দিগ্দর্শন
মাঘের সন্ধ্যায় গ্রামের মাথার উপরকার বায়ুস্তরে সাঁঝাল ধোঁয়ার ধূসর আস্তরণ বেশ ভারী হইয়া চাপিয়া বসিয়াছিল; যেন শীতরাত্রির ভয়ে গ্রামটি তাড়াতাড়ি গুটিসুটি পাকাইয়া ভোটকম্বলের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িয়াছে।
গ্রাম কিন্তু ঘুমায় নাই। ঐ সাঝাঁল ধোঁয়ার মতো একটা গুরুভার দুর্ভাবনা গ্রামের দীনতম প্রজা হইতে জমিদার পর্যন্ত সকলের বুকের উপর চাপিয়াছিল। বৈকুণ্ঠবাবুকে প্রজারা ভালবাসিত এবং শ্রদ্ধা করিত; কারণ তিনি দরদী লোক ছিলেন, জমিদারীর ভার নায়েব-গোমস্তার হাতে তুলিয়া দিয়া নিজে শহরে গিয়া বাস করেন নাই। তাই সকলের মনেই আশঙ্কা জাগিতেছিল, না জানি আজিকার রাত্রিটা কেমন কাটিবে; সুদূর সমুদ্রপার হইতে যে সংবাদ আসিবার কথা, তাহা কিরূপ বার্তা বহন করিয়া আনিবে।
গ্রামের মাঝখানে জমিদারের প্রকাণ্ড বাড়ির ঘরে ঘরে আলো জ্বলিয়াছে; পরিজন, দাসদাসী চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কিন্তু সকলেই পা টিপিয়া টিপিয়া হাঁটিতেছে। কাহারও মুখে কথা নাই, কথা বলিবার একান্ত প্রয়োজন হইলে ফিস্ফিস্ করিয়া কথা বলিতেছে। যেন বাড়িতে কোথাও মুমূর্ষু রোগী অন্তিমশয্যায় পড়িয়া আছে, একটু শব্দ করিলে তাহার শেষ বিশ্রামে বিঘ্ন ঘটিবে।
সদর বৈঠকখানার ফরাসের উপর জমিদার বৈকুণ্ঠবাবু তাকিয়ায় কনুই রাখিয়া একাকী বসিয়াছিলেন। সম্মুখে দুইটি কাচের বাতিদানে মোমবাতি জ্বলিতেছিল। গড়গড়ার নলটি বাঁ-হাতে মুখের কাছে ধরা ছিল, মাঝে মাঝে তাহাতে মৃদু টান দিতেছিলেন। গায়ে একটি জাম রঙের বহরমপুরী বালাপোষ জড়ানো; গৌরবর্ণ দীঘাঙ্গ পুরুষ, বয়স ষাটের কাছাকাছি; মুখে এমন একটি শুদ্ধ-সাত্ত্বিক বুদ্ধির দীপ্তি আছে যে, দেখিলে বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণপণ্ডিত বলিয়া মনে হয়।
বৈকুণ্ঠ শান্তভাবেই বসিয়া তামাক টানিতেছিলেন; কিন্তু তাঁহার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করিতেছিল। যখন প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কোনও কাজ থাকে না, তখন সময় যেন কাটিতে চায় না—কর্মহীন মুহূর্তগুলা পঙ্গুর মতো এক পা এক পা করিয়া অগ্রসর হয়। আজ রাত্রি আটটার মধ্যে বিলাতি ‘তার’ আসিয়া পৌঁছিবার কথা; বৈকুণ্ঠ তাঁহার ছোট নায়েব প্রফুল্লকে সন্ধ্যার পূর্বেই ডাকঘরে পাঠাইয়াছেন। কিন্তু ছয় ক্রোশ দূরে মহকুমা শহরে টেলিগ্রাফ অফিস; সুতরাং নয়টার পূর্বে কোনক্রমেই সংবাদ পাওয়া সম্ভব নয়। প্রফুল্ল অবশ্য বাইসিকেলে গিয়াছে—
বৈকুণ্ঠ দরজার মাথার উপর প্রাচীন ঘড়িটার দিকে তাকাইলেন। সাড়ে ছয়টা। এখনও আড়াই ঘণ্টা দেরি। সময়কে হাত দিয়া ঠেলিয়া দেওয়া যায় না।
দশ বছর ধরিয়া জমিদার বৈকুণ্ঠবাবু একটি মামলা লড়িতেছেন। মামুলী মামলা নয়—একেবারে জমিদারীর স্বত্বাধিকার লইয়া বিবাদ; জিতিলে সর্বস্ব বজায় থাকিবে, হারিলে পথে দাঁড়াইতে হইবে। দশ বৎসর এই মোকদ্দমা স্তরে স্তরে উর্ধ্বতর আদালতে উঠিয়া শেষে একেবারে চরম আদালত বিলাতের প্রিভি কাউন্সিলে পৌঁছিয়াছে। সেখানে কয়েক মাস শুনানী চলিবার পর আজ রায় বাহির হইবার দিন। বৈকুণ্ঠের জীবনে এক মহা-সন্ধিক্ষণ আসন্ন হইয়াছে,—তিনি যেমন আছেন তেমনি থাকিবেন অথবা পথের ভিখারী হইবেন, তাহা আজ চরমভাবে নিষ্পন্ন হইয়া যাইবে।
অন্দরের ঠাকুরঘরে গৃহদেবতার শীতল ভোগের ঘন্টি বাজিল। বৈকুণ্ঠ হাতের নল নামাইয়া রাখিয়া চক্ষু মুদিত করিয়া ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করিলেন। আজই কি তাঁহার শেষ পূজা? কাল প্রভাতে কি তাঁহার গৃহদেবতার পূজার অধিকার থাকিবে না? অন্য যজমান আসিয়া পূজা করিবে?
দীর্ঘশ্বাস দমন করিয়া বৈকুণ্ঠ আবার ঘড়ির দিকে তাকাইলেন—ছ’টা পঁয়ত্রিশ। মাত্র পাঁচ মিনিট কাটিয়াছে। আর তত সহ্য হয় না। মাসের পর মাস তিনি নীরবে শান্ত মুখে প্রতীক্ষা করিয়াছেন, কিন্তু আজ যখন সময় একেবারে আসন্ন হইয়াছে, তখন আর তাঁহার মন ধৈর্য মানিতেছে না। অসহ্য এই সংশয়। এর চেয়ে যাহোক একটা কিছু হইয়া যাক।
গত কয়েকমাস ধরিয়া যে প্রলোভনটি তিনি অতি যত্নে দমন করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহা আবার তাঁহার মনের মধ্যে মাথা তুলিল। দেখাই যাক না! অদূর ভবিষ্যৎ এখনই তো বর্তমানে পরিণত হইবে—তবে আর ইতস্তত করিয়া কি লাভ। সংশয়ের যন্ত্রণা ক্রমেই অসহ্য হইয়া উঠিতেছে।
বালাপোষখানা কাঁধের উপর টানিয়া লইয়া বৈকুণ্ঠ ডাকিলেন—‘হরিশ।’
হরিশ জমিদারীর ম্যানেজার। মোটা ধরনের মধ্যবয়স্ক লোক, গায়ের রঙ কালো, মাথার চুল খোঁচা খোঁচা; গত কয়দিনের দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় চোখের কোলে কালি পড়িয়াছে, গালের মাংস ঝুলিয়া পড়িয়াছে। হরিশ দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন, উদ্বিগ্ন-চক্ষে প্রভুর মুখের পানে চাহিয়া ভাঙা গলায় বলিলেন—‘কি দাদা?’ নিজের অজ্ঞাতসারেই তাঁহার গলার স্বর একেবারে বসিয়া গিয়াছে।
বৈকুণ্ঠ তাহার পানে চাহিয়া একটু হাসিলেন, সহজ গলায় বলিলেন—‘এস, এক বাজি রঙে বসা যাক।’
হরিশের কালিমালিপ্ত চোখে ভয়ের ছায়া পড়িল; তিনি বলিয়া উঠিলেন—‘না না দাদা, কাজ নেই। আর তো ঘণ্টা দুই—’
বৈকুণ্ঠ বলিলেন—‘তাইতো বলছি, এস খেলা যাক। নিষ্পত্তি যা হবার তা তো হয়েই গেছে, তবে আর খবরটা পেতে দেরি করি কেন? এস।’
হরিশ আর না বলিতে পারিলেন না; পাশার ছক পাতিয়া দু’জনে খেলিতে বসিলেন। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সত্ত্বেও বৈকুণ্ঠ ও হরিশের মধ্যে একটা গভীরতর সম্বন্ধ ছিল; দীর্ঘ সংশ্রবের ফলে উভয়ে উভয়ের সত্যকার পরিচয় পাইয়াছিলেন এবং সে পরিচয়ে কেহই নিরাশ হন নাই। তাই জীবনের প্রারম্ভে শুষ্ক বৈষয়িকতার মধ্যে যে সম্বন্ধের সূত্রপাত হইয়াছিল জীবনের প্রান্তে তাহাই অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে পরিণত হইয়াছে। আজ যদি দুর্নিয়তির চক্রান্তে বৈকুণ্ঠকে পথে দাঁড়াতেই হয়, হরিশও তাঁহার পাশে গিয়াই দাঁড়াইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
পাশা খেলা আরম্ভ হইল। বৈকুণ্ঠের এই পাশা খেলার মধ্যে এক আশ্চর্য রহস্য নিহিত ছিল। ত্রিকালদর্শী জ্যোতির্বিদ যেমন নির্ভুলভাবে ভবিষ্যৎ গণনা করিয়া বলিতে পারেন, বৈকুণ্ঠও তেমনি পাশা খেলার ফলাফলের দ্বারা নিজের ভবিষ্যৎ শুভাশুভ নির্ণয় করিতে পারিতেন। আজিকার কথা নয়, প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে খেলাচ্ছলেই তিনি এই বিস্ময়কর আবিষ্কার করিয়াছিলেন। তারপর শতবার ইহার পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে—পাশার ফলাফল কখনও ব্যর্থ হয় নাই। খেলায় জিতিলে বৈকুণ্ঠ বুঝিতেন আগামী সমস্যায় শুভ ফল ফলিবে, হারিলে বুঝিতেন কুফল অনিবার্য।
কালক্রমে এই পাশা খেলা তাঁহার জীবনে দিগ্দর্শন যন্ত্রের মতো হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ছোট-বড় কোনও সমস্যা বা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সংশয় উপস্থিত হইলেই তিনি হরিশের সহিত রঙ খেলিতে বসিতেন। রঙের বাজি ব্যর্থ হইত না। বৈকুণ্ঠ নিঃসশংয় মনে অমোঘ ভবিষ্যতের পরীক্ষা করিতেন।
কিন্তু আজিকার এই জীবন-মরণ সমস্যার ফলাফল তিনি এই উপায়ে জানিবার চেষ্টা করেন নাই, বার বার ইচ্ছা হইলেও শেষ পর্যন্ত ভয়ে পিছাইয়া গিয়াছিলেন। কি জানি কি ফল দেখা যাইবে! যদি সত্যই মোকদ্দমায় হারিতে হয়, আগে হইতে জানিয়া দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘ করিয়া লাভ করি?
এতদিন এই বলিয়া মনকে বুঝাইয়াছিলেন, কিন্তু এখন আর পারিলেন না—খেলিতে বসিলেন। খেলার সময় বৈকুণ্ঠ ও হরিশের মধ্যে একটা অকথিত বোঝা-পড়া ছিল, হরিশ ইচ্ছা করিয়া হারিবার চেষ্টা করিবেন না। দু’জনেই ভাল খেলোয়াড়, দেখিতে দেখিতে তাঁহার খেলায় মগ্ন হইয়া গেলেন।
রাত্রি আটটার সময় খেলা শেষ হইল।
বৈকুণ্ঠ হারিলেন।
হরিশ কিছুক্ষণ বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো বসিয়া রহিলেন, তারপর চোখে কাপড় দিয়া উঠিয়া গেলেন।
বৈকুণ্ঠের মুখখানা পাথরের মতো হইয়া গিয়াছিল, তিনি আবার গড়গড়ার নল হাতে লইয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া বসিলেন। যাক, তাঁহার ভাগ্য-বিধাতা ইহাই তাঁহার জন্য সযত্নে সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। সারা জীবন ঐশ্বর্য ও মর্যাদার মধ্যে কাটাইয়া বৃদ্ধ বয়সে রিক্ত নিঃস্ব বেশে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরিয়া পথে দাঁড়াইতে হইবে। নিরাসক্ত সংসার চাহিয়া দেখিবে, নির্মম শত্রু হাততালি দিয়া হাসিবে। উদরের অন্ন—যাহার জন্য জীবনে কখনও ভাবেন নাই—তাহারই কথা একাগ্র হইয়া ভাবিতে হইবে। স্ত্রী-পুত্র-পৌত্রের ক্ষুধিত মুখ দেখিতে হইবে।
ইহার চেয়ে কি মৃত্যু ভাল নয়?…
মর্মান্তিক চিন্তার তিক্ত সমুদ্রে বৈকুণ্ঠ ডুবিয়া গিয়াছিলেন, সময়ের প্রতি লক্ষ্য ছিল না। হঠাৎ দ্বারের কাছে একটা শব্দ শুনিয়া তিনি চোখ তুলিলেন।
দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া হরিশ প্রবল উত্তেজনায় হাঁপাইতেছেন, চক্ষু যেন ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে—হাতে বাদামী রঙের একটা খাম। অসম্বৃত কণ্ঠে তিনি বলিয়া উঠিলেন—‘দাদা—‘তার’—’।
বৈকুণ্ঠ করুণনেত্রে হরিশের পানে তাকাইলেন, নিজের দুঃখ ছাপাইয়া হরিশের জন্য তাঁহার বুকের ভিতরটা টন টন করিয়া উঠিল। বেচারা! তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে সেও ডুবিল।
গলার স্বর সংযত করিয়া তিনি বলিলেন—‘তুমিই খুলে পড়।’
‘না না, আপনি খুলুন, দাদা—’ হরিশ স্খলিত পদে আসিয়া বৈকুণ্ঠের পাশে দাঁড়াইলেন—‘প্রফুল্ল বলছে—পোস্ট-মাস্টার নাকি মিষ্টি খেতে চেয়েছে—বলেছে আমরা জিতেছি—’
বৈকুণ্ঠের চক্ষু দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়া আবার নিভিয়া গেল, তিনি খাম ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে শুষ্কস্বরে বলিলেন—‘পাগল! প্রফুল্ল ভুল শুনেছে—’
টেলিগ্রাম বাহির করিয়া পড়িলেন, লেখা রহিয়াছে—আন্তরিক অভিনন্দন, আপনি মোকদ্দমা জিতিয়াছেন।
বৈকুণ্ঠের চারিদিকে পৃথিবীটা একবার ঘুরিয়া উঠিল; তিনি সংজ্ঞা হারাইয়া তাকিয়ার উপর এলাইয়া পড়িলেন।
সানাই বাজিতেছে, ঢাকঢোল বাজিতেছে। জমিদার বাড়ি আপাদমস্তক আলোকমালায় ঝলমল করিতেছে। প্রজারা দলে দলে আসিয়া বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া সংকীর্তন করিতেছে, নাচিতেছে, তরজা গাহিতেছে। অন্দরে মেয়েরা শীত ভুলিয়া হোলি খেলা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। রাত্রি শেষ হইতে চলিল, এখনও বিরাম নাই।
বৈকুণ্ঠ আবার সুস্থ হইয়াছেন, বৈঠকখানা ঘরে তাকিয়া হেলান দিয়া নল হাতে বসিয়াছেন। তাঁহার হাতটা এখনও একটু একটু কাঁপিতেছে। অমানুষিক চেষ্টার পর দুস্তর নদী পার হইয়া সাঁতারু যেমন বেলাভূমির উপর লুটাইয়া পড়ে, তারপর আবার সার্থকতার তৃপ্তিতে তাহার অন্তর ভরিয়া ভরিয়া উঠিতে থাকে—বৈকুণ্ঠের দেহ-মনও তেমনি অসীম তৃপ্তিতে ক্রমশ ভরিয়া উঠিতেছে। ঠাকুর মুখ রাখিয়াছেন। ঠাকুর—ঠাকুর—ঠাকুর—
চারিদিকে উৎসব কোলাহল, প্রিয়জনের মুখে হাসি! কিন্তু তবু এই পরিপূর্ণ সফলতার মধ্যেও বৈকুণ্ঠের জীবনের একটি নিভৃত কোণ যেন সহসা খালি হইয়া গিয়াছে, পাশা খেলার ফল ব্যর্থ হইয়াছে। আর পাশা খেলার উপর নির্ভর করিয়া ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে স্থির নিশ্চয় হওয়া চলিবে না—কাণ্ডারীর দিগ্দর্শন যন্ত্র হঠাৎ বানচাল হইয়া গিয়াছে।
বৈকুণ্ঠের মনে হইল আজিকার এই পরম পরিপূর্ণ আনন্দের দিনে একটি আজীবনের বন্ধু তাঁহাকে ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।
১০ শ্রাবণ ১৩৫২