দি অনারেবল রমেশচন্দ্র মিত্র ও তাঁর পরিবারবর্গ
২৪ পরগণার দমদমের নিকটবর্তী রাজারহাট বিষ্ণুপুরে বনেদী সম্ভ্রান্ত মিত্র পরিবারে দি অনারেবল রামচন্দ্র মিত্রের জন্ম হয়। তাঁর প্রপিতামহ কালী-প্রসাদ মিত্র নদীয়ার কালেকটরের অধীনে সম্মানিত পদে চাকরি করতেন; ব্যক্তিগত বহু গুণের জন্যও তাঁকে জনগণ শ্রদ্ধা করতেন।
কালীপ্রসাদের পুত্র রামধন মিত্র হলেন পিতার সমগ্র সমগ্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, পিতার কাছে তিনি উত্তম শিক্ষা লাভ করে বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরে মুন্সেফের চাকরি করতেন; তেজস্বী, ন্যায়পরায়ণ ও বুদ্ধিমান রামধনের প্রতি সরকার ও বাদীবিবাদী সকল পক্ষই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর পুত্র রামচাঁদ মিত্রও উত্তম শিক্ষা লাভ করেছিলেন; তিনি ছিলেন সদর দেওয়ানী আদালত (বর্তমানে হাইকোর্ট, আপীল বিভাগ)-এর সেরেস্তাদার বা জুডিশিয়াল হেডক্লার্ক।
রামচন্দ্রের ছয় পুত্র : প্রসন্নচন্দ্র (অল্প বয়সে মারা বান), উমেশচন্দ্ৰ, কেশব চন্দ্ৰ, কাশীচন্দ্র, প্রবোধচন্দ্র এবং অনারেবল রমেশচন্দ্র মিত্র।
উমেশচন্দ্র ইংরেজিতে সুপন্ডিত, তিনি জমিদারী সংক্রান্ত বিষয় খুব ভাল বোঝেন; বর্তমানে তিনি বর্ধমান জেলার চকদীঘির জমিদার সারদাপ্রসন্ন রায়ের জমিদারী এস্টেটের ম্যানেজার।
শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান কেশবচন্দ্র নিজের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করেন। সচ্ছল মানুষ কেশবচন্দ্র অন্য কোন কাজ করেন না। মৃদঙ্গ বাদনে তিনি দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন।
কাশীচন্দ্র ছোট আদালতের সম্মানিত অ্যাটর্নী।
পরলোকগত প্রবোধচন্দ্র ছিলেণ হাইকোর্টের নাম করা অ্যাটর্নী।
অতি বাল্যকাল থেকেই রমেশচন্দ্রের লেখাপড়ার দিকে অসাধারণ ঝোঁক। একে সাধারণ ছেলেমেয়ের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান, তার ওপর অভিভাবক ও গৃহশিক্ষকগণের উৎসাহদান, ফলে, অল্পকালের মধ্যেই শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর প্রচুর অগ্রগতি হল। মাত্র পনের বছর বয়সেই তিনি শ্রেষ্ঠ ইংরেজ লেখকদের গ্রন্থসমূহ কারও সহায়তা না নিয়েই পড়তে ও বুঝতে পারতেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি তাঁর অনুসন্ধিৎসা এবং সহজ বোধ শক্তির জন্য সেখানকার সুপন্ডিত অধ্যাপকদের প্রদত্ত শিক্ষা দ্রুত আয়ত্ত করে নিতেন। সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ব্যাচেলার অব আর্টস ডিগ্রী লাভ করেন। বংশের ঐতিহ্য অনুযায়ী আইনের দিকে ঝোঁক থাকায়, তিন বছরের অধিককাল প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়ে তিনি আইনের স্নাতক হন।
এর কিছুকাল পরে তিনি সদর দেওয়ানী আদালতে আইন ব্যবসায় আরম্ভ করেন, পরিশ্রম সততা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য তিনি অল্পকালের মধ্যে মক্কেলদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। সদর দেওয়ানী আদালতে বছর দেড় এবং হাইকোর্টে প্রায় বারো বছর ওকালিত করার পর বার-এর শ্রেষ্ঠ ব্যবহারজীবীদের অন্যতমরূপে তিনি পরিগণিত হতে থাকেন। এই সময় (১৮৭১এ) অনারেবল অনুকূলচন্দ্র মুখার্জি পরলোক গমন করায় সরকার ঐ শূন্যপদে রমেশচন্দ্রকে নিয়োগ করতে চান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের এবং বহু শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে রমেশচন্দ্র উচ্চ স্থানের অধিকারী। কেবলমাত্র কঠোর ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা বা স্বাধীনচিত্ততার জন্য তিনি বিশিষ্টতা অর্জন করেন নি, আইনে গভীর জ্ঞানের জন্যও তিনিও বিশিষ্ট। তাঁর ভদ্র, নম্র, অমায়িক আচরণ এবং পরহিতৈষণার জন্য তিনি সর্বজনের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন। বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠানকে তিনি নিয়মিত চাঁদা দেন, স্বগ্রাম বিষ্ণুপুরের উন্নতির জন্য, বিশেষত এর দাতব্য চিকিৎসালয়টির উন্নতিসাধনে তিনি অর্থদান ছাড়াও, সর্বপ্রকারে চেষ্টা করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং কলকাতা ও ২৪ পরগণার বহু শিক্ষাবিষয়ক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সদস্য।