দিনলিপি – ১০

দিনলিপি

আত্মজীবনী লেখার প্রচেষ্টা

আমার অগ্রজ তার বাল্য, কৈশোর ও পরিণত জীবন যে দেশকালপাত্রের ভিতর কাটে তার বর্ণনা লিখেছেন। এতে করে প্রধানত শ্রীহট্টবাসী, গৌণত পূর্ব পাকিস্তান, এমনকি আসামবাসীরাও উপকৃত হবেন। মুখবন্ধে তিনি বিশেষ করে নবীন সেনের দৃষ্টান্ত তুলে নিবেদন করেছেন, তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবন যতদূর সম্ভব চেপে গিয়ে সেই সময়ের কথা বলবেন বেশি। এ অতি উত্তম প্রস্তাব ও সাতিশয় বিনয়ের লক্ষণ সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয় শ্রীহট্ট জেলার কৃতী-সন্তানের কাছে তাঁর দেশবাসী তার জীবন সম্বন্ধেও অনেক কিছু জানতে উৎসুক। আর কিছু না হোক, স্কুল-কলেজের ছেলেছোকরারা অন্তত জানতে চাইবে, তিনি কী করে শিক্ষাজীবনে ম্যাথমেটিক্স-ফিজিক্স অধ্যয়ন করে পরবর্তী জীবনে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক, নৃতত্ত্ববিদ, ভৌগোলিক, তথা আর্ট ও স্থাপত্যের পণ্ডিত হলেন। বস্তুত অধুনা প্রকাশিত তাঁর চর্যাপদ সম্বন্ধে অতিশয় গবেষণামূলক প্রবন্ধ না পড়ার পূর্বে আমারও জানা ছিল না, ভাষাতত্ত্বেও তিনি কতখানি ব্যুৎপত্তি লাভ করেছেন।

কিন্তু এস্থলে এটা আমার মূল বক্তব্য নয়। মমাগ্রজ আমাকে অনুরোধ করেছেন, যেহেতু আমরা একই পাঠশালে একই স্কুলে পড়েছি, অতএব আমিও যদি আমার বাল্যস্মৃতি স্মরণ করি তবে তাঁর ভুলে যাওয়া কথাগুলোও তাঁর স্মরণে আসবে।

এটিও উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু বিপদ এই যে, আমি প্রায় ষোল বছর বয়েসে, স্কুল পাস করার পূর্বেই দেশ ছেড়ে পশ্চিম বাঙলার শান্তিনিকেতনে চলে আসি এবং পরবর্তী জীবনের অধিকাংশ বাইরে বাইরে কাটে। গোড়ার দিকে বছরের দুই ছুটিতেই দেশে গিয়েছি, পরবর্তী জীবনে সেটাও সম্ভব হয়নি– বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে।

মানুষ বিদেশে দীর্ঘকাল থাকলে বাল্যস্মৃতি ম্লান হয়ে যায়। তার কারণ দেশে থাকলে দেশের লোকজন ঘরবাড়ি তাকে পুনঃপুন প্রাচীন দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি ক্রমে ক্রমে দেশের নানা প্রাচীন কীর্তিকাহিনীও সে শোনবার সুযোগ লাভ করে– বাল্যে যেগুলোর প্রতি স্বভাবতই তার কোনও কৌতূহল ছিল না।

আমার ভাগ্যে হয়েছে উল্টোটা। বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে, সিলেটি বলা দূরে থাক, বাঙলা বলারও সুযোগ ঘটেনি। দেশের লোকজন, ছেলেবেলার ঘটনাগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেগুলোকে সজীব রাখার জন্য জলসিঞ্চন করার নসখা প্রায় পাইইনি বললেও অত্যুক্তি হয় না। স্মৃতির অঙ্গনে চটুল নৃত্য জাগাতে হলে এক হাতের করতালি অসম্ভব।

অথচ স্মরণ করিয়ে দিলে এখনও অনেক কিছু মনে আসে।

পূর্বেই আমার ভাতার বিষয়ের উল্লেখ করেছি। তার স্মৃতিকাহিনীতে তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন : তিনি গোড়ার দিকে রীতিমতো পয়লারি স্কুল-পালানো ছেলে ছিলেন। আমার তখন হঠাৎ যেন কোন যাদুমন্ত্রের বলে চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছবিটি। দু তিনখানা তক্তপোশ-জোড়া বিরাট খাটে সুদূরতম প্রান্তে দাদা দেয়ালে হেলান দিয়ে মুখের ভাব করেছেন, পাদমেকং ন গচ্ছামি; বিদ্যামন্দির নৈব নৈব চ। বাবা-মা সাধাসাধি করছেন। কড়ে আঙুলে দোয়াত ঝুলিয়ে বড়দা স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে বিরক্তি প্রকাশ করছেন ও সবচেয়ে বেশি কাকুতিমিনতি করছেন আমাদের সম্পর্কে দাদা আলফী মিয়া। আর আমি এই পাঁচজনের বাইরেপাঁচের বাদ। আমি শুধু ঘুরঘুর করছি চতুর্দিকে। আর ভাবছি, আমাকে যেতে দিলে আমি এখখুনি যাই। তখনও স্কুল নামক ব্যাটির সঙ্গে পরিচয় হয়নি বলে দাদার আতঙ্ক কিছুতেই হৃদয়ঙ্গম হত না।

অথচ দাদা বলতে বেবাক ভুলে গেলেন না চেপে গেলেন– সে যখন যেতে আরম্ভ করলেন তখন এক লতে শুয়াগাছের মগডালে উঠে বসলেন অবহেলে। এবং সেই যে বসলেন, তার পর কখনও তাকে কেউ নামতে দেখেনি। পরে সপ্রমাণ হল তিনি আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে সেরা পড়ুয়া।

সামান্য দুএকটি উদাহরণ দিই।

তখনকার দিনে আর কটি মুসলমান ছেলে স্কুলে যেত? এবং তাদেরও প্রধান আতঙ্ক ছিল অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি। অথচ সপ্তম শ্রেণিতে উঠে তিনি গায়ে পড়ে নিলেন মেকানিকস্যার জন্য দরকার তুখোড় ম্যাথ জ্ঞান। এবং তখনকার দিনের দুই অঙ্কবিশারদ ক্ষীরোদবাবু (ইনি অল্পবয়সে গত হন) ও গোপালবাবুর প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠলেন। পরবর্তী যুগে কলেজে নিলেন 1.Sc. সে-ও এক বিস্ময়। বি.এস-সিতে সেকেন্ড ক্লাস অনার্স পেয়ে তার ক্ষোভের অন্ত ছিল না। তার জন্য প্র্যাকটিকালের একটি দুর্ঘটনা দায়ী। স্থির করলেন, এম.এস-সিতে সেটা তিনি অধ্যাপক রামনের (তখনও রামনরশ্মি আবিষ্কৃত হয়নি ও তিনি ও তাঁর অন্যতম সহকর্মী শিষ্য কৃষ্ণন বিশ্ববিখ্যাত হননি) কাছে শিক্ষালাভ করে পুষিয়ে নেবেন।

দিনলিপি
(১২ বৈশাখ ১৩৬৭– ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭)
CALCUTTA– ISHURDI– RAJSHAHI
১২ বৈশাখ ১৩৬৭

A terrible journey from Calcutta to Rajshahi.

Yesterday it was 107° here in Calcutta. Fancy catching the train at 16.00, hottest part of the day. Kendu, Mukuldi, Ghantu, Saumen & Prof Saurin Dasgupta at the station.

I do not recollect the times. From 19 to 21 or more at Darsana (India) From 21.30 to 23.45 of so, at Darsana (Pak).

1.35 Ishurdi. No room in the waiting room. Hot like hell even at that early hour. Wait wait till 6. Train left at 7.45. No fan in the compartment till 7.35. Hell again. I thought it was the last leap. No, another change at Abdullapur at about 8.15. jump up & down the railway line ditch. Hot platform! Wait for the train. Train left at 8.30.9.30. at Rajshahi.

***

রাজশাহী

১৫ বৈশাখ, ১৩৬৭

এ কদিন ধরে পুব বাঙলার সর্বত্রই অসাধারণ গরম যাচ্ছে। কোনও কোনও জায়গায় ১০৫° পর্যন্ত উঠেছে। ঢাকা ১০২°, দিনাজপুর ১০৬°। রাজশাহী তো terrific তবে তার উত্তাপ কাগজে দেয়নি। এখানকার লোকে বলছে ৫/৭ বছরের ভিতর এরকম গরম পড়েনি। কাগজ বলছে, উত্তর-পশ্চিম থেকে আসা গরমের ফলে। এখানে এসেছি অবধি সেই হাওয়াই দেখছি। দক্ষিণে পদ্মা– সেখান থেকে এযাবৎ কোনও হাওয়া আসেনি। কালবৈশাখী বা অন্য কোনওপ্রকারের বৃষ্টি, রাজশাহী অঞ্চলে অন্তত এখনও হয়নি।

অথচ একেবারে খোলা ছাদে শুয়ে ভোরের দিকে গায়ে একখানা চাদর টানতে হয়।

***

১৬ বৈশাখ, ১৩৬৭

এখানে আজ এই প্রথম দক্ষিণের বাতাস পেলুম। কিন্তু ১০/১১ টার ভিতর সেটা বন্ধ হয়ে গেল। তার পর উত্তর-পশ্চিমের বাতাস। তবে কালকের মতো দুর্দান্ত নয় ও পদ্মাকে সাদা সাদা ফেনার ঢেউয়ে বিক্ষুব্ধ করেনি।

***

১৭ বৈশাখ, ১৩৬৭

উত্তর-পশ্চিমের বাতাস কাল থেকে বন্ধ হওয়াতে গরম অল্প কম।

 Message incomplete-এর বদলে একটা কাগজে ছিল massacre incornplete. খবরটা ছিল কোথাকার যেন ম্যাসাকারের। কিন্তু শেষে messacre incomplete সেনসরের ম্যাসাকার না খবরের ম্যাসাকার বোঝা গেল না।

.

এবারের গরম পূব বাঙলায়ও ভীষণ। ডেলি কাগজে প্রথম পৃষ্ঠায় রোজই ফ্ল্যাশ করছে। পাঁচ বসরে এরকম হয়নি। আমার হিসেবে তারও বেশি। সাত মাস ধরে এদেশে বৃষ্টি হয়নি। Simply terrific.

পশ্চিম বাঙলার কোনও খবর পাচ্ছিনে। কিন্তু সেখানে নিশ্চয়ই বৃষ্টি হয়নি, ঠাণ্ডাও পড়েনি। কারণ তা হলে পূর্ব বাঙলাকে যে তাতিয়ে তুলেছে উত্তর-পশ্চিম থেকে আসা গরম হাওয়ায় সেটা এল কী করে?

শীতে বৃষ্টি হয়নি। গরমে দিনের পর দিন শুকনো কেটে যাচ্ছে, আদপেই বৃষ্টি হল না, এরকম অবস্থা পূর্ব বাঙলায় আমি কখনও শুনিনি।

***

১৮ বৈশাখ, ১৩৬৭ আজকের কাগজ বলছে, দু একদিনের ভিতর ঝড়ঝঞ্ঝা হতে পারে। এখানে তার একমাত্র লক্ষণ, আকাশে .০১ হয়, কি না হয়, উটকো শরঙ্কালের হালকা মেঘ! এখন পশ্চিমের বাতাস বন্ধ। সকালে অল্প দক্ষিণা বাতাস পদ্মার উপর দিয়ে এল– সুশীতল না হলেও বেশ ঠাণ্ডা।

কলকাতায় গত ৩৪ বৎসরের মধ্যে এরকম পরপর এত অধিক তাপ দেখা যায়নি। ১৯৫৯-এ মাত্র একদিন ১০৮° থেকে ফের গরমি কমে যায়।

৭/৫/৬০-এর খবরের কাগজ রাজশাহী থেকে ৫/৫-এর খবরে বলছে এখানে নাকি পয়লা মেতে hottest day with 108° গেছে। ব্যস! তার আগে যে একটা খবর বেরুল ২৮/৪-এ এখানে ১১০° গেছে?

ধর্ম জানেন আমি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এই যে প্রতি সন্ধ্যায় বিদকুটে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে খচখচানি আর তার সঙ্গে সঙ্গে বেসুরা বেতালা গান রাত বারোটা-তেরোটা অবধি এরও একটা সীমা থাকা দরকার।

ক্ষীণ চাঁদের আলো, মাথার উপর সপ্তর্ষি, দূর পদ্মার মৃদু গুঞ্জরণ, নারকেল-গাছের অল্প শিহরণধ্বনি– এছাড়া কোনও শব্দ নেই– শান্ত-গম্ভীর পরিবেশ, কেমন যেন রহস্যময়। এর ওপর এই অসহ্য খচখচানি!

***

২০ বৈশাখ, ১৩৬৭

 মানিকগঞ্জ এলাকায় পদ্মার ভীষণ ঝড় ও নৌকাডুবি।

 কয়েকদিন ধরে উত্তর-পশ্চিমের গরম হাওয়া বন্ধ।

আজ দুপুর আর বিকেল গেল গুমোট গরমে। ১০৮০-এর কম নিশ্চয় নয়।

উনিশটার সময় এল দক্ষিণ থেকে ঝড় লু। অতিশয় সূক্ষ্ম সাদা ধুলোতে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল। দুরাশা গল্পে রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিঙে কুয়াশায়-ঢাকা পৃথিবী দেখে বলেছিলেন, ভগবান যেন রবার দিয়ে সৃষ্টি ঘষে তুলে ফেলতে চান। এখানে সাদা ধুলো দিয়ে। এ ধুলো পদ্মচরের।

পদ্মা নদী পর্যন্ত আর দেখা গেল না।

কিছুক্ষণের জন্য সপ্তর্ষি পর্যন্ত লোপ পেল।

ন টার সময় সামান্য একটু ক্ষান্ত দিয়ে ফের সমস্ত রাত জোর দক্ষিণের বাতাস বইল। ঠিক ঝড় নয়– ঝোড়ো বাতাস। এখনও চলছে।

আকাশের অতি উচ্চ যে আড়াইখানা ছেঁড়া মেঘ তারা পশ্চিমদিকে চলে গেল।

বিদ্যুৎ চমকালো না, মেঘ ডাকল না।

 বাতাস এসময় যতটা ঠাণ্ডা হয় ততটাই– কোনওদিকে বৃষ্টি হয়ে থাকলে যতখানি শীতল হয় তার কিছুমাত্র না। নিতান্ত পদ্মার বারো মাইল জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এসেছে বলে যা ঠাণ্ডা হওয়ার কথা।

একেবারে মেঘটেঘ না জমেই হঠাৎ ঝড়।

সেই ঝড় যখন তার চরম রুদ্রে তখন দেখি একটা দাঁড়কাক প্রাণপণ তার সঙ্গে লড়ছে। ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি সে আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু সে যেন আশ্রয় না খুঁজে অন্য কিছু খুঁজছে। তার হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীকে।

***

২১ বৈশাখ, ১৩৬৭

কোথায় কালকের লুর পর আজ দিনটা ঠাণ্ডায় যাবে, আজ গেল সবচেয়ে গরম দিন।

ভোরে পদ্মাতে প্রথম স্নান। আমাদের বাড়ির সামনে পদ্মা একটা মাছের বঁড়শির মতো হুক করেছে। সেই হুকে রাজ্যের মেয়েমানুষ ভোর থেকে নাইতে আসে। তাদের ঘন ঘন অঙ্গ বিতাড়ন এবং যত্রতত্র মর্দন থেকে বোঝা যায় তারা এই নিদাঘ যামিনী নিষ্কর্মা কাটায়নিঃ তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেই হুকে তো আর নাইতে পারিনে। তাই হুক পেরিয়ে খানিকটে এগোতে হয়। তখন দেখি পায়ের তলায় লিকলিকে ভলভলে প্যাঁচপেঁচে পলিমাটি। বালুর সুখস্পর্শের বদলে এই স্লাইমি কাদার উপর হেঁটে যাওয়া, এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কাদার ক্লেদময় স্পর্শে সর্বাঙ্গে কেমন যেন কিরকির করে। শত শত কিলবিলে বা মাছের উপর দাঁড়ালে যে অনুভূতি হয় এ তাই।

জল ভারি সুন্দর। দক্ষিণের বাতাসে সঞ্চালিত হয়ে সর্বাঙ্গ সহস্র চুম্বনে শীতল করে দেয়।

রাত দশটায় ফের লু। কিন্তু কালকের মতো জোরালো নয়। এবং ঠাণ্ডাও নয়। এ অঞ্চলে অন্তত কোথাও বৃষ্টি হয়নি।

লু কালকেরই মতো এল হঠাৎ আচমকা। আকাশে একরত্তি মেঘও ছিল না। এখন বুঝলুম পদ্মার ঝড় কেন ভয়ঙ্কর। আকাশে বাতাসে কোনওপ্রকারের ইশারা না দিয়ে হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে। আস্তে আস্তে যে গতিবেগ বাড়বে তা-ও নয়। অসাবধান কেন, সাবধানী দাড়িও এর হঠাৎ ধাক্কা সামলাতে পারে কি?

সমস্ত রাত এবং এখনও হিল্লোলের পর হিল্লোলে দক্ষিণ বাতাস।

.

নবমী
২২ বৈশাখ, ১৩৬৭

 ঠিক কালকেরই মতো। অসহ্য, দুঃসহ না কালকের চেয়ে কম না বেশি এসব আর চিন্তা করার শক্তি নেই।

ঠিক কালকেরই মতো রাত দশটায় লু। তবে গোড়াতে কমজোর ছিল। এখন ২২.৪৫, বাড়ছে। ধুলোতে লেখা যাচ্ছে না।

তার পর কিন্তু বাতাস কমে গিয়ে মশার উৎপাত শুরু হল। মশারি খাটাতে হল। সকালে দেখি, হিম পড়েছে। এই প্রথম।

আকাশে কণামাত্র মেঘের চিহ্ন নেই।

সিলেটে জোর বৃষ্টি।

***

২৩ বৈশাখ, ১৩৬৭

 আজ কোনওদিক থেকে কোনওপ্রকারের বাতাস ছিল না। গরম অন্যদিনের তুলনায় কম বলেই মনে হচ্ছে। ঢাকা বলেছে, আমাদের এলাকা শুকনো শুকনিতেই যাবে। এটা বলার দরকার ছিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনামাত্র করতে পারিনে, কোনদিক হতে, কী কারণে মেঘ জমতে পারে আর বৃষ্টিই হতে পারে। এই যে দক্ষিণের বাতাস আসে সেই-বা কোত্থেকে? বঙ্গোপসাগর থেকে কলকাতা ছাড়িয়ে? তা হলে এত জোর পায় কোথায়? কলকাতার উপর দিয়ে তো এত জোরে বয়ে যায় না। তবে পদ্মাতেই এর জন্ম? তাই-বা কী করে হয়।

একটা জিনিস বিলক্ষণ বুঝেছি। হঠাৎ এমনই আচমকা এই দক্ষিণের বাতাস আসে কোনওপ্রকার মেঘ না জমে– যে, যে কোনও নৌকার পক্ষে এটা কাল। প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারলেও সে বাতাস সামলে হাল ধরে নৌকো বাঁচানো শক্তিশালী পুরুষের দরকার। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এই আচমকা ঝড় সম্বন্ধে একাধিকবার সাবধান করেছেন।

আজ এগার দিন হল এখানে এসেছি। গরমের ঠেলায় চৈতন্য যেন সময়ের হিসাব রাখতে পারেনি। মনে হয় মাত্র তিন-চার দিন হল।

রাত এগারটায় দক্ষিণের বাতাস উঠল। ধুলোয় ঝড় না তুলে সমস্ত রাত ব্যজন করে গেল।

***

২৪ বৈশাখ, ১৩৬৭

 আজ দিনটা যেমন তেমন কাটল কিন্তু রাতটা গেল খারাপ। বাতাস ছিল না বললেই হয়। মশারির ভিতর-বাইরে শুয়ে আরামহীন রাত।

***

২৫ বৈশাখ, ১৩৬৭

 দিনটা জ্যোঁও ত্যোঁও কাটে কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই আরম্ভ হয় গরমের সত্য উৎপাত। ঘরটা তেতে ওঠে চরমে– ওদিকে বিজলির জোর কমে গিয়ে পাখা আর ঘুরতেই চায় না। বাইরেও গরম। হাওয়া বন্ধ। কখন বইতে শুরু করবে তার ঠিক নেই। সে-ও বইবে গরমই। কারণ চতুর্দিকে বৃষ্টি হয়েছে বা হবার আশা আছে বলে কোনও কাগজ আশা দেয়নি।

রাতটা কাটল দুঃসহ গরমে। অন্যদিনের মতো রাত বারোটায়ও ঠাণ্ডা হল না।

গেল দু দিন ঢাকা ভরসা দিয়েছিল, রাজশাহী অঞ্চলেও বৃষ্টি হতে পারে। আজ তা-ও প্রত্যাহার করল।

***

২৬ বৈশাখ, ১৩৬৭

আজ আরও গরম। সন্ধ্যার পর দক্ষিণ থেকে বাতাস কিন্তু ঠাণ্ডা নয়।

পূর্বে কিছুক্ষণ খরার বিজলি হানল। সন্ধ্যায় ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ জমেছিল। কিছুক্ষণের ভিতর তা-ও কেটে গেল। মেঘগুলো যেন কোথাকার বর্ষাভোজের পর ইতস্তত ছড়িয়ে ফেলা এঁটো পাতা। দেখলে হিংসে হয়, কোথাও যেন কপালীরা উত্তম বৃষ্টির উৎসব ভোজ করেছেন। আমাদের কপালে ছেঁড়া পাতা। ক্ষেমা-ঘেন্না করে সেগুলো চাটতে রাজি আছি– যদি তারা বৃষ্টি হয়ে নামেন। তা-ও তারা নামলেন না।

এখন (২৩.০০) জোর দক্ষিণের বাতাস কিন্তু আরামহীন। পদ্ম মাঝে মাঝে সমুদ্রেরই মতো অনেকক্ষণ ধরে একটানা গর্জন রব ছাড়ে। বড় গম্ভীর– তবে সমুদ্রের মতো উদ্দাম নয়। পাড়ে এসে ঢেউও মাথা কোটে না। সমুদ্রপারেরই মতো নারকেলপাতার একটানা ঝিরঝির শব্দ। অন্য পাতার সঙ্গে মেশা বলে ঠিক সমুদ্রপারের আওয়াজ নয়।

***

২৭ বৈশাখ, ১৩৬৭

কাল রাত্রে বাতাস ক্রমেই ঠাণ্ডা হয়ে এল বলে নিদ্রা হল ভালো।

ভোরে দেখি আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে মন্থর গতিতে রওনা দিয়েছে। পদ্মার বুকে কিন্তু দুর্দান্ত দক্ষিণের ঝোড়ো বাতাস। সেই বাতাসে পাল তুলে দিয়ে চলেছে খান-চারেক বিশাল মহাজনি নৌকো। দক্ষিণের বাতাস কী কৌশলে পাল দিয়ে কাবু করে নৌকা উজানে পশ্চিম দিকে যেতে পারে সেটা আমার বুদ্ধির অগম্য।

এখন ১৩, ৪৫-এ মৃদুমন্দ কিন্তু গরম বাতাস। মেঘ বেবাক অন্তর্ধান করছে। বুঝেছি এ ধরনের মেঘে বৃষ্টি হবে না। যদি হয় তবে হুড়মুড়িয়ে আসা কালো মেঘে– বিন নোটিসে, সন্ধ্যার দিকে। সে এখন মাথায়।

২০টায় লু উঠে (৩/৫-এর মতো) ধুলোয় ধুলোয় ত্রিভুবন ধূলিতন্ত্রের তাঁবেতে গেল। বারোটা থেকে সকাল অবধি সুন্দর বাতাস। ঘরের ভিতরে শুয়েও ভোরে গায়ের চাদর খুঁজতে হল।

***

পূর্ণিমা
২৮ বৈশাখ, ১৩৬৭

পদ্মার পাড়ে বাসা– আমাদের বাসা ছাড়িয়ে মাত্র দুটি কি তিনটি পরিবারটি সিরাজগঞ্জের। বিরাট নদীর সঙ্গে এদের আশৈশব পরিচয় থাকার কথা।

তিন ভাই স্নান করতে গেছে এগারটায়। যার বয়েস বাইশ সে হঠাৎ নাকি চিৎকার করল, ডুবলুম, গেলুম গেলুম। অন্য ভাইরা মশকরা ভাবল।

আমি যখন তাকালুম, বাড়ি থেকে, তখন ১১.৩০/১১.৩৫ নাগাদ। একটা নৌকা যোগাড় করে উড়ন জাল ফেলে ফেলে চেষ্টা করা হচ্ছিল ছেলেটাকে খুঁজে বের করার। ইতোমধ্যে গোটাতিনেক ছেলেও ডুব দিচ্ছিল– কেউ কেউ লগি পুঁতে তাই ধরে ধরে নামছিল। এদিকে ওদিকে বিস্তর ছেলে-ছোকরারা সাঁতার কাটছিল কিন্তু ডুব দিয়ে সন্ধান করার মতো শক্তি ওদের নেই, কারণ ওখানে ৩/৪ লগি গভীর জল।

ইতোমধ্যে মিলিটারির দু জন লোক একজনের মাথায় লোহার টুপি পাড়ে এসে জুটল। লোকজন তাদের চতুর্দিকে জটলা করল। তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখল। কিছু করল না– করবার ছিলই-বা কী?

তার পর আরেকটা নৌকা এল রাঘব-জাল নিয়ে। সেটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজে লাগানো হল না। তবে কি রাঘব-জাল অতখানি গভীরে তলাতে পারে না।

প্রায় একটার সময় ওপার থেকে তরতর করে দক্ষিণ বাতাসে পাটল-রক্ত রঙের পাল তুলে একটা জুড়িন্দা নৌকা আসছে দেখা গেল– আমার মনে একটু আশা হল। এরা এসে সাবধানে খাড়ির ওদিকে প্রথম দাঁড়াল। তার পর একটা একটা করে আসলে জুড়িন্দা নয়– দুটোই খাড়ির মুখে এসে আর পাঁচজনেরই মতো লগির খোঁচা দিয়ে দিয়ে সন্ধান করল।

প্রায় দেড়টার সময় আস্তে আস্তে সব চেষ্টাই বর্জিত হল। যে জেলে জাল ফেলছিল সে খাড়ির ওপারে চলে গেল। জোড়া নৌকা এবারে লগি পুঁতে নৌকা বাঁধল। শুধু দু তিনটি ছেলে তখনও মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

ইতোমধ্যে বাচ্চু এসে বলল, ছেলেটি নাটোরের। বাপের এক ছেলে (আপিসের চাপরাসি বলল বাপের নাম ডা. রেবতীভূষণ চক্রবর্তী), এখানে মামাবাড়িতে এসেছিল, সাঁতার জানত অল্পই; পাড়ার দুই ছেলে তাকে নিয়ে সাঁতরাতে যায়। ছেলেটা সাঁতারে অপটু। ডুবে যাচ্ছে দেখে ওরা সাহায্য করেও ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠেকাতে পারেনি।

আমি শুধু একটা জিনিস বুঝতে পারলুম না। ও যদি খড়ির মুখেই ডুবে থাকে তবে ওখানে সন্ধান বেশি না করে করা তো উচিত ছিল আরও ভাটিতে। যত কমই হোক, স্রোত তো এখানে কিছুটাও আছে।

সন্ধ্যার পর ফের লু। এখন ২৩.৪৫ কিছুটা কমেছে। তবু squalls.

পদ্মা পূর্ণিমায় তাঁর নরবলি নিলেন!

[এই সর্বনাশা রূপ ছাড়াও পদ্মার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লেখক দিনলিপির এক স্থানে একটি বর্ণনা লিখে রাখেন। প্রসঙ্গক্রমে সেটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হল]

.

পদ্মা– রাজশাহী

একে উজান, তার ওপর পবন যেন বান ডেকেছে ভাটার দিকে। এতে কখনও নৌকো বাওয়া যায়? তা-ও যায়। স্পষ্ট দেখলুম দু জনাতে কী রকম তরতর করে নৌকা উজানে ঠেলে নিয়ে গেল— লগি মেরে মেরে।

পদ্মর সঙ্গে যাদের কারবার তারা সব পারে।

সপ্তমীর রাতে পদ্মা পেরিয়ে আসছে ধূ ধূ করে দক্ষিণা বাতাস–কখনও-বা দমকা দমকায়।

আমার সামনে বিরাট পদ্ম। তার চর, চরের পর ফের নদী, তার পর দূর সুদূরের ঝাপসা ঝাপসা গাছপালা– সে-ও চরের উপর। কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে মনে হয় আমি যেন অন্তহীন সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসে-জলে ধাক্কাধাক্কিতে যে ধ্বনি উঠছে সেটা ক্ষীণতর হলেও সমুদ্রগর্জনেরই মতো। একই গাম্ভীর্য। সমুদ্রে যেরকম পাল পাল ঢেউ বেলাভূমির দিকে এগিয়ে আসে, এখানেও ঠিক তেমনি নদীর স্রোতের গতিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে পুব-পশ্চিম জোড়া পালের পর পাল ঢেউ আসছে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে, আমার দিকে। দমকা বাতাসে মাঝে মাঝে নদীর এখানে-ওখানে ফেনা জেগে উঠছে– ঠিক সমুদ্রেরই মতো।

এই ঝোড়ো বাতাসেও কিছুটা শীতলতা আছে বলে তার অস্থিরতা সত্ত্বেও সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নদীপারে জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।

মনে হল, আজ আরেকটা ছোট চর ভেসে উঠেছে।

বাতাসের উল্টোদিকে পাল তুলে দিয়ে নৌকা যেতে পারে, শুনেছিলুম, বিশ্বাস করিনি। এখন এখানে সেটা স্পষ্ট দেখলুম।

স্রোত বইছে পশ্চিম থেকে পূবে, হাওয়া বইছে পুব-দক্ষিণ থেকে উত্তর-পশ্চিম পানে। দু খানা নৌকো পাল তুলেছে নৌকোর সঙ্গে গা মিলিয়ে প্যারালেল– বোধহয় উল্টো বাতাস নৌকোর ভারের সঙ্গে আড়াআড়ি আটকা পড়ে হাওয়াটার বিপরীত ধাক্কা neutralize করে দেয়। এবং তার পর স্রোতের ভাটার বেগে গন্তব্যদিকে অগ্রসর হয়। কারণ খাড়ির ভিতরে ঢুকেই এরা পাল গুটিয়ে নিল– কারণ সেখানে হাওয়া কম।

পদ্মার এ অদ্ভুত সৌন্দর্য থেকে মুখ ফিরিয়ে খাতায় পোকার দাগ কাটতে হবে! বিরাট অথচ ছেঁড়া ছেঁড়া একটা কালো ছায়া নদীর ওপার থেকে এপারে ভেসে আসছে দ্রুতগতিতে– তার পিছনে যেন তার বাছুর, সে-ও আসছে সঙ্গে সঙ্গে। এদের আকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে এই দুটি মেঘ আকাশে খুঁজে নিতে কণামাত্র কষ্ট হয় না। পারে উঠেই যেন এরা অদৃশ্য হয়– ওদের যেন পাসপোর্ট-ভিজা নেই। একেবারে মিলিয়ে যায় তা নয়। কারণ পাড়ের বালি বড় সাদা। একটুখানি আমেজ যেন থেকে যায়। V. I, P-দের বডিগার্ডের মতো ভিড়ের মাঝখানে মিলেও মেশেনি।

ওই দূরে দূরে দু একখানি ডিঙি নৌকা। তারও দূরে চরের পশ্চিমতম কোণে লম্বা সারির খড়ের ঘর। শুনেছি পদ্মার জল গত বৎসর থেকে এপারের দিকে আসছে– আমাদের বাড়ির সামনেকার জলধারা আর খাড়ি নাকি গত বছরেও ছিল না, মাঝগাঙ্গের চর অবধি হেঁটে যাওয়া যেত– এদের ম্যাদ তা হলে আর ক-বছরের।

ওপারের হিন্দুস্থান ভোরের বৃষ্টি বর্ষণের ফলে বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

 ওই উপর দিয়ে গেল বাঘডোগরা থেকে কলকাতার প্লেন।

এপারে মহাজনি নৌকো যাচ্ছে নির্ভয়ে পুরো পাল চেতিয়ে। আরেকখানা বিনা পালেই যাচ্ছে উজান। হালের কাছের মাঝিটা পর্যন্ত নেই। কাৎ হয়ে হয়ে পশ্চিম-দক্ষিণের দিকের বাতাসে চলেছে সূর্যাস্তের দিকে।

কাল রাত্রে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কিছুক্ষণ ধরে গুমোট থাকার পর বইল উত্তর থেকে বাতাস। হঠাৎ দেখি আমার ঘরের ভিতর তুমুল কাণ্ড। উত্তর-দক্ষিণ বাতাসে লাগিয়েছে হাতাহাতি। যেন ফিরোজ আর ভজু।

***

২৯ বৈশাখ, ১৩৬৭

বাড়ির গেট বন্ধ করে যখন বেরোলুম তখনও অতি অল্প হাওয়া। বিশ কিংবা পঁচিশ কদম যেতে-না-যেতেই হুড়মুড় করে যে লু ধেয়ে এল তখন রীতিমতো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, এগুবো না বাড়ি যাব। নিতান্ত গোঁয়ার বলেই এগুলুম। অবশ্য গলির ভিতর ঢুকতেই অন্তত চোখ মেলে তাকাতে পারলুম।

কাজেই পদ্মাতে নৌকা চালানো যে কী হুঁশিয়ারির কাজ সেটা এ সময়ে এদেশে এলে একটা অভিজ্ঞতা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

রাত এগারোটা অবধি এই সূক্ষ্ম ধুলোর মাঝখানে খেতে বসতে ইচ্ছে করে না।

মাইল বারো দূরে, শারদার কাছে ছেলেটির মৃতদেহ আজ পাওয়া গেছে। তাই বলছিলুম, দু ঘণ্টা পরেও যেখানে সে ডুবেছিল সেখানে ওরা জাল ফেলেছিল কোন আক্কেলে।

বাপের নাম রেবতী সান্ন্যাল। বিশী যা বলল সেটা বাচ্চুর কাহিনীর সঙ্গে মেলে। তবে প্রথমটায় তারগেলুম, গেলুম কেউ বিশ্বাস করেনি, পরে দুটি ছোকরা তাকে ধরেও ছিল বটে তবে বয়সে কাঁচা বলে ঝাঁপটাঝাঁপটিতে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়াতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

গরম অল্প কমেছে পূর্ববঙ্গের সর্বত্রই, কিন্তু এখানে প্রতি রাত্রে এই ধুলোর অত্যাচার অসহ্য হয়ে উঠেছে।

মেঘ রোজই সকালের দিকে আকাশের এখানে-ওখানে দেখা যায়। বোধহয় শেষরাত্রে বা ভোরে যখন হাওয়া বন্ধ হয় তখন জমবার সুযোগ পায়। তার পর হাওয়া উঠে দুপুর হতে-না-হতে মেঘ হাওয়া।

মেঘের চেহারা অনেকটা আকাশের ডাবরে নীল দুধে বদখদ দম্বল দিলে যেরকম হেথায় জমাট হোথায় জোলো দই জমে সেইরকম!

.

১২ তারিখ প্রিন্স আলী খান মোটর দুর্ঘটনায় গত হয়েছেন।

 জিনিসটা অত সরল নয়।

 প্রথমত তিনি মারা গেলে করিম– প্রতিপক্ষ দলের আর কোনও ইমাম প্রার্থী রইলেন না। দ্বিতীয়ত করিমের প্রতিপক্ষ দল নিজেদের অসন্তোষ হালে প্রকাশ করছিল। তাই করিম পক্ষীয় দলের পক্ষে এই দুর্ঘটনার ব্যবস্থা করা অসম্ভব ছিল না।

দুর্ঘটনায় দেখা যাচ্ছে,

(ক) আলী পূর্বে জানা ঠিকঠাক করা রাঁদেভুতে যাচ্ছিলেন– এলোপাতাড়ি bunmelu করতে বেরোননি। আততায়ীর পক্ষে আগেভাগেই জানা কঠিন ছিল না।

(খ) আলী অতি বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ড্রাইভার। যে বয়সে মানুষ par excellence গাড়ি চালায় তার বয়েস সেই। চালাচ্ছিলেন ৩৮ মাইল বেগে প্যারিসে সে কিছুই নয়, তা-ও রাত্রিবেলা।

(গ) তিনি ধাক্কা মারেননি। মোড় নিতেই অন্য গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দেয়।

***

প্রথম বর্ষণ
৩০ বৈশাখ, ১৩৬৭

ঘুম থেকে উঠলুম প্রায় উনিশটায়। দেখি মেঘ জমেছে, কিন্তু সেরকম কালো-ঘনঘটা নয় যা দিয়ে বোলপুরে বৃষ্টি নামে। সকালে মেঘ করেছিল কিন্তু অন্য দিনের মতো দুপুরবেলা হাওয়ার জোরে অন্তর্ধান করেনি। আপিসের বড়বাবু বৃষ্টির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

তার পর বিদ্যুৎ চমকাতে আরম্ভ করল। ক্রমে ক্রমে আকাশের সর্বত্রই। মেঘও ডাকল জোর। তবু বৃষ্টি নামে না।

৮-১০-এ অতি সূক্ষ্ম বারিকণা দিয়ে বৃষ্টি আরম্ভ হল। মনে হল পুব-দক্ষিণে কোথাও বৃষ্টি হতে হতে এখানে এসে পৌঁছচ্ছে। অন্যদিনের তুলনায় হাওয়াও ছিল জোলো ও ঠাণ্ডা। অনেকক্ষণ পাঁয়তারা কষার পর বৃষ্টি এল উত্তর দিক থেকে। (ঢাকায় একাধিকবার এই ব্যাপার দেখেছি। তার পর আরম্ভ হল দক্ষিণ থেকে।

বিদ্যুৎ এমনই ঘন ঘন চমকাচ্ছিল যে পূর্ণ অর্ধ সেকেন্ডের তরে আকাশ একবারও অন্ধকার যায়নি। আর শিরা-উপশিরা ছড়ানো এতখানি আকাশ জুড়ে বিদ্যুৎ-জাল আমি ইতোপূর্বে কমই দেখেছি। আর মাঝে মাঝে রীতিমতো অশনি-পাত। বলতে গেলে মনসুন ভাঙার মতো তোড়জোড় এবং তা। তবে বৃষ্টিটা সেরকম জোর নয়।

ঘন্টা দুই পরে থামল। ধরণী শীতল হলেন।

 বিজলি আলো বন্ধ হল ২১.০০। উৎপাত। খুলল ভোরে। মিলিটারি এদের ফাঁসি দিতে পারে না?

***

বৈশাখ ৩১, ১৩৬৭

কাল রাত্রে দু ঘণ্টা বৃষ্টির ফলেই আজ দেখি ঘাস চিকন-সবুজ রঙ ধরেছে।

দিনটা গেল অবিশ্বাস্য আবহাওয়ায়। মোলায়েম ঠাণ্ডা। ১৫.৩০-এ যখন শুতে গেলুম তখন ঘর অন্ধকার করার জন্য দোর-জানালা বন্ধ করলুম বলে পাখা চালাতে হল। না চালালেও হয়তো চলত।

উনিশটায় সেই সুন্দর ঠাণ্ডা দমকা বাতাস। সমস্ত দিন মেঘলা ছিল– এখনও তাই। অল্প বিদ্যুৎও চমকাল।

ঠাণ্ডার ঠেলায় ফিরোজের আর জ্বর নেই।

আঠারো তারিখ লাটসায়েব আসবেন। তারই প্রস্তুতির জন্য রাবেয়াকে কাল ঢাকা যেতে হবে। বিশ তারিখ (ইংরেজি) মেজ ভাই আসবেন।

ফিরোজের আবার জ্বর (২১.০০)।

আশ্চর্য! রাতদুপুরে হাওয়া বিলকুল বন্ধ হওয়াতে ঘরে মশারির ভিতর আর আরাম বোধ হচ্ছিল না। ওই সময়টাতেই তা হলে Max-heat গেল!

আকাশে চাঁদ, তারা; মেঘ নেই।

***

কৃষ্ণা পঞ্চমী, জ্যৈষ্ঠ ১, ১৩৬৭

ভোর থেকে মেঘলা ঠাণ্ডা আরামের বাতাস।

 বিকেলের দিকে সামান্য একটু গরম।

সন্ধ্যায় অল্পক্ষণের জন্য পুব থেকে জোর বাতাস।

তার পর অনেকক্ষণ ধরে পুবের বাতাসে বিদ্যুৎ চমকাল।

তার ওপর বিদ্যুতের খেল উত্তর বাগে চলে গেল। বাতাসও কালকের মতো আজও রাত্রে বন্ধ হয়ে গেল। এখন (২৩.৪৫) কষ্টদায়ক না হলেও মশারির ভিতর অনারাম হবে।

রাবেয়া দুপুরের গাড়িতে ঢাকা গেল।

সাঁওতালরা পুব বাঙলার কতখানি গভীরে ঢুকেছে জানিনে। উত্তর বাঙলায় বগুড়া ও বারেন্দ্রভূমিতে তারা আছে। এখানে বাড়ির সামনে মাটি কাটার কাজ করছে।

এরা বোলপুরের সাঁওতালদের মতো বুনো-বুনো নয়। দু তিন জনে হাত ধরাধরি করে মৃদু গুঞ্জরণে গান গাইতে গাইতে এদের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখিনি। বোলপুরীয়দের মতো এদের growth stunted নয়। অনেকটা তন্বঙ্গী শ্যামা বাঙালির মতো। শাড়িও পরে হুবহু বাঙালি ঝি মেছুনির মতো। গামছা আছে, কিন্তু সেটা কোমরে জড়ায়নি। এদের রঙও তৈলচিক্কণ নয়। একটু যেন অপরিষ্কারও। খিল খিল করে হাসতেও এদের দেখিনি।

***

২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭ সমস্ত বাংলায় ভীষণ ঝড়, রাত্রে খড়গপুরে বৃষ্টি।

ভোরবেলা থেকে ধূ ধূ প্রচণ্ড উত্তরের বাতাস। ঘরে মশারির ভিতর গায়ে চাদর জড়াতে হল। আকাশ মেঘলা। একদিকে আসন্ন বর্ষণের কালো রঙ মাখা।…

***

৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

ভোর থেকেই সুন্দর দক্ষিণের বাতাস।

কখন মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে লক্ষ করিনি। পৌনে তিনটে নাগাদ স্নান করতে যাবার সময় দেখি, উত্তর-পশ্চিম কোণে কালো মেঘ। তার কিছুক্ষণ আগে থেকেই খানিকটে গরম আর গুমোট ছিল বলে পাখা চালাতে হয়েছিল। বাথরুমে থাকা অবস্থাতেই লু উঠল। খেতে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেশ জোর বৃষ্টি নামল।

উত্তর দিক থেকে। কয়েকদিন আগে W. F. বলেও ছিল বটে, উত্তর-পশ্চিম থেকে ঝড় বইতে পারে।

তোড়ে বৃষ্টি। দু একবার শিলঙের মতো দু ঝাঁপটা বৃষ্টি মেঘের মতো বারান্দা পেরিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।

বোধহয় ১৫/২০ মিনিটের বেশি বৃষ্টি হয়নি– সমস্তটাই উত্তর থেকে– তবু ঘরের মাঝখান অবধি শুধু ভিজে যায়নি, রীতিমতো জল দাঁড়াল। চৌকাঠ না থাকার ফল। বেশিক্ষণ এরকম তোড়ে বৃষ্টি হলে ঘরের জিনিসপত্র রাখবার জায়গা থাকত না।

রাবেয়া আজ ফিরল না কেন বুঝতে পারলুম না।

সন্ধ্যায় পদ্মার জল অদ্ভুত অলিভগ্রিন হল।

এখনও বেশ মোলায়েম ঠাণ্ডা। অতি মৃদু দক্ষিণের বাতাস (০০.৩০), তবে দু চারটে মশার ভনভনানি কানের কাছে।

***

৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

আজও সন্ধ্যার পর সামান্য বৃষ্টি হল। এ কদিন রাতদুপুরে হাওয়া বন্ধ হত। আজ আর তা হল না। পরদিন পর্যন্ত সুন্দর হাওয়া ছিল।

***

৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭

দুপুরবেলা খুব ঘন মেঘ জমল।

 খুব হাঁকডাক। এন্তের আঁক দেমাক। বুঝি আকাশ ফেটে পড়বে।

আধ আউন্স শিলাবৃষ্টি হল।

 তার পর তিন আউন্স বৃষ্টি। সে-ও পূর্বদিনের মতো উত্তরের বাতাসে জলকণা।

তার পর হাওয়া বন্ধ।

এখন (১৯.৪৫) সুন্দর বাতাস।

পুবের বাতাস যখন বইছিল তখন পশ্চিমের স্রোতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পদ্মার বুকে যা সাদা ফেনার ঢেউ জাগাল, তা-ও আবার এমন chopped যে সে এক প্রলয় কাণ্ড

.

বৃহস্পতিবার সকালের বসুমতী লেখে :

…অন্তত আবহাওয়া অফিস বুধবার রাত্রে যে পূর্বাভাস দিয়াছেন তাহাতে অদ্য বৃহস্পতিবার ঝড়বৃষ্টি হইবার কোনও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ তো নাই, বরঞ্চ বলা হইয়াছে যে, অদ্য আবহাওয়া শুষ্ক থাকিবে ও দিবাভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাইবে!

***

৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

কলকাতায় কালবৈশাখী, সামান্য বৃষ্টি। সেই যে গেল শুক্রবার বৃষ্টি হয়েছিল, তার পর আর কষ্টদ গরম পড়েনি। ফৈজু ভাই ঠিকই বলেছিল, একবার বৃষ্টি হলে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আমি ভেবেছিলুম, শান্তিনিকেতনের মতো উটকো বৃষ্টি হয়ে ফের গরম পড়বে। তা হল না, Thank God, touch wood! So far.

আজ বেশ ঠাণ্ডা। দিনে একবার ঝড় উঠেছিল। রাত্রে ২২টা নাগাদ অল্পক্ষণ সামান্য বৃষ্টি হল। এখন ০০.৩০-এ সারা আকাশ জুড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর গুরুগুরু মেঘ ডাকছে যেন খাঁটি বর্ষাঋতু। অতীব রমণীয়।

তার পর নামল তুমুল বেগে বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি। আর ঝঞ্ঝার বাতাস। এক্কেবারে খাঁটির খাঁটি বর্ষা।

***

৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 প্রবল ঘূর্ণির্বাত্যা in Bonga from 6.45 to 7.30 in the moming.

সকাল থেকে রীতিমতো ঠাণ্ডা বাতাস।

সমস্ত দিন মেঘলা আর ঠাণ্ডা। দুপুরবেলাও শুধু গেঞ্জি গায়ে দিয়ে থাকা যায় না। সকালে তো ড্রেসিংগাউন পরেই কাটাতে হল।

সমস্ত দিনটা গেল আঁটি বর্ষাঋতুর মতো।

রাত প্রায় দশটা থেকে কী বিদ্যুতের খেলা। বিদ্যুত্বহ্নির সর্প হানে ফণা যুগান্তের মেঘে।

গেল রাত্রির বৃষ্টিতে আকাশ থেকে শেষ ধূলিকণা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে বলে আজ সকালে দূরের চরের মনে হয় ওপারের গাছপালা পরিষ্কার ঘনশ্যাম দেখাচ্ছিল। দেশে ধানক্ষেতের ওপারের গ্রাম যেরকম দেখায়। দূর-দূরান্ত অবধি অবাধ দৃষ্টি ধেয়ে গিয়ে যা-কিছু দেখবার সব দেখা যায়। নদীর বড়ধারা যেখানে শূন্যে লীন হয়েছে– বালুচরের উপর যে কটি সবুজ ঘাস রাতারাতি গজিয়েছে। স্বচ্ছ– একেবারে স্বচ্ছ। মনে হল আমার চোখের উপর যে চামড়ার পরদাটা রয়েছে সেটাকেও যেন কাল রাত্রের বৃষ্টি ধুয়ে পুঁছে ঝকঝকে স্বচ্ছ সাফ করে দিয়ে গিয়েছে।

রাবেয়া সকালে পাবনা গিয়েছিল, সন্ধ্যায় ফিরে এল।

মাইজম ভাইসাহেব কাল ও আজ রাত্রে এখানে খেলেন।

***

৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 কী শীত, কী ঠাণ্ডা! সমস্ত রাত বৃষ্টি হয়েছে নাকি? এখন তো ধমকে ধমকে বাতাসের ঝাঁপটার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি আসছে উত্তর দিক থেকে (৭.৩০)। যেন ভরা বর্ষার ভোরের বৃষ্টি।

এই আজ প্রথম নদীতে স্নানার্থিনী নেই। একটিও না।

তবু তো স্নান এ দেশে fetish necessity না হলেও। বৃষ্টি থামতেই সেই কনকনে ঠাণ্ডাতেই দু তিনটি রমণীর আবির্ভাব। ওদিকে যে পোলটা তৈরি হচ্ছে তারও মজুররা কাজে লেগে গিয়েছে।

তিনজন জেলে উড়োন জাল ফেলে মাছ ধরছে। অন্যদিন এ সময়ে ধরে না। বোধহয় গরম বলে এতক্ষণে মাছ জলের গভীরে ডুবে যায় যেখানে জাল পৌঁছয় না।

দূরদূরান্ত অবধি কী সুন্দর পেলব ধরণী। বাতাসে মাঝে মাঝে যখন গতিবেগ কমায় তখন বিশাল পদ্মার উপর যেন ছোট ঘোট নাগ-নাগিনী ক্ষুদে ক্ষুদে ফণা তোলে। দূরে চরের সদ্যজাগা কচি সবুজের প্রলেপ দিয়েছে সবে-গজা ঘাস। তার পিছনে প্রাচীন গাছপালার ঘন সবুজ। তার পিছনে কাজল-নীল আকাশ।

***

৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 সেই যে তের তারিখে বৃষ্টি হয়েছিল, তার পর আর গরম পড়েনি। সেই অতি সূক্ষ্ম ধূলিতন্ত্রেরও অবসান হয়েছে।

সমস্ত দিন মেঘলা আকাশ। আসন্নবর্ষণ না হলেও চেহারা বর্ষাকালেরই মতো। সর্বাঙ্গসুন্দর নিম্বাস (Nimbus) না হলেও ওই গোত্রেরই বটে। আকাশের কোনও কোনও জায়গা যেন নীলাঞ্জন-লিপ্ত। শুধু মাঝে মাঝে সাদা সাদা ভাব– কাজলটা যেন জলের সঙ্গে ঠিকমতো লেপা হয়নি। আবার সমস্ত উত্তর আকাশ জুড়ে পুঞ্জ পুঞ্জ পাক-খাওয়া-খাওয়া কালোয় ধুলায় মেশানো সেই বনসঙ্কর নিম্বাস।

শেষ বালুকণা আকাশ থেকে বিলীন হয়েছে বলে ওপারের হিন্দুস্থান দেখা যাচ্ছে। আমার শালীর ছেলের বয়স ১৫/১৬, সে কত অনায়াসে বলল, ওপারে? ওপারে ইন্ডিয়া।

এই জেনারেশনের কাছেই পরদেশ ইন্ডিয়া। প্রার্থনা করি, তার পরের জেনারেশন যেন ইন্ডিয়াকে মিত্রের চোখে দেখে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই দুই দেশ যদি ঠিকমতো সহযোগিতা করে তবে চীনকেও সর্বক্ষেত্রে হারাতে পারবে।

***

১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

কাল রাত্রে হাওয়া বন্ধ ছিল। পাখা না চালিয়েও খুব কষ্ট হয়নি।

সকালে আকাশ মেঘহীন ছিল। ক্রমে দক্ষিণের বাতাস মেঘ জমাতে আরম্ভ করল। Cumulus Nimbus-এর দোআঁশলা। দক্ষিণের বাতাসটি গায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকাতে শুক্র শনি রবিতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার ফলে সংবাদ উল্টো গান গাইছে।

মার্কিন বৈজ্ঞানিক বলছেন, ক্যালেন্ডারের একই দিনে বৃষ্টি হয়। যদি অন্য সময় বেশি বৃষ্টি হয় তবে সে আকাশে মেটেওর-ফেটেওর কী সব কারণে।

আমার ক্যালেন্ডার তো তা বলে না। তবে কি অন্য Geo-physicalCalander রয়েছে?

দিল্লি থেকে সংবাদদাতা লিখছেন, ভারত-পাকিস্তানে entente cordial বাড়ছে। সাধু!

সন্ধ্যায় হাওয়া বন্ধ হয়ে গুমোট। আকাশেও মেঘ নেই। রক্তাক্ত সূর্যাস্ত। এই কি ফের গরম আরম্ভ? Pre-monsoon গুমোট?

রাবেয়া পাবনা গেল। কিসের যেন মুখপোড়ার Pre-census.

***

অমাবস্যা
১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

Birthday of রাসবিহারী বসু। আশুতোষের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।

নজরুল্ ইসলামেরও জন্ম ১৩০৬ সালে।

কাজী আমিন উল্লা        মুনশী তুফায়েল আলী

কাজী ফকীর আহমদ     মূসম্মৎ Zaheda খাতুন।

কাজী নজরুল ইসলাম

তাঁর পিতৃব্য কাজী বজল-ই-করীমের কাছ থেকে নজরুল ইসলাম বিস্তর ফারসি শোনেন। আত্মীয়েরা তাকে দুখু মিয়া ডাকত, অন্যেরা ক্ষ্যাপা। আসানসোল বেকারি। কাজী রফীকুদ্দীন সইন্সপেকটর অব পুলিশ তাঁকে কাজীর সিমলা (Kazir Simla) গ্রামে (মৈমনসিংহে) পাঠান। সেখানে তিনি class X অবধি ওঠেন। ১৩২৯-এ ত্ৰৈসাপ্তাহিকধূমকেতু প্রকাশিত। ২৩ বছর বয়সে ১ বছরের জেল। ৩৯ দিনের অনশন। আব্দুলা সুহাওর্দীর অনুনয়ে অনশন ভঙ্গ– he carried a message from the nation requesting him to do so Mrs M. Rahman took charge of him, fic, আশালতা সেন (পরে নাম প্রমীলা)–কুমিল্লার মেয়ে–

সকাল থেকে গুমোট। ভাবলুম, এই বুঝি শুরু হল ফের গরম।

 দুপুরে পাখা চালালুম! অবশ্য সবসুদ্ধ তেমন কিছু পীড়াদায়ক নয়।

 সন্ধ্যা ছ-টায় ঘনঘটা করে এক মিনিটের জন্য দক্ষিণ থেকে ফাইন বৃষ্টি।

 এখন অতি ফিনফিনে বৃষ্টি পূর্ব থেকে (১৯.১৭), ঠাণ্ডা। আরামদায়ক।

বিশীর বাড়ি থেকে রাত্রে ফিরে ঘরটা গরম বোধ হল।

রাত্রে দোমনা হয়ে শুলুম, গুমোটই, পাখা না চালিয়ে। ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। ছাত ভেজা।

কলকাতায় বর্ষাকালীন আবহাওয়া বিরাজ করছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও দু এক পশলা Sie i Main monsoon proceeding to Calcutta.

***

প্রতিপদ ৬/৫৯, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 সকালে চড়চড় করে গ্রীষ্মের রোদ উঠল। ভাবলুম, খেয়েছে, আমাদের ঠাণ্ডার হনিমুন শেষ হল।

তার পর কোথা থেকে ঘন মেঘ জমতে আরম্ভ করল– যদিও ঠিক বর্ষণদ নয়। আর ধূ ধূ বাতাস। কাঁচের দরজা বন্ধ করে বসতে হয়েছে। কোদাল কাটা পদ্মায় সাদা ফেনা। গাছপালা, মেয়ে-মন্দের শাড়ি-ধুতি হেন বস্তু নেই যা শান্ত থাকতে পারে। চানের ঘাটেও হৈ-হৈ জনা পঞ্চাশেক প্রচুর তোলপাড় করে স্নান করছে।

আর পূর্ব দিগন্তে মেঘে, জলে, বালুচরে কী অপূর্ব রহস্যময় সমন্বয়ে সবকিছু পেলব করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে দুফোঁটা বৃষ্টিও হয়েছে। সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা। তার পর অনেকক্ষণ হালকা পাতলা বৃষ্টি হল– প্রায় ঘণ্টা-দেড়। বিদ্যুৎ না, মেঘের ডাক না। হাওয়া এখনও বইছে। তবে জোরটা কমেছে।

নারকোল গাছ এখানে সর্বোচ্চশির। কখনও মনে হয় windmill, কখনও-বা আনাড়ি হাতে তৈরি দশভূজার মূর্তির মতো।

দিনটা সুন্দর গেল। সন্ধ্যায় মেঘলা ছিল বলে ঈদের চাঁদ দেখার কোনও প্রশ্নই উঠল না।

***

১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

কত না দৃশ্য দেখা যায় এখানে ঝড় উঠলে।

খাড়ির ভিতরে দু খানি জালি বোট এবং আর সব নৌকো নিশ্চিন্ত। খাড়ির বাইরে কুণ্ডের বাইরে ছিল মহাজনি নৌকো–বালুভর্তি। সে খাড়ির ভিতর আশ্রয় নেবার জন্য রওনা দিল। একজন জল সেঁচছে– একজন হাল ধরেছে, আর দু জনা জোর বৈঠা চালাচ্ছে। ভাটাতে যাচ্ছে বটে কিন্তু পূর্ব-দক্ষিণের হাওয়া বলে তাকে পুরো লড়াই লড়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুতে হল। খাড়িতে ঢুকে নিষ্কৃতি।

মাঝ-নদীর চর থেকে আসছে আরেকখানা মহাজনি। ওখানে হাওয়ার থেকে কোনও আশ্রয় নেই। হয়তো-বা নৌকোতে বালু। সে যদি পুরো ভেজে তবে নৌকো ডুবিয়ে দেবে। তাই এই ঝড় মাথায় করে পুবের বাতাসের সঙ্গে লড়তে লড়তে এল। খাড়ির মোহনায় পৌঁছতে এতই বেগ পেতে হয়েছে যে সেখানে পৌঁছনোমাত্রই একজন রশি হাতে মাটিতে নেবে বাকিটা টেনে নিয়ে এল।

কিন্তু আশ্চর্য, আরেকখানা নৌকো মাঝগাঙে দাঁড়িয়ে– এদিকে আসছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ওর কি ডর-ভয় নেই! ঝড়ের বেগ তো আরও বাড়তে পারে।

কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য, মাল্লাদের ভিতর কণামাত্র দৌড়ঝাঁপ বা অন্য কোনও প্রকারের উত্তেজনা নেই। লড়ালড়ি যুঝাযুঝি সব করে যাচ্ছে অতিশয় আটপৌরে চালচলনসহ। হৈ-হুল্লোড় করল পুল তৈরির জন তিরিশেক মজুর।

বেতারে সতর্কবাণী দেওয়ার এক-দেড় ঘন্টার ভিতরই বৃষ্টি আরম্ভ হল। অবশ্য মেঘ জমতে আরম্ভ করেছিল সকাল থেকেই। ভোরে রৌদ্র ছিল। হাওয়া বইল দুপুর অবধি উত্তর থেকে। অথচ বৃষ্টি আর ঝড় এল পূর্ব এবং দক্ষিণ থেকে।

