1 of 2

দিগা পাঁড়ে

দিগা পাঁড়ে

লোকটার নাম যে, দিগা পাঁড়ে তা জানতাম না।

সামারিয়া টাঁড় থেকে যে লালমাটির রাস্তাটা সোজা চলে গেছে দানুয়া-ভুলুয়া জঙ্গলের মধ্যে, সেই রাস্তার পাশে একটা কুঁড়েঘরে লোকটা থাকত। চারধারে গভীর জঙ্গল মাইলের পর মাইল। আসন, পিয়ার, গামহার; কেঁদ, শাকুয়া, পন্নন, প্রভৃতি নানা গাছ এবং লতাপাতা ফুলের আঁচলে চতুর্দিকের দিগন্ত হারিয়ে গেছে।

রেঞ্জার সিনহা সাহেবের বাংলো থেকে গল্পগুজব সেরে সাইকেলে করে আমি যখন আমার ডেরার দিকে রওনা হতাম, তখন সন্ধে হয়ে আসত প্রায়। জোরে প্যাডেল করে এলেও ওই কুঁড়েঘরের পাশে আসতে আসতে অন্ধকার হয়েই যেত। শুকনো ঘাসের ফাঁকফোঁকর দিয়ে কেরোসিনের কুপির আলো দেখা যেত আর শোনা যেত কুঁড়ের ভেতর গুনগুন করে সুর করে কে যেন, কী পড়ছে।

পরে জেনেছিলাম, তুলসীদাস পড়ত দিগা পাঁড়ে, সুর দিয়ে পড়ত:

সকল পদারথ হ্যায় জগমাহি। কর্মহীন নর পাওয়াত নাহি।

একদিন আমার সাইকেলের টিউব পাংচার হয়ে যায়, ওর কুঁড়ের কাছে এসে। সেদিনইপ্রথম তার সঙ্গে পরিচয় হয়। বড়ো আদর করে তার জীর্ণ কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মাটির মেঝের ঘরে বসিয়ে দিয়ে বাজরার ছাতু আর ভেলিগুড় মেখে খেতে দিয়েছিল আমাকে। ঝকঝকে করে বালি দিয়ে মাজা লোটাতে করে জলও এগিয়ে দিয়েছিল।

সেদিনই প্রথম জানতে পাই যে, তার ইহজগতে আর কেউই নেই। ভইষালোটনের জঙ্গলে তার একটা ছোটো ঠিকাদারি ব্যবসা ছিল খয়েরের। জঙ্গলের খয়ের বানাত আর মহাজনের কাছে বিক্রি করত। তার যুবতী স্ত্রীকে মানুষখেকো বাঘে খায়, তার একমাত্র ছেলেকে খায় বসন্ত। তার পর থেকেই ভইষালোটনেই বড়োলোক হওয়ার স্বপ্ন ফেলে, ও এসে এই দানুয়া-ভুলুয়ার জঙ্গলে আস্তানা গাড়ে। ঠিকাদারবাবুর জঙ্গলে দিনের বেলা কূপ কাটে। সন্ধের আগে আগেই ফিরে এসে নালার জলে মুখ-হাত ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে একা একা দিগা প্রতিদিনই তুলসীদাস পড়ে। লোকটা তুরিয়ানা গ্রামে না থেকে একা একা কেন যে এমন গভীর জঙ্গলে থাকে তা বুঝতে পারতাম না। তাকে জিজ্ঞেস করাও হয়ে ওঠেনি কখনো।

