দি অনারেবল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই
হরকুমারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যতীন্দ্রমোহনের জন্ম কলকাতায়, ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর আট বছর বয়সে তাঁকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করা হয়; এখানে তিনি ন’বছর শিক্ষালাভ করেন; মেধাবী যতীন্দ্রমোহনের ছাত্রজীবন ছিল উজ্জ্বল। এরপর ক্যাপটেন ডি এল রিচার্ডসন, রেভারেন্ড জন ন্যাশ প্রভৃতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং কয়েকজন (এঁদের তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণির) শিক্ষাবিদের গৃহশিক্ষকতায় ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞানে তাঁর শিক্ষা পরিচালিত হয়। পিতার আদর্শ ও উৎসাহ তাঁকে সংস্কৃত শিক্ষার প্রেরণা দেয় এই ভাষাতেও তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন। অপরদিকে কাব্যের প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক থাকায় তিনি ইংরেজি ও বাংলায় অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করতেন; এগুলি ‘লিটারারী গেজেট’ ও ‘প্রভাকরে’ সাদরে প্রকাশিত হত। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় নাট্যকলার পুনরুজ্জীবনের জন্য তাঁর উদ্যম ও প্রচেষ্টার মূল্য অসীম। তাঁর পদমর্যাদা ও সম্পদের জোরে কিছু পুরাতন নাটকে অভিনয় করানো তাঁর পক্ষে আদৌ কঠিন ছিল না; এজন্য বিশেষ প্রশংসার কোন কারণ থাকত না; কিন্তু সেটুকুতেই তিনি ক্ষান্ত থাকেন নি; নিজেই তিনি কয়েকখানি উচ্চশ্রেণির নাটক লেখেন; এগুলির মধ্যে তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য; কারণ প্রচলিত অশ্লীলতা সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে নৈতিকতা ও সুরুচি বজায় রেখে তিনি নাটকীয় ঘটনা গড়ে তোলেন। বাল্যকাল থেকেই সাহিত্য রচনার দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল; এই সময় তিনি বেশ কয়েকটি নাটক বা গীতিনাট্য হয় রচনা করেন নয়তো সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করেন। কিন্তু এগুলি তিনি প্রকাশ করেন অপরের নামে। সে যুগে বেলগাছিয়া ভিলায় জনপ্রিয় নাটকগুলির অভিনয় তাঁরই অনুপ্রেরণায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানকালে নাট্যানুষ্ঠানে যেরূপ ঐকতান বাদন হয়ে থাকে, তিনিই তার স্রষ্টা; হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের রাগ-রাগিণীকে তিনি এজন্য কাজে লাগিয়েছিলেন। যৌবনে যতীন্দ্রমোহনের ধারণা ছিল ছন্দ, শব্দের ঝঙ্কার ও লালিত্যের দিক থেকে বাংলা ভাষা এত দুর্বল যে, এতে অমিত্রাক্ষর ছন্দে উচ্চস্তরের কবিতা বা কাব্য রচনা করা সম্ভব নয়। তাঁর এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য রচনা করলেন; এটি পড়ে মহারাজার ভুল ভাঙল। তিনি কাব্যখানা প্রকাশনার সমগ্র ব্যয় বহন করতে রাজি হলেন। সাহিত্য কীর্তিকে তাঁর সাহায্যদান এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না; বহু সাহিত্যিকের বহু গ্রন্থ সময়মত তাঁর সহায়তা না পেলে কখনও প্রকাশিত হতে পারত না। শহর কলকাতা ও তার আশপাশের যে-সকল জ্ঞানী গুণী মানী ব্যক্তি তাঁর বৈঠকখানায় পরিচালিত বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানসমূহ দেখবার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা একবাক্যে ঐ সকল অনুষ্ঠানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এইভাবে তাঁর প্রচেষ্টাতে ভারতের প্রাচীন নাট্যসাহিত্যের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা পুনরায় জাগ্রত হয়। লর্ড নর্থব্রুক দুবার এই নাট্যানুষ্ঠান দেখেছিলেন, ভারতের প্রাক্তন আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট (উপমন্ত্রী) মিঃ গ্র্যান্ট ডাফ, কয়েকজন ছোট লাট বাহাদুর, কয়েকজন জেনারেল, অন্যান্য উচ্চপদাধিকারী এবং যেসব সম্ভ্রান্ত বিদেশী কৃতবিদ্য ব্যক্তি এই সকল অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা সকলেই ভারতীয় প্রাচীন নাট্যকলার অতি উচ্চ প্রশংসা করেন। এক সময় তিনি ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সঙ্গীতের যথেষ্ট চর্চা করতেন; গান বাজনায় কিছু পারদর্শিতাও লাভ করেছিলেন। তিনিই প্রথম ইংল্যান্ড থেকে মিউজিক্যাল বস্ ও অরগ্যান আনিয়ে দেশীয় গানের সুর বসিয়েছিলেন।
বাইরের কর্মজীবনে তাঁকে দীক্ষা দেন তাঁর কাকা অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর, সি এস আই। তাঁর সমাজে যে মর্যাদা, ধনসম্পদ, স্বাভাবিক ও অর্জিত গুণরাশি আছে, স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায় যে বাইরের কর্মজীবনে তিনি উপযুক্ত স্থান সহজেই অধিকার করবেন। পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের পরলোকগমনে তাঁর সামনে একটা সুযোগ এসে যায়। তাঁকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের অবৈতনিক সম্পাদক নির্বাচন করা হয়– এই প্রতিষ্ঠানের তিনি এখন সভাপতি সরকার থেকেও সম্মান এল। স্যার উইলিয়াম গ্রে তাঁকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নিয়োগ করেন।
স্যার উইলিয়াম গ্রে-র ধারণা ছিল, তাঁর মতো মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ যথেষ্ট নয়, তাই তিনি তাঁকে এমন সম্মান দানের জন্য সুপারিশ করেন যা, এদেশীয় সমাজে তাঁর স্থানের উপযুক্ত হয়।
‘বাবু যতীন্দ্রমোহন অতি উচ্চ শিক্ষিত, তিনি উত্তম ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছেন। দেশীয় সমাজে তিনি নেতাস্বরূপ, তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র অসাধারণ; তাঁর দেশবাসিগণ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তিনি লেফটেন্যান্ট গভর্নরের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সক্রিয় সদস্য; দেশের মঙ্গলের জন্য তিনি সুচিন্তিতভাবে অংশগ্রহণ করেন। মেদিনীপুর, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ, ‘রাজশায়ে’, ‘নদ্দীয়া’ এবং ২৪ পরগণায় তাঁর জমিদারি আছে। এছাড়া তিনি জীবদ্দশায় পরলোকগত রায় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের রংপুর প্রভৃতি স্থানের জমিদারীসমূহের উপস্বত্বেরও অধিকারি। কলকাতা এবং তাঁর জমিদারির এলাকা সমূহে রাস্তা স্কুল প্রভৃতি জনহিতৈষণামূলক কাজে দান করতে তিনি সব সময়ই আগ্রহী; স্বদেশবাসীগণের মধ্যে সাহিত্য ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রসারের জন্য তিনি অকাতরে দান করে আসছেন। কলকাতায় তিনি আঠারো জন ছাত্রের ভরণপোষণ করে চলেছেন। তা ছাড়া সম্ভ্রান্ত জমিদার হিসাবে তিনি ১৮৬৬র দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন; ঐ সময় তিনি প্রজাদের খাজনা মাফ করেন। তিন মাস তিনি ২৫০ জন নিরন্ন মানুষকে প্রত্যহ অন্নদান করেছেন।’
তদানীন্তন ভাইসরয় অ্যান্ড গভর্নর জেনারেল আর্ল অব মেয়ো ১৮৭১-এর ১৭ মার্চ একখানি সনদ দ্বারা ‘ব্যক্তিগত’ সম্মান হিসাবে ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাবে তাঁকে ভূষিত করেন। ঐ সম্মান অর্পণ করবার সময় লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্বেল তাঁর অভিভাষণে বলেন :
‘মহামান্যা মহারাণীর প্রতিনিধিরূপে মাননীয় ভাইসরয় আপনাকে যে খেতাব দান করেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি আপনাকে অর্পণ করায় সৌভাগ্য হওয়ায় আমি বিশেষ আনন্দবোধ করছি।
কলকাতার ইতিহাসে মহান স্থানের অধিকারী, এমন কি ব্রিটিশশাসিত ভারতেও মহান স্থানের অধিকারী একটি পরিবারে আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন। পরিবারটি রাজভক্তি এবং জনহিতৈষণার জন্য সুপরিচিত।
শুধুমাত্র আপনার বংশগৌরব স্মরণ করেই মাননীয় ভাইসরয় আপনাকে এই সম্মানে ভূষিত করেন নি; আপনার ব্যক্তিগত যোগ্যতার জন্যও আপনাকে এই সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। আপনার বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, উল্লেখযোগ্য জনহিতৈষণা, মহান চরিত্র এবং রাজ্যের প্রতি আপনি যে সেবা প্রসারিত করেছেন তার জন্য এই সম্মান অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবেই আপনার প্রাপ্য।
বেঙ্গল কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে আপনি আমাকে যেরূপ সাহায্য করেছেন, তাতে আমি আনন্দিত এবং উক্ত পরিষদে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা কালে আপনি যে জ্ঞান ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তার দ্বারা আমি প্রভূত উপকৃত হয়েছি। আপনার মতো ব্যক্তির পরামর্শ আমার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অনেক সময় আপনার সঙ্গে আমার মতের পার্থক্য হয়েছে একথা সত্য; কিন্তু মানুষে মানুষে মতের ভিন্নতা তো স্বাভাবিক : আজ অকপটে জানাচ্ছি যে, আপনার সহমত আমার পক্ষে সব সময় মূল্যবান ছিল। আর ঘটনাক্রমে আপনি যখন আমার বিরোধিতা করেছেন, আপনার বিরোধিতা সব সময়ই বুদ্ধিদীপ্ত, সরকারের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত এবং শিষ্টতাপূর্ণ ছিল।
একমাত্র স্যার উইলিয়াম গ্রে-ই যে তাঁর গুণ, চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তা নয়; পরিষদে তাঁর প্রথমবারের ‘কাল’ শেষ হলে, স্যার জর্জ ক্যামবেল তাঁকে দ্বিতীয়বার সদস্যপদ গ্রহণের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। তাঁর পত্র :
বেলভেডিয়ার, আলিপুর
৫ অক্টোবর, ১৮৭১
প্রিয় রাজা,
পরিষদে আর একটি টার্মে’র জন্য আপনাকে সদস্য মনোনীত করার সম্মতি চাইছি। আপনার চরিত্রবত্তা এবং নিরপেক্ষভাবে সকল প্রশ্ন পর্যালোচনা করার ক্ষমতার জন্য আপনার সাহায্যকে মূল্যবান মনে করি; শ্রেণিস্বার্থে আপনার চিন্তা আবদ্ধ নয়, বরং আপনার দেশের উচ্চনীচ সকলের প্রতি আপনার সমদৃষ্টি আছে, এই আমার বিশ্বাস।
ইতি ভবদীয়,
স্বাঃ জি ক্যামবেল
রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ইত্যাদি।
তাঁর নির্মলচরিত্রবত্তা, পরিশীলিত দক্ষতা এবং সশ্রদ্ধ সরকার-প্রীতির জন্য অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কারণে ছোটলাট বাহাদুরগণ, এমন কি বড় লাট বাহাদুরগণ পর্যন্ত এই মানুষটির ওপর বিশেষ আস্থা রাখতেন, জনগণের মঙ্গল সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজে তাঁর পরামর্শ চাইতেন। ১৮৭৩-৭৪-এর বিহার দুর্ভিক্ষের সময় মাননীয় লর্ড নর্থব্রুক শুধু যে তাঁর পরামর্শ চেয়েছিলেন তাই নয়, বরং তাঁকে এ-কথাও বলেছিলেন, ‘হয় ইংল্যান্ড গিয়ে হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির কাজে ভারতীয় বিষয়াবলীর ওপর সাক্ষ্য দিতে, বা এই কাজের জন্য এমন একজন ভারতীয় বিষয়াবলীর ওপর সাক্ষ্য দিতে, বা এই কাজের জন্য এমন একজন ভারতীয় ভদ্রলোকের নাম সরকারকে জানাতে, যাঁর ভারতীয় বিষয়াবলীর ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে এবং যিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।’ এতখানি আস্থা আর কোন ভারতীয় ভদ্রলোকের ওপর এর আগে কোন শাসক স্থাপন করেন নি। লর্ড নর্থব্রুক তাঁকে যে কি পরিমাণ শ্রদ্ধা করতেন, মহারাজ রমানাথ ঠাকুরকে লিখিত ১৮৭৭ এর ১৬ মার্চ তারিখের তাঁর পত্রে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পত্রখানির সংশ্লিষ্ট অংশ এখানে আমরা উদ্ধৃত করছি : ‘রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে জেনে খুশি হলাম। সব সময়ই আশা করতাম যে, তিনি পরিষদের সদস্য হবেন। আমার কথা দয়া করে তাঁকে জানাবেন।’
উত্তরাধিকার সূত্রে রাজা যতীন্দ্রমোহন বিশাল জমিদারীর মালিক ছিলেন, তার ওপর তাঁর কাকা অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর সি এস আই উইল দ্বারা তাঁর জমিদারীও আজীবন ভোগ করবার অধিকার দেওয়ায়, তিনি দেশের প্রথম শ্রেণীর জমিদারদের অন্যতম হতে পেরেছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁর অগণিত প্রজাসাধারণের মঙ্গলের প্রতি তাঁর সদয় ও বিবেচনাপূর্ণ দৃষ্টি ছিল। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার দিনে তাঁর দান ও সাহায্য হত অবারিত।
১৮৬৬র আকালের সময়, প্রজাদের দুর্দশা নিবারণের জন্য তিনি সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন; আর মেদিনীপুরের রায়তদের দুর্দশা চরমে ওঠায়, অন্যান্য ত্রাণ ব্যবস্থার সঙ্গে ৪০,০০০ টাকা খাজনাও তিনি মাফ করে দেন। জনহিতৈষণার এই মহান কাজের জন্য জেলা কর্তৃপক্ষের মারফত সরকার থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানানো হয়। তাঁর উদারতা ও দানশীলতার এটিই একমাত্র দৃষ্টান্ত নয় : নেটিভ হাসপাতালটি চাঁদনীচক থেকে পাথুরিয়াঘাটার স্ট্র্যান্ড রোডে স্থানান্তরের প্রস্তাব করা হলে, হাসপাতালের বর্তমান বাড়িগুলি যে বিস্তৃত মূল্যবান জমির উপর অবস্থিত, তার সবটাই তিনি নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে সরকারকে দান করেছিলেন। ১৮৭৬ এর ৩ ফেব্রুয়ারি মেয়ো নেটিভ হাসপাতালটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে উক্ত অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলার প্রধান বিচারপতি স্যার রিচার্ড কৌচ্ বলেন, ‘এই স্থানে হাসপাতাল স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব হয়েছে শোনামাত্র রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এই জমির ওপর তাঁর সকল স্বত্বস্বামিত্ব অসুস্থ স্বপ্নেশবাসীর চিকিৎসার জন্য নিঃস্বার্থভাবে দান করে দিয়েছেন।’
দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও জনগণের মঙ্গলের জন্য স্থাপিত নিধিতে দান করতে বা চাঁদা দিতে মহারাজা কখনও দ্বিধা করেন না। তাছাড়া তাঁর বিপুল প্রভাব, প্রতিপত্তিকেও তিনি জনহিতৈষণার কাজে লাগান। তরুণদের শিক্ষায় উৎসাহ দেবার উদ্দেশ্যে তিনি সরকারের পরিচালনায় ১২,০০০ টাকা গচ্ছিত রেখেছেন। এর সুদ থেকে তাঁর পিতার নামে মাসিক ২০ টাকা হারে একটি বৃত্তি সংস্কৃতের শ্রেষ্ঠ ছাত্রকে দেবার এবং আরেকটি সমপরিমাণ মাসিক বৃত্তি তাঁর কাকার নামে আইনের সর্বাপেক্ষা সফল ছাত্রকে দেবার ব্যবস্থা হয়।
