দাড়ি
জয়ন্ত ট্রেন থেকে নেমেই মাকে জড়িয়ে ধরল, প্রণাম করল।
মা ওর চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললেন, হ্যাঁরে, এক গাল দাড়ি রেখেছিস কেন?
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বলল, আমাদের হোস্টেলের সবাই দাড়ি রেখেছে।
এবার জয়ন্ত ওর কাকাকে প্রণাম করতেই বিজয়বাবু ওর বৌদিকে বললেন, জয় আর এখন কচি বাচ্চা নেই। ও এখন আইআইটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।
জয়ন্তর মা বললেন, তাই বলে এক গাল দাড়ি রাখবে? এবার ছেলের দিকে ফিরে বললেন, কাল সকালেই দাড়ি কেটে ফেলবি।
হাওড়া থেকে হরিনাভি অনেক দূর। হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে বড়বাজারের পাশ দিয়ে ব্ৰেবোর্ন রোড ধরে এগিয়ে ডালহৌসিএসপ্লানেড পিছনে ফেলে পার্ক স্ট্রিটক্যামাক স্ট্রিট সার্কুলার রোড, ওরসদয় দত্ত রোড ঘুরে আমীর আলি এভিন ধরে বেশ খানিকটা যাবার পর গড়িয়াহাটের মোড়।
দীর্ঘ পথ। একে চব্বিশ ঘণ্টা রেলে চড়ে এসেছে, তার উপর বাক্সবিছানাবইপত্তর আছে বলেই ট্যাক্সিতে যেতে হয়। যেতে যেতে অনেক কথা হয়!
মা অনুযোগের সুরে বলেন, হারে জয়, তুই ঠিকমতো চিঠি দিস না কেন বল তো?
প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই তো চিঠি দিই।
মা প্রতিবাদ করেন, কোনো মাসে দুটোর বেশি চিঠি দিস না।
তোমাকে না দিলেও বাবাকে বা কেয়াকে তো দিই।
–ওদের চিঠি দেওয়ানা দেওয়া একই ব্যাপার।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করে, ও কথা বলছ কেন মা?
মা কিছু বলার আগেই বিজয়বাবু বললেন, ভালো কথা জয়, সামনের বুধবার চন্দনের বিয়ে।
জয়ন্ত আনন্দে ট্যাক্সির মধ্যেই লাফ দিয়ে ওঠে, পরশুই চন্দনদার বিয়ে!
হ্যাঁ। তোর জন্য ওরা সবাই হাঁ করে বসে আছে।
কোথায় কার সঙ্গে চন্দনদার বিয়ে হচ্ছে?
এবার জয়ন্তর মা বলেন, কেয়া বলছিল মেয়েটা খুব ভালো।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, কেয়া চেনে নাকি?
ওদের লেডি ব্রেবোর্নেই তো পড়তো।
কেয়ার সঙ্গেই পড়তো?
না, এক বছরের সিনিয়ার; তবে কেয়ার সঙ্গে খুব ভাব।
জয়ন্ত আবার প্রশ্ন করে, কি নাম মেয়েটির?
রূপশ্রী।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে, মেয়েটি বুঝি খুব সুন্দরী?
হ্যাঁ।
বিজয়বাবু বললেন, খুব ভালো গান গাইতে পারে।
জয়ন্ত এবার দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রায় আপনমনে বলল, তাহলে ছুটিটা ভালোই কাটবে।
গড়িয়াহাট ব্রীজ পেছনে ফেলে যাদবপুর পার হয়ে গড়িয়ার দিকে এগুতেই জয়ন্ত যেন চোখের সামনে হরিনাভি দেখতে পায়। মনে পড়ে কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, আনন্দের ইতিহাস। স্কুলের কথা, ফুটবল ম্যাচের কাহিনি, হেডমাস্টার মশায়ের কাছে বকুনি, চন্দনদাদের বাড়িতে তাস খেলা, দোলের দিন কেয়ার হাতের আবীর নিয়ে কৃষ্ণার সারা মুখে মাখিয়ে দেওয়া। মনে পড়ছে অনীতার বিয়েতে পাল্লা দিয়ে মোঙ্গার চকের দই খাওয়া, রুমা হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করার পর সারা হরিনাভিতে উৎসব আর আনন্দের কথা। আরো কত কি মনে পড়ছে ওর।
ট্যাক্সিটা খুব জোরে মোড় ঘুরতেই মা বললেন, এসে গেছি।
সামনে গোলাপী রঙয়ের স্কুলবাড়ি দেখেই জয়ন্ত যেন আর স্থির থাকতে পারে। এখানকার প্রত্যেকটা গাছপালাধূলোবালির সঙ্গেও ওর আত্মীয়তা। মিত্তির পাড়ার চেহারা অনেক বদলে গেছে। নতুন ছোট ছোট বাড়িতে মাঠ ভরে গেছে। তা হোক। তবু সবকিছু ওর আপন, পরিচিত মনে হয়।
জয়ন্ত ট্যাক্সি থেকে নামতেই কেয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে নেচে উঠল; খুশির হাসিতে হাসতে হাসতে গোপালবাবু এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন।
কেয়া ওর দাদার দাড়িতে হাত দিয়ে বলল, তুই দিল্লিতে থাকিস বলে সত্যি সত্যি সর্দারজী হয়ে গেলি?
বাসন মাজতে মাজতে পুঁটির মা বেরিয়ে এসেছে। হাসতে হাসতে বলে, হারে, এমন সুন্দর মুখখানা দাড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছিস কেন?
জয়ন্ত মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, বউ দাড়ি রাখতে বলেছে।
দূর হতভাগা! পুঁটির মা আর দাঁড়ায় না, বাসন মাজতে চলে যায়।
ওর কথায় সবাই হাসেন। হাসি থামতে না থামতেই কৃষ্ণা প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য জয়ন্তকে দেখেই কেয়ার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, একটু পরে জয়ন্তদাকে পাঠিয়ে দিস। দাদা ডাকছে।
কেয়া কিছু বলার আগেই জয়ন্ত বলল, চন্দনাকে বল আমি চা খেয়েই আসছি।
কৃষ্ণা দাঁড়াল না। যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটে চলে গেল।
চায়ের কাপটা জয়ন্তর হাতে তুলে দিতে দিতে কেয়া বলল, জানিস দাদা, চন্দনদার বিয়েতে আমাদের ব্রেবোর্নের অনেক মেয়ে আসবে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, অনেক মানে?
অনেক মানে ইন্দিরা আসবে, শিবানী আসবে, মিতা-রিতা আসবে.
কেয়াকে আর এগুতে না দিয়ে জয়ন্ত একটু চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, চন্দনদার বিয়েতেই যদি এতগুলো মেয়ে আসে, তাহলে দেবু যেদিন টোপর মাথায় দিয়ে এ বাড়িতে আসবে, সেদিন তো তোদের কলেজে আর কোনো মেয়ে থাকবে না।
দাদা বলে খুব জোরে একটা চীৎকার করেই কেয়া লজ্জায় ঘর থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে গেল।
দুটো দিন কোথা দিয়ে কিভাবে চলে গেল তা ওরা কেউ জানতেও পারলেন না।
বুধবার সকাল থেকে চন্দনদের বাড়িতে চীৎকারচেঁচামেচি, হৈহুঁল্লোড়, হাসিঠাট্টা, দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে। শুধু চন্দন ছাড়া সবাই ব্যস্ত। জয়ন্তর এক মিনিটের ফুরসত নেই। প্রায় দৌড়ে যাবার পথে চন্দনের মাকে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, কী হল বড়মা?
উনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, কি আর হবে! তোর জ্যাঠার হুকুম তামিল করতে করতেই মরে গেলাম।
চন্দনের মা আর দাঁড়ালেন না। কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। জয়ন্ত উপরে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা দিতেই হঠাৎ পেছন থেকে কৃষ্ণা ডাকল, জয়ন্তদা, একটু শুনে যাও।
জয়ন্ত পিছন ফিরতেই কৃষ্ণা ওকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বেশ গম্ভীর হয়ে। বলল, এই এক গাল দাড়ি নিয়ে তুমি বরযাত্রী যাবে না।
জয়ন্ত দাড়িতে হাত দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল, কেন?
কৃষ্ণা আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বলল, কেন আবার? আমার ভালো লাগছে না।
কিন্তু..
জয়ন্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কৃষ্ণা বলল, তর্ক না করে যা বলছি শোন।
জয়ন্ত নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
সময় যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। চন্দন টোপর মাথায় দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চারদিকে ভীড়। উত্তেজনা। হঠাৎ জয়ন্তকে পাশে দেখে চন্দন হাসতে হাসতে বলল, এমন সুন্দর দাড়ি কেটে ফেললি?
জয়ন্ত গম্ভীর হয়ে বেশ জোরেই বলল, কি আর করব? বউয়ের কথা তো না শুনে পারি না।
ওর কথায় সবাই হো হো হাসেন।
শাঁখ বাজছে, উলুধ্বনি হচ্ছে, বরণ-আশীর্বাদের পালা চলছে। হঠাৎ কৃষ্ণ জয়ন্তর কানে কানে বলল, তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।
জয়ন্ত হাসে।
কৃষ্ণা আবার ফিস্ ফিস্ করে বলে, বিয়েবাড়িতে মেয়েদের সঙ্গে বেশি ফাজলামি করবে না।
জয়ন্ত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, করব না?
কৃষ্ণা বেশ জোরের সঙ্গে বলল, না।