দিঘির মাঠে বাংলো
এক
মাসিক পত্রে কবিতা লিখি বলে বন্ধুমহলে নাম হয়েছিল, কবি।
আমার কবিতায় যে কবিত্ব নেই, সে কথা আমার চেয়ে ভালো করে আর কেউ জানে না।
কবিত্ব থাকে প্রত্যেক মানুষের অন্তরে। এই হিসাবে প্রত্যেক মানুষই কবি। কিন্তু ভাষায় সেই কবিত্বকে প্রকাশ করতে পারে খুব অল্প লোকই এবং আমি ওই অল্পসংখ্যকদের কেউ নই। যদি জিজ্ঞাসা করেন— তবু আমি কবিতা লিখি কেন, তবে উত্তরে বলব— ওটা আমার মুদ্রাদোষ।
সম্প্রতি বাল্যবন্ধু সতীশের পত্র পেয়েছি। সতীশ গিয়েছিল পুজোর সময়ে বায়ু পরিবর্তনে। পশ্চিমের এক দেশ থেকে লিখেছে
কবি,
আমি যেখানে বাসা বেঁধেছি তার আশেপাশে অজস্র কবিত্বের বাহার। এখানে উপর-পানে তাকালে ঝুলে-ভরা কড়িকাঠের বদলে দেখা যায় নীলার-রং-মাখানো অসীম আকাশ, পদব্রজে বেড়াতে বেরুলে নরহত্যাকারী মোটর ও ট্রামের বদলে চোখে পড়ে কেবল বনফুলে রঙিন পাহাড় ও নদীর হার-দোলানো স্নিগ্ধসবুজ খেতের পরে খেত এবং কান পেতে শুনলে হেটো লোকের হট্টগোল আর পাওনাদারের সচীৎকার তাগাদার বদলে শোনা যায় শুধু মুক্তবিহঙ্গের আর গিরি-নির্ঝরিণীর মতো সংগীত। অতএব বাঁধো তোমার মোটমাট, কেনো একখানা ইন্টার ক্লাসের টিকিট এবং চলে এসো আমার ঠিকানায়। তোমার উদরে অন্ন জোগান দেওয়ার ভার গ্রহণ করব আমি।
বলাবাহুল্য সতীশের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দেরি করলুম না।
দুই
সতীশের বাসায় পৌঁছে দেখলুম, অত্যুক্তি করেনি। যা আমার কবিতায় প্রকাশ পায় না, সেই কবিত্বই এখানে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে-বাতাসে, বনে-বনে, নদীর লহরে, প্রজাপতির পাখনায়, মৌমাছির গানে। নিজেকে কী নিঃস্ব মনে হল! একরত্তি একটি ঘাসের দুলদুলে ফুল, বাতাসের দীর্ঘশ্বাসও সইতে পারে না, কিন্তু তারই তিল-পরিমাণ পাপড়িতে যে অনন্ত ছন্দ ও কবিত্বের ইঙ্গিত, আমার শত শত বড়ো বড়ো কবিতাও তার কাছে নগণ্য! এখানে আমার কবিতার পাশ ফিরে শোবারও ঠাঁই নেই!
সতীশ বললে, ‘কবি, এখানে খালি কবিত্ব নয়, তারও চেয়ে শ্রেষ্ঠ জিনিস পাওয়া যায়।’
আমি বললুম, ‘কবিত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জিনিস স্বর্গেও নেই।’
‘স্বর্গে— অন্তত হিন্দুদের স্বর্গে— না থাকতে পারে, কিন্তু মর্ত্য আছে। টাকায় দুই গণ্ডা রামপাখি কিংবা বিশ গণ্ডা তস্য ডিম্ব!’ ”এমন দেশটি কোথায় গেলে পাবে খুঁজে তুমি”?’
চমৎকৃত হয়ে বললুম, ‘তাহলে প্রাণপণে আমি প্রতিজ্ঞা করছি সতীশ, এদেশকেই আমার স্বদেশ বলে মনে করব।’
সতীশ চোখ পাকিয়ে বললে, ‘কবি, তুমি মীরজাফরেরও চেয়ে নিম্নশ্রেণির লোক!’
‘কেন?’
‘মীরজাফর স্বদেশ ভুলেছিলেন সিংহাসনের আর বিপুল ঐশ্বর্যের লোভে। আর তুমি এমনি পামর যে তুচ্ছ ফাউলের লোভে স্বদেশকেও ভুলতে চাও?’
‘ভুল সতীশ, ভুল! ফাউল তুচ্ছ নয়, আর ফাউল হচ্ছে আমার স্বদেশেরই একটি বড়ো সম্পদ। ”এনসাইক্লোপিডিয়া” খুলে দেখে, ফাউল বিদেশি নয়, তার প্রথম জন্ম ভারতবর্ষেই। অতএব ফাউলের স্বদেশ হচ্ছে আমাদের স্বদেশ। ইউরোপের রসনা সেদিনও পর্যন্ত ফাউলের আস্বাদ জানত না, কিন্তু তার ওপরে আমাদের জন্মগত অধিকার। ইউরোপ যখন শ্রীরামপক্ষীর স্বপ্নও দেখেনি, ভারতের বিরাট আকাশ আচ্ছন্ন করে উড়ত তখন ফাউলের পর ফাউল— কোটি কোটি নরম নধর রংচঙে ফাউল। এদেশে এত ফাউল থাকতে লক্ষ্মীদেবী ”আউল” বাহিনী হলেন কেন, মাঝে মাঝে তাই ভেবে আমি অবাক হই। কেন না লক্ষ্মীমন্ত না-হলে নিত্য কেউ ফাউলকারি খেতে পারে না। মা লক্ষ্মীর সঙ্গে ফাউলের সম্পর্ক বড়োই ঘনিষ্ঠ।’
সতীশ বললে, ‘তোমার গভীর গবেষণার ওপরে আর কথা চলে না। আজ তাহলে ফাউলের চপ, কাটলেট আর কারিই তোমার বরাদ্দ রইল।’
সেদিন সন্ধ্যার চাঁদ আসন্ন কোজাগরী পূর্ণিমার আনন্দে প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। তার রূপ দেখে মন আর বাসায় ফিরতে চাইলে না। পাহাড়ের একখানি পাথরের ওপরে একলাটি বসে বসে দেখতে লাগলুম— ঝরনায় ঝরছে হিরের ধারা, আর শালবনে কালোর ফাঁকে ফুটছে আলোর চিত্রমালা!
এ-সময়ে প্রত্যেক মানুষই মনে মনে কবিতা রচনা করে— এমনকী শিশুরা পর্যন্ত। আমারও মন তখন যে কাব্যকথা উচ্চারণ করছিল, অক্ষম ভাষায় তার ভাব ফোটাবার চেষ্টা করব না।
কিন্তু আচম্বিতে শরতের এক বেরসিক মেঘ কোথা থেকে ছুটে এসে চাঁদের ওপরে করলে যবনিকাপাত। শরতের মেঘ বটে, কিন্তু অভাবিতরূপে ঘন। চাঁদ-তারার আলোকিত নাট্যশালা একেবারে অন্ধকার!
এমন আকস্মিক দৃশ্য পরিবর্তনের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলুম না। ভাগ্যে সঙ্গে ‘ইলেকট্রিক টর্চ’টা ছিল, তাই কোনোরকমে পাহাড় থেকে নেমে বাসার পথ ধরতে পারলুম।
পৃথিবীর সৌন্দর্য আলোকের ওপরে কতটা নির্ভর করে, তাই ভাবতে ভাবতে পথ চলছি, হঠাৎ বইল ঠান্ডা জোলো হাওয়া এবং তার সঙ্গে-সঙ্গেই জাগল বজ্রবিদ্যুতের সমারোহ। আরও তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলুম বটে, কিন্তু পৃথিবীকে অনর্থক জ্বালাতন করবে বলেই আজ যে অকাল বাদলের আগমন হয়েছে, তাকে বোধ হয় আর ফাঁকি দিতে পারব না।
টর্চের আলোতে পথের চিহ্ন দেখে বোঝা গেল, আমাদের বাসার অনতিদূরেই এসে পড়েছি। আমার ডান পাশেই রয়েছে একটা ছোটো মাঠ, স্থানীয় লোকেরা তাকে ‘দিঘির মাঠ’ বলে ডাকে।
বৃষ্টি শুরু হল। প্রথমে বড়ো বড়ো দু-চার ফোঁটা। অনুভবে ফোঁটার আকার বুঝেই আন্দাজ করলুম বৃষ্টি খুব জোরেই আসবে।
অসময়ে স্নান করে দেহ আর জুতো-জামা-কাপড় ভেজাবার সাধ হল না। আশ্রয়ের জন্যে অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছি, হঠাৎ চোখে পড়ল দিঘির মাঠের নিবিড় অন্ধকারের বুক ছ্যাঁদা করে ফুটে উঠেছে আলোকোজ্জ্বল অনেক জানলা-দরজা।
বৃষ্টির তোড় বেড়ে উঠল, আমিও বেগে ছুটলুম সেই আলো লক্ষ্য করে।
তিন
ছোটো বাঁশঝাড়ের পাশে ছোটো একখানি বাগান, মাঝখানে ছোটো একখানি বাংলো। ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু লোকের দেখা বা সাড়া নেই।
চার-পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে বারান্দা বা দালানের তলায় গিয়ে যখন দাঁড়ালুম তখন বৃষ্টির মুষলধারায় পৃথিবী হয়ে উঠেছে শব্দময়।
দালানের মাঝখানে এবং দুইদিকেই রয়েছে একটা একটা করে তিনটে দরজা। সব দরজাতেই পর্দা ঝুলছে।
একদিক থেকে মিহি নারীকণ্ঠে প্রশ্ন এল, ‘কে ওখানে?’
গলার আওয়াজটা যথাসম্ভব মোলায়েম করে বললুম, ‘আজ্ঞে, ভেজবার ভয়ে এখানে এসে একটু দাঁড়িয়েছি।’
নারীকণ্ঠ বললে, ‘বেশ করেছেন। কিন্তু বাইরে কেন, ভিতরে এসে বসতে পারেন।’
বুঝলুম, এমন কোনো শিক্ষিতা আধুনিক মহিলা কথা কইছেন, পর্দার আড়ালে থেকেও যিনি পর্দাপ্রথার ধার ধারেন না। অতএব অসংকোচে পর্দা ঠেলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলুম।
ছোটো ঘর। মেঝের ওপরে খুব পুরোনো কার্পেট পাতা। মাঝখানে রয়েছে মার্বেলের সেকেলে একটা গোল টেবিল, তার ওপরে রয়েছে একটা সেকেলে বড়ো ল্যাম্প এবং টেবিলের চারপাশে রয়েছে খানকয় ভারী ভারী সেকেলে চেয়ার। একটু তফাতে একখানা ইজিচেয়ারের ওপরে অর্ধশায়িত অবস্থায় রয়েছেন একটি মহিলা। তাঁর অসাধারণ সৌন্দর্য প্রথম দৃষ্টিতেই মনকে বিস্মিত করে দেয়। মহিলার কোলের ওপরে পড়ে আছে একখানি খোলা বই। বোধ হয় এতক্ষণ তিনি বই পড়ছিলেন।
হঠাৎ গর্জন-শব্দ শুনে চমকে চেয়ে দেখি, ইজিচেয়ারের পিছন থেকে একটা কালো কুকুরের মস্ত মুখ উঁকি মারছে। তার চোখদুটো আগুন-ভরা! ত্রস্তপদে আমি আবার পিছিয়ে পড়লুম। ভেড়া ছাড়া আর কোনো চতুষ্পদ জীবকে আমি বিশ্বাস করি না।
মহিলা ধমক দিয়ে বললেন, ‘টাইগার! চুপ!’ কুকুরের মুখখানা আবার চেয়ারের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অতি মিষ্ট হাসি হেসে তিনি আমার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেন, ‘ওকী, ভয় পাচ্ছেন কেন? একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসুন-না, টাইগার আপনাকে আর কিছু বলবে না।’
চেয়ারের ওপরে বসে পড়লুম। সঙ্গে-সঙ্গে মহিলাটিকে আর একবার বিশেষভাবে আমাকে লক্ষ করেই যেন আমার অস্তিত্ব একেবারে ভুলে গেলেন। বইখানা মুখের সামনে তুলে ধরে আবার পড়তে শুরু করে দিলেন।
তিনি যখন আমাকে লক্ষ করেছিলেন, আমিও তখন লক্ষ করেছিলুম, তাঁর দৃষ্টি কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক উগ্রভাবে ভরা। তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলে মনে কেমন একটা অস্বস্তি ছটফট করতে থাকে।
বাইরের ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিদীর্ণ তমিস্রার ভিতর থেকে ভেসে আসছে বৃষ্টিধারার প্রচণ্ড ঐকতান। তাই শুনতে শুনতে আরও লক্ষ করলুম, মহিলাটি অপূর্বসুন্দরী ও যুবতী বটে এবং তাঁর মুখে-চোখেও শিক্ষা ও সংস্কৃতির ছাপ আছে বটে; কিন্তু তাঁর সাজপোশাক একেবারেই আধুনিক নয়। প্রাচীন তৈলচিত্রে সেকালকার ইংরেজি-শিক্ষিতা বঙ্গমহিলাদের যেরকম সাজপোশাক দেখা যায়, এঁরও পরনে অবিকল সেইরকম জামাকাপড়!
ঘরের প্রত্যেক ছবি ও তার গিল্টি করা ফ্রেমগুলোও সেকেলে। ওই যে মস্ত ঘড়িটা টক-টক শব্দে সময়ের গতি নির্দেশ করছে, তারও জন্ম নিশ্চয় আমাদের পূর্বপুরুষদের যুগে! এই গৃহের মধ্যে গত যুগ যেন বন্দি ও অচল হয়ে আছে।
মহিলার হাতের বইখানার দিকে আমার নজর পড়ল। মলাটের ওপরে লেখা রয়েছে ‘দুর্গেশনন্দিনী।’
আর কৌতূহল দমন করতে পারলুম না, আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘এতদিন পরে আপনি ”দুর্গেশনন্দিনী” পড়ছেন?’
মহিলা বইখানি নামিয়ে অল্পক্ষণ স্থির-চোখে আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘এতদিন পরে বলছেন কেন? আমি তো শুনেছি বইখানি সবে বাজারে বেরিয়েছে!’
সবে বাজারে বেরিয়েছে! তবে কি কোনো অপোগণ্ড লেখক ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নামে নতুন একখানা বই লিখেছে? বাঙালি লিখিয়েদের এ নষ্টামি হচ্ছে চিরকেলে। পুরোনো নাটক-উপন্যাসের নামেই তাঁরা নতুন বইয়ের নাম রাখেন। তাঁদের বিশ্বাস বোধ হয়, পুরোনো নামের খাতিরেই লোক নতুন বই না-কিনে পারবে না।
আবার শুধোলুম, ‘ওখানি কি বঙ্কিমচন্দ্রের ”দুর্গেশনন্দিনী” নয়?’
মহিলাটি বললেন, ‘হ্যাঁ, এখানি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোকেরই লেখা। নতুন লেখক, নাম আগে কখনো শুনিনি।’
মহিলাটি বেশ গম্ভীর মুখে পরিহাস করতে পারেন দেখে, আমি মুক্তকণ্ঠে হেসে উঠলুম।
আমাকে হাসতে দেখে মহিলাটির মুখে বিরক্তিমাখা বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। এমন সময়ে ঘড়িতে টং-টং করে দশটা বাজল এবং সঙ্গে-সঙ্গে তিনিও উঠে পড়ে বললেন, ‘মাপ করবেন, বাড়ির ভিতরে আমার একটু কাজ আছে। যতক্ষণ বৃষ্টি না-ধরে, আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন, আমি একটু পরেই আসছি। আয়, টাইগার!’ তিনি ভিতরের এক দরজা দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন এবং টাইগারও আবার চেয়ারের পিছন থেকে বেরিয়ে অগ্নিময় দৃষ্টিতে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে যেন অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনিবের অনুসরণ করলে। পাশের ঘরের আলো দপ করে নিবে গেল।
বৃষ্টির শব্দ তখন কমে এসেছে। আকাশেও স্থানে স্থানে মেঘের ফাঁকে জ্যোৎস্নার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু এ-ঘরের আলোও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই ল্যাম্প তৈলের অভাব! হঠাৎ দরজা দিয়ে আমার দৃষ্টি গেল পাশের ঘরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দপ দপ করে জ্বলছে দুটো ক্ষুধার্ত বন্য চক্ষু! আমার বুক শিউরে উঠল! টাইগার কি আমাকে একলা পেয়ে ভালো করে আদর করতে আসছে? কিন্তু তারপরেই সন্দেহ হল, ও চোখ দুটো বোধ হয় টাইগারের নয়! কারণ চোখ দুটো জ্বলছে মাটি থেকে প্রায় পাঁচফুট উঁচুতে। টাইগারের চোখ অত-উঁচুতে উঠবে কী করে? তারপরেই মনে হল, হয়তো আমাকে ভালো করে দেখবার জন্যেই, টাইগার ওই অন্ধকার ঘরের কোনো টেবিলের ওপরে লাফিয়ে উঠে পড়েছে।
আমিও উঠে পড়ে এক লাফে বাইরে এসে দাঁড়ালুম। এখনও অল্প-অল্প বৃষ্টি পড়ছে— পড়ুক গে! টাইগারের চেয়ে বৃষ্টি ঢের বেশি নিরাপদ!
কিন্তু বাংলোর বাইরে এসেই মনে পড়ল— ওই যাঃ, তাড়াতাড়িতে ভুলে ইলেকট্রিক টর্চটা টেবিলের ওপরে ফেলে এসেছি। তখনি আবার ফিরে দাঁড়ালুম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলুম, সেই আলোকোজ্জ্বল বাংলো হঠাৎ নিবিড় অন্ধকারের ভিতরে ডুব দিয়েছে! এবং সেখানে কেবল ধক ধক করছে ভয়ানক দুটো চলন্ত ও জ্বলন্ত চক্ষু! তারপরেই শুনলুম, অতিশয় খনখনে গলায় খিল খিল করে কে হেসে উঠে, সেই ভিজে রাতের স্তব্ধতাকে করে তুললে সচকিত।
টর্চের কথা ভুলে গিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে দিলুম দৌড়। এবং দৌড়তে-দৌড়তেই ভাবতে লাগলুম, বাংলোর সমস্ত আলো হঠাৎ একসঙ্গে নিবে গেল কেন? ওই জ্বলন্ত চোখদুটো কার? অমন করে হাসলে কে? আর কেনই-বা হাসলে? আমার পালানো দেখে?
চার
ঊর্ধ্বশ্বাসে একেবারে বাসায়। আমার চেহারা দেখেই সতীশ বলে উঠল, ‘একী কবি, এ কী মূর্তি!’
আমি কাদামাখা জুতোজোড়া খুলতে খুলতে বললুম, ‘আস্ত মূর্তিটাকে যে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, সেজন্যে ভগবানকে আমি ধন্যবাদ দিই।’
‘কেন হে, কেন?’
ধপাস করে বসে পড়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললুম, ‘বৃষ্টির ভয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের জগৎসিংহ মাঠের ভাঙা মন্দিরে ঢুকে পেয়েছিলেন দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমাকে। বৃষ্টির ভয়ে আমিও দিঘির মাঠের বাংলোয় ঢুকে পেয়েছি নব্যযুগের অসীম এক সুন্দরীকে। হাতে তাঁর ”দুর্গেশনন্দিনী”, মুখে তাঁর সকৌতুক প্রলাপ। আলাপ বেশ জমে উঠেছিল, কিন্তু আমার ভাগ্যে ওসমানের ভূমিকায় অভিনয় করতে এল, এক বিপুলবপু সারমেয় অবতার। ওসমান তরবারি ব্যবহার করত, কিন্তু এ ব্যবহার করে খালি বড়ো বড়ো দাঁত। কাজেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ না-করে পৃষ্ঠ ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েছি।’
সতীশ সবিস্ময়ে বললে, ‘এর মধ্যে যে দস্তুরমতো রোমান্সের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে হে!’
‘রোমান্স নয় ভাই, মিস অ্যাডভেঞ্চার! বিউটি অ্যান্ড বিস্টের আর একটা নতুন নমুনা। রূপে মুগ্ধ হলুম, আর টাইগারের দাঁত দেখে পালিয়ে এলুম।’
সতীশ সাগ্রহে বললে, ‘কবি, তোমরাই হচ্ছ ভাগ্যবান জীব। এখানে এসেই রোমান্স আবিষ্কার করলে! ব্যাপারটা খুলে বর্ণনা করো দেখি।’
একে একে সবকথা বললুম। সব শুনে সতীশ হতভম্বের মতন বললে, ‘দিঘির মাঠের ধার দিয়ে এতবার আনাগোনা করেছি, কিন্তু ওখানে যে এমনধারা এক চিত্তাকর্ষক রহস্যময় বাংলো আছে, কোনো দিন তো আমি লক্ষ করিনি! একেই বলে কবির দৃষ্টি! বন্ধু, কাল সকালেই তোমার ওই জ্যান্ত আবিষ্কারটিকে স্বচক্ষে দর্শন করতে যাব। তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে তো?’
বললুম, ‘কিন্তু কাল সকালে তো আর বৃষ্টি পড়বে না! কী অছিলায় আবার সেখানে মুখ দেখাতে যাব? টাইগারকে একটু আদর করব বলে?’
সতীশ বললে, ‘দূর ও-সব নয়, তুমি বলবে গিয়ে, তোমার ”টর্চটা” নিয়ে যেতে এসেছ।’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, এ ওজর অকাট্য বটে! কিন্তু এখন ওসব বাজে কথা রাখো, উদর-দেবতার পুজোর দরকার। এইবারে থালা-বাটি ভরে তোমার বহুবিজ্ঞাপিত ফাউলের নৈবেদ্য নিয়ে এসো, এই আমি আসনে বসে ধ্যানস্থ হলুম।’
সকালে উঠে সতীশের সঙ্গে দিঘির মাঠে গিয়ে অত্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেলুম।
কোথায় সেই বাংলো? মাঠময় ঝোপঝাপ, দু-চারটে ছোটো-বড়ো গাছ, সেখানে বাড়িঘর কিছুই নেই। জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে দেখলুম খালি পানায় সবুজ দিঘির ধারে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে গোটাকয় বক, আর একটা গাছের ডালে স্থির হয়ে বসে তিনটে শকুন।
সতীশ বললে, ‘কবি, আমি জানি, দিঘির মাঠে বাংলো-টাংলো কিচ্ছু নেই। এখন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় তোমাকে বলতে পারি— ‘পথিক, তুমি পথ ভুলেছ।’
আমি দৃঢ়স্বরে বললুম, ‘না, তা বলতে পারো না! পাহাড়ের ঝরনাতলা থেকে বাসায় ফিরতে গেলে, এই মেঠো পথ ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ নেই। টর্চের আলোতে কাল আমি ওই বাঁশঝাড়কে স্পষ্ট দেখেছিলুম— বাংলোখানা ছিল ওরই পাশে।’
সেইদিকে এগুতে-এগুতে সতীশ বললে, ‘কবি, তুমি কি বলতে চাও আলাদীনের দৈত্য এসে সেই বাংলোখানাকে রাতারাতি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে?’
আমি জবাব না-দিয়ে পায়ে পায়ে বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললুম, ‘কিন্তু দেখ সতীশ, কী আশ্চর্য! ভাঙা ইটের স্তূপ আর ভিতের চিহ্ন দেখছ? এক সময়ে এখানে সত্যি সত্যিই বাড়িঘর ছিল!’
সতীশ সায় দিয়ে বললে, ‘তা হয়তো ছিল। আর সেই সময়েই হয়তো তোমার দুর্গেশনন্দিনীর অসীম-সুন্দরী পাঠিকা তার দীপ্তচক্ষু টাইগারকে নিয়ে এখানে বাস করত। কবি, তুমি কি এইখানে বসে বসে মনের মতো স্বপ্ন দেখছিলে?’
উত্তর খুঁজে পেলুম না। কী করে সতীশকে বোঝাব, আমি মিথ্যা স্বপ্ন দেখিনি, সত্য-সত্যই এইখানে এক আলোকময় বাংলোয় এসে উঠেছি, ঝড়-বৃষ্টির কবল থেকে উদ্ধার পেয়েছি, এক বিচিত্র সুন্দরীর সঙ্গে কথা কয়েছি এবং তারপর অন্ধকারে ভীষণ এক কুকুরের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছি!
সতীশ হঠাৎ অস্ফুট শব্দ করে ভাঙা ভিতের ওপরে হেঁট হয়ে পড়ে কী-একটা জিনিস কুড়িয়ে নিলে। অবাক হয়ে সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলুম, কালকের ভুলে-ফেলে-যাওয়া আমার সেই ইলেকট্রিক টর্চটা! তাহলে আমি পথ ভুলিনি! সত্যই আমি এখানে এসেছিলুম।… তবে? তবে কাল যা দেখেছি সেগুলো কী?
ভাবতেও আমার গায়ে কাঁটা দিলে! তাহলে এখানে কি কোনো অজানা অদৃশ্য রহস্যের আত্মা বিরাজ করছে?
কোনোরকমে হাসি চেপে সতীশ একবার শিস দিলে। তারপর বললে, ‘একেই বলে কবির দৃষ্টি! ধন্য! কবি, আলাদীনের দৈত্যও তোমার কাছে হার মানে!’
ভারি রাগ হল। ভাবলুম, দিই ঠাস করে সতীশের গালে এক চড় বসিয়ে!