অকস্মাৎ কাল দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ আশ্রমে এসে পৌঁছল। শোকের ঘটনা উপলক্ষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে যে শোকপ্রকাশ করা হয় তার প্রথাগত অঙ্গ যেন একে না মনে করি। বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা সকলে দিনেন্দ্রকে ব্যক্তিগতভাবে জানত না– কর্মের যোগে সম্বন্ধও তাঁর সঙ্গে ইদানীং এখনকার অল্প লোকের সঙ্গেই ছিল। অধ্যাপকেরা সকলেই এক সময়ে| তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে স্নেহপ্রেমের সম্বন্ধ তাঁদের ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিল।
যে শোকের কোনো প্রতিকার নেই তাকে নিয়ে সকলে মিলে আন্দোলন করে কোনো লাভ নেই এবং আত্মীয়বন্ধুদের যে-শোক, অন্য সকলের মনে তার সত্যতাও প্রবল নয়। এই মৃত্যুকে উপলক্ষ ক’রে মৃত্যুর স্বরূপকে চিন্তা করবার কথা মনে রক্ষা করা চাই। সমস্ত জগৎকে ব্যাপ্ত করে এমন কোনো কোণ নেই যেখানে প্রাণের সঙ্গে মৃত্যুর সম্বন্ধ লীলায়িত হচ্ছে না; এই যে অনিবার্য সঙ্গ, এ যে শুধু অনিবার্য তা নয়, এ না হলে মঙ্গল হত না– দুঃখকে মানতেই হবে, শোক-দুঃখ মিলন-বিচ্ছেদ উন্মীলন-নিমীলনেই সমাজ গ্রথিত– এই আঘাত-অভিঘাতের মধ্য দিয়েই সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব যে কঠোরতা আছে সেইটি না থাকলেই যথার্থ দুঃখের দিকটাই দেখব, তার মধ্যে যে অপরাজিত সত্য সে তো অবসন্ন হয় না– অথচ মানুষের দুঃখের কি অন্ত আছে? মৃত্যুকে যদি বিচ্ছিন্ন করে দেখি তা হলেই আমরা অসহিষ্ণু হয়ে নালিশ করি এর মধ্যে মঙ্গল কোথায়? এই দুঃখের মধ্যেই মঙ্গল নিহিত আছে, নইলে দুর্বলতায় সৃষ্টি অভিভূত হত– দুঃখ আছে বলেই মনুষ্যত্বের সম্মান। দুঃখের আঘাত, বেদনা মানুষের জীবনে নানান কান্নায় প্রকাশ; ইতিহাসের মধ্যে যদি দেখি তা হলে দেখব অপরিসীম দুঃখকে আত্মসাৎ করে মানুষ আপন সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সে-সব এখন কাহিনীতে পরিণত। ইতিহাসে কত দুঃখ প্লাবন ঘটেছে, কত হত্যাব্যাপার কত নিষ্ঠুরতা– সে-সব বিলুপ্ত হয়েছে, রেখে গেছে দুঃখবিজয়ী মহিমা, মৃত্যুবিজয়ী প্রাণ– মৃত্যুর সম্মুখ দিয়ে প্রাণের ধারা চলেছে– এ না হলে মানুষের অপমান হত। মৃত্যুর স্বরূপ আমরা জানি নে বলে কল্পনায় নানা বিভীষিকার সৃষ্টি করি। প্রাণলোককে মৃত্যু আঘাত করেছে কিন্তু বিধ্বস্ত করতে পারি নি– প্রাণের প্রকাশে অন্তরালে মৃত্যুর ক্রিয়া, প্রাণকে সে-ই প্রকাশিত করে। সম্মুখে প্রাণের লীলা, মৃত্যু আছে নেপথ্যে।
অনেকে ভয় দেখায় মৃত্যু আছে, তাই প্রাণ মায়া। আমরা বলি, প্রাণই সত্য, মৃত্যুই মায়া, মৃত্যু আছে তৎসত্ত্বেও তো যুগে যুগে কোটি কোটি বর্ষ ধরে প্রাণ আপনাকে প্রকাশিত করে আসছে। মৃত্যুই মায়া। এই কথা মনে করে দুঃখকে যেন সহজে গ্রহণ করি; দুঃখ আছে, বিচ্ছেদ ঘটল, কিন্তু এর গভীরে সত্য আছে এ কথা যেন স্বীকার করে নিতে পারি।
আশ্রমের তরফ থেকে দিনেন্দ্রনাথের সম্বন্ধে যা বলবার আছে তাই বলি। নিজের ব্যক্তিগত আত্মীয়বিচ্ছেদের কথা আপনার অন্তরে থাক্– সকলে মিলে তা আলোচনা করার মধ্যে অবাস্তবতা আছে, তাতে সংকোচ বোধ করি। আমাদের আশ্রমের যে একটি গভীর ভিত্তি আছে, তা সকলে দেখতে পান না। এখানে যদি কেবল পড়াশুনোর ব্যাপার হত তা হলে সংক্ষেপ হত, তা হলে এর মধ্যে কোনো গভীর তত্ত্ব প্রকাশ পেত না। এটা যে আশ্রম, এটা যে সৃষ্টি, খাঁচা নয়, ক্ষণিক প্রয়োজন উত্তীর্ণ হলেই এখানকার সঙ্গে সম্বন্ধ শেষ হবে না সেই চেষ্টাই করেছি। এখানকার কর্মের মধ্যে যে-একটি আনন্দের ভিত্তি আছে, ঋতু-পর্যায়ের নানা বর্ণ গন্ধ গীতে প্রকৃতির সঙ্গে যোগস্থাপনের চেষ্টায় আনন্দের সেই আয়োজনে দিনেন্দ্র আমার প্রধান সহায় ছিলেন। প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম তখন চারি দিকে ছিল নীরস মরুভূমি– আমার পিতৃদেব কিছু শালগাছ রোপণ করেছিলেন, এ ছাড়া তখন চারি দিকে এমন শ্যাম শোভার বিকাশ ছিল না। এই আশ্রমকে আনন্দনিকেতন করবার জন্য তরুতলার শ্যাম শোভা যেমন, তেমনি প্রয়োজন ছিল সংগীতের উৎসবের। সেই আনন্দ উপচার সংগ্রহের প্রচেষ্টায় প্রধান সহায় ছিলেন দিনেন্দ্র। এই আনন্দের ভাব যে ব্যাপ্ত হয়েছে, আশ্রমের মধ্যে সজীবভাবে প্রবেশ করেছে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে এর মূলেতে ছিলেন দিনেন্দ্র– আমি যে সময়ে এখানে এসেছিলাম তখন আমি ছিলাম ক্লান্ত, আমার বয়স তখন অধিক হয়েছে– প্রথমে যা পেরেছি শেষে তা-ও পারি নি। আমার কবিপ্রকৃতিতে আমি যে দান করেছি সেই গানের বাহন ছিলেন দিনেন্দ্র। অনেকে এখান থেকে গেছেন সেবাও করেছেন কিন্তু তার রূপ নেই বলে ক্রমশ তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু দিনেন্দ্রের দান এই যে আনন্দের রূপ এ তো যাবার নয়– যত দিন ছাত্রদের সংগীতে এখানকার শালবন প্রতিধ্বনিত হবে, বর্ষে বর্ষে নানা উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন চলবে, তত দিন তাঁর স্মৃতি বিলুপ্ত হতে পারবে না, তত দিন তিনি আশ্রমকে অধিগত করে থাকবেন– আশ্রমের ইতিহাসে তাঁর কথা ভুলবার নয়। এখানকার সমস্ত উৎসবের ভার দিনেন্দ্র নিয়েছিলেন, অক্লান্ত ছিল তাঁর উৎসাহ। তাঁর কাছে প্রার্থনা করে কেউ নিরাশ হয় নি– গান শিখতে অক্ষম হলেও তিনি ঔদার্য দেখিয়েছেন– এই ঔদার্য না থাকলে এখানকার সৃষ্টি সম্পূর্ণ হত না। সেই সৃষ্টির মধ্যেই তিনি উপস্থিত থাকবেন। প্রতিদিন বৈতালিকে যে রসমাধুর্য আশ্রমবাসীর চিত্তকে পুণ্য ধারায় অভিষিক্ত করে সেই উৎসকে উৎসারিত করতে তিনি প্রধান সহায় ছিলেন। এই কথা স্মরণ ক’রে তাঁকে সেই অর্ঘ্য দান করি যে-অর্ঘ্য তাঁর প্রাপ্য।
প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩৪২