দিল হ্যায় কে মানতা নেহি

দিল হ্যায় কে মানতা নেহি

‘হুই মেহেঙ্গি বহুত হি শরাব কে, থোড়ি থোড়ি পিয়া করো’

দিনদুপুরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝকঝকে বারে হালকা চালে বাজছিল পঙ্কজ উদাসের পাগল করে দেওয়া গান।কিন্তু সে—সবের থোড়াই কেয়ার করেন কলকাতা পুলিশের তিন কর্মী! চেপে বসা নেশার দাপটে বর্হিজগত নিয়ে তাঁদের কোনও হেলদোল নেই তখন। আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা, ঘুরে চলে ঘড়ির কাঁটা। অবশেষে পেরিয়ে যায় জেলে পৌঁছনোর নির্ধারিত সময়। যত মদ তত পথ’ এই সহজ তত্ত্ব মেনে দামি সুরা আকণ্ঠ গিলে ডিউটির কথা বেমালুম ভুলে গেলেন তিন সাদা উর্দিধারী। ধীর পায়ে কাউন্টারে গিয়ে, বিদেশি মদের চড়া দাম মিটিয়ে, ওয়েটারদের হাতে মোটা টাকার টিপস গুঁজে দিল একটি চরিত্র। গৌরী সেনের ভূমিকায় সেখানে হাজির হওয়া, রণবিজয় সিং রাঠোর। কাম তামাম করে পিছনের দরজা দিয়ে কলকাতার কোলাহলে জাল কেটে চুপিসাড়ে বেরিয়ে গেল, হ্যান্ডকাফে দুটো হাত আটকে থাকা এক বেপরোয়া যুবক। ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে বাইরে তখন ফাঁকায় দাঁড়িয়ে কলকাতা পুলিশের প্রিজন ভ্যান।

তার পর? পরদিন সব কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হল পুলিশকে বুদ্ধ বানিয়ে গা ঢাকা দেওয়া এক যুবকের বিস্তারিত বর্ণনা। বিভাগীয় তদন্তে সাসপেণ্ড হতে হল তিন সাদা উর্দির কর্মীকে। এক সাংবাদিক তাঁর লেখা খবরে এর সঙ্গে তুলনা টানলেন ২০০০ সালে ব্যাঙ্ককে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার।

ছোট্ট করে এখানে বলে দেওয়া যাক সেই ঘটনাটা: দাউদের লোকেদের হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ওখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আমাদের দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন ছোটা রাজন। ২৪x৭ পুলিশ প্রহরায় রাখা হয়েছিল তাঁকে। এসবের মধ্যে মাস্টারস্ট্রোক। রাজনের শাগরেদ ফরিদ তানাশা এক সপ্তাহ ভেক ধরে পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে জমিয়ে খানাপিনার আসর বসাতে শুরু করেন সেখানে। তারপর, এক রাতে পানীয়তে ওষুধ মিশিয়ে বেঁহুশ করে দেন পাহারাদারদের। তাতেই খেলা শেষ। ধাঁ হয়ে যান রাজন।

বছর চারেক আগে বালি থেকে সেই রাজন ধরা পড়লেও ২০০২ সালে কলকাতা থেকে বেমালুম হাওয়া হয়ে যাওয়া যুবকের ১৭ বছর ধরে কোনও খোঁজ নেই। শুধু পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড লেখা শব্দটা ছাড়া, ফিকে হয়ে গিয়েছে রণবিজয়ের নাম। কোনও লাইন, কোনও কোড, আজও ট্রাক করতে পারেনি তাকে। হয়তো, পথের হদিশ পথই জানে। মনের কথা মত্ত।

ওই ঘটনার পর বাজারে অবশ্য রণবিজয়কে নিয়ে রটনার খামতি নেই। কখনও গুজরাত, আবার কখনও বা অস্ট্রেলিয়া এই যুবকের স্থায়ী ঠিকানা বলে নানা মহল থেকে দাবি করা হয়েছে বারবার। বেশ কয়েকবার পুলিশ কর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন রণবিজয় আদৌ সে—সব জায়গায় নেই। কয়েকদিন বৃথা ছোটাছুটির পর সেই তদন্তের ফাইলে লাল দড়ির বাঁধন পড়েছে নতুন করে। দীর্ঘদিন না খোলার ফলে ফাইলটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে মোটা ধুলোর আস্তরণে। পুলিশের ক্রাইম রেকর্ড বলছে, রণবিজয়ের অপরাধ মূলত দু’টি। এক, সঞ্জীব জুলকা নামে এক যুবককে সুপারি দিয়ে খুন করানো। দুই, ধরা পড়ার পর জেলে নিয়ে যাওয়ার পথে তিন পুলিশ কর্মীকে মাতাল বানিয়ে নিজে চম্পট দেওয়া। ছেলে গা ঢাকা দেওয়ার পর পরই বেকবাগান এলাকার পেট্রোল পাম্পের মালিক রণবিজয়ের পরিবার বালিগঞ্জ রোডের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ফ্ল্যাট কিনে চলে যায়।

কিন্তু কীভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল এই যুবক? পাঠকদের আগে সেই ঘটনাটা জানা প্রয়োজন।

সঞ্জীব জুলকা হত্যা রহস্য। ২০০১ সালের ২২ মে। তিলজলা থানা।

প্রবল গ্রীষ্মের একটা সন্ধ্যা। অন্যান্য বছরের তুলনায় সে বারের গরমটা যেন একটু বেশিই ছিল। অন্তত আবহাওয়া দপ্তরের রিপোর্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিল তাই। তালতলা থানা এলাকার মারকুইস স্ট্রিটের একফালি আগে রাস্তার ধারে একটি লালচে রঙের মারুতি গাড়ি উদ্ধার করল পুলিশ। তবে উদ্ধার ঠিক নয়, গাড়িটা সকাল থেকেই বেওয়ারিশ অবস্থায় ছিল ওখানে। জায়গাটা দিনভর এতটাই ব্যস্ততা থাকে যে প্রথম দিকে কারও নজরে আসেনি বিষয়টা। পরে কয়েকজন হকারের সন্দেহ হওয়ায় তাঁরা পুলিশকে খবর দেন। গোড়ায় এলাকাটা কোন থানার মধ্যে পড়ে, তা নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তি তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তালতলা থানার অফিসারেরা এসে গাড়িটির লক ভেঙে তল্লাশি শুরু করেন। আর সেই সময় তাঁদের নজরে আসে ভিতরে পানের পিকের মতো লাল কিছু একটা দরজার সামনে লেগে রয়েছে। প্রথমে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না তাঁরা। অবশ্য না—দেওয়ারই কথা। এমন কত গাড়ি স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মীরা বাজেয়াপ্ত করে আনেন রোজ, পরে মালিক এসে কাগজ দেখিয়ে, কানটান মুলে সেই গাড়ি আবার ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তা হল না। বরং, দরজার পাশে দেখা গেল একটা ‘এল’ টাইপের দাগ। যেন রঙের খানিকটা ছড়ে গিয়েছে। সামান্য সন্দেহ দূর করতে ওই লাল রঙ ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল ল্যাবে। প্রাথমিক রিপোর্ট এল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। তা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল, ওটা গুটখা বা পানের পিক নয়, আসলে রক্তের ছাপ। জল দিয়ে সেই দাগ তুলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টাও করা হয়েছে। এতেই টনক নড়ল পুলিশের কর্তাদের। মামলা দায়ের করে তড়িঘড়ি শুরু হল তদন্ত। আর তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে নিল। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।

একেবারে গোড়ায় গাড়িতে ফের ভাল করে তল্লাশি চালাতে গিয়ে গোয়েন্দারা দেখতে পেলেন, একটি ভেজা টি—শার্ট এবং জিনসের প্যান্ট গুঁজে রাখা হয়েছে ডিকির ভিতরের দিকে এক কোণায়। গাড়ির মধ্যে এইচ’ আকারে আরও একটি চটা ওঠা দাগ, আগে যা নজরে আসেনি কারও। ৪৮ ঘণ্টা পর পরিবহণ দপ্তর থেকে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ জানতে পারল, ওই গাড়ির মালিক আসলে রণবিজয় সিং রাঠোর নামে বালিগঞ্জের এক যুবক। অদ্ভুত বিষয়, যে দিন গাড়িটি উদ্ধার করা হয়, ঠিক সে দিন বেশি রাতে রণবিজয়ের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোেগ থানায় জমা দিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির লোকেরা। যদিও গাড়ি নিয়ে কিছুই জানাননি তাঁরা। ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে হাতড়াতে গিয়ে পুলিশকে নির্ভর করতে হল নিজস্ব ‘খোচর’ নেটওয়ার্কের উপর। তাঁরাও দিলেন এক আজব তথ্য। এবং তা যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতো।

লালবাজারের সোর্স মাটি খুঁড়ে তুলে আনল গোপন খবর। যে দিন গাড়িটি তালতলা এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, ঠিক তার আগের রাতে ইএম বাইপাসের ধারে এক যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওই যুবককে খুন করে তাঁর জামা—প্যান্ট সব খুলে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল রাস্তায়। প্রমাণ লোপাট করতে মৃতদেহ শুইয়ে উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয় গাড়ি। দুটি ঘটনার মধ্যে নাকি যোগসূত্রও রয়েছে!

বাইপাসের একটা বড় অংশের দেখভালের দায়িত্ব তখন পরমা পুলিশ ফাঁড়ির উপর ছিল। এমন কোনও ঘটনা পরমা ফাঁড়ি এলাকায় তাহলে সত্যি কি ঘটেছিল? জানতে কলকাতা পুলিশের কর্তারা যোগাযোগ করলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা পুলিশের সঙ্গে। আসলে, তখন পরমা ফাঁড়ি কাজ করত তিলজলা থানার অংশ হিসেবে। আবার সেই থানা ছিল জেলা পুলিশের আওতায়। খোঁজ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জানা গেল, হ্যাঁ, গাড়ি চাপা পড়া একটি বেওয়ারিশ লাশ এক দিন আগেই বেশি রাতে উদ্ধার করা হয়েছে মাতঙ্গিনী কলোনীর ঠিক সামনের রাস্তা থেকে। প্রাথমিকভাবে খুনের ঘটনা মনে হওয়ায় লাশটিকে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তখনও মৃতদেহের কোনও দাবি করেননি কেউ।

এ বার শুরু হল তদন্তের দ্বিতীয় পর্যায়। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা বিস্তারিত তথ্য যাচাই করতে গিয়ে জানতে পারলেন, এরকম একটা ঘটনা ঘটলেও, বিষয়টা নিতান্তই হালকা ভাবে নেওয়া হয়েছিল। তাই ওই মৃত্যুর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে কী উঠে এসেছে, তা জানার আগ্রহটুকু দেখাননি ওই থানার পুলিশ কর্মীরা। শুরুতেই গোয়েন্দা বিভাগের জন্য এটা ছিল একটা বড়সড় ঠোক্কর।তবুও প্রাথমিক ধাক্কা সামলে মামলার বিষয়ে ফের নতুন করে তৎপরতা শুরু হল পুলিশ মহলে। মেডিকেল কলেজের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা তাঁদের মতামত জানালেন, খুব কাছ থেকে মাথায় এবং বুকে গুলি করে খুন করা হয়েছে এই যুবককে। যার আসল পরিচয়, সঞ্জীব জুলকা ওরফে বান্টি। বাড়ি, পিকনিক গার্ডেন।

কেন খুন হতে হল বছর তিরিশের সঞ্জীবকে, কে—ই বা খুন করল?

আশেপাশের সব কটি থানা এলাকার সোর্সকে হঠাৎ সক্রিয় করে তুলল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। তারাই খুঁজে আনল ঘোড়ার মুখের খবর। যা এরকম: লারেলাপ্পা—জীবনপ্রিয় মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ সঞ্জীব জুলকা ওরফে বান্টি বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে পিকনিক গার্ডেনের বাসিন্দা কলেজ ছাত্রী তৃষা রায়ের। তাঁরা কাছাকাছি থাকেন। এ দিকে, সঞ্জীবের দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল পয়সাওয়ালা বাবার ছেলে রণবিজয়। শহরের বিভিন্ন অভিজাত পার্টিতে যাওয়ার সুবাদে বন্ধু বান্টির গার্লফ্রেন্ড তৃষার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় রণবিজয়ের। সুদর্শন, আধুনিক পোশাকে সর্বদা রঙিন, দু’হাতে টাকা ওড়ানোর ক্যারিশমা দেখে রণবিজয়ের প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যায় তৃষা। দ্রুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। দু’জনের মনে বেজে ওঠে ‘দিল হ্যায় কে মানতা নেহি’র থিম সং, ‘তু প্যায়ার হ্যায় কিসি অউর কা/ তুঝে চাহতা কোই অউর হ্যায়।’ অল্পদিনের মধ্যে তৃষা প্রথম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু নারাজ ছিল বান্টি। বিকল্প উপায় খুঁজে না পেয়ে পথের কাঁটা বন্ধুকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ফাঁদে রণবিজয়। তাতে সম্মতি পায় বান্ধবীরও। নীলনকশা অনুযায়ী, ২২ তারিখ রাতে ট্যাংরার চায়না টাউনের একটি রেস্তোরাঁয় গভীর রাত পর্যন্ত বসে খানাপিনার আসর। সেখানে আগে থেকে হাজির হয়ে যায় দক্ষিণ কলকাতার ডন তথা শার্প শুটার গব্বর, সঙ্গী ফ্যাটম্যান, রণবিজয়, তৃষা এবং তাদের আরও এক বান্ধবী শবনম। কলকাতা শহরের উত্তর—দক্ষিণের বিভিন্ন পার্টিতে তখন রোজকার খদ্দের গব্বর। এরকম একটা পার্টিতে রণবিজয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। সেটা কাজে লাগায় ব্যবসায়ী পুত্র। বান্টিকে খালাস করে দিতে পারলে দু’লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় গব্বরকে। ফলে সুপারি নিয়ে নেয় সে।

রাত তখন আটটা। বন্ধুদের সঙ্গে বাড়িতে আড্ডা দিতে ব্যস্ত বান্টি। আচমকা বেজে ওঠে তার মোবাইল। ও পারে রণবিজয়, “আরে, কোথায় তুই। চলে আয় চায়না টাউনে, আমরা একসঙ্গে ডিনার করি। এখানে তৃষাও রয়েছে।

জেলবন্দি গব্বর
জেলবন্দি গব্বর

‘ছোড় ইয়ার, সঙ্গে অন্য বন্ধুরা রয়েছে। আমরা সবে ঠাণ্ডা বিয়ার নিয়ে বসেছি। আজ নয়, অন্যদিন যাব’, ক্যাজুয়ালি উত্তর দেয় বান্টি। রণবিজয় ছাড়ার পাত্র নয়। পাল্টা প্রস্তাব গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, ‘ওদের নিয়েই চলে আয়। সবাই মিলে খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাবে। এবার রাজি হয়ে গেল বান্টি। চার বন্ধু চেপে বসল একটা হলুদ ট্যাক্সিতে। বাড়িতে বাবাকে জানিয়ে এল, ‘এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে ডিনারে যাচ্ছি, সুতরাং রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়ার প্রশ্ন নেই।’

পিকনিক গার্ডেন থেকে চায়না টাউন বেশি দূরত্ব নয়। হু হু করে ট্যাক্সি রওনা দিল। রাতের বাইপাস তখন নানা রঙে রঙিন। আর চায়না টাউনের কথা তো আলাদা! যেন দেশের বাইরে অন্য একটা জগত। রাত বাড়লে মস্তি বাড়ে এই মহল্লায়।

মাত্র ২০ মিনিট। রেস্তোরাঁয় পৌছে গেল বান্টিরা। ঢুকতেই নজরে এল গব্বর, ফ্যাটম্যান এবং তৃষাও বসে রয়েছে। সামান্য স্ন্যাক্স মুখে দিতে দিতে শুরু হল দু’পক্ষের প্রাথমিক কথাবার্তা। প্রথম দিকে খানিকটা লেগ পুলিং। এ বার সেই প্রসঙ্গ, সম্পর্কটার কী হবে? জানতে চায় রণবিজয়। এক কথা দু’কথার পর উত্তেজিত হয়ে ওঠে বান্টি। এই জন্য আমাকে ডেকেছিস এখানে? বেশ চেঁচিয়েই বলে সবার সামনে। তর্কাতর্কি শুরু হওয়ার মুখেই অবশ্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিল গব্বর। পকেট থেকে নিজের .৪৫ বোরের পিস্তলটা বার করে টেবিলের উপর রাখল ঠকাস করে একটা আওয়াজ তুলে। সামান্য মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘এনজয়। খানাপিনা কোথায়?’

সামনে সাজিয়ে দেওয়া হল থরে থরে খাবারের থালা। মূল বিষয়টা তখন চাপা পড়ে গিয়েছে নানা কথার ভিড়ে। আধঘণ্টার মধ্যে এসে গেল রঙিন পানীয়ও। সমস্বরে টেবিলে আওয়াজ উঠল, ‘উল্লাস, চুক চুক পিও। যুগ যুগ জিও।’

ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে ততক্ষণে সাড়ে এগারোটা ছুঁয়ে ফেলেছে। অথচ চায়না টাউনের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে স্রেফ সন্ধ্যা সাতটা যেন। সার সার দিয়ে বিভিন্ন দেমাকী গাড়ি ভিড় জমাচ্ছে তখনও। সবাই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। অন্যদের দিকে তাকানোর ফুরসত পর্যন্ত কারও নেই। জগঝম্প গানে কান পাতাও দায়।

খাওয়া—দাওয়া শেষ করে মোটা অঙ্কের বিল ডেবিট কার্ডে পুরোটা একা মিটিয়ে দিল রণবিজয়। বেরিয়ে আসার খানিকক্ষণ আগে বান্টিকে নিজেই প্রস্তাবটা দিল, “আমার গাড়িতে চল। তোকে বাড়ি নামিয়ে দেব। গান শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে। বান্টিও রাজি হয়ে গেল সহজে। সবাই প্রায় চেনা। সঙ্গে আসা পাড়ার বন্ধুদের বলে দিল, তারা যেন নিজেদের মতো করে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে যায়। সকালে ফের কথা হবে। সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে যায় বন্ধুরা।

রাত তখন বারোটা। বাইরে দাঁড় করানো লালচে মারুতিতে গিয়ে প্রায় গাদাগাদি করে বসতে হল ছ’জনকে। সামনে চালক রণবিজয়ের পাশে ফ্যাটম্যান। পিছনে দুটি জানলার ধারে তৃষা এবং শবনম। মাঝে গব্বর আর বান্টি। নিচুস্বরে একটা গান চালিয়ে দিয়ে বাইপাস ধরে এগিয়ে চলল গাড়ি। খানিকটা যেতেই গব্বর সরাসরি প্রশ্ন করে বসে, ‘আজ তাহলে দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাক। তুই শালা তৃষাকে ছাড়বি কিনা সেটা বল?’

আচমকা এই প্রসঙ্গ ওঠায় বিরক্ত হল বান্টি। গব্বরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের প্রবলেম কেন? ওটা আমি বুঝে নেব।’

‘দূর……দ। আজ এখানেই ফয়সালা হবে।’ গব্বরের গলার জোর তখন যেন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।

পাল্টা জবাব দেয় বান্টিও, “কী করবি তুই। বড় মাতব্বর নাকি?’

কথা কাটাকাটি চলতে চলতেই সামনের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে বান্টির পা চেপে ধরে ফ্যাটম্যান। পাশে বসে নিজের পিস্তলটা বার করে সরাসরি মাথায় গুলি চালিয়ে দেয় গব্বর। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে করা একটা গুলিতেই নিথর হয়ে যায় বান্টি। রক্তাক্ত মৃতদেহ থেকে খুলে নেওয়া হয় জামা কাপড়। গাড়িটা নিয়ে বেশ খানিকটা উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরির পর নজরে আসে মাতঙ্গিনী কলোনির আশেপাশে পুলিশের কোনও নজরদারি ভ্যান নেই, ফলে সেখানে বডিটা ফেলে দেওয়া যেতে পারে। কাজ শেষ করে প্রায় ভোর রাতে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয় তৃষা আর শবনমকে। ফেরার পথে রাস্তার ধারে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে জল দিয়ে তোলার চেষ্টা হয় রক্তের দাগ। তারপর বান্টির টি—শার্ট দিয়ে মোছা হয় খানিকটা। দিনের আলো ফর্সা হতে হতে রণবিজয়ের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে চম্পট দেয় গব্বর আর ফ্যাটম্যান। পালিয়ে যায় রণবিজয়ও। তার আগে পুলিশকে খানিকটা বিভ্রান্ত করতে গাড়ি সাফসুতরো করে রেখে দেওয়া হয় তালতলা এলাকায়।

২৩ তারিখ সকাল। বেলা বাড়লেও ছেলে বাড়ি না ফেরায় বাবা নরেন্দ্র ছুটে যান বান্টির বন্ধুদের কাছে। জানতে পারেন, চায়না টাউনে আড্ডার কথা। তাছাড়া, সেখানে উপস্থিত থাকা শবনমও বলতে গেলে বান্টিদের প্রায় প্রতিবেশী। ফলে আগের রাতে রেস্তোরাঁয় থাকা বান্টির বন্ধুরা সহজে পৌছে যায় ওই বাড়িতে। একটু চাপ দিতেই সে কবুল করে বিস্তারিত ঘটনা। পুরো বিষয়টি বান্টির পরিবারের তরফে লিখিত ভাবে জানানো হয় তিলজলা থানাতেও। ঘটনাচক্রে, সে দিনই আবার সন্ধ্যার আগে তালতলা থেকে উদ্ধার করা হয় পরিত্যক্ত গাড়িও। কিন্তু পুলিশের সেই প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা সংক্রমিত রোগ। সমন্বয়ের অভাব। ফলে কোনও তথ্যই আদানপ্রদান হয়নি নিজেদের মধ্যে। তাহলে হয়ত কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত।

পিও অর্থাৎ প্লেস অফ অকারেন্স কলকাতা পুলিশের এলাকায় না হলেও চাপ বেড়ে যায় লালবাজারের। শহরে এরকম চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনায় সক্রিয় হয়ে ওঠে সংবাদ মাধ্যমও। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে দুটি থানার পুলিশ একযোগে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু দেখা যায় অভিযুক্ত চারজনের আর খোঁজ নেই।

এলাকার সোর্সদের নতুন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন গোয়েন্দারা। সেই অস্ত্র কাজ করা শুরু করে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ঘটনার তিনদিনের মাথায় তিলজলার একটি গোপন ডেরা থেকে প্রথম গ্রেপ্তার হয় শবনম। আবার তাকে জেরা করে পাকড়াও করা হয় ফ্যাটম্যানকে।

কিন্তু আসল দু’জন কোথায়? গোয়েন্দাদের সেই সোর্স খোঁজ নিয়ে এল, ‘স্যর, পাক্কা খবর, গব্বর পালিয়ে গিয়েছে রাজস্থানের আজমেঢ়ে।’

লুকিয়ে গিয়েছে রণবিজয়। হদিশ নেই তৃষারও। তাহলে? হাল না ছেড়ে তদন্তকারীরা বাকি অভিযুক্তদের সম্ভাব্য ঠিকানাগুলিতে তল্লাশি জারি রাখলেন। এক সপ্তাহের মাথায় আচমকাই একদিন শোরগোল। দুপুরবেলা কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজের আইনজীবী অমিতাভ কাহালীকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার পুলিশ সুপার সিদ্ধিনাথ গুপ্তার দপ্তরে হাজির হয়ে গেল তৃষা রায়। পুলিশ সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পাঠিয়ে দিল আদালতে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হল তাঁর বিরুদ্ধে। এরপর বেশ কিছুদিন দিল্লি—বম্বে ছোটাছুটির পর এক সময় বাড়ি থেকে টাকা নিতে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল রণবিজয়ও।

সব কিছু হলেও আসল কাজের কাজটাই হচ্ছিল না। বারবার পাতা ফাঁদ কেটে পালিয়ে যাচ্ছিল গব্বর। প্রায় ৬ মাস ধরে খাটাখাটনির পর সাফল্য অবশেষে ধরা দিল পুলিশকে। কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট থানার দুই অফিসার খবর পেলেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে দেখতে মাস খানেক আগে কলকাতায় ফিরে এসেছে গব্বর। দক্ষিণ কলকাতার মারকুইস স্ট্রিটে বাড়ি। অথচ নাম ভাঁড়িয়ে থাকছে অন্য জায়গায়। একবার পুলিশের নজরে পড়লে যা হয়, এক্ষেত্রেও তাই হল। উত্তর কলকাতার এক সোর্সের ফোন এল ডিসি(সেন্ট্রাল) জুলফিকার হাসানের কাছে, ‘স্যর, গব্বর ফুলবাগানের একটি ক্লাবে থাকছে। নামও পাল্টে নিয়েছে। দেখতে পারেন। ওই ফোনটা কাজে দিল। হেয়ার স্ট্রিটের দুই সাব—ইনস্পেক্টরকে মাথায় রেখে একটি বিশেষ দল তৈরি করে দিলেন ডিসি জুলফিকার।

১০ ডিসেম্বর, ২০০১।

রাতের অন্ধকারে বিশেষ প্রশিক্ষিত দলটা ঘিরে ফেলল পুরো ক্লাব। তবে শুরুতে একটু সমস্যা দেখা দিল। খবরটা জানতে পেরে ক্লাবের কর্তারা ব্যাকআপ টিমকে বারবার এসে জানাতে থাকলেন, ‘স্যর। সম্ভবত আপনারা ভুল করছেন। ছেলেটা মুখে রা কাড়ে না। যা করতে বলি করে দেয়। দেখে ক্রিমিনাল মনে হয় না। আরও একবার ভালো করে চেক করুন। এমনও হতে পারে হয়ত গব্বরের সঙ্গে ওর মুখের মিল রয়েছে। তাছাড়া ওর নাম আলি। বিহারে বাড়ি। এখানে কাজের খোঁজে এসেছে। প্রাথমিক ভাবে একটু থমকে গেলেও বিশেষ সেই দলের সদস্যরা ঠিক করে নিলেন, খবর পাক্কা। কাজেই যাই হোক না কেন, গব্বরকে আজ জ্যান্ত ধরতে হবে, ঠুকে দিলে চলবে না। এদিকে, গব্বরের কোমরে যে আর্মস গোঁজা নেই, তা কীভাবে জানবেন তদন্তকারীরা? অভিযানের সময় প্রায় হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে একজন পৌছে গেলেন ক্লাবঘরের দরজার সামনে। অবাক হয়ে গেলেন তিনি, গব্বরকে ভিতরে দেখা যাচ্ছে না। একটু উঁকি দিতেই নজরে এল, ক্লাবের ক্যারাম বোর্ডটাকে ঢালের মতো ব্যবহার করে দেওয়াল ঘেঁষে ঘাপটি মেরে রয়েছে মোস্ট ওয়ান্টেড। পরনে একটা হলুদ গেঞ্জি, কালো বারমুডা। ইঙ্গিত পেতেই পাঁচজন ঝাঁপিয়ে পড়লেন গব্বরের উপর। হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হল বাইরে। প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পর ‘দ্য এন্ড’ হল দু’পক্ষের স্নায়ুযুদ্ধের। শেষ পর্যন্ত মাঝরাতে নিরস্ত্র গব্বর অভিনব অফার দিল গোয়েন্দাদের, ‘আমাকে পালিয়ে যেতে দিন, আপনাদের লাইফ তৈরি করে দেব। কত টাকা চাই, একবার বলুন। হো—হো করে হাসলেন এক অফিসার। মুখে বললেন, ‘থানায় চল, ওখানে বসে হিসেবটা কষে নেব।’ তখন দু’টো। মধ্যরাত।

এই ঘটনার পর বছর খানেক কাটতে না কাটতে আদালতে জমা পড়ে গেল সঞ্জীব জুলকা হত্যা মামলার চার্জশিট। ততদিনে জেল হেফাজতে চলে গিয়েছে সব অভিযুক্ত। মামলার তারিখ এলে তাদের আদালতে নিয়ে আসা হত। এরকমই একদিন আলিপুর জেল থেকে আদালতে হাজির করার পর প্রিজন ভ্যানে করে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল রণবিজয়কে। গাড়িতেই সে পুলিশকর্মীদের প্রস্তাব দেয়, বাইরে ভালো—মন্দ কিছু খেয়ে নেওয়া যেত না? কথায় বলে, স্বভাব যায় না ম’লে। ব্যতিক্রম হল না প্রবাদের। বড়লোকের ছেলের আবদারে, বলা যেতে পারে গোপন বোঝাপড়ায়, রাজি হয়ে গেলেন তিন পুলিশ কর্মী। সোজা পথে জেলে না গিয়ে, গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল দক্ষিণ কলকাতার একটি জমজমাট বারে। আগে থেকেই সেখানে সব কিছু ফিটিং করা ছিল। তারপর সাজানো চিত্রনাট্য অনুযায়ী শুধু অভিনয় করতে হল রণবিজয়কে। পালিয়ে গেল সে কলকাতা ছেড়ে। সেই থেকে আজও কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ফাইলে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’—এর তকমা বহন করে চলেছে বর্তমানে মধ্য চল্লিশের ওই অভিযুক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *