দিল্লির গণধর্ষণ, গণরোষ!
ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েরা এ পর্যন্ত যতটুকু অধিকার অর্জন করেছে, বেশির ভাগই করেছে পুরুষের কারণে। পুরুষেরা মেয়েদের সতীদাহ বন্ধ করার, মেয়েদের ভোট দেওয়ার, বাড়ির বাইরে বের হওয়ার, ইস্কুলে যাওয়ার, চাকরিবাকরি করার অধিকারের পক্ষে নারীবিরোধী সমাজের সঙ্গে লড়াই করেছে। তারপরও কিন্তু ভালো পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। পথে যে বিরাট বাধার দেওয়াল, তা কিছুটা সরিয়ে সামনে এগোতে পুরুষেরা মেয়েদের সাহায্য করেছে বটে, তবে বেশির ভাগ লোক মেয়েদের ঠেলে দিয়েছে পেছনে। মেয়েদের পেছনে ঠেলার লোকের সংখ্যা বরাবরই বড় বেশি। ভারতবর্ষকে বেশ কয়েক বছর কাছ থেকে দেখছি, যেহেতু এখানে বাস করছি আমি, যেহেতু ভারতবর্ষ ছাড়া এই উপমহাদেশের অন্য কোথাও বাস করার আমার অধিকার লঙ্ঘন করছে গণতন্ত্রে বিশ্বাস-না-করা তথাকথিত গণতা ন্ত্রিক সরকার। উপমহাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন গণতান্ত্রিক দেশ, শিক্ষায়, সম্পদে সমতায় যে দেশ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ থেকে অনেক এগিয়ে, সে দেশে প্রতি সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে পড়ি ধর্ষণের খবর। নাবালিকা ধর্ষণ তো। আছেই, ধর্ষণের পর ঠাণ্ডা মাথায় খুন। গলা টিপে, গুলি করে, কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, পাথর ছুঁড়ে পুরুষেরা মেয়েদের মারছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি, এসবের কোনও প্রতিবাদ হয় না দেখে। পেঁয়াজ বা পেট্রোলের দামের একটু এদিক ওদিক হলে রাস্তায় হাজার লোক বেরিয়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে, আর একশ মেয়ে ধর্ষিতা হলেও একটি মেয়ে বা একটি ছেলেও রাস্তায় নামে না। ধর্ষণের কথা শুনতে শুনতে, ধর্ষণ দেখতে দেখতে, ধর্ষণ এখন ডাল ভাত হয়ে গেছে। কেউ আর ধর্ষণের খবর শুনে আঁতকে ওঠে না। ধর্ষণের খবরেও প্রচার মাধ্যমের লোকদের তেমন আর আগের মতো উৎসাহ নেই। গণধর্ষণ না হলে ওরা আজকাল খবরও করে না। দিল্লির একটি মেয়েকে সেদিন বাসের ভেতর গণধর্ষণ করেছে কিছু লোক, শুধু গণধর্ষণ নয়, আরও ভয়ংকর কিছু, পুরুষাঙ্গ দিয়েই আঘাত করে শান্ত হয়নি, লোহার রড যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে জরায়ু ফুটো করে পেটের নাড়ি ভুড়ি বের করে নিয়ে এসেছে। যৌনাঙ্গে যখন পেটের নাড়ি, তখনও তাদের ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। ধর্ষণোল্লাস শেষ হলে প্রায়-মৃত মেয়েকে চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। মেয়ে এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। বাঁচার সম্ভাবনা খুব বেশি আছে বলে আমার মনে হয় না।
এই প্রথম মানুষ রাগলো। নাকি জাগলো? জাগরণ কি এত সহজে ঘটে? তবে। এ ঠিক, এই প্রথম হাজার হাজার ছেলে মেয়ে রাস্তায় নেমে মেয়েদের নিরাপত্তার দাবি করলো সরকারের কাছে। ধর্ষকদের ফাঁসি দিতে হবে, এমন দাবিও উঠছে। সরকা রের পক্ষে ফাঁসি দেওয়া তো কোনও অসুবিধের ব্যাপার নয়। ফাঁসিতে ঝুটঝামেলা সবচেয়ে কম। এর চেয়ে সহজ কাজ আর কী আছে! কিন্তু ছেলেরা যেন মেয়েদের যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে, শৈশব থেকে যেন মানুষ মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখে, এই ব্যবস্থা করাটা বরং সহজ নয়। এই কঠিন কাজটির দায়িত্বই তো সরকা রকে দেওয়া উচিত।
অবশ্য শৈশবে তোতাপাখির মতো নারী ও পুরুষের অধিকার সমান, নারীকে ছোটজাতের মানুষ ভাবিয়া অবজ্ঞা করিও না, তাহাদিগকে মারিও না, ধর্ষণ করিও না উচ্চারণ করলেই যে তা একেবারে মগজ অবধি পৌঁছবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। পোঁছোলেও বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে যখন ক্রমাগত শিশু-কিশোররা দেখতে থাকে যে পুরুষেরা মাতব্বর আর নারীরা নেপথ্যের লোক, তখন এই দেখার অভি জ্ঞতাই তাদের মগজের বাকি কিছুকে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নেয়। যৌবনে পতিতা-অভিজ্ঞতা তাদের আরও একটি জ্ঞান মগজে ঢোকায়, মেয়েদের শরীর নিয়ে যা ইচ্ছে তা করা যায়, শিশুকে ধর্ষণ করা যায়। সমাজের খুব বেশি কেউ একে ঠিক অন্যায় বলেও মনে করে না। স্ত্রীর বেলাতেও তাই, স্ত্রীকে ধর্ষণ করা আইনের চোখে অপরাধ হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে মোটেও অন্যায় কিছু নয়। পণপ্রথা আইনের চোখে নিষিদ্ধ হলেও যেমন সমাজের চোখে নয়। পণপ্রথাই প্রমাণ করে নারী নিতান্তই নিচ, নিরীহ নিম্নলিঙ্গ, নির্বাক জীব, পুরুষকে উৎকোচ দিয়ে পুরুষের ক্রীতদাসী বনা ছাড়া তার আর গতি নেই।
বিবাহিত নারীর শরীরে নানারকম চিহ্ন থাকে জানান দেওয়ার যে সে বিবাহিত, কোনও প্রাণহীন ছবির ফ্রেমে যেমন লাল চিহ্ন দিয়ে লেখা থাকে সোল্ড, মেয়েদের কপালে, সিঁথিতে সিঁদুরের লাল চিহই মেয়েরা যে বিক্রি হয়ে গেছে তা জানান দেওয়ার চিহ্ন। বিবাহিত মেয়েদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি স্বামীর সম্পত্তি। বিবাহিত স্বামীরা কিন্তু কোনও অর্থেই স্ত্রীর সম্পত্তি নয়। এই সব হাজারো পুরুষতান্ত্রিক প্রথা অক্ষত রেখে এখন যদি মেয়েদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়, তাহলে কি ধর্ষণ বন্ধ হবে? এদিকে বলিউডের নিরানব্বই ভাগ ছবিতেই দেখানো হচ্ছে নারী যৌনবস্তু, টেলিভিশনেও একই বার্তা, খবরের কাগজ খুললেই আধন্যাংটো মেয়েদের ছবি, সবখানে মেয়েরা কেবল শরীর, নিভাঁজ নিটোল ত্বক, কেবল স্তন, কেবল যোনী, মস্তিষ্ক হলেও মস্তিষ্ক নয়, দার্শনিক হলেও দার্শনিক নয়, বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানী নয়, চিন্তক হলেও চিন্তক নয়, বুদ্ধিজীবী হলেও বুদ্ধিজীবী নয়। পুরুষ তাদের নাগালের মধ্যে পেলে ধর্ষণ করবে না তো বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়ে আলোচনা করবে? মেয়েরা ছোট পোশাক পরুক, বা ন্যাংটো হোক, ধর্ষণ করার অধিকার কারও নেই– এ কথা পুরুষেরা জানে না তা নয়, জানে। কিন্তু এও তো তারা জানে যে পুরুষই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তা। পুরুষের পেশি বেশি, পুরুষের দেমাগ বেশি, পুরুষের সাহস বেশি, পুরুষ ঝুঁকি নিতে পারে বেশি, পুরুষের লজ্জা করা বা ভয় পাওয়া মানায় না, পুরুষেরা বীর, নির্ভীক, পুরুষের ক্ষমতা বেশি, গায়ের জোর বেশি, মনের জোর বেশি, পুরুষেরা পারে না এমন কিছু নেই– জন্মের পর থেকে তো তা-ই জেনে আসছে তারা! এসবই তো অনুক্ষণ শেখানো হয়েছে তাদের। ধর্ষণ করলে, পুরুষ মনে করে, পৌরুষের প্রমাণ দেওয়া হয়। সত্যি বলতে কী, পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরকে যত ধর্ষণ করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি করছে মনকে। ধর্ষণ করছে মনের স্বাভাবিক বিকাশকে, মনের জীবনীশক্তিকে, প্রাণকে, প্রাণের উচ্ছ্বাসকে, অসীম সম্ভাবনাকে, স্বপ্নকে, স্বাধীনতাকে। শরীরের ক্ষত শুকিয়ে যায়, মনের ক্ষত শুকোয় না।
শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনই ঘটছে। বিবর্তিত হতে হতে চলেছি সব প্রাণীই। ক্রমশ ভালো থেকে আরো-ভালো, আরও-ভালো থেকে আরো-আরো-ভালো অব স্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে মানুষ চলেছে বলেই মানুষ প্রজাতি টিকে আছে। এই প্রজাতিকে, শুধু যৌনাঙ্গ ভিন্ন হওয়ার কারণে, যদি অত্যাচার করতেই থাকে পুরুষেরা, তবে এই দুর্ভাগা মানুষ প্রজাতিই হয়তো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ধর্ষণের ইচ্ছেকে যদি পুরুষেরা সংযত করতে না চায়, জোর খাঁটিয়ে আনন্দ পাওয়ার অভ্যেসকে যদি বিদেয় করতে না পারে, তবে মানুষের বিবর্তন ভালোর দিকে না এগিয়ে মন্দের দিকে এগোবে। মন্দের দিকে যাওয়া মানে বিলুপ্তির দিকে যাওয়া। হাতে গোণা খুব দুষ্ট কিছু প্রজাতি ছাড়া আর কোনও প্রজাতি নিজের প্রজাতির মেয়েদের দাবিয়ে রাখে না। গণধর্ষণ? মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রজাতির চরিত্র এমন বীভৎস নয়।
মানুষ বুদ্ধিমান। বুদ্ধির নিদর্শন অনেক কিছুতে রাখছে। মঙ্গলগ্রহে অবধি মেশিন পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ছোট্ট এই গ্রহে, সমতায়, সমানাধিকারে, সমমর্মিতায়, সমঝো তায় সুখে আর স্বস্তিতে নারী আর পুরুষের বাস করার পরিবেশ আজও তৈরি করতে পারছে না সে কি বুদ্ধি নেই বলে, নাকি ইচ্ছে নেই বলে? আমার তো মনে হয় ইচ্ছে। নেই বলে। হাঁ বুঝলাম, পুরুষের গায়ের জোর বেশি বলে ধর্ষণ করে। কিন্তু গায়ের জোরে তো আমরা সমাজটা চালাচ্ছি না, রাজ্যটা বা রাষ্ট্রটা চালাচ্ছি না। চালাচ্ছি বুদ্ধির জোরে। পুরুষেরা কি তাদের বুদ্ধি আর চেতনকে, বিবেক আর হৃদয়কে গণধর্ষণ করে বেহুঁশ করে রেখেছে? চেতনার নাড়ি টেনে বের করে ধর্ষণ করছে নিজেদেরই ভবিষ্যৎকে!
সমাজটা তাহলে পাল্টাবে কারা? যাদের হাতে ক্ষমতা, তারা। যারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজটা গড়েছে, তারা। যারা ক্ষমতাহীন, যারা অত্যাচারিত, ধর্ষিত, নির্যাতিত, যারা ভূক্তভোগী তাদের আর কতটুকু শক্তি! দিল্লির রাস্তায় ধর্ষণের প্রতিবাদে অত্যাচারি তের উপস্থিতির চেয়ে অত্যাচারী গোষ্ঠীর উপস্থিতি অনেক বেশি দরকারি। অত্যাচারী গোষ্ঠী অত্যাচার বন্ধ করলেই অত্যাচার বন্ধ হবে। শাস্তির ভয়ে বন্ধ করলে অবশ্য সে বন্ধ করা সত্যিকারের বন্ধ করা নয়, বোধোদয় হওয়ার পর বন্ধ করলে সে বন্ধ করা সত্যিকারের বন্ধ করা, চিরস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা সেটিরই বেশি। ভারতবর্ষ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র, জনসংখ্যা বিচার করলে এই বাক্য অসত্য নয়। কিন্তু গণতন্ত্র শুধু ভোটের ব্যবস্থাই নয়। গণতন্ত্র নারী পুরুষ, ধনী দরিদ্র, সবার জন্য সমানাধি কার আর বাক স্বাধীনতার ব্যবস্থাও বটে। ভারতবর্ষে এ দুটোর কোনওটিই নেই। কেবল ভারতবর্ষ নয়, পুরো উপমহাদেশেরই একই হাল। সত্যিকার গণতন্ত্রে জনগণ নিরাপদে বাস করে। সত্যিকার গণতন্ত্র আনতে মধ্যবিত্তের একাংশের গণরোষ খুব কাজ দেবে কি? কাজ দেবে বিশাল এক গণজাগরণ। উপমহাদেশের রাজনীতি ছলে বলে কৌশলে গণজাগরণ বন্ধ করে রাখে। বৈষম্য দেখতে দেখতে, বৈষম্যের সঙ্গে সহবাস করতে করতে, বৈষম্যেই মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সমতা বা সমানাধিকার ঠিক কাকে বলে, বেশির ভাগ মানুষ জানে না। দুঃখ এই, বেশির ভাগ বঞ্চিতই জানে না তারা বঞ্চিত, লাঞ্ছিতরাই ঠিক বোঝে না তারা লাঞ্ছিত।
আগে জানুক, আগে বুঝুক, তারপর রাস্তায় বেরোক।