দিনগুলি রাতগুলি (রচনা ১৯৪৯-৫৫। প্রকাশ ১৯৫৬)
দিনগুলি রাতগুলি
[ইভাকে]
৭ জানুয়ারি। রাত্রি
হে আমার সুনিবিড় তমস্বিনী ঘনভার রাত্রি, আমাকে হানো।
ঐ তার আলুলায়িত বেদনার কালো, তারই চুপে দীর্ঘকাল এ আমার স্নান,
বন্ধমোহ গতশ্বাস আলুথালু বাঁচা–
কী লাভ কী লাভ তাকে অবিশ্রাম ক্লীবত্বের জ্বালাময় দৈন্যে পুঞ্জ ক’রে?
কিংবা তাকে মহত্ত্বের শিখরে ছুটিয়ে নিয়ে অবশেষে নির্বাধ প্রপাতে
অন্তহীন অন্তহীন অন্ধকারে বিসর্জন ক’রে
কী লাভ কী লাভ?
তাই
এমন আকাশ হবে তোমার চোখের মতো ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার স্থির
হবে মৃতের প্রাণের মতো উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছো সর্বময় রাত্রির গহনে
মিশে আমি এক ক্লান্তির কফিনে, তুমি যদি মৃত্যু আনো অবসাদে মূক আর কঠিন
কুটিল রাত্রি জুড়ে–
হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্ৰিময় মালা,
মৃত্যুফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা,
আমার জীবন তুমি জর্জরিত করো এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে
এবং আমাকে বলল, ‘মাটির প্রবল বুকে মিশে যাও তৃণের মতন’:
আমি হব তাই
তৃণময় শান্তি হব আমি।
.
৮ জানুয়ারি। সকাল
ধীরে, আরো ধীরে সূর্য। উঠো না উঠো না। আবার প্রভাত হলে পৃথিবী
উন্মুখ হবে, রৌদ্র হবে ব্যাধের মতন। আমাকে হানবে তারা বড়ো!
তার চেয়ে তমস্বিনী রাত্রি ভালো আজ, তামসীরে মেরো না মেরো না–
ধীরে, আরো ধীরে সূর্য। উঠো না উঠো না।
.
৮ জানুয়ারি। দুপুর।
হাহাতপ্ত জ্বালাবাষ্প দিনের শিয়রে কাঁপে হৃদয় আমার।
আকাশ, প্রসন্ন হও। রৌদ্রহর মেঘে মেঘে ঝাঁকালো করো দিগঞ্চল- দীর্ঘ
করো তামসগুণ্ঠন। আমাকে আবৃত করা ছায়াস্তৃত একখানি ধূসর-বাতাস-
ঢালা অকরুণ আলোর মালায়,
আমাকে গোপন করো তুমি।
.
৮ জানুয়ারি। রাত্রি
আকাক্ষা উন্মত্ত হয়, প্রেমের বিষাণে তারা ছুটে ছুটে মাথা কুটে মরে, ভয়ে
কাঁপে দূর-দূরান্তর।
কত বলি, কত ভালোবেসে মৃদু স্বরে-সুরে বলি তাকে, রে দুরন্ত চোখ, স্পর্শ
তাকে কোরো না কোরো না। সে তবু শোনে না। বারংবার ঘুরে ঘুরে একই
বৃত্তে অন্তহীন সে পেয়েছে শুধু একখানি
অবসন্ন দীন ছায়ামাখা ভারি কৃপণ আকাশ
সেই তার ভালো।
কত বলি, শোনো তুমি অবকাশহারা গুঢ় ব্যথায় আরক্ত-চিত্ত, শোনো। লজ্জার
আনীল বিষে মুখ তুমি ঢেকো না ঢেকো না। সে তবু শোনে না। বারংবার ঘুরে
ঘুরে একই বৃত্তে অবিরাম সে এনেছে একখানি শুধু
যন্ত্রণার ডালা।
সেই তার ভালো।
.
৯ জানুয়ারি। সকাল।
‘এখানে ঘুমায় এক মানবহৃদয়, তার জলে লেখা নাম।’
কবিদেব, কেবল বেদনা- আহা কেবল বেদনা বুঝি ভালোবাসে তোমার হৃদয়!
মাটির শীতল স্পর্শে অবিরাম অবিরাম কবর কামনা করো তাই? কতদিন
মুঠো মুঠো এমন প্রভাত তুমি ধরেছ কিশোর? কতদিন সূর্য থেকে মাটি থেকে
শূন্য থেকে ধরেছ আকুল মনোভারে
একখানি শিথিল প্রণয়?
অবশেষে একদিন জলে-লেখা-নাম কবি মাটির বাসরে ঘুম রচে।
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না
বেদনার শাদা ফুলে আকাশ নিবিড় হবে, অবকাশে ভরে যাবে প্রাণ। অবশ
বিরামভরা এ পদচারণা তার পুঞ্জ হবে ভাষার আলোকে। আকুঞ্চিত দুটি হাতে
আঙুলে আঙুলে তুমি টেনে নেবে গান–
অবশেষে থরে থরে কথার কাকলি তুলে বীথিকুঞ্জ সাজাবে প্রণয়ী, উচ্চকিত
পৃথিবীর দুর্বার প্রতাপ তুচ্ছ করে, কবিতার লেখে-লেখে সুন্দর-আশ্লেষ-ধন্য
মেঘকুঞ্জ কথার প্রণয়ী
রাত্রির আবেশে মগ্ন হবে–
তবু সে প্রেমের রাত্রি তার!
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না।
.
১১ জানুয়ারি। দুপুর
সুন্দর কবিতা সখী!
যখন বিষণ্ণ তাপে প্রধূম গোধুলি তার করুণাবসন ফেলে সূর্যমুখী পৃথিবীকে ঢাকে,
কঠিন বিলাপে কাপে উপশিরা-শিরা, জ্যোতিষ্কলোকের রূপসীরা একে একে
ছিন্ন করে দয়িত-আকাশ, যখন প্রেমের সত্য ভুবনে ভুবনে ফেরে করুণ লেখায়,
তুমিও আসন্ন চন্দ্রে মেলে দাও হৃদয় তোমার, আমি থরোথরো শীতে যন্ত্রণার
শিখা মেলি আতপ-ত্যিক, যখন পৃথিবী কাপে মৃততেজা মুঠোতে আমার
তখন কবিতা মিতা, প্রিয় থেকে প্রিয় সখী, সুহৃদ, সুন্দর!
জলের ডালায় যদি হৃদয় প্রসার করি, তোমারই বিকাশ।
মেঘের গুহায় ঢালি হৃদয় যখন, দেখি তোমারই বিকাশ।
কুয়াশা-উথাল জটা দিক দিক ভরে যদি, তোমারই বিকাশ।
স্মরণ যেখানে, প্রাণ যেখানেই, সেখানেই তোমার বিকাশ।
তখন কবিতা মিতা প্রিয় থেকে প্রিয় সখী সুহৃদ সুন্দর!
কবি রে, তোর শূন্য হাতে
আকাশ হবে পূর্ণ–
উদাস পাগল গভীর সুরে
ডাক দে তারে ডাক দে!
ভাঙতে কাঁকন, ছিঁড়তে বাঁধন কু
লোয় না তার সাধ্যে
কবি রে, আজ প্রেমের মালায়
ঢেকে নে তোর দৈন্য!
বহো রে আলোর মালা অবশা রাত্রি ঘিরে
মেঘের ওই আকাশ ছিঁড়ে ঝরে রে বেদন-সুরা
কবিতা কল্পলতা আকুলা চঞ্চলতা
বাঁধে রে যন্ত্রণা তার বাঁধে সে তমস্বিনী।।
বহো রে আলোর মালা গগনে দাও ছড়িয়ে
দহনে দগ্ধ ক’রে হৃদয়ে ঝিলিক করো–
মেঘে কে জাগছ তুমি জাগো কে শূন্যপুরে?
কবিতা সূর্যলতা হৃদয়ে চক্ষে জ্বলে।।
বহো রে আলোর মালা তামসী কণ্ঠ জুড়ে–
তবু কে কাঁদছে সুরে? কবি কি নিত্য কাঁদে?
কবি সে, নিত্য কাঁদে আকাশে নিত্য বেদন
বহো রে আলোর মালা ছেঁড়ো রে কালোর বাঁধন।।
.
১২ জানুয়ারি। রাত্রি
বাসনা-বিদ্যুতে তুমি ছিন্ন করো চরিত্রের মেঘ। প্রভূত-আবেগ-পুঞ্জ চেতনার বৃষ্টি করো আলুথালু প্রকৃতির মুখে। রজনী শাঙন-ঘন, জীবন ময়ূর, দুঃখ কাপে দুর্বল দারুণ।
প্রেমের বিকীর্ণ শাখা ফুলে-ফলে জ্বলে। জেগে ওঠে ধীরে ধীরে একখানি তপ্তহত পরিপূর্ণ মুখ। রাত্রির কলস ভেঙে প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে।
*
বাউল
বলেছিলাম, তোমায় নিয়ে যাব অন্য দূরের দেশে
সেই কথাটা ভাবি,
জীবনের ওই সাতটা মায়া দূরে দূরে দৌড়ে বেড়ায়
সেই কথাটা ভাবি।
তাকিয়ে থাকে পৃথিবীটা, তোমার কাছে হার মেনে সে
বাঁচবে কেমন ক’রে।
যেখানে যাও অতৃপ্তি আর তৃপ্তি দুটো জোড়ায় জোড়ায়
সদরে-অন্দরে।
উদাসিনী নও কিছুতে-বুঝতে পারি তোমার বুকে
অন্য কিছু আছে,
যন্ত্রণা তার পাকে পাকে হৃদয় খোলে, সে-খোলাটার
অন্য মানে আছে।
ঘুমের মধ্যে দেখি আলোর ভরা-কুসুম নীলাংশুকে
বাঁধতে পারে না, এ
উঠেই দেখি কী বিচিত্র, একটি আঁচড় লাগেনি তার
ভালোবাসার গায়ে।
বলেছিলাম তোমায় আমি ছড়িয়ে দেব দূর হাওয়াতে
সেই কথাটা ভাবি।
তোমার বুকের অন্ধকারে সুখ বেজেছে মদির হাতে
সেই কথাটা ভাবি।
*
কবর
আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা
লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে
গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে,
তার সবটুকুতেই শস্য যেন ফলে।
কঠিন মাটির ছোঁয়া বাতাস পেয়েছি এই সমস্ত দিন
নীচে কি তার একটুও নয় ভিজে?
ছড়িয়ে দেব দু-হাতে তার প্রাণাঞ্জলি বসুন্ধরা,
যেটুকু পাই প্রাণের দিশা নিজে।
ক্ষীণায়ু এই জীবন আমার ছিল শুধুই আগলে রাখা
তোমার কোনো কাজেই লাগে নি তা–
পথের কোণে ভরসাহারা পড়ে ছিলাম সারাটা দিন
আজ আমাকে গ্রহণ করো মিতা।
আর কিছু নয়, তোমার সূর্য আলো তোমার তোমারই থাক
আমায় শুধু একটু কবর দিয়ো
চাই না আমি সবুজ ঘাসের ভরা নিবিড় ঢাকনাটুকু
মরাঘাসেই মিলুক উত্তরীয়।
লজ্জা ব্যথা অপমানে উপেক্ষাতে ভরা আকাশ
ভেঙেছে কোন্ জীবনপাত্রখানি–
এ যদি হয় দুঃখ আমার, তোমায় নয় তো এ অভিযোগ
মর্মে আমার দীর্ঘ বোঝা টানি।
সেদিন গেছে যখন আমি বোবা চোখে চেয়েছিলাম
সীমাহীন ওই নির্মমতার দিকে–
অভিশাপ যে নয় এ বরং নির্মমতাই আশীর্বাদ
হে বসুধা, আজ তা শেখে নি কে।
রক্তভরা বীভৎসতায় ভরেছে তার শীর্ণ মাটি
রিক্ত শুধু আমাদের এই গা-টা
টানাটানা চক্ষু ছিঁড়ে উপচে পড়ে শুকনো কাঁদা
থামল না আর মরুবালুর হাঁটা!
যে পথ দিয়ে সূর্য গেল ছায়াপথও তার পেছনে
হারিয়ে যায় লুকিয়ে যায় মিশে
ঘোড়ার ক্ষুরে থিঁতাল বুক অলজ্জ-সে আলোর ধারা
দীপ্ত দাহ ভরেছে চোখ কিসে!
কুণ্ডলিত রাত্রিটা আজ যাবার সময় বলল আমায়
‘তুমিই শুধু বীর্যহারার দলে,
ঋজু কঠিন সব পৃথিবী হাড়ে-হাড়ের ঘষা লেগে
অক্ষমতা তোমার চোখের পলে।’
নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী
আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা–
মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে
অস্ত্র গোড়া, আমায় কোরো ক্ষমা।
*
ঘরেবাইরে
এই সেই অনেকদিনের ঘর, তার দেয়াল ফাটছে, আশা ফাটছে।
যেদিকে তাকাই তার নির্বোধ নীরব চোখ,
ভীষণ লজ্জাহীন একঘেয়ে সূর্যহীন গন্ধ
বৎসরের পর বৎসর একখানি করে টালি খসিয়ে মাথা তুলছে।
বৃদ্ধা ঠাকুমার নামাবলির মতো মূঢ় দেয়ালের অসহ্য দুরবলোক্য তর্জনী
তাকিয়ে মনে হয়
আশা নেই আশা নেই
আমার বয়স হাজার কিংবা এ-রকম
আর সামনের ভবিষ্যৎ মানেই প্রাগৈতিহাসিক অন্ধ বর্বর যুগ
যে মারে সেই বাঁচে–
অন্তত মা-র মুখে তাকিয়ে এ-ছাড়া আর কোন্ আশা?
আমি জানি মায়ের এই দন্ত ঘুচবে না কোনোদিন
অকুলানের সংসারকে কুলিয়ে দেবার দম্ভ–
এ দুঃসাহসিক স্পর্ধা তার ভঙ্গুর পদক্ষেপেও কী আশ্চর্য প্রখর ফোটে।
কিন্তু তবু
তবু তার আঙুলের পঞ্চমুদ্রার বঙ্কিম ভঙ্গিতে বিধাতা ঝিলকিয়ে ওঠেন হঠাৎ
আর স্পর্ধার মেরুদণ্ডে সেই আদিম হা-কপাল শিরশির করে ওঠে
‘আর পারি না
তোমরা বরং এই দুর্দম ভার গ্রহণ করো, আমি দেখি
কী আলাদিনের প্রদীপে খরচ কুলোয় রাবণের।
আর, ভগবান,
সংসারের কোন্ সাধটা-বা মিটল এই অফুরান ঘানি টেনে টেনে!’
এমন ললিত সন্ধ্যা সোনার পঞ্চপ্রদীপ ছোঁয়াবে শান্ত ছেলের মাথায়
(হায়রে শান্তি)
ধানের শিয়রে পায়রা
(হায়রে শান্তি)
প্রজাপুঞ্জ বাইরে বেরোয় ঘর ছেড়ে কোন্খানে একটু নিশ্বাস মিলবে
শূন্য নীলে কিংবা শহরে
যেখানে ঘর নেই, ঘরের নৈরাশ্য নেই, ঠাকুমার চোখ নেই।
তারপর
সারাদিনের ক্লান্তি মিশে মিশে
সেই অস্বচ্ছ দিনান্তে ভয় নেমে ভীষণ
বাহির কৈল ঘর।
আর দেখব না সেই লাঞ্ছিত চোখ।
যার এক চোখ হাওয়ায় পশুগ্ৰাস দেখে দেখে ভয়ে স্থির,
ধর্ষকাম পৃথিবীর হাত থেকে, শূন্যবন্ধন থেকে
কেঁপে কেঁপে পেছোতে চায়, দেয়ালে লেগে লেগে রক্তের মতো নিশ্বাস টলছে–
আরেক চোখে ভীষণ নির্লিপ্ত ক্ষমা নীরব থেকে থেকে
লজ্জাতুর করে তুলছে যৌবন।
পসারিনী, যৌবন নিলাম করে ঘাটে ঘাটে
এমন নিষ্ঠুর ক্ষমায় বিধো না আমায় যৌবনবতী–
এই অজস্র বলি (মাগো!)
বালির নীচে নীচে কবর কামনা করে,
কতদূর থেকে তৃষ্ণা এসে এসে সমুদ্র ছুঁতে পায় না
আর মায়ের যন্ত্রণা!
এ কোন সৃষ্টির যন্ত্রণা।
*
সপ্তর্ষি
‘Strait is the gate and narrow is the way which leadeth unto
Life : and few there be that find it.’- New Testament.
আমি প্রায়ই ভাবি, মেঘলা-টোপর সন্ধ্যাকে ভালোবাসব প্রিয়ার মতো
হাত বাড়িয়ে ডাকব তাকে এসো এসো। এসো
প্রাত্যহিকের দিনযাপনকে জীবন করে ভরিয়ে দাও–
আমি প্রায়ই ভাবি।
সাত ঋষি নিত্য জাগে আকাশে প্রশ্নচিহ্ন তুলে
অন্ধকারের অনিবার্য সূচিভেদ্য আক্রমণ বেদনার ঢেউ তোলে বুকের উপান্তে,
কঠিন আবিলতায় আচ্ছন্ন নীরক্ত কৃষ্ণ চক্ষু
অগণ্য বুদ্বুদের রাশীকৃত অনিশ্চয়তার মধ্যে
মুহুর্মুহু সে-প্রশ্নের উত্তর জোগাবার ভান করে!
ইতিহাস স্থির এবং কঠিন
এবং অকম্পিত কৃপাণশোভিত বজুহাত দৃঢ় থেকে দৃঢ়
ক্ষমা জোগায় না তার নির্দেশে।
তিথিতে আর তিথির বাইরে তার মহাশ্বেত ঘোষণালিপির শমন পৌঁছয়
দ্বারে দ্বারে—
অকৃপণ তার কণ্ঠ :
প্রত্যূষের পাখিকূজন ঘুমভাঙানোর বার্তা আনবে জেনে
শয্যাপিষ্ট যে নিরাসক্ত মন
ইতিহাসের কুঠারে ঈশ্বরের টুকরো-টুকরো-খণ্ড অভিশাপ বর্ষণ করে তার মাথায়,
মৃত্যুর শোচনীয় গহ্বরে মুহূর্তে তলিয়ে যায় তারা;
এবং আর এক মহান মৃত্যু দুর্গম নিশ্চিতের লালপথে আহ্বান জানায় সকলকে।
মহতো মহীয়ান, দেদীপ্য আশা আমার সামনে,
সপ্তর্ষির প্রশ্ন কোটি হৃদয়ে আবেগবন্ধুর জিজ্ঞাসার অনুরণন তোলে
সতত তরুণ যাত্রা
বিদ্রোহী নবকেতন কুয়াশালীন পথের প্রস্তুতি স্থির করে
আর ঘোষণা করে–
‘জীবনের দ্বার সংকীর্ণ এবং পথ দুর্গম
অল্প লোকেই তা পায়’ :
কেননা আমরা সেই কতিপয়ের অন্যতম।
মেঘ থেকে ছিন্ন বৃষ্টিতে আমরা সিক্ত
এবং আমাদের ডেরায় পানীয়ের সন্ধান নেই কোনো–
মৃত্যু যদিও তোমায় স্তূপ স্তূপ জমায়
বৃষ্টি তাকে বন্যা করে কঠিন ছল ভাঙছে।
*
বলো তারে ‘শান্তি শান্তি’
১.
মাগো, আমার মা—
তুমি আমার দৃষ্টি ছেড়ে কোথাও যেয়ো না।
এই যে ভালো ধুলোয় ধুলোয় ছড়িয়ে আছে দুয়ারহারা পথ,
এই যে স্নেহের সুরে-আলোয় বাতাস আমায় ঘর দিল রে দিল–
আকাশ দুটি কাঁকন বাঁধে, বলে, আমার সন্ধ্যা আমার ভোর
সোনায় বাঁধা- ভুলে যা তুই ভুলে যা তোর মৃত্যু-মনোরথ।
সেই কথা এই গাছ বলেছে, সেই কথা এই জলের বুকে ছিল,
সেই কথা এই তৃণের ঠোঁটে- ভুলে যা তুই, দুঃখরে ভোল তোর,
ধুলোতে তুই লগ্ন হলে আনন্দে এই শূন্য খোলে জট!
তুমি, আমার মা–
শান্তি তোমার ঘট ভরেছে, দুঃখ তোমার পল্লবে কি গাঁথা?
তুমি আমার চক্ষু ছেড়ে কোথাও যেয়ো না।
.
২.
আকাশ বলে বাতাস বলে ব্যথা।
ব্যথার তুলি পলাশলাল মেঘে।
ভাঙলে তুমি প্রেমের নীরবতা
দুঃখ আমার টলবে বুকে লেগে।
দুঃখ আমার বুকের টলোমলো
জলের বুকে সন্ধ্যা দিল এঁকে–
ব্যথায় লেগে বন-বনানী হলো
আমার মতো, আমার মতো কে কে?
আমার মতো বাতাস জানে ডানা,
আমার মতো সূর্য জানে ফুল,
তোমার চোখে নিদ্রা হলো টানা
মরণমুখী সূর্য আর জাগনলোভী চাঁদে
আকাশ পরে স্নিগ্ধ দুটি দুল।
.
৩.
মাগো, আমার মা–
তুমি আমার এ ঘর ছেড়ে কোথাও যেয়ো না।
মৃত্যু তোমায় ভয় পেয়েছে, রাত্রি এল অস্তদিঘির পার,
যেখানে এই চোখ মেলেছ সেইখানে কার শান্তি কেঁদে মরে?
নিশুতি রাত ঝুমঝুমিয়ে আর্তনাদের বর্শা এল ছুটে
যেখানে যাও সেখানে নেই শান্তি তোমার সেখানে নেই আর!
দিন ছুটেছে রৌদ্ররথে শহরগ্রামে সাগরে-বন্দরে
যেখানে যাও সেখানে চাপরক্ত পাবে শীর্ণ করপুটে
আকাশ-ডাঙা বন-বনানী শান্তি বাঁধে শান্তি বাঁধে কার?
তুমি, আমার মা–
শান্তি তোমার ঘট ভরেছে, রক্তে ঘটের সিঁদুর হবে টানা,
তুমি আমার ঘর ছেড়ে মা কোথাও যেয়ো না।
.
৪.
বাজনা বাজে, চৌকিদার, বাজনা বাজে কেন?
নীলদুয়ারে ঘা দিল ভাই মেঘের সেনাগুলো।
বাজনা বাজে, চৌকিদার, বাজনা বাজে কেন?
ভয়ের দুয়ার-বন্ধ ঘর কাঁপছে জড়োসড়ো–
বাজনা বাজে, চৌকিদার, বাজনা বাজে বড়ো!
মাগো, আমার মা–
ঝড় নেমেছে, দুয়ারে তার ঝঞ্ঝা লাগো-লাগো
তুমি আমার বাজনা শুনে শঙ্কা মেনো না।
বাজনা বাজুক, ভয় পেয়ো না, বাজনা বাজুক মা!
*
যমুনাবতী
One more unfortunate
Weary of breath
Rashly importunate
Gone to her death.
–Thomas Hood
নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী
দু-এক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দি’।
হায় তোকে ভাত দিই কী করে যে ভাত দিই হায়
হায় তোকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়
নিভন্ত এই চুল্লি তবে
একটু আগুন দে–
হাড়ের শিরায় শিখার মাতন
মরার আনন্দে।
দু-পারে দুই রুই কাৎলার
মারণী ফন্দি
বাঁচার আশায় হাত-হাতিয়ার
মৃত্যুতে মন দি’।
বর্গি না টর্গি না, যমকে কে সামলায়।
ধার-চকচকে থাবা দেখছ না হামলায়?
যাসনে ও-হামলায়, যাসনে।।
কান্না কন্যার মায়ের ধমনীতে আকুল ঢেউ তোলে, জ্বলে না–
মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না–
চলল মেয়ে রণে চলল!
বাজে না ডম্বরু, অস্ত্র ঝনঝন করে না, জানল না কেউ তা
চলল মেয়ে রণে চলল!
পেশির দৃঢ় ব্যথা, মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা সঙ্গে
চলল মেয়ে রণে চলল!
নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল
মৃত্যুরই গান গা–
মায়ের চোখে বাপের চোখে
দু-তিনটে গঙ্গা।
দূর্বাতে তার রক্ত লেগে
সহস্র সঙ্গী
জাগে ধক ধক, যজ্ঞে ঢালে
সহস্র মণ ঘি!
যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে।
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে।
*
সূর্যমুখী
ইচ্ছে হলো ব্যাকুল, তবু খুলল না সে ঘর
অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠল স্বর
‘এ যে বিষম! এ যে কঠিন!’
কী যে ছোট্ট বাড়ি
সকালও তার মুখ দেখে না, বিকেল করে আড়ি।
পীতল মুখে শূন্যে ঝোলে সূর্য সারা দুপুর
ঘরেতে তার তাপ পৌঁছয়, জ্বর হয়েছে খুকুর।
শুকনো ভাঙা বেদানা তার মাথার কাছে খোলা,
ছোট্ট দুটো হাত ভরে দেয় বুকে কঠিন দোলা,
লালছলোছল আলগা চোখে তাকাল ভয়-ভয়,
যে-দেয়ালেই চোখ পড়ে তার সে-দেয়ালেই ক্ষয় :
হঠাৎ জোরে কেঁপে উঠল, আলো দেখব মাগো—
এ কী বিপুল সহ্য সখী! জাগো কঠিন জাগো!
বেঁচে থাকব সুখে থাকব সে কি কঠিন ভারি
সকালও যার মুখ দেখে না বিকেল করে আড়ি?
*
অন্যরাত
মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে,
বলা হয় না কিছু–
আকাশ যেন নামতে থাকে নিচুর থেকে নিচু
মুখ ঢেকে দেয় মুখ ঢেকে দেয়, বলা হয় না কিছু।
মুখ ঢেকে দেয় আড়াল থেকে দেখি পক্ষ্মপুটে
জলে জমল বেদনা আর কেঁপে দাঁড়ায় উঠে
নানারঙের দিন–
সোনার সরু তারে বাজনা বাজে রে রিনরিন
বেদনা তার জাগায় মধু-হাওয়ায় ভরা দিন।
মস্ত বড়ো অন্ধকারে স্বপ্ন দিল ডুব–
বেঁচে থাকব সুখে থাকব সে কি কঠিন খুব?
মিলাল সংশয়–
শাদা ডানায় জল ভরে কে তুলল বরাভয়
কঠিন নয় কঠিন নয় বাঁচা কঠিন নয়।
*
পথ
পথের বিলাস যায় পথে পথে বিলাতে বিলাতে–
উদবৃত্ত থাকে না কিছু- এ বড়ো আশ্চর্য লাগে সখী।
যত ছন্দ বাজে, যত তৃপ্তি দেখো স্ফটিকে নীলাতে
তাতে খুঁজে দেখো, প্রশ্ন করে দেখো, ‘আছো কি আছো কি’–
থাকে না সে কিছুতেই, মেলে না যা কিছুতে মেলে না,
ঘরে যাকে পেতে চাও সে পালায় পথে পথে ঘুরে।
স্ফটিকে নীলায় যাকে পাও, প্রাণভরণের দেনা
তাতেও মেটে না তাই ছুটে চলি আরো আরো দূরে।
এ কেমন মন্দ নয় তবুও পথেই বাসা ভরা–
দৃষ্টিতে মেলেনি যাকে সৃষ্টি ভরে তাই অনুভব।
মন্দ নয় গিয়ে বসা জমায়েতে, নির্দয়-অক্ষরা
প্রকৃতির কথা শোনা, দূরাদয়শ্চক্রনিভ সব
গোল হয়ে ঘুরে যাওয়া মরীচিকাবৎ চোখে চোখে,
ফুল ছোঁড়া রং ছোঁড়া প্রাণহীন স্থবির ভিলাতে।
যে বিলাস অন্তহীন ধুলাগত পলাশে অশোকে
পথের সে প্রেম যাক পথে পথে বিলাতে বিলাতে।
*
আড়ালে
দুপুরে-রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে–
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে।
যখন যা চাই তখুনি তা চাই।
তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই
মিথ্যে, আমার সকল আশায়
নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়
দগ্ধ হাওয়ার কৃপণ আঙুলে–
তাহলে শুকনো জীবনের মূলে
বিশ্বাস নেই, সে জীবনে ছাই!
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে–
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে।
*
কলহপর
যত তুমি বকোঝকা মেরেকুটে করো কুচিকুচি–
আমি কিন্তু তবু বলব এসবেই আন্তরিক রুচি
ঘরে থাকতে অল্প মতি, রোদে রোদে পথে ঘুরে ফেরা,
আকাশে বিচিত্র মেঘ নানা ছন্দে তোলে যে অপেরা
তাতে লুপ্ত হতে হতে রুক্ষ চুলে বাড়ি ফিরে আসা
পোড়া-মুখে চিহ্ন তার অকুণ্ঠ বিস্মিত ভালোবাসা!
ক্ষিদেয় তৃষ্ণায় টলে কণ্ঠাবধি সমস্ত শরীর,
অভ্যাস মরে না জেনে দুই চোখে তুমি তোলো তীর
তা সত্ত্বেও বিনাস্নানে ভালো লাগে মধ্যাহ্নভোজন। স্বাস্থ্যকে তা ক্ষুণ্ণ করে, দিনে দিনে কমায় ওজন,
ভদ্রতা বিপন্ন হয়– নানাজনে করে কানাকানি,
এ সবই যে দুঃখপ্রদ, সন্দেহ কী, অবশ্য তা মানি।
কিন্তু তবু নিরুপায়। স্বভাবে যে পৃথিবীর মুঠি
তাকে আলগা করা তার সাধ্য নয়- প্রকাণ্ড ভ্রুকুটি
প্রকাণ্ড দুর্বৃত্ত দিন মুষড়ে পড়ে যে-আমার পায়ে
সে যে মরে ছুটে ছুটে মগ্ন হয়ে বিবিধ অন্যায়ে
তাকে কী ফেরাব আমি। অসম্ভব, অসম্ভব প্রিয়
আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয়!