সংস্কৃত শিক্ষারও তিনি উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক। একটি নিধি স্থাপন করে তিনি মেধাবী দরিদ্র টোল ছাত্রকে মাসিক ৮ টাকা হারে ‘প্রসন্নকুমার ঠাকুর বৃত্তি’ এবং বাংলায় টোলসমূহের মধ্যে থেকে সর্বাপেক্ষা মেধাবী দুজন ছাত্রকে ‘হরকুমার ঠাকুর’ কেয়ুর দেবার ব্যবস্থা করেন।
তিনি ‘মহারাজা’ খেতাব পান দিল্লীতে ১৮৭৭-এর ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘সামাজিক সমাবেশে’ এবং ১৮৭৭ এর ১৪ আগস্ট কলকাতার বেলভেডিয়ারে অনুষ্ঠিত দরবারে সনদ দান উপলক্ষে ছোট লাটবাহাদুর নিম্নোক্ত ভাষণ দান করেন :
‘এমন একটি বংশের প্রতিনিধিরূপে আপনি এসেছেন, যে বংশে বহু সদ্গুণভূষিত জনহিতৈষী ও দেশের হিতে উৎসর্গিত-প্রাণ প্রথম শ্রেণির মানুষের উদ্ভব হয়েছে, এই জন্য ‘মহারাজা’ খেতাবের সনদটি আপনাকে উপহার দেবার সময় আমি বিশেষ আনন্দ বোধ করছি; সরকার এই পরিবারটিকে সব সময় বিশ্বাস করেছেন এবং প্রয়োজনে এর পরামর্শ নিয়েছেন। জনগণের মঙ্গলের জন্য আপনি সব সময়ই সুচিন্তিত উদার মনোভাব অবলম্বন করেছেন; লেফটেনান্ট গভর্নর ও গভর্নর জেনারেলের পরিষদের সদস্যরূপেও আপনি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করেছেন।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই দরবারে মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণকেও মহারাজা খেতাবের সনদ ও খেলাৎ দেওয়া হয়, কিন্তু প্রথম স্থানটি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, সি এস আই-এর জন্য।
সেই বছরই মহারাজাকে গভর্নর জেনারেলের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত করা হয়। যে উৎসাহ ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি এই পদের কর্তব্যসমূহ সম্পাদন করেন, তার জন্য তাঁকে ১৮৭৯ তে দ্বিতীয়বারের জন্য সদস্য মনোনীত করা হয়। এ সম্মান আজ পর্যন্ত কোন বাঙালী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বা ভদ্রলোককে দেখান হয়নি। সুপ্রীম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে তিনি যেরূপ মূল্যবান কাজ করেছিলেন, সে সম্পর্কে ওই পরিষদের সর্বাপেক্ষা যোগ্যতাসম্পন্ন আইন সদস্য স্যার আর্থার হর্ হাউস সিভিল প্রোসিডিওর বিলের ওপর বিতর্কের সময় যে মন্তব্য করেন, সেইটি উদ্ধৃত করলেই বোধ হয় যথেষ্ট হবে। তিনি বলেন :
এ বিষয়ে যা কিছু বলা যেতে পারে, সে সবই আমার বন্ধু, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর অবশ্যই বলবেন : কারণ কমিটির অধিবেশনে তিনি বিশেষ দক্ষতা ও যুক্তিসহ বিলের বিরোধীদের মত প্রকাশ করেছেন। বন্ধুত্ব ও বিনয়ের সঙ্গেই স্বীকার করছি যে, ৪র্থ সংখ্যক বিলে ধারাটি যেভাবে আছে, অপরিবর্তিতরূপে তেমনি থাকলে, আমি মাননীয় মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের যুক্তিসমূহের বিরুদ্ধে নিজ মত সমর্থন করতে পারব। ৪র্থ সংখ্যক বিলের ওপর ভোট দেবার সময় কমিটিতে তাঁর যুক্তি মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গেই ভোট দিয়েছি– এই হল আমার বক্তব্যের বাস্তব প্রমাণ।’
ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট পাস করার সময় মহারাজা কি ভূমিকা নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণার উদ্ভব হয়েছে। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রসমূহকে নিন্দা করা দূরে থাক, সংবাদপত্রের ওপর যে-কোন প্রকার বাধা নিষেধের তিনি সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। দেশীয় ভাষায় নিচুস্তরের কিছু সংবাদপত্রের দায়িত্বজ্ঞানহীন ঘৃণ্য প্রচারের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বলেন, ‘এদের প্রচারগুলি শূন্যগর্ভ বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়।’ তাঁর এই সমালোচনাকে স্যার একিন পেরী বলেন, ‘অত্যন্ত সঠিক সমালোচনা’ (দ্রষ্টব্য : Copy of Opinions and Reasons entered in the Minutes of Proceedings of the Council of India relating to the Vernacular Press Act, 1882, presented to both Houses of Parliament, p. 3). সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার দমনের জন্য পেনাল কোডই পর্যাপ্ত এই ছিল ব্যাপকভাবে জনগণের অভিমত। কিন্তু সরকারের আগ্রহাতিশয্যের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের জন্য এবং আফগান সংকটের কথা বিবেচনা করে, তিনি (মহারাজা যতীন্দ্রমোহন) স্থির করেন যে, রাজভক্ত প্রজারূপে বিরোধিতা করা উচিত নয়। এই অবকাশে তাঁর উক্তরূপ আচরণের এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাইট অনারেবল মিঃ ডবল্যু ই গ্ল্যাডস্টোন। তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলের একমাত্র নেটিভ সদস্য ইচ্ছাকৃতভাবে এবং চেষ্টা সহকারেই কোনরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। কাউন্সিলের একমাত্র নেটিভ সদস্যের এই হল অভিমত; তিনি বিলটি সমর্থন করেছেন, কিন্তু বিলের বিষয়বস্তুকে সমর্থন করেন নি। (দ্রষ্টব্য : Hansard’s Parliamentary Debates, Vol. 242, Pt. I. P 57).
১৮৭৯তে তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই বছর মহামান্যা ভারতসম্রাজ্ঞীর আদেশে তাঁকে মোস্ট এগজলটেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া পদবী দেওয়া হয়– এই উপলক্ষে লর্ড লিটন তাঁকে পত্র ও টেলিগ্রাম দ্বারা অভিনন্দন জানান।
ওই সময় বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স দূর্গাপূজার ছুটি ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪ দিন করার জন্য সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিল; মহারাজা যতীন্দ্রমোহন হস্তক্ষেপ না করলে দেশবাসী বারো দিন ছুটি উপভোগের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হত; বোম্বাই থেকে প্রকাশিত থিওজফিস্ট পত্রিকা তাঁদের ১৮৮০র আগস্ট সংখ্যায় লিখলেন :
মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য। ইনিই অন্যতম ভারতীয় অভিজাত ব্যক্তি যাঁকে ইউরোপীয় সমাজ সর্বাপেক্ষা বেশি সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকে। তাঁর কাকার মতো তাঁকেও মহামান্যা মহারাণী ‘কম-প্যানিয়নশিপ অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া’ পদবী দ্বারা সম্মানিত করেছেন; আর দূর্গাপূজার ছুটি রক্ষার জন্য দেশবাস এঁর নিকট ঋণী।
লর্ড লিটনকে এ বিষয়ে ভুল বোঝান হয়েছিল; মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের ব্যক্তিগত প্রভাবে লর্ড লিটন প্রকৃত তথ্য জেনে ছুটি সংরক্ষণ না করলে, বাংলার অধিবাসীরা যে কি হতাশ হত, তা বলার নয়। এ ছুটি শুধুমাত্র বাঙালীরা ভোগ করেন না। সর্বধর্ম ও জাতির মানুষ বাৎসরিক এই দীর্ঘ ছুটিতে রেল ও নদীপথে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য বাইরে যান। এই ছুটির অবসরে সরকারি বা বেসরকারি অফিসে কর্মরত বাঙালী আত্মীয়স্বজনের কাছে বছরান্তে যেতে পারেন, ব্যক্তিগত বৈষয়িক কাজের তদারক করতে পারেন, সর্বোপরি তাঁদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু উৎসব আনন্দ করা যায়, তা তাঁরা এই অবকাশেই করে নেন। হিন্দুরা যতদিন এই ছুটি উপভোগ করতে পারবেন, ততদিন অন্তত তাঁরা মহারাজা যতীন্দ্রমোহনকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবেন।
লর্ড লিটন তাঁর প্রতি বিশেষ বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্যপদ মহারাজার প্রতি যেমন সম্মানজনক, তেমনই, রাজভক্ত একজন অভিজাতের সেবাও সরকারের পক্ষে মূল্যবান; কারণ মহারাজার মতামত ছিল স্বাধীন, কিন্তু কখনই সরকারের কাজের পক্ষে বাধাস্বরূপ হত না; বিবেকের দ্বারাই তিনি পরিচালিত হতেন, কিন্তু তাঁর মতামত পূর্বাপর কখনও সামঞ্জস্যহীন হত না। দুজনের মধ্যে বরাবর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সম্পর্ক ছিল। লর্ড লিটন বিশ্বাস করতেন, তিনি যেমন মহারাজার বিবেচনাপূর্ণ আপসপন্থী মনোভাব দ্বারা উপকৃত হয়েছেন, ভবিষ্যৎ ভাইসরয়গণও তাঁর এই সেবা ও মনোভাব দ্বারা সমভাবে উপকৃত হবেন। পরবর্তীকালে এখান থেকে অবসর গ্রহণের পর, লর্ড লিটন তাঁকে যত চিঠি লিখতেন, সবগুলিতেই তাঁকে ‘ইয়োর হাইনেস’ সম্বোধন থাকত।
রাজা মহারাজা খেতাব দ্বারা সম্মানিত অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিগণ তাঁদের মোট পাঁচ জন, বেশি হলে দু’জন, সশস্ত্র প্রহরী রাখার অধিকারী; একমাত্র মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, সি এস আই সরকারের বিশেষ আদেশ বলে, দেশীয় রাজন্যবর্গের মতো অনেক বেশি সংখ্যক সশস্ত্র প্রহরী রাখবার অধিকারী।
অপরপক্ষে মহারাজা অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু; পূজা পাঠে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন। মর্যাদাসম্পন্ন হয়েও তিনি অমায়িক, চালচলন সাদা-সিধা লোক দেখানো কোন ভাব নেই, যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে আসেন সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, ভালবাসেন। তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র নির্মল, নিষ্কলঙ্ক; ইংরেজ সমাজ, ইংরেজি শিক্ষা দেশের অভিজাত হিন্দুদের মধ্যে বিলাস-ব্যসনের যে প্রলোভন সৃষ্টি করেছে, তিনি অপরিমেয় অর্থ ও পদমর্যাদা সত্ত্বেও সে সব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাঁর মহৎ চরিত্রের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তাঁরা বৃদ্ধা মা-র প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি আর ভাইয়ের প্রতি অসাধারণ স্নেহ ও প্রীতি।
তাঁর কোন পুত্রসন্তান নেই; তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রগণই তাঁর বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হবেন; আমরা আশা করব যে, তাঁরা তাঁর সম্পত্তির মতো তাঁর গুণাবলীরও উত্তরাধিকারী হবেন।
তিনি মেয়ো হাসপাতালের গভর্নর, ভারতীয় যাদুঘরের অছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। কলকাতা শহরের জাস্টিস অব দি পীস, ইত্যাদি ইত্যাদি।
জ্যেষ্ঠ যতীন্দ্রমোহন ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে থাকলে, তাঁর অনুজ শৌরীন্দ্রমোহন বিশেষ প্রতিভার জোরে সারা জগৎকেই তাঁর খ্যাতির মঞ্চে পরিণত করেছেন।