দিনের বাগানে
বিধান আমার কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে পাশ কাটিয়ে সরে পড়েছিলুম। ধার দেবার মতো টাকা যে আমার ছিল না তা নয়, ব্যাঙ্কে আমার জমে, মাসে মাসেই জমে। জমতে জমতে বেশ কিছু জমেছে। জমাবার একটা নেশা আছে। দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার। মাঝে মাঝে পাশবই দেখি আর উৎফুল্ল হয়ে উঠি। বা: কি সুন্দর বেড়ে চলেছে।! বৃষ্টির জলে বালতি পাতার মতো। ধীরে ধীরে বাড়ছে। এক সময় উপচে পড়বে। পারতপক্ষে আমি জমা টাকা ভাঙি না। যেখান থেকে যা আসে সব জমা করে দি। হঠাৎ নিজের কোনো প্রয়োজন হলে অন্যের কাছ থেকে ধার করে চালাই। পরে শোধ করে দি।
বিধান বলে গেল, বড়ো বিপদে পড়ে গেছি রে! পেলে ভীষণ ভালো হত!
আমি উদাস মুখে শুনে গেলাম। এমন একটা ভাব করলুম, যেন এই মুহূর্তে ধারে আমার কিছু টাকা পেলে ভালো হয়! দূর কোনো এক আত্মীয়ের অলীক অসুখের কথা শুনিয়ে দিলুম। অভিনয় মনে হয় ভালোই করেছিলুম। মিথ্যে বলারও একটা কায়দা আছে। সবাই তেমন পারে না, ধরা পড়ে যায়। মিথ্যেটাকে এমন করে বলতে হবে, যেন সত্যের চেয়ে সত্য হয়ে ওঠে। প্রখর কল্পনা আর স্মৃতিশক্তি থাকা চাই। আজ কী বললুম, কাল যেন তা মনে থাকে!
বিধানের স্ত্রী প্রায় মরো মরো। ডেলিভারি গোলমাল হয়ে গিয়ে প্রায় যায় যায়! পড়ে আছে নার্সিংহোমে। বিধানের বরাতটাই মন্দ। ছেলেটা ভালো চাকরি করত, মাইনেও তেমন খারাপ ছিল না। পোজিশান ছিল। বিয়ে করলে নিজেই দেখেশুনে। বউও নেহাৎ খারাপ হল না। হঠাৎ শুরু হয়ে গেল স্ট্রাইক। স্ট্রাইক থেকে লকআউট। সেই লকআউট চলছে। বেচারা মাইনেপত্তর পায় না, বছর ঘুরে গেল। পুঁজি ভেঙে ভেঙে শেষ।
এমন মানুষকে টাকা ধার দেবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। বিধানের ভবিষ্যৎ কী? কিছুই না। একেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থা। যা নেবে তা আর শোধ করতে পারবে না। চাইতেও পারব না। দিলে একেবারেই দিয়ে দিতে হবে! দানধ্যান করা ভালো। কারা করবে? যাদের কালো টাকা আছে। আমাদের মতো মানুষের আছে কী! যেটুকু সঞ্চয়, সেইটুকুই শেষের ভরসা। কেউ তো তখন দেখবে না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন, তখন কোথায়! বিধানকে এসব বোঝাবে কে?
বিধান সেই যে চলে গেল, আর দেখা নেই। আমিও খোঁজপাত করিনি। বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার কম হয়নি। বুদ্ধিরও খুব একটা অভাব আছে বলে মনে হয়নি কোনোদিন! কেমন গুছিয়ে সংসার করছি! সংসার করা আর যুদ্ধ করা প্রায় এক জিনিস! আজকাল যা বাজার পড়েছে! আমি জানতুম, বিধানের সঙ্গে আবার দেখা হওয়া মানেই টাকার কাঁদুনি শোনা। শোনা মানেই, মন খচ খচ করা। বিবেক বলবে, তোর রয়েছে, তবু দিতে পারিস, তুই দিলি না, ব্যাটা আত্মপর! বিবেক একটা বেয়াড়া জিনিস ঠোঁটকাটা সমালোচক। বিধানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মানেই একটা অপরাধবোধ নিয়ে ফিরে আসা।
দ্বিতীয় কারণ আমি খেরেস্তানী প্রথা বিশ্বাস করি না। বিপদে মানুষের জন্যে যদি কিছু করতে পার তো পাশে গিয়ে দাঁড়াও, তা না হলে, ওই দেঁতো ভদ্রতা! কী রে বিধান, তোর বউ কেমন আছে এ প্রশ্ন যেন একটা আদিখ্যেতা! ওই কারণে আমার আত্মীয়স্বজন বিপদে পড়লেও আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াই না। এখনকার কালের করা মানে টাকা দিয়ে করা। বেশ প্রাণখুলে কিছু দিতে পারলে, তবেই সকলে বলবে, ওঃ খুব করেছে! কাজে-কম্মেও দেখেছি বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, কে কত দিয়েছে, কেমন দিয়েছে; সেই বিচারে আত্মীয়দের জাত তৈরি হচ্ছে। চিঁড়ে চিরকালই কথায় ভেজে না, ভেজে টাকায়!
একটা কথা আমি সার বুঝেছি, সামাজিক হবার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই! কী হবে সামাজিক হয়ে। লোকসান ছাড়া লাভ নেই! আজ অমুক কাল তমুক। আজ এ আসছে, কাল ও আসছে। রেস্ত ফাঁক। সংসারে কেউ কারুর নয়। টাকাই হল সারাৎসার! ব্যাঙ্কব্যালেন্স থাকা মানেই মান-সম্মান, ভাব-ভালোবাসা, প্রেম-প্রণয়, আদর-যত্ন। শেষ সময় তা না হলে ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসবে। মর ব্যাটা বুড়ো। টাকা থাকলে, অচেনা রাস্তার লোকও টাকার লোভে এসে সেবা করবে। আর ট্যাঁক খালি হয়ে গেলে আপনার লোকও ফিরে তাকাবে না। দুনিয়ার হালচাল আমার জানা হয়ে গেছে।
অনেক কষ্টে, অনেক পরিশ্রম করে আমার রোজগার। কিছু টাকা আমার ফিক্সড ডিপোজিটে আছে। পনেরো বছর পরে ডবল হয়ে ফিরে আসবে। বিকাশবাবুর পরামর্শে ইউনিট কিনতে শুরু করেছি। ইউনিটের দাম কমে না, বেড়েই বলে। তা ছাড়া আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে, যেখানে টাকা খাটালে সুদেই সংসার চলে যায়, আসলে আর হাত পড়ে না। বেশ একটা সুখ সুখ ভাবে জীবন কাটছে। ভবিষ্যৎ আমার রঙিন। যে প্ল্যানে চলেছি তাতে কারুর ক্ষমতা নেই আমাকে পথে বসায়। স্ট্রাইক, লকআউট, ক্লোজার, ডিসচার্জ কোনো কিছুরই আমি আর পরোয়া করি না।
এইবার ছোট্ট একটা বাড়ি তৈরি করব। দালাল লাগিয়েছি। জায়গা জমি দেখা চলছে। দাঁও বুঝে মেরে দোব ঠিক। বিধবার বা বিবাদের সম্পত্তি অনেক সময় জলের দরে মিলে যায়। সন্ধান রাখতে হয়। কালেকটারিতে আমার লোক আছে। তাকে তোয়াজে রেখেছি। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। আমার এমন কিছু বয়েস হয়নি যে তাড়াহুড়ো করতে হবে। এখনও অনেক সময় আছে। একটিমাত্র ছেলে আমার। সংসার আর বাড়াচ্ছি না। আনন্দ করতে হয় তো বাঁকা পথে করব। তাতে খরচ অনেক কম। আমি হিসেব করে দেখেছি। আমার নীতিতে সংযমের ব্যাখ্যা দেবতার মতো চরিত্র নয়। মানুষ কখনও দেবতা হতে পারে না। তার ভোগ থাকবে, দুর্ভোগ থাকবে। লোভ থাকবে, লালসা থাকবে। সংসারী মানুষের হাজার বায়নাক্কা। সংযম মানে হিসেব করে নিজেকে খরচ করা।
দিন দুয়েক পরে বিধানের সঙ্গে বাজারে দেখা হল। উসকোখুসকো চেহারা। দেখেই বুঝেছি খবর সুবিধের নয়। পাশ কাটিয়ে সরে পড়ার তালে ছিলুম। কী জানি বাবা, বউ মরলে শ্রাদ্ধ করতে হয় কি না! এখুনি হয়তো সেই ছুতোয় আবার টাকা চেয়ে বসবে। সামনে একটা গোরু পড়ায় বিধান ধরে ফেললে। বাধ্য হয়েই জিগ্যেস করতে হল, কী হে খবর কী?
সংসারে গা বাঁচিয়ে চলতে হলে একটু অভিনয় ক্ষমতা থাকলে ভালো হয়। তাতে বদনাম একটু কম হয়। ভুরুটুরু কুঁচকে এমনভাবে প্রশ্নটা করলুম, যেন কদিন উৎকন্ঠায় আমার ঘুম হচ্ছিল না।
বিধান করুণ হেসে বললে, সব শেষ হয়ে গেছে ভাই। আর তোদের ভয় নেই।
আদিখ্যেতা! বউ এমন একটা কিছু পরম পদার্থ জিনিস নয়। এক গেলে আর এক আসবে। বাংলাদেশে মেয়ের অভাব! তুই আজ ঘাড় নাড়লে কালই তোকে পিঁড়েতে বসিয়ে দোব টোপর পরিয়ে। প্যান প্যান করিসনি বাপু। বউ মরা অনেক মিঞাকেই আমি চিনি। সব দ্বোজপক্ষ, তেজপক্ষ হয়ে আন্ডাগ্যান্ডা নিয়ে সংসার করছে। দেয়ালে প্রথমপক্ষ ছবি হয়ে কেতরে ঝুলছে। কাছে গিয়ে কাঁচে আঙুল ঠেকালে তবেই শরীরের এক টিপ নজরে পড়ে। বউরা বেশ ভালোই জানে, স্বামী কী বস্তু! বেঁচে থেকেই সামলান যায় না, মরে গেল তো কথাই নেই। বাঁধা গোরু ছাড়া পায়। বিধু প্রেততত্ত্ব কিছুই জানে না। বউরা মরে ভূত হয়। ভূত হয়ে সব দেখে নেয়। তারপর জন্মে আবার বউ হয়। তাই তো বউরা স্বামীদের পয়লা নম্বর শত্রু হয়ে ওঠে। যত দিন যায় ততই প্রবল আকার ধারণ করে। বউ এক প্রকার কঠিন ব্যামো। মরেছে, তুই বেঁচেছিস বিধু। তোর ক্রনিক ব্যাধি সারল। পুজো দে, পুজো দে!
এসব কথা তো আর বলা যাবে না। করুণ মুখে চুক চুক শব্দ করে দুঃখপ্রকাশ করলুম।
বিধু সরে পড়ল। কী আর করবে! কে কার দুঃখের কথা শোনে। মানুষের আর অত সময় নেই। সবাই বড়ো ব্যস্ত। মৃত্যুর আর তেমন ধার নেই, ভোঁতা হয়ে গেছে। আমারও তাড়া আছে। আড়কাঠির কাছ থেকে খবর পেয়েছি, উত্তরপাড়ায় এক পরিবারে ভাঙন ধরেছে। পৈতৃক সম্পত্তি বেচে বেচে এক বঙ্গসন্তান একটু ওড়া-উড়ি করছে। দেনায় বুক পর্যন্ত ডুবেছে, আর একটু মদত পেলেই ভরাডুবি হবে। সব উড়ে গিয়ে বাবুর এখন একমাত্র সম্বল বসত-বাড়িটি। সেটি না বেচলে পাওনাদারের হাতে প্রাণ যাবে। এখন একটু উৎসাহ পেলেই কাজ হাসিল। দুনিয়ার এইটাই তো নিয়ম! একজন ক্ষয় হয় আর একজন পূর্ণ হয়। নদীর একদিক ভাঙে আর এক দিক গড়ে ওঠে। একদিকে মজে চর ভেসে ওঠে, সঙ্গেসঙ্গে সুযোগসন্ধানী মানুষের দল এসে দখল করে বসে, ফুটি আর তরমুজের চাষ বসে যায়।
আমার আবার শরীরের কী ব্যামো ধরল কে জানে! ডাক্তারবদ্যি করা মানেই হাজাররকম ফিরিস্তি বেরোবে। ভয় দেখিয়ে কিছু টাকার শ্রাদ্ধ করে ছেড়ে দেবে। মানুষকে ঘায়েল করার জন্যে লোকে অভিশাপ দেয়, তোর বাড়িতে উকিল ঢুকুক, বদ্যি ঢুকুক। একটা মানুষকে ফতুর করতে মামলা আর ব্যামো, দুটো মোক্ষম অস্ত্র। ও পথে সহজে আমি পা বাড়াচ্ছি না। আমার নিজের জানা কিছু টোটকা-টুটকি আছে, হোমিয়োপ্যাথি আছে। ওইতেই সামাল দিতে হবে! লোক তো আমি খারাপ নই। কারুর উপকারে নেই, এই যা আমার দোষ, তা ছাড়া আমার সবই ভালো। নেশাভাঙ করি না। বদখেয়াল নেই। তা হলে হোমিওপ্যাথিতে কেন কাজ হবে না!
ব্রিজ পেরিয়ে উত্তরপাড়ায় বাস থেকে নামার সঙ্গেসঙ্গে পেটের পুরোনো ব্যথাটা এমন চাগাড় দিয়ে উঠল, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না। এ আবার কী হল ছাই! যাচ্ছি একটা শুভ কাজে। একজন বঙ্গসন্তান বিপদে পড়েছে! তাকে পথে বসাতে হবে। সব গেলেই তবে না তার চেতনা আসবে। এ জন্মে তার আর ওঠার সাধ্য হবে না ঠিকই তবে সামনের জন্মে এ জন্মের শিক্ষা অবশ্য কাজে লাগবে। প্রথম থেকেই বুঝতে শিখবে, কী করলে কী হয়।
কিন্তু শরীর যদি এমন বেগোড়বাঁই করে মানুষের কিছু ভালো লাগে! পেটে কী যে দুশমন ঢুকল! শরীর গোলমাল করলে ধর্মও হয় না, অধর্মও হয় না। ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। রিকশা লাফাচ্ছে, ব্যথাও লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। মাঝেমধ্যে ভোগায়, তবে আজ যেন বড়ো বেশি ভোগাচ্ছে!
কোনোরকমে গোলোক সাঁতরার বাড়িতে এলুম। সেই আমাকে নিয়ে যাবে। সাঁতরা তৈরিই ছিল। আমার চেহারা দেখে বলল, কী হয়েছে আপনার! শরীর খারাপ লাগছে! কীরকম যেন দেখাচ্ছে! চোখমুখ কালো হয়ে গেছে।
আমার আর তখন কথা বলার ক্ষমতা নেই। পেট চেপে ধরে একটা চেয়ারে বসে পড়লুম। সাঁতরা ভয় পেয়ে গেল। আমি হলে আমিও পেতুম। উড়ো ঝামেলা। কেউ কারুর বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভালো লাগে! কাজ বেড়ে যায়। তাকে বলাও যায় না, যান মশাই বাড়ি যান। মরতে হয় বাড়িতে গিয়েই মরুন। মানুষ এখনও অতটা ঠোঁটকাটা হতে পারেনি। রাস্তায় ঘাটে কেউ খাবি খেলে, না দেখে চলে যাওয়া যায়! আমরা তো কেউ বাইবেল পড়া খ্রিশ্চান নই। চেনা লোক বাড়িতে এসে চিতিয়ে পড়লে মেজাজ খিঁচড়ে যায়। সামনা-সামনি না বলতে পারলেও, অন্দরে এসে বলা যায়, কী আপদ! ব্যাটা রোববারটাই মাটি করে দিলে! নাও এখন বোঝো ঠ্যালা! আমি হলে তাই বলতুম। আমার ছোটো শ্যালক গত বছর বেড়াতে এসে মায়ের দয়া বাঁধিয়ে বসল। উঃ সে এক জ্বালা! তিন দিনের জন্যে বেড়াতে এসে, দেড়মাস উস্তমখুস্তম করে গেল। সেই সময় আমার মেজাজ যা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, বউ যদি গোলাপফুল হয় শ্যালকরা সব গোলাপের কাঁটা।
গোলোক বললে, বিশ্বাস মশাই, গাড়ি ডেকে দি, আপনি বরং বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। শরীর সুস্থ হলে, বিষয়সম্পত্তি হবে। শরীরম আদ্যম।
ব্যাটা! সংস্কৃত কলি আওড়াচ্ছে। জিজ্ঞেস করলুম, কাছাকাছি কোনো ডাক্তার নেই?
গোলোক বললে, নিজের ডাক্তার দ্যাখানোই ভালো। তিনি আপনার ধাত বোঝেন। এক পুরিয়াতেই ঠিক করে দেবেন।
গোলোকের গোলোকধাম থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে বাড়ি চলে এলুম। এ আমার কী হল! বাড়ির লোকের সব কিছু সহজ করে নেবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা থাকে। ও তোমার অম্বল, ও তোমার আমাশা বলে যে যার পাশ কাটিয়ে সরে পড়ল। একটু গরমজল খাও। একটু জোয়ানের আরক খাও। নানা জনের নানা পরামর্শ।
সন্ধ্যের দিকে পায়ে পায়ে একবার ডাক্তারবাবুর কাছে যেতেই হল। আগে ডিসপেন্সারিতে বিনাপয়সায় হত। এখন সব খাঁই বেড়েছে। দশ টাকা কনসালটেশান ফি লাগে। কী দিনকাল হল! প্রবীণ ডাক্তারবাবু মন দিয়ে সব শুনলেন।
প্রশ্ন করলেন, কত দিন এইরকম হচ্ছে?
হচ্ছে অনেকদিনই। তবে এই বছরখানেক বেশ যেন বাড়াবাড়ি হয়েছে। খেতে পারি না। খেলেও হজম হয় না। মনে হয় গলার কাছে সব আটকে যাচ্ছে।
হুঁ, বলে ডাক্তারবাবু বেশ যেন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমার চেয়েও বড়ো অভিনেতা। দেবেন সেই হজমের ওষুধ, তার আগে এমন একটা ভাব করছেন, যেন কী-না-কী হয়েছে। যত সব ব্যবসাদারী চাল।
আচ্ছা নিন, শুয়ে পড়ুন।
শুতে শুতে ভাবলুম, একবার যখন এসেছি তখন আপনি কী আর না শুইয়ে ছাড়বেন! কত পরিবার এই ভাবে শুয়ে পড়ছে! এক-একটাকে ধরছেন আর শুইয়ে দিচ্ছেন। সেই যে শোয়াচ্ছেন, রেস্তোর জোর না থাকলে ওঠে কার বাপের সাধ্যি!
চতুর্দিক টিপেটুপে, বুক দেখে, প্রেসার মেপে, ফুটখানেক লম্বা, ঘিচিঘিচি লেখা এক প্রেসক্রিপসান ছাড়লেন। অত ওষুধ কে খাবে! পাগল নাকি।
জিগ্যেস করলুম, ডাক্তারবাবু এর মধ্যে কোনটা কাজের?
তার মানে?
ভীষণ রেগে গেছেন। রাগলে কী হবে! আমি শুনেছি, কাঁচের জানলার দিকে এক মুঠো ঢ্যালা ছোঁড়ার মতো, ওঁরা যেকোনো অসুখের দিকে এক মুঠো ক্যাপসুল ছোঁড়েন। যেটা লেগে যায়।
মানে কোনটা খেলে পেটের ব্যথা কমবে!
আপনার কী ধারণা, আমরা এখানে খেলা করার জন্যে বসে আছি! নিজের চিকিৎসা নিজেই তাহলে করুন। আমাদের কাছে আসার কী দরকার!
ওষুধের দোকানের ভদ্রলোক বললেন, তিন নম্বর ওষুধটা হল ব্যথা কমাবার।
তাহলে ওইটাই দিয়ে দিন গোটাচারেক। বাকি সব থাক।
সেটা কী ঠিক হবে!
ঠিক বেঠিক আমি বুঝব!
দিন তিনেক মোটামুটি ভালোই চলল। তারপর শুরু হল বাড়াবাড়ি। যা খাই, সবই বেরিয়ে আসে। একেবারে কাহিল অবস্থা। মরতে আমি ভয় পাই না। আমার ভয়, এত কষ্ট করে, পথঘাট বেঁধে সব গোছগাছ করে তুললুম, ভোগ করবে কে! নেপোয় দই মেরে যাবে। মরেও শান্তি পাব না। অনেক আদর্শবাদী মূর্খ বউয়ের জন্যে সমাধি বানায়। ছেলের জন্যে ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। মেয়ের বিয়ের জন্যে অ্যাকাউন্ট খোলে। তারা মনে হয় রামপ্রসাদের সেই গানটা শোনেনি:
যার জন্য মর ভেবে, সে কী তোমার সঙ্গে যাবে।
সেই প্রেয়সী গোবর ছড়া দিবে, অমঙ্গল হবে বলে।।
আমার বাবা বিলিতি মেজাজ। নিজের রোজগার নিজে উড়িয়ে যাও, ভোগ করে যাও। অবর্তমানে নিজেদের ব্যবস্থা নিজে করে নাও।
এবার একজন বড়ো ডাক্তার এলেন। এঁদের মধ্যেও আবার দশ আনি, ছ আনি আছে। ইনি হলেন চৌষট্টি পরগনার মনসবদার। প্রথমে দূর থেকে দেখলেন। দেখতে দেখতে শুনলেন। তারপর পেটের একটা দিক ঘ্যাঁক করে চেপে ধরলেন।
মিনিট দশেকের মধ্যেই রায় বেরোলো, আমি ভালো বুঝছি না। আরও ভালো করে বুঝতে হবে। সন্দেহ হচ্ছে ক্যানসার।
অ্যাঁ, বলেন কী?
চৌষট্টিটা টাকা পকেটে গুঁজতে গুঁজতে তিনি অম্লানবদনে বললেন, আজকাল খুব হচ্ছে। প্রথমে তেমন ধরা যায় না। পেটে হলে তো একেবারেই ধরা যায় না। অনেকটা এগোলে তবেই ধরা পড়ে, আর তখন!
ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন, নিয়তির মতো হেসে কথা শেষ করলেন, তখন আর কিছুই করার থাকে না।
হঠাৎ পৃথিবীর আলো যেন কমে এল। মনে হতে লাগল, যা করছি সবই যেন সন্ধ্যের আধো অন্ধকারে। তেল ফুরোনো বাতি যেন চোখের সামনে জ্বলছে। বালিশের তলায় হাতঘড়ি রেখে শুলে যেমন হয়। সময়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। চলছে, অনবরতই চলছে, টিক টিক করে।
বিকেলের দিকে বিধান এল। কার কাছ থেকে খবর পেয়েছে।
শুনলুম তোর নাকি শরীর খারাপ হয়েছে রে! দেখলুম বড়ো ডাক্তার এসেছিলেন!
অন্য সময় হলে, আমার স্বভাব অনুসারে বিধানকে পাত্তা দিতুম না। এখন নিজেকে যেন বড়ো নি:সঙ্গ লাগছে। মনে হচ্ছে মৃত্যুনদীর তীরে গালে হাত দিয়ে বসে আছি একা। মৃত্যুপথে সঙ্গী পাওয়া যায় না। মৃত্যু তো সকলকে একসঙ্গে ডাকে না। এক এক করে ডেকে নেয়। এ তো তীর্থে যাওয়া নয়। পিকনিকে যাওয়া নয়, যে সবাই একসঙ্গে দল বেঁধে হইহই করে গান গাইতে গাইতে যাব। শেষ যাত্রাপথে মানুষকে একাই যেতে হয়।
বিধানের মুখ দেখে মনে হল, আমার সঙ্গে মজা করতে আসেনি। হালফিল মৃত্যু এসে তার জীবনের সব চেয়ে প্রিয়জনকে তুলে নিয়ে গেছে। মৃত্যুর আঁচড় এখনও লেগে আছে মুখে। দূরযাত্রায় কাউকে বিদায় জানিয়ে আসার পর মানুষের মুখের অবস্থা যেমন হয়ে থাকে, বিধানের মুখের অবস্থা সেইরকম হয়ে আছে।
আমি বিধানকে আজ বসতে বললুম। আর্থিক দুর্দশায় আছে বলে, আজ আর ঘৃণা করতে পারা গেল না।
বিধান বললে, কী হয়েছে তোর?
ডাক্তারবাবু সন্দেহ করছেন ক্যানসার। বলে গেলেন, আরও ভালো করে দেখতে হবে।
সে কী রে?
মনে হল না বিধান অভিনয় করছে। যথেষ্ট আন্তরিকতা রয়েছে। বিধান বললে, যা:, ক্যানসার হওয়া অত সহজ নাকি!
কী বলব বল! তাই তো বলে গেলেন!
তুই আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি?
হ্যোমিয়োপ্যাথি?
না না, ক্যানসারের কাছে ওসব শিশু। তোকে একবার ক্যানসার হসপিট্যালে নিয়ে যাব, সেখানে আমার একজন চেনাশোনা আছেন।
বিধানের সঙ্গে পরের দিনই সকালে হাসপাতালে গেলুম। যাঁর কাছে গেলুম তিনি ডাক্তার নন, তবে ডাক্তারবাবুরা তাঁর হাতের মুঠোয়। বিধানের শ্বশুরবাড়ির তরফের আত্মীয়! তিনি সঙ্গে- সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। শরীরের ভেতরের খবর জানার জন্যে ভেতরের যেসব জিনিস নেওয়া প্রয়োজন সবই তাঁরা টেনেটুনে বের করে নিলেন। বললেন, রায় জানা যাবে কয়েক দিন পরে।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমার ভীষণ কান্না পেল। কেঁদে ফেলতে পারলে মানুষের ভেতরটা অনেক ঝরঝরে হয়ে যায়। কান্না কান্না ভাব অথচ কাঁদতে পারছি না, এর মতো কষ্টের আর কিছু নেই। ভেতরটা কেমন যেন ফেটে যায়। বিধানকে সেই সময় কিছু টাকা দিলে ওর স্ত্রী হয়তো বেঁচে যেত। অবশ্য ভাগ্যবাদীরা বলবেন, জীবনমৃত্যুর ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। তাতে কিন্তু আমার অপরাধবোধ কমছে না। আমি দিতে পারতুম; কিন্তু দিই নি। বিধানের তুলনায় আমি অনেক নীচ। দু-জনের খোলে বিশেষ তফাৎ নেই; তফাৎ এই, বিধানের মনটা অনেক বড়ো।
বিধানকে বললুম, আমি এখন সন্দেশ খাব। কোথায় ভালো নরমপাক সন্দেশ পাওয়া যায়? সন্দেশ নিশ্চয়ই খাওয়া যায়।
বিধান বলল, খুব যায়। আরে তুমি এখনই অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? ক্যানসার বললেই ক্যানসার! আমার মনে হয় তোমার আলসার হয়েছে। সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করো না। একগুঁয়ে স্বভাবের লোক!
একটা ভালো দোকানে ঢুকে দু-তিনরকম সন্দেশের অর্ডার দিলুম। মনে করেছিলুম, খুব খাব। দুটো খাবার পরেই পেটটা ভীষণ ভার হয়ে গেল। বিধান কিছুতেই আমাকে দাম দিতে দেবে না। আমি বললুম, তোর এখন টানাটানি যাচ্ছে।
বিধান বললে, তোকে একটা সুখবর দি। আমার ফ্যাক্টরি খুলে গেছে রে। বকেয়া কিছু টাকাও পেয়েছি। এই টাকাটা যদি মাসখানেক আগে পেতুম, তা হলে হয়তো…
বুকপকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে সেই দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বিধান বসে রইল। আমার তখনই মনে হল প্রিয়জন চলে গেলে মানুষের যে বেদনা তার মধ্যে অভিনয় নেই। মানুষ প্রকৃতই কষ্ট পায়! কেউ প্রকাশ করে কেউ চেপে রাখে। বিধানকে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। ‘হয়তো’ এমন একটা শব্দ যা খুলে দেখা যায় না। হলে জানা যায়। পেটের সন্তানের মতো।
বিধান আমাকে গাড়িভাড়া পর্যন্ত দিতে দিলে না। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল যত্ন করে। বলে গেল সন্ধ্যের পর আবার আসবে। বাড়িতে পা রাখতেই মনে হল, সব ভোজবাজি। ডাক এলে কেউ কাউকে ধরে রাখতে পারবে না। মানুষ যেন বাগানের ফুল। ফুটল, গন্ধ ছড়াল, একটু শোভা দিল, দিল ফুরোলেই ঝরে গেল।
অসুস্থ মানুষ যদি মনে করে থাকে, সবাই তাকে ঘিরে বসে আহা, উহু করবে, যন্ত্রণার অংশীদার হবে, উদ্বেগে চব্বিশ ঘণ্টা ম্রিয়মাণ হয়ে আসবে, সে মূর্খ। যন্ত্রণার অংশীদার হয় না। অংশীদার হয় আনন্দের। আমি আমার ঘরে একাই বসে রইলুম। হাতের কাছে রেডিয়ো। ঘোরাতেই ফুটে উঠল সংবাদ। স্থানীয় সংবাদের পাঠক আমার দিকে যেন ঘুঁষি ছুঁড়লেন। একটা জায়গায় আমার বেশ কিছু টাকা ইনভেস্ট করা ছিল। সেই প্রতিষ্ঠান লাটে উঠেছে। কর্মকর্তা পুলিসের হেফাজতে। মানুষ হায় হায় করছে।
মনের বাঁধন একেবারে আলগা হয়ে গেল। অনেক দিন আগে আমি একটি লোককে হঠাৎ মরে যেতে দেখেছিলুম। দৃশ্যটা ভুলি নি। ভদ্রলোক একটা দোকান থেকে অনেক প্যাকেট বুকে চেপে ধরে বেরোচ্ছিলেন। হঠাৎ স্ট্রোক। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে একের পর এক সব পড়ে যেতে লাগল। আর একটা ঘটনাও মনে পড়ছে। একবার একজনের বাগানে ফুটফুটে একটি মেয়ে ভোরবেলা চুরি করে অনেক ফুল তুলে কোঁচড়ে ভরেছিল। হঠাৎ পেছন থেকে সেই বাড়িব বউ এসে বললে, ফ্যাল, সব ফুল রেখে যা। আমরা যেমন জীবনের দিন অনিচ্ছায় একটা একটা করে ফেলি, মেয়েটি তেমনি করুণ মুখে দু হাতে ধরা ফ্রকের প্রান্ত নীচু করল। প্রথমে গড়িয়ে গড়িয়ে একটি দুটি করে ফুল পড়ল, তারপর হুড় হুড় করে সব ফুলে পড়ে গেল শিশির ভেজা ঘাসে। মেয়েটির সেই চোখ দুটো আমি আজও ভুলিনি। আমার মনে হচ্ছে, আমি সেই মেয়েটি। মৃত্যুর বাগানে দিনের ফুল কুড়োতে এসে ধরা পড়ে গেছি। একটি দু-টি করে দিন পড়তে পড়তে, কোঁচড় থেকে সব দিন ছড়িয়ে পড়েছে শিশির ভেজা ঘাসে।