দিব্যদৃষ্টি
আমার নাম অমল, বয়স ষোলো। ছোটোবেলা থেকেই একটা অদ্ভুত রোগ আমাকে পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে আমার চোখের সামনে এমন সব জিনিস ভেসে ওঠে যা আর কেউ দেখতে পায় না। এমন অনেকবারই ঘটেছে। যেমন আমি আর পাঁচজনের সঙ্গে বসে আছি হঠাৎ দেখলাম একজন লোক ঘরে ঢুকল, তাকে আগে কখনো আমি দেখিনি। আমি হয়তো অবাক হয়েই লোকটির দিকে তাকিয়ে আছি। ঘরে আর যারা আছে তারা আমার চোখ-মুখের ভাব দেখে কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করে। আমি উলটে তাদের প্রশ্ন করি যে লোকটা ঘরে ঢুকল, সে কে? তারা অবাক হয়ে যায়। আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।
আমি নাকি মানসিক রোগে ভুগছি, আমার শরীর নাকি ভালো নেই, এসব শুনতে শুনতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে। আমি জানি আমার কোনো অসুখ নেই, আমার বয়সি যেকোনো ছেলের চাইতে আমার স্বাস্থ্য মোটেই খারাপ নয়। ছোটোবেলা এমন কিছু কঠিন অসুখও আমার হয়নি।
আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ তখনই আমি আমার মাকে হারিয়েছি। বাবা তারপর থেকেই কেমন যেন হয়ে গেছেন। অনেক দিনের পুরোনো কাজের লোক দাশুদার ওপর আমার ভার ছেড়ে দিয়ে সেই যে বইপত্রের মধ্যে ডুবে গেছেন আজও সংসারের কিছুর মধ্যে থাকেন না। বাবা দর্শনের অধ্যাপক।
আর সবাই আমার মাথায় গোলমাল আছে ভাবলেও দাশুদা কিন্তু আমার কথা অবিশ্বাস করে না। বলে, আমি যা দেখি তা নাকি সূক্ষ্মদেহী মানুষের কায়া। যাদের আত্মা মুক্তি পায়নি, অসুখী, তারাই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। যাদের দিব্যদৃষ্টি আছে তারাই শুধু তাদের দেখতে পায়, আর কেউ নয়। এসব অবশ্য দাশুদার কথা। দাশুদার কথা কেউ আমল দেয় না, কারণ দাশুদা ঘরের কাজ করে, লেখাপড়া জানে না, কিন্তু আমি জানি দাশুদার মতো সৎ আর জ্ঞানী লোক সহজে মেলে না। কত ভালো ভালো কথা, ধর্মের কথা, দাশুদার মুখে যে আমি শুনেছি তার হিসেব নেই।
বেশ চলছিল, হঠাৎ আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। বাবার দূর সম্পর্কের এক বিধবা দিদি আমাদের বাড়ি এলেন, এখানেই পাকাপাকি থাকবেন। তিনি আমার এই ‘দেখতে পাওয়া’ ব্যাপারটা জেনে আঁতকে উঠলেন, বাবাকে ধরলেন আমার চিকিৎসা করাতে হবে নইলে নাকি বাকি জীবনটা হয়তো আমাকে পাগলাগারদেই কাটাতে হবে।
পিসিমার কথায় বাবার টনক নড়ল। তিনি আমাকে নিয়ে এ ডাক্তার ও ডাক্তার করলেন। আমার রোগের কারণটা জেনে সবাই কিন্তু বললেন আমি মানসিক রোগে ভুগছি, যা দেখি সবই কল্পনা। আমি কিন্তু জানি ডাক্তারবাবুদের এই কথা সত্যি নয়। স্কুলে ভালো ছাত্র বলে আমার সুনাম আছে, একটু নির্জনতা পছন্দ করলেও খেলাধুলোয় আমি মোটেই খারাপ নই, বরং ফুটবল ভালোই খেলি। মানসিক রোগ থাকলে এসব কি সম্ভব!
শেষ পর্যন্ত বাবা এমন একজন ডাক্তারের খোঁজ পেলেন যিনি মানসিক রোগের চিকিৎসায় বেশ নাম করেছেন, কয়েক বছর বিদেশেও ছিলেন। তিনি নাকি আকর্ষণীয় কেস পেলে নিজের বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। বাবার চিঠিতে আমার সম্বন্ধে সব জেনে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিতে লিখলেন।
বাবা একজন পরিচিত লোকের সঙ্গে আমাকে ডা বসুর কাছে পাঠালেন। কলকাতা থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে তাঁর বাড়ি। পরে জেনেছিলাম তিনিও ওখানে বছর দুই আছেন। তাঁর আগে ওখানে আরেকজন ডাক্তার ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই বাড়ি আর চারপাশের কিছু জমি কিনে মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য তিনি একটা আশ্রম গড়ে তুলেছেন, নাম দিয়েছেন ‘নিরাময়’। বাড়িতে কিন্তু অন্য কোনো রোগী থাকে না, আশ্রমেই তাদের সব ব্যবস্থা।
আমি অবশ্য অত জানতাম না, তাই তিনি যখন তাঁর বাড়ির একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করলেন, আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর সবাই কোথায়?’
‘আর সবাই কারা?’ তিনিও অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন।
‘বাকি সব পাগলরা,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আমার মাথা খারাপ ভেবেই তো এখানে চিকিচ্ছের জন্য পাঠানো হয়েছে।’
ডা বসু আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন, তারপর আমার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘এ বাড়িতে তুমি, আমি, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অবিনাশ, কাজ করার লোক কানাই আর মালি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে যারা বলে, তারা কিচ্ছু জানে না। তুমি এখানে খুশিমতো ঘুরে বেড়াবে, বই পড়বে, কেউ কিছু বলবে না।’
ডা বসুকে প্রথম থেকেই আমার খুব ভালো লেগে গেল। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি খুব নাম করেছেন, কিন্তু এতটুকু অহংকার নেই। হাসিখুশি খোলামনের এই মানুষটি যে মানসিক চিকিৎসার ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ, তা মনেই হয় না।
কয়েকটা দিন কেটে গেল। আমি আরও অবাক হলাম ডা বসু আমার রোগ সম্বন্ধে আমাকে কোনো প্রশ্নই করলেন না, চিকিৎসার ব্যবস্থা তো নয়ই। একদিন রাত্রে আমরা দু-জন ক্যারাম খেলছিলাম আর গল্প করছিলাম। কেমন করে জানি না কথায় কথায় আমার দেখতে পাওয়া প্রসঙ্গটা এসে গেল।
উনি খেলা থামিয়ে একটা সোফায় আমাকে পাশে নিয়ে বসলেন, তারপর আমি কী কী দেখেছি, কখন দেখেছি, তা খুলে বলতে বললেন। আমি অসংকোচে আমার মন আলগা করে দিলাম। আমার কথা শুনতে শুনতে আর সবার মতো তিনি মাথা নাড়লেন না কিংবা তাঁর চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছাপও ফুটে উঠল না। গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার প্রতিটি কথা তিনি শুনলেন, তারপর নানা প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নগুলো কিন্তু আমার সম্বন্ধে নয়, যা যা আমি দেখেছি সেই বিষয়ে।
‘এসব কিন্তু আমার মনের বিকার নয়,’ আমার বক্তব্য শেষ করে আমি বললাম, ‘আমি সত্যিই এসব দেখেছি, বিশ্বাস করুন।’
ডা বসু আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করছি।’ একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘এখানে তুমি যতদিন আছ, তার মধ্যে যদি কিছু দেখ, তবে তখুনি আমাকে এসে বলবে, কেমন?’
আমি ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলাম।
ডা বসু আমাকে বলেছিলেন, এই বাড়িটা নাকি অনেক বছরের পুরোনো, এক নীলকর সাহেব বানিয়েছিলেন, তারপর কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। ডা বসু যাঁর কাছ থেকে এই বাড়িটা কিনেছিলেন তাঁর নাম ডা মৈত্র। তিনিও নাকি একজন ডাক্তার ছিলেন। শেষের দিকে ডাক্তারি তেমন করতেন না তাই বাড়ি বিক্রি করে সব ছেড়েছুড়ে এখান থেকে চলে গেছেন।
আরও ক-টা দিন কেটে গেছে। আমার সেই ‘দেখতে পাওয়া’ রোগটা আবার ফিরে এসেছে। শেষ যখন দেখেছিলাম তারপর প্রায় তিন চার মাস কেটে গেছে, তারপরই আবার দেখলাম।
ডা বসুকে সপ্তাহে তিনদিন কলকাতা যেতে হয়, সেখানে হাসপাতালে তিনি রোগী দেখেন, তা ছাড়া নিজেরও কিছু রোগী দেখা থাকে। ভোরের ট্রেনে চলে যান, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। গতকাল বিকেল পাঁচটা, ডা বসু কলকাতা থেকে ফেরেন নি, তাঁর সহকারী অবিনাশ (তিনিও একজন ডাক্তার) ‘নিরাময়’-এ রোগীদের দেখাশোনার জন্য গেছেন, কানাই আর মালি বোধ হয় রান্নাঘরে, আমি একা একা বসবার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়ছিলাম। একটু বোধ হয় তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ আমার মনে হল ঘরে যেন আমি একা নই। অনুভূতিটা এত প্রখর হয়ে উঠল যে, পুরো এক মিনিট আমি চুপ করে চোখ বুজে বসে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুললাম, আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে আমি কিছু দেখতে পাব।
সত্যিই তাই।
আমি যেখানে বসে ছিলাম তার মাত্র কয়েক হাত দূরে আমারই বয়সি একটি ছেলেকে দেখতে পেলাম। একটু লম্বাটে, গায়ের রং কটা, চুল লালচে, সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে, বেশ রোগা চেহারা। পরনে একটা সাদা হাফপ্যান্ট আর গায়ে মেরুন রঙের হাওয়াই শার্ট, পায়ে বুট জুতো। মাথা নীচু করে একটু পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল, তাই ওর মুখ আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ছেলেটি সোজা হয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বাইরের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর মুখ।
আমার অনুমানই ঠিক। ছেলেটি আমারই বয়সি। বিষণ্ণ এক মুখ, ফ্যাকাশে, চিন্তাভাবনায় মুখে যেন কালো ছায়া পড়েছে। বেশ বড়ো বড়ো চোখ, কিন্তু চাউনিতে ফুটে উঠেছে কেমন একটা ভয়ের ছাপ।
আমি স্থির হয়ে বসে মূর্তিটিকে লক্ষ করতে লাগলাম। ও যেন কী করবে মনস্থির করতে পারছে না, তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে একটা জানলার সামনে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে বাইরে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর প্রথম যেখানে দেখেছিলাম আবার সেখানে ফিরে এল। কয়েক মিনিট ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি নিঃশব্দে ওর পিছু নিলাম কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে আর দেখতে পেলাম না ওকে।
ডা বসু ফিরে এলে আমি তাঁকে ঘটনাটা বললাম। আমার কথা শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে উঠল তাঁর মুখ। আমাকে তিনি বললেন, ‘অমল, আবার যদি তুমি ওকে দেখ, আমাকে জানিয়ো।’
সেই ছেলেটিকে আমি আবার দেখেছি।
আজ বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে আমি একটু দূরে চলে গেছিলাম। এখানে ক্রিশ্চানদের একটা খুব পুরোনো গির্জে আছে। আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম। গির্জের লাগোয়া কবরখানায় সমাধির ওপর পাথরের বেদিতে খোদাই করা নামগুলো পড়তে পড়তে আমি এগিয়ে চলেছিলাম, তখুনি সেই ছেলেটিকে আবার আমি দেখলাম। গির্জের এক প্রান্তে একটা কবরের পাশে ও দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পরনে সেই আগের পোশাক, দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও সেই আগের মতো। মুখে সেই বিষণ্ণ ভাব। বড়ো বড়ো চোখ দুটো দিয়ে ও একটা সমাধি স্তম্ভের ওপর চোখ বুলোচ্ছিল আবার ঝুঁকে নীচের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কিছু পড়তে চেষ্টা করছিল।
আমি আরও এগিয়ে গেলাম। সমাধির ওপর সেই স্মৃতিফলকে কী লেখা আছে তা জানবার আগ্রহ আমাকেও যেন পেয়ে বসল। আমি ওর মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়ালাম। আমার মনে হল ও যেন আমাকে দেখল, কিন্তু অচেনা মানুষের দিকে কেউ যেভাবে তাকায় অনেকটা সেই দৃষ্টি। স্মৃতিফলকে জন স্টিফেন নামে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের জন্মমৃত্যুর বিবরণ ছিল। আমি হিসেব করে দেখলাম ঠিক ষোলো বছর বেঁচে ছিল।
মুখ তুলে ছেলেটিকে আর আমি দেখতে পেলাম না। বাড়ি ফিরে এসে ডা বসুকে আমার অভিজ্ঞতার কথা বললাম। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন তারপর কোনো মন্তব্য না করে আমাকে তাঁর অনুসরণ করতে বললেন। বাগানে বুড়ো মালি তখনও কাজ করছিল। ডা বসু এই বাড়ি কেনার আগে থেকেই সে এই বাগানের মালি ছিল।
‘মালি,’ তিনি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি এখানে কত বছর আছ?’
‘তা বাবু পঞ্চাশ বছর বটে তো হবে।’
‘তুমি জন বলে কাউকে চিনতে? পনেরো ষোলো বছরের ছেলে, সাহেবদের মতো গায়ের রং?’
‘জন?’ মালি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ বাবু, জেমস সাহেবের ছেলে। ওই গির্জের আধ মাইল দূরে যে পুরোনো বাড়িটা আছে, সেখানেই জেমস সাহেব থাকতেন। পাট কলের ম্যানেজার ছিলেন। সাহেব হঠাৎ মারা গেলেন, সাহেবের বউও এক বছরের বেশি বাঁচেননি। মেমসাহেব মারা যাবার পর তাদের ছেলে জন এই বাড়িতেই আগের ডাক্তারবাবুর কাছে কিছুদিন ছিল। ছেলেটিও মারা গিয়েছিল।’
‘কী হয়েছিল তার?’
‘কী জানি বাবু, খুব রোগা ছিল, শরীলে রক্ত ছিল না। এ বাড়িতে আসার পর শরীল আরও খারাপ হয়েছেল, তাই ডাক্তারবাবু তারে নে কোথায় যেন গেইছিলেন, সেখানেই ছেলেটা মারা যায় শুনেছি।’
‘তা, জন ডাক্তারবাবুর কাছে এল কেন? ওর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না?’
‘না, বাবু। ডাক্তারবাবু জেমস সাহেবের পরিবারের বন্ধু ছিলেন, তেনাকে ওঁরা খুব বিশ্বাস করতেন। অন্য কারো সঙ্গে সাহেব আর মেমসাহেব তেমন মিশতেন না।’
‘জেমস সাহেবের অনেক টাকাপয়সা ছিল?’
‘তা ছেল বাবু, লোকে তো তাই বলে।’
আরও কয়েকটা প্রশ্নের পর ডা বসু আমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে এলেন। মালি জনের চেহারা ও বয়সের যে বর্ণনা দিয়েছিল, তার সঙ্গে আমার দেখা ছেলেটির হুবহু মিল ডা বসুকে যেন চিন্তায় ফেলে দিল।
এখন আর আমার কথা কেউ অবিশ্বাস করতে পারবে না, আমি মানসিক অসুখে ভুগছি একথাও বলা চলবে না।
আরও ক-দিন কেটে গেছে। বেলা তখন প্রায় একটা। ডা বসু, অবিনাশবাবু আর আমি খাবার ঘরে খেতে খেতে গল্প করছি। ডা বসু একটা মজার কথা বলছিলেন আর আমরা হাসছিলাম, হঠাৎ সেই ছেলেটি ঘরে ঢুকল। যেন খুব সন্তর্পণে ঘরে ঢুকল, মনে হল কী করবে তা যেন ও ভেবে পাচ্ছে না। মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ আরও গভীর হয়ে ফুটে উঠেছে, দু-চোখের দৃষ্টিতেও গভীর হতাশা।
আমি যে খাওয়া বন্ধ করে স্থির দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়েছিলাম তা ডা বসুর নজর এড়াল না।
‘কী হল, অমল?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘ও আবার এসেছে,’ আমি জবাব দিলাম। অবিনাশবাবুও ইতিমধ্যে সব জেনেছেন।
‘কোথায় দেখতে পাচ্ছ?’ ডা বসু আবার জিজ্ঞেস করলেন।
‘দরজা আর আপনার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। কোনদিকে যাবে মন ঠিক করতে পারছে না। কী যেন খুঁজছে।’
‘তুমি লক্ষ করে যাও আর আমাদের বলতে থাক।’
আমি বলতে লাগলাম।
‘ও জানলার সামনে দাঁড়িয়েছে, বাগানের দিকে তাকাচ্ছে…আবার ফিরে এসেছে…আমাদের টেবিলের দিকে তাকাচ্ছে…ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে…’
‘তুমি ওর পিছু নাও,’ ডা বসুর গলায় মৃদু উত্তেজনার আভাস পেলাম।
আমি তাঁর কথামতো ওর পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ডা বসু আর অবিনাশবাবুও চেয়ার ছেড়ে আমাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। এবার কিন্তু ও মিলিয়ে গেল না। বারান্দা দিয়ে হেঁটে ডান দিকে ডা বসুর লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল। আমরাও তাই করলাম।
‘ও এখন কী করছে?’ ডা বসু জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার বই পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছে…ড্রয়ারে কী যেন খুঁজছে…ওর মুখে ”কী করব” ”কী করব” এমন একটা ভাব ফুটে উঠেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে…’
‘পিছু নাও।’
ও খাবার ঘর পেরিয়ে বাগানে পড়ল, আমরা তিনজন ওকে পায়ে পায়ে অনুসরণ করলাম। হঠাৎ ও দাঁড়িয়ে পড়ল, মনে হল যেন খুব মনমরা হয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে ও বাগানে একবার চক্কর দিল। ছেলেটা সামনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়েছে; মুখে ফুটে উঠেছে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন। হঠাৎ ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বাগানের এক জায়গায় কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছের মাঝখানে যে ঝোপ ছিল সেদিকে এগিয়ে গেল। ঝোপের সামনে কয়েক মুহূর্ত ও দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবছে, মুখে আবার ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তার ছাপ। তারপরই ও ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি যা দেখেছি ডা বসুকে বললাম।
আবার বাড়ির দিকে ফিরলাম আমরা।
‘আপনার কী মনে হয়?’ ডা বসু অবিনাশবাবুর দিকে তাকালেন।
‘অদ্ভুত ব্যাপার,’ তিনি জবাব দিলেন।
ডা বসু আর অবিনাশবাবু লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে ঘণ্টাখানেক কী সব পরামর্শ করলেন। তাঁরা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তখন বেলা প্রায় তিনটে। আমাকে তাঁরা আমার ঘর থেকে ডেকে নিলেন। বাগানে ওই ঝোপের কাছে এসে আমরা থামলাম। একটু পরেই মালি আর কানাইকে দুটো কোদাল হাতে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি বেশ অবাক হয়েই ডা বসুর মুখের দিকে তাকালাম। তিনি শুধু একটু হাসলেন, কোনো কথা বললেন না।
ডা বসুর কথামতো মালি আর কানাই ঝোপ পরিষ্কার করে ওখানকার মাটি কোপাতে লাগল। যে ছেলেটিকে আমি দেখেছিলাম তার কঙ্কাল মাটির তলায় পাওয়া গেল। তার ডান হাতের অনামিকায় ঢল ঢল করছিল একটা আংটি যেটা দেখে মালি কোনোরকম ইতস্তত না করে বলল ওটা ছিল জনের আংটি।
ডা বসু থানায় খবর পাঠালেন।
তদন্তে জানা গেল ছেলেটিকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছিল। ডা মৈত্রকে পুলিশ কলকাতার এক শহরতলি থেকে গ্রেপ্তার করল। তিনি সেখানে নতুন বাড়ি বানিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলেন। বিচারের সময় আসল ঘটনা প্রকাশ পেল। জেমস সাহেব তাঁর স্ত্রীর অবর্তমানে তাকেই তাঁর সব সম্পত্তির ট্রাস্টি করে জনের অভিভাবক নিযুক্ত করেছিলেন। জন যদি মারা যায় এবং তার বউ, ছেলেপুলে, না থাকে তবে ডা মৈত্র ওই সম্পত্তির মালিক হবেন, উইলে একথাও লেখা ছিল। ব্যাঙ্কে মজুত টাকা আর সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম ছিল না।
ডা মৈত্র জনকে অল্প অল্প করে আর্সেনিক খাইয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। পরে বাগানের মাটিতে কবর দিয়ে প্রচার করেছিলেন তিনি ওর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ওকে দেশভ্রমণে নিয়ে যাচ্ছেন। মাসখানেক পরে ফিরে এসে রটিয়ে দিয়েছিলেন জন মারা গেছে। ওর স্বাস্থ্য বরাবর খারাপ ছিল তাই কেউ সন্দেহ করেনি। ডা মৈত্র নিজে ডাক্তার ছিলেন তাই জনের স্বাভাবিক মৃত্যুর একটা জাল সার্টিফিকেট জোগাড় করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। তবু কেমন করে যে তিনি সব প্রমাণ করেছিলেন এটাই আশ্চর্য। পরে ডা বসুর কাছে পুরোনো বাড়িটা বিক্রি করে অন্যখানে গিয়ে বাড়ি-গাড়ি করেছিলেন, ডাক্তারিও করছিলেন। তাঁর অবস্থা মোটামুটি সচ্ছলই ছিল তবু লোভ তাঁকে কোথায় টেনে নামিয়েছিল।
বিচারে ডা মৈত্রর ফাঁসির হুকুম হয়েছিল।
আমাকে আর কেউ এখন মানসিক রোগী বলে ভাবে না। ডা বসু আমাকে একটা সুন্দর সার্টিফিকেট দিযেছেন, তাতে লিখেছেন আমার যদি মানসিক রোগ থাকে তবে পৃথিবীর সবাই পাগল। আমি ওটা বাঁধিয়ে আমার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি। ভালো কথা, ওই ঘটনার পর আর কিছু আমি দেখিনি।
(বিদেশি কাহিনির ছায়ায়)