এখন ঝড়ের দাপট কমেছে। ঘাট পাড় জনশূন্য। পুলের মজুর সব অন্তর্ধান করেছে। নৌকোর ভিতরে মাল্লারা আশ্রয় নিয়েছে। গয়লানী তুফানের শুরুতেই গাই দুটো ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল, এখন ঘুঁটে সরাচ্ছে। ওপারে নৌকোটা ওখানেই দাঁড়িয়ে। (ওখানে বোধ হয় চড়ার কাছে বলে জল কম) এবং এই বৃষ্টিতে দুটো বাদর ছোঁড়া সাঁতার কাটছে। বোধ হয় সেই প্রবাদটা শুনেছে, এমন সুবুদ্ধিমানও আছে যারা বৃষ্টির হাত থেকে এড়াবার জন্য পুকুরে ডুব দেয়।

দুপুরে ঘুমিয়ে উঠে দেখি (১৭.৩০), জোর বৃষ্টি হচ্ছে। যখন অল্পক্ষণের জন্য থামল তখন দেখি, বাগানে রাস্তায় জল দাঁড়িয়েছে– ওবেলা যেরকম দাঁড়িয়েছিল। দিনে দু বার এরকম ধারা পূর্বে হয়নি।

এখনও খাঁটি বর্ষাকালের পিটির পিটির চলছে।

কেউ বলবে না এটা গ্রীষ্মকাল।

এরকম আর কয়েকদিন চললেই তো এ বৃষ্টি মৌসুমি বৃষ্টির সঙ্গে মিলে যাবে। কারণ খবর এসেছে মৌসুম বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে এগিয়ে আসছে।

এখন অবধি চলেছে বর্ষার মতো। কখনও পিটির পিটির, কখনও দমকা হাওয়া। বাতাস একেবারে বন্ধ কখনও হয়নি। বিদ্যুৎও কম। যেটুকু তা-ও দূরে দূরে। বেতারকেও ব্যাঘাত করে না।

***

১৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

যেন খাঁটি বর্ষা ভোর।

একটুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে বলে ওপারের গাছপালা ঝাপসা হয়ে দেখা যাচ্ছে। নদীঘাট জনহীন। মাত্র দুটি মেয়ে মুখোমুখি হয়ে কোমরজলে শীতে জবুথবু প্রায় দাঁড়িয়ে অন্যদিন তারা তলওয়ারের মতো খাড়া হয়ে ভীষণ বিক্রমে সর্বাঙ্গ মর্দন করত– মাঝখানে একটা উপু কলসি ভাসছে। কাছে কাছেই দু একটা শিশুক এসে জুটেছে। কাল সন্ধ্যায় একখানা জালিবোট ফিরে এসেছে। তার নবদ্বার বন্ধ। পাড়ে ছাতা মাথায় একটি লোক কোনও গতিকে পা টিপে টিপে নিচের দিকে নামছে। পোলটার মেরামতি হচ্ছে বলে ঢালু পাড়ির অনেকখানি নেমে ফের চড়ে সড়কে উঠতে হয়।

অতি সূক্ষ্ম বারিকণা ওই ওপার হিন্দুস্থান থেকে ধেয়ে আসছে। ভুল বললুম, আস্তে আস্তে সবকিছু ঝাপসা করে দিয়ে এগিয়ে আসছে। যেন পাহাড়ে কুয়াশার পর্দা এগিয়ে আসছে। এখন এসে পৌঁচেছে মানার্থিনীদের কাছে। বালুচর, ওপারের বনরাজি দেখা যাচ্ছে না– যদিও দূরত্বটা বোঝা যাচ্ছে। নদীর মাঝখানে অতি ঝাপসা দেখা যাচ্ছে কাল ঝড়ের সেই দুঃসাহসী দুদে-নৌকোটা। ভুতুড়ে, ফ্যানটম বোট যেন।

এ-ছবি জাপানিরা আঁকে চমৎকার।

আবার জোর দমকা হাওয়ায় মেশানো বৃষ্টি। সমস্ত দিন কাটল ঝোড়ো বৃষ্টিতে– মাঝে মাঝে থেমেছিল বটে। এসেছে সর্বক্ষণ উত্তর দিক থেকে এবং এমনি ট্যারচাভাবে যে উত্তরের চওড়া বারান্দা ভেজা– শুকোবার ফুৎ পায়নি অথচ ঝড় সাইক্লোন তো আসবার কথা দক্ষিণ থেকে।

সেটাই বোধহয় এল এখানে ২০.০০। খুলনা থেকে এখানে আসতে লেগেছে প্রায় ছ ঘণ্টা। এখন একটানা শোঁ শোঁ শব্দ! তবে যে বেগে হঠাৎ এসেছিল, সেই বেগেই চলছে বাড়েনি এখনও (২১.০০)। ঝড়ের গোঙরানোটা কিন্তু অদ্ভুত শোনাচ্ছে। বৃষ্টি খুব নয়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না।

বর্ধমান চারদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার পর ও মাঝে মাঝে বৃষ্টির পর কাল রাত থেকে অবিরাম বৃষ্টি।

২৫/৫। অদ্য সিউড়িতে প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ। শুক্রবারেও হয়েছে।

***

১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

কাল ২০.০০ থেকে এখন ৮.৩০ নাগাড়ে চলেছে বৃষ্টি–যদিও জোর নয়–আর ঝোড়ো বাতাস। বাতাস আসছে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে। কেন জানিনে বিজলির জুস এত লাফাচ্ছে যে রেডিয়ো খুললেই এত শব্দ হয় যে কিছুই ভালো করে বোঝা যায় না। এই জলঝড়ে রাবেয়া পাবনা থেকে আসবে কী করে?

উজানে বর্ষা না নামলে নদীর জল বাড়ে না। কিন্তু এই লোকাল বৃষ্টিই পদ্মার জল বেশ বাড়িয়েছে। ভাটির দিকে হাওয়া বইছে বলে কোনওকিছুর সঙ্গে ধাক্কা না খাওয়াতে পদ্মার বুকে তেমন তরঙ্গ উঠছে না– কিন্তু যা উঠছে তা-ও এর পূর্বে কখনও দেখিনি।

বানুর বিশ্বাস, এটাই মনসুন। কী করে হয়?

বর্ষাঋতু চলল ১৫.৩০ অবধি। তার পর ঘুমুতে গেলুম। ১৭ নাগাদ উঠে দেখি সবকিছু শুকনো, হাওয়া বন্ধ; বর্ষার ভাব পুরো কেটে গেছে। তবে আকাশ মেঘলা, যদিও তার ভিতর দিয়ে চাঁদ দেখা গেল। চতুর্থী কি পঞ্চমী। পাবনা অঞ্চলে বোধহয় বাস ছাড়ার সময় অবধি বৃষ্টি ধরেনি। বউ তাই আসেনি।

নৌকোগুলো ফের খাড়ির মুখে জড়ো হয়েছে। নদীপারে সন্ধ্যায় ফের জনসমাগম। এখনও বৃষ্টিহীন অল্প গুমোট আবহাওয়া। গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ছে না।

সন্ধ্যার পর আমার অল্প– যদিও অতি অল্প গরম বোধ হচ্ছিল।

 ন-টায় অতি সুন্দর মলয় বইতে লাগল। এখনও (০১.০০)।

এই দিনেই শান্তিনিকেতনে ৪.৩০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। Highest of the month according to V. B. Bulletin.

***

১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 সকালবেলা শুকনো–যেমন তেমন।

দুপুরে ভ্যাপসা পীড়াদায়ক গরম। পাখা চালিয়েও শান্তি নেই। একদিনেই হেন পরিবর্তন! রাজশাহী গরম জায়গা by nature.

বউ ফিরেছেন।

ঘুম থেকে উঠে বাইরে গুমোটে ফের কষ্ট। যদিও হাওয়া অল্প-স্বল্প ছিল। ঠাণ্ডা হতে হতে বেশ সময় লাগল। এখন ০১.০০ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।

আজ সন্ধ্যায় বেতার বলল, রুশিয়া স্পষ্ট বলেছে, যেসব আড্ডা থেকে বিদেশি প্লেন গুপ্তচরী করতে রুশ আকাশে উড়বে সেসব আড্ডার উপর বোমা ফেলা হবে। আরও বলল, এসব প্লেন যেন না ভাবে, তারা এমন উপর দিয়ে উঠতে পারবে যেখানে তাদের রকেট পৌঁছতে পারে না।

শাবাশ! এইবার তা হলে পাকাপাকি পাঁয়তারা কষা আরম্ভ হল। কিন্তু এসব কথা শুনে তো বুকে রক্ত হিম হয়ে যায়। রুশে-মার্কিনে লড়ুক না, কিন্তু আমাদের নিয়ে কেন টানাটানি?

আরেকটা প্রশ্ন, ওদের রকেট যদি সবকিছুই যত উপরেই হোক না কেন, নষ্ট করতে পারে তবে হাওয়াই আচ্ছা ধ্বংস করার হুমকি কেন? ওদের মেরে ফেললেই পার। আমার মনে হয় পারে না। আর ওই যে মার্কিন বিমান ভেঙেছে ওর চালক কম্যুনিস্ট।

***

১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

কালকের মতোই দিন গেল। চতুর্দিক থেকে ফোরকাস্ট-ও হয়েছে যে বৃষ্টি কমবে। আজও তাই কালকের মতো শুকনো গেল। গরম কিন্তু অসহ্য নয়। কালকেরই মতো সন্ধ্যা থেকে ধূ ধূ হাওয়া।

সকালে চারবার দাস্ত হল। মাছের ডিম খেতে নেই। মনকে একাধিকবার বুঝিয়েছি।

আকাশ এত পরিষ্কার যে শরৎকালের মতো তারা সব জ্বলজ্বল করছে। ছায়াপথ দেরিতে ওঠার পর তাকেও অতি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভাটার সমুদ্রের মতো পদ্মা কখনও গর্জন করছে জোর, কখনও ক্রন্দন খানিকটে কমিয়ে দিচ্ছে।

এত হাওয়া– সে শুধু একেবারে পদ্মার বুকের উপর খাড়া এই বাড়ির কল্যাণে। সেকথা একাধিক লোক আমাকে বলেছেন।

কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনে। সমুদ্রপারেই বল আর এখানেই বল, ধূ ধূ হাওয়ার মাঝখানে মন যেন শান্তি পায় না, কোনও কাজে পুরোপুরি concentrate করা যায় না। একদিকে গায়ে ক্রমাগত হাত বুলোচ্ছে, অন্যদিকে কানের কাছে শব্দ করছে– একসঙ্গে দুটো disturbance.

***

১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 এ কদিন গরম ছিল ভ্যাপসা। ঘামও হচ্ছিল। বোধহয় আজ তাই সকাল থেকে আকাশ মেঘলা করে, এই মিনিট দশ আগে (৮.৩) অতি সূক্ষ্ম একপশলা বৃষ্টি এক মিনিটের তরে হল। তার পর দূর-দূরান্ত অবধি সেই পাতলা জলকণাযবনিকা ঢাকা মাঝনদীর চর, ওপারের সবুজ রেখায় বিলীয়মান জনপদভূমির তরু-বনানী, আকাশের দিগ্বলয়প্রান্ত শ্যাম কাজলে মসীমাখা।

আবার পুবের বাতাস-এতদিন ছিল দক্ষিণের। তারই জোরে মহাজনি নৌকো চলেছে বুক ফুলিয়ে। এদের গতি এতই মসৃণ আয়াসহীন যে এর কাছে রাজহাঁসও হার মানে।

এরই মাঝখানে দেখি, আকাশ-ভরা মেঘের এক জায়গায় অতি ছোট একটা চক্র তার ভিতর দিয়ে ট্যারা হয়ে সূর্যরশ্মি পড়েছে শুভ্র বালুচরের উপর– সে রশ্মি যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে নীল মেঘের, নীল আকাশের উপর। বালুচর যেন আতশি কাঁচ হয়ে সূর্যের সঙ্গে চোখ-ঠারাঠারি করছে।

এইবারে রাক্ষুসী পদ্মা ধরেছেন জেব্রার ঢঙ।

আকাশের অনেক জায়গায় মেঘ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। ফালি ফালি ডোরা ডোরা হলদে পদ্মার জল, আর অন্য জায়গায় নীলের ডোরা। সেই পরশুরামের দক্ষিণরায়, মোশয়, ডোরা ডোরা আঁজি আঁজি!

***

২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

শান্তিনিকেতনে যেরকম নিত্য নিত্য আবহাওয়ার চার্ট রেখেও এত বৎসর পরেও কোনও পূর্বাভাস দিতে পারিনে, এখানেও তাই। কখন যে কোন দিক দিয়ে ডিপ্রেশন হয় এবং ফলে ঝড়বৃষ্টি হয় (যদি সত্যই তাই হয়) তার কোনও হদিস আগের থেকে পাওয়া যায় না।

গত বছর অনেক দেরি অবধি বর্ষা চালু থেকে বন্যা ঘটাল।

শান্তিনিকেতনের মাটি ভেজা রইল অনেকদিন। কিন্তু শীতের বৃষ্টি যেটা প্রতি বৎসরের পাওনা, হল না। এমনকি পুব বাঙলায়ও না–বেশিরভাগ জায়গায় সাত মাস ধরে বৃষ্টি হয়নি।

জোর ঝঞ্ঝা ঝড় হওয়ার কথা বৈশাখ মাসে। হল না। হল ৩০ বৈশাখে। সেটা আবার চলল একটানা ২৯/৩০ অবধি। সচরাচর কি এরকম হয়?

তার পর এখনও ঠিক গরম পড়েনি। পশ্চিম বাঙলা অন্তত ২৬ তারিখ অবধি ঠাণ্ডা ছিল।

ইতোমধ্যে কলকাতা একদিন বলল, মনসুন বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে আসছে। তার পর চুপ।

এখন প্রশ্ন সত্যকার আসল বর্ষা নামবে কবে?

এসব অস্বাভাবিক অবস্থার ফলে পেছিয়ে যাবে, না মাঝ-জুনে যথারীতি নামবে।

তেরো তারিখে বৃষ্টি নামার পূর্বে দিনকয়েক যে হাওয়া বন্ধ হয়ে গুমোট করেছিল তা নয়। কাজেই আজকের দিনের জোর হাওয়া দেখে বলা, যে বৃষ্টি হতে অনেক দেরি এটিও অভিজ্ঞতাবিরুদ্ধ।

.

সুন্দর বাতাসে ভোর আটটা অবধি সুনিদ্রা।

পদ্মার দিকে তাকাতেই দেখি, তিনি এক রাত্রেই ডুবে ডুবে অনেকখানি জল খেয়েছেন। কুণ্ডের একটা পাশ ডুবে গিয়ে এখন স্রোতের ধারা প্রায় পাড়ের সঙ্গে সমান্তরাল। ছোট্ট চরটি সম্পূর্ণ অন্তর্ধান করেছে।

আকাশে ভালো করে মেঘ জমেছে। বর্ষা-সকালের আবহাওয়া।

খাড়ির সবকটা নৌকাই যেন একে একে পাড়ি দিয়েছে উজানের দিকে পশ্চিম পানে। তাদের গতি এমনই মসৃণ পিচ্ছল অনায়াস যেন পাকা স্কেটিঙের সর্দারনীর বুকে ফোলানো প্রফাইল দেখতে পাচ্ছি পারের থেকে।

এই দেখে মনে পড়ল, আমাদের দেশে যখন কোনও নৌকো পাল তুলে তর তর করে উজানে ধায়, আর দেখে অন্য কোনও নৌকো পাল নেই বলে বৈঠা মেরে মেরে অবিরাম ঘামছে তখন চেঁচিয়ে বলে, হালের বলদ বন্ধক দিয়ে পাল কেন।

কত গরিব আমাদের দেশ। সামান্য একটুকরো কাপড় কেনার পয়সা নেই।

রাত সাড়ে দশটায় লু আরম্ভ হল। উত্তর দিকে দূরে দূরে মেঘের আড়ালে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শব্দহীন। আকাশেও মেঘ নেই। আজ ধুলো কম। না হলে এই বাতাসেই আমরা ফের ধূলিতন্ত্রের অধীন হতুম। বৃষ্টির আশা কম। কালকের তুলনায় আজ ভ্যাপসা ছিল কম।

ঘণ্টাখানেক এই লু উৎপাত করে চলে যাওয়ার পর এখন (০১.০০) হাওয়া একদম বন্ধ। কী উৎপাত। কাল এই সময় কী হিল্লোলে হিল্লোলে তরঙ্গে তরঙ্গে হাওয়া আসছিল।

***

২১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

আজ সকালে স্নানের ভিড়। দশেরা? এ-সময়ে দশেরা কী রে বাবা? আজ দুপুর এবং এখন (১৮.৪০) সত্যই গরম। ভ্যাপসা, ধুলো, দক্ষিণের হাওয়া নেই। পুবের হাওয়া এখানে ঢোকে না। পদ্মা চলেছে বোঝা যায় তার শব্দ থেকে হাওয়া থেকে নয়। জুস শেষপ্রান্তে।

আজ কতরকম আবহাওয়াই না যাচ্ছে।

সন্ধ্যায় ছিল গুমোট। তার পর সন্ধ্যাবেলাতেই পুবের বাতাস। তার পর পুব-দক্ষিণ থেকে ধূ ধূ হাওয়া। দরজার একটা পাটি বন্ধ করে দিতে হল; না হলে কাগজ উড়িয়ে নিয়ে যায়। মেঘ ছিল অল্প– তা-ও খুব বর্ষণপ্রদ নয়, লম্বা লম্বা ফালি ফালি। তার পর অসহ্য গুমোট। হাওয়া এমনই মোক্ষম বন্ধ হল– এরকম ধারা জীবনে কখনও দেখিনি– যে বেশ কিছু মশা সর্বাঙ্গের চতুর্দিকে ভন ভন করে অস্থির করে তুলল। ওদিকে উত্তর-পশ্চিম আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ আর মেঘের ডাক। ঠিক বৃষ্টি হব হব ভাব। তার পর হঠাৎ জোর বাতাস ধূলিতন্ত্র। নিরাশ হয়ে দোর জানালা পর্যন্ত বন্ধ করলুম না।

এই হাওয়া-গুমোটের তামাশা কবার হয়েছিল জানিনে।

 শেষরাতে অনুভব করলুম, বৃষ্টি হয়েছে। সকালে দেখি ছাত বেশ ভেজা।

***

২২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭
 ঈদ-উজ-জোহা/ আজ হল না
১০ জু’অল হজ্জ

সকালে দেখি ছাত ভেজা। অল্প অল্প বাতাস। তাতে ধূলিকণার অত্যাচার কম। এখন ৫.৫৫-এ ঢাকা ফোরকাস্ট দিল আজ চাটগাঁ, দক্ষিণ ঢাকা ও দক্ষিণ রাজশাহী বিভাগে ঝড় বিদ্যুৎ-বৃষ্টি তাবৎ কিছুই হবে। এই মুহূর্তে এখানে নিদারুণ গুমোট, বাবলাগাছের বিন্দুপারা পাতাটিও নড়ছে না। বৃষ্টি হলে বাঁচি। তবে ঈদের বাজারের সর্বনাশ হবে।

.

ঈদ
২৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 আজ আবার নীল চাঁদ দেখলুম। এই নিয়ে জীবনে তিনবার। আর দু বার বছরের ঠিক এই সময়েই দেখেছিলুম। এবারে বু, কিংবা fine emareld green.

আজ চাঁদের শুক্লা দ্বাদশী। সূর্যাস্ত এখানে রাজশাহীতে আজ ১৮.৫২-তে। দেখলুম ঠিক ১৯.০০। পাঁচ মিনিটের ভিতরেই চাঁদ সোনালি হয়ে গেল। বোধহয় অন্ধকার বাড়ল বলে চাঁদের জ্যোতিও বাড়ল। তাই সবুজ-নীলত্ব লোপ পেল। ১৯.৫৫-এ নিত্যিকার চাঁদ।

অতি সূক্ষ্ম মসলিন মেঘ তখন আকাশ ও চাঁদের গায়ে। এমনকি তখনও সূর্যাস্তের লালিমা আকাশের হেথা হোথা-লেগেছিল।

.

আজ সকালে উঠে বুঝলুম, কালকেরই মতো বৃষ্টি হয়েছে।

বেতার বলল, ঢাকাতে বৃষ্টি সত্ত্বেও নামাজের জনসমাগমে মানুষ কম হয়নি।

দিনটা মোটামুটি গরমই। তবে এখন ২২.১৫ হাওয়া বইছে। সন্ধ্যা থেকেই পুব থেকে ছিল। বর্ষা কাছে আসার সঙ্গে পুবের বাতাসের প্রাধান্য বাড়ছে।

***

২৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

কালকের চাঁদের কথা ভুলে গিয়েছিলুম বলে এবং visitors ছিল বলে নীল চাঁদ দেখার চেষ্টা করিনি। দুঃখ হচ্ছে।

সাঁওতাল রমণীর বর্ণনা– শান্তিনিকেতন।

স্পষ্ট মনে হচ্ছে চুলে তেল দেয় না।

 খোঁপা কি আমাদেরি মতো বাঁধে?

পরনে কমলা রঙের শাড়ি বেগুনি পাড়।

ডান হাতে বাজুবন্ধ।

 গলায় সাদা পুঁতির হার।

কানে পেতলের সাদাসিধে গোল একটি কানফুল– just a big full stop। ডান হাতে সুতো বাঁধা– ওতে কি কবজ?

***

RAJSHAHI– CALCUTTA
২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৭

 ফিরোজ ভজু স্টেশনে এসেছিল। তাদের মুখ শুকনো। থাক, সে আমি বলতে পারব না।

বউ ঈশ্বরদী অবধি এল। আমাদের বগিটা অনেকক্ষণ ধরে শানটিং করল।

আমার মনে হচ্ছিল, আমরা যেন হানিমুনে। বউ ঘুমিয়ে পড়ল। বেচারি ওই ঢাকা এই পাবনা একাধিকবার বাসে করে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

রাত দেড়টার সময় আমার গাড়ি ছাড়ল। সে-ও শুকনো মুখে বিদায় নিল।

এ বড় পীড়াদায়ক। এসব কথা আর লিখব না। এ তো কাল্পনিক পীড়ার জাল বুনে বুনে উপন্যাস লেখা নয়।

***

সমুদ্র-প্রকৃতি
১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা চওড়া কালো রাস্তা। তারি সঙ্গে গা মিলিয়ে একফালি ঘন সবুজ মাঠ, ছোঁড়ারা ক্রিকেট খেলে– তার সঙ্গে গা মিলিয়ে ফের আরেক ফালি সোনালি বালুপাড়–একপাশে জেলেদের বস্তি, গাছ নেই পালা নেই কতকগুলি কুঁড়েঘর– বালুপাড়ির সঙ্গে গা মিলিয়ে আরেক ফালি লম্বা একটানা নীল সমুদ্র।

চোখে পড়ে চার ফালি কালো পথ, সবুজ মাঠ, সোনালি বালু আর নীল সমুদ্র। নীল হল কথার কথা। তা না হলে দিনে যে সুন্দরী ক-বার কাপড় বদলাল তার হিসাব রাখা দায়– বাকি তিনজন কুঁড়ের বাদশাহ, তাদের রঙের ফেরফার হয় না।

সমুদ্রের একদিকটা গিয়ে লেগেছে আডিয়ার নদীর মোহনায়। দুইজনের ধাক্কাধাক্কিতে টক্কর খেয়ে একটা ঝিল তৈরি হয়েছে সে এঁকেবেঁকে আমাদের দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছে জেলেদের গা ছাড়িয়ে। ঝিলটা নিতান্তই খরা, তার উপর নৌকা চলে না, জেলে জাল ফেলে না, তার রঙেরও অদলবদল হয় না। তবু এঁকেবেঁকে গেছে বলে মাঠ, বালু সমুদ্রের ফালি কেটে সব জিনিস যেন দূরে নিয়ে গিয়েছে।

***

১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

 সকালবেলা দেখি বালুপাড়ের গায়ে যেন কে নীলাম্বরি শাড়ি শুকোতে দিয়েছে। আলো-আঁধারে ভালো দেখা যাচ্ছে না। এদিকে দক্ষিণের বারান্দায় পুবের রোদ এসে পড়েছে, নিমগাছের ফাঁকে ফাঁকে। অনেকক্ষণ ধরে বাইরের দিকে চেয়ে রইলুম। মন বোধহয় শান্ত ছিল তাই কোনও পরিবর্তন লক্ষ করিনি। বেলা যখন বেশ হয়েছিল তখন দেখি পুবের রোদটুকু বারান্দাটি যেন মুছে দিয়ে চলে গেছে।

ওদিকে দেখি নীলাম্বরি শাড়ির উপর রুপালি জরির অগুনতি চুমকি কুচি ফুটে উঠেছে। সাদাসিধে নীলাম্বরি কখন যে হঠাৎ জড়োয়া হয়ে গেল টেরই পাইনি।

একসারি খুঁটি পোঁতা, কাত হয়ে, দেখছিলাম সকালবেলা নীলাম্বরির পারে। জেলেরা জাল টেনে তুলছে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি তারা আর নেই– বালুচর পেরিয়ে, সবুজ মাঠের উপর জেলেনিরা চলেছে মাথায় কঁকা করে বাজারের দিকে।

মাঠের গরুগুলো ঠিক সেইরকম ছবিতে আঁকা। শুধু compositionটা বদলে গেছে। একদিকে বেশিরভাগ জড়ো হয়েছে অন্যদিকে দুটো-চারটে ছিটকে-পড়া।

পেছনের বস্তিতে জেলেনি কলতলায় কাপড় কাঁচছে। এমনি আঁটসাট গঠন যে সমস্ত শরীর দু ভাঁজ করে পায়ের কাছে কাপড় আছড়ানোতেও শরীরের কোনও জায়গা দুলে উঠছে না। আমাদের মালীর বউ নাইতে বসেছে। কাকের কা-কার সঙ্গে কাপড় কাঁচার ধোপধাপ আর কলতলায় ঝট দেবার শব্দ।

জোয়ার আসার সময় হয়েছে। বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে তার প্রথম মৃদু গর্জন শোনা যাচ্ছে।

সন্ধেয় গিয়ে দেখি কপাল জুড়ে চওড়া লাল আবির মেখেছেন, এক কান থেকে আরেক কান অবধি।

অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?

 আজ সন্ধেয় কি বাসর-সজ্জাটাই না পরেছিলে!

 এতবড় কালো ঘোমটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে?

***

১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

আজ সন্ধেয় গিয়ে বললুম মাটির মানুষ আমি। মাটির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এসেছি যেখানে মাটির শেষ। তোমার নীল কোলে জায়গা দাও।

গরম বালুতে পা পুড়িয়ে রোজ আসি– তুমি আমার পা শীতল করে দাও।

একদিনের তরে সমস্ত ভেতরটা ঠাণ্ডা করে দাও না কেন?

.

গভীর অন্ধকার– পরশু মহাশিবরাত্রি শুধু বা আর স্পর্শ। গুরু গুরু গর্জন ঘন ঘন মিশে যাচ্ছে পাগল হাওয়ার এদিক ওদিক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে। কখনও কানে আসছে দুয়ে মেলার শব্দ। কখনও হাওয়া যেন গর্জন থেকে খসে পড়ে যায়। তার পর হঠাৎ গমগমানি যেন নিজেকে একা বোধ করে থেমে যায়। নোনা বাতাস কপালের উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়, কখনও-বা জোর লাগিয়ে চাদরখানা সরিয়ে দেয়।

তবু যেন অন্ধকারেরই জয়। দূরের গর্জন, মাঝামাঝি অন্ধকার, কাছের স্পর্শ সবকিছু তলিয়ে পড়ে কী যেন অজানা অন্য কোনও অন্ধকারের তলায়।

এই গভীর বিলুপ্তি অতল বিস্মৃতি নিয়ে আসে না কেন?

.

সমুদ্রপারে কখনও শান্তি পাওয়া যায় না–

***

১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, আমার দুঃস্বপ্ন দুশ্চিন্তা কালো ভারতবাসীর মতো। সুরাৎ মাহমুদ তার তলোয়ার চালাতেই তাদের আর সন্ধান পাওয়া যায় না–Scatters and slays with his enchanted sword– আমার হয়েছে সত্যিকার তাই, কাক– দুপুরের শান্তির প্রধান অন্তরায়। সমুদ্রের গুরুগম্ভীর গর্জন, দমকা হাওয়ায় দোল-লাগা নারকেলপাতার শিরশিরি সব চাপা পড়ে যায় ওই কর্কশ লুব্ধ চিৎকারের তলায়। এ চিৎকারে যেন সমুদ্রপারের পচা মাছের গন্ধ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

নীল ফরাস পেতে রেখেছ এতক্ষণ ধরে নাচ শুরু হোক না।

সমুদ্রের বুক চিরে যেন অন্ধকার বেরিয়ে এসে, আলাদীনের জিনের মতো সমস্ত আকাশ বালুপার কালো বিষ ঢেলে একাকার করে দিল।

জলের ভেতরে কি আরেকটি জিন এখনও পোরা রয়েছে নাকি? তার লাথালাথির গমগমানিতে সমুদ্র আকাশ পর্যন্ত কেঁপে উঠছে।

পশ্চিম আকাশের লাল কাগজের ফানুসবাতিতে যেন হঠাৎ আগুন ধরল। দেখতে না দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে আলোটাও নিভে গেল। পুবে-পশ্চিমে একটানা অন্ধকার।

***

১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

 বউমার ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না। ডানদিকে বালুচরের লম্বা কোলবালিশ, বা দিকে ঘন ঘোলাটে মেঘ পাকিয়ে পাকিয়ে বানিয়ে তোলা তুলতুলে আরেক কোলবালিশ। কে যে পাখার হাওয়া করছে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মেঘের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ঘোলাটে শাড়ির জমি হেথা-হোথা সর্বত্র বারে বারে কেঁপে উঠছে। দুঃস্বপ্ন দেখছেন কি না বলা যায় না, মাঝে মাঝে গুমরে উঠছেন, পাখার হাওয়ায় সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে- পাপষ্টি কিছু বলার উপায় নেই।

পাখার হাওয়া ঝড়ের হাওয়া হতে চলল যে। হঠাৎ কখন একপাশের শাড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সাদা ফ্যানার পেটিকোট না লেসের সেমিজের শেষের দিকটা?

কালোজাম, গোলমোহর, নিম-নারকোলে কী মাতামাতি। সমস্ত অশান্ত হয়ে উঠেছে। বাইরের দিকে তাকাবার উপায় নেই। শুধু ওই ইলেকটেরির খুঁটিটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ওর কোনও নড়নচড়ন নেই। এতবড় সমুদ্র– তিনিও দুলে দুলে ওঠেন প্রাণের কাঁপনে কিন্তু খুঁটিটার কাঁপন নেই, জীয়ন মরণও নেই।

পারের সবাইকে তাড়াবার জন্য আজ গুমরে গুমরে বড় বড় ঢেউ পারে এসে আছাড় খাচ্ছিল। কী মতলব কে জানে। তাড়াতাড়ি অন্ধকার টেনে আনার জন্য আকাশে একরত্তি মেঘও ছিল না। কাল অমাবস্যা– আজ এত তাড়া কিসের?

অন্ধকার যেন পেছন থেকে তাড়া করে করে বাড়িতে ভাগাল।

বারান্দায় বসে আছি জোর আলো জ্বালিয়ে কিন্তু বাইরের অন্ধকারের গায়ে যেন আঁচড়টি কাটতে পারছে না। ওদিকে সমুদ্র হুংকার দিয়ে বারে বারে শোনাচ্ছেন, আজ হোথায় যাওয়া বারণ। কাল মহাশিবরাত্রির আয়োজনে কোনও কাঁপালিকদের ডমরু আজ সন্ধে থেকেই বাজতে আরম্ভ করল।

নোনাগন্ধে খানিক খানিক আভাস পাচ্ছি।

***

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

 বড়লোক দেউলে হওয়ার অনেকদিন পরও জাকজমক সমানই চলতে থাকে বরঞ্চ অনেক সময় বেড়ে যায়। পালাপরবে গমগমানি বরঞ্চ বেশি হয়– ওদিকে আটপৌরে খরচে টানাটানি চলে।

আকাশের একটানা লাল নিভে গেল কিন্তু টুকরো টুকরো মেঘে তার জাকজমক জেগে রইল অনেকক্ষণ ধরে–আরও বেশি লাল হয়ে। দেউলে-হয়ে-যাওয়া জমিদারের ইয়ারবকসি যেন এরা। মনিবের শেষের তলানিটুকু খেয়ে মাতলামির লালে লাল। হুজুর লুকিয়ে থেকে গাদা গাদা আবির ছুড়ছেন।

আটপৌরে আকাশ ম্লান কিন্তু মেঘে মেঘে পালাপরবের বাড়াবাড়ি জাঁকজমক। আড়াল থেকে অস্তগত সূর্য পেলা দিচ্ছেন। দাক্ষিণ্য থেকেই দারিদ্র্য ধরা পড়ে।

পুবে-পশ্চিমে দেখনহাসি ইলেকটেরিতে খবর পাঠানো না বয়স্কাউটের নিশানে নিশানে কথাবার্তা। পশ্চিম লালের ইশারায় পুব লাল হল। সেই লাল ফিকে হচ্ছে–কি গোপন কায়দায় তার খবর পুবে পৌঁছচ্ছে? মাঝের বিস্তীর্ণ আকাশ তো ফিকে, কোনও রঙ নেই, ফেরার নেই। কী করে এর হাসি ওর গায়ে গিয়ে লাগে–এর বেদনা ওর বুকের সাড়ায় প্রকাশ পায়!

***

২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

 আকাশ যেন উবু হয়ে শুয়ে সমুদ্রকে চুমো খাচ্ছে– এদিকে সমুদ্রের পা ওদিকে মুখ। রঙে রঙে সমস্ত জিনিসটা ঘটল। প্রথম চুম্বনে দিগ্বলয় লাল হল। তার পর নিবিড়তর চুম্বনের কাতরতায় বেগুনি হল, সেই বেগুনি ফিকে হতে লাগল, এদিকে ঢেউয়ের দোলায় সুন্দরীর পা যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছে–সমস্ত দেহ শান্ত। চুম্বনের তরঙ্গ শান্ত শরীরের ভিতর দিয়ে ওপার হতে এপারে এসে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলে ফুলে উঠছে কেন্দ্রীভূত আনন্দ এপারে এসে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

তার পর বেগুনি সম্পূর্ণ কেটে গিয়ে ছাইরঙ হল। এ যেন সর্বশেষ নিবিড়তম চুম্বনে হৃৎপিণ্ডের শেষ রক্তবিন্দু ঠোঁট দিয়ে শুষে নিয়ে চলে গেল। এপার ওপার জুড়ে পড়ে রইল প্রাণহীন ফ্যাকাসে শবদেহ।

কালো চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা পড়ল। তার পর আকাশে ছোট ছোট মোমবাতির পিদিম জ্বালিয়ে শবের পাহারা।

সেই কালো চাদরে সবকিছু ঢাকা। দক্ষিণমুখো হয়ে বারান্দায় শুয়ে আছি। বাঁ দিক থেকে আসছে কান্নার শব্দ শোক যেন উথলে উথলে উঠছে। ডানদিকে নারকোলের ডগায় বাতাসের ঝিরিঝিরি– যেন মাথার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। পায়ের তলায় ঝিল্লির রিনিঝিনি। সামনে মোমের ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল জমে গিয়ে কালো চাদরের গায়ে লেগে আছে।

কিসের প্রতীক্ষা? কোনও চন্দ্রোদয়ের? যেন তিনি সুধাভাণ্ড নিয়ে অতল গহর থেকে উঠে এসে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে কোনও মৃতদেহে প্রাণ দেবেন।

***

২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

সূর্য অস্ত যাব-যাব করছেন এমন সময় পারে পৌঁছলুম। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ছিল, অন্যদিনেরই মতো। ভাবলুম কালকের মতো আজও ফাগের খেলা জমে উঠবে। প্রথম লক্ষণ দেখাও দিল। আকাশ ফিরোজা সবুজ শাড়ি পরল–আস্তে আস্তে গয়না চাপাব চাপাব করছে, এমন সময় দেখি শাড়িখানাই ফিকে হয়ে হয়ে, কেমনধারা সেই ছাইনীল হয়ে গেল। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখি তারও সেই ফিকে শ্যাওলা সবুজ রঙ। চারদিকেই কেমনধারা আধমরা ছাইরঙ ধরতে লাগল।

কালকের দিনের সব সাজসরঞ্জামই ছিল কিন্তু কেন জানিনে খেলা শুরু হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল।

তখন দেখি আকাশে দ্বিতীয়বার অতি ক্ষীণ চাঁদের অত্যন্ত ম্লান ঝিলিক।

যেন হিমালয় তার সব রঙ সব সৌন্দর্য মুছে দিলেন, আড়ম্বর-আভরণহীনতার মাঝখানে দুখিনী কন্যাকে ঘরে তুলবেন বলে। চাঁদের মুখে তাই কি ধীরে ধীরে হাসি ফুটতে লাগল?

অন্ধকার যখন ঘনতর হল তখন চাঁদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর সবাই, মেঘ জল বালুচর আপন আপন আলো নিভিয়ে দিয়ে চাঁদের দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে।

বরণশেষে বাড়ি ফিরলুম।

ফাল্গুন মাস কিন্তু কোনওদিকে নবজাগরণের কোনও চিহ্ন নেই। এদেশে শীতের ঘুম নেই, বসন্তের জেগে-ওঠাও নেই।

***

২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

মাঝআকাশ থেকে একটুখানি ঢলে-পড়া তৃতীয়ার ক্ষীণ শশী; সূর্য হেলে পড়েছেন কিন্তু তখনও জ্যোতির্ময়। তাই ভস্মভাল শিবের ললাটে হীনজ্যোতি শশাঙ্ক-কলা। উমা কি এখনও ঘরের কাজ শেষ করে উঠতে পারেননি– বেলা যে গড়িয়ে এল। জেলেদের পাড়ায় কাজকর্মে ভাটা পড়েছে জেলেনিরা রঙিন-শাড়ি পরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সমুদ্রপারের লোক বোধহয় স্বল্পভাষী হয়, ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথাবার্তার মেহনতে গল্পগুজব জমে না, ঝগড়াঝাটিতে গলা চিরে যায় জেলেরা বোধ করি বাজারে গেছে– নারকোলপাতার ছাউনির কুঁড়েঘর ওই নারকোলগাছের গা-ঘেঁষে যেন রোদ থেকে শরীর বাঁচাচ্ছে।

উমার কাজ শেষ হয়েছে। ভস্ম মুছে ফেলে, ঘোর আসমানি রঙ দিয়ে শঙ্করের কপাল ঢেকে দিয়েছেন তার উপরে দিয়েছেন তিনটান টকটকে ফাগ– আর মাঝখানে একে দিয়েছেন উজ্জ্বল, নবকান্তি, অকলঙ্ক শশাঙ্ক।

হাসি ফুটেছে। সমুদ্রের জল আসমানি রঙ নিয়েছে ধূসর বালুচর সোনালি হল। সমুদ্রের লোনা হাওয়ার জোর কমল–উত্তর থেকে হিমালয়ের বাতাস এল নাকি উমার চঞ্চল অঞ্চল আন্দোলনে?

সমুদ্রের একটানা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে তার মাঝে ডুকরে ডুকরে ওঠা গুমরানো।

নিমগাছ ডাল নাড়ছে, কালোজামের পাতা কাঁপছে, বারান্দার টবে বেতগাছের সরু পাতা ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে। দিনের বেলা তারা রঙ বদলায়, পাখি এসে বসে তাদের উপর, সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন, সূর্যাস্তের কতরকম আলো তাদের উপরে এসে পড়ে তারা সাড়া দেয়– তাদের জীবনপ্রবাহের ঢেউ ওঠে, তারাও দোল খায়।

রাতের অন্ধকারে তারা শুধু সমুদ্রের কান্না শোনে একমনে। বাতাস সে কান্না বয়ে নিয়ে আসে, আর সেই বাতাসের ডাকে সাড়া দিয়ে সমুদ্রের কান্নার সঙ্গে যেন নিজেকে মিশিয়ে দেয়।

সমুদ্রের কান্না থামে না বলে, ওদেরও যেন চোখে ঘুম নেই।

 এখানকার সংসারের সবরকমের সবকটা তার যেন সমুদ্রের কান্নার সুরে বাঁধা।

***

২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭

 এ খেলা তিন দিন ধরে চলেছে। আকাশ, সমুদ্র, বালুচর বিবর্ণ নিরস দেখায় যতক্ষণ সূর্য একেবারে না মিলিয়ে যান– মনে হয় আর সবাই ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে আছে। সূর্য যেই অদৃশ্য হলেন অমনি কী গোপন লিঙ্গায় আকাশের গাল লাল হয়ে আসে– ভাসুরঠাকুর উঠে যাওয়া মাত্রই কনেবউ যেরকম বরের দিকে তাকায় প্রথমটায় আমেজ লাগার মতো। তারি রেশ সমুদ্রের ফেনায় লেগে গোলাপি হয়ে ওঠে– তারি পরশভেজা বালুতে গোলাপজামের ফিকে গোলাপি হয়ে দেখা দেয়। তার পর বরবধূতে কী কথাবার্তা হয় জানিনে কনে লজ্জায় টকটক করতে থাকেন– ফাগ সিঁদুর সব রঙ তখন হার মানে। আর সে লালের সঙ্গে সঙ্গে পেছনের আকাশ হয় ঘন আসমানি, দূর সমুদ্রের জল হয় গাঢ় পান্না। সমস্ত দিনের মূৰ্ছা কেটে গিয়ে বিরাট আকাশ যেন গমগম করে ওঠে, পশ্চিম থেকে পূর্ব জুড়ে লম্বা লম্বা রঙিন কড়িকাঠ যেন পূর্বাচল-অস্তাচলকে জুড়ে দেয়, দূরে পূর্বদক্ষিণ সমুদ্রের কোণে।

তার পর লজ্জা-শরম ইশারা ঠারাঠারিতে কী খুশি হয় জানিনে। দেখতে পাই পিদিম যেন কেউ নিভিয়ে দিল–না বউ কালো কপাটের দরজা বন্ধ হয়ে দিল–না কালো ঘোমটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে চোখের সামনে থেকে সরে গেল।

দুপুররাতে ঘুম ভাঙল। এ কী কাণ্ড! চাঁদের আলো জ্বালিয়ে আকাশে তারার খুঁটি সাজিয়ে বরবধূতে এ কী খেলা!

***

৫ মার্চ, ১৯৪৭

এখানে সমুদ্র নেই। উঁচুনিচু সবুজ ক্ষেত– মাঝে মাঝে তালগাছ আলের কাছে কাছে দাঁড়িয়ে। তার পর নিকটের পাহাড়– বড় বড় পাথর স্পষ্ট দেখা যায়। তার পেছনে দূরে নীলাভ পাহাড়–লাইন বেঁধে পূর্ব থেকে পশ্চিম সমস্ত দক্ষিণ দিকটা জুড়ে।

বর্ষাকালে এই শুষ্ক দেশও সম্পূর্ণ সবুজ হয়ে গিয়েছিল। বসন্তের মাঝামাঝি এরি মধ্যে ফালি-ফালি হলদে ক্ষেত বেরিয়ে সেই সবুজের গা যেন জখম করে দিয়েছে। সূর্যোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত আকাশ কী যেন এক ব্যাকুল ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পালাবার পর্যন্ত সাহস নেই। পুবের বাতাস আসছে ধীরে ধীরে এবং অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে। মৃদু তপ্ত এবং অল্প ভেজা-ভেজা। দু দিন বাদেই পশ্চিম থেকে হু-হু করে জোর গরম বাতাস বইতে আরম্ভ করবে– পুবের বাতাস এখনও ঠিক মনস্থির করতে পারছে না এদেশে আর আসবে কি না।

পশ্চিমের হাওয়া পৌঁছায়নি বটে কিন্তু গাছপালা তার খবর পেয়ে কোন আশ্চর্য উপায়ে সব ফুল গা থেকে আছড়ে ঝেড়ে ফেলেছে। রক্তকরবী ঝরেনি কিন্তু কে যেন আগুন দিয়ে ঝলসে দিয়ে গেছে। শুধু বুগনভিলিয়া আর রাঙাজবা–না স্থলপদ্ম?

এতদিন ঘুঘু ডাকেনি। তপ্ত মধ্যাহ্নে এখন অত্যন্ত ক্লান্ত তার ডাক। সমস্ত শীতকাল ময়ুর নিস্তব্ধ ছিল– মেঘ আসার কোনও লক্ষণ নেই তবু থেকে থেকে ডেকে ওঠে- ঠিক যেন একা কৈ? একা কৈ প্রশ্ন শুধায়।

প্রজাপতি পালিয়েছে দল বেঁধে না তাদেরও ডানা ঝলসে গিয়েছে?

দুপুরবেলা শুনি সাপে যেন কার গলা চেপে ধরেছে– চাপা গলার ক্ষীণ আতাঁরব– এ কি খাণ্ডবদহনের অগ্নিদেব পশুভোজনের বিরাট পর্ব আরম্ভ করেছেন?

না দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ? সবুজ অঞ্চল গেছে- এখন যেন অঙ্গবস্ত্র প্যাঁচের পর প্যাঁচ খুলছে গ্রীষ্ম দুঃশাসন– বীভৎস আনন্দ যেন ধীরে ধীরে রসিয়ে রসিয়ে চেখে নিচ্ছে।

ধরণীর কণ্ঠশাস রুদ্ধপ্রায় পত্রে-পুষ্পে; কূপগহ্বর অন্ধের উপড়ে নেওয়া চোখের মতো– ক্ষতজল পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে।

***

৬ মার্চ, ১৯৪৭

বহুকাল পূর্বে পড়েছিলুম কারও ফাঁসির হুকুম হলে রুশিয়ার কোনও জেলে জেলরের সুন্দরী মেয়ে কয়েদির সঙ্গে প্রেম করতে যেত। তার সঙ্গে ফুর্তিফার্তি করে সেপাইদের হুকুম দিত শেকলে তাকে আচ্ছা করে বাঁধবার। তার পর সেই মেয়ে সিগারেট ফুঁকে ফুকে আসত তার কাছে। হাত দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট তার চোখের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে ধরত। কয়েদি মাথা পেছনের দিকে সরিয়ে সরিয়ে দেওয়াল পর্যন্ত নিয়ে যেত। তার পর মেয়েটা সিগারেট চোখের উপর চেপে ধরে তাকে অন্ধ করত।

দ্বিপ্রহরের সূর্য ক্রমেই কুয়োর জলের দিকে এগিয়ে আসছে– জল ক্রমেই নিচের দিকে নেবে যাচ্ছে। তার পর শেষের দিন আসবে যেদিন তার স্বচ্ছ টলটলে চোখ কানা হয়ে গিয়ে থলথলে ঘোলাটে কাদা বেরুবে। তার পর তা-ও শুকিয়ে গিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।

থাকবে অন্ধকার কোটর।

***

৮ মার্চ, ১৯৪৭

সকালবেলা এবারে এখানে পৌঁছে দেখি চতুর্দিক নিস্তব্ধ। পুব-পশ্চিম কোনও দিক থেকে হাওয়া বইছে না। সমুদ্রে জমে-যাওয়া নীল বরফের মতো স্কেটিং রিঙ্ক। তারি মাঝখানে দক্ষিণ বাতাস এল জোর। নারকোল, গোলমোহর, নিম, বকুল দুলে উঠল– সমুদ্রের সর্বাঙ্গ যেন হাল চালিয়ে চষে দিল।

এ দক্ষিণ বাতাস ঠাণ্ডা নয়, গরমও নয়। এ এসেছে সবাইকে চঞ্চল করে দেবার জন্য। কলতলায় সুন্দরী কাপড় সামলে স্নান করতে পারছে না, নারকোল ঘন ঘন মাথা দুলিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে, কলতলার শ্রীকৃষ্ণ কিছুতেই বিড়ি ধরাতে পারছেন না– এক চোখ সুন্দরীর দিকে, পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে ভিজে শাড়ি হেলতে হেলতে ধুলোয় জবুথবু হয়ে পড়ে গেল।

***

৯ মার্চ, ১৯৪৭

সমুদ্রের গর্জনে নানা সুর। কোনওদিন অশান্ত উদ্বেলিত হাহাকার, কোনওদিন গুমরে-ওঠা চিৎকার, কোনওদিন একটানা করুণ আর্তনাদ। যেদিন জোর পুরবীয়া হাওয়া বয় সেদিন সব গর্জন ক্রন্দন ছিন্নভিন্ন হয়ে পারের দিকে আসে– আজ হঠাৎ দক্ষিণ বাতাস বন্ধ হল সন্ধ্যাবেলায়, কিন্তু পুবের বাতাস এল না। আজ তাই সমুদ্রের একটানা কান্না লহমার তরে বিরাম নিচ্ছে না। ওদিকে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চুপচুপ দাঁড়িয়ে, আজ পর্যন্ত তাকে কখনও কোনও শিহরণে বিক্ষুব্ধ হতে দেখিনি।

কে শুনছে? পারে লোকজন নেই। গয়লাপাড়ার শেষ বাতি নিভে গেছে। ডাইনে-বাঁয়ে কোনও কোনও বাড়িতে আলো নেই। চুনকাম করা দেয়ালের গায়ে খোলা জানালা চৌকো চোখের মতো বাইরের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অন্ধের তাকানোর মতো। মাঠে, রাস্তায়, বালুপাড়ে চাঁদের আলোর অতি ক্ষীণ স্তিমিত আস্তরণ। শুধু সমুদ্রের জলে যেখানে চাঁদের আলো পড়েছে সেখানে গালানো রুপা বালুচর থেকে সোজা পূব আকাশে গিয়ে মিলেছে।

জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ কেমন যেন মনে হয় গাছগুলো সমুদ্রের মতোই প্রাচীন। তারা বহুকাল ধরে এই নানা সুরের কান্না শুনেছে। তারা যেন তার কারণও জানে। একে অন্যের দিকে মাথা দুলিয়ে কী যেন বলে, আর সবাই শিরশিরিয়ে উত্তর দেয়, ছিছি, ছিছি।

***

১১ মার্চ, ১৯৪৭

টলটল নীল রঙ সমুদ্রের আর দূরের আকাশ ঘন বেগুনি। পশ্চিমের আকাশ লাল টুকটুকে মাথার উপরে প্রকাণ্ড এক থাবড়া মেঘ শুভ্রমল্লিকার স্কুপের মতো জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণমুখো হয়ে আডায়ারের দিকে চললুম। যেতে যেতে যেখানে আডায়ার নদীর মোহনা সেখানে পৌঁছলুম। তিনদিকের ঢেউ সেখানে এলোপাতাড়ি মারামারি করে দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর বালু জমে জমে সমুদ্র ওই জায়গাটায় অগভীর। গোটা পাঁচেক জেলে গোড়ালি-জলে সুতো দিয়ে মাছ ধরবার চেষ্টায় ডাইনে-বাঁয়ে চলাফেরা করছে। সাদা পাল তুলে সায়েব মেম আডিয়ার উজিয়ে চেট্টিনারের বাড়ির দিকে হু-হু করে ভেসে যাচ্ছে।

মোহনার জল নীল হতে আরও নীল হতে লাগল। দূরের আকাশ বেগুনি ছেড়ে গাঢ় নীল হতে লাগল। তার পর আস্তে আস্তে দুই নীলে মিলে গিয়ে মোহনার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল– দূরের আকাশ আধা আলো-অন্ধকারে আর প্রায় দেখা যায় না। সে-নীল এমনি জোয়ারের মতো সবকিছু ছাপিয়ে কাছে আসতে লাগল, যেন মনে হল বাতাস পর্যন্ত নীল হয়ে গিয়েছে। জেলেদের ময়লা কাপড় সে-নীলে ছুপিয়ে রঙ ধরল– আমার মনে হল যেন নীল রঙ ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চলেছি।

নীলের বানে সবকিছু ডুবে গেছে। আমি চোখ বন্ধ করলুম। সেখানেও নীল চোখের সাদা-কালো কি দুই-ই নীল হয়ে গেল?

***

১২ মার্চ, ১৯৪৭

বালুপাড়ে কত অজানা পদচিহ্ন; তার ওপর সাগরের ঢেউয়ের কী রাগ। দূর থেকে ছুটে এসে আছড়ে পড়ে, আকুলিবিকুলি হাত বাড়িয়ে মুছে দেবার কী অবিরাম চেষ্টা। উঁচু পাড়িতে বসে দেখি জোয়ারের জলে মুছেই যাচ্ছে, মুছেই যাচ্ছে। এদিকে লোকজনের চলাচল কমে গেল– নতুন পদচিহ্ন আর পড়ে না বললেই চলে। তার পর যতদূর দেখা যায় সাগরের জল ধুয়ে-মুছে সবকিছু পরিষ্কার করে দিয়েছে।

এবারে ভাটার জল আর এগুচ্ছে না। ঢেউ ভেঙে পড়ে লম্বা লম্বা হাত আর এগিয়ে দিচ্ছে না– এখন যেন লক্ষ লক্ষ রুপার নূপুর নেচে নেচে নাচের গরমে গলে গিয়ে জলে মিশে যাচ্ছে।

সকালবেলা গিয়ে দেখি সেই পরিষ্কার থোয়া-মোছা বালিতে সাগর ঝিনুকের গয়না সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে প্রথম আলোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ঝিলমিলিয়ে উঠল।

বাড়িতে কুড়িয়ে আনলুম। দেখি ম্লান হয়ে গিয়েছে। যেন সুন্দরীর কানের দুল ভেলভেট বাক্সের কফিনে সাজানো ফ্যাকাসে মড়া।

***

১ আগস্ট, ১৯৪৭

 এবারে প্রথম সন্ধ্যায় সমুদ্রপারে গিয়ে দেখি সবাই যেন বেজার মুখে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছেন। আপন আপন কাজ করে যাচ্ছেন সবাই কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে–বাড়ির বউরা যেমন মুখ গুমসো করে শাশুড়ির দিকে না তাকিয়ে আপন আপন কর্তব্য করে যান। আমি এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করে অনেকক্ষণ চলাফেরা করলুম কিন্তু কেউ একটিবারের তরেও সাড়া দিল না।

সবাই আপন আপন কাজ করলেন আবার–মিনিমাল রেট। আকাশ যে সেই শেলেটের রঙ নিয়ে মুখভার করে বসেছিল তার রদবদল হল না– জল যে সেই ফিকে শ্যাওলার রঙ নিয়েছিল তার উপরে সূর্যাস্তের কোনও রঙ এক লহমার তরে গায়ে মাখল না– আকাশ কতকগুলি সাদা মেঘের বুদ্বুদ ওড়াচ্ছিল, সেগুলোকে নড়াল না, ফাটাল না- জলের ঢেউ একটানা দড়ি পাকিয়ে পারে এসে সেগুলোকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ল, পারের দিকে এগুলো না, সমুদ্রের দিকে পেছুল না।

আমি অবহেলায় লজ্জা পেয়ে বাড়িমুখো হলুম।

এমনকি সেই চারজন জুয়াড়ি ঠিক সেইরকম উবু হয়ে আধা আলো-অন্ধকারে জুয়া খেলছে। এই চারটি মাস যেন হা করে তাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে।

***

১৪ আগস্ট, ১৯৪৭

ফটোগ্রাফ ভোলাবার সময় মানুষ যেরকম কাঠের পুতুল হয়ে বসে, আজ সকাল থেকে জল স্থল আকাশের সেই অবস্থা। যে মেঘের টুকরো ভোর হওয়ার সঙ্গে আড্রয়ারের আকাশে বাসা বেঁধেছিল সে এখনও ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে টেলিগ্রাফের খুঁটিতে শূলবিদ্ধ হয়ে। কৃষ্ণচূড়ার চিকন পাতার স্পন্দন সমস্ত নিস্তব্ধতাকে যেন আরও নিস্তব্ধ রূপ দিচ্ছে, সিগারেটের ডগা থেকে ছাইটুকু মাটিতে পড়ল ডাইনে-বাঁয়ে এতটুকু না পড়ে।

কী অসহ্য থমথমে গরম। যেন ইলেকট্রিক উনুনে রান্না হচ্ছে–আগুনের হল্কা চোখে পড়ে না। কালোজাম পচতে আরম্ভ করেছে, নিমপাতা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, কলতলার কলরব চিৎকার-বিদীর্ণ। দূর জেলেপাড়া থেকে মেয়েটি কলসি কাঁখে করে, আসছে যেন রোদ্দুরের বন্যা উজান ঠেলে ঠেলে। এদিকে অজন্তা-স্তনওয়ালী মালীবউ সবুজ মেরুনের শাড়ি কাঁচছে, আর থেকে থেকে কপালের ঘাম মুছছে।

এতদিন হাওয়ার গর্জন আর সমুদ্রের হুঙ্কারে বাড়িঘরদোর ডুবে থাকত বলে বাইরের পৃথিবীর বিচিত্র কোলাহল কানে এসে পৌঁছত না। আজ বাতাস নেই, সমুদ্র ক্লান্ত তাই অনেক রকম শব্দ কানে এসে পৌঁছচ্ছে, এমনকি পাশের বাড়ির কড়া পর্দানশিন মুসলমান মেয়েদের জীবনযাত্রার অর্ধগুঞ্জরণ এখানে এসে পৌঁছচ্ছে। রোজার শেষের দিক, কড়া গরম, হাওয়া বন্ধ– তাই সে গুঞ্জরণে ক্লান্তি জড়ানো।

পশ্চিমের বর্ষা এদেশে দুর্বল– পুবের বর্ষার এখনও ঢের দেরি। ইংরেজ রাজত্বের অবসান হয়েছে, দেশি লোক এখনও আসনে বসেননি– তারি ফাঁকে লাহোর কলকাতার অরাজকতার মতো গরমের একচোট নির্মম প্রহার!

***

১৬ আগস্ট, ১৯৪৭

 যখন বন্ধু কলকাতায় তখন তিনি কাজকর্মে বড্ড ব্যস্ত থাকেন বলে চিঠিপত্র লিখতে পারেন না, যখন বোম্বায়ে তখন dul feel করেন বলে– তা সে বর্ষার জন্যই হোক অথবা কোনও কাজকর্ম নেই বলেই তোক চিঠি লিখতে পারেন না; তার ওপরে তারই ভাষায় মাঝে মাঝে চিঠি না লেখার spell আসে বলে চিঠি লিখতে পারেন না। এ তিন ফাড়া কাটিয়ে চিঠি লেখার শুভলগ্নে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বন্ধুত্ব এত পাকাঁপোক্ত হয়ে যাবে যে তখন চিঠি লেখার আর প্রয়োজন থাকবে না। অনুপস্থিতি নাকিদুই বিরহী হৃদয়কে এক করে দেয়– চিঠিপত্র না লেখার নীরবতা দুই হৃদয়কে আরও এক করে দেয়। তার ওপর আরও একটা প্রবাদ রয়েছে– নীরবতা হিরন্ময়।

আমার হাসি পেল, অগোচরে যে অবহেলা রয়েছে সে-ই এসব ফাড়াজুটিয়ে দিয়ে অপরাধী বিবেকদংশনে প্রলেপ লাগায় এবং অজানাতে সেই প্রলেপ যুক্তির রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। মানুষ ভাবে সে দুর্গন্ধপ্রলেপ বন্ধুর কানে সুধাবর্ষণ করবে।

***

১৭ আগস্ট, ১৯৪৭

 কয়েকদিন ধরে বেশিরভাগ সময় হাওয়া বন্ধ থাকে বলে গরমে মনপ্রাণ কচ্ছপের মতো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে। কাল বেতারে বলল আজ এ অঞ্চলে বৃষ্টি হবে। সকালে দেখি হাওয়ার দিক পরিবর্তন হয়েছে। বর্ষার গোড়ার দিকে যেরকম পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া বইত ঠিক সেইরকম গরম বাতাস বইতে শুরু করেছে কিন্তু উপরের আকাশে অষুহীন পাণ্ডুমেঘ পুবসাগর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমের দিকে চলেছে। দুপুরবেলা হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল–বিকেলের দিকে ফের পুবের বাতাস বইতে আরম্ভ করল। ভাবছি এই দু-টানার ভেতর আকাশ মনস্থির করে বর্ষণ করবেন কী করে। এযাবৎ যা অবস্থা তাতে তো মনে হয় না বৃষ্টি হবে। অথচ বর্ষায় সমুদ্রের প্রলয়নাচ দেখার জন্যই তো এখানে এলুম। গরমে প্রাণ যায়, নতুন বই আরম্ভ করতে কিছুমাত্র উৎসাহ বোধ করিনে।

জানি অভ্যাস নেই বলে লিখতে কষ্ট বোধ হয়। মানুষ সে কষ্ট নানা কারণে সয়ে নিয়ে বই লেখে। কেউ টাকার জন্য, কেউ প্রিয়জনদের কাছে নিজের দাম বাড়াবার জন্য, কেউ আত্মম্ভরিতার তাড়নায়। আমার বেলা শুধু প্রথম কারণটা খাটে, অথচ টাকার জন্য লিখতে মন যায় না। মনে হয় তার চেয়ে অল্প মেহনতে খবরের কাগজে লিখে টাকা পাওয়া যাবে।

***

১৯ আগস্ট, ১৯৪৭

মাদ্রাজ উপকূল দুই বর্ষার সঙ্গমভূমি। পশ্চিমের বর্ষা এখানে আসে ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এখানে এসে তার আর সে ঝামর মুখ কৃষ্ণগম্ভীর হয়ে বর্ষণ-আশা সঞ্জীবিত করে না। বাঙালোরেই দেখেছি পশ্চিমের মেঘ পুব দিকে যাচ্ছে কী রকম পানসে চেহারা নিয়ে। এখানে দেখি সে মেঘ প্রায় সাদা হয়ে গিয়ে শরতের হংসও ঝালর হয়ে নীল চন্দ্রাতপে দুলছে। এখান থেকে আর পুব দিকে যেতে চায় না, এক সমুদ্রপার থেকে রওনা দিয়ে অন্য সমুদ্রপারে পৌঁছে আর যেন এগুবার উৎসাহ তার নেই।

তাই কোনও কোনও দিন দেখি অদ্ভুত দৃশ্য। নিচে পশ্চিম সাগরের মেঘ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, আর উপরে পুর্ব সাগরের মেঘ মন্থরগতিতে পশ্চিম দিকে রওনা হয়েছে। আর কখনও-বা দেখি পশ্চিমের মেঘ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে আর ঊর্ধ্বে, অতি উর্ধ্বে পুবের মেঘে শান্ত শুভ্র স্থির হয়ে সমস্ত আকাশ জুড়ে বসে আছে– দুই স্তরের মাঝখানে বিপুল ব্যবধান।

কখনও আসে পশ্চিম থেকে গরম বাতাস দাক্ষিণাত্যের তৃষ্ণার্ত উষ্ণ জনপদের বহ্নিদাহনের শুষ্ক ও চর্মদাহক। কখনও আসে বাতাস– ভিজে ভিজে। বঙ্গসাগরের ঠাণ্ডা জলের পরশ পেয়ে পেয়ে সুশীতল।

কাল রাত্রে দুই বাতাসে আর দুই সমুদ্রের মেঘে কী বোঝাঁপড়া হল জানিনে। মাঝরাতে বৃষ্টি আরম্ভ হল। বাতাস আর বৃষ্টি এল পশ্চিম দিক থেকে।

সকালবেলা দেখি সমস্ত আকাশ কালো কম্বল দিয়ে পালঙ্ক ঢাকা দিয়েছে দুই মেঘের মাঝখানে ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে তারা যেন গভীর নিবিড় আলিঙ্গনে গড়িয়ে পড়েছে, বাকি পৃথিবীকে তারা দেখতে দিতে চায় না।

***

২৬ আগস্ট, ১৯৪৭

অশান্ত ক্রন্দন।

সমুদ্রপারে অশান্ত মন নিয়ে যেতে নেই। মন জানে যে সমুদ্র প্রাণহীন তার গর্জনে অথবা ক্রন্দনে কোনও অর্থ নেই এমনকি গর্জন বা ক্রন্দন শব্দ দিয়ে এই অনুভূতিহীন ধ্বনিকে চৈতন্যের স্তরে নিয়ে আসা ভুল। সুস্থ লোক এ তত্ত্ব জানে, এবং তার অবচেতন মনেও এ সম্বন্ধে কোনও দ্বিধা নেই বলে সমুদ্রের ধ্বনি সম্বন্ধে সে খানিকক্ষণ পরেই অচেতন হয়ে যায়।

কিন্তু যার অবচেতন মন বিক্ষুব্ধ সে বেশিক্ষণ বুদ্ধিমানের মতন স্বীকার করে বসে থাকতে পারে না যে সমুদ্ৰধ্বনি নৈসর্গিক প্রাণহীন শব্দতরঙ্গ মাত্র।

সে শুধায় :

এর হৃদয়ের অন্তস্তলে কী আলোড়ন? সে আলোড়নের কেন্দ্র কোথায়? সে কি দূরে উদয়-দিগন্তেরও পেছনে? সেই আলোড়ন কি দৃষ্টির অগোচরে অন্তরালে উদ্বেলিত হয়ে হয়ে এই সিন্ধুপারে এসে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে শুভ্র অশ্রুজলের কোটি কোটি তে বুদ্বুদে ভেঙে পড়ছে?

না এ অনাদৃতা সুন্দরী? ক্ষণে ক্ষণে নীল অঙ্গনের উপর শুভ্র ফেনের আলিম্পন একে রবিকরকে তার চটুল নৃত্যে প্রলুব্ধ করছে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যভঙ্গের ভয়ে দ্রুততর গতিতে নব নব আলিম্পনের পরিবেশন করে যাচ্ছে। সব চেষ্টা বিফল হল বলে শেষ রশ্মি মেলাবার সঙ্গে সঙ্গে তার সকরুণ ক্রন্দন নিষ্ফল আক্রোশ গর্জনে পরিণত হচ্ছে।

না এ অভিমানী শিশু। দূর থেকে দেখতে পাই ছুটে আসছে, তার ঠোঁট কাঁপছে, ডাইনে-বায়ে কোণের কাছে বিকৃত ভঙ্গি নিয়ে ফাট-ফাট হচ্ছে, তার পর কাছে এসে পারের উপর আছড়ে পড়ে শতধা অশ্রুতে বিগলিত হয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠছে। পারের মা কিন্তু হাত বাড়িয়ে কোল দিলেন না। ওদিকে কে যেন সেই থমকে-গিয়ে-চুপ করে যাওয়া শিশুকে মায়ের পায়ের কাছ থেকে ভাটার টানে সরিয়ে নিল।

না কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত মাতাল? বেহুঁশ বেখেয়ালে ক্রেমদ্য খাতের উপর বোতলের পর বোতল সোডার ফেনা ঢেলেই যাচ্ছে ঢেলেই যাচ্ছে। আর সেই মাতলামোর ভেতরে ও যতই দেখছে হুইস্কি-সোডার রঙ আসছে না ততই রোষে ক্রোধে গর্জন করে যাচ্ছে?

***

৩১ আগস্ট, ১৯৪৭

চোখ বন্ধ করে বসে ছিলুম। অন্ধকার নেবে আসছিল মুমূর্ষর চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসার মতো করে।

ভেতরে ভেতরে যেন সাড়া পেলুম–না সত্যি শুনতে পেলুম আমার পাশ দিয়ে কে যেন চলে গেল।

চোখ মেলে দেখি সত্যি তো। আমার চোখের সামনে দিয়ে কে যেন সমুদ্রের উপর সোনালি জল শাড়ি থেকে নিংড়ে ফেলে ফেলে, সমুদ্রকে যেন দুই ভাগ করে সোজা উদয় সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে– চোখ বন্ধ ছিল, তাকে দেখতে পাইনি। শেষ প্রান্তে পৌঁছে ওই সাদা দেয়াল বেয়ে অভিসারিকা যেন কার বাড়ির ঝরোকায় দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেল সমুদ্রের উপর তার চলে যাওয়ার সোনালি চিহ্ন ঝলমল করছে– অবাক হয়ে তাই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঘোমটা নেই।

পূর্ণচন্দ্র।

এক মিনিটের তরে। যার জন্য অভিসার সে যেন তাড়াতাড়ি এসে কালো মেঘের কম্বল দিয়ে সুন্দরীর মুখ ঢেকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সোনালি রাস্তা যেন মন্ত্রবলে অন্তর্হিত হল। আকাশ-বালুপার সব আড়ি-পাতার-দল অন্ধকারে গা-ঢাকা দিল।

***

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭

 পাছে অন্য লোকের হাতে পড়ে যায় তাই খবরের কাগজ দিয়ে জানাল সন্ধে সাতটা পনেরোয় দেখা হবে। আমাকে খুঁজে নিতে তোমার অসুবিধে হবে না জানতুম তাই ডাঙায়-তোলা নৌকাখানার আড়ালে সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসলুম।

রাক্ষুসে সমুদ্র লক্ষ লক্ষ সাদা দাঁত দিয়ে বালুপারের গায়ে অবিরাম কামড়াচ্ছে। সূর্য ডুবল সাড়ে ছটায়। আকাশের শেষ লালিমা মোছর সঙ্গে সঙ্গে বেলাভূমি নির্জন হতে লাগল, সাতটা বাজতে না বাজতে বেশ অন্ধকার হয়ে এল, জনমানবের চিহ্ন নেই, আমি এক নৌকার আড়ালে বসে– মনে কোনও ভয় নেই, আমাকে ঠিক খুঁজে পাবে, কতবার পেয়েছ, কোনওদিন ফাঁকি যায়নি।

নির্জন, অন্ধকার। তোমার আসার সময় হল বলে। চিরকাল এসেছ নিঃশব্দ পদক্ষেপে তাই শুধু চোখ দিয়ে তোমার প্রতীক্ষা করেছি।

অন্ধকারে ঘড়ির কাঁটা জ্বলজ্বল করছে।

তোমার আসার সময় পেরিয়ে গেল।

তার পর সাড়ে সাতটা বাজল, পৌনে আটটা, আটটা। এ কী! তুমি তো কোনওদিন এক মিনিটের তরেও আসতে দেরি কর না। আমাকে কোনওদিন খণ্ডিত বিপ্রলব্ধ করনি। তবে আজ! খবরের কাগজে দিয়ে লগ্ন মুহূর্ত পাকাপাকি জানিয়ে দিয়ে।

এক ঘণ্টা ধরে ঘড়ির কাঁটা দেখছি, বুকের কাটা গম্ভীর হতে গভীরতর হয়ে ঢুকেছে।

 সোয়া আটটায় উঠে দাঁড়ালুম।

বাড়ির দিকে চলার মুখে একবার ফের শেষবারের মতো পেছনের দিকে তাকালুম।

কৃষ্ণ-সপত্নের আলিঙ্গনে এতক্ষণ মুখ ঢেকে রেখেছিলে? তারি জটার ভেতর দিয়ে আমার অবমানিত প্রত্যাগমনের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে গিয়ে ধরা দিলে!

লজ্জা পেয়ো না সুন্দরী। বহু লাঞ্ছিত অপমানিত রক্তসিক্ত এ দেহে আর স্থান নেই যেখানে তোমার দৃষ্টিক্ষেপ নব অবমাননার অচেনা বেদনা হানতে পারে।

তুমি যেন বেত্রাহত গায়ে উল্কি সাজালে!

***

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭

পূব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ প্রায় চতুর্দিকেই ভোলা বলে গোলচক্রবাল, গম্বুজের মতো আকাশ। মনে হয় সোনালি নীল আণ্ডার মাঝখানে বসে আছি হাঁসের বাচ্চাটির মতো– ছেলেবেলায় বারুণীতে জাপানি খেলনা কিনতুম, গোল কাঁচের ভেতর সোনালি হাঁসের ছানা।

এতদিন ধরে এই হাঁসের বাচ্চার মতো অপেক্ষা করেছি এই নীল আণ্ডা ফাটবে কবে আর আমি এই বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু যতই ভাবি ততই কূল-কিনারা পাইনে যে এই আণ্ডার বাইরে আছে কী। হাঁসের বাচ্চা ডিমের ভেতরে বসে কী ভাবে জানিনে কিন্তু সে যতই কল্পনার ছুট লাগাক না কেন, সে কি কখনও বাইরের পৃথিবীর কল্পনা করতে পারে? তাই কল্পনা করে কী লাভ।

দুপুররাতে ঘুম ভাঙল দেখি চাঁদ যেন আকাশের আণ্ডাতে ফুটো। অনেকক্ষণ ধরে তাকালুম যে এর ভেতর দিয়ে মুক্তির পৃথিবীর সন্ধান মেলে কি না।

***

২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭

 পশ্চিমের তপ্ত বাতাস থেকে থেকে কালোজাম গাছের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া আর নিমের চিকন পাতার ঝুঁটি হাতের মুঠির ধরা এড়িয়ে যায় বলে তারা শুধু দোল খায়।

কৃষ্ণচূড়ার বীজপুট চারমাস হল শুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু কিছুতেই গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়তে চায় না, এরা না খসলে গাছ ফুল ফোঁটাবে কী করে?

এ যেন মরাস্বামী বিধবার সর্বচৈতন্য অভিভূত করে ভূতের মতো চেপে বসে আছে, নতুন প্রেমের নব কিশলয় ফোঁটাতে দিচ্ছে না।

দূরে একফালি নীল সমুদ্র বালুচর আর দিম্বলয়ের মাঝখানে সেঁটে দেওয়া নীল রিবন। এর দিগন্তব্যাপী বিস্তীর্ণতা এখান থেকে কিছুতেই হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। মৃত্যুর মতো এর রঙ নীল। মৃত্যু অহরহ মানুষের চতুর্দিকে রয়েছে তবু মানুষ তার উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন নয়– এ সমুদ্রেরও যে শেষ নেই সেকথা মন জানলেও সে সম্বন্ধে সে সচেতন নয়।

গাছ, সবুজ মাঠ, বালুপার, নীলজল– সবকিছু রৌদ্রস্নানে গা এলিয়ে দিয়েছে কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ শুয়ে শুয়ে। মেঘমুক্ত আকাশ শরতের নীলরঙ এখনও ধরেনি– বর্ষার ভয়ে এখনও সেই পুরনো ফ্যাকাসে বরষাতি দিয়ে গা জড়িয়ে রেখেছে। বাতাস নিষ্কর্মা ভবঘুরের মতো এ-গাছে ও-গাছে ধাক্কা দিচ্ছে– মেঘ বয়ে নিয়ে আসার বেগার থেকে যেন রেহাই পেয়েছে।

জেলেপাড়ার নারকোলপাতার ছাউনি বর্ষায় ভিজে কাকের মতো জবুথবু হয়ে বসে ছিল। রৌদ্রে এখন যেন পালক শুকিয়ে উস্কোখুস্কো হয়েছে। যদি একদিন উড়ে চলে যায় তবে নগ্ন দারিদ্র্যের এই চক্ষুশূল থেকে হেথাকার মানুষ নিষ্কৃতি পাবে।

গতিহীন, বেগহীন নির্জীবতা পুব বাঙলার নদীর পারে গড়ে ওঠা মানুষকে বাড়ির কথা, দেশের কথা বারে বারে স্মরণ করিয়ে দেয়।

***

২৯ জুন, ১৯৫৫

স্বপ্ন

সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেল স্বপ্ন দেখে।

কী স্বপ্ন?

আমি যেন একটি রসিকতা তৈরি করার চেষ্টা করছি। ইংরেজিতে যাকে বলে humourous story– ওই যেসব বস্তু Tit-Bits-এ বেরোয়।

কী গল্প তৈরি করলুম।

 এক ভদ্রমহিলা ভিখিরি trampকে শুধাচ্ছেন, তা, তুমি কাজকর্ম কর না কেন?

ম্যাডাম, কাজ দেয় কে?

আমি দিচ্ছি। আমার বাগানটি বড় অযত্নে আছে। তুমি ওটাকে একটু সাফ-সুরো করে দাও।

ট্রাম্প একটু ভেবে বলল, তাই সই।

মহিলা বললেন, যন্ত্রপাতির কী কী দরকার হবে তার একটা ফর্দ করা যাক। বলে তিনি একটা কাগজেকোদাল, কাস্তে এসব লিখলেন। তার পর ভ্যাগাবন্ডকে বললেন, আমার আর তো কিছু মনে পড়ছে না। আচ্ছা তুমি কাগজ-পেসি নিয়ে ভেবেচিন্তে বাকিগুলো লেখ। আমি ততক্ষণ তোমার জন্য গোটা দুই স্যানউইচ নিয়ে আসি।

ফিরে এসে দেখেন, ভাগাবন্ড লিখেছে, বেশ বড় বড় হরফে–

একখানা খাট
দুটি বালিশ!

 ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবলুম। স্বপ্নে এরকম গল্প বানাবার প্রবৃত্তি আমার হতে যাবে কেন? আমার বন্ধু-বান্ধবদের কেউই তো কখনও বলেননি যে তারা স্বপ্নে রস-গল্প তৈরি করেছেন। কোনও humourist-এর আত্মজীবনীতেও এরকম ঘটনার কোনও উল্লেখ পাইনি।

হ্যাঁ, জানি, কেউ কেউ একটা episode দেখেছেন। যেমন মনে করো রবিবাবুরগানভঙ্গ। তিনি দেখলেন, বড়বাবু (দ্বিজেন্দ্রনাথ) তাঁর বাল্যসখা এক বুড়োকে মজলিসে গান গাইতে হুকুম দিলেন। সে গান গাইতে গিয়ে কেঁদে ফেলল বলে, তিনি তার হাত ধরে তাকে সভাস্থলের বাইরে নিয়ে চলে গেলেন।

তাই নিয়ে রবিবাবু ‘গানভঙ্গ’ লিখলেন।

 এরকম ধারা আরও বিস্তর হয়েছে।

 কিন্তু এই humourous story by itself, স্বপ্নেই সম্পূর্ণ তৈরি করে দেওয়া–উপরের episode-গুলো, কিছুটা স্বপ্নে বাকিটা জাগরণে– এর উদাহরণ তো জানিনে। এটা কী করে হল।

তখন মনে পড়ল, আইয়ুব, কচিতে, আমাতে একদিন কথা হচ্ছিল, আমরা উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাট্য সবই লিখতে পারি। ওস্রাবে কি না, সে হচ্ছে অন্য কথা। আমরাই হয়তো তখন বলব, এ গল্প কিন্তু গল্প হল না, এ উপন্যাস কিন্তু উপন্যাস হল না, ইত্যাদি। কিন্তু tit-bits-এর গল্প লেখা আমাদের সাধ্যের বাইরে। এসব গল্পের উৎস কোথায়, কী করে আরম্ভ হয়, তার কোনও পাত্তাই আমরা জানিনে। তাই যদি জোর করে কিছু লিখি তবে সেটা হবে nothing : আমাদের ছোটগল্প লোকে বলবে খারাপ ছোটগল্প, উপন্যাস পড়ে বলবে, খারাপ উপন্যাস, ইত্যাদি, কিন্তু আমাদের জোর-করে লেখা tit-bits প্রচেষ্টাকে লোকে চিনতেই পারবে না, বলবে এটা Just nothing।

এ-আলোচনা আমাদের ভিতর কবে হয়েছিল আমার আর মনে নেই। দশ, পনেরো পঁচিশও হতে পারে, কিন্তু এ আলোচনার কথা আমি বহুবার ভেবেছি।

তাই কি আমার অবচেতন মন যে-সমস্যা তার গোপন কোণে সঞ্চয়ন করে রেখেছিল তাই দিয়ে এই গল্প গড়ল?

***

কলকাতার কালীপুজো
১ নভেম্বর, ১৯৬৭

সকাল ৮.০০–  বিকটতম পিছ-এ তীব্রতম ভলুমে মাইকবাদ্যসঙ্গীত।

চাপা দেবার জন্য রেডিয়োর একটি যা তা স্টেশনে classical music লাগালুম। ১০%-ও চাপা পড়ল না। কাজে মন দেবার চেষ্টা করলুম। ইয়াল্লা! হঠাৎ সেই classical বন্ধ হয়ে তারাও পাল্লা দিয়ে আরম্ভ করেছে ওই ফিল্মি গানা দিয়ে।

 মোটর স্টার্ট নিচ্ছে না। রোজ সকালে সেটাকে অভিসম্পাত দিই। আজ সেটা নন্দনকাননের মধুরতম সঙ্গীত বলে মনে হল– মাইকটা বেশ চাপা পড়েছে। কপাল আমার! অন্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি স্টার্ট নিল। প্যান্ডাল যদি লং প্লেইং বাজাত তবে হয়তো বেঁচে যেতুম। দুটো রেকর্ডের মাঝখানের নীরবতাটাই যন্ত্রণার বহর বুঝিয়ে দেয়। কনফুস বলেছেন, নিরেট দেওয়ালটা কোন কাজে লাগছে! লাগছে তো তার মাঝখানের ফাঁকটা দরজাটা। এখানে ঠিক উল্টো। দুটো রেকর্ডের মাঝখানের ফাঁকটা না থাকলে ওই চিৎকারে অভ্যস্ত হয়ে যেতুম। ভাগ্যিস ওরা classical বা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাচ্ছে না। বিনোদ বলত, জোর করে কুইনিন খাইয়েছে কিন্তু রসগোল্লা হলে আরও কষ্ট হত। এটা ঠিক নয়। Rape case আসামির উকিল মেয়েটার Connivance ছিল প্রমাণ করতে গিয়ে শুধোল, কিন্তু তোমার ভালো তো লেগেছিল? মেয়েটা বলল, উকিলবাবু, জোর করে কেউ মুখে রসগোল্লা পুরে দিলে সেটা কি তেতো হয়ে যায়?

১০.১৫ — গব্বযন্ত্রণা থেকে মুক্তি?

১০.২৫ — Alas, false pain! ফের শুরু!

১১.৩২ — বেশি না, পাঁচ পাঁচ মিনিটের ভিতর পাঁচবার, পিন গ্রুভে আটকে গাঁ ওঁ উ, গাঁ ওঁ। cf বন্ধ ছিলেম এই জীবনের অন্ধকূপে।

দুপুর ১২.০০ — আমার সুখ-শান্তির বারোটা। চিৎকার করে গলা ফেটে গেল। উত্তরের বারান্দায় গিয়ে বুড়ো শয়তান, আর শয়তানের আণ্ডা দুটোই প্যান্ডেলে জাত-ইডিয়েটের মতো হাঁ করে লৌড-স্পিকারের দিকে তাকিয়ে আছে। খাসা excuse আছে– আমার ডাক শুনতে পায়নি।

আমি লবদ্বার বন্ধ করে অতিষ্ঠ। আর এরা তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ভূমার সন্ধানে একেবারে লাউডস্পিকারের সদরে।

 এরাই মহাজন! পরিবেশ– তা সে যা-ই হোক পছন্দ করতে জানে। আর আমার প্রতিবেশীদের ঈর্ষায় বুক ফেটে যাচ্ছে- আহা, ওরা যদি আমার বদলে এ বাড়ির বাসিন্দা হত।

৩.০০ — ওহ্! কী ভুল করিনু আমি যোগী!

মডারন্ কবিতা আকছারই মেশিনারি থেকে নিরন্তর inspiration পায়। W. C.-তে বসে শুনছিলুম– উপায়ান্তর সেই অন্তত সেখানে একটা গানে বার বার যেন পিন গ্রুভে আটকা পড়ে যাচ্ছে। শেষে বুঝলুম, অহহহা। এটা deliberate নয়া টেকনিক। গাওয়াইয়া ঠিক groove-এ খাবি-খাওয়া পিনের অনুকরণে হুবহু একই শব্দ পাঁচবার তার পর কিছু নির্ঝঞ্ঝাট গান– ফের একই শব্দ পাঁচবার তার ওই গাঁ ও উঁ, গাঁ ও ঊর অনুকরণে গান গাইছে।

১৩.১০ — আহ কি আরাম! মহাসঙ্গীত থেমেছে। ঢাকের বাদ্যি নাকি থেমে গেলে ভালো লাগে (সে আমলে গ্রামাঞ্চলেও শব্দকাতর সজ্জন ছিলেন। আশ্চর্য); যদি বলি এই মহাসঙ্গীতের বদলে আমি ঢাকের বাদ্যি any day prefer করব।

যে গুণী বলেছিলেন।

কী কল পাতাইছ তুমি!
বিনা বাইদ্যে নাচি আমি ॥

তিনি প্যান্ডেলের এ মহাবাদ্য শুনলে কী করতেন।

১৩.৪০ –ওরে মূর্খ, ওরে উন্মাদ, ওরে ঘটোৎকচ! ঝড়া তেরোটি বছর স্কুল কলেজে ইংরেজি পড়ে এই প্রবাদটুকু শিখিসনি, অরণ্যানীর লতাগুলু বিচ্ছিন্ন করে জনপদে পদার্পণ না করা পর্যন্ত হর্ষোল্লাস করে উঠিসনি। কিন্তু সেই বোগদাদি মূর্খ অন্-নশৃশারের মতো আণ্ডার ঝুড়ি সামনে রেখে রাজকুমারীকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিসনি।

আবার আবার সেই কামানগর্জন।

 লাঞ্চ খেতে গিয়েছিল। এবং এরা অত্যন্ত আইনসম্মত আচরণ করে বলে সরকারি কর্মচারীদের মতো আধ ঘণ্টার বেশি লাঞ্চ আওয়ারে নেয় না। সোনারচাঁদরা বাঁচলে হয়!

কামানগর্জন বললুম, কিন্তু কামানগর্জন গম্ভীর সিংহগর্জনের মতো আদৌ কর্ণপটাহ-বিদারক নয়। এমনকি চ্যাংড়া মেশিনগানের ক্যাটক্যাটও প্যান্ডেলের তাণ্ডব-আরাবের সমানে ভূঁইফুলের গানের মতো মোলায়েম।

সেদিন যেন কৃপা আমার করেন ভগবান।
মেশিনগানের সম্মুখে গাই জুঁই ফুলের ওই গান।

 গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। হুঁ। কিন্তু এই প্রচণ্ড প্রলয়বাদ্যের সামনে তিনি কি গাইতেন?

১৪.০০ — রাত্রে আমার সুনিদ্রা হয় না। আমার ভরসা দুপুর। দুপুর থেকে তিনটে অবধি দিবান্দ্রিায়। ঘুম লেগে আসছে, এবার কে যেন কেসিয়াস ক্লে-ই হবে– পেটে মারে মোক্ষম উত্তা। ফের no loudspeaker, এবারে ক্রশের কাঁটা দিয়ে পাঁজরে খোঁচা। চলল নিদেন আধঘণ্টা।… যা দেখলুম, এ যাবৎ আমার ঘুমটাই একমাত্র হিরো যে ওই বিটকেল মুজিকির সঙ্গে lost batle-এর rearguard action লড়ল।

মা কালী! একটা প্রশ্ন শুধব মা, তুমি দুপুরবেলা অ্যাটু দিবান্দ্রিা দাও না?

না এই উৎকট– সেই যে তুলসীদাস বানরদের লঙ্কা আক্রমণের সময়কার বিকট শব্দ অনুপ্রাস সহযোগে প্রকাশ করেছেন–

কটকটহি মরকট বিকট ভট কোটি কোটিগহ ধাবহি—

 কী বলছিলুম মা, এই কটকটহি-ই কি তোমার অতি বিকটিনী দিবান্দ্রিা আয়েশের আফিং!

১৭.৩০ — আমি তো অগা। তাই শুধাই, সন্ধ্যা তো হল। দেবীর আরতিটারতি হবে না? তখন তো শাখটাখ বাজার কথা। সেটা শুরু হলে বাঁচি।

 ম্যাডাম কালী ভূতনাথের কোন পক্ষ যেন হন। না, সে বুঝি অন্নপূর্ণা–

ভূত নাচাইয়া পতি ফিরে ঘরে ঘরে।
না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে!

 তা, ও, একই কথা। তা পাষাণ বাপ মরুক আর না-ই মরুক, ভাইয়ের

অভিমানে যে বড় লাগে এটি বড়ই খাঁটি, আমাদের পাড়াগাঁয়ের ঘরোয়া বাঙালির গোপন গন্ধে-ভরা বেদনা।

অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিল ভাই,
যে মোরে আপন ভাবে তার ঘরে যাই।

 ১৮.০০– শাঁখ বাজল না, লাউডস্পিকারও থামল না। উত্তরের বারান্দায় গিয়ে অবশ্যি শুধানো যায়। সর্বনাশ! ঈশুর রক্ষতু! আমার মতো মঙ্গলাকাভক্ষী, পাড়ার মুরুব্বিকে উৎসাহিত কৌতূহলী দেখে তারা না আমাকে ডবলাপ্যায়িত করার জন্য আরেকটা লাউডস্পিকার-এর সন্ধানে ভূতের ঘোড় চেপে ছুট লাগায়!

১৯.০০– ডাক্তার যা বলে বলুক না কো, আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস exercise physical movements of any sort স্বাস্থ্যের পক্ষে অতিশয় খতরনাক। কিন্তু আর পারা গেল না। প্যান্ডেলের সঙ্গীত উচ্চতর হয়েছে। রাস্তায় নামতে হল।

 প্রথমেই শুনলুম, লাউডস্পিকার বলছে, আজ রাত্রি আটটার সময় নির্ধারিত যাত্রা হবে না! আমি প্রথমটায় উল্লাস বোধ করেছিলুম। সঙ্গে সঙ্গে বলল, কাল হবে।

 সেটা নিশ্চয়ই মিন লা, স্পি, হবে না। সেটা কি এর চেয়েও খুনিয়া হবে? কে জানে!

এখান থেকে প্রায় একশো গজ দূরে একটি ছোট্ট ঘরে আরেক কালী। প্যান্ডেল লাউডস্পিকার কিছুই নেই। দু চারটি বউ বাচ্চাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাস্তায়ও যুবতী মা-ই বেশি। সন্তানের যেন অমঙ্গল না হয়।

২০.১৫ — এবারে আরম্ভ হয়েছে যা তা অতুলনীয়। আধঘণ্টা ধরে রেকর্ড বাজছিল না। এখন organizer-রা বেসুরা গান গাইছেন, মাইক চরম চড়ায় তুলে। তবলাও চলছে। চতুর্দিক নীরব হয়ে যাওয়ার ফলে এবারে আমার suffering চরমে উঠেছে। কালীপূজায় রাত জাগাটা তো স্বাভাবিক।

সকাল ১০.৩০– ফের রেকর্ড চলছে।

***

২১ নভেম্বর ১৯৪৭
মৌলবি বাজার

প্রিয় কণামিয়া,

কিসের কণা ভাবিয়া মনে হদিস নাহি পাই
হলপ তবু করিতে পারি তাহার সাথে নাই
জ্ঞানের যোগ, ইলিম আর বুদ্ধি যারে কয়
 পেয়েছ মেলা সুযোগ তবু দাওনি পরিচয়।
না হলে এতদিনে
আসিতে হেথা, বলিতে হাসি, নিয়েছি আমি চিনে
যেমন করে মেঘের ডাকে ময়ূর উঠে নাচি
 অলখকর-পরশ পেয়ে কুমুদ উঠে বাঁচি
 –তপ্ত-খর নিদাঘ-দাহ দিবার অবসানে–।
অজানা কোন টানে?
কিসের পরিচয়?
ডাউকি হতে ছুটিল জল সাগরে হবে লয়?
মেঘের বাণী, শুক্লা নিশি, সিন্ধু পারের ডাক,
চিনেছি আমি ভাষায় ভরা কভু বা নির্বাক।

উপযুক্ত তত্ত্বকথা করিতে সপ্রমাণ
চলিয়া আসো তুরিতগতি চড়িয়া মোটর যান।
 সঙ্গে এনো তাবৎ লেখা তব
 অছাপা ছাপা বেবাক মাল প্রাচীন আর নব।

কহেন গুণী, বাড়ির জোরে বিশেষ এক প্রাণী
 তেরিয়া হয়ে বীরেরে যায় হানি।
 আম্মো তাই সাহস করি তবে
–হুঙ্কারিয়া টঙ্গি ঘরে নাচিয়া ভৈরবে
মনের সুখে করিব গালাগাল,
 বলিব, তব তাবৎ লেখা নেহাত জঞ্জাল
 রদ্দি ওঁচা, ভ্যাপসা পচা, থাডো কেলাশ অতি
 ওরে রে দুর্মতি
 বাড়াস কেন এ দুনিয়ার বিভীষিকার ভার
নাম যে কণা, কণামাত্র সন্দেহ নেই আর।

***

১২ জুন ১৯৫৫

মডার্ন কবিতা

এখানে কত রকম গরমই না পড়ে।
এবং বৃষ্টিও নামে কোনওপ্রকারের নেটিশ না দিয়ে।
 কাল দুপুর রাতে হঠাৎ ঝমাঝঝম।
সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল, প্রাণ যেন গান গেয়ে উঠল।

আজ সকাল থেকে ভ্যাপসা গরম।
 কী করি, কী করি, কী করে গরম ভুলি।

এমন সময় এক বন্ধু এলেন এক ঠোঙা কালো জাম নিয়ে!

 কত বৎসরের পরে কালো জাম!

মনে পড়ল,
বন্ধুরা হাসাহাসি করেছিল;
আমি যখন একদিন এই রঙের একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলুম,
কারণ আমার রঙ তখন ছিল ফর্সা,
–আজ আমার ছেলে ফিরোজের মতো।

হার্টটা দুম করে বন্ধ হলে গেল।

***

৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০

HEINE

[আজ সকালে হাইনের কবিতা অনুবাদ করলুম]

সত্যি সত্যি আমরা দুজনে মিলে
 অদ্ভুত এক গড়েছি প্রেমের জোড়া
 প্রিয়া মোর পায়ে না পারে দাঁড়াতে ভালো
 আর আমি? আমি একবারে হায় খোঁড়া।

ব্যামোতে কাতর সে যেন বেরাল-ছানা
 আমি তো কুকুর শুয়ে শুয়ে কাতরাই,
আমার মনেতে সন্দেহ আছে মেলা
দুজনার সাথে বেশ কিছু আছে বাই!

তার মনে লয় কমলিনী তিনি নাকি
কল্পনা করে গড়েছে আপন মনে
 ফ্যাকাশে চেহারা– তাই লয় মোর মন
নিজেরে হেরো না, চন্দ্রমাসম গণে!

কমলিনী ওই খুলিল পাপড়িগুলি
 চন্দ্রমা পানে তুলে ধরে তার আঁখি
 কোথায় না ভরা সফল জীবন পাবে
হাতে তার, হায়, কবিতাটি শুধু রাখি।

***

রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে

১২ এপ্রিল ১৯৬১

শতাব্দী হয়েছে পূর্ণ। আজি হতে শতবর্ষ পরে
নরনারী বালবৃদ্ধ কাব্য তব বক্ষোপরি ধরে
ভাবিয়া অবাক হবে কী করে যে হেন ইন্দ্রজাল
বঙ্গভূমে সম্ভবিল। পরাধীন দীন দগ্ধ-ভাল
অন্ধভূমি। তারি তমা বিনাশিতে উদিল যে রবি
স্বর্গের করুণা সে যে। বঙ্গ কবি হল বিশ্বকবি।
তার পর এ যুগের লোকে স্মরি মানিবে বিস্ময়
কোন পূণ্য বলে মোরা পেনু তার সঙ্গ, পরিচয়!

***

১৪ এপ্রিল ১৯৬১

নববর্ষ
(১৩৬৮)

স্নেহের মুকুল,

তুমি তো আক্কেল ধরো, বলো তো আমারে
 নববর্ষ লয়ে কেন ফাটাফাটি প্রতিবারে!
পুরনো বছরটারে বাতাস কুলার
 দিয়ে কেন ঝাঁটা দিয়ে করে দেয় বার?
কী দোষ করেছে, কও, পুরনো বছর
তারেই তো নিয়ে বাবা, করে নিলে ঘর
তিনশ পষট্টি দিন। গেল কি খারাপ,
উঠেনি কি সূর্য বুঝি, দেয়নি কি তাপ?
উঠোন বাজারে মাছ ভালো মন্দ যাই,
 ব্লেডেতে কাটিয়া মাছ দিন কাটে নাই?
 মদ্য খেয়ে চাচা বুঝি হয় নাই টং
পুপু পুটু মীরামাই করে নাই ঢং
যার যাহা, অভিরুচি? টেটেন পটের
বিবি সেজে বেরোয়নি? মেজদা ঘটের
বুদ্ধিটি খরচ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
 মাথায় বুলায়ে হাত এনেছে এন্তের
খরচ করেনি তারো বেশি? পদি পিসি
 করেনি ক্যাটের ক্যাট? ভাঙা ফাটা শিশি
 করেনি কি বিক্রি, রামা, টুপাইস তরে?
 বৌদি চষেনি মাঠ চক্করে চক্করে
 টাট্টু ঘোড়া যেন হায়! যাবে অলিম্পিকে।
বড়দা করেনি রাঙ্গা বাড়িটারে পিকে?
পাক মাম গুড়গুড়ি বাবুজি জামাই
করেনি কি দিবারাত্রি শুধু খাই খাই?
 রকেতে দুজনা বসি করিনি কি প্ল্যান
টুপাইস কামাবো বলি- খুদা যদি দ্যান!
কে জানে জর্মনি বসে হয়তো ভাইয়া
 করে রেখে আছে ব্লন্ড গুণ্ডা দুই বিয়া!

(২)

তবে কি পুরানা সাল ছিল দিশি সস্তা
 তাহারে বিদায় দিয়া ভরি বস্তা বস্তা
আনিবে জর্মন-মাল কিংবা সে বিলাতি
নববর্ষ- গ্যারান্টিড পাকা সে বেসাতি!
 চলিবে দশটি সন এক নব বর্ষে
 কই, দিদি, বলে না তো চোখেতে সরষে–
 দেখি যবে, বলে কি না এরেও বিদায়
দেওয়া হবে। বারো মাস হয়ে গেল, হায়!

(৩)

তুমি তো সেয়ানা মেয়ে চালাও সংসার
 বল দেখি তবে কেন এহেন ব্যাভার?–
 বাজে খর্চা একদম– পুরানটা যবে
 দিব্য কাজ দিয়ে যায়; নয়া আনা তবে?

***

২ জানুয়ারি ১৯৬২

বর

মুখ খান্ কেনে মেঘলা মেঘলা
চউক্ষে কেনে পানি
ঠোঁট ফুলাইয়া থাকিলে পরে
কেমুন কইরা জানি।

কনে

 ছলে বলে বানছো আমায়
কাইরা নিছো মন
কাইলকা যা কইছিলাম, নাগর
আছে কি স্মরণ?

বর

জেওর-বেসর যত চাইছ
ঢ্যাইল্যা দিমু পায়
একটুখানি হাস কন্যা
পরান জ্বইল্যা যায়

***

৯ এপ্রিল ১৯৬২

পিলসুজপরে হেরো জ্বলে দীপশিখা;
চতুর্দিকে যে আঁধার ছিল পূর্বে লিখা
মুহূর্তেই মুছে ফেলে।
 কিন্তু অবহেলে
মাভৈ বলিয়া তারে ছেড়ে দেয় স্থান
যে-আঁধার পায়ে ধরে মাগে পরিত্রাণ।

[দিনলিপি-তে উল্লিখিত ব্যক্তিগণের পরিচয়।

 ১। রাবেয়া– লেখকের স্ত্রী।

 ২। ফিরোজ লেখকের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

 ৩। ভজু লেখকের কনিষ্ঠ পুত্র।

৪। বিশী–প্রফুল্লকুমার বিশী (লেখক শ্রীপ্রমথনাথ বিশীর মধ্যম ভ্রাতা)।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *