দিনশেষে

দিনশেষে

নাড়ুবাবু ইণ্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে ছিলেন। একসময় দিল্লির সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েটেও পোস্টেড ছিলেন। নর্থ ব্লকে। অল ইণ্ডিয়া সার্ভিস। চাকরিতে ঢোকার পর থেকে সারা ভারতবর্ষেই ঘুরতে হয়েছে। রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক বাকি আছে। তাই রিটায়ারমেন্টের আগে আবার মধ্যপ্রদেশেই ফিরে এসেছেন। এখানকারই লোক তিনি। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই অবসর নেওয়ার আগে নিজ নিজ রাজ্যেই ফিরে আসেন যাতে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বসতে পারেন। সারাজীবনের মতো।

নাড়ুবাবুর কিন্তু কর্ণাটক জায়গাটিও খুব পছন্দ হয়েছিল। বিশেষ করে ব্যাঙ্গালোর। মাইশোরও রিটায়ার করে থাকার পক্ষে চমৎকার জায়গা।

সস্তাতে একটা বাড়িও পেয়েছিলেন ব্যাঙ্গালোর থেকে হুইটফিল্ডে যাওয়ার পথে। থাকুন আর না-ই থাকুন, তখন কিনে রাখলে আজকে সেই বাড়ি বিক্রি করেই বড়োলোক হয়ে যেতে পারতেন। ব্যাঙ্গালোরে থেকে হয়তো যেতেনও, যদি-না তাঁর স্ত্রী মিনতিকে আর্থরাইটিস কাবু করে ফেলত। ব্যাঙ্গালোরের সব ভালো কিন্তু যাদের বাত-টাত বা আর্থরাইটিস আছে তাদের পক্ষে জায়গাটি মোটেই সুবিধের নয়। বেশিদিন থাকলে, যাদের নেই তাদেরও হতে পারে।

অনেক দেখে দেখে, ভেবে-টেবে নিজরাজ্যে, নিজের ছেলেবেলায় এবং প্রথম যৌবনে যেখানে কেটেছে সেই জব্বলপুরেই ফিরে এলেন। মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে ছিলেন গত বছর। সেখান থেকেই এসেছেন জব্বলপুরে। ভাগ্যিস সিভিল লাইনসে পাঁচপেডিতে তাঁদের বাবা এবং বড়দার তৈরি বাড়িটি ছিল। বড়দা আর নেই। ব্যাচেলর ছিলেন তিনি। মেজদা হারু কলকাতায় গিয়ে সেটল করেছেন। বউদি বালিগঞ্জের মেয়ে। কলকাতার বালিগঞ্জের তুলনায় জব্বলপুর যে থাকার মতো একটা জায়গাই নয়, একথা সম্বন্ধে বউদি এবং মেজদারও কোনো দ্বিমত ছিল না। কলকাতায় বাঙালিদের যে কী মধু আছে তা তাঁরাই জানেন। গতবছর মেজদার মেজোছেলের বিয়েতে দিন চারেকের জন্যে যেতে হয়েছিল। নিশ্বাস নেওয়া যায় না, হাঁটা যায় না ভিড়ে। স্কুল কলেজ হাসপাতাল যানবাহনের অবস্থা দেখে বাঙালি হয়েও কলকাতা সম্বন্ধে সব মোহই উবে গেছে তাঁর। পালিয়ে আসতে পেরে বেঁচেছেন। লোডশেডিং, ম্যালেরিয়া, পাড়ায় পাড়ায় গুণ্ডা মস্তানদের অত্যাচার, এসব দেখে বাঙালি হিসেবে বড়ো লজ্জিত হয়েই ফিরে এসেছেন তিনি।

জব্বলপুরের সিভিল লাইনস বেশ অভিজাত পাড়া। নিরিবিলি ছিমছাম। মিনতি যদি থাকত, তবে রিটায়ার্ড লাইফ খুব সুখেই কাটাতে পারতেন নাড়ুবাবু। মিনতিরও পছন্দ ছিল খুব জব্বলপুর জায়গাটা। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, তার কমই সত্যি করে তোলা যায় এক জীবনে। মিনু হঠাৎই চলে গেছে যখন দিল্লিতে থাকতেন ওঁরা। গলায় ক্যান্সার হয়েছিল। অনেক দেরিতে ধরা পড়েছিল। কিছুই করা গেল না। জর্দার নেশা ছিল খুব। ঘনঘন পান খেত, জর্দা দিয়ে।

সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। সময় বড়ো বেইমান, অকৃতজ্ঞ। আজকাল দিনান্তে মিনুকে মনে করার সময় এক বারও হয় না। শুধু শুতে যখন যান, তখন তাঁর খাটের ঠিক সামনের দেওয়ালে রাখা ছবিটির দিকে চোখ পড়লেই অনেক কথা মনে পড়ে। তবু রোজই কি আর পড়ে চোখ! চোখও বেইমান বড়ো!

পাঁচপেডিতে তাঁদের বাড়ির পাশের বাড়িই ছিল রায় সাহেবদের। রায় সাহেবের বড়োছেলে নির্মলদা ছিলেন মেজদার ক্লাসফ্রেণ্ড। মস্ত বাংলো টাইপের বাড়ি। সামনে ছোট্ট লন আর পেছনে বাগান। তখন বাগান ছিল, মানে নাড়ুবাবুর ছেলেবেলায়। গাছগুলো সব এখন এতবড়ো হয়ে গেছে যে, দূর থেকে জঙ্গল বলে মনে হয়। রায় সাহেবের বড়োছেলে। নির্মলদার স্ত্রীর ছোটোবোন নিরুপমা। তখন থার্ড ইয়ারে পড়েন নাড়ুবাবু। নিরুপমা সবে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দিদি-জামাইবাবুর কাছে বেড়াতে এসেছেন। দু-টি বাড়ির পেছনেই মস্ত বাগান। এখন আরও ঘন হয়েছে। গাছগুলো সব মহিরুহ হয়ে উঠেছে। বাগানে তখন পেয়ারাই ছিল বেশি। এখন দেখছেন আম। অন্য হরজাই গাছও অনেক ছিল। সারাদুপুর টিয়া ঘুঘু আর বুলবুলিদের ডাকের মধ্যে একজোড়া বুলবুলিরই মতো ঘুরে বেড়াতেন নাড়ুবাবু আর নিরু সেই বাগানে। কত কী নিয়ে আলোচনা করতেন। গান-সাহিত্য-ছবি। মাত্র দেড় বছর ছিল নিরু। দেড়শো বছরই যেন মনে হত ও কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পর। ভালোবাসা কাকে বলে জানতেন না তখন। দু-জনের কেউই নন। যদিও ভালো লাগা কাকে বলে তা জানতেন। নিরু চলে যাওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত চিঠি লেখালেখিও ছিল দু-জনের মধ্যে। নাড়ুবাবুর মনে হয়, তখনকার দিনে ছেলে-মেয়েরা এত পাকা ছিল না। চিঠির মধ্যে গান-বাজনা, প্রকৃতি, সাহিত্য, পারিবারিক খবরাখবর এই সবই থাকত শুধু। প্রেম মানে যে প্রেমের কথা নয়, ভালোবাসার গদগদে ডায়লগ নয়, প্রেম মানে যে গভীরতর নিরুচ্চার কিছু রুচির মিল, পছন্দর মিল এবং অপছন্দের মিল, প্রেম মানে দু-জনেরই দু-জনের পরিবারের সকলকে ভালো লাগা; এসবই বুঝতেন তাঁরা। দিনকাল অন্যরকম ছিল।

নিরুর বিয়ের চিঠির সঙ্গে আরও একটি চিঠি পাঠিয়েছিল সে নাড়ুবাবুকে। লিখেছিল, ‘আর চিঠি লিখবেন না কিন্তু নাড়ুদা আমাকে। আমার এখন বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমার স্বামীর ঔদার্য সম্বন্ধে আমার কোনো স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারণাও নেই। যদি তিনি উদার হন-ও তবুও চিঠি আমাদের কারওরই আর না লেখাই ভালো। যদি কোনো কারণে আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমি বড়োই দুঃখ পাব। আশা করি, আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না! চিঠি আপনাকে আমি লিখব না বটে, তবে আপনার সব খবরই নেব দিদি-জামাইবাবুর কাছ থেকে। প্রতিচিঠিতেই আপনার কথা লিখব। আপনিও লিখবেন দাদার কাছে। কলকাতায়। আমাদের বাড়িতে। দাদা-বউদির কাছেই আমার সব খবর পাবেন। অন্যকে লেখা চিঠির ভেতর দিয়ে আমাদের যোগাযোগ অটুট থাকবে। যদি আমার স্বামী সত্যিই উদার ও প্রকৃতার্থে শিক্ষিত হন তবে আপনাকে আমিই লিখব। কে বলতে পারে? আজ থেকে অনেক অনেক বছর পরে আমাদের হঠাৎ আবার দেখা হয়ে যাবে না কোথাও? খুব মজা হবে কিন্তু তাহলে। তাই না?’

দুই

মজা হল কি না জানেন না নাড়ুবাবু। মজা হয়তো হল না। কিন্তু কিছু-একটা হল। এত বছর পর।

নিরুর স্বামী মারা গেছেন দু-বছর হল। সেক্রেটারি ছিলেন দিল্লির সাউথ ব্লকে। ছেলেও আই.এ.এস. হয়েছে। এখন ওড়িশাতে পোস্টেড। বিয়েও করেছে একটি আই.এ.এস. মেয়েকে। দু-জনের আলাপ হয় মুসৌরিতে ট্রেনিং-এ থাকার সময়। মেয়ে শীলা এম.এ. পড়ে। সেও নিরুর সঙ্গেই এসেছে। নি:সন্তান দিদি-জামাইবাবুর কাছে থাকতে এসেছে ওরা তাঁদেরই আমন্ত্রণে।

জব্বলপুরে পৌঁছেই পরদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন নাড়ুবাবু, রোজকার অভ্যেসমতো। টেনিস খেলতেন। ইসকিমিয়া ও অ্যানাজাইনার জন্য ডাক্তারের বারণ আছে এখন। শুধুই হাঁটেন। শর্টস পরে, হাতে লাঠি নিয়ে। পাঁচপেডির রাস্তায় এখনও বড়ো বড়ো গাছ আছে অনেক। উঁচু একটা ওয়্যারলেসের টাওয়ার হয়েছে কাছেই। তাঁদের ছেলেবেলায় এই সিভিল লাইনস একেবারেই অন্যরকম ছিল। পুজোর পরে ভোরের কুয়াশাতে কেমন আবছা আবছা লাগে সকাল বেলাটাকে।

ওঁর উলটোদিক থেকে একটা অল্পবয়সি মেয়ে হেঁটে আসছিল। জিনসের ট্রাউজার পরনে তার। গায়ে একটি গেঞ্জি হলুদরঙা। প্রলিনের। তার ওপরে হালকা নীল হাফ-স্লিভস সোয়েটার। আজকালকার ছেলে-মেয়েতে তফাত নেই বিশেষ, পোশাক-আশাকে। ভাবছিলেন নাড়ুবাবু। অভ্যস্তই হয়ে গেছে চোখ এখন। মেয়েটি যখন কাছে এল, তিনি চমকে উঠলেন। ওঁর মুখ থেকে অসাবধানে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল শব্দটি : নিরু….

মেয়েটি তাঁকে পেরিয়ে চলে গেছিল। হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ল। ভুরু তুলে সামান্য বিরক্তির সঙ্গে নাড়ুবাবুকে ইংরেজিতে বলল, ‘আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?’

নাড়ুবাবু উত্তর না-দিয়ে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন?

একেবারেই নিরু। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের নিরু। সেই কপাল, চুল বাঁধার ঢং, সেই চোখের উজ্জ্বলতা হুবহু তেমনই; ঠোঁটে আর চিবুকে ঠিক সেইরকমই গর্ব-গর্ব ভাব।

থতোমতো খেয়ে চুপ করে রইলেন নাড়ুবাবু কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, না আপনাকে নয়। আপনারই মতো একজনকে আমি চিনতাম আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। তার নাম ছিল নিরুপমা। তাই…। আপনি মনে করলেন না তো কিছু।

মেয়েটি হাসল।

কী আশ্চর্য! হাসিটাও অবিকল নিরুরই মতো।

বলল, উনি কোথায় থাকতেন? জব্বলপুরেই কি?

—না। থাকতেন না। আমাদের প্রতিবেশী আছেন নির্মলবাবু, তাঁর বাড়িতেই এসে ছিলেন দেড় বছরের মতো। নির্মলবাবু নিরুপমার জামাইবাবু হতেন!

—ও! তাই বুঝি? নির্মলবাবুর পদবি কী?

—রায়। নির্মল রায়। রায় সাহেব পরেশ রায়ের ছেলে। আপনি কী চেনেন নাকি নির্মলদাকে? নির্মলবাবুকে?

নাড়ুবাবু উৎসাহের সঙ্গে শুধোলেন। বললেন, কোনো আত্মীয়তা আছে কি?

—না না, চিনি না। আমি কী করে চিনব? চলি।

বলেই, মেয়েটি চলে গেল।

অনেকক্ষণ ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন নাড়ুবাবু।

হাঁটার ধরনটাও অবিকল নিরুরই মতো। চলকে চলকে অদৃশ্য কোনো বাজনা বাজিয়ে চলেছে যেন। নাড়ুবাবুর একবার মনে হল যে, মেয়েটির চোখে কথা বলার সময়ে যেন প্রচ্ছন্ন কৌতুক ঝিলিক মারছিল। ঠিক বুঝলেন না। নতুন বাইফোকাল চশমা নিয়েছেন। মাঝে মাঝে চলতে গিয়ে হোঁচট খান। যা দেখতে চান তা চোখের মধ্যে লাফালাফি শুরু করে। তাই এই কুয়াশা-ভরা হেমন্তর ভোরে চশমা না নিয়েই বেরিয়েছিলেন।

মেয়েটি…ভুরু তুলে…ইংরেজিতে বলল, ‘আপনি কি আমাকে কিছু বললেন ?’

মেয়েটি মনের গোপন ভাবটি ঠিক ভালো করে ঠাহর করতে পারলেন না। কেন যেন ওঁর মনে হতে লাগল, এই মেয়েটি নিশ্চয়ই নিরুরই মেয়ে। কে জানে? নিরু কি বেঁচে আছে? সত্যিই কি কারও সঙ্গে দেখা হল তাঁর একটু আগে? পেছনে চেয়ে দেখলেন। না:, ঝুপড়ি ঝুপড়ি বড়ো গাছপালার তলায় কুয়াশার চাপ। মেয়েটিকে, তাঁর স্মৃতিকে, খেয়ে ফেলেছে কুয়াশা।

তিন

শীলা জগিং করে বাড়ি ফিরেই ডাকল, মা!

নিরুপমা বাড়ির ভেতরের উঠোনের দাওয়ায় বসে জলখাবারের জন্য কুটনো করছিলেন। জামাইবাবু নির্মলদা ডালপুরি খেতে ভালোবাসেন। ডালপুরির সঙ্গে বেগুন ভাজবেন বলে বেগুন কুটছিলেন। আজ রবিবার। ওঁদের অবশ্য এখন রোজই রবিবার।

—মা!

নিরুপমার মাথার মধ্যে ধাক্কা দিল শীলু।

—হলটা কী? সকাল বেলা এত চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?

চিৎকার শুনে নির্মলবাবুও বেডরুমের বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলেন। ড্রেসিং গাউন পরে রোদে পিঠ দিয়ে বসে তিনি পাইপ খেতে খেতে কাগজ পড়ছিলেন। বললেন, কী রে শীলু? হলটা কী? এত শোরগোল কীসের?

—ও মেসো, ও মেসো! মাকে বলো, আমাকে খাওয়াতে হবে।

শীলু উত্তেজিত হয়ে বলল।

—কেন? সাতসকালে হঠাৎ তোকে খাওয়াতে হবে? খুলেই বল।

আমি জগিং করার পর হেঁটে ফিরছিলাম, এমন সময় দেখি একজন ভেরি টল, একস্ট্রিমলি হ্যাণ্ডসাম প্রৌঢ় ভদ্রলোক লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে আসছেন। আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বিড়বিড় করে বললেন, নিরু…নিরুপমা। স্বগতোক্তির মতো। আপনমনেই।

—কে? কে?

চমকে উঠে বললেন, নিরু।

বললেন, দ্যাখ শীলু, সাতসকালে মা-মেসোর সঙ্গে ইয়ার্কি, না? সবসময় তোর এই ফাজলামি ভালো লাগে না। আজকাল তোদের একটা সেন্স অফ প্রোপোরশনই নেই।

কথাগুলি বলতে বলতে ফর্সা মুখ কিন্তু লালও হয়ে উঠল নিরুপমার। তাঁর ভেতরে ভেতরে তখন ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছিল।

—সত্যি মা! শীলু বলল।

যত বাজে কথা!

মেসোমশাই নির্মলবাবু বললেন, চিন্তায় ফেললি রে শীলু। পাঁচপেডির রাস্তাতে কে তোকে দেখে নিরু বলে ভুল করবে? কোনো পাজি বুড়ো-টুড়ো তোর সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টায় এমন করছে না তো? তার বিয়ের যোগ্য ছেলেও থাকতে পারে।

—না না। অমন রেসপেক্টেবেল চেহারার লোক কখনো পাজি হতেই পারেন না।

—কী জানি। জব্বলপুরে তো তোর মা স্কুল ফাইনাল পাশ করে এসে দেড় বছরই মোটে ছিল।

তারপর শালির দিকে ফিরে বললে, তুমি কি কিছু অনুমান করতে পারছ? নিরু?

—আমি? না! আ-আমি, কী করে?

ডাহা মিথ্যে কথা বললেন নিরুপমা।

বাথরুম থেকে মাসি বেরুতেই শীলা বলল, ও মাসি! শিগগির এসো। মিষ্টিমুখ করতে হবে।

—কীসের মিষ্টি?

—আমাকে দেখে এক একস্ট্রিমলি হ্যাণ্ডসাম, টল এলডারলি ভদ্রলোক নিরু নিরু করে রাস্তায় প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়ে যাচ্ছিলেন। বললেন এক নিরুকে তিনি চিনতেন যিনি নির্মলবাবুর শালি…তিরিশ…বছর নির্মল রায়েরই শালি। রায় সাহেব পরেশ রায়েরই ছেলে নির্মল রায়। তাহলে?

আমি ? না! আ-আমি,কী করে ? ডাহা মিথ্যে কথা বললেন নিরুপমা।

—ও-ও-ও…তাই বল। নাড়ু হবে নিশ্চয়ই। কালই বিকেলে তো এসেছে ওরা শুনলাম। রিটায়ার করছে শিগগিরই। এখানে নাকি সেটল করবে।

—পার্মানেন্টলি?

চোখ বড়ো বড়ো করে শুধোল শীলু।

—হ্যাঁ। না তো কী! নিজেদের বাড়ি আছে। এখানেই মানুষ হয়েছে। আসবে না? হারুবাবু তো কলকাতার বালিগঞ্জি মেয়ে বিয়ে করে কলকাতাতেই গিয়ে থিতু হলেন জব্বলপুর ছেড়ে।

—তা করুন। বেশ করুন। সেটল করুন, থাকুন, আসবেন। কিন্তু এ কী! আমার একমাত্র মাকে নিয়ে এমন…। না:, বাবাকে প্ল্যানচেটে ডাকতে হবে আমায়।

শীলু বলল, মুখে কৃত্রিম গম্ভীরতা এনে। বাবাকে সব রিপোর্ট করতে হবে।

ঠিক সেই সময়ই গিদাইয়া, বাড়ির বেয়ারা, ভেতরের উঠোনে এসে মেসোকে বলল, এক সাহাব আয়া।

—কউন সাহাব? ইতনা সুব্বে সুব্বে? নাম নেহি পুছা?

—পুছাতো যা সাব। উনোনে কহা, বগলওয়ালা কোঠিসে আয়া হুয়া। নাম নেহি বোলা।

মেসোমশাই নির্মলবাবু চকিতে একবার শীলুর চোখে তাকালেন। বললেন, শীলু মা, দ্যাখ তো গিয়ে কে এসেছেন? বসা ড্রয়িংরুমে। পুবের জানলাগুলো খুলে দে। আলো আসুক ঘরে।

শীলু চলে যেতেই, নিরুর দিদি, নির্মলবাবুর স্ত্রী বললেন, বগলওয়ালা কোঠি থেকে? তারপর বললেন, নিশ্চয়ই নাড়ু।

নির্মলবাবু বললেন, আমার টোব্যাকোর টিনটা এনে দাও তো পারু।

নিরুর দিদি ঘর থেকে যেতেই জামাইবাবু শালিকে বললেন, ডালপুরি বেশি করেই করো, হাঁটলে খিদে পায় মানুষের। বলেই গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন—

‘মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায়।

বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।

হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়

আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়…’

—নির্মলদা!

রোদ-ভরা বারান্দা থেকে মুখ নীচু করে প্রতিবাদ করলেন নিরু। তারপর কুটনো কাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি বাথরুমে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি আজ চান করব। আজ ওঁর মৃত্যুদিন। শীলুটা জানে, তবুও…সবসময় কি ইয়ার্কি ভালো লাগে বলুন নির্মলদা? আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে গভীরতা বলে কি কিছুই নেই?

নির্মলবাবু বললেন, সরি নিরু। মনে আমারও ছিল না। পাঁচ-পাঁচটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল। আচ্ছা, যদি নাড়ু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? কী বলব?

—বলবেন…। বলবেন যে, আজ নয়। আজ আমার শরীর ভালো নেই। ব্লাড সুগারটা বেড়েছে। তা ছাড়া বলবেন যে, আজ ওঁর মৃত্যদিন। আমার মন ভালো নেই।

পারু পাইপের টোব্যাকোর টিনটি নিয়ে এসে দিলেন নির্মলবাবুর হাতে।

অবাক হয়ে বললেন, ও কী। নিরু কোথায় গেল?

—বাথরুমে।

—হঠাৎ? কেন?

—আজকে শ্যামলের মৃত্যুদিন, একথা তুমি আমাকে আগে বলবে তো। না জেনে, নিরুর সঙ্গে ফাজলামি…

—তুমিই তো এই করতেই আছ! কোনো সেন্স নেই তোমার….আর মেয়েটাও তেমনই। আমার বলতেই-বা হবে কেন? বোন কি আমার, না তোমার? আমার মনে থাকে আর তোমার থাকে না কেন?

বলতে বলতেই শীলু এল উঠোনে।

—কী রে? চলে এলি? একা বসিয়ে রেখে? ছি:।

—উনি তো চলেই গেলেন।

—কেন? কেন রে?

—খুবই বকলেন আমাকে। বোধ হয় আমাকে বকতেই এসেছিলেন।

—কেন? কী বলল কী নাড়ু?

—বললেন, মা! যৌবনের খুশি দিয়ে, যাদের যৌবন চলে গেছে তাদের আহত কোরো না কখনো। যৌবন কারওই চিরদিন থাকে না। তোমার বলা উচিত ছিল যে, নিরু তোমার মা। তোমার বাবা কোথায়? কখনো আলাপই হয়নি ওঁর সঙ্গে।

আমার বাবা….। আমি কথা শেষ করার আগেই উঠে পড়ে বললেন, না:, থাক। আমার স্ত্রীর মৃত্যুদিন আজ। বলেই, উনি চলে গেলেন। সত্যিই চলে গেলেন। আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেলেন। গেটের কাছে পৌঁছে বললেন, নির্মলদাকে আর পারুবউদিকে বোলো যে, আমি এসেছি এখানে কাল বিকেলে। এখন তো এখানেই থাকব। দেখা হবে। তাড়া নেই কোনো। আসব আবার।

নিরুপমা বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। সকলের মুখে চেয়েই বুঝলেন যে, কিছু-একটা ঘটেছে।

বললেন, নির্মলদার সঙ্গে একটু বাজারে যাবি? ড্রাইভার আসবে না আজ, না?

—আজ তো রবিবার।

নির্মলবাবু বললেন, না নাড়ু নিজেই চলে গেল নিরু। বসল না একটুও। শ্যামলের মৃত্যুদিনের কথা আমারও কিছু বলতে হল না।

—কেন? নিরুপমা শুধোলেন।

শীলু বলল মুখ নীচু করে—আজ ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুদিন না।

—ওঃ তাই বুঝি….

মুখ নামিয়ে বললেন নিরু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *