নলিনী,- তোমার যাবার পরে আমি ভাবিয়া দেখিলাম যে, দিন-কয়েক বাহিরে যাওয়ার অজুহাতে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লেখার বিপদ আছে। প্রথম, এই জাতীয় লেখা আমার আসে না; অনধিকারচর্চা অপরাধে আমার পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান্ জলধর ভায়া হয়ত রাগ করিবেন। লোকেও অপবাদ দিয়া বলিবে, এ শুধু তাঁহার নৈহাটী ও বরানগর ভ্রমণ-বৃত্তান্তের নিছক নকল। দ্বিতীয় বিপদ শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়। কারণ, আমি যদি বলি, দিল্লীতে এবার রেলওয়ে স্টেশন দেখিয়া আসিলাম, তিনি হয়ত কাগজে প্রতিবাদ করিয়া বলিবেন, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র উপন্যাস লিখিয়াছেন। দিল্লীতে স্টেশন বলিয়া কোন-কিছুই নাই, ওখানে রেলগাড়িই যায় না। অতএব, মুশকিল বুঝিতেই পারিতেছ। তবে, গোটাকয়েক নিজের মনের কথা বলা যাইতে পারে। চৌধুরী-মশায় উপন্যাস বলিলেও দুঃখ নাই, শ্রীমান্ রায়বাহাদুর ভ্রমণ-বৃত্তান্ত নয় বলিলেও আপসোস হইবে না।
আমার যাওয়ার ইতিহাস এই প্রকার।
প্রায় মাসখানেক পূর্বে বন্ধুরা একদিন বলিলেন, দেশোদ্ধার করিতে অনেকে দিল্লী কংগ্রেসে যাইতেছেন, তুমিও চল। অস্বীকার করিয়া ফল নাই জানিয়া রাজী হইলাম। ভরসা ছিল, অন্যান্য বারের মত এবারেও ঠিক যাইবার দিন পেটের অসুখ করিবে। কিন্তু এবার তাঁহারা এরূপ দৃষ্টি রাখিলেন যে, তাহার সুযোগই ঘটিল না, রওনা হইতে হইল। সন্ধ্যা নাগাদ আমার প্রবাসের বাহন ভোলার স্কন্ধে আত্মসমর্পণ করিয়া মেল ট্রেনে চাপিয়া বসিলাম। ট্রেনের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। আফিমের ঘোরে সারারাত্রি ধরিয়া আমি তামাক খাইলাম, এবং আমার একমাএ অপরিচিত সহযাত্রী আমাশার বেগে আলো জ্বালাইয়া সারারাত্রি ধরিয়া পায়খানায় গেলেন। ভোর নাগাদ আমিও শ্রান্ত হইয়া পড়িলাম, তাঁহারও হাত-পা অশক্ত অবশ হইয়া আসিল। সুতরাং আলো নিবাইয়া উভয়েই কিয়ৎকাল নিদ্রা দিলাম। সকালে কোন একটা স্টেশনে নামিবার সময় জলের সোরাইটা আমার তিনি দিলেন ভাঙ্গিয়া, এবং উহার টাইম-টেবল্টা আমি রাখিলাম বালিশের নীচে চাপিয়া। অতঃপর বাকী পথটা একাকী নিরুপদ্রবে কাটিল, অবিশ্রাম তামাক খাইয়া গাড়ির ফুলকাটা সাদা ছাতটা কালো করিয়া দিলাম।
এবার দিল্লী কংগ্রেসের পালা। এ সম্বন্ধে এত লোকে এত কলরব এত আস্ফালন করিয়াছে, এত গালি দিয়াছে, জ্বালা ও উদ্দাম আবর্তনের জন্মদান করিয়াছে যে, সেখানে অন্তর বস্তুটি আমার প্রবেশ করিবার বাস্তবিকই পথ খুঁজিয়া পায় নাই। কেবল সাধারণের পরিত্যক্ত, অতি সঙ্কীর্ণ নিরালা একটুখানি পথ সন্ধান করিয়া পাইয়াছিলাম, এবং সেইজন্যই শুধু আমার মনে হয়, মনের মধ্যেটা আমার নিছক ব্যর্থতার গ্লানিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারে নাই।
বাঙ্গালার দেশবন্ধু দাশকে অতিশয় কাছে করিয়া দেখিবার অবকাশ পাইয়াছিলাম। যতই দেখিয়াছি, ততই অকপটে মনে হইয়াছে, এই ভারতবর্ষের এত দেশ এত জাতির মানুষ দিয়া পরিপূর্ণ বিরাট বিপুল এই জনসঙেঘর মধ্যেও এতবড় মানুষ বোধ করি আর একটিও নাই। এমন একান্ত নির্ভীক, এমন শান্ত সমাহিত, দেশের কল্যাণে এমন করিয়া উৎসর্গ-করা জীবন আর কৈ? অনেকদিন পূর্বে তাঁহারই একজন ভক্ত আমাকে বলিয়াছিলেন, দেশবন্ধুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং বাঙ্গালাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা প্রায় তুল্য কথা। কথাটা যে কত বড় সত্য, এই সভার একান্তে বসিয়া আমার বহুবারই তাহা মনে পড়িয়াছে। অথচ, এই বাঙ্গালাদেশেরই কাগজে কাগজে যে তাঁহাকে ছোট বলিয়া লাঞ্ছিত করিয়া, পরের চক্ষে হীন করিয়া প্রতিপন্ন করিবার অবিশ্রাম চেষ্টা চলিয়াছে, এতবড় ক্ষোভের বিষয় কি আর আছে? তাঁহাকে ক্ষুদ্র করিয়া দাঁড় করানোর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাঙ্গালাদেশটাই যে অপরের চক্ষে ক্ষুদ্র হইয়া আসিবে, এমন সহজ কথাটাও যাঁহারা অনুভব করিতে পারেন না, তাঁহাদের লেখার ভিতর দিয়া দেশের কোন্ শুভকার্য সম্পন্ন হইবে? একের সঙ্গে অপরের মত ষোল-আনা মিলিতে না পারে, হয়ত মিলেও না, কিন্তু মতামতের চাইতেও এই মানুষটি যে কত বড়, এ কথা লোকে এত সহজে ভুলিয়া যায় কি করিয়া? তাঁহার প্রতি চাহিয়া বিভিন্ন জনতার এই বিপুল হট্টগোলের মাঝখানে বসিয়াও এ কথা আমার বারবার মনে হইয়াছে যে, এই সাধারণ মানুষটি তাঁহার জীবদ্দশায় কতখানি দেশোদ্ধার করিয়া যাইবেন, তাহা ঠিক জানি না, কিন্তু যে অসাধারণ চরিত্রখানি তিনি দেশবাসীর অনাগত বংশধরগণের জন্য রাখিয়া যাইবেন, তাহা তার চেয়েও সহস্র গুণে বড়। কাগজের গালিগালাজ এই পরাধীন দেশকে কোনদিনই স্বাধীনতা দিবে না, যে দিবে, সে শুধু এই সকল চরিত্রের ইতিহাস।
এই জাতীয় কংগ্রেসের আর একটা ব্যাপার আমার বেশ মনে আছে, সে হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি। এই ইউনিটির এক অধ্যায় ইতিপূর্বেই সাহারানপুরে অনুষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল। সভাপতি মৌলানা আজাদ সাহেব নাকি উর্দুতে দু-চার কথা বলিয়াছিলেন, কিন্তু মহাত্মাজীর অশেষ প্রীতিভাজন মৌলনা মহম্মদ আলি এ সম্বন্ধে নীরব হইয়া রহিলেন। তা থাকুন, কিন্তু তথাপি শুনিতে পাইলাম, হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি একদিন জাতীয় মহাসভার মধ্যে সম্পন্ন হইয়া গেল। সবাই বাহিরে আসিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বলিতে লাগিল—যাক, বাঁচা গেল। চিন্তা আর নাই, নেতারা হিন্দু-মুসলমান সমস্যার শেষ-নিষ্পত্তি করিয়া দিলেন, এবার শুধু কাজ আর কাজ,—শুধু দেশোদ্ধার। প্রতিনিধিরা ছুটি পাইয়া সহাস্যমুখে দলে দলে টাঙ্গা, এক্কা এবং মোটর ভাড়া করিয়া প্রাচীন কীর্তিস্তম্ভসকল দেখিতে ছুটিলেন।
সে ত আর এক-আধটা নয়, অনেক। সঙ্গে গাইড, হাতে কাগজ পেন্সিল—কোন্ কোন্ মস্জেদ কয়টা হিন্দু মন্দির ভাঙ্গিয়া তৈয়ার হইয়াছে, কোন্ ভগ্নস্তূপের কতখানি হিন্দু ও কতখানি মোসলেম, কোন্ বিগ্রহের কে কবে নাক এবং কান কাটিয়াছে ইত্যাদি বহু তথ্য ঘুরিয়া ঘুরিয়া সংগ্রহ করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। অবশেষে শ্রান্তদেহে দিনের শেষে গাছতলায় বসিয়া পড়িয়া অনেকেরই দীর্ঘশ্বাসের সহিত মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিতে শুনিলাম—উঃ! হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি! (‘বিজলী’, ২৫ আশ্বিন ১৩৩০)
মানুষের অত্যন্ত সাধের বস্তুই অনেক সময়ে অনাদরে পড়িয়া থাকে। কেন যে থাকে জানি না, কিন্তু নিজের জীবনে বহুবার লক্ষ্য করিয়াছি, যাহাকে সবচেয়ে বেশী দেখিতে চাই, তাহার সঙ্গেই দেখা করা ঘটিয়া উঠে না, যাহাকে সংবাদ দেওয়া সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন, সেই-ই আমার চিঠির জবাব পায় না। শ্রীশ্রীবৃন্দাবন ধামটিও ঠিক এমনি। সুদীর্ঘ জীবনে মনে মনে ইহার দর্শনলাভ কত যে কামনা করিয়াছি তাহার অবধি নাই, অথচ আমার পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের পথের কখনো দক্ষিণে, কখনো বামে ইনিই চিরদিন রহিয়া গেছেন, দেখা আর হয় নাই। এবার ফিরিবার পথে সে ক্রটি আর কিছুতে হইতে দিব না, এই ছিল আমার পণ। দিল্লী পরিত্যাগের আয়োজন করিতেছি, শ্রীমান মন্টু অথবা দিলীপকুমার রায় ব্যস্ত-ব্যাকুলভাবে আমার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার গলা ভাঙ্গা এবং চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত সচেতন। বাসায় তিনি কান খাড়া করিয়াই রহিলেন। অনুমান ও কিছু কিছু জিজ্ঞাসাবাদের দ্বারা বুঝা গেল, এই কয়দিনেই দিল্লীর লোকে তাঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসিয়াছে, তাই আত্মরক্ষার আর কোন উপায় না পাইয়া অপেক্ষাকৃত এই নির্জন স্থানে আসিয়া তিনি আশ্রয় লইয়াছেন। আমার বৃন্দাবন-যাত্রার প্রস্তাবে তিনি তৎক্ষণাৎ সঙ্গে যাইতে স্বীকার করিলেন। বৃন্দাবনের জন্য নয়, দিল্লী ছাড়িয়া হয়ত তখন ল্যাপল্যাণ্ডে যাইতেও মন্টু রাজী হইতেন। আর একজন সঙ্গী জুটিলেন শ্রীমান সুরেশ,—কাশীর ‘অলকা’ মাসিকপত্রের প্রতিষ্ঠাতা। স্থির হইল বৃন্দাবনে আমরা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে গিয়া উঠিব, এবং সুরেশচন্দ্র একদিন পূর্বে গিয়া তথায় আমাদের বাসের বিলি-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করিয়া রাখিবেন।
দিল্লী হইতে শ্রীবৃন্দাবন বেশি দূর নয়। শুভক্ষণ দেখিয়াই যাত্রা করিয়াছিলাম, কিন্তু পথিমধ্যে আকাশ অন্ধকার করিয়া বৃষ্টি নামিল। মথুরা স্টেশনে নামিতে জিনিসপত্র সমস্ত ভিজিয়া গেল, এবং বৃন্দাবনের ছোট গাড়িতে গিয়া যখন উঠিলাম তখন টিকিট কেনা হইল না। আধ-ঘণ্টা পরে সাধের বৃন্দাবনে নামিয়া গাড়ি পাওয়া গেল না, কুলিরা অত্যধিক দাবী করিল, টিকিট-মাস্টার জরিমানা আদায় করিলেন, একগুণ মোটঘাট ভিজিয়া চতুর্গুণ ভারী হইয়া উঠিল এবং পায়ের জুতা হাতে করিয়া সিক্ত বস্ত্রে ক্লান্ত দেহে যখন সেবাশ্রমের উদ্দেশে যাত্রা করা গেল, তখন সন্ধ্যা হয়-হয়; এবং ওয়াকিবহাল এক ব্যক্তিকে আশ্রমের সন্ধান জিজ্ঞাসা করায় সে নিঃসংশয়ে জানাইয়া দিল যে, সে একটা জঙ্গলের মধ্যে ব্যাপার, তথায় যাইবার কোন নির্দিষ্ট রাস্তা নাই এবং দূরত্বও যেমন করিয়া হউক ক্রোশ-দুয়ের কম নয়। মন্টু কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠিল এবং আমার বাহন ভোলা প্রায় হাল ছাড়িয়া দিল। কিন্তু উপায় কি? জলের মধ্যে এই পথের ধারেও ত দাঁড়াইয়া থাকা যায় না; কোথাও ত যাওয়া চাই, অতএব চলিতেই হইল। বৃষ্টি থামার নাম নাই, প্রভূত রজ ছিট্কাইয়া মাথায় উঠিয়াছে, শ্রীকণ্ঠকে পদতল ক্ষত-বিক্ষত, রাত্রি সমাগতপ্রায়, এমনি অবস্থায় দেখা গেল, শ্রীমান সুরেশচন্দ্র একটা চালার আবরণ ভেদ করিয়া বাহির হইতেছে। সে একদিন আগে আসিয়াছে, সে সব জানে, তাহার এইপ্রকার আকস্মিক অভ্যাগমে আমাদের মধ্যে যেন একটা আনন্দ-কলরব উঠিয়া গেল। অপরাহ্ণ-শেষের স্বল্পালোকে দূর হইতে তাহার চেহারা ভাল দেখা যায় নাই, কিন্তু কাছে আসিলে দেখা গেল, মুখ তাহার ভোলার চেয়ে, এমন কি, মন্টুর চেয়েও অধিকতর মলিন। সুরেশ ছেলেটির বয়স কম, কিন্তু এই অল্পবয়সেই সে জ্ঞান লাভ করিয়াছে যে, সংসার দুঃখময়, এখানে প্রফুল্ল হইয়া উঠিবার অধিক অবকাশ নাই। সে গম্ভীর ও সংক্ষেপে সংবাদ দিল যে, বৃন্দাবন কলেরায় প্রায় উজাড় হইয়াছে এবং যে দু-চারজন অবশিষ্ট আছে, তাহারা ডেঙ্গুতে শয্যাগত। কাল সে সেবাশ্রমেই ছিল, সেখানে বামুন নাই, চাকর পলাইয়াছে, ব্রহ্মচারীরা সব জ্বরে মর-মর। গোটা-সাতেক কুকুর আছে, একটার ল্যাজে ঘা, একটা মস্ত রামছাগল আছে তার নাম রামভকত, সে রাজ্যসুদ্ধ লোককে গুঁতাইয়া বেড়ায়। সেবাশ্রমের স্বামীজী বেদানন্দ শুধু ভাল আছেন, আজ তিনি রাঁধিয়াছেন এবং সুরেশ নিজে বাসন মাজিয়াছে। গরম চায়ের আশা ত সুদূরপরাহত, রাত্রে দুটা ভাত পাওয়াই শক্ত। পাশে চাহিয়া দেখিলাম, ভোলা ঊর্ধ্বমুখে বোধ করি তাহার দেশের জগবন্ধু স্মরণ করিতেছে এবং শ্রীমান মন্টুর চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া আমরা আবার গন্তব্যস্থানের অভিমুখেই প্রস্থান করিলাম, কিন্তু সমস্ত পথটায় কাহারও মুখে আর কথা রহিল না।
যথাকালে সেবাশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অধ্যক্ষ স্বামীজী বেদানন্দ আমাদের সানন্দে ও সমাদরে গ্রহণ করিলেন। গরম চা পাইতে কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। কারণ, চাকর না থাকিলেও একজন নূতন দাসী আসিয়াছে। বামুন ঠাকুর কি-একটা অছিলায় দিন-দুই পলাতক ছিল, সেও ভাগ্যক্রমে আজ বিকালে আসিয়া হাজির হইয়াছে। সাতটা কুকুরের কথা ঠিক। একটার ল্যাজেও ঘা আছে বটে।
রামভকত গুঁতায় সত্য, কিন্তু সে কেবল মেয়েদের—পুরুষদের সহিত তাহার খুব ভাব। সুতরাং আমাদের আশঙ্কা নাই। আশ্রমের একজন ব্রহ্মচারী পুরানো ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগিতেছিলেন, কাল তিনি পথ্য পাইবেন। একজন বৈষ্ণবী নব-পরিক্রমা হইতে ফিরিবার পথে কলেরায় আক্রান্ত হইয়াছিল, দিন-দুই হইল তাহার শ্রীবৃন্দাবনলাভ হইয়াছে, এ খবর যথার্থ। সমস্ত পশ্চিমাঞ্চলের ন্যায় এ-শহরেও ডেঙ্গু দেখা দিয়াছে, এ সংবাদও মিথ্যা নয়। অতএব শ্রীমান্ সুরেশকে দোষ দেওয়া যায় না।
শহরের একান্তে যমুনাতটে পনর-কুড়ি বিঘার একখণ্ড ভূমির উপর এই সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠিত। বছর দশ-বার পূর্বে এই বাঙ্গালাদেশেরই একজন ত্যাগী ও কর্মী যুবক কেবলমাত্র নিজের অদম্য শুভেচ্ছাকেই সম্বল করিয়া, এই সেবাশ্রম স্থাপিত করিয়া তাঁহার ইষ্টদেব শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ দেবোদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। আজ এই প্রতিষ্ঠানটির সহিত আপনাকে তিনি বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়াছেন, কিন্তু ইহার প্রত্যেক ইট ও কাঠের সহিত তাঁহার বিগত দিনের কর্ম ও চেষ্টা নিত্য বিজড়িত হইয়া আছে। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না, মনে মনে তাঁহাকে শত ধন্যবাদ দিয়া এই রাত্রেই আবার সকলে মন্দিরাদি দেখিতে বাহিত হইয়া পড়িলাম। স্বামীজী আমাদের পথ দেখাইয়া চলিলেন। বৃষ্টি থামিয়াছে, কিন্তু আকাশ তখনও পরিষ্কার হয় নাই। অধিকাংশ মন্দিরের ভিতরের কাজ শেষ হইয়া তখন দ্বার রুদ্ধ হইয়াছে,—দেখিবার বিশেষ কিছু নাই। লণ্ঠন লইয়া রাস্তা চলিতে হয়,—শ্রীকাদায় ও মাঠের ধোয়া শুক্নো গোক্ষুরফলের তিনকোণা শ্রীকাঁটায় পথ পরিপূর্ণ, স্বামীজী বারবার করিয়া বলিতে লাগিলেন, তোমরা শ্রান্ত, আজ থাক;—কিন্তু থাকি কি করিয়া? শ্রীমান্ সুরেশের বৃন্দাবন-কাহিনী যে রায়বাহাদুর জলধর সেনের হিমালয়-কাহিনীর মত একেবারে অতখানি সত্য নয়,—এই আনন্দাতিশয্য ঘরের মধ্যে আজ আবদ্ধ করিয়া রাখি কি দিয়া ? পারিলাম না। আলো হাতে সত্য সত্যই বাহির হইয়া পড়িলাম।
অথচ, না গেলেই হয়ত ভাল করিতাম। পথ চলার দুঃখের কথা বলিতেছি না, সে ত ছিলই। কিন্তু সেই আবার পুরাতন ইতিহাস। শুনিতে পাইলাম, এখানে ছোট-বড় প্রায় হাজার পাঁচেক মন্দির আছে। কিন্তু অধিকাংশই আধুনিক,—ইংরাজ আমলের। ইংরাজের আর যাহাই দোষ থাক, যে মন্দিরের প্রতি তাহার বিশ্বাস নাই তাহারও চূড়া ভাঙ্গে না। যে-বিগ্রহের সে পূজা করে না তাহারও নাক-কান কাটিয়া দেয় না। অতএব যে-কোন দেবায়তনের মাথার দিকে চাহিলেই বুঝা যায়, ইহার বয়স কত।
স্বামীজী দেখাইয়া দিলেন, ওটি ওমুক জীউর মন্দির সম্রাট আওরঙ্গজেব ধ্বংস করিয়াছেন, ওটি ওমুক জীউর মন্দির ওমুক বাদশাহ ভূমিসাৎ করিয়াছেন, ওটি ওমুক দেবায়তন ভাঙ্গিয়া মস্জেদ তৈরি হইয়াছে; ওখানে আর কেন যাইবে, আসল বিগ্রহ নাই,—নূতন গড়াইয়া রাখা হইয়াছে,—ইত্যাদি পুণ্যময় কাহিনীতে চিত্ত একেবারে মধুময় করিয়া আমরা অনেক রাত্রে আশ্রমে ফিরিয়া আসিলাম। পথে সুরেশচন্দ্র নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,—যাক্, সে অনেককালের কথা।
স্বামীজী কহিলেন, কালের জন্য আসিয়া যায় না সুরেশ, মন্দির ভাঙ্গিয়া মস্জেদ ও বিগ্রহ দিয়া সিঁড়ি তৈরির সুযোগ আর নাই,—এই যা তোমাদের ভরসা। তোমরা কংগ্রেসের দল ইংরাজ-রাজার এই গুণটা অন্ততঃ স্বীকার করো।
এই বৃন্দাবনে এক মারবাড়ী ধনী কানা খোঁড়া কালা অন্ধ খঞ্জ সমস্ত বৈষ্ণবীদেরই বৈকুণ্ঠে চড়িবার এক অদ্ভুত লিফ্ট প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন শুনা গেল। সুরেশচন্দ্র ত এই মারবাড়ীর ধর্মপ্রাণতায়, বুদ্ধির সূক্ষ্মতায় ও ফন্দির অপরূপত্বে একপ্রকার মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল। দেখা হওয়া পর্যন্ত ত এই কথাই সে আমাদের এক-শ’বার করিয়া বলিতে লাগিল, এবং পরদিন সকাল হইতে না হইতে আমাদের সে সর্বকর্ম ফেলিয়া সেইদিকে টানিয়া লইয়া গেল। একটা ঘেরা জায়গায় নানা বয়সের শ’-দুই-তিন বৈষ্ণবী সারি দিয়া বসিয়াছে, প্রত্যেকের হাতে এক-এক জোড়া খঞ্জনী। তাহারা সেই বাদ্য-যন্ত্র সহযোগে সুর করিয়া অবিশ্রাম আবৃত্তি করিতেছে—নিতাই গৌর রাধে শ্যাম, হরে কৃষ্ণ হরে রাম। তাহাদের মাঝখান দিয়া পথ। দুই-তিনজন মারবাড়ী কর্মচারী অনুক্ষণ ঘুরিয়া ঘুরিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিয়াছে—কেহ ফাঁকি না দেয়। এইভাবে প্রত্যহ বেলা এগারোটা পর্যন্ত তাহারা বৈষ্ণবী ধর্ম পালন করিলে আধ সের করিয়া আটা পায়, এবং সন্ধ্যাকালে এইমত রুটিনে পরকালের কাজ করিলে এক আনা করিয়া পয়সা পায়। প্রভাতকাল। জন-দুই বুড়া বৈষ্ণবীর তখন পর্যন্ত ঘুম ছাড়ে নাই, তাহারা ঢুলিতেছিল, একজন আধা-বয়সী বৈষ্ণবী তাহার পাশের বৈষ্ণবীর সহিত চাপা-গলায় তুমুল কলহ করিতেছিল। আমরা হঠাৎ প্রবেশ করিতেই বৃদ্ধা দুইটি চমকিয়া উঠিয়া নামগান শুরু করিল এবং যাহারা বিবাদ করিতে ব্যস্ত ছিল, তাহাদের অসমাপ্ত কোন্দল এইপ্রকার আকস্মিক বাধায় বুকের মধ্যে যেন পাক খাইয়া ফিরিতে লাগিল। বিরক্তি ও ক্রোধে মুখ তাহাদের কালো হইয়া উঠিল।
সেই ক্রুদ্ধ মুখের নামকীর্তন ভাগ্যে গিয়া গৌর-নিতাইয়ের কানে পৌছায় না! জন-কয়েক কম-বয়েসী চালাক বৈষ্ণবী দেখিলাম, তালে তালে শুধু হাঁ করে এবং ঠোঁট নাড়ে। চেঁচাইয়া শক্তি ক্ষয় করে না। কিন্তু সকলের মুখে-চোখেই ঠিক পাউন্ডে আটকানো গরু-বাছুরের ন্যায় অবসন্ন করুণ চাহনি। দেখিলে ক্লেশ বোধ হয়। মারবাড়ীরা কিন্তু অত্যন্ত উৎফুল্ল। তাহারা নিজেদের সদনুষ্ঠানের কথা সগর্বে বারংবার বলিতে লাগিল। আর একটা ইঙ্গিতও প্রকারান্তরে করিতে ছাড়িল না যে, কোন একটা উপায়ে ইহাদের আবদ্ধ না রাখিতে পারিলে অসৎপথে যাইবারও বিলক্ষণ সম্ভাবনা।
সম্ভাবনা ত আছেই। তথাপি, ফিরিবার পথে আমাদের কেবলই মনে হইতে লাগিল, ইহার প্রয়োজন ছিল না,—এই ফন্দি অসাধু! ধর্ম বস্তুটাকে এমন করিয়া উপহাস করা অন্যায়! ছলে, বলে, কৌশলে মানুষকে ধার্মিক করিতেই হইবে—ইহা কিসের জন্য? এই যে মারবাড়ী ধনী কতকগুলি নিরুৎসুক উদাসীন বুভুক্ষু প্রাণীকে আহারের লোভে প্রলুব্ধ করিয়া ভগবানের নাম-কীর্তনে বাধ্য করিয়াছে, ইহার মূল্য কতটুকু? অথচ, এইরূপ জবরদস্তির দ্বারাই ধর্মচর্চায় নিরত করা সকল ধর্মেরই একটা প্রচলিত পদ্ধতি। কোনটা বা ব্যক্ত, কোনটা বা গুপ্ত, এই যা বিভেদ। এবং মারবাড়ী প্রসন্নচিত্তে ইহাই অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে মাত্র। এই ব্যক্তিকেই আর একদিন প্রশ্ন করিয়াছিলাম, তোমরা এত খরচ কর, কিন্তু সেবাশ্রমে সাহায্য কর না কেন? সে স্বচ্ছন্দে জবাব দিল, সেবাশ্রমের সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীরা ঔষধ দেয়, যে-সে জাতের মড়া ফেলে, রোগীর সেবা করে—এইসব কি সাধুর কাজ? সাধু সুদ্ধাচারী হইবে, ভজন-সাধন করিবে, তবেই ত সে সাধু।
মনে মনে বলিলাম, তাই বটে! তা না হইলে আর আমাদের এই দশা!