রাতের হাতির দল বৃংহণ করতে করতে কখনো তার কুঁড়ের কাছাকাছি চলে আসে। মটমট করে বড়ো বড়ো গাছের ডাল ভাঙে। তুরিয়ানা গ্রামের অড়হর খেতে সম্বরেরা এসে জোটে। তাদের পেছনে পেছনে আসে ডোরাকাটা বড়ো বাঘ। সম্বরের দল ‘ঘাক ঘাক’ আওয়াজ করতে করতে হুড়মুড় করে দৌড়ে পালায়। কখনো বা কুলথিখেতে চিতল হরিণের ঝাঁক এসে কুলথি খায়। মাঝে মাঝে শিঙাল হরিণগুলো টাঁউ টাঁউ করে ডেকে ওঠে। বড়কা শোনচিতোয়া তাদের পিছু নেয়। চিতল হরিণের দল কুলথিখেত পেরিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে উড়ে যায়।

দিগা পাঁড়ের কুঁড়ের পেছনের ঝাঁকড়া আসনগাছের মগডাল থেকে হুতোম প্যাঁচা ডেকে ওঠে বুকের মধ্যে চমকে দিয়ে ‘দুরগুম দুরগুম’ করে। তার ডাক শুনে পথের বাঁকে ছোটো প্যাঁচাগুলো ‘কিঁচি-কিঁচি কিঁচির-কিঁচির’ করে উড়ে উড়ে ঝগড়া করে। রাত বাইরে ঘন হয়ে আসে। শিশিরে দূর্বাঘাসের শরীর ভারী হয়ে ওঠে। শজারু চোরের মতো শটিখেতে ঢোকে। চাঁদের গা থেকে, গাছের গা থেকে, লতার কোল বেয়ে শিশিরের সঙ্গে ফিসফিসে রাত গড়িয়ে পড়ে যতই প্রহর বাড়ে। মাটির মালসায় কাঠকয়লার আগুন কোলের কাছে নিয়ে দিগা খড়ের ওপর একটা বস্তা বিছিয়ে এবং অন্য একটা বস্তা গায়ে চাপা দিয়ে হাড়কাঁপানো শীতের রাতে পরমশান্তিতে ঘুমোয়।

দিগার কাছে সে রাতে সাইকেলটা গচ্ছিত রেখে আমি যখন বেরিয়ে পড়লাম আমার ডেরার দিকে তখন দিগা খুব অবাক হয়েছিল।

বলেছিল, এতখানি পথ যাবে রাতের বেলা, বিপদ-আপদ আছে—চলো বাবু আমিও তোমার সঙ্গে যাই মশাল জ্বেলে।

আমি বলেছিলাম, রাতের বনে একা একা হাঁটতে আমার ভারি ভালো লাগে। খুশিতে আমি বেহুঁশ হয়ে যাই।

দিগা কেরোসিনের কুপিটা আমার মুখের দিকে তুলে ধরে বলেছিল; তুমি তো শহুরে পড়েলিখে বাবু। কিন্তু তুমি একটু অন্যরকম।

আমি হেসে বলেছিলাম, কীরকম? জংলি?

তার পর বলেছিলাম, ভয় জানোয়ারের কাছ থেকে কিছুই নেই দিগা; ভয় শুধু মানুষেরই কাছ থেকে।

দিগা ছোটো করে ছাঁটা চুলে-ভরা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল, বড়ো খাঁটি কথা বলেছ বাবু। মানুষের চেয়ে খতরনাক জানোয়ার এ-দুনিয়ায় আর দুটি নেই।

এর পর থেকে যখনই ওই পথে যেতাম, আসতাম, তখনই দিগা থাকলে, তার ঘরের সামনের একটা কাটা শালের গুঁড়িতে বসে, নানা গল্প করতাম দিগার সঙ্গে। একদিন ওর জন্যে মাংস রাঁধিয়ে নিয়ে গেলাম। কিন্তু বানানো খাবার ও খেল না। দিগা নিরামিষাশী ছিল। চিঁড়ে খেতে ও খুব ভালোবাসত, আর ছোলার ডাল। তাই মাঝে মাঝেই ওর জন্যে চিঁড়ে, হাজারিবাগ থেকে পাঠানো কলকাতার পাটালি গুড় আর ছোলার ডাল নিয়ে যেতাম।

দিগা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাত। বলত, আমি তো তোমার জন্যে কিছুই করতে পারি না। আমি তো তোমার কেউই নই; তবু তুমি এত কিছু করো আমার জন্যে। কেন করো তুমি?

আমি হাসতাম।—বলতাম, এমনিই। তোমাকে ভালোবাসি বলে।

দিগা ওর বয়স্ক তিক্ত অভিজ্ঞতার লিখনভরা কিন্তু তবুও অতিপবিত্র প্রসন্ন মুখটি তুলে আমার দিকে তাকাত।

স্বগতোক্তির মতো বলত, আজিব বাত—। তার পর বলত, এই দুনিয়ায় স্বার্থ ছাড়া কেউ কি কাউকে ভালোবাসে বাবু?

আমি আবারও হাসতাম।

বলতাম, স্বার্থ নিয়ে ভালোবাসলে তাকে কি আর ভালোবাসা বলে? ভালোবাসার মধ্যে স্বার্থের জায়গা কোথায়? তোমাকে দেখলেই আমার ভালো লাগে, তোমার কাছে এলে ভালো লাগে, তোমাকে খুশি দেখলেই আমি খুশি হই—এটা কি কম হল? ভালোবাসা কি অন্য কিছু?

দিগা মনে মনে কীসব বলত বিড়বিড় করে। তার পরই বলত, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। যখনই সে ভগবানের কথা বলত, তার চোখের ভাব আশ্চর্যরকম নরম হয়ে উঠত।

দিগার জন্যে একবার চৌপারণের হাটিয়া থেকে একটা গরম দেহাতি চাদর কিনে নিয়ে এসেছিলাম।

দিগা কিছুতেই নেবে না।

বলে, এ কী অন্যায়! ই বহত বুড়া বাত। আমার জন্যে এসব অপচয় কেন? আমার তো শীত লাগে না। বেশ কেটে যাচ্ছে আমার। তুমি এত দামি দামি সব জিনিস আমায় দিলে, আমার ঘরে তো ডাকাতি হবে? তা ছাড়া বয়েসের আমার গাছ-পাথর নেই, আজ বাদে কাল তো মরেই যাব আমি—কাকে এসব সম্পত্তি দিয়ে যাব? আমার যে কেউই নেই।

আমি অবাক হয়ে বলতাম, দামি সম্পত্তির মধ্যে তো এই চাদরটাই। চিঁড়ে, গুড় তো আর থাকবে না। খেয়েই শেষ হবে।

দিগা বড়ো কুন্ঠিত হয়ে বলত, না, না। বাবু, এসব ঠিক নয়। আমি তোমাকে আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারি না।

আমি হাসতাম। বলতাম, আশীর্বাদের দাম জানো? আশীর্বাদের দাম কি টাকা-পয়সা দিয়ে দেওয়া যাবে?

দেখতে দেখতে শীত পেরিয়ে বসন্ত এল। বসন্তের শেষে চৈত মাসের পাঁচ তারিখে এ-অঞ্চলের সব লোক দেওতার থানে পুজো চড়ায়। গভীর জঙ্গলের মধ্যে গুহায় দেওতার থান আছে। এই তুরিয়ানার দেওতা বড়ো জাগ্রত দেওতা। গাড়ি নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে পয়সাওয়ালা লোকেরাও প্যাঁড়া ও ফুল নিয়ে চলে আসে এই দুর্গম রাস্তা বেয়ে। রেঞ্জ অফিসের কাছে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে আসে তিন-চার মাইল পথ—মেদবহুল থলথলে মহিলা ও পুরুষ। দলে দলে গরিব-গুরবোরাও আসে।

জঙ্গল নিলাম ডাকতে হবে শিগগিরই। তারই তদবির তদারকি করতে গেছিলাম সেই পুজোর দিনে ডি এফ ও সাহেবের অফিসে, সদরে। ফেরার সময় সকাল সকাল রওনা হয়েও এদিক পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আজ এ তল্লাটে সকলেরই ছুটি। কূপ কাটা বন্ধ, খয়ের বানানো বন্ধ, রেঞ্জ অফিসেও কাজ হয় না। এই পরবের দিনে।

তুরিয়ানা দেবতার পুজো দেয় সকলেই।

দিগার ঘরের কাছে এসে পৌঁছোতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখি, দিগা জঙ্গলের ভেতর থেকে আমলকী বনের মধ্যে দিয়ে কুঁড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। এখন জঙ্গলে কী করতে গেছিল, তা ও-ই জানে।

সাইকেল থেকে নেমে পড়ে আমি বললাম, কী ব্যাপার দিগা? তুমি পুজো চড়াতে যাওনি? কথায় কথায় বলো, ভগবান মঙ্গল করুন, তুমিই ভগবানের পুজো চড়ালে না?

আমার কথায় সহজ ঠাট্টা ছিল। কিন্তু দিগা ঠাট্টাটাকে আমল দিল না। আমার কথার জবাবও নয়।

আমার দিকে দুটি শান্ত সুন্দর চোখ তুলে বলল, তোমার মুখ গরমে তেতে রয়েছে। এ বছর গরমটা বড়ো তাড়াতাড়ি পড়ল। চারদিকে এরইমধ্যে পলাশের ছড়াছড়ি। আঁধি উঠছে দুপুরে। সাপ-বিছে সব বেরিয়ে পড়েছে।

তার পর বলল, বাঙালিবাবু, বোসো, জিরিয়ে নাও, তুমি খিচুড়ি খেতে ভালোবাসো— লোটার মধ্যে মুঙ্গকা ডাল আর তুরিয়ানার গাইয়ের ঘি দিয়ে দু-মুঠো চাল ছেড়ে দিচ্ছি—এক্ষুনি খিচুড়ি হয়ে যাবে। খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করে তার পর যাও। ডেরায় তোমার জন্যে তো কেউ আর অপেক্ষা করে নেই।

তার পরেই আমাকে শুধোল, তুমি কি পুজো চড়াতে যাবে নাকি?

আমি বললাম, ভাবছি। কিন্তু তুমি ধার্মিক বুড়োমানুষ পুজো চড়ালে না, আমি নাস্তিক জওয়ান পুজো চড়িয়ে আর কী করব?

দিগা আমার কথার জবাব না দিয়ে, খিচুড়ির বন্দোবস্ত করতে লাগল। আমি সাইকেলটা একটা গাছে হেলান দিয়ে রেখে শালের গুঁড়িতে বসে লোটা থেকে ঢকঢকিয়ে জল খেয়ে তৃষ্ণা মেটালাম।

খিচুড়িটা চাপিয়ে দিয়েই দিগা এসে আমার পাশে বসল। ঊরু অবধি তোলা মোটা দেহাতি ধুতি আর একটা খদ্দরের নীলরঙা ফতুয়া ছিল তার গায়ে। খালি-পা। কিন্তু শরীরের ও পোশাকের কোথাও এককণা ময়লা ছিল না।

আমি লোটা নামিয়ে রাখলে—দিগা আর একবার পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তখনও অনেক লোকজন কলরব করতে করতে পুজো চড়িয়ে সামনের পথ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। এই শেষবেলায় দেওতার থানে যাওয়ার লোকের ভিড় ছিল না। এখন শুধু ফেরার পালা।

দিগা ওই পথচলতি লোকজনের দিকে কেমন উদাসীন চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমাকে শুধোল, আচ্ছা! বাঙালিবাবু; তুমি কখনো ভগবান দেখেছ? আমি হেসে ফেললাম। বললাম, আমি কি মহাপুরুষ না সাধুসন্ত যে ভগবান দেখব?

দিগা আবারও বলল যে, এত লোক যে তুরিয়ানার দেওতার থানে পুজো চড়াতে গেল, এবং পুজো চড়িয়ে ফিরেও এল; ওদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই দেখেছে।

আমি বললাম, কী করে বলব? হয়তো দেখেছে।

কথাটা বলবে, কি বলবে না, অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে দিগা হঠাৎ যেন, সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলল, আমি কিন্তু দেখেছি, রোজই দেখি।

ততক্ষণে আমার কথার হালকা ভাবটা কেটে গেছে। আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, বলো কী দিগা? রোজ দেখো? কখন? কোথায়?

দিগা মুখ নীচু করে লজ্জিত গলায় বলল, এখানেই দেখি, আমার এ ঘরের সামনে। দু-বেলাই দেখি—

তার পর বলল, তুমি একটু থেকে যাও, তোমাকেও দেখাব, আজই দেখাব।

আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

দিগা আমাকে নিভিয়ে দিয়ে, বলল, তাড়া নেই, ভালো করে খিচুড়িটা খাও, তার পর সময় হলেই দেখাব। তাকে দেখতে তোমার কোথাওই যেতে হবে না, নিজেই সে এসে দু-বেলা দেখা দেয়। আমি তাকে সবসময় বুকের মধ্যে অনুভব করি। কিন্তু এই যে এত লোক পথ মাড়িয়ে দেওতার থানে এল-গেল, ওরাও সকলেই আমারই মতো তাকে বুকের মধ্যে অনুভব করে কি না ভারি জানতে ইচ্ছা করে।

খিচুড়ি খেয়ে পাহাড়ি নালায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসতে আসতে টুণ্ডু পাহাড়ের পায়ের তলা অবধি গড়িয়ে যাওয়া গভীর জঙ্গলের মধ্যে সূর্যটা হারিয়ে যেতে লাগল।

বেলা পড়ে এসেছে। চারদিক থেকে তিতিরের ডাক শোনা যাচ্ছে—ছাতার পাখির দল ঝোপে-ঝাড়ে নড়েচড়ে বসতে বসতে ক্রমান্বয়ে ‘ছ্যা ছ্যা’ করে ডাকছে। দ্রুতগামী টিয়ারা তাদের সবুজ ডানায় দুলতে দুলতে সূর্যের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। জঙ্গলের সব সবুজ মুছে নিয়ে চলে গেল পশ্চিমে। অস্তগামী সূর্যকে ধাওয়া করে টি-টি পাখিরা শূন্যে ঠ্যাং ঝুলিয়ে ধেয়ে গেল পশ্চিমে।

সমস্ত পশ্চিমাকাশ এক আশ্চর্য ম্লান লালিমায় ভরে উঠল। গাছের ছায়া, পাথর নুড়ি ঘাসের ফলার ছায়াগুলি দেখতে দেখতে ছড়িয়ে যেতে লাগল। দূর বনের গভীরে ময়ূর ডেকে উঠল, ক্বেঁয়া ক্বেঁয়া করে।

দিগা হঠাৎ খুব উত্তেজিতভাবে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে আমার পাশে এসে, শালের গুঁড়িরওপর বসল।

প্রায় ফিসফিস করে বলল, এসে গেছে, এসে গেছে; দেখতে পেয়েছ বাঙালিবাবু?

আমি নিশ্বাস বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকালাম। কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। আমার মস্তিষ্কের মধ্যে বনের গভীর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাকই শুধু চারিয়ে গেল।

দিগাকে যেন, কোনো দেবতা সত্যি সত্যিই ভর করল।

দিগা ফিসফিস করে বলল, দেখো, দেখো, তার দিকে একবার চোখ চেয়ে দেখো।

দিগার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, তার কুঁড়ের সামনে একফালি টাঁড় জমিতে শেষ সূর্যের নরম কনে-দেখা-আলো এসে লুটিয়ে পড়েছে গাছগাছালির আঁজলার ফাঁক বেয়ে। সেই নরম আলোয় কতকগুলো ছোটো ছোটো কালো কালো পাথর ও নুড়ি, ধুলো, ঘাস, পিলাবিবির ঝাড় এইসব সামান্যতা, এক আশ্চর্য স্বর্গীয় রূপ পেয়েছে। আর সেই আলোর অয়নপথে একটি ময়ূরপঙ্খি কাচপোকা বুঁ-উ-উ-উ-বুঁ-বুঁ-বুঁ-ই ই করে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। আর সেই ঘন ময়ূরপঙ্খি ডানায় শেষসূর্যের আলো পড়ে পৃথিবীতে যত রং আছে হালকা ও গাঢ়, সেই সমস্ত রং একইসঙ্গে ঝিলিক মেরে উঠছে।

দিগা কোলের ওপর রাখা আমার হাতের ওপর ডান হাতের পাতা রেখে ফিসফিস করে বলল, দেখেছ? দেখতে পেলে?

যে-দৃশ্য রোজ দেখেছি অথচ দেখিনি, রোজ চোখ চেয়েছি, কিন্তু চোখের মন যেদিকে চায় না; সেই অতিসাধারণ অথচ অবাক অসাধারণ সদ্যজাত, সদ্যমৃত দৃশ্যে দিগার স্পন্দিত হাতের শিহরনে, সেই বিকেলে যেন আমি আবিষ্ট হয়ে গেলাম। সেদিকে চোখ চেয়ে, কথাপর্যন্ত বলতে পারলাম না আমি।

ধীরে ধীরে আমার ও দিগার চোখের সামনে থেকে সেই নরম উষ্ণতাটুকু কখন যে চুপিসাড়ে এবং অতিধীরে মিলিয়ে গেল তা, বুঝতেও পারলাম না আমি।

হঠাৎ কানে এল, ছোটো প্যাঁচারা ঝগড়া বাধিয়েছে অশ্বত্থ গাছের ঝুরিতে—। তাদের কিঁচি-কিঁচি-কিঁচি চিৎকারে সেই সুন্দর স্বপ্নটা যেন ভেঙে গেল।

নরম জ্যোৎস্নার মতো সাদা, সোঁদা গন্ধ জংলি ইঁদুরগুলো ঝরে যাওয়া শুকনো পাতার মধ্যে খসখস করে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল প্যাঁচাদের আওয়াজে ভয় পেয়ে। শঙ্খচূড় সাপ বড়ো গাছের কোটর ছেড়ে তখনও উত্তপ্ত পাথরের বুক বেয়ে শুকনো পাতার সড়সড় আওয়াজ তুলে পানুয়ানা টাঁড়ের দিকে চলে যেতে লাগল। মনে হল, সাপটা যেন অনন্তকাল ধরেই যাচ্ছে এবং যাবে।

দিগা আবার আমার হাঁটুতে হাত ছুঁইয়ে বলল, দেখলে বাঙালিবাবু? এখন আর দেখা যাচ্ছে না, এখন শুধু শোনা যাচ্ছে তার পায়ের শব্দ চারিদিকে। শুনতে পাচ্ছ না?

তার পর একটু থেমে দিগা বলল, প্রথম ভোরে পুবের আকাশে চেয়ো—তাকে আবার দেখতে পাবে। ভালো করে চেয়ে-দেখো, তাকে দিনে-রাতের সমস্ত সময় দেখতে পাবে, তোমার বুকের মধ্যে সে নড়বে চড়বে। সত্যি।

হঠাৎ মনে হল যে, আজ তুরিয়ানার দেওতাকে অনেকেই দেখল। কিন্তু দিগা পাঁড়ের ভগবানকে, যিনি অগম্য নন, যিনি দূরের নন, যিনি কোনো ছায়াচ্ছন্ন গুহার অন্ধকার গভীরে নির্বাসিত নন; তাঁকে দেখার সৌভাগ্য একমাত্র আমারই হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *