দিনেন্দ্রনাথ
‘দেশে’র ৪১শ সংখ্যা শ্ৰীযুক্ত প্ৰভাতচন্দ্র গুপ্ত স্বর্গীয় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সর্বাঙ্গসুন্দর সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখে দিনেন্দ্ৰভক্ত, দিনেন্দ্ৰ-সখাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। গুপ্ত মহাশয় দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ পরিচয়, দিনেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রবীন্দ্রসঙ্গীতানুরাগী মাত্রেরই অবশ্য জ্ঞাতব্য তত্ত্ব এবং তথ্য, দিনেন্দ্রনাথের মধুর, সহৃদয়, বন্ধুবৎসল হৃদয়ের এ বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমার মনে দিনেন্দ্ৰনাথের যে ছবি আছে সেটি হুবহু মিলে গেল। একাধিকবার ভেবেছি দিনেন্দ্ৰনাথ সম্বন্ধে এত অল্প লোকই লিখেছেন যে তাঁর প্রতি আমার শ্ৰদ্ধা জানিয়ে আমার যেটুকু জানা আছে তাই লিখে ফেলি, কিন্তু প্রতিবারেই মনে হয়েছে, দিনেন্দ্র-জীবন আলোচনা করার শাস্ত্ৰাধিকার আমার নেই। গুপ্ত মহাশয় এখন আমার কর্তব্যটি সরল করে দিলেন। আমার বক্তব্যের কোনো কথা যদি গুপ্ত মহাশয়ের কাজে লেগে যায়, তবে আমি শ্রমসাফল্যের আনন্দ পাব।
স্বীকার করি, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন-মন্দিরে যে বক্তৃতা দিতেন, তা অতুলনীয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্বীকার করি, যেদিনকার উপাসনা দিনেন্দ্ৰনাথের সঙ্গীত দিয়ে আরম্ভ হত, সেদিন সে সঙ্গীত যেন আমাদের মনে করে রবীন্দ্ৰনাথের উপাসনার জন্য সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুত এবং উন্মুখ করে তুলত। দিনেন্দ্রনাথের বিশাল গভীর কণ্ঠ আমাদের হৃদয়মন ভরে দিত, তার পর সমস্ত মন্দির ছাপিয়ে দিয়ে ভাঙা-খোয়াই পেরিয়ে যেন কোথা থেকে কোথা চলে যেত। তাই আমার সব সময় মনে হয়েছে দিনেন্দ্ৰনাথের কণ্ঠ একজনকে শোনাবার জন্য, এমন কি একটা সম্পূর্ণ আসরকেও শোনাবার জন্য নয়, তার কণ্ঠ যেন ভগবান বিশেষ করে নির্মাণ করেছিলেন সমস্ত দেশের জনগণকে শোনাবার জন্য তাই বোধ হয় তার কণ্ঠে যে রকম ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গান শুনেছি আজ পর্যন্ত কারো কণ্ঠে সেরকম ধারা শুনলাম না।
এরকম গলা এ দেশে হয় না—এ গলার ভালুম পেলে ইতালির শ্রেষ্ঠতম অপেরাগাইয়ে জীবন ধন্য মনে করেন।
হয়তো আমার কল্পনা, কিন্তু প্রায়ই আমার মনে হয়েছে, মন্দিরে দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গীত যেন অনেক সময় রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠতর ধর্মব্যাখ্যানে অনুপ্রাণিত করেছে।
একথা সবাই জানেন, দিনেন্দ্রনাথ যে শুধু গায়কই ছিলেন তাই নয়, তিনি অতিশয় উচ্চাদরের সঙ্গীতরসজ্ঞও ছিলেন। কি উত্তর কি দক্ষিণ, কি ইয়োরোপীয় সর্বসঙ্গীতে সর্ববাদ্যের খবর তিনি তো রাখতেনই-তার উপর তিনি জানতেন কি করে গায়ক এবং যন্ত্রীকে উৎসাহ দিয়ে দিয়ে তার সর্বশ্রেষ্ঠ নৈপুণ্য টেনে বের করে আনতে হয়। প্রায় ত্রিশ বৎসর হয়ে গিয়েছে, তাই আজ আর ঠিক মনে নেই, তবে বোধ হয় সে গুণীর নাম ছিল সঙ্গমেশ্বর শাস্ত্রী, পিঠাপুরুম মহারাজের বীণকার-তিনি এসেছেন রবীন্দ্রনাথকে বীণা শোনাতে। রবীন্দ্রনাথ আর দিনেন্দ্রনাথ উদগ্ৰীব হয়ে বসেছেন; তার পর আরম্ভ হল বীণাবাদন।
আমার সন্দেহ হয়েছিল দক্ষিণের গুণীর মনে কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল, উত্তর ভারতের শান্তিনিকেতন তাঁর সঙ্গীত সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে কি না। দশ মিনিট যেতে না যেতেই রবীন্দ্রনাথ আর দিনেন্দ্রনাথ যেমন যেমন তাঁদের সূক্ষ্ম রসানুভূতি ঘাড় নেড়ে, মৃদু হাস্য করে বা বাহবা বলে প্রকাশ করতে লাগলেন সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গমেশ্বর বুঝতে পারলেন তিনি যে সমঝদার শ্রোতার সামনেই বাজাচ্ছেন তাই নয়, এ রকম শ্রোতা তিনি জীবনে পেয়েছেন। কমই। সে রাত্রে কটা অবধি মজলিস চলেছিল আজ আর ঠিক মনে নেই, তবে শান্তিনিকেতনের ‘খাবার ঘণ্টা’র অনেক পর অবধি—বারোটা হতে পারে, দুটাও হতে পারে।
সে যুগে ইয়োরোপ থেকেও বহু কলাবিৎ আসতেন। রবীন্দ্রনাথকে গান কিংবা বাজনা শোনাতে। দুজনকে স্পষ্ট মনে আছে, কিন্তু নাম ভুলে গেছি। একজন ডাচ মহিলা গাইয়ে (বিনায়ক রাও এর নাম স্মরণ করতে পারবেন) এবং অন্যজন বেলজিয়ান বেহালা-বাজিয়ে। ডাচ মহিলাটি খুব বেশি দিন আশ্রমে থাকেন নি, কিন্তু বেলজিয়ানটি দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে একদম জমে যান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি বাজিয়ে যেতেন-ভদ্রলোক দিনে অস্তুত বারো ঘণ্টা আপন মনে, একা একা, বেহালা বাজাতেন–আর দিনেন্দ্রনাথ তার সূক্ষ্মতম কারুকার্যের সময় মাথা নড়ে নেড়ে রসবোধের পরিচয় দিয়ে তার উৎসাহ বাড়াতেন।
বেলজিয়ানটি দিনেন্দ্রনাথের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছিলেন-তার অন্যতম, সিগার বর্জন করে গড়গড়া পান। আশ্রম ছাড়ার দিন ভদ্রলোক দুঃখ করে আমাকে বলেছিলেন, ‘দেশে যেতে মন চাইছে না, সেখানে তামাক পাব কোথায়?’ যদিস্যাৎ পেয়ে যান। সেই আশায় ভদ্রলোক তার আলবোলাটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দিনেন্দ্ৰনাথ সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ সমঝদার ছিলেন। প্ৰাপ্তবয়সে তিনি ফরাসীও শিখেছিলেন এবং স্বচ্ছন্দে ফরাসী উপন্যাস পেতে পারতেন। ওদিকে ভারতের সংস্কৃতি ইতিহাসের প্রতি ছিল তাঁর গভীর প্রেম। তাই কি লেভি, কি উইনটারনিৎস সকলের সঙ্গে ছিল তাঁর হৃদ্যতা। বিদেশীকে কি করে খানা খাইয়ে, আড্ডা জমিয়ে, সঙ্গীতের চর্চা করে, সৌজন্য ভদ্রতা দেখিয়ে-আমি একমাত্র দিনেন্দ্রনাথকেই চিনি যিনি পৃথিবীর সকল জাতের লোকেরই ম্যানারস এটিকেট জানতেন—তার দেশের কথা ভুলিয়ে দেওয়া যায় এ কৌশল তাঁর যা রপ্ত ছিল এর সঙ্গে আর কারো তুলনা হয় না। তাই তাঁর বাড়ি ছিল বিদেশীদের কাশীবৃন্দাবন। দিনেন্দ্ৰনাথ গাইতে পারতেন, বাজাতে পারতেন, অন্যের গানবাজনার রস চাখতে পারতেন এ-কথা পূর্বেই নিবেদন করেছি; তদুপরি তিনি ছিলেন সঙ্গীতশাস্ত্ৰজ্ঞ। এ বড় অদ্ভুত সমন্বয়। শাস্ত্রজ্ঞের রসবোধ কম, আবার রসিকজন শাস্ত্রের অবহেলা করে—দিনেন্দ্ৰনাথ এ নীতির ব্যত্যয়-শাস্ত্রের কচকচানি তিনি ভালবাসতেন না। কিন্তু সঙ্গীতের বিজ্ঞানসম্মত চর্চার জন্য যেখানেই শাস্ত্রের প্রয়োজন হত, তিনি সেখানেই সত্য শাস্ত্ৰ আহরণ করে ছাত্রের সঙ্গীতচর্চা সহজ সরল করে দিতে জানতেন।
আমাদের ঐতিহ্যগত রাগপ্রধান সঙ্গীতচর্চার জন্য প্রাচীন অর্বািচীন বহু শাস্ত্ৰ আছে, রবীন্দ্রনাথ এ যুগে সঙ্গীতের যে নূতন ভুবন সৃষ্টি করে দিলেন, তার রহস্য ভেদ করার জন্য কোনো প্ৰমাণিক শাস্ত্র নেই। এ-শাস্ত্র নির্মাণ করার অধিকার একমাত্র দিনেন্দ্ৰনাথেরই ছিল। বহু অনুনয়-আবেদন করার পর তিনি সে শাস্ত্র রচনা করতে সম্মত হলেন।
কয়েকটি অধ্যায় তিনি লিখেছিলেন। সেগুলি অপূর্ব। শুধু যে সেগুলিতে রবীন্দ্ৰসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত দর্শনে’র সন্ধান মেলে তাই নয়, সেগুলিতে ছিল ভাষার অতুলনীয় সৌন্দর্য অমিত ঝঙ্কার-সে ভাষার সঙ্গে তুলনা দিতে পারি একমাত্র ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’র ভাষা।
এ শাস্ত্ৰ তিনি কখনো সমাপ্ত করতে পেরেছিলেন। কিনা জানিনে। হয়তো আমার ভুল, কিন্তু প্ৰথম অধ্যায়গুলো শুনেই আমার মনে হয়েছিল। এ ছন্দে শেষরক্ষণ করা সহজ কর্ম নয়। এর জন্য যতখানি পরিশ্রমের প্রয়োজন, দিনেন্দ্ৰনাথের হয়তো ততখানি নেই।
আমি দিনেন্দ্রনাথের নিন্দে করছি নে। কিন্তু আমি জানি তিনি গান গাইতে, বাজনা বাজাতে, গানবাজনা শুনতে, সাহিত্যরস উপভোগ করতেন, প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে, আড্ডা জমাতে, বন্ধুবান্ধবকে খাওয়াতে, বিদেশীদের আদর-আপ্যায়ন করাতে এত আনন্দ পেতেন যে কোনো প্রকারের কীর্তি নির্মাণ করাতে ছিলেন তিনি সম্পূর্ণ পর্যাম্বুখ, নিরঙ্কুশ বীতরাগ।
নাই বা হল সে শাস্ত্র সে কীর্তি গড়া! আজ যদি দিনেন্দ্ৰ-শিষ্যেরা আপন আপন নৈবেদ্য তুলে ধরেন, তবে তার থেকেই নূতন শাস্ত্ৰ গড়া যাবে।