দিনেমার বাংলোর নর্তকী – সসীমকুমার বাড়ৈ
নিশানঘাটে দিনেমার বাংলো বাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকে একা নিস্তব্ধ—নিঝুম। পাইক পেয়াদা গোমস্তার হাঁকডাক নেই। কর্মব্যস্ততা নেই। থাকার কথাও নয়। যুগটাই যে নেই। বাড়িটার বিবর্ণ খোলসের মধ্যে গুটিকয় কর্মচারী কাজটুকু সেরেই আক্রান্ত হয়ে যায় বুঁদ নেশায়। বসে বসে ঝিমোয় আর জাবর কাটে, না দেখা সময়ের। বাংলোটা হঠাৎ জেগে উঠল সেদিন বিকালে। লালবাতির বিদেশি মডেলের গাড়ি থেকে নেমে এলেন নতুন মহকুমা শাসক মিস অলকানন্দা। তেইশ—চব্বিশ বছরের মহিলা এসডিও—কে দেখে সাময়িক জড়তা কাটিয়ে হাউস—গার্ড স্বপন হাঁকডাক শুরু করল—গোপালদা, দিলীপ শিগগির এসো, ম্যাডাম এসে গেছেন। মালপত্র নামাতে হবে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বিপুল এল, অন্য হাউজ—গার্ড গোপাল এল। আপ্তসহায়ক ‘গুড ইভনিং ম্যাডাম’, বলে ঘরে ঢুকে গেল। বিপুল তর্জনী তুলে নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে গেল—ব্রিফকেসটা নাও, স্বপনদা। আহা, আহা, মাসিমাকে ধর। দেখ, মাসিমার যেন সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট না হয়। গোপাল গাড়ি বারান্দা থেকে ওঠার রাস্তা প্রায় আগলে দাঁড়িয়ে রইল। স্থির নিশ্চল দেহে পলকহীন চোখ। গা ঘেঁষে যেতে গিয়ে অলকানন্দার মনে হল একটা রক্তশূন্য মানুষের হিম বাতাস লাগল তার গায়ে।
বাংলোটা উত্তরমুখো। পশ্চিমে সিঁড়ি। সামনে হাঁটছে অলকানন্দা। মাঝে বিধবা মা, পিছনে লাগেজ হাতে স্বপন। সিঁড়িটা দেখেই মন ভরে গেল অলকানন্দার। পুরোনো কাঠের সিঁড়িতে লাল কার্পেট পাতা। আলোটা সব জায়গায় সমানভাবে পড়েনি। খানিকটা আলো—আঁধারি। সিঁড়িতে পা দিতেই তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। মনে হল কে যেন পা—টা দুলিয়ে দিল। প্রতিটা সিঁড়ির ধাপ যেন এক—একটা কাঠের মঞ্চ। পায়ের মধ্যে নাচের তাল। পা যেন কয়েক পা না নেচে থাকতে পারছে না আর। ভুল হচ্ছে না তো। পিছনে মা একটু কুঁজো হয়ে হাঁটলেও দিব্যি উঠছে। সদ্য একটা মহকুমার দায়িত্বভার নেওয়ার ভারে কি ভাবনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে? সে চেপে গেল ব্যাপারটা।
—ওয়া! দেখ মা, কী সুন্দর বারান্দাটা। অলকানন্দা সিঁড়ি থেকে মায়ের হাত ধরে প্রায় ছুটতে যায়।
—দাঁড়া দাঁড়া, আমার হাঁটুতে হাঁটুতে খিল ধরে গেল। বাব্বা, তিনতলার সমান দোতলা। এতগুলো সিঁড়ি এই কোমর নিয়ে, দম বেরিয়ে গেল। অলকার মা বারান্দায় পাতা সোফায় বসে হাঁপাতে লাগল। অলকা দু—দিকে জোড়া গোল স্তম্ভের মাঝখানে কাঠের রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল। সামনে লন, লনের ফুলের বাগান অবিন্যস্ত। পাঁচিলের ওপাশে রাস্তায় অনিয়মিত যান চলাচল। নদীর ওপারে ব্যারাকপুরে জ্বলে উঠেছে তীর বরাবর একসার নিয়নের আলো। কড়িবর্গার দালান বাড়িটার বারান্দায় টালির ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে অলকার মনে বিষণ্ণবোধ এল। সামান্য মাইনের চাকরিতে বাবার জীবন কেটেছে উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি ভাড়াবাড়িতে। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকত, তাকে বলত অলকা—দেখ বাবা, তোমার নন্দার বাংলোটা কেমন প্রাসাদের মতো। পিছনে ঘুরে মা—র দিকে তাকাল সে। মা—কেও কেমন আনমনা মনে হল। মা—ও কি বাবার কথা ভাবছে? কিন্তু মাকে কী করে বোঝাবে সে, বাবার আয়ু বড়োই ছোটো ছিল। তার দারিদ্র্য ছিল সম্রাটের মতো, জীবনের সীমা ছিল প্রগাঢ় মতো। বারান্দার আলোটা জোরালো নয়। সোফায় আধশোয়া মাকে তার মনে হল বৃদ্ধা শ্বেতপরির মতো। সাদা চুল, সাদা শাড়িতে মায়ের ঝুলে পড়া ফরসা মুখে আশ্চর্য সুন্দর একটা রূপ এসেছে। মা—র মুখ দেখতে দেখতে অলকার খেয়াল হল গ্যালারির মতো নদীমুখ করে পাতা সোফা, চেয়ার, ইজিচেয়ার মিলিয়ে মোট ছয়টা। ছয় ভাবতেই কল্পনার একটা স্রোত বয়ে গেল—ছয় ছয় ছয়। অমঙ্গল? বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল—কারা বসে এতগুলো যুগ সাক্ষী পুরোনো চেয়ার—টেবিলে এই শূন্য বারান্দায়?
রবিবার সকালে স্বপন দোতলায় উঠে দরজা থেকে ডেকে বলল—ম্যাডাম, তিন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
অলকানন্দা বারান্দায় বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল—কোথা থেকে এসেছেন, বলেছেন কিছু? স্বপন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল—ক্ষেত্রমোহন কৃষি…কৃষি…। কী যে বলল পুরো কথাটা ঠিক মনে পড়ছে না, ম্যাডাম।
—ঠিক আছে, ওঁদের বসতে বল। আমি যাচ্ছি।
একতলায় বাংলো চেম্বারে তিনজন প্রবীণ নাগরিক এসডিও সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছিল। অলকানন্দা চেম্বারে ঢুকতেই তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। তিনজনেরই মাথার চুল কদমফুল। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে অন্যদের পরিচয় করিয়ে দিল। সে বলল—ম্যাডাম, আমরা ক্ষেত্রমোহন শা মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে এসেছি। আমরা শুধু পূজা—আর্চাই করি না, কৃষি উন্নয়নেও ক্ষেত্রমোহন শা—র ব্যাপক অবদান ছিল। সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে। কিন্তু আমরা এসেছি একেবারে অন্য একটা বিষয় নিয়ে। আপনি এই মহকুমার প্রথম মহিলা শাসক। আমাদের সংগঠনের প্রথম সভায় শ্রীরামপুরের প্রথম মহকুমা শাসক মি. জে. উয়িন্ডোর গিয়েছিলেন। আপনি আর একটা ইতিহাসের অংশীদার হলেন। একে স্মরণীয় করতে আমরা আপনাকে সংবর্ধনা দিতে চাই। এত বছরে মহকুমা প্রশাসনে আপনার আগমন একটা বিরল ঘটনা।
অলকানন্দার রিভলভিং চেয়ার বিপরীত দিকে ঘুরে গেল। এতদিন খুঁটিয়ে পড়া হয়নি এসডিও—দের নামের তালিকাটা। সত্যিই তো প্রথম মহকুমা শাসক মি. জে. উয়িন্ডোর। আইসিএস ১৮৯৭। লম্বা লাইনের তালিকা। একদমে পড়ে ফেলল তার সামনে থাকা দেশি—বিদেশি সাহেব—সুবোদের নাম, সাল, তারিখ। সব শেষে সদ্য লেখা অলকানন্দার নাম। তার নামের আগে একটা মিস লেগেছে। প্রথম মহিলা এসডিও। এ যেন হোয়াইট হাউসে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি প্রবেশের মতোই বিরল ঘটনা। এক লম্ফে ইতিহাসের চরিত্র হয়ে যাওয়া ভাবতেই চোখের সামনে ভিড় করল শ্রীরামপুরের গণমান্য ব্যক্তিবর্গ। কে সোয়েটম্যান, কে ওলি বি, কে যে পঞ্চানন কর্মকার। টাক মাথার ভদ্রলোককে উইলিয়াম কেরি হিসাবে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না। শ্রীরামপুরের অলিতে—গলিতে যেন বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের শব্দ—টরে টক, টরে টক ধ্বনিতে—প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এত খাটো করে ধুতি পরা বাবুদের মধ্যে কে যে পঞ্চানন কর্মকার? বাঙালির আত্মবিস্মৃতি তাকেও গ্রাস করে নিল। শুধু জেগে আছে কেরি আর মিশনারি—ত্রয়ীর জীর্ণ ধূসর কবর।
পুবদিকের কাঠের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে জারিত হচ্ছিল অলকানন্দা। পায়ের নীচে যুগের ঘষায় ক্ষয়ে যাওয়া কাঠ। সামনে বিশাল বাংলো বাগানের জংলি পোকাদের চির চির, ক্রির ক্রির বিচিত্র সুরে অভিসার গান। পাঁচিলের ওপাশে চেসার্স হোমের প্রতিবন্ধী অনাথজনেরা সিস্টার লিন্ডার আদরে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। গা—লাগা পাশের বাড়িটা ম্যাকডাওয়েল কোম্পানির। নেশা কারবারিরা রাত জেগে বাতাসে ভাসিয়ে নিচ্ছে বোতলে রঙিন পানীয় ভরার শব্দ। টুং টাং। অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে অলকানন্দা। ইতিহাস নেশা। কোনো ডেনিস গভর্নর বানিয়েছিল নিশানঘাটের বাণিজ্য কুঠি। গথিক স্থাপত্যের বাড়িটায় লাল মেঝের উপর পা রাখলেই মনে হয় মুছে যাবে পদচিহ্ন। মৃত কত কত লোকের হেঁটে যাওয়া পায়ের ছাপ। কখনো কি তাদের আত্মা ফিরে আসে স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে? বেডরুমে মা একা শুয়েছিল। সে সেখান থেকে ডাকে—নন্দা। অলংকার সাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না। মা কালের গানের মতো ডেকে চলে—নন্দা। নন্দা। নন্দা… ঘরে আসতে গিয়ে অলকানন্দার মনে হল কে যেন পা দুটো নাচিয়ে দিল—তা তা থৈ থৈ। কেন যে এমন অনুভূতি হয়।
অলকার চোখে ঘুমে নেই। মাথার মধ্যে ফেড্রিকনগরের পতনের ছবিটা কিছুতেই সরছে না। ১৮৪৫ সাল। দিনেমার বণিকরা ইংরেজ বণিকদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ফিরে যাচ্ছে দেশে। আর ভেঙে পড়ছে সব বাড়িঘর। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শ্রীরামপুরের হাঁসফাস। অলকা পাশ ফিরে শোয়। মা ঘুমোচ্ছে। ডিম লাইটে সাদা চুল আর সাদা শাড়িতে মাকে কেমন শুইয়ে থাকা মূর্তি মনে হল তার। মা, তার একমাত্র প্রিয়জন, তাকে কিনা পাথরের মূর্তি মনে হল? মন জুড়ে বসল দুঃখ—জড়তা। ইচ্ছা হল মাকে ঝাঁকিয়ে দিতে—না মা, তুমি কিছুতেই মূর্তি বা পরি হতে পার না। তখন তার কান খাড়া হয়ে গেল। নিস্তব্ধ বাংলোয় রাতদুপুরে জল পড়ার শব্দ। খানিকটা সময় বাদে বাদে শব্দটা। ছ্যার ছ্যার। ভেসে আসছে শব্দ। দূরে না কাছে বোঝা গেল না। আকাশে তো মেঘ ছিল না। খইয়ের মতো তারা বিছানো আকাশ দেখেছে সে একটু আগে। তবে কি ট্রাঙ্ক উপচে পড়া জল? বিছানা থেকে নেমে অলকা কলিং বেল টিপল। দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই চমকে উঠল সে। হাউসগার্ড গোপাল দাঁড়িয়ে—স্থির নিশ্চল। আবছা আলোতেও বোঝা গেল গোপালের রক্তশূন্য শীতল চোখে পলক নেই। অলকার মাথায় এল না এত তাড়াতাড়ি দোতলায় এল কী করে সে। মায় পায়ের শব্দ পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অলকা বলল—এত রাতে পাম্প চলছে কেন? জল পড়ে যাচ্ছে। শিগগির বন্ধ কর। গোপাল কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে ডুবে গেল সিঁড়ির অন্ধকারে। ছয়—ছয়টা শূন্য চেয়ার—সোফার মধ্যে অলকার নিজেকে বড়ো একা মনে হল। ইজিচেয়ারটায় কোনো অদৃশ্য মানুষ বসে নেই তো? স্পষ্ট যেন একটা নিশ্বাস লাগল তার ঘাড়ে। অলকানন্দার গা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সে তড়িৎগতিতে দরজা বন্ধ করে মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল। অলকা ছোটোবেলা থেকে অনুভব করেছে মশারির মধ্যে ঢুকলে একটা বাড়তি নিরাপত্তা বোধ জন্মায়। আজও ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু ঘুম এল না চোখে। রোজকার মতো শ্মশানযাত্রীদের একটা গাড়ি চলে গেল পিছনের রাস্তা দিয়ে। এই এক সমস্যা, যাদের বাড়ি শ্মশান পথের পাশে তারা প্রতি রাতে একাধিকবার ঢুকে যায় মৃত্যুর আবর্ত ছায়ায়। অলকা হিসাব করে দেখেছে পিছনের রাস্তা দিয়ে প্রতি রাতে গড়ে প্রায় তিনটে করে বডি যায়। বাংলোর বাগানে স্থির হয়ে ঝুলে থাকে কান্না—ভেজা বাতাস অনেকক্ষণ। আজকাল হরি বোলের রকমফের শুনেই অলকা বুঝতে পারে কোন মৃত্যুতে খুশি হয়েছে পরিজনেরা। আর কোন মৃত্যুতে ভেঙেছে বেবাক হৃদয়। এখনও তার কানের গভীরে গেঁথে আছে—হরিবোল, হরিবোল। হরিবোল, হরি—বো—ও—ল—ল। অসহায় আত্মসমর্পণের কান্না গ্রাস করে ফেলল দিনেমার বাংলোর পাঁজর।
ফুরফুরে আকাশ। গঙ্গার উপর ঝুলে রয়েছে নীল পেঁজা পেঁজা ঘন মেঘ। অলকানন্দার মধ্যে একটা মুগ্ধভাব। যা ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় কী একটা সেলাই করছিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল—রাখো তো ওসব। সারাজীবন কি সেলাই করেই কাটাবে? দেখো মা আকাশে কেমন মন জুড়ানো মেঘ।
—হ্যাঁ, আপিসে অমন গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে থাকিস কি করে?
—থাকতে হয় মা, থাকতে হয়, নইলে কেউ মানবে না। এমনিতে সবাই বলে বাচ্চা মেয়ে। আমার রাগ হয়। সামনে অবশ্য বলার সাহস পায় না।
মা ফিক করে হেসে বলল। বলল—ওরা বোধহয় ঠিকই বলে, নইলে ফেলে আসা জীবন কেউ ভুলতে চায়! তোর ফ্রক সেলাই করতে করতে তোকে বড়ো করেছি। এখনও রানসেলাই দিতে গিয়ে দেখি ছোট্ট মেয়েটা কেমন বড়ো হয়ে যাচ্ছে। ফ্রক পরা মেয়েটা এখন এসডিও। কিন্তু তোকে আমার ছোট্ট মেয়েটিই মনে হয়। আর ওই আকাশের কথা বলছিস, ওটা শরতের আকাশ। এ সময় ওরকম পুজো—পুজো ভাব হয়। সামনের মঙ্গলবার মহালয়া তা খেয়াল আছে?
—ও মা, বল কী! কাজের চাপে বুঝতেই পারিনি কখন পুজো এসে গেল।
—একটা কাজ করবি, মা?
—বল।
—মহালয়ার দিন সকালে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অর্পণ তর্পণ করবি।
—না, তুমি দেখছি কিচ্ছু জানো না মা। স্ত্রীলোক আর শুদ্দুরদের গায়ত্রী মন্ত্র, তর্পণের মন্ত্র উচ্চারণ করার অধিকার নেই। বামনাই মতে সব মেয়েরাই শূদ্র। তা হলে কি করে হবে, মা?
—তোর ওই বামনই মতে কোনো ঘরের বউকে ট্যাক্সি চালানোর অধিকার দিয়েছে। তিনি তো আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে একা চলে গেলেন। তারপর তোর জন্য আমি কী না করেছি। কে বামুন, কে শূদ্র, কে মুসলমান সব পুরুষের সঙ্গে সমান তালে ট্যাক্সি চালিয়েছি দিনের পর দিন। গিলেছি কত ব্যথা। কোনো সংস্কার আমাকে আটকাতে পেরেছে? আর তুই বাবার আত্মার তৃপ্তির জন্য একটু জল দিতে পারবি না?
পৃথিবীর সব প্রতিযোগিতায় জিতলেও মা—র কাছে হারতেই ভালো লাগে অলকানন্দার। মা—র কাঁধে মাথা রেখে সে বলল—দেখ মা, তোমার মেয়ে এটাও পারবে। তার মনের মধ্যে বাবার চন্দনের ফোঁটা দেওয়া ছবিটা ভেসে ওঠে—তোমার নন্দা তৃপ্তির একটু জল দিতে পারবে না বাবাকে? মা—মেয়ের চোখের কোণ ভিজল। কেউ দেখল না।
গঙ্গার নরম জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভেসে আসছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর—যা দেবী সর্বভূতেষু…। তাই শুনে অলিগলি আর ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা কাতারে কাতারে চলে এল গঙ্গাতীরে। আকাশ খানিকটা ফরসা হতেই অলকাও দোতলা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেল। পায়ের মধ্যে সেই অনুভূতি—কে যেন দু—এক পা নাচিয়ে দিল। নাচো, নাচো। সে দ্রুত পায়ে নেমে এল একতলায়। সিকিউরিটি গার্ড আগেই এসে গেছে।
আদুল গায়ে খাটো করে ধুতি পরা মাঝবয়সি লোকজনই বেশি। ন্যাদোস ন্যাদোস চেহারার কেউ কেউ দিব্যি গামছা পরে চালিয়ে যাচ্ছে তর্পণ। ভিজে জ্যাবজ্যাবে ধুতি—গামছা গায়ে বসে গেছে। লেপ্টে বসা সবেধন কাপড়ে পুরুষাঙ্গ সুস্পষ্ট নধর। অলকা লজ্জা পায়। মাথা নীচু করে মহিলা—চানঘাটের দিকে গেল সে। সেখানেও দু—চারটে পুরুষ প্রায় উদোম। সিকিউরিটি গার্ড তাড়া করে সরিয়ে দিল তাদের। গঙ্গার নোংরা জলে প্রথমে পা দিতে ইতস্তত করছিল অলকা। পরে পা দিতেই একটা চোরা স্রোত তাকে টেনে নিয়ে গেল কোমর জলে। তার শরীর জুড়ে টান। অনেকগুলো জলরেখা ঢেউয়ের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে হারিয়ে গেল জলে। অলকা আঁজলা ভরে জল নিয়ে প্রায় গানের সুরে আহ্বান করল—
‘যে চ হই পিতরো যে চ নেহ
জাংশ্চ বিদ্ম যা ঊ চন ন প্রবিদ্ধ।’
যাদের আমি চিনি, যাদের আমি চিনি না, স্বদেশি—বিদেশি যেই হোন না কেন, হে আমার পূর্বপুরুষগণ, মাতৃগণ, আমাদের আনন্দ দিনে আপনাদের আসতে আজ্ঞা হোক। অলকার মনে হল ফেড্রিকনগরের চলে যাওয়া প্রাণ—পুরুষদেরও ডাকা যেতে পারে—হে ফেড্রিকনগরের শাসকগণ, হে সাধুগণ, আপনারাও আসুন। স্বর্গ অথবা নরকে অধিষ্ঠিত সারা বসুন্ধরার আত্মীয়—অনাত্মীয় পূর্বপুরুষগণ উৎসবে অংশীদার হোন।
বাবার কথা মনে পড়তেই বাকি সব মন্ত্র, সব কথা ভুলে গেল অলকা। শরীরের মধ্যে একটা তিরতির স্রোতানুভূতির টান বয়ে যেতে লাগল। করাঞ্জলির জল যে কখন গঙ্গায় গড়িয়ে পড়ল খেয়াল নেই তার। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে ভিজে গেল গঙ্গা। অলকানন্দা নদী হয়ে গেল।
তক্ষকটা ডেকে যায় সারাক্ষণ—তকতক। তকতক। বাংলোর পিছনে বাগানের মধ্যে ছিল গেস্ট হাউস। বর্তমানে গেস্ট হাউসের কঙ্কাল হানাবাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। আউট হাউসগুলোরও তথৈবচ অবস্থা। স্বপন একদিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল নতুন ম্যাডামকে বাংলোবাড়ির বিবর্ণ খোলস। বলছিল—রাজাও নেই, রাজত্বও নেই। এখন তো ম্যাডাম, আপনাদের শুধু আমলাই ভাবে লোকজন। পুষতেও চায় না কেউ। তক্ষকটা বোধহয় থাকে গেস্ট হাউসের পাঁজরে। অলকানন্দার মাথার মধ্যে ডাকতে থাকে—তক তক। তক তক। বাংলোর ছত্রিশ ইঞ্চি মোটা চুন—সুরকির দেওয়ালের ভিতর থেকে একনাগাড়ে আওয়াজ হয়—তক তক। ঘুমের ঘোরে মাথার কোষগুলো নড়ে—তক তক। পাতলা মসলিন হয়ে যায় ঘুম। মসলিন ওড়নায় ভাসে অলকা। খুলে যায় এক—একটি হাওয়া—দরজা। বারান্দায় কোজাগরী রাত পেরনো আলো ঠিকরে পড়েছে খানিকটা। অলকানন্দার নিজের চোখকে অবিশ্বাস্য মনে হয়—ঘোমটা মূর্তির মতো কারা বসে আছে মাথা নীচু করে। ছয় ছয় ছয়। না, আরও বেশি। গোটা একটা গ্যালারি জুড়ে বসে আছে আবছা আলোর মূর্তি মানুষেরা। তবে কি অলকানন্দা ভুল শুনল? সমস্বরে কারা বলল—ইয়োর হাইনেস। সোলস, দাউ ইনভাইটেড। অলকা চমকে উঠল—কাদের আত্মা? আত্মা—মানুষেরা ছিল কোথায়? চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে দেশি—বিদেশি ফেলে আসা যুগের মানুষজন। কিন্তু কে যে হান্না মার্সম্যান, কে যে পঞ্চাননবাবু, সূত্রধর কৃষ্ণপাল বা অলি বি বোঝা দায় এত ভিড়ে। তবু অলকানন্দার বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা সকলে ছিল ফেড্রিকনগরের বাসিন্দা একদিন। এতদিন পরে কেন এল এখানে? হঠাৎ অলকানন্দার ভাবার আচ্ছাদন খুলে যায়—হ্যাঁ, সত্যিই তো, ভুবনলোকের বাসিন্দাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তর্পণে। হায়, হায়, তাদের তৃপ্তির জল দিতে ভুলে গেছে সে। বলা হয়নি মন্ত্রে শেষ পঙক্তি শ্লোক। অলকানন্দা ভাবতে ভাবতে উদ্ধার করে—তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতা মহোদয়ঃ। …তোমরা আমার হৃদয়ের নৈবেদ্যে পরিতৃপ্ত হও। আবার অলকানন্দার মনে হল কারা যেন সমস্বরে বলল—সাধু। সাধু। সামনের চেয়ার—সোফা যেমন ছিল তেমনি ফাঁকা। মিলিয়ে গেল সব আত্মা—মানুষ। কিন্তু কোনার দিকে আঁধার—আলোয় কারা বসে এখনও। অচেনা হলেও বুঝতে অসুবিধা হল না, বাবা—মেয়ে। রোমান চেহারা। মূর্তি মেয়ের রূপে তাক লেগে গেল অলকানন্দার। বাইশ—তেইশ বছরের যুবতীস্বরে ছায়াসুন্দরী বলল—ইয়োর হাইনেস। আই অ্যাম ক্লারা ব্রাউন। বাবা মি. ব্রাউন নতমুখে বসে রইল সোফায়। মুখে বেদনার গভীর ক্ষত। মসলিনে ভেসে ভেসে অলকানন্দা ভাবল—আহা, কেন হয় না অমন রূপ। ভাবতে ভাবতে অলকানন্দা মিশে গেল ক্লারা ব্রাউনের শরীরে। নাক হল টিকালো। চোখ হল চোখা। অলকার পা নেচে উঠল—তা তা, থৈ থৈ তা…। হাতে মুদ্রা। সারা শরীরে নেচে উঠল মন্দিরে মন্দিরে দেবীদের মতো। ক্লারা ব্রাউনের নাচ আর স্বর মিলে শরীরে ফুটে উঠল কবিতা—আই হ্যাড বিন টু দিস বাংলো লং এগো। আমরা এই বাংলোতে অনেক আগে থাকতাম। গঙ্গাকে ভালোবাসতাম। নাচের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। নাচের গুরু, নাচ আর আমি ছিলাম একটিমাত্র সত্তা। নাচের তালে তালে আমার খোঁপার জুঁই ফুল খসে পড়ত লাল মেঝেয়, সিঁড়িতে। আমি ভালো নাচলে আমার নাচের গুরুর গৌরসুন্দর শরীরে ভেসে উঠত মুগ্ধ বসন্ত। কুড়িয়ে নিত খসে পড়া খোঁপার জুঁই ফুল। বাট মাই ফাদার অবজেকটিভ এগেনস্ট দি ইন্ডিয়ান ডান্স। বাবার আভিজাত্যে বেধেছিল। ফর দি সেক অফ ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল ডান্স আমি জীবনকে বাজি রেখেছিলাম। বাবা নেটিভ গোমস্তাদের সাহায্যে আমায় গুম করে দিল।
অলকানন্দা উৎসমুখে উচ্ছল ঝরনার মতো নেচে যাচ্ছে। তার গলার ক্লারা ব্রাউনের স্বর আবার বলে উঠল—ইয়োর হাইনেস। আপনি হয়তো ভাবছেন তর্পণ জলে সবাই তৃপ্ত হল কিন্তু আমি কেন ফিরলাম না। আসলে আমার তৃপ্তি নাচে। এতগুলো বছর নাচতে চেয়েছি এই বাড়ির কাঠ—পাথরের কণায় কণায়, পারিনি। শুধুই জড়তায় আটকে যেত আমার পা। আজ যখন আপনাকে আধার করলাম, আমার সমস্ত সত্তা নেচে উঠল। মাই সোল ফিলস নাউ স্যাটিসফায়েড। আমি তৃপ্ত। নাচতে নাচতে লাল মেঝে ছেড়ে শূন্যে উঠে যাচ্ছে অলকানন্দ। ঝড়ো বাতাসে খসে যাচ্ছে শরীর থেকে এক—একটি মসলিন ওড়না। পালক ছাড়া পাখির মতো তার ভারী শরীর নেমে আসছে পৃথিবীর কাছাকাছি।
চড়া রোদের আভায় চোখ খুলে দেখল—ইজিচেয়ারে বসে আছে সে। একটু আগেও রাতে ডুবে ছিল সামনের নদীটা। এখন জোয়ার জলে ভেসে যাচ্ছে দু—কূল আর অলকার ভাবনার বিস্তার। তবু অলকানন্দা ভাবল—নাই বা হলে সত্যি। তবু সখী, প্রতিরাতে এসো তোমার ঘরে।