দিদিমার খেলাঘর – শ্যামল দত্তচৌধুরী

দিদিমার খেলাঘর – শ্যামল দত্তচৌধুরী

অনেক-অনেক বছর আগে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে ছাদের চিলেকোঠায় লাবণ্য এক আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করেছিল।

দিদির বন্ধুদের সঙ্গে লাবু খেলায় মেতে উঠেছিল। ওরা লাবুকে এলেবেলে ভাবে। মোটেই পাত্তা দেয় না। অথচ লাবুকে বাদ দিলে ও বাড়ি মাথায় করে কান্না জুড়ে দেবে। কাজের সময় রেগে গিয়ে মা নির্ঘাত বকুনি দেবেন দিদিকে। তাই ওকে খেলায় বাদ দেওয়া যায় না।

ছাদে তখন মনুপিসি রোদে পিঠ দিয়ে চুল ছড়িয়ে ডালের বড়ি আর আচার পাহারা দিচ্ছিল। পাখি তাড়াবার জন্য হাতে বেতের লাঠি। লাবু হন্তদন্ত হয়ে ‘কাউকে বলবে না’, বলে লুকোতে গেল ছাদের ঘরে। সংসারের যত অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঘরটা ঠাসা। বাক্সপ্যাঁটরা, টিনের ট্রাঙ্ক, অকেজো ঢাউস রেডিয়োগ্রাম, পায়াভাঙা চেয়ার, কাঁসার থালা, বালতি, ৭৮ আর ৩৩ আর পি এম রেকর্ডের স্তুূপ, ভাঙা ঝুড়ি, ছেঁড়া ইজিচেয়ার কী নেই! লাবু গুটিসুটি মেরে একটা বেঁাচকার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ধুলোবালি, মাকড়সার জালে ভরা ঘরটা। ভয়ও করছে লাবুর। কখন বিছেটিছে বেরোয় ঠিক কী?

করোগেটেড টিনের ছাদ। ভীষণ গরমে গলগল করে ঘামছিল ও। হঠাৎ খুট করে শব্দ ও ঝুপঝুপ কয়েকটা গাঁটরি আর বেতের চুবড়ি গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। দারুণ চমকে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে লাবুর মনে হয়, বোধ হয় ইঁদুর-টিদুর হবে। কিন্তু ওটা কী?

একটা রঙিন পুতুলের বাড়ি। কী সুন্দর দেখতে। একদম আসল বাড়ির মতো। এই পরিবারের কোনও মেয়ে হয়তো একদিন খেলা করত। সেবড়ো হয়ে উঠতে ওই খেলাঘর ঠাঁই পেয়েছিল ঘরসংসারের অন্যান্য বাতিল জিনিসের সঙ্গে।

ছোটো-ছোটো চৌকো জানলা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, সব একেবারে নিঁখুত। টালির মতো ছাদ। ছাদটা দু-হাতে তুললে খেলাঘরের ভিতরটা পরিষ্কার দেখা যায়।

জলপাইগুড়ি টাউনে ছিল বারীনদাদুর কাঠের ফার্নিচারের দোকান। গ্রাম সম্পর্কে বারীনদাদু ছিলেন ওদের কীরকম এক জ্ঞাতি। বাড়ির বড়োরা ডাকেন ‘বারীনদাদু’। দেখাদেখি ছোটোরাও তাই ডাকে। রবিবার দিনটা তিনি এই বাড়িতে কাটান। ধোপদুরস্ত ধুতি আর হাতা-গুটোনো সাদা ফুলশার্ট পরেন। খুব ফিটফাট। সকলের সমস্ত ফাইফরমাশ রবিবারের জন্য তোলা থাকে। ফিউজ লাইট বদলানো, পেরেক মেরে কাপড় শুকনোর দড়ি অথবা দেয়ালে ফোটো টাঙানো, খাট তুলে পায়ার নীচে আস্ত থানইট গুঁজে দেওয়া, লেপ-কম্বল রোদে দেওয়া, যাবতীয় কাজ বারীনদাদুর জন্য অপেক্ষা করে থাকত। লাবুর পুতুলের বাড়ি সারিয়ে, রং চড়িয়ে একদম নতুন করে দিয়েছেন বারীনদাদু। লাল টুকটুকে টালির ছাদ, দরজা-জানলা গাঢ় সবুজ। বাড়ির বাইরের দেয়ালটা চৌকো হলদে আর কালো রঙের দাবার ছকের মতো। একতলার হলঘরে কার্পেট, ঝাড়লন্ঠন, সোফাসেট। ডাইনিং টেবিলে কাপ, ডিশ, চায়ের সরঞ্জাম। রান্নাঘরে তোলাউনুন। কড়াই, খুন্তি, হাতা, বঁটি সব আছে। হলঘরের মাঝখানে চওড়া সিঁড়ি দোতলায় উঠে গিয়েছে। শোবার ঘরে সুদৃশ্য পালঙ্ক, বিছানা, বালিশ, আলমারি, আয়না লাগানো ড্রেসিংটেবিল। কোনও ঘরের দেয়াল আকাশি নীল, কোনওটা হালকা মেরুন, কোনওটা হলদে। এমন রংচঙে সুন্দর পুতুলের বাড়ি কেউ কখনও দেখেনি।

শুধু কি তাই? ব্যাটারি থেকে তার টেনে বারীনদাদু ঘরে-ঘরে টুনি বাল্ব লাগিয়ে দিয়েছেন। ঝাড়লন্ঠনও জ্বলে। অনেক সময় লাবু রাত্রিবেলা ঘরের আলো নিভিয়ে ওর পুতুলের বাড়ির সব আলো জ্বালিয়ে দেয়। অন্ধকারে ঝলমল করতে থাকে লাবুর খেলাঘর।

বারীনদাদু ভালো হাতের কাজ জানেন। লাবুর জন্য তিনি নিত্যনতুন নানারকম পুতুল তৈরি করে আনেন। শোলার, কাপড়ের, কাঠের, তুলোর কিংবা খড়ের। একবার নিয়ে এলেন রোগা শরীরের এক ‘দ্বাররক্ষী-পুতুল’। পরনে লাল চোগা চাপকান, মুখে গালপাট্টা, মাথায় পাগড়ি। হাতে তার বর্শা। তার নাম ছুছুন্দর সিং। সেপুতুলের বাড়ির সদর দরজায় পাহারায় রইল।

পরেরবার বারীনদাদু নিয়ে এলেন ‘বাবুমশাই’ আর ‘গিন্নিমা পুতুল’। বাবুমশাই পরেন কোঁচানো ধুতি আর ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি। মাথায় কোঁকড়া চুল, ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফ। গিন্নিমা-র লালপেড়ে গরদের শাড়িতে চকচকে সুখী চেহারা। হাতে পানের বাটা, কপালে ইয়া বড়ো এক সিঁদুরের টিপ। তারপর এল ‘আনারকলি নর্তকী’। এল ‘মিঞা তানসেন’, সঙ্গে তবলচি আর সারেঙ্গীবাদক। এল রাঁধুনি ‘পটলার মা’।

অবশ্যই পুতুলগুলো খেলাঘরে ঢোকানো যায় না। সাইজে বড়ো। কিন্তু তাতে লাবুর কী আসে-যায়? ও দিব্যি ঘরসংসার পেতে বসে ছিল। ছুছুন্দর সিং তার হুকুম খেটে-খেটে হয়রান। পটলার মা ঘাস-পাতা সম্বল করে রোজ-রোজ উপাদেয় রান্না করে। লাল ছাদটা তুলে লাবু দোতলার বেডরুমে গিন্নিমাকে বসিয়ে দেয়। তিনি প্রাণভরে সাজগোজ করেন। সন্ধেবেলায় বাবুমশাই গড়গড়া হাতে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসেন। ঝাড়লন্ঠনের নীচে দুটো বিনুনি দুলিয়ে আনারকলি ভরতনাট্যম নাচে। মিঞা তানসেন নাচের বোল আওড়ায়।

পুতুলের বাড়ি হয়ে উঠেছিল লাবুর দিনরাত্রির স্বপ্ন।

তারপর পঞ্চাশ বছর কেটে গিয়েছে। লাবণ্য এখন কারও ঠাম্মা, কারও দিম্মা। কোমরে, হাঁটুতে বাতের ব্যথা। একলা থাকেন মেখলিগঞ্জের বাড়িতে। তাঁর সাধের খেলাঘর কবে ভেঙেচুরে গিয়েছে, মনেও নেই।

সেবার মেয়ে এসেছিল নাতনি টুলুকে নিয়ে। কদিনেই টুলু খুব নেওটা হয়ে পড়েছিল দিম্মার। অধুনা নাকি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, দিদিমার অধিকাংশ জিন তার মেয়ের মেয়েতে বর্তায়, তাই দিদিমার স্নেহের টান মেয়ের ঘরে নাতনির উপর বেশি। সত্যিমিথ্যে যাই হোক, ইতিমধ্যে টুলুর গভীর মায়ায় পড়ে গিয়েছেন লাবণ্য।

সুতরাং মেয়ে বিতস্তা যখন মাকে নিয়ে কেরল রওনা দিল, তখন মুখে বিরাগ দেখালেও মনে-মনে লাবণ্য শিহরন অনুভব করেছিলেন। জামাই সুরঞ্জন পাওয়ারপ্ল্যান্টে প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। কট্টায়াম জেলায় পোস্টেড। বিতস্তা এক বেসরকারি স্কুলে ইংরেজি পড়ায়।

টুলুর সঙ্গে সারাদিন দিব্যি আনন্দে কাটে লাবণ্যর। শরীরের ব্যথাবেদনা অনেকটাই গায়েব। ওদেশের ভাষা বোঝেন না, কিন্তু টুলু বেশ কড়মড় করে মলয়ালি বলতে পারে।

কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। সাতদিনের মধ্যে রান্নার লোক উধাও। সব কাজ ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিল বিতস্তা। দু-দিনেই হিমশিম অবস্থা। লাবণ্য তারপর রান্নাঘরের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

বেলা বারোটা পর্যন্ত টুলুর ক্লাস। স্কুলবাড়িটা ছোটো একটা টিলার ওপর। জায়গাটার নাম লাবণ্য অনেক চেষ্টা করেও রপ্ত করতে পারেননি— কাভুনগুমপেরিয়ার। লাবণ্য যান ওকে ছুটির পরে নিয়ে আসতে। একদিন ফেরার পথে বললেন, ‘আমাদের ওখানে কী সুন্দর নদী ছিল। তোমাদের দেশে নেই?’

টুলু ভারিক্কি চালে বলল, ‘এখানে তো শুধু নদী আর নদী। লঞ্চে চেপে আল্লেপ্পি গেলেই হয়!’

‘কাল তোমার উইকলি হলিডে, যাবে কাল? কাউকে বলতে পারবে না কিন্তু!’

টুলুর দারুণ উৎসাহ। সেদিম্মার গাইড, তার ওপর বাবা-মাকে না জানিয়ে যাওয়া। ভাবটা যেন সব পথ তার দখদর্পণে। পরদিন বিতস্তা ও সুরঞ্জন বেরিয়ে গেলে লাবণ্য আর টুলুও চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। নদীপথে আল্লেপ্পি যাবে আর দুপুরে বাসায় ফিরে খাবে। তখন কী আর জানে কপালে কী আছে?

চেঙ্গানাচেরি মার্কেট বাসে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বেশ বড়োসড়ো এক বঁাধানো ঘাট থেকে ওরা আল্লেপির লঞ্চে উঠে পড়ল। একটা খাল ধরে লঞ্চ গিয়ে পড়ল দিগন্তজোড়া এক বিশাল জলাশয়ে। লাবণ্য ভেবেছিলেন বুঝি সমুদ্র, নাম শুনে বুঝলেন তা নয়, ভেম্বেনাদ লেক। নামেই লেক, কিন্তু এপার-ওপার দেখা যায় না। লঞ্চ একবার এপার থেকে যাত্রী তোলে, আবার লেক অতিক্রম করে ওপার থেকে। কিছু লোক নামে, কিছু ওঠে।

ঘণ্টা দুয়েক চলার পর উৎকন্ঠিত লাবণ্য বললেন, ‘এ কোথায় যাচ্ছি রে টুলু?’

মনে-মনে টুলু ভয় পেয়েছে, তার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। লঞ্চে চেপে ও কখনও আল্লেপ্পি যায়নি। বাবা কাকে যেন একদিন ফোনে বলছিলেন, টুলু শুনতে পেয়েছিল। লাবণ্য বললেন, ‘তুমি কখনও আল্লেপ্পি গিয়েছ?’ নি:শব্দে মাথা নাড়ল টুলু।

তারপর আরও ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেল। দিদিমা আর নাতনি দু-জনেই ভয়ে জড়সড়। এ ওঁকে জড়িয়ে কাছ ঘেঁষে বসে আছেন। লঞ্চ নিজস্ব গতিতে পারাপার করছে। ভেম্বেনাদ লেকের সঙ্গে সমুদ্রের সংযোগ আছে। তবে কি ওঁরা সমুদ্রে পৌঁছে গেলেন?

খিদের চোটে টুলুর পেট চুঁইচুঁই করছে। লাবণ্য প্রকাশ করছেন না, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে তিনিও ভয়ে কাতর হয়ে পড়েছেন। অজানা, অচেনা দেশে হারিয়ে গেলে কী হবে? আতঙ্কে টুলুর লোকাল ভাষাজ্ঞান লোপ পেয়েছে। এমন জাপটে ধরেছে দিদিমাকে, যেন তাঁর শরীরে ঢুকে পড়বে। এদিকে লঞ্চ চলছে তো চলছেই!

ওঁরা যখন আল্লেপ্পি পৌঁছল তখন বেলা তিনটে বেজে গিয়েছে। একটা দোকান থেকে বিস্কুটের প্যাকেট কেনা হল। তারপর ডাব। জলপথে ফেরার চিন্তাই করা যায় না। হয়তো পুরো রাতটাই কাবার করে দেবে। বাস? চেঙ্গানাচেরি মার্কেট বাস? লোককে জিজ্ঞেস করতে-করতে লাবণ্য টার্মিনাসে পৌঁছে নাতনিকে নিয়ে বাসে চেপে বসলেন। সেও এক অনন্তযাত্রা। বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে গিয়েছিল। সুরঞ্জন ও বিতস্তা উদবেগে আর আশঙ্কায় ঘরবার করছিল। টুলু খুব একচোট বকুনি খেল, যদিও লাবণ্য সব দোষ নিজের ঘাড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বিতস্তা শুধু একবার ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘মা, তুমি যেন কী! টুলুর না হয় কান্ডজ্ঞান হয়নি, কিন্তু তুমি? তোমার কি এই বয়সে ভীমরতি হল নাকি?’

কোনও কথাই অবশ্য তখন লাবণ্যর কানে ঢুকছিল না। তিনি মনে-মনে এক স্বপ্নের জগতে ভাসছিলেন। কারণ, বাস থেকে এক আশ্চর্য দৃশ্য তিনি দেখে ফেলেছিলেন।

টুলুর যেখানে স্কুল, তার মিনিট পনেরো আগে বাসটা উঁচু-নীচু পথ ধরে চলছিল। টিলার মতো জায়গাটার পাদদেশে রাস্তার এক পাশে প্রচুর গাছগাছালি। সুপুরি, কাঁঠাল, বেঁটে-বেঁটে নারকেল গাছের ঘন জঙ্গল। গোলমরিচের লতানে গাছ পেঁচিয়ে ধরেছে গাছগুলোকে। হঠাৎ…!

লাবণ্য দেখতে পেলেন গাছের ফাঁকে একটা বাড়ি। ঘরে-ঘরে আলো জ্বলছে। অন্ধকারের সমুদ্রে যেন এক জাহাজ। দোতলা বাড়িটার লাল টুকটুকে টালির ছাদ। টাটকা সবুজ রঙের দরজা-জানলা। বাড়ির দেয়ালে চৌকো হলদে-কালো ঝলমলে রং। হুবহু লাবণ্যর সেই ছেলেবেলার পুতুলের বাড়ি। তফাত শুধু এই, এটা খেলাঘর নয়। দিব্যি প্রমাণ সাইজের বাড়ি।

বাসের জানলার রড আঁকড়ে ধরে লাবণ্য বিস্ফারিত চোখে দেখছিলেন। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। জায়গাটা পার হয়ে গেল। লাবণ্যর দেহ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল। গায়ের প্রতিটি রোমকূপে রোমাঞ্চ। কপালের ঘাম মুছলেন লাবণ্য। চোখ বন্ধ করে বাসের সিটে শরীর ছেড়ে দিলেন। টুলু তাঁর কোলে ঘুমিয়ে কাদা।

সেই রাতে লাবণ্যর চোখে ঘুম নেই। বুকের ধুকপুকুনি কেটে গেলেও গায়ের কাঁপুনি তখনও টের পাচ্ছেন। ছেলেবেলার সেই সাধের খেলাঘর আচমকা বড়ো বাড়ি হয়ে যাওয়ায় লাবণ্যর বিস্ময় আর উত্তেজনার অন্ত নেই। ভীষণ মনে পড়ছে দিদির কথা। দিদি আর নেই। ওই পুতুলের বাড়িকে কেন্দ্র করে একসময় দু-জনের খিটিমিটি লেগেই থাকত। বারীনদাদু লাবুর জন্য কত রকমের পুতুল বানিয়ে আনতেন। নিজেই নামকরণ করতেন। আনারকলিকে লাবুর কোলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওস্তাদজি গান ধরলে আনারকলি ঘুঙুর বাজিয়ে বেণী দুলিয়ে নাচবে।’ বারীনদাদুর শেষপর্যন্ত কী হয়েছিল লাবণ্য জানে না। লাবুর কল্পনায় সত্যিই তার পুতুলেরা নেচে-গেয়ে খেলা করে বেড়াত।

লাবুর ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঝাঁপিয়ে লাবণ্যর মনের তটে এসে আছড়ে পড়তে লাগল। বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন লাবণ্য। পাশেই টুলু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

আজকাল লাবণ্য উদাসীন হয়ে পড়েছেন। সকাল থেকে সংসারের কাজ কলের পুতুলের মতো করে যান। কিন্তু কাজে মন নেই। কথাবার্তা বলেন না বিশেষ। তাঁর মন পড়ে থাকে জঙ্গলে, হঠাৎ দেখতে পাওয়া প্রমাণ সাইজের খেলাঘরের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড মাত্র, কিন্তু তাঁর চিনতে ভুল হয়নি। লাবণ্যর তীব্র ইচ্ছে, বাড়িটার অন্দরমহল দেখবেন। একদিন যেতেই হবে সরেজমিন তদন্তে। কিন্তু ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বিনিময় করবেন? হঠাৎ কি কোনও অচেনা বাড়িতে ঢুকে পড়া যায়? ওরা যদি লাবণ্যকে পাগল ভাবে?

দারুণ অশান্তিতে দিন কাটে। দিনেরবেলা অনেক কাজ। টুলু স্কুল থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে একলা বাড়িতে রেখে যাওয়া যায় না। তা ছাড়া সকাল থেকে ঘরের কাজ সারতে-সারতে লাবণ্য নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বয়স হয়েছে, দুপুরে বিশ্রাম না নিলে শরীরটা বইতে চায় না। কিন্তু সারাক্ষণ তাঁর মন পড়ে থাকে সেই আশ্চর্য বাড়ির দিকে।

এক শনিবার পুরোদমে পার্টি চলছে। এই সব দিনে বিতস্তা নিজের হাতে কিচেনের ভার নিয়ে নেয়। আগেভাগে খাওয়া সেরে সেই রাতে লাবণ্য আর টুলু নিজেদের ঘরে চলে গিয়েছেন। হোমটাস্ক নিয়ে বসলেই টুলুর চোখে কুম্ভকর্ণ ভর করে বসে।

এই সুযোগ। চুপিসাড়ে পিছনের দরজার ল্যাচ টেনে লাবণ্য বেরিয়ে পড়লেন। পার্টি ভেঙে যাওয়ার আগে তিনি বাড়িতে ফের ঢুকে পড়তে পারবেন। কেউ জানতে পারবে না তাঁর অ্যাডভেঞ্চারের কথা।

লাবণ্য বুক ভরে টানলেন রাতের তাজা বাতাস। দারুণ ফুরফুরে লাগছে। যেন দেহের কোনও ভার নেই। হাঁটুর ব্যথা উধাও। এত রাতে রাস্তাঘাট ফাঁকা। ওঁদের বাড়ির সামনেই শুধু কয়েকটা গাড়ি। বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হাঁটা ছাড়া গতি নেই। বাচ্চা মেয়ের মতো প্রবল উৎসাহে লাবণ্য হালকা পায়ে হাঁটছেন।

ছেলেবেলা থেকে বৃদ্ধ বয়সের দিকে যে অদৃশ্য হাইওয়েটা গিয়েছে, হঠাৎ যেন তার সন্ধান পেয়ে গিয়েছেন লাবণ্য। রাস্তা উঠছে, আবার নামছে। ক্রমশ তিনি টুলুর স্কুলের সামনে পৌঁছে গেলেন। অন্ধকারে ডুবে আছে বাড়িটা। তার পাশ দিয়ে রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদ টিমটিম করছে আকাশে। কোনও রাতচরা পাখি ট্যা ট্যা ডাকতে-ডাকতে কাউকে যেন জরুরি খবর দিতে উড়ে গেল। দ্রুতপায়ে লাবণ্য টিলা থেকে নামতে লাগলেন ঝোপঝার, গাছে ঘেরা জঙ্গলটার দিকে।

কাঁঠাল গাছের গোড়ার দিকে অতিকায় সাইজের কাঁঠাল। স্থানীয় লোকেরা মাটিতে বড়ো-বড়ো গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। তার মধ্যে কাঁঠাল বাড়ছে। কাজুবাদামের গাছ, সুপুরি আর নারকেল গাছের ভিড়। লতাপাতা সরিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই লাবণ্যর চোখের সামনে ঝলসে উঠল খেলাঘর।

ঘরে-ঘরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। হলদে-কালো দাবার ছকের মতো চৌকো খোপ-কাটা ঝলমলে দেয়াল। জানলা-দরজার কাঠের পাল্লাগুলো কটকটে সবুজ। টালির ছাদ এমনই লাল, যেন এখনই টুপটুপ রক্ত ঝরে পড়বে। লাবণ্য অবাক হয়ে দেখছেন। ভিতরে কেউ উচ্চাঙ্গ সংগীতের আলাপ ধরল। অসাধারণ মধুর সেস্বর। জঙ্গল সম্পূর্ণ নিস্তবধ হয়ে গেল। হাওয়ায় ডালপালা নড়ে ওঠার শব্দ পর্যন্ত নেই।

লাবণ্য এগিয়ে গেলেন ধীরে-ধীরে। আচমকা বাড়ির সদর দরজা খুলে গেল। দরজার ফ্রেমে একজন রোগা চেহারার লোক। তার পরনে লাল চোগা চাপকান। মুখে গালপাট্টা, মাথায় বিশাল পাগড়ি। তার হাতে বর্শা। আরে, এ যে ছুছুন্দর সিং! দ্বাররক্ষী কুর্নিশ করে বলল, ‘আসুন মালকিন, সকলে আপনার ইন্তেজার করছেন।’

লাবণ্য যন্ত্রচালিতের মতো হলঘরে প্রবেশ করলেন। মাথার ওপর ঝাড়লন্ঠন জ্বলছে। একদিকে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে কার্পেটে বসে আছেন বাবুমশাই। কোঁচানো ধুতি, পাঞ্জাবি, হাতে গড়গড়া। একধারে বসেছেন মিঞা তানসেন, তবলাবাদক আর বুড়ো সারেঙ্গিওয়ালা। মাঝপথে গান থামিয়ে তানসেন অভিবাদন জানালেন লাবণ্যকে।

আনারকলি পায়ে ঘুঙুর বঁাধছিল। বিনুনি দুলছিল তার পিঠে। লাল চুড়িদারের ওপর জরির সবুজ ঘাঘরা পরেছে।

হলঘর থেকে উঠে গিয়েছে দোতলার চওড়া সিঁড়ি। পানের বাটা হাতে আসরে যোগ দিতে নামছেন গিন্নিমা। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ। দোতলার ঘরগুলো মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন লাবণ্য। একদম সেই খেলাঘরের মতো। পটলার মা কোথায়?

সকালবেলা যখন টুলু ‘দিম্মা, দিম্মা’ ডাকতে-ডাকতে ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন সবার টনক নড়ল। গেলেন কোথায় মা?

সুরঞ্জন শেভ করছিল। বিতস্তা তাকে ফ্যাঝাসে মুখে বলল, ‘শিগগির এসো, মাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

বিতস্তা গেল আশপাশের বাড়িতে খবর নিতে। সুরঞ্জন গাড়ি বের করে ছুটল চেঙ্গানাচেরি মার্কেট। হঠাৎ কি মা না বলেকয়ে চলে গেলেন বাজারে? নাকি বেড়াতে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ভুলে গিয়েছেন? এমন শোনা যায় খুব হচ্ছে আজকাল।

টুলু বাগানের ফটক ধরে একলা দাঁড়িয়ে ছিল। দিম্মাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে টুলু। বিতস্তা কার সঙ্গে যেন সেলফোনে কথা বলতে-বলতে বাড়ির ভিতর দিকে চলে গেল। প্রথমে খেয়াল করেনি বিতস্তা, ওর পাশ ঘেঁষে টুলু এসে দাঁড়িয়েছে। মা’র হাত টেনে টুলু বলল, ‘এই দ্যাখো মা ‘দিম্মা পুতুল’।’

টুলুর হাতে একটা পুতুল। তার পরনে কালোপেড়ে সাদা সুতির শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। ডালের বড়ির মতো খোঁপা। গোলগাল মুখটা হাসিতে ভরপুর। বিতস্তা অবাক হয়ে দেখল, সত্যি, অনেকটা যেন মা-র মতো দেখতে।

‘কোথায় পেলি রে টুলু? কে দিল?’

‘বাইরে একজন লোক দিল। বলল, ‘দিম্মা পুতুল’।’

‘অচেনা লোকের থেকে তোমাকে কিছু নিতে বারণ করেছি না? কেমন দেখতে লোকটা, নাম বলেছে?’

‘একজন বুড়ো লোক। নাম বলল, ‘বারীনদাদু’।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *