দিদিমার গল্প
এ গল্প আমি শুনেছি আমার সহপাঠী ও বাল্যবন্ধু নীলাম্বর মজুমদারের কাছে। তিনি শুনেছিলেন তাঁর দিদিমার কাছে। নীলাম্বরের বয়স যখন দশ, তখন তাঁর দিদিমা বয়স সত্তর, আর এই সময়ই দিদিমা নীলাম্বরকে এই গল্পটি বলেন। গল্পের ঘটনা যে সত্য, তার প্রমাণ নীলাম্বরের দিদিমা ছিলেন নিরক্ষর, অতএব কোনো বই থেকে তিনি এ গল্প সংগ্রহ করেন নি। আর রামায়ণ-মহাভারত ছাড়া অন্য বিষয়ে ছেলেদের গল্প বলা সে কালে মেয়েদের অভ্যাস ছিল না। তবে যদি কোনো বিশেষ ঘটনা তাঁদের মনে গাঢ় ছাপ রেখে যেত—এমন যদি কিছু ঘটত যা তাঁরা কিছুতেই ভুলতে পারতেন না, তা হলে কখনো কখনো সে কথা ছেলেদের বলতেন। এরকম ঘটনা এ কালে বোধ হয় ঘটে না। কিন্তু আজ থেকে একশো বছর আগে বাঙালি-সমাজে ঘটা অসম্ভব ছিল না। কি ধর্মের, কি অধর্মের, সেকেলে জোর এ কালে নেই।
নীলাম্বরদের গ্রামে একটি প্রকাণ্ড ভিটে পড়ে ছিল, তার অধিকাংশই জঙ্গলে ভরা, আর একপাশে ছিল মস্ত একটি দিঘি। নীলাম্বর জানত যে তাদের মজুমদার-বংশেরই একটি উচ্ছন্ন পরিবারের বাস্তুভিটের এগুলি ধ্বংসাবশেষ। এককালে নাকি ধনেজনে তারাই ছিল গ্রামের ভিতর সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ। বাড়ির বুড়ো চাকরদের কাছে শিশুকাল হতে নীলাম্বর এই পরিবারের ঐশ্বর্য ও পূজাপার্বণ ক্রিয়াকর্মের জাঁকজমক ধুমধামের কথা শুনে এসেছে। কি কারণে তাদের এমন দুর্দশা ঘটল ও বংশলোপ হল, তা জানবার জন্য নীলাম্বরের মহা কৌতূহল ছিল।
সে একদিন তার দিদিমাকে এ বিষয় জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, “এ হচ্ছে ধর্মের শাস্তির ফল।”
নীলাম্বর বললে, “ব্যাপার কি হয়েছিল বলো।”
২
দিদিমা বললেন—
ঐ-যে পড়ো ভিটে দেখছ যা এমনি জঙ্গলে ভরে গেছে যে দিনের বেলায়ও বাঘের ভয়ে লোক সে দিক দিয়ে যায় না, আর যেখানে শুধু পাঁচ হাত লম্বা বন্দুক দিয়ে বুনোরা কখনো কখনো শুয়োর শিকার করে, ঐ ছিল তোমাদের পরিবারের সব চাইতে বড়ো জমিদার স্বরূপনারায়ণের বাড়ি। তিনি নবাব সরকারের চাকরি করে অগাধ পয়সা করেছিলেন। তা ছাড়া লোককে বিচার করা ও তাদের শাস্তি দেবার ক্ষমতাও, গৌড়ের বাদশার সনন্দের বলে, তাঁর ছিল বলে শুনেছি। যদিচ তাঁর রাজা খেতাব ছিল না, রাজার সমস্ত ক্ষমতাই তাঁর ছিল, এমন-কি, মানুষকে কোতল করবারও। ঐ- যে প্রকাণ্ড দিঘি দেখতে পাও যা আজ পানায় বুজে গেছে, ওটি শুনতে পাই তাঁর কয়েদীদের দিয়ে কাটানো। আমি অবশ্য তোমাদের বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে বড়ো তরফের সৈন্যসামন্ত কিছুই দেখি নি, কারণ তখন আর নবাবের আমল নেই— হয়েছে ইংরাজের আমল। জমিদারেরা সব হয়ে পড়েছে শুধু জমির মালিক, প্রজার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নয়। তবে আমি যখন এ বাড়িতে আসি, তখনো বড়ো তরফের খুব রব্রবা সময়, দাসদাসী পাইক- বরকন্দাজ গুরুপুরোহিত আত্মীয়স্বজন নিয়ে প্রায় শতাধিক লোক ও-বাড়ি সরগরম করে রেখেছিল। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় ওখানে পাশা খেলার আড্ডা বসত আর গ্রামের যত নিষ্কর্মা বাবুর দল বড়ো বাড়িতে গিয়ে জুটত, আর রাত দুটো-তিনটেয় আড্ডা ভাঙলে ওখানেই আহার করে বাড়ি ফিরত। তার পর হত বাড়ির মেয়েদের ছুটি। এরই নাম নাকি সেকেলে জমিদারি চাল।
৩
সে যাই হোক, আজও এদের ভিটে বজায় থাকত আর ও পরিবারের মোটা ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা থাকত, যেমন তোমাদের আছে, যদি-না ঐ বংশে একটি কুলাঙ্গার জন্মাত। ভৈরবনারায়ণ স্বরূপনারায়ণের প্রপৌত্র। প্রকাণ্ড শরীর, ছোট্ট মাথা, টিয়াপাখির মতো ঠোঁট-ঢাকা নাক, বসা চোখ— ভৈরবনারায়ণ ছিল মূর্তিমান পাপ। সে ছেলেবেলা থেকে কুস্তি লাঠিখেলা তলওয়ার- খেলা সড়কি-চালানো ছাড়া আর কিছুই করে নি । ফলে তার শরীরে ছিল শুধু বল, আর ছিল না দয়ামায়ার লেশমাত্র। পূজার সময় সে পাঁঠাবলি মোষবলি নিজহাতেই দিত, আর মোষবলির পর সে যখন রক্তে নেয়ে উঠত তখন তার কি আনন্দ, কি উল্লাস! গরিব লোকের উপরে তার অত্যাচারের আর সীমা ছিল না। কারণে-অকারণে সে লোককে মারপিট করত— যেন ভগবান তাকে হাত দিয়েছেন আর-পাঁচজনের মাথা ভাঙবার জন্য। গাঁ-সুদ্ধ লোক—গাঁ-সুদ্ধ কেন দেশ-সুদ্ধ লোক-তাকে ভয় করত, কারণ তার লোককে খুন করতেও বাধত না। তার সঙ্গী ছিল লাল খাঁ, কালো খাঁ, সরিৎউল্লা ফকির, আর ময়নাল। চার জনেই নামজাদা লেঠেল, আর চার জনই বেপরোয়া লোক। লাল খাঁ, কালো খাঁ ছিল জাতসিপাই—আর যার নুন খায় তার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। সরিৎউল্লা ফকির ছিল অদ্ভুত লোক। সে একবার সাত বৎসরের জন্য জেল খেটে বেরিয়ে হল ফকির। তার পরনে ছিল আলখাল্লা, আর গলায় ছিল নানা রঙের কাঁচের মালা। এদানিক কোথাও কাজিয়া বাধলেই সে ফকিরি সাজ ছেড়ে লেঠেলি বেশ ধরত। আর ফকির-সাহেব সড়কি ধরলেই খুন। ময়নাল ছিল নেহাৎ ছোকরা। বছর-আঠারো বয়েস, সরিৎউল্লার সাগরেদ, আর অদ্ভুত তীরন্দাজ। তার তীর যার রগে লাগত, তারই কর্মশেষ। আর তাঁর মন্ত্রী ছিল জয়কান্ত চক্রবর্তী, ওবাড়ির কুল-পুরোহিত। তিনি ভৈরবনারায়ণের সকল রকম দুষ্কর্মের প্রশ্রয় দিতেন চক্রবর্তী মহাশয়ের কথা ছিল যে, মজুমদারবংশে এতকাল পরে একটি দিপাল জন্মেছে— এই ছোকরাটি বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। এই লেঠেল ও পুরোহিত ছিল তার ইয়ার-বক্শি। এর যথেচ্ছাচারের ফলে যে সে জেলে যায় নি, তার কারণ তখন এ অঞ্চলে বিশ ক্রোশের ভিতরও একটি থানা ছিল না।
৪
তার উপর তিনি ছিলেন মহা দুশ্চরিত্র। ভৈরবনারায়ণের দৌরাত্ম্যে গেরস্ত ঝি- বৌদের ধর্ম রক্ষা করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল— অবশ্য তাদের দেহে যদি চোখ পড়বার মতো রূপ থাকত। আর কামার-কুমোর জেলে- কৈবর্তদের মেয়েদের গায়ে রঙ না থাক্, কখনো কখনো খাসা রূপ থাকে। তিনি কোথায় কার ঘরে সুন্দরী স্ত্রীলোক আছে দিবারাত্র তার সন্ধান নিজে করতেন আর অপরকে দিয়ে খোঁজ করাতেন, এবং ছলে-বলে-কৌশলে তাকে হস্তগত করতেন। এ বিষয়ে পণ্ডিতমহাশয়ই ছিলেন তাঁর একসঙ্গে দূত আর মন্ত্রী। বাপের একমাত্র সন্তান— ছেলেবেলা থেকে যা- খুশি তাই করেছেন, কেননা তাঁর যথেচ্ছাচারিতায় বাধা দেবার কেউ ছিল না; তার পর দেহে যখন যৌবন এসে জুটল, তখন ভৈরবনারায়ণ হয়ে উঠলেন একটি ঘোর পাষণ্ড। ছেলের চরিত্রের পরিচয় পেয়ে ভৈরবনারায়ণের মা অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, ছেলের কখন কি বিপদ ঘটে। কিন্তু পণ্ডিতমহাশয় তাঁকে বোঝালেন যে, বনেদি ঘরের ছেলেদের এ বয়সে ওরকম ভোগতৃষ্ণা হয়েই থাকে, পরে সে আবার ধীর শান্ত ও ঋষিতুল্য ধার্মিক হয়ে উঠবে; যৌবনের চাঞ্চল্য যৌবনের সঙ্গেই চলে যাবে। তিনি কিন্তু এ কথায় বড়ো বেশি ভরসা পেলেন না, তাই খুঁজে পেতে একটি বছর— চৌদ্দ বয়সের ফিট্ গৌরবর্ণ মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলেন। মহালক্ষ্মীর রূপের ভিতর ছিল রঙ। ছোটোখাটো মানুষটি, নাক চাপা, চোখ দুটি বড়ো বড়ো, কিন্তু রক্তমাংসের নয়—কাঁচের। তিনি ছিলেন গোঁসাইয়ের মেয়ে, জমিদারের নয়, নিতান্ত ভালোমানুষ— যেন কাঠের পুতুল। আর তাঁর ভিতরটা ছিল কাঠের মতোই অসাড়।
৫
এরকম স্ত্রীলোক দুর্দান্ত স্বামীকে পোষ মানাতে পারে না, বরং নিরীহ স্বামীকেই বিগড়ে দেয়। বিয়ের পর কিছুদিনের জন্য ভৈরবনারায়ণের পরস্ত্রীহরণ রোগের কিছু উপশম হয়েছিল। তাঁর মা মনে করলেন, ওষুধ খেটেছে। কিন্তু মার মৃত্যুর পর থেকেই ভৈরবনারায়ণ আবার নিজমূর্তি ধারণ করলেন। মহালক্ষ্মী তাঁর স্বামীর পরস্ত্রী-টানাটানির বিরুদ্ধে একদিনের জন্যও আপত্তি করেন নি, এমন-কি, মুহূর্তের জন্য অভিমানও করেন নি। তাঁর মহাগুণ ছিল তাঁর অসাধারণ ধৈর্য। তাঁর ঐ বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে কখনো রাগে আগুনও বেরোয় নি, দুঃখে জলও পড়ে নি। তিনি ছিলেন হয় দেবতা, নয় পাষাণ। তবে তাঁর শরীরে যে মানুষের রক্ত ছিল না, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মহালক্ষ্মীদিদি ছিলেন ঘোর ধার্মিক, দিবারাত্র পূজা-আর্চা নিয়েই থাকতেন। কত চরিত্রের কত নামের ঠাকুরদেবতাকে যে তিনি ধূপদীপনৈবেদ্য দিয়ে পুজো করতেন, তার আর লেখাজোখা নেই। তাঁর কারবারই ছিল দেবতাদের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে নয়। কে জানে দেবতা আছেন কি নেই, কিন্তু মানুষ যে আছে, সে বিষয়ে তো সন্দেহ নেই। শুধু দিদি জানতেন— দেবতা আছে, আর মানুষ নেই। ফলে তাঁর স্বামীও হয়ে উঠলেন তাঁর কাছে একটি জাগ্রত দেবতা। যে লোককে পৃথিবীসুদ্ধ লোক ঘৃণা করত, একমাত্র তিনি তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করতেন। অবশ্য ভৈরবনারায়ণকে তিনি ধূপদীপ দিয়ে পুজো করতেন না, কিন্তু তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করাই ছিল তাঁর স্ত্রীধর্ম। স্বামীর সকল দুষ্কর্মের তিনি নীরবে প্রশ্রয় দিতেন, অর্থাৎ তিনিও হয়ে উঠলেন সরিৎউল্লা ফকির ও পণ্ডিতমহাশয়ের দলের একজন। অবশ্য তিনি কখনো কোনো বিষয়ে মতামত দেন নি, তার কারণ কেউ কখনো তাঁর মত চায় নি। তার পর যে ঘটনা ঘটল, তাতেই হল ও পরিবারের সর্বনাশ সে ব্যাপার এতই অদ্ভুত, এতই ভয়ংকর যে, আজও মনে করতে গায়ে কাঁটা দেয়।
৬
ভৈরবনারায়ণ একদিন বাড়ির ভিতরে এসে দেখেন যে, পুজোর ঘরে একটি পরমাসুন্দরী মেয়ে বসে টাটে ফুল সাজাচ্ছে। তার বয়েস আন্দাজ ষোলো কি সতেরো। তার রূপের কথা আর কি বলব, যেন সাক্ষাৎ দুর্গাপ্রতিমা। মেয়েটিকে দেখে ভৈরবনারায়ণ দিদিকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কে? দিদি উত্তর করলেন, “অতসীকে চেন না? ও যে সম্পর্কে তোমারই ভগ্নী, সর্বানন্দ মজুমদারের ছোটো বোন; যার জন্য দেশবিদেশে বর খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু মনোমত কুলীন বর পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বানন্দ বলে, অমন রত্ন যার-তার হাতে সঁপে দেওয়া যায় না। আমি ওকে ডেকে পাঠিয়েছি টাটে ফুল সাজাবার জন্য। ও রকম সুন্দর শিব গড়ে, তেমনি সুন্দর টাট সাজায়।” এ কথা শুনে ভৈরবনারায়ণ বললেন, “তা হলে কাল ওকে আমার জন্য শিব গড়তে আর ফুল সাজাতে বোলো।” দিদি বললেন, “আচ্ছা।”
অতসী পরদিন সকালে এসে অতি যত্ন করে, অতি সুন্দর করে ভৈরবনারায়ণের পুজোর সব আয়োজন করলে। তার পর সেই মূর্তিমান পাপ এসে পুজোর ঘরে ঢুকে, ভিতর থেকে দুয়ার বন্ধ করে দিলে। মহালক্ষ্মীদিদি বাইরে পাহারা রইলেন। ভৈরবনারায়ণ যখন ঘণ্টাখানেক পরে পুজো শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, তখন দিদি ঘরে ঢুকে দেখেন যে অতসী বাসী ফুলের মতো একদম শুকিয়ে গিয়েছে, আর শিব মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, আর ঘরময় টাটের ফুল-নৈবেদ্য সব ছড়ানো রয়েছে। দিদিকে দেখে অতসী অতি ক্ষীণস্বরে “আমাকে ছুঁয়ো না” এই কথা বলে, ধীরে ধীরে বড়ো বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল। আর সেখানে গিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। সে বিছানা থেকে সে আর ওঠে নি। এক ফোঁটা জলও মুখে দেয় নি। তিন দিন পরে অতসী মারা গেল। আর গ্রামের যেন আলো নিভে গেল। কারণ রূপে-গুণে হাসিতে-খেলাতে অতসী এ গ্রাম আলো করে রেখেছিল। সমস্ত মজুমদার-পরিবারের মাথায় বজ্রাঘাত হল, আর সকলের মনেই প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল। শুধু মহালক্ষ্মীদিদির পূজা-আর্চা সমানে চলতে লাগল। স্বর্গের লোভ বড়ো ভয়ংকর লোভ। এই লোভেই তিনি ভীষণ পতিব্রতা স্ত্রী হয়েছিলেন। সকলেই চুপচাপ রইলেন, সর্বানন্দ কি করে দেখবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঝড় আসবার পূর্বে আকাশ-বাতাসের যেমন থমথমে ভাব হয়, এ গ্রামের ভাব সেইরকম হল।
৭
সর্বানন্দ ছিলেন ভৈরবনারায়ণের ঠিক উল্টো প্রকৃতির লোক। তিনি ছিলেন অতি সুপুরুষ— সাক্ষাৎ কার্তিক; তার উপরে ঘোর শৌখিন। গেরোবাজ লোটন লক্কা সিরাজু মুখি ইত্যাদি হরেকরকম পায়রার তদবির করতেই তাঁর দিন কেটে যেত। তিনি শ্যামা পাখিকে ছোটো এলাচের দানা ঘিয়ে ভেজে নিজ হাতে খাওয়াতেন। এলাচ খেলে নাকি শ্যামার গানের লজ্জত বাড়ে। তার উপরে তিনি দিবারাত্র গানবাজনা নিয়েই থাকতেন। আর নিজে চমৎকার সেতার বাজাতেন। এর ফলে তিনি চারপাশের ছোটোবড়ো সব জমিদারদের মহা প্রিয়পাত্র হয়ে পড়েছিলেন। তিনি না থাকলে কারো নাচগানের মজলিস জমত না। বাই খেমটা-মহলে তাঁর পসার নাকি একচেটে ছিল। সর্বানন্দের কিন্তু এ দুর্ঘটনায় বাইরের কোনো বদল দেখা গেল না। সেই হাসিমুখ, সেই মিষ্টি কথা, সেই ভালোমানুষী হালচাল। শুধু তিনি গানবাজনা ছেড়ে দিলেন। আর তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বড়োনগরের বড়ো জমিদার কৃপানাথ রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে, থাকে প্রাণ যায় প্রাণ কবুল করে দুই বন্ধুতে ভৈরবনারায়ণের ভিটেমাটি উচ্ছন্নে দেবার জন্য কৃতসংকল্প হলেন। যে রাগ সর্বানন্দের বুকে এতদিন ধোঁয়াচ্ছিল, তার থেকে আগুন জ্বলে উঠল। আর সেই আগুনে ভৈরবনারায়ণের সর্বস্ব জ্বলেপুড়ে খাক্ হয়ে গেল।
৮
ক্রমে ভৈরবনারায়ণ ও সর্বানন্দের লেঠেলরা কাজিয়া শুরু করলে। ফলে এ গ্রাম হয়ে উঠল ভদ্রলোকদের নয়, লেঠেলের গ্রাম। গ্রামের সকলেই ছিলেন ভৈরবনারায়ণের বিপক্ষে, সুতরাং তাঁরা নানারকমে সর্বানন্দের সাহায্য করতে লাগলেন। এমন-কি, আমাদের মেয়েদেরও কাজ হল সর্বানন্দের জমী লেঠেলদের শুশ্রূষা করা। আমি নিজের হাতেই কত-না লেঠেলের সড়কির ঘায়ে ঘিয়ের সলতে পুরেছি। এই তো গেল আমাদের অবস্থা। আর প্রজাদের দুঃখের কথা কি বলব। যত টাকার টান হতে লাগল, তাদের উপর অত্যাচার তত বাড়তে লাগল। ভৈরবনারায়ণের প্রজারা জুলুম আর সহ্য করতে না পেরে সব বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তখন তিনি জমিদারি বন্ধক দিয়ে কেঁয়েদের কাছে ঋণ করতে শুরু করলেন। আর নিজে কাপ্তেন সেজে লেঠেলদের দলপতি হয়ে লড়াই চালাতে লাগলেন।
তার পর একদিন রাত্তিরে সর্বানন্দ ও কৃপানাথের লেঠেলরা ভৈরবনারায়ণের বাড়ি আক্রমণ করলে। তখন বর্ষাকাল; সমস্ত দিন ছিপছিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। ভৈরবনারায়ণ এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর দলবল সব গিয়েছিল সর্বানন্দের মফস্বল- কাছারি লুঠতে। তিনি বেগতিক দেখে ঘোড়ায় চড়ে খিড়কির দুয়োর দিয়ে পালিয়ে গেলেন। সর্বানন্দের লেঠেলরা বড়োবাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে, বাড়িতে ধনরত্ন যা ছিল সব লুঠে নিল।
বাড়ির একজন লোক পুজোর আঙিনা দিয়ে পালাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল। সর্বানন্দের হুকুমে তাকে ধরে হাড়কাঠে ফেলে বলি দেওয়া হল। লোকে বলে, এ বলি সর্বানন্দ নিজহাতেই দিয়েছিলেন, লোকটাকে ভৈরবনারায়ণ বলে ভুল করে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি; কারণ সর্বানন্দ শৌখিন হলেও, তার বুকে ছিল পুরুষের তাজা রক্ত।
যে ব্যাপার শুরু হয়েছিল স্ত্রীহত্যায় তার শেষ হল ব্রহ্মহত্যায়। এর পর ও বংশ যে উচ্ছন্নে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কি। স্বামীর অধর্ম ও স্ত্রীর ধর্ম— এ দুয়ের এই শাস্তি।
৯
দিদিমার এ গল্প শুনেও নীলাম্বরের কৌতূহলের নিবৃত্তি ছিল না। সে জিজ্ঞাসা করলে, “এর পর ভৈরবনারায়ণ কি করলেন?” দিদিমা বললেন, “এর পর ভৈরবনারায়ণ আর দেশে ফেরেন নি। লোকমুখে শুনেছি, তিনি কিছুদিন পরে এক ডাকাতের দলে ধরা পড়ে চিরজীবনের জন্য দায়মাল হয়েছেন—লাল খাঁ, কালো খাঁ, সরিৎউল্লা ফকির ও ময়নাল ছোকরা সমেত। দেশ যখন শান্ত হল, তখন আবার সর্বানন্দ মনের সুখে সেতার বাজাতে লাগলেন; যদিচ এই-সব দাঙ্গাহাঙ্গামার ফলে তাঁর অবস্থা অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়েছিল, আর তাঁর রূপলাবণ্য সব ঝরে পড়েছিল— যেন শরীরে কি বিষ ঢুকেছে
“ভৈরবনারায়ণও গেলেন, বড়োবাড়ির সুখের পায়রাও সব উড়ে গেল। ঐ পড়ো বাড়িতে পড়ে রইলেন শুধু মহালক্ষ্মীদিদি আর একটি পুরানো দাসী। আর দিদি ঐ রাবণের পুরীতে একা বসে একমনে দিবারাত্র তুলসীকাঠের মালা জপ করতে শুরু করলেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, সর্বানন্দের মনের আগুন একেবারে নেবে নি ।
“তবে সর্বানন্দ ব্রহ্মহত্যা করে যে আবার স্ত্রীহত্যা করে নি, সে শুধু তোমার ঠাকুরদাদার খাতিরে। মহালক্ষ্মীকে সকল বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। তোমার ঠাকুরদাদার ধারণা ছিল যে, মহালক্ষ্মী পাগল—একেবারে বদ্ধ পাগল। দিদি যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন তিনি হাতের শাঁখাও ভাঙেন নি, পাছে তাঁর স্বামীর অমঙ্গল হয়। ভৈরবনারায়ণ যে কবে কোথায় মারা গেলেন, সে খবর আমাদের কেউ দেয় নি। তার পর মহালক্ষ্মীদিদি মারা যাবার পর যে ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়, তাতেই এই পাঁচমহল বাড়ি একেবারে ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। আর সেখানে রয়েছে জঙ্গল, আর বাস করছে বাঘ ও শুয়োর। এরাই এখন ভৈরবনারায়ণের বংশরক্ষা করছে।
“ভালো কথা, আশা করি মহালক্ষ্মীদিদি মরে স্বর্গে যায় নি, কেননা সেখানে গেলে যে অতসীর সঙ্গে দেখা হবে।”
আষাঢ় ১৩৩৯