দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো
প্রাচ্য ইতিহাসে অনেক স্থলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, রাজা নিজকে প্রজাগণের ধৰ্ম্মনেতা বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। ইহার কারণ মানুষের স্বাভাবিক আত্মগৌরব হইতে পারে, অথবা গভীর রাজনৈতিক ফন্দি। রাজা যদি অন্তর এবং বহির্জগৎ এই উভয় ক্ষেত্রেই কৰ্ত্তা হইতে পারেন, তবে দেশে তাঁহার অপেক্ষা উচ্চতর কোন শক্তি থাকিতে পারে না; জগতে তাঁহার ক্ষমতা অপ্রতিহত, দ্বন্দ্বহীন, একক। নয় লক্ষ অশ্বারোহীর প্রভু, দিল্লীর বাদশাহও এই ভাবিয়া সুখ পাইতেন যে, তিনি কোটি-কোটি মানবের স্বেচ্ছা-ভক্তি এবং আন্তরিক প্রেম লাভ করিয়াছেন– তিনি অন্য মানবের মতো নহেন, দেবতার অবতার অথবা দৈবশক্তিসম্পন্ন।
প্রাচীন হইতে প্রাচীনতর সেই আদিযুগের মিশরের ইতিহাসেও দেখিতে পাই যে, রাজা নিজকে সূর্য্যদেব “রা”-র পুত্র বলিয়া প্রচার করিতেন এবং যাহাতে এই সূর্য্যতেজ তাঁহার সন্তুতিগণের মধ্যে ষোল আনা থাকিতে পারে, এজন্য নিজ সহোদরা ভগিনীকে বিবাহ করিতেন। ইহাই কৌলিন্য প্রথার ন্যায়সঙ্গত চরম ফল। রাজ দুহিতা ভিন্ন অপর রাণীর সন্তানগুলি শুধু আট আনা পরিমাণে সূর্য্যের সন্ততি, তাহাদের সিংহাসনে অধিকার কম। এইজন্য মিশরের প্রাচীন শিলালিপিতে পাটরাণীর গৌরবান্বিত উপাধি ছিল “রাজার ভগিনী, রাজার স্ত্রী”।
আবার রোমের প্রজাতন্ত্রের পতনের পর যখন ‘অগষ্টস্’ উপাধিধারী সেনাপতিগণের অধীনে সাম্রাজ্য স্থাপিত হইল, তখন ভূমধ্যসাগরের পূর্ব্বদিকে এশিয়ার প্রদেশগুলিতে সম্রাটের উপাসক সম্প্রদায় গঠিত হইল; তাহাদের নাম অগষ্টটেলস্ (Augustales); তাহারা মন্দিরে সম্রাটের মূর্ত্তি রাখিয়া পূজা করিত। ‘নরপতি’ ‘নরদেব’ হইলেন।
ইংলণ্ডেও এক সময় ছিল যখন রাজাকে ঠিক দেবতা না হইলেও দেব ভাবাপন্ন বলিয়া ভয় ভক্তি করা হইত; তাঁহাকে ঈশ্বরের পার্থিব প্রতিনিধি ও প্রজাশক্তির শাসন-সমালোচনের অতীত বলিয়া ঘোষণা করা হইত। এটি–ষ্টুয়ার্ট যুগ। যথা, সেক্সপিয়র :
Most sacrilegious murder hath broke one
The Lord’s anointed temple. ( Macbeth )
আর আমাদের দেশে? যেখানে তেত্রিশকোটি দেবদেবীর পূজা হইতেছে, সেখানে রাজাকে দেবতার তালিকাভুক্ত না করিলে শুধু যে ঘোর রাজদ্রোহ হয় তাহা নহে, সাধারণ ভদ্রতার অভাবও দেখান হয়। এমন একগুঁয়ে প্রজাতন্ত্র-তেজ হইতে আমাদের প্রপিতামহগণ মুক্ত ছিলেন। ভারতে, আগে একমাত্র ব্রাহ্মণেরা দেবতা ছিলেন; তাঁহারাই ভূবিদেবঃ ভূদেব, ভূবি সুরঃ ভূসুরঃ। এখনও নিমন্ত্রণে ব্রাহ্মণদিগকে ডাকা হয় “দেবতারা গা তুলুন!” কায়স্থ-সভা স্থাপিত হইবার পর “দেব দেবীর” সংখ্যা আরও বাড়িয়াছে; কিন্তু সেটা এই আমাদের কলিযুগে এবং ইঁহারা বর্ম্মপরিহিত। এমন দেশে কি রাজাকে দেবতা না বলিয়া থাকা যায়? তাই, কালিদাস রামচন্দ্রকে বলিতেছেন-
“অন্যত্র রক্ষোভবনোষিতায়াঃ
পরিগ্রহান্-মানবদেব! দেব্যাঃ।” (রঘু, ১৪)
মুসলমান-রাজ্যে দৈবভাব হওয়া অতি সহজ। ইসলামের বিধি অনুসারে দেশ-শাসক প্রকৃত বিশ্বাসীগণের সেনাপতি (আমির-উল-মুনীন) এবং সমবেত প্রার্থনা (জমাএৎ-নমাজ) এর নেতা অর্থাৎ ইমাম্। তিনিই একমাত্র খলিফা, এবং যদি তিনি নিজ পদের উপযুক্ত হন তবে প্রেরিত পুরুষের (মুহম্মদের) গুণ ও শক্তি তাঁহাতেও বৰ্ত্তিয়াছে, এবং তিনি একাধারে ইস্লামীয় সৈন্যের নায়ক ও ধর্মগ্রন্থের সর্ব্বোচ্চ ব্যাখ্যাকারক (মুতাহিদ)। তবে বিপদে পড়িয়া অনেক মুসলমান দেশ অনেক শতাব্দী ধরিয়া নিরক্ষর সেনাপতিকে সুলতান বলিয়া মানিয়া লইয়াছে, এইসব ক্ষেত্রে রাজা কাৰ্য্যত ইমাম বা মুতাহিদ হন নাই।
সুফী নামক ইসলামীয় দার্শনিক-সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যে, জগতে যুগে যুগে অমানুষিক ক্ষমতাসম্পন্ন বা দৈবভাষে প্রণোদিত (inspired) ধৰ্ম্মনেতা দেখা দেন। তাঁহাদিগকে ‘ইন্সান্-ই-কামিল্’, অর্থাৎ পূর্ণ মনুষ্য অথবা সংস্কৃত অভিধানের অর্থে ‘ভগবান’ বলা হয়। মুসলমান দর্শনেও হিন্দু দর্শনের মত প্রকৃতি পুরুষকে ঈশ্বরের দুই যুগ্ম স্বরূপ বলিয়া গণ্য করা হয়। অর্থাৎ স্রষ্টা (আল্হক) এবং সৃষ্টজীব (আল্ খাল্ক) পরস্পরকে সম্পূর্ণ করে, ইহারা একই জিনিসের দুই দিক মাত্র। একজন আরব বৈদান্তিক লিখিয়াছেন, “মানুষে ঈশ্বরের ও জগতের রূপ সমবেত হইয়াছে। ঈশ্বর মানব-রূপ দর্পণেই প্রকাশিত হন। আমরা নিজেই সেই গুণ যাহার দ্বারা আমরা ঈশ্বরকে বর্ণনা করি। আমাদের অস্তিত্ব শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্বের জড় বা প্রকটমান স্বরূপ।” সেই পূর্ণ মনুষ্যে বা পূর্ণ অবতারে পরমাত্মা প্রকটিত হন এবং তাহা হইতেই আবার নিজের মধ্যে ফিরিয়া আসেন। এই পূর্ণ মনুষ্য ক্রমাগত উচ্চ হইতে উচ্চতর জ্ঞানালোকে ভ্রমণ করিয়া অবশেষে ঈশ্বরে মিলিত হইয়া যান, তখন তিনি দেবতা হন।
এইরূপ পূর্ণ মনুষ্য বিশ্বের কেন্দ্র (কুতুর্), তাঁহার দ্বারাই জগৎ রক্ষা পায়, তিনি সৰ্ব্বশক্তিমান সৰ্ব্বজ্ঞ। সকলে তাঁহাকে উপাসনা করুক, কারণ তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। (কোরান, ২-২৮এ লেখা আছে যে জগতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা খলিফা আবির্ভূত হইবেন।) এই ইন্সান্ইকামিল্ একাধারে দেবতা ও জীব, অতএব তিনি ঈশ্বর ও সৃষ্ট জগতের মধ্যে সেতুস্বরূপ। আল্ জিলি নামক মুসলমান দার্শনিক বলেন যে, প্রতি যুগে সেই আদি ইন্সান্- ই-কামিল অথবা মুহম্মদ এক-একটি জীবিত পীরের আকার ধারণ করিয়া অবতীর্ণ হন এবং ভক্তদিগের নিকটে নিজকে প্রকাশ করেন (এনসাইক্লোপিডিয়া অব্ ইস্লাম, ২য় খণ্ড, ৫১০ পৃঃ)
আর, হিন্দুরা ত প্রত্যহই অবতারকে পূজা করিবার জন্য, স্বীকার করিবার জন্য প্রস্তুত আছে। তাহাদের বিশ্বাস যে এরূপ অবতার কোটি-কোটিবার অতীতে দেখা দিয়াছেন এবং ভবিষ্যতেও দেখা দিবেন –”হে ভরতবংশজ! যখনই ধর্ম্মের গ্লানি এবং অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হইবে, তখনই আমি নিজেকে (অবতাররূপে জগতে) সৃষ্টি করিব।” (গীতা)
সুতরাং দেখা যাইতেছে যে মুঘল যুগের ভারতে কি হিন্দু কি মুসলমান অবতারের প্রতীক্ষায় হৃদয় পাতিয়া ছিল। রাজার পক্ষে এ মহা সুযোগ।
তাহার উপর, মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপনের ঠিক পূর্ব্বেই, অর্থাৎ খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে, পাঠানযুগের শেষে খণ্ডরাজ্যের কাটাকাটি, অশান্তি, সভ্যতা ও ধনের বিনাশ এবং সুনীতি ও ধর্ম্মের বিপ্লবে দেশময় এক অবসাদ, হতাশা আসিয়া পড়িয়াছিল। আমাদের কোটি-কোটি নরনারী শুষ্ক হৃদয়ে দাঁড়াইয়া ছিল, প্রার্থনা করিতেছিল যে, যুগাবতার দেখা দিন, বরিষ ধরামাঝে শান্তির বারি! ঠিক এইসময়ে সুদূর পূর্ব্ব প্রদেশে চৈতন্যদেব তাঁহার ভক্তিধর্ম্মের স্রোতে বঙ্গ ও উড়িষ্যা প্লাবিত করিলেন, আর ভারতের অপর প্রান্তে পাঞ্জাবে নানক তাঁহার শিখ ধর্ম্ম প্রচার করিয়া ভক্তগণকে নবজীবন দিলেন। (এই দুই ধর্ম্মই অল্প দিনে ভারতে জগজ্জয়ী হইয়া উঠিল।) কিন্তু সে সময়ে আরও অসংখ্য নূতন ধৰ্ম্ম সম্প্রদায় নানা প্রদেশে খাড়া হইতে লাগিল; সৰ্ব্বত্রই লোকে যুগাবতারের আশায় পথ চাহিয়া আছে। সর্ব্বত্রই একত্র হইয়া গুরু খুঁজিয়া বেড়ায়; অনেক স্থলেই ভণ্ড পীর ও যুগাবতার (মাহ্দী) দেখা দিল। (পারসিক ইতিহাস হইতে ইহার বিস্তৃত বিবরণ ব্লকমানের অনূদিত আইন-ই-আকবরীর প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় দেওয়া হইয়াছে)।
ঠিক এই সুযোগে বাদশাহ আকবর নিজেকে ইন্সান্-ই-কামিল বা সাহিব-ই-জমান্ (অর্থাৎ যুগাবতার) বলিয়া স্থাপিত করিলেন। যদিও তিনি লিখিতে পড়িতে জানিতেন না, তথাপি দরবারের মুল্লাগণ লোভে ও ভয়ে এক পাঁতি (ফতাওয়া) সহি করিয়া দিল যে বাদশাহই কোরানের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ও নির্ভুল ব্যাখ্যাকারক এবং ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় সমস্ত প্রশ্নের শেষ বিচারক (মুতাহিদ)। এদিকে হিন্দুরা তাঁহার গুণে মুগ্ধ হইয়া এবং তাঁহার হাতে নিজেদের ধর্ম্মের প্রশ্রয় এবং সাধু-সন্ন্যাসিগণের আদর দেখিয়া তাঁহাকে “জগৎ গুরু” উপাধি দিল। মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত ভক্তগণ এবং ভণ্ড অর্থলোভী চাটুকারগণ তাঁহাকে “সাহিব-ই-জমান্” অর্থাৎ ‘বর্তমান যুগের প্রভু বা গুরু” বলিতে লাগিল।
এই ভক্তগণের অধিকাংশই পারসিক ছিল। পারস্য জাতি আর্য্য, মুসলমান হইবার পরও নরপূজার আকাঙ্খা তাহাদের মজ্জাগত ছিল! পারস্য ইস্লামীয় যুগের প্রথম দুই শতাব্দী ধরিয়া কত-কত অবতার, পীর ও অমানুষিক শক্তি সম্পন্ন গুরু দেখা দিলেন এবং স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে নূতন নূতন সম্প্রদায় করিলেন, তাহার সংখ্যা করা যায় না। অধ্যাপক ব্রাউন রচিত পারস্যের সাহিত্যিক ইতিহাস প্রথম খণ্ডে ইহার সুন্দর বর্ণনা আছে। আকবরের পারসিক শিয়া, কর্মচারী ও সভাসদগণ তাঁহাকে অবতার বলিয়া খোসামোদ করিতে লাগিল। তিনি তাহাই বিশ্বাস করিলেন এবং প্রথমে গোপনে পরে কতকটা প্রকাশ্যে নিজেও মুহম্মদের অনেকগুলি গুণ ও শক্তি আরোপ করিতে লাগিলেন, এবং অবশেষে আরও উঁচুতে উঠিয়া ঈশ্বরত্ব বা অবতারত্ব দাবি করিলেন। গোঁড়া মুসলমানগণ ইহাতে অত্যন্ত বিরক্ত হইল; এবং সময়ে সময়ে মুসলমান-সৈনিকগণ বিশুদ্ধ ইস্লাম হইতে ভ্রষ্ট বাদশাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য ক্ষেপিয়া উঠিল। সম্রাটের চাটুকার আবুল ফজলের ভাষার আড়ালে আমরা এই সত্যটা বেশ ধরিতে পারি। তিনি লিখিতেছেন (আইন, ১খণ্ড, ১৬৩-১৬৬ পৃষ্ঠা) :-
“যখন কোন দেশের সৌভাগ্যক্রমে এমন দিন আসে যে সকলে সত্য পূজা করিবার পন্থা জানিতে পারে, তখন তাহারা স্বভাবতই রাজার দিকে তাকায় এবং তাঁহাকেই তাহাদের ধর্ম্মনেতা হইতে বলে। কারণ রাজাতেই দিব্যজ্ঞানের রশ্মি আছে, যাহা মানুষে নাই। আমাদের যুগের বাদশাহেরও তো তাহাই ঘটিয়াছে। তাঁহার জন্মের সময় দৈবজ্ঞেরা একথা জানিয়াছিল এবং তাহার পর তাহারা ইহা সফল হইবার প্রতীক্ষায় বসিয়া ছিল।”
“কিন্তু বাদশাহ্ প্রথম প্রথম নিজকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছিল যেন ইহাদের আশার কথা জানিতেন না। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা কে রোধ করিতে পারে? বাদশাহ বাধ্য হইয়া আত্ম-প্রকাশ করিলেন। এখন তিনি প্রজাবর্গের গুরু হইয়াছেন, তাহাদের জন্য সত্য-পথ খুলিয়া দিয়াছেন, এবং সমস্ত সত্য-পিপাসু পথিকের তৃষ্ণা নিবারণ করিতেছেন।”
সব জাতির লোক, বালক বৃদ্ধ, চেনা অচেনা, কাছের বা দূরবর্তী সকলেই জানে যে বাদশাহের নামে মানত করাই তাহাদের সমস্ত বিপদ বাধা ভঞ্জনের উপায়। যখন তাহাদের বাঞ্ছা পূর্ণ হয়, তখন তাহারা উঁহাকে পূজা করিতে মাথা নত করে। যখন বাদশাহ রাজধানী ছাড়িয়া ভ্রমণে বাহির হন, প্ৰতি গ্রামে প্রতি নগরে শত শত স্ত্রীপুরুষ আসিয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করে, হাতে পূজার উপহার, মুখে প্রার্থনা; মাটিতে কপাল রাখিয়া তাঁহাকে প্রণাম করে এবং বলিতে থাকে তাঁহাদের নামে প্রার্থনা কেমন ফলবতী হইয়াছে এবং বাদশাহকে উপাসনা করায় কিরূপ আশ্চর্য্য ভাবে তাহারা আধ্যাত্মিক বল লাভ করিয়াছে। বাদশাহ তাহাদের উৎকৃষ্ট উত্তর দেন এবং প্রত্যেকেরই ধর্ম্মসংশয়ের সমস্যা করেন। প্রত্যহ কত লোক তাঁহার নিকট বাটিতে করিয়া জল আনে ও তিনি তাহার উপর নিঃশ্বাস ফেলেন। এই জল খাইয়া কত কত কবিরাজে ছাড়িয়া দেওয়া হতাশ রোগী স্বাস্থ্যলাভ করিয়াছে!
“অনেক সহস্র লোক বাদশাহের শিষ্য হইয়া তাঁহার প্রতিষ্ঠিত ‘দীন-ই-ইলাহী’ নামক ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে।”
এই ধৰ্ম্মশিষ্যগুলি বাদশাহকে দণ্ডবৎ প্রণাম করিত। এইরূপ প্রণাম, ‘সিজদা’, শুধু নামাজের সময় ঈশ্বরকে এরূপ ভক্তি দেখান হইতেছে শুনিয়া গোঁড়া মুসলমানগণ অত্যন্ত চটিয়া উঠিলেন, নরপূজা আবার বুঝি মুসলমান রাজ্যে প্রচলিত হইল। তখন আকবর ভয়ে হুকুম দিলেন যে তাঁহাকে শিষ্যগণ গোপনে সিজ্দা করিবে। ইহার ভারতীয় নাম ‘ভূমিচুম্বন’ (জমীন্-বুস্, ফার্সী শব্দ।) প্রাচীন পারস্যদেশে রাজাকে এবং হিন্দুদের মধ্যে ধর্ম্মগুরুকে এই উপায়ে সম্মান দেখান হইত। আবুল্-ফজল অম্লানবদনে বলিতেছেন (১৫৯ পৃষ্ঠা)–”বাদশাহের সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত আর ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম একই কথা, কারণ রাজা ঈশ্বরের শক্তির চিহ্ন (emblem)। কিন্তু আকবরের মৃত্যুর পর মুসলমান বিদ্রোহের ভয়ে শাহজাহান এই প্রকার সম্মান গোপনেও করিতে নিষেধ করিলেন।
আবার, একদল হিন্দু ছিল, যাহারা প্রাতঃকালে আগ্রা (বা দিল্লী) দুর্গের বাহিরের প্রাচীরের বারান্দায় বাদশাহের মুখ না দেখিলে সেদিন আহার ও কাজকর্ম্ম করিত না; যেমন গয়া বা জগন্নাথে প্রাতে দেবদর্শন করিয়া তবে ভক্ত হিন্দুগণ আহার করে। ইহাদের ‘দর্শনিয়া’ সম্প্রদায় বলা হইত এবং ইহাদের জন্য কতকগুলি বিশেষ নিয়ম ছিল (আইন-২০৭ দেখুন)।
এমন কি রাজসংসারের ক্রীতদাসগুলিকেও অন্তত নামে, বাদশাহের শিষ্য করা হইল। আবুল-ফজল্ বলিতেছেন “ধৰ্ম্মপ্রাণ বাদশাহ বান্দা বা দাস এই শব্দ ব্যবহার করা অপছন্দ করেন, কারণ তাঁহার বিশ্বাস যে একমাত্র ঈশ্বরই মানবের প্রভু; (অর্থাৎ মানুষ মানুষের দাস হইতে পারে না।) সেজন্য তিনি দাস দিগের নাম দিয়াছেন ‘চেলা’ অর্থাৎ ভক্ত শিষ্য” (২৫৩ পৃ.)। এই নাম মুঘলযুগের শেষ পর্য্যন্ত ব্যবহৃত হইত।
বাদশাহ ধর্মগুরু এবং প্রজাদিগকে দীক্ষা দিয়া শিষ্য করেন এই বিশ্বাস আকবরের অনেক পরে পর্য্যন্তও চলিয়া আসিয়াছিল। তিনি তো ইস্লামভ্রষ্ট; কিন্তু তাঁহার প্রপৌত্র আওরংজীব অতি নিষ্ঠাবান মুসলমান, ‘নমাজী’ ‘দরবেশ’ ছিলেন। তাঁহাকেও লোকে বলিত ‘আলগীর জিন্দা পীর, অর্থাৎ ‘জাগ্ৰত সাধু”। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে এই বাদশাহ কৃষ্ণা নদীর তীরে শিবিরে বসিয়া দরবার করিতেছেন, এমন সময় একজন লোক আসিয়া বলিল, “আমি মুসলমান, সুদূর বঙ্গদেশ হইতে আপনার শিষ্য হইবার জন্য আসিয়াছি। আমার মনস্কামনা পূর্ণ করুন!” বাদশাহ ব্যঙ্গহাসি হাসিয়া মীর তুজুককে একশত টাকা দিয়া বলিলেন ‘এগুলি উহাকে দেও; লোকে আমার কাছে ইহারই মনস্কামনা করিয়া আসে!” লোকটা কিন্তু টাকা ফেলিয়া দিয়া ছুটিয়া গিয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়া পড়িত। দরবারের রক্ষিগণ তাহাকে জল হইতে বাঁচাইলে পর বাদশাহ আজ্ঞা দিলেন যে সরহিন্দ নগরের একজন বিখ্যাত মুল্লার নিকট লইয়া গিয়া তাঁহারই শিষ্য করিয়া দেও (মাসির্-ই-আলগীরি, ৩৩৩-৩৩৪-৩৩৪ পৃ.)।
ফার্সী ইতিহাস ও চিঠিপত্রে মুঘল বাদশাহগণকে এইসব উপাধি দেওয়া হয়:- ধর্ম্মের কেন্দ্র (কুতর্-ই-দীন), “কিরা ও কাবা’ অর্থাৎ মক্কার যে মন্দিরের দিকে মুসলমানেরা মুখ ফিরাইয়া নমাজ করে এবং জেরুজালেমে সলোমানের মন্দির, ইহজগত ও পরলোকের গুরু পীর ও মুর্শিদ্-ই-আলম্ ও আলমীয়াঁ (অথবা দীন ও দুনিয়া অথবা দু-জহাঁ) ঈশ্বরের ছায়া, বর্তমান কালের খলিফা, যুগ-প্ৰত্ব ইত্যাদি।
দাক্ষিণাত্যে সমৃদ্ধ বিজাপুর রাজ্যের সুলতানরা মুঘল বাদশাহের অনুকরণ করিতে ভালবাসিতেন। আকবরের সমসাময়িক বিজাপুর রাজ ২য় ইব্রাহিম আদিল শাহ (রাজত্বকাল ১৫৮০-১৩২৩) আকবরের মতো ‘জগৎ গুরু’ উপাধি লইয়াছিলেন। তিনি কিছুদিন পৰ্য্যন্ত হিন্দুধৰ্ম্ম মত গ্রহণ করিয়া নিরামিষ খাইয়া দেবদেবীর পূজা করিতেন। আমি যখন বিজাপুরে ভ্রমণ করি, আমার পথপ্রদর্শক (একজন মুসলমান পীরজাদা) রাজদুর্গের পরিখার ধারে “নারসোরা” নামক ঠাকুরের পুরাতন মন্দির দেখাইয়া দিয়া বলিল যে ইব্রাহিম আদিল শাহ এইস্থানে দেবপূজা করিতেন, সে প্রবাদটা মিথ্যা; তিনি অসুখের জন্য শুধু গোদুগ্ধ খাইতেন এবং নিরিবিলি ধ্যান করিতেন বলিয়া লোকে, তিনি হিন্দু হইয়াছেন এই অপবাদ রটাইয়া দেয়। স্থানটি বেশ নির্জ্জন, প্রাসাদদুর্গেও এক কোণে, মন্দির-পদতলে পরিখার জল, উপরে বৃহৎ প্রাচীন অশ্বত্থবৃক্ষ। কিন্তু ইব্রাহিম যে ‘জগৎগুরু’ নামে বিখ্যাত ছিলেন এবং ফার্সী ও ব্রজবুলী-মিশ্রিত নিজের সৃষ্ট এক ভাষার পদ্য রচনা করিতেন তাহার প্রমাণ ইতিহাসে। তাঁহার ফার্সী মুসলমান, ঐতিহাসিক (রসাতীন্ ই-সলাতীন্ ২৫৯-২৬০, ২৬৪ পৃ.) প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে তাঁহার হিন্দু সাধু ও উপাসক হওয়ার কথা অপবাদ মাত্র।
যাহা হউক সম্রাট ত জগৎ গুরু হইলেন, এখন সম্রাজ্ঞীকে ঐ মতো একটা উপাধি না দিলে বড়ই অসামঞ্জস্য থাকে। সেকালের কর্তাভজাগণ এটিও ছাড়ে নাই। তাহারা, জাহাঙ্গীরের প্রধানা পত্নী যোধপুর-দুহিতা এবং শাহজহানের মাতা) কে ‘জগৎ-গোস্বামিনী বলিয়া ডাকিত। (তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী, সৈয়দ আহমদ খাঁ সম্পাদিত মূল ফার্সী, ৫ পৃ.)
এই যে রাজার প্রতি দাস্যভাব (slave mentality) বলিয়া একটা কথা আজকাল বড়ই চলিতেছে, এটা ভারতের অতি পুরাতন সুদীর্ঘ পরিচিত বন্ধু বলিয়া ঐতিহাসিক চেনেন; গোলদিঘির বক্তারা যদিও তাহা ভুলিয়া গিয়াছেন। এ প্রবন্ধে তাহারই প্রমাণ দেওয়া গেল।
[প্রভাতী, ভাগ ২, সংখ্যা ১, নিদাঘ সংখ্যা, ১৩২৮-এ প্রথম মুদ্রিত। ভারতবর্ষ, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৮-এ পুনর্মুদ্রিত।]
১। ইহাই দিল্লী সাম্রাজ্যের নিয়মিত ভাল সৈন্যের সংখ্যা। শাহজহান্ যখন বিদ্রোহী পুত্র কর্তৃক আগ্রাদুর্গে অবরুদ্ধ হইলেন এবং যমুনা হইতে তাঁহার পানীয় জল আনা বন্ধ হইল, তখন তিনি আওরংজীবকে এক পত্র লেখেন, “বাবা আমার! বীর আমার! কাল আমি ৯ লক্ষ সোয়ারের প্রভু ছিলাম, আর আজ আমায় জল দিবার একজন জন চাকর (আবদার) নাই!”
(ব্রিটিশ মিউজিয়ম হস্তলিপি)
২। ঐশ্বৰ্য্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রীয়ঃ জ্ঞান বৈরাগ্যয়েশৈব যন্নাম্ ভগ ইতি স্মৃতঃ।