খালাকে দেখে সেই মুখ হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

তবে ঝুমু খালা ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসে ঢুকল না, সেখানে ঢুকল শুধু শান্ত। তার হাতে একটা বড় বাদামি খাম।

শান্তকে দেখে রিসেপশন কাউন্টারের মেয়েটি তাকে চিনতে পারল। মুখ তুলে বলল, “স্যারের কাছে এসেছ?”

“হ্যাঁ। আছেন কাফী স্যার?”

“হ্যাঁ আছেন। তুমি অফিসে চলে যাও।”

শান্ত অফিসে ঢুকল। শান্তকে দেখে সরফরাজ কাফীর মুখে একটা তেলতেলে হাসি ফুটে উঠল। বলল, “কী ব্যাপার?”

“আপনাকে বলেছিলাম না আব্বুর একটা জরুরি ফাইল গাপ করে দিব?”

“হ্যাঁ।”

“অনেক কষ্ট করে গাপ করেছি। আপনাকে দেওয়ার জন্য এনেছি।”

সরফরাজ কাফী হাত বাড়াল, “দাও।”

শান্ত বাদামি পেট মোটা বড় খামটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। অনেক যত্ন করে খামটা তৈরি করা হয়েছে। খামের উপরে কোম্পানির নাম লেখা আছে, তার উপরে-নিচে অনেক ধরনের নম্বর। কালো মার্কার দিয়ে বড় বড় করে ইংরেজিতে কনফিডেনসিয়াল লেখা। খামটা হালকাভাবে লাগানো, একটু চেষ্টা করলেই ভোলা যাবে।

সরফরাজ কাফী যখন খামটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তখন শান্ত বলল, “আপনি কিন্তু খামটা খুলবেন না–তাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে।”

“কী ঝামেলা?”

“ভেতরে আব্বুর গোপন কাগজপত্র, হারিয়ে গেলে বিপদ।”

“ঠিক আছে খুলব না।”

শান্ত তারপর ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, “এখন আব্বুর ফোনের জন্য অপেক্ষা করেন।”

“করব।”

“মনে আছে তো, ফিফটি ফিফটি?”

“মনে আছে।”

শান্ত দাঁত বের করে মোটামুটি একটা ভয়ংকর হাসি দিয়ে বের হয়ে গেল।

তাদের টিমের সবাই তখন কাছাকাছি একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছে। শুধু ঝুমু খালা কিছু খাচ্ছে না, তার মুখ শক্ত। একটু পরেই তাকে নাটকের তিন নম্বর পর্ব করতে হবে, যেটা শেষ এবং আসল পর্ব। সে জন্য ঝুমু খালার মনে হয় ভেতরে ভেতরে একটু টেনশন হচ্ছে।

শান্তকে দেখে সবাই তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক আছে?”

শান্ত দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হান্ড্রেড অ্যান্ড টুয়েন্টি টু পারসেন্ট।”

ঝুমু খালা ঝটকা দিয়ে তার মাথার চুলগুলো এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরিয়ে বলল, “এখন আমি যাব?”

ঝুমু খালা আজকে সারাক্ষণ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে।

টুনি বলল, “পাঁচ মিনিট সময় দাও ঝুমু খালা।”

শাহানা বলল, “এখন সরফরাজ কাফী প্যাকেটটা খুলছে।”

টুনি বলল, “হ্যাঁ। প্যাকেটটা যে রঙের গুঁড়া দিয়ে বোঝাই সেটা বুঝতে একটু সময় লাগবে। রং দিয়ে মাখামাখি হবার পর ধোয়ার চেষ্টা করবে তখন আরো বেশি সর্বনাশ হবে। সেইজন্য আরো দশ মিনিট সময়!”

কাজেই তারা আরো পনেরো মিনিট সময় দিল, তারপর বের হয়ে এল। এইবারে সবাই একসাথে।

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, যাও তোমার শেষ পার্টটা করে আস। কোনো ভুল যেন না হয়।”

শান্ত দাঁত বের করে হাসল, “আমার ওপর ছেড়ে দে! সরফরাজ কাফীকে তুষ করে ছেড়ে দেব।”

শান্ত রাস্তা পরে হয়ে ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসের দিকে যেতে থাকে। ঝুমু খালা ঝটকা মেরে তার চুলগুলো এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরিয়ে বলল, “এখন আমিও যাই?”

“যাও ঝুমু খালা।”

টুম্পা বলল, “সরফরাজ কাফীকে তুষ করে দিয়ে আস।”

টুনি বলল, “ঝুমু খালা তোমার ব্যাগটা নাও।”

ঝুমু খালা টুনির কাছ থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে শান্তর পিছে পিছে যেতে লাগল।

***

শান্ত ঝটকা দিয়ে ডিটেকটিভ এজেন্সির দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। রিসেপশন কাউন্টারের মহিলাটি নেই। সরফরাজ কাফীর অফিস থেকে তার আতঙ্কিত গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শান্ত দৌড়ে অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে! সর্বনাশ!”

সরফরাজ কাফীকে দেখে মনে হলো তার সর্বনাশ আগেই ঘটে আছে। তার হাত পা মুখ টকটকে লাল। পাশে দাঁড়ানো মহিলাটি একটা টিস্যুর বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সরফরাজ কাফী সেখান থেকে টিস্যু নিয়ে নিজের হাত মুখ মোছার চেষ্টা করছে। পুরো ঘর লাল টিস্যুতে ভরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো লাভ হচ্ছে না।

শান্ত চিৎকার করে বলল, “এত রক্ত কেন? মার্দানা ম্যাডাম কি এসে গেছে?”

সরফরাজ কাফী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “মাদানা ম্যাডাম কে?”

“আব্বুর বডিগার্ড! সিক্সথ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট।”

“সে কেন আসবে?”

“আব্ব খবর পেয়ে গেছেন আমি তার ফাইল চুরি করে আপনাকে দিয়ে গেছি! সর্বনাশ হয়ে গেছে! সর্বনাশ!”

সরফরাজ নিজের টকটকে লাল হাত-পা আর কাপড়ের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল, “সর্বনাশ আগেই হয়ে গেছে–”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “কী হয়েছে? আপনার গায়ে হাতে পায়ে রক্ত কেন? তাড়াতাড়ি হাসপাতাল যান, আপনার মনে হয় ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। কিন্তু আগে আমাকে আব্বুর ফাইলটা দেন। তাড়াতাড়ি। মার্দানা ম্যাডাম আসার আগে–”

সরফরাজ কাফী কেমন যেন ঘোলা চোখে তাকিয়ে রইল। শান্ত আবার চিৎকার করল, “তাড়াতাড়ি দেন, আমি পালাব। তাড়াতাড়ি

সরফরাজ কাফী কঁপা হাতে টেবিল থেকে একটা বাদামি খামের প্যাকেট তুলে দিল। প্যাকেটটা খোলা এবং সেখান থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো রং পড়ছে।

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “এই প্যাকেটটা কে খুলেছে? আপনি? আপনি প্যাকেটটা খুলে ফেলেছেন? সর্বনাশ! আপনাকে আমি না করেছিলাম না?”

সরফরাজ কাফী আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। শান্ত তাকে কিছু বলতে না দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “এখন আপনি শেষ, না হলে আমি শেষ। আপনার নির্ঘাৎ পঞ্চাশ বছরের জেল। তা না হলে ক্রস ফায়ার! না হলে গুম! সর্বনাশ।”

সরফরাজ কাফী কেমন যেন ভয় পাওয়া চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত চিৎকার করে বলল, “পালান! পালান এখান থেকে! জান নিয়ে পালান। মাদানা ম্যাডাম আসার আগে পালান!”

সে নিজে পালানোর জন্য দরজার দিকে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই লাথি দিয়ে দরজা খুলে ভয়ংকর মার্দানা ম্যাডাম ভেতরে ঢুকে গেল। চোখ থেকে ঝপ করে কালো গগলসটা খুলে ফেলল। মানুষটা ঝুমু খালা কিন্তু যেভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে হিংস্র চোখ মুখ কটমট করে তাকিয়ে আছে যে দেখে শান্ত পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। মার্দানা ম্যাডাম শান্তর দিকে তাকিয়ে হুংকার দিল, “খামোশ!”

তার হুংকার শুনে সবাই রীতিমতো কেঁপে উঠল। মার্দানা ম্যাডাম এক পা ভেতরে ঢুকে শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোমার বাবা হচ্ছেন ফিরেশতার মতো মানুষ আর তার ছেলে হয়ে তুমি হয়েছ ছিঁচকে চোর? ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ–”

শান্ত, হাসি গোপন করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

মার্দানা ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, “তুমি খুঁজে খুঁজে অন্য ছিঁচকে চোর বের করো দুই নম্বুরি কাজ করার জন্য? হ্যাঁ? তোমার এত বড় অধঃপতন?”

শান্ত মিনমিন করে বলল, “আর কোনোদিন করব না মার্দানা ম্যাডাম! খোদার কসম।”

“খবরদার। তোমার দুই নম্বুরি কাজের মাঝখানে আল্লাহ্ খোদাকে টানাটানি করবে না।”

শান্ত মাথা নাড়ল। মার্দানা বেগম বলল, “ফাইলটা দাও।”

“এর মাঝে খালি রং। ডেঞ্জারাস রং।”

“আমি জানি। আমি নিজে এই ফাইলের ভেতর দুই হাজার পাওয়ার লাল রং ঢুকিয়েছি। পার্মানেন্ট রং। চামড়ায় লাগলে চামড়া উঠে গেলেও রং উঠবে না। ক্রিমিনাল ধরার এক নম্বর ওষুধ।”

ঝুমু খালা মার্দানা ম্যাডামের অসাধারণ অভিনয় করতে করতে তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ বের করে সেটা খুলে ফেলল, বলল, “ফাইলটা ঢুকাও।”

শান্ত বাধ্য ছেলের মতো ফাইলটা পলিথিনের ব্যাগে রাখল। মার্দানা ম্যাডাম পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে সেটা নিজের ব্যাগে রেখে টেবিলে দুই হাত রেখে সরফরাজ কাফীর দিকে ঝুঁকে পড়ে তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল। ঝুমু খালার চোখের দিকে তাকিয়ে সরফরাজ কাফী কেমন যেন কুঁকড়ে গেল।

ঝুমু খালা–এখন যে মার্দানা ম্যাডাম, একটা চেয়ারে বসে ঝটকা মেরে তার চুলগুলো ডান দিক থেকে বাম দিকে নিয়ে গেল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা টকটকে লাল লিপস্টিক বের করে তার ঠোঁটে লাগাতে শুরু করল, ঠিক করে লাগানো হলো না, ঠোঁটের এদিকে সেদিকে একটু লেপ্টে গিয়ে তাকে আরো ভয়ংকর দেখাতে লাগল।

মার্দানা ম্যাডাম ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সরফরাজ কাফীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার নাম মাদানা বেগম। আমি আমার স্যারের জন্য কাজ করি। স্যারের জন্য আমি জান দিয়ে দেব। তাই স্যার যেদিন আমাকে বললেন তার এই পাজি ছেলেটার দিকে নজর রাখতে আমি তখন থেকে তার উপরে চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখি। তার শার্টের কলারে মাইক্রোফোন লাগানো আছে। সে যে কথা বলে আমি শুনি, রেকর্ড করি। বুঝেছেন?”

সরফরাজ কাফী ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। মার্দানা ম্যাডাম বলল, “তার রেকর্ড করা কথা শুনতে চান? আপনার সাথে কী কথা বলেছে সেটা শুনবেন?”

সরফরাজ কাফী মাথা নাড়ল, সে শুনতে চায় না।

মার্দানা ম্যাডাম হিংস্র মুখে বলল, “একটু শুনেন।”

তারপর ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা স্মার্টফোন বের করে সেটা চালিয়ে দিল। শোনা গেল শান্ত বলছে, “…আব্বুর, কাছ থেকে যত টাকা পাবেন সেটা ফিফটি ফিফটি ভাগ হবে। অর্ধেক আপনার অর্ধেক আমার।…”

মার্দানা বেগম স্মার্টফোনটা চালাতে থাকে, এক সময় শোনা গেল সরফরাজ কাফী বলছে, “…ঠিক আছে। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।”

তারপর শান্তর উত্তেজিত গলা, “হাই ফাইভ!”

মার্দানা বেগম তখন ফোনটা বন্ধ করে দিল, হুংকার দিয়ে বলল, “শুনেছেন?”

সরফরাজ কাফী মাথা নিচু করল। রিসেপশন কাউন্টারের মেয়েটি অবাক হয়ে একবার ঝুমু খালা আরেকবার সরফরাজ কাফীর দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “আমি বাইরে যাই”

ঝুমু খালা হুংকার দিয়ে বলল, “না, বাইরে যাবে না, তোমাকে এখানে থেকে সব শুনতে হবে। তোমার বস কী রকম মানুষ তোমাকে জানতে হবে।” তারপর সরফরাজ কাফীর দিকে তাকিয়ে মার্দানা ম্যাডামের গলায় বলল, “স্যারের ছেলে চ্যাংড়া মানুষ উল্টাপাল্টা কাজ করতেই পারে। তাই বলে আপনি তার সাথে তাল দিয়ে ক্রিমিনাল কাজ করবেন?”

সরফরাজ কাফী মিনমিন করে বলল, “ভুল করে হয়ে গেছে–”

মাদানা ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, “না! ভুল হয় নাই। যখন আমি টের পেয়েছি আপনি আমার স্যারের ছেলের সাথে ক্রিমিনাল কাজ করার প্ল্যান করেছেন তখন আপনার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। কী জেনেছি জানেন?”

সরফরাজ কাফী মাথা নাড়ল, “না।”

“আমি জেনেছি আপনি পুরা ক্রিমিন্যাল। এই অফিসটা আপনার না। এইটা শাহরিয়ার চৌধুরী নামের একজন চ্যাংড়া ডিটেকটিভের, আপনি তারে ধোকা দিয়ে এইটা দখল করে নিয়েছেন। পুরা প্রতারণা। পুরা বেআইনি। পুরা সন্ত্রাসী।”

সরফরাজ কাফী মাথা নাড়ল, মিনমিন করে বলল, “না, আমি দখল করি নাই। উনি আমাকে লিখে দিয়েছেন।”

ঝুমু খালা টেবিলে থাবা দিল, হুংকার দিয়ে বলল, “না। আমি জানি। আপনি চিটিংবাজি করে লিখিয়ে নিয়েছেন। আমি খবর নিয়েছি।”

সরফরাজ কাফী মাথা নিচু করে বসে রইল।

মার্দানা বেগম বলল, “এখন আপনি আমার স্যারের সাথে মাস্তানি করতে নেমেছেন? আপনার কপালে দুঃখ আছে। এখন আপনার বাঁচার একটি মাত্র উপায়।”

সরফরাজ কাফী বলল, “কী উপায়?”

“সব দোষ স্বীকার করে মুচলেখা দিবেন যে আর জীবনে এই রকম কাজ করবেন না।”

সরফরাজ কাফী মিনমিন করে বলল, “ঠিক আছে।”

“মুচলেখায় লিখবেন ছোট বাচ্চাদের ক্রাইম করতে শিখাবেন না।”

“ঠিক আছে।”

“লিখবেন সত্তাবে জীবন কাটাবেন।”

“লিখব।”

“আর ওই চ্যাংড়া ডিটেকটিভকে তার অফিসটা ফেরত দিবেন।”

সরফরাজ কাফী একটা অনেক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।”

ঝুমু খালা তখন তার ব্যাগ খুলে কাগজপত্র বের করতে শুরু করল।

***

দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা।

ফারিহার গাড়িতে ছোটাচ্চুকে ওঠানো হয়েছে। তবে আজকে ছোটাচ্চু বসেছে পেছনের সিটে। তার চোখ একটা গামছা দিয়ে শক্ত করে বাধা, যেন সে কোনোভাবেই দেখতে না পারে। তার এক পাশে টুনি অন্য পাশে শান্ত, তারা শক্ত করে ছোটাচ্চুর হাত ধরে রেখেছে। যেন ছোটাচ্চু হাত দিয়ে তার চোখের বাধন খুলে ফেলতে না পারে।

গাড়ির সামনের সিটে ফারিহাপুর পাশে বসেছে ঝুমু খালা। ঝুমু খালা অনেক আপত্তি করেছে কিন্তু কেউ শুনে নাই। সবাই মিলে তাকে আবার মাদানা ম্যাডামের মতো সাজিয়ে দিয়েছে, তার কপালে টিপ আর ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক।

ফারিহাপু যখন গাড়ি স্টার্ট করেছে তখন ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করেছে। “তোমরা সবাই মিলে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”

টুনি বলল, “তুমি একটু পরেই দেখবে ছোটাচ্চু।”

“ক্রিমিনালদের মতো চোখ বেঁধে কেন নিয়ে যেতে হবে?”

শান্ত বলল, “মনে নাই তোমাকে আমরা সারপ্রাইজ দিব? এটা হচ্ছে সেই সারপ্রাইজ।”

“আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা আমার জন্মদিনে। আজকে মোটেও আমার জন্মদিন না।”

শান্ত বলল, “তোমার জন্মদিন কবে আমরা জানি না তাই আজকেই হবে সেই সারপ্রাইজ।”

ছোটাচ্চু বলল, “চোখ বেঁধে যদি নিয়ে যাস তাহলে সারপ্রাইজ হবে কেন? সারপ্রাইজ দিতে চাইলে না জানিয়ে করতে হয়।”

টুনি বলল, “আমাদের সারপ্রাইজ এ রকমই। তোমার পছন্দ না হলে আমাদের কিছু করার নাই।”

গাড়ি চালাতে চালাতে ফারিহা বলল, “এত অধৈর্য না হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর শাহরিয়ার!”

“যদি না করি?”

“তাহলে মনে হয় চোখের সাথে সাথে মুখটাও বেঁধে ফেলতে হবে!”

সবাই হি হি করে হাসল। মনে হয় ছোটাচ্চু তার মুখ বেঁধে ফেলার ভয়ে আপাতত তার মুখ বন্ধ করল।

রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম বেশি ছিল না, তাই কিছুক্ষণের মাঝেই তারা দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে পৌঁছে গেল। গাড়ি থামতেই ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কোথায় এসেছি আমরা? কোথায়?”

টুনি বলল, “এক্ষুনি দেখাব ছোটাচ্চু। একটু ধৈর্য ধর।”

টুনি আর শান্ত দুই পাশ থেকে ছোটাচ্চুকে ধরে নামাল, তারপর তাকে ধরে ধরে রাস্তার পাশে ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসের সামনে দাঁড় করাল। অফিসের সামনে বাসার অন্যান্য বাচ্চারা হাজির হয়েছে। শুধু বাচ্চারা না বড় মানুষেরা আছে। দাদি (কিংবা নানি) পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু বাসার বড়রা না, শওকত সাহেব পর্যন্ত চলে এসেছেন, শওকত সাহেবের অফিসের একজন একটা অনেক দামি ক্যামেরা (যার প্রায় দুই হাত লম্বা লেন্স) নিয়ে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলে যাচ্ছে। রাস্তায় আশেপাশের মানুষেরাও মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেছে।

শাহানা বলল, “দাদি তুমি ছোটাচ্চুর চোখটা খুলে দাও?”

দাদি বললেন, “আমি কেন? তোরা যারা ঘটনাটা ঘটিয়েছিস তারা খুলে দে!”

টুনি বলল, “তাহলে শান্ত ভাইয়া আর ঝুমু খালা।”

ঝুমু খালা লজ্জা পেয়ে বলল, “না, না, আমি না–অন্য কেউ!”

ফারিহাপু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। সবাই মিলেই খোলা হবে। বাচ্চারা চলে এসো! ঝুমু তুমি চলে যেয়ো না, থাকো এখানে।”

গামছার গিঁটটা খুবই কঠিনভাবে দেওয়া হয়েছিল তাই খুলতে মোটামুটি সময় লাগল। যখন খোলা হলো এবং টান দিয়ে গামছাটা সরানো হলো তখন ছোটাচ্চু চোখ পিট পিট করে তাকালো। কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু কিছুই বুঝতে পারছে না, সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে? এখানে কেন?”

মুনিয়া তার রিনরিনে গলায় বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সি হচ্ছে তোমার সারপ্রাইজ গিফট!”

ছোটাচ্চু আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু–কিন্তু–কিন্তু–” তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “আ-আমার ডিটেকটিভ এজেন্সি… আমার?”

সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি!”

ছোটাচ্চু কেমন যেন বোকার মতো হাসার চেষ্টা করল। তারপর বলল, “কেমন করে?”

টুনি বলল, “সেইটা বিশাল কাহিনি। আমরা সবাই মিলে করেছি। প্রথমে আমরা বাচ্চারা আর ঝুমু খালা। তারপর ফারিহাপু, তারপর শওকত আংকেল। তারপর পুলিশ-”

“কী আশ্চর্য! আর আমি কিছু জানি না।”

দাদি বললেন, “রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে, সবাই ভেতরে ঢুকিস কেন?”

তখন সবাই ভেতরে ঢুকল। ভেতরে একটা টেবিলের উপরে বিশাল বড় একটা কেক। পেছনে বড় একটা ব্যানার সেখানে লেখা :

আমার চাচ্ছ তোমার চাচ্চু
ছোটাচ্চু! ছোটাচ্চু!!

পাশে ছোটাচ্চুর একটা কার্টুন, এক হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস, অন্য হাতে একটা দড়িতে সরফরাজ কাফীকে ঝুলিয়ে রেখেছে! খুব উঁচু দরের শিল্পকর্ম বলা যাবে না। কিন্তু অর্থবহ তাতে সন্দেহ নেই।

প্রমি বলল, “তোমার কেমন লাগছে বলবে ছোটাচ্ছ?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমার খুবই অবাক লাগছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“আর কী?”

“আর–আর–” বলে ছোটাচ্চু কেমন যেন কান্না কান্না হয়ে গেল। হাত দিয়ে চোখ মুছে নিচে তাকিয়ে রইল। একটু পরে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “পরেরবার যদি চোখ বাঁধিস একটু ঢিলে করে বাঁধবি।”

সবাই হি হি করে হাসল। শওকত সাহেব বললেন, “আর যেন পরেরবার না হয়!”

ফারিহাপু মুখ টিপে হাসল, গলা নামিয়ে শওকত সাহেবকে বলল, “আপনি শাহরিয়ারকে চিনেন না, এ রকম অনেকবার হবে!”

শওকত সাহেব শাহরিয়ারের পিঠে থাবা দিয়ে বললেন, “ইয়াং ম্যান! পরেরবার যখন কোনো কাগজ সাইন করবে আমাকে একবার দেখিয়ে নেবে! পৃথিবীতে সরফরাজ কাফীর অভাব নাই!”

ফারিহাপু বলল, “কিন্তু তাতে সমস্যা নাই আমাদের বাচ্চারাও আছে! তার সাথে ঝুমু!”

বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “আছি আছি আমরা আছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *