পৰ্ব : ৪
পারিবারিক চিঠি
প্রেসিডেনসি জেল।। ১০ সেল
২৩।১০।৭৫
খুকু
একখানা তারিখবিহীন, ঠিকানাহীন, কাগের ঠ্যাং-বগের-ঠ্যাং পোস্ট কার্ড। আর তার মধ্যে গোটা কতক পাকা পাকা কথা। বুঝলাম বড় মেয়ের চিঠি। হাঁ রে, হাতের লেখা ভাল করলি নে, পরীক্ষেও না-হয় চুলোয় যাক। তোর তো বাবা প্রেম পত্তর লেখার বয়েস হয়ে এল। কী করবি তখন? ঐ হাতের লেখা কেউ যে পড়েও দেখবে না মা। আর কিছু না পারিস তোর মার কাছ থেকে এই ব্যাপারে পাঠ নে।
সত্যি খুকু, এই হাতের লেখা এখনই বদলা। অভ্যাস কর। পরের চিঠি সুন্দরভাবে লিখবি। বাড়ির খবর, দাদুর খবর, ঐ যে মেয়েটা সন্ধ্যে হলেই ঘুমোয়, তার খবর? হজমি দাদু, মীলা, উমাদি, নিমাইদা। এদের খবর কী? সুকোমলবাবু, রাখালকাকা, দেব-মাসীমাদের খবর কী রে?
আমার খবর ভাল। ভাল থাকিস সবাই।
বাবা।
পু: ধুলুকাকার চিঠি এসেছে। তোরা টি ভি দেখতে যাবি। বেশ মজা হবে। ধুলুকে বলবি, চিঠি দিতে দেরি হবে।
বাবা
.
প্রেসিডেনসি জেল।। ১০ সেল
২৩।১০।৭৫
স্নেহের আপু, তোমার এবং শঙ্করের এবং দিদির চিঠি আজ পেয়েছি। আর পেয়েছি অমিত কাকার চিঠি আর আরতি পিসির। তোমার চিঠির মধ্যে অমিত কাকার চিঠি পাঠালাম। তুমি অফিসে ফোন করে অমিত অথবা শান্তিকাকাকে সে কথা জানিয়ে দেবে। আর তীর্থংকর কাকার হাত দিয়ে অমিতকাকার কাছে চিঠিটা পাঠিয়ে দিও।
আরতি পিসিকে বলবে, তাকে পরে চিঠি দেব।
তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। এই জেলে শ্রীঅরবিন্দ এবং নেতাজী ছিলেন। তাঁদের স্ট্যাচু আছে। তোমার [তোমরা?] ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করেছ, খুব ভাল। মন দিয়ে খেলবে। কোনও কাজ, সে খেলাই হোক, আর পড়াই হোক, হেলাফেলা করে করবে না। মন দিয়ে করবে। আলুওলাকে বলবে, আমি ভাল আছি। ভালবাসা জেনো। —বাবা
স্নেহের শংকর, তোমার চিঠি খুব ভাল লেগেছে। কাজ এবং পড়া ভাল করে কর। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে।—মামাবাবু
.
সেল =
Cell
10 CELL
তুলু,
তোমার চিঠিটা আজও পাইনি। সুজিতকে বলো, ওর একখানা চিঠি পেয়েছি। এখানে খাম পোস্ট কার্ডের মাপা বরাদ্দ। তাই সবাইকে হয়ত আলাদা করে সব বারে চিঠি দিতে পারব না।
বইগুলোর কী হল? বাদলকে বলেছিলে? কবে পাব? বর্ধমান থেকে শ্যামাপ্রসাদ একটা ভাল চিঠি দিয়েছে। পরে জবাব দেব। আরতির চিঠি এসেছে। ও আর গৌরী— বাড়িতে গিয়েছিল শুনে খুব খুশি হয়েছি। আইয়ুব কেমন আছেন? একদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওখানে যেতে পারবে?
পূরবী বিষ্ণুদের খবর কি কিছু জান? সুপ্রিয়র খবরই বা কী? সুপ্রিয়, রিক্তা, পথিকৃৎ এবং তুম্পাকে, আমার বিজয়ার ভালবাসা জানিও। আর হারু, কুলপী, ঝুমরুকে। আর সন্দীপন রিক্তা তৃণাকে। আর গৌরীদা, বউদি, খোকন, বুড়োকে। আর নরেনদার বাড়ির সবাইকে। শোভনার চিঠিতে পিসিমণিদের প্রণাম জানিয়েছি। নিরঞ্জনকে আমার কথা বলো।—তোমার গৌর
.
২৭/১০
পু: তোমার ২৪।১০-এর চিঠি এইমাত্র পেলাম। বই এখনও পাইনি। তোমার শোকের খবরও পেয়েছি। তোমার মনে শক্তির একটা অসীম উৎস আছে, তাই তোমাকে পথ দেখাবে। শুধু শরীরটা ভাল রেখো। সাগরদাকে বলো সলিলের ঠিকানা যেন জানান। মামামণির কথা মনে পড়ে। আশ্চর্য, সুধীনদারও। ওঁকে বলো, মন আমার আগেই শান্ত ছিল। এখনও। নানাজন সম্পর্কে হয়ত নানা কথা কানে আসবে। বিচলিত হবে না। যারা আমাকে ভালবাসে, আমার অন্তরই তাদের গ্রহণ করে। অমিত সুপ্রিয়র খবর নিও।
.
শ্রীচরণেষু মা,
বিজয়ার প্রণাম নেবে। শোভনা, শিবু, মীরা ও রাজার চিঠি পেয়েছি। উত্তরও দিয়েছি। দেখা হলে বলো, ভাই ফোঁটা যেন চৌকাঠে দেয়। এখানে আসবার দরকার নেই। তোমার ওষুধ আছে তো? তোমার ওষুধ হচ্ছে:-
1) Adelphane, 2) Esidrex 50, 3) Cardioxine, 4) Peritrate SA, 5) Potklor, 6) Equanil 400, 7) Novalgin— না থাকলে আনিয়ে নেবে।
এবার ছোটমামা, বাদলমামা, বিনোদমামা, হয়ত তোমার এখানেই ফোঁটা নেবেন। ছোটমাসীমাকেও ডেকে এনো।
সেজো মেসোমশাই বাড়িতে এসেছিলেন। শুনে খুব ভাল লাগল। শরীরের যত্ন নেবে। আমার শরীর ভাল। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট নেই। ভাবছি আবার ওজন বেড়ে না যায়। প্ৰণাম। —গৌর
.
প্রেসিডেনসি সেল (জেল),
১০ সেল
৩।১১।৭৫
তুলু
ঘরে ফিরেই তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। কত কথা বলব বলে অপেক্ষা করে থাকি। হট্টগোলে কিছুই বলা হয়ে ওঠে না। তুমি শুক্রবারে আসবে বললে, আপ্পা কবে আসবে? এবারে কাজের কথা বলি। (১) ইজিচেয়ারের ক্যানভাসটা— যাতে ঠেস দিয়ে বসতে হয়, শম্ভুকে তাড়াতাড়ি কিনে দিতে বলবে। জেলের ভরসায় থাকলে আর চলবে না। সবাইকে বলে বলে হয়রান হয়ে গিয়েছি। ক্যানভাস বা ভাল শক্ত সুতোর বোনা কাপড়েও চলবে। তবে রেকসিন, প্লাসটিক বা হাল চলতি কোনও জিনিষ যেন না হয়। সব চেয়ারেই মাপ এক। তবে দুপাশে কাঠি ভরবার যে জায়গা তার সেলাইটা যেন ভাল হয়। বাবুয়ার বউএর হাতে পাঠিয়ে দিও। (২) গ্যাবারডিন অথবা টেরিকটের প্যানট এবং ফুলহাতা সবুজ গেঞ্জিটা পাঠাতে পার, অল্প শীতে ভাল হবে। গেঞ্জির বোতাম লাগিয়ে দিও। তারপর দুটো গেঞ্জিই কেচে পাঠিও। (৩) চিনি এনো না। শুধু চা আনবে, একটু বেশি করে। আর কিছু না। (৪) প্রত্যেককে বলবে ডাক মারফৎ চিঠি পাঠাতে। আমার বাড়িতে কেউ যদি চিঠি দিয়ে যায়, তুমি সেগুলোকে ডাকে পাঠাবে।
এবারে একটা জরুরি কথা: আমাকে এমারজেনসি মিসায় Group B দিয়েছে। আমি শুনলাম আমার যা সামাজিক মর্যাদা তাতে আমাকে Group C দেওয়া উচিত। অনেককে তাই দিয়েছে। সম্প্রতি একজন মামলা লড়ে Group C আদায় করেছেন। Group C-রা নাকি জেলে নৈকষ্য কুলীন। আমিও তার জন্য হাইকোর্টে লড়তে চাই। তুমি এ বিষয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পার। মুশকিল কি জান, একজন ভাল উকীল— দুধে ও সাহসী উকীল আমার নেই। থাকলে নাজেহাল করে দিতাম। সেক্সপীয়ারের নাটকের নায়ক রাজা তৃতীয় রিচারডের মত আর্তস্বরে “একটা ঘোড়া একটা ঘোড়া, আমার রাজ্যের বিনিময়ে আমাকে একটা ঘোড়া কেউ দাও”— এই কথা বলে রণক্ষেত্রে আমাকেও কি চেঁচাতে হবে? ধন্য দেশ!
ওদের জিজ্ঞেস করো। তবে ১৮ মাসে বছর যেন না করেন। ওরা যদি না পারেন, জানিও, আমি নিজেই তখন অন্য চেষ্টা করব। কাজের কথাতেই চিঠি ফুরিয়ে গেল। তুলু, তুমি আমার পাশে আছ। তোমার আত্মমর্যাদা বোধ আমাকে সদাই সংগ্রামে সাহস জোগায়। তুমি কারোর কাছে কোনও সুবিধা চাও না— এইটাই আমার জোর। কোনও অনুরোধ কোনও অফিসারের কাছে আমার জন্য করব (না)। ওদের বরাদ্দ যা, তার বেশি আমরা কোনও কিছুই নেব না। ওরা যদি একজন আসতে দেয়, একজন আসবে। তল্লাসী করতে চায়, দেবে— তবে যার তার কাছে নয়। তুমি বলবে D/O পদমর্যাদার মেয়ে অফিসার ছাড়া আর কাউকে তল্লাসী করতে দেব না। কেন না তুমি Division 1-এর কয়েদীর সঙ্গে দেখা করবে। না হলে তুমি ফিরে যাবে। পরবর্তী ব্যবস্থা আদালতে হবে। এইসব খুঁটিনাটি তুমি বরং একদিন প্রতাপদার কাছে গিয়ে জেনে নিতে পার।— গৌর
পু: গৌরীকে বলো, ও আমার চোখে জল এনে দিয়েছে।
.
প্রেসিডেনসি সেল (জেল)
১০ সেল
৩।১১।৭৫/সন্ধ্যে ৬
খুকু,
চমৎকার, খুবই চমৎকার হয়েছে। এইমাত্র পড়ে শেষ করলাম। সবদিক থেকেই উপভোগ্য। আমি মনে করতে পারিনে, তোর এই বয়সে আমি এত ভাল গদ্য লিখতে পেরেছি কি না? বিষয়, বর্ণনা— সব ঠিকঠাক তাল রেখে চলেছে। এইখানেই ওস্তাদী। লেখার এই রকম হাত টিকিয়ে রাখতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। এবার টুনটুনিও আমাকে অবাক করেছে। ছন্দে কোনও গোল নেই।—বাবা
.
টুনটুনি,
এতদিন পরে ছন্দ তোমার বশে এসেছে। প্যারোডিটা চমৎকার। এবার তোমাদের দুজনের রচনাই ভাল উৎরেছে। বিশেষ করে “করিলে চেষ্টা, এই বিষয়টা…” এই অন্তে মিলটা রীতিমত বিস্ময়কর। পরীক্ষা চলছে? চলছে চলবে। তারপর “ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি” এখানেও অন্তে মিল। সহজ এবং স্বতঃস্ফুর্ত। তাই এত ভাল। আর এই পংক্তির পরেই “সেদিন— বিছানাটি ছেড়ে… বড় ব্যথা হল গায়।”— সাধু সাধু! পাকা হাতের কাজ। হজমি দাদুকে পড়িয়েছিস?—বাবা
.
খুকু, রিক্তা কাকীমাকে ফোন করে এই চিঠিটি পড়ে দিবি। তোর মা বলল, আমাদের ফোন খারাপ। অন্য কারো ফোন থেকে পড়ে দিস। এটা জরুরি।
রেখা, এটা কি সত্যি যে আমার এক স্নেহভাজন পাগল খালি পায়ে তুমপাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল দেখে বিরাট শিশুটি ভয় পেয়ে পুলিশে ফোন করেছিল? খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছি। আমাকে চিঠি লিখে জানিও।
গৌরদা
.
১০ সেল,
প্রেসিডেনসি জেল,
আলিপুর,
কলকাতা
১১।১১।৭৫
স্নেহের আপু,
আশা করি, এতক্ষণে মনটাকে পরীক্ষার জন্য তৈরি করে ফেলেছ। এবার তোমার পড়া বিশেষ তৈরি হয়নি। কাজেই যদি প্রচুর না খাটো তবে পরে দুঃখ পেতে হবে।
আমি লক্ষ্য করেছি, ছাত্র হিশাবে তোমার দুটো দোষ। এক, তুমি অমনোযোগী। দুই, তুমি অলস। এই দুটো দোষ তুমি যদি শোধরাতে না পার, তবে মানুষ হিশাবেও তোমাতে এই দোষ থেকে যাবে। যার ফলে তোমাকে সারাজীবন দুঃখ পেতে হবে। যে মানুষ কোনও বিষয়ে মন দিতে পারে না, এবং যে কাজে ফাঁকি দেয়, সে জীবনে কিছুই হতে পারে না। তার পড়াও নষ্ট হয়, খেলাও নষ্ট হয়। তুমি যদি এই বিষয়ে এখনই সাবধান না হও তবে তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে।
তোমাকে যদি ভালভাবে পাশ করতে হয়, যদি সম্মান চাও, তবে সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে যাও। চেষ্টা, বার বার চেষ্টার দ্বারা ইংরাজী, অংক, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয় আয়ত্ত করা।
তুমি দেখেছ, আমি জেলে আছি। ভবিষ্যতে কী আছে, জানিনে। যদি পরীক্ষার ফল ভাল করতে না পার, হয়ত আর পড়াশুনাই হবে না। সেটা কি ভাল হবে? এটুকু বোঝবার বয়েস তোমার হয়েছে। আমরা সকলেই তোমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু তুমি নিজেকে যদি নিজে সাহায্য না কর, তবে কিছুই হবে না। আশা করি পরীক্ষা ভালই দেবে। ভালবাসা জানবে।—বাবা
পু: ফেরৎ ডাকে চিঠির জবাব দেবে।
.
প্রেসিডেনসি জেল /১০ সেল
২০.১২.৭৫
প্রিয়তমাসু, তোমার এবারের চিঠির অন্তর্নিহিত বিষণ্ণতা আমার মনটা কিঞ্চিৎ ভারাক্রান্ত করে দিয়েছে। গতকাল চিঠিখানা পেয়েছি। কালই, তালাবদ্ধ হবার পরই, উত্তর লিখতে বসেছিলাম। আজ আর সেই চিঠিখানা ডাকে দিতে ইচ্ছে করল না। তাই এবার নতুন করে লিখতে বসেছি।
আমি জানি, তোমাকে কি ভারী বোঝাটাই না বইতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। শুধু তো সংসারের বোঝাটাই নয়, মনের বোঝাটার ভারও কম নয়। তুমি যদি অন্য ধাতুতে গড়া হতে, তবে হয়ত ইনিয়ে বিনিয়ে তোমাকে সান্ত্বনা দিতে বসতাম। কিন্তু আমি তোমাকে জানি, তুমি বৃথা সান্ত্বনা ও স্তোকবাক্যের ঊর্ধ্বে। তাই তোমাকে বাস্তব সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই। সত্য কঠোর, কিন্তু নিষ্ঠুর নয়। কারণ যেখানে সত্য সেইখানেই কল্যাণ। তাই সত্যকে কখনোই ভয় পেয়ো না। এবারে শোনো, আমার সম্পর্কে সত্য কথাটি এই যে, আমার আশু মুক্তির কোনও সম্ভাবনা নেই। অতএব তোমরা সেইভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করে তোলো। ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েদের মনকেও সেইভাবে তৈরি করে তোলো। কাজটা কঠিন। তবে তুমি পারবে, সে ভরসা রাখি। আমিও আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব।
হাইকোরটের আবেদনের উপর কোনও ভরসা রেখো না। ওটা আমার মুক্তিতে সাহায্য করতে পারবে না, তবে সংগ্রামের শেষ সম্বল হবে, এইটুকুই ওর দাম।
যে সুস্থ আবহাওয়ায় আমরা নিঃশ্বাস নিয়েছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদেরও নিঃশ্বাসবায়ুর সঙ্গে সেই নির্মলতা অন্তরে গ্রহণ করুক, দায়িত্বশীল পিতা হিসাবে তার ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছি এবং বিবেকের নির্দেশে সেই কর্তব্য সম্পাদনে এগিয়েছি। এর বাইরে আমি আর কিছুই করিনি। কোনও বড় কাজ নয়, কোনও মহৎ কাজ নয়, শুধু মাত্র কর্তব্যটুকু করেছি। এবং করবও। প্রলোভন, ভ্রূকুটি, আজীবন কারাবাস অথবা শিরশ্ছেদ— কিছুই আমাকে নিবৃত্ত করতে পারবে না।
তোমাকে আমি কিছুই হয়ত দিতে পারিনি, সেই অর্থে যে অর্থে আমার বন্ধুরা নানা উপকরণে সজ্জিত করে তাঁদের স্ত্রীদের ওজন বৃদ্ধি করেছেন। আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। কেউ এতে ক্ষতি বোধ করলে আমার কৈফিয়ৎ কিছুই নেই। তবে আমার সন্তানদের আমি দিয়েছি এমন একটা পরিচয় যা একদিন আমার বন্ধু কেন শত্রুদের পক্ষেও ঈর্ষার কারণ হবে। “আমাদের বাবা এবং মা প্ৰকৃত মানুষ ছিলেন,” এই কথাটা আমাদের সন্তানেরা যতটা স্বাভাবিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারবে এমন আর কে পারবে? হয়ত এর কোনোই দাম নেই, হয়ত উপকরণের নগদ দামই আসল। তা বেশ তো, সেই পথ তো তাদের সামনে খোলাই রইল। ঝাঁকের কই ঝাঁকেই না হয় মিশে যাবে।
তাবলে আমি আমার কর্তব্য কেন করব না? এবার তোমাকে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা কথা শোনাই। এই বুড়োটা শেষ বয়সে আমার মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে। তুমি যাদের লক্ষ্য করে লিখেছ, “তাতে কি লাভ হল? তোমার বন্ধুদের পরিবারের সাথে আমি কত আলাদা। কি সাধারণ বেশভূষা”— এইবার শোনো তাঁদের সম্বন্ধে ঐ বুড়োটা কি লিখেছেন— “আমরা তো নকল মানুষ। অনেকটা মানুষের মতো। ঠিক মানুষের মতো খাওয়া দাওয়া করি, চলিয়া ফিরিয়া বেড়াই, হাই তুলি ও ঘুমোই— দেখিলে কে বলিবে যে মানুষ নই।” অবশ্য সাংসারিক লাভ ক্ষতির অংকে এই উত্তরে পাশ নম্বর পাওয়া যে যাবে না, তাও জানি। তবে এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছ যে ঐ অংকে আমি বরাবরই কাঁচা।
আমার ছোঁড়া তীর লক্ষ্যে বিঁধেছে বলে খবর পেয়েছি। অতএব নতুন নিগ্রহের জন্য তৈরি হচ্ছি। আমার গল্প এবং প্রবন্ধের ইংরাজি তর্জমা কি হয়েছে। দেখো, প্রকাশকদের কাছে যেন ঠিক সময়ে পৌঁছোয়। আবার বলি, আমার জন্য ভেবে লাভ নেই। নিজেদের শরীরের দিকে নজর দাও। সামনে বিরাট চড়াই, হে যাত্রী, শক্তি সঞ্চয় করো। ভালোবাসা— আরও ভালোবাসা। গৌর— এমারজেনসি মিসা কয়েদী
ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই শীতে নিশ্চয়ই কিছু একটা করছ। করো, আমার ভালো লাগবে। তুমপার কেক— ভুলো না।
.
প্রেসিডেনসি জেল, ১০ সেল/ ১ জানুয়ারি ১৯৭৬
তুলু, এবারে তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা। এবং পরীক্ষা কঠিন। এ বিষয়ে তোমার মাকে আদর্শ গ্রহণ করে দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হও। সত্য এবং কল্যাণের উপর অবিচল আস্থা যেন থাকে নাহলে মাঝপথেই বসে পড়তে হবে। আমি দেখছি, সামনে বড়ই দুর্যোগ। এবার বোধ হয় কিছু বড় গাছ ভেঙ্গে পড়বে। এবারে শোন: ১) তুমি অবিলম্বে বাদল বা নিশি কাউকে দিয়ে ১০ কপি হিং টিং ছট্ প্রকাশক ব্রজ মণ্ডলের কাছ থেকে আনিয়ে নেবে। এখানে আসবার সময় এক কপি বই অবশ্যই আনবে, এক কপি ভবানীর হাত দিয়ে গৌরীপ্রসাদ বসুর কাছে পাঠিয়ে দেবে। বাকি কপিগুলো সুজিত বা শম্ভুর হেফাজতে পাঠিয়ে দেবে। হ্যাঁ, এক কপি বাড়িতেও রাখবে। ২) চা, মধু, খানিকটা ফর্সা ন্যাকড়া আনবে। ৩) প্রকাশকরা কে কত টাকা দিল, তার একটা হিসাব আনবে। ৪) মাকে বলবে, শীঘ্রই তাকে চিঠি দিয়েছি। ৫ ব্যাংকের পাশ বইগুলো পাঠিয়ে সুদ কষিয়ে রেখে দিও। ৬) খুকুকে যে-সবগুলো খুঁজতে বলেছি যদি পারে যেন খুঁজে দেয়। ৭) তুমি অবশ্যই মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাসখানা পড়ে ফেলবে আর ওটা হাতছাড়া করবে না। ৮) সন্দেশ ফন্দেশ আর এনো না।
নূপুরের কেক অনেকে মিলে খেয়েছি। ও কেমন আছে? আপ্পার নতুন ঠিকানা কী? ওর ঘরে কে কে? শংকু এবং শুভ্রর ফলাফল কী?
অরুন্ধতীকে কি বলেছ, ওর দেওয়া জামা-পায়জামা আমার খুব উপকার দিয়েছে।
তোমার উপর বড্ড চাপ পড়েছে, বড্ড চাপ! তোমার জন্য আমার খুব উদ্বেগ হয়। তবে মেয়েরা ছেলে যদি তাদের দায়িত্ব পালন করে যায় তবে উদ্বেগ অত থাকে না। আর ওরা কাজ তো করছেই। নিজের তাগিদে করুক, আমি এই চাই।— গৌর
.
১১। ১।৭৬
মাকে
শ্রীচরণেষু মা, তোমার দুটো চিঠিই পেয়েছি। লেখার সরঞ্জাম ছিল না। তাই দেরি হল। আমার শরীর এই শীতেও যে ভালো আছে, তার কারণ জেল-কর্তৃপক্ষ আমার ভালোভাবেই দেখাশুনা করছেন। ডঃ বোসও আমাকে দেখে গিয়েছেন। তুমি ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছ তো? ওখানে শীত নিশ্চয়ই বেশী পড়েছে। এখন দিনকতক সকালে এবং ঠান্ডা জলে চান করো না। আর যদি শরীর ভালো থাকে তবে নাহয় পুটেদের ওখানে দিনকতক ঘুরে আসতে পার। অবশ্য বাড়ির যদি অসুবিধা না হয়।
ভণ্ডুলে চিঠিখানা পেয়েছে শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। বাবাকেও একখানা চিঠি দিয়েছি। পেলে খুশি হব।
ছোটমামাদের খবর কি বল তো? বিনোদমামারা কি এবার এসেছিল। সেজ মেসোমশাই-এর শরীর কেমন আছে? বাদল মামা, রাঙ্গাদিদিমার খবর আশা করি ভালোই আছে। তোমার, রাঙ্গাদিদিমার, তিনা মাসীমার এখন তো “হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যে হল, পার কর আমারে”- গান গাইবার সময় হয়ে এল। এখন প্রসন্ন মনে সকলে খেয়াঘাটে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু কর। ইহকালের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, জমা-খরচ সব সমান সমান করে ফেল। দেনা-পাওনা সবই তোমার ঠাকুরকে বুঝে নিতে বলো। এত যে খাওয়ালে পরালে তা এখন সে ব্যাটা এসে বুঝে নিক সব। তোমার বোঝা হালকা করে দিক। মনের ভয় কাটিয়ে দিক। আনন্দে প্রেমে ভরিয়ে দিক তোমার মনটাকে। ডাকো ব্যাটাকে। নাকে সরষের তেল দিয়ে কোন চুলোয় ঘুমুচ্ছে সেই অকর্ম্মার ধাড়িটা। ধমক লাগাও। কি গো? আমাদের যেমন করে ধমকাতে সেই রকম গোটা কতক দাও দিকিনি। তখন দেখবে বাছাধন, পথে আসবেন। আর তোমার ডাকও শুনবেন। সাবধানে থাকবে। প্ৰণাম
তোমার গৌর
.
প্রেসিডেনসি জেল/ ১০ সেল
১৯।২।৭৬
প্রিয়তমাসু, তোমরা তো চলে গেলে। তারপর সোমবারেই চিঠি এল। নাকি মঙ্গলবার? সন্ধ্যার পর তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। চার পাঁচ লাইন লিখেছি কি না লিখেছি, শরীর খারাপ লাগতেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জ্বর, গায়ে ব্যথা এবং প্রচণ্ড অরুচি। সেই যে শুলাম, আজও ঘর থেকে বের হইনি। তবে জ্বর ছেড়েছে কাল। বুকে কোন গোলমাল নেই। ফণী যন্ত্ৰ দিয়ে দেখে গিয়েছে। মুখে রুচি অতি ধীরে ফিরে আসছে। চিঠি না লেখার কারণ এই
এবারে একটা ভাল খবর। হাইকোরট আমাকে Group C মঞ্জুর করেছেন এবং আমি যেভাবে প্রত্যাশা করেছিলাম সেইভাবে। সুপার-সাহেব অনুগ্রহ করে নিজে এসে হাইকোরটের রায় পড়িয়ে গেলেন এবং আমাকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাইরে থাকবার ব্যবস্থাও করে গেলেন। খাওয়া দাওয়ার সুবিধাও আগের চাইতে ভাল হবে। গোবিন্দ চন্দ্রের জয় হোক। ওকে অভিনন্দন জানিও। আর বলো, আমার সঙ্গে অবিলম্বে লিগ্যাল ইনটারভিউ যেন করে। হাইকোরটের রায়ের নকলটা যেন সঙ্গে আনে। গাগরুদাকে খবরটা দিয়ে বলো, তারকুণ্ডেকে যেন খবরটা জানানো হয়। রায়ের নকল তাঁকেও পাঠাতে হবে। গৌরী, ডঃ বোস বা অন্যদেরও খবরটা দেবে। এইটুকু চিঠি লিখতেই জিব্ বেরিয়ে গেছে। আশা করি সব কুশল, ভালোবাসা। গৌর
পু: ইনটারভিউ একমাস বন্ধ। আমার সাজা। বিস্তারিত পরে জানাব।
টুনটুনকে ফরমায়েস
১) কলকাতা থেকে বলছি
২) জিরাফের সন্ধ্যা-সঙ্গীত
৩) আইয়ুবকে— দুটি বুনোফুল
৪) কলকাতার বাবু-বিবেক
৫) শ্রীসত্যজিৎ রায় প্রিয়বরেষু
৬) স্যামসন, প্রিয়তম বন্ধুর উদ্দেশ্যে
(ক) উপরের সব কবিতাগুলো তোমরা একটা খাতায় কপি করে রাখবে।
(খ) একটা বাঁধানো খাতায় আমাকে তাড়াতাড়ি কবিতাগুলো কপি করে পাঠাবে— জেলে ফিরে যাবার আগেই যেন পাই
গ) এই খাতাটা কালাদাকে পাঠিয়ে দেবে— বলবে আমাকে যেন স্যামসন সম্পর্কে মতামত পাঠায়— আমার খুঁতখুঁতি এখনো যায়নি — ক্রমাগত পাঁচদিন রোজ ৬।৭ ঘণ্টা করে এর পিছনে খেটেছি— হারুকে অবশ্য পড়াবে— ওর মত চাই— আপাতত ধুলু খান্দু ছাড়া আর কাউকে নয়। মনে হয় মেরামত আরও কিছু হবে।
টুনটুন, খাতাটা ভালোই হয়েছে। তবে (১) কবিতাগুলো এলোমেলো সাজানো হয়েছে এবং (২) “কলকাতা থেকে বলছি” কবিতাটা নেই। ওটা বাড়ির খাতায় যত্ন করে তুলে রেখো।
বড়মেয়ে, পরীক্ষার প্রস্তুতির ব্যাপারে খুবই যে ব্যস্ত, তা বুঝতে পারছি। আগেও বলেছি, আবারও বলি, পরীক্ষাটা একটা ট্রিক্স্। মাথাটি ঠান্ডা রাখলে নির্ঘাৎ বাজীমাৎ। নির্ভয়ে, ঠান্ডা মাথায় একবার কি দুবার প্রশ্নপত্রটা পড়ে শুধু বুঝে ফেলা যে কী জানতে চেয়েছে তোমার কাছ থেকে। তাহলেই তো কেল্লার অর্ধেক ফতে। বাকি অর্ধেক to the point উত্তরে এবং পরিষ্কার হস্তাক্ষরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
.
তুলু,
১) সোমবার আমার ছুটি হচ্ছে।
২) শনিবার তোমার পক্ষে কি গোটা ৮০ (আশি) পেরাকি বানিয়ে আনা সম্ভব হবে? ডাক্তারবাবু, সিস্টার ইত্যাদিকে তাহলে ২/১টা করে খাইয়ে দেওয়া যেত। যা হয় আমার কপালে, এরা আমাকে কিঞ্চিৎ ভালোবেসে ফেলেছেন। যদি না তৈরি করতে পারো, তাতেও ক্ষতি নেই। কখন এখানে আসবে?
৩) আইয়ুবের লেখাটা কিছুটা এগিয়েছে। শেষটা মনের মত এখনও হয়নি।
৪) রবিবারে অবশ্যই নীল পাড় খদ্দেরের ধুতিটা আনবে আর জেলের গামছা আর পাঞ্জাবী— যে পাঞ্জাবীটা জেলের টাকায় করা।
৫) হিং টিং ছট্ এবং ব্রজদার গুল্প সমগ্র— আনবে।
৬) সেদিন শেষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে যাওনি। মণীন্দ্রবাবুর কাছে ১০ টাকা দিয়ে দিও। পকেট একেবারে শূন্য
৭) খুকুর অংক কেমন হল? কাল রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত ফোনের কাছে বসেছিলাম।
৮) আজ ঝুনুদি, শালকি আসবে। গত কাল মন্টুদা ঝুনুদি এসেছিলেন।
।৯) সোমবারে হঠাৎ আরতি আর রুচিরা এসে হাজির। কী সাহস!
১০) শনিবার কি এখান থেকে আইয়ুবের ওখানে যাবে? সকালে মামামণিকে একটা ফোন করো।
১১) ভারবির রামায়ণের শেষ অংশটা কি বেরোয়নি? যদি পারো বাদলকে জিজ্ঞেস করো। পরে করলেও চলবে? মহাভারতেরও একটা বাকি আছে। বোধ হয় পঞ্চম। নূপুর বোধ হয় জানে।— ৫ / ৫
১২) জিনিষপত্র যা জমে গিয়েছে। আরতির শিঁকেয় ধরবে বলে মনে হয় না। রবিবার একটা সাইড ব্যাগ এনে দিও। পরে ফেরৎ দেবো।
.
১ বৈশাখ ১৩৮৩
মা, নববর্ষের প্রণাম। আমি ভালো আছি।
[ওপিঠে]
বড় মেয়ে, নববর্ষের ভালোবাসা।
[ওপিঠে]
টুনটুনি, নববর্ষের ভালোবাসা।
[ওপিঠে]
শঙ্কর, নববর্ষের ভালোবাসা।
[ওপিঠে]
তুলু, তুমি আমার নববর্ষের ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা জেনো। আর নৃপেনদাকে এই স্লিপটা দিও। [ওপিঠে]
.
তোমার এবার ঝরার পালা, ধন্য তুমি, হে পুরাতন বৃক্ষ
তোমার দানেই পুষ্ট ধরা, পূর্ণ অন্তরীক্ষ ॥
দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভ্রান্তি ভয় দূর হোক জীর্ণ পত্র প্রায়
নতুন উৎসাহে প্রাণ ভরে যাক শাখায় শাখায় ॥
হে নবীন, হে নূতন, হে সজীব আশা
কানায় কানায় পূর্ণ করে তোলো ভালোবাসা ॥
আজ যে কচি কাল সে বড় হবে, হবেই হবেই হবে
ইচ্ছে যদি চেষ্টা যদি থাকেই থাকে তবে ॥
[তোমাকে শুধুই ফরমাশ, হে আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস।]
তুমি কি নিশীথকে বলে SCOPE-স্কোপ-কাগজটা রবিবারে পাঠাতে পারবে? অফিসে আমার নামেও একটা আসে। আর মহাভারত— ৫ খণ্ড বেরিয়েছে। এবার যেন কিনে ফেলে।
.
নিবেদন
(আপ্পু ও নূপুরকে)
পুরাতন বৎসরের শেষ সূর্য কিছুক্ষণ বসে অস্তাচলে
বিদায় নেবার আগে কী আশ্চর্য কথা গেল বলে!
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে এঁকে দিয়ে অপরূপ
শোভা প্ৰশান্ত ছটায়
মমতা মাখানো মৃদুস্বরে ডাক দিল, এবার বিদায়!
যা ছিল আমার কাজ শীতে গ্রীষ্মে হেমন্তে বর্ষায়
ক্লান্তিহীন কর্তব্যের ভার
দায়িত্ব অপার
সব কিছু করেছি সমাধা।
কোনো কাজ কখনোই করে আধা-আধা
কোনোদিন রাখিনিকো ফেলে।
প্রকৃতির নিয়ম কঠিন,
কাঁটায়-কাঁটায় তাই আবর্তিত হয় রাত দিন।
সুনিয়মে সেই হেতু
আসে যায় ঋতু।
যদি এর কিছুমাত্র নড়চড় হয়
মুহূর্তে প্রলয়।
এই কথা বলে যাই বছরের অন্তিম বিকেলে।
জগতের গতির পাল্লায়
যে-পাল্লা পারে না দিতে আপন পৌরুষে
সে রবে পিছনে পড়ে।
দুর্বল হাতি যতই অঙ্কুশে
বিদ্ধ তাকে কর, সে
যেমন পড়লে কাদায়
ক্রমেই তলিয়ে যাবে,
যতই করি না হায় হায়
তেমনি নিয়মে যে-রবে পিছনে পড়ে সে-রবে পিছনে
পৃথিবীর উদাসীন নিত্য আবর্তনে
পক্ষপাতিত্ব নেই।
পিছনের সারি
ধনে মানে বংশের গৌরবে যতই হোক না কেন ভারি
তার কাছে মাত্র আবর্জনা।
যে-পারে এগিয়ে যেতে নিজের চেষ্টায়
অক্লান্ত উদ্যমে কর্তব্যের দায়
যে দেয় উশুল নিত্য কড়ায় গণ্ডায়
সেই শুধু পায় মার্জনা।
তাই এই যাবার বেলায় সবারেই ডেকে বলে যাই
ভাই কাজে কিছুতেই দিও নাকো ফাঁকি।
নিজে ফাঁকে পড়ে যাবে,
জীবনের সতর্ক হিশাবে
টেঁকে না চালাকি।
বছরের শেষ সূর্য স্মিত হেসে এই কথা বলে
পুরানো শেলেট মুছে দিয়ে গেল চলে।
এস এস কে এম হাসপাতাল
হৃদরোগ বিভাগ,
১ বৈশাখ ১৩৮৩
.
স্পেশাল সেল/প্রেসিডেনসি জেল/ ২৭ জুলাই ১৯৭৬
টুনটুন, তোমার মাকে লেখা চিঠিখানা যদি ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়ে থাকে তবে তো আমার খবর পেয়েই গিয়েছ। এর ভিতর নতুন খবর এই যে আমার বাসা বদলেছে। অতএব এবার থেকে নতুন ঠিকানায় চিঠি দেবে।
আমি […] দোতলা বাড়ির দোতলার একটা ঘরে থাকি। আমার ডান পাশে […] বিখ্যাত “নেতাজী সেল”। নেতাজীকে যেখানে রাখা হয়েছিল এখন সেটা স্মৃতিতে পূর্ণ। নেতাজীর জন্মদিনে এখন সেটা সাজানো হয়
আমার ঘরের সামনেই বারান্দা— আমি সেখানে বসেই তোমাকে চিঠি লিখছি। এবার আকাশ দেখার খুব সুবিধে। আর আমাদের ঘেরের মধ্যে কত গাছপালা। অধিকাংশই বন্দীদের লাগানো। বছরের পর বছর— সেই বৃটিশের আমল থেকে— ধরে কারা যে এত গাছ লাগিয়ে গিয়েছে কে জানে? এই তো আমার প্রায় নাগালের কাছেই একটা বিরাট স্বর্ণচাপার গাছ। দোতলার ছাদ ছাড়িয়ে তার মগডাল উঠে গিয়েছে— এবং আশ্চর্য, আমি তো স্বর্ণচাপা ভালোবাসি, তাই এ-ডালে ও-ডালে একটা দুটো করে ফুল আমার জন্য জমিয়ে রেখেছে এখনও। এই গাছটার পাশেই ছোট পাঁচিল আর পাঁচিলের ঠিক ওপারেই ঝাঁকড়া একটা গন্ধরাজের গাছ। তাতেও দেখি একটা দুটো ফুল ফোটে। আর আমাদের ঘেরের মধ্যে কত দোপাটির গাছ, ফুলে ভর্তি। একটা ছোট্ট ঝাকড়া গাছে অতসীর লতা গাছটাকে প্রায় ঢেকেই দিয়েছে— আর তাতে ফুটে রয়েছে অপরাজিতা অতসী। একটা সুন্দর ছোট্ট ঝাউ গাছও আছে। আছে শীর্ণ গোলাপ নানা রঙের। এখান ওখান থেকে ডিগডিগে রজনীগন্ধাও উঁকি দিচ্ছে। কাঠগোলাপেও ফুল রয়েছে বেশ।
আরও যে কত গাছ— তিনটে পাম, গোটা কয়েক আম, পেয়ারা, পাতি লেবু, এমন কি লংকার গাছও আছে। আর কয়েকটা বাহারি কচুর গাছ। এই কচু গাছ দেখলেই আমাদের মথুরাপুর গ্রামের কথা কেন যে মনে পড়ছে!
এ তো গেল আমাদের সীমানার ভিতরকার কথা। সীমানার বাইরেও বেশ গাছ— আম আর অশত্থ— দূ-রে একটা নারকেল গাছও উঁকি দিচ্ছে।
আর কত যে পাখি। এতদিন কাক আর ডাক চোখ-কান প্রায় পচিয়ে দেবার জোগাড় করেছিল। কাকের আধিপত্য এখানেও যে নেই— কোথায়ই বা নেই, বল?— তা নয়, তবে অন্যান্য নানা জাতের পাখির কর্মচঞ্চলতা একটা বৈচিত্র্যের স্বাদ এনে দিয়েছে। অতএব আমার জন্য তোমরা কোনো চিন্তা করো না। আমি এখন শরীরের যত্ন নিচ্ছি।
এখন তোমরা নিজ নিজ কর্তব্য সাধনে মন দাও। তোমার এবং তোমার দিদির দায়িত্বের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে, এটা মনে রেখো। নিজেদের পড়াশুনা এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপারে এবার থেকে নিজেরাই যত্ন নেবে। উপরন্তু চেষ্টা করবে মা আর বুঠাকুমার শরীর ও মনের ভার যতটা সম্ভব লাঘব করবার। আর ভাই একেবারে একা থাকে, ছোট, একথা সর্বদা মনে রাখবে। তাকে উৎসাহ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে তাজা রাখবে।
.
।। সন্ধ্যের পরে।।
টুনটুন, তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছিলাম দুপুরে। গলগল করে ঘামছিলাম। এমন সময় বৃষ্টি নামল। আর কোত্থেকে হাঁস অথবা পানকৌড়ি, বক, কাক প্রভৃতি আমার চোখের সামনে উড়ে উড়ে মহা ফূর্তিতে ভিজতে লাগল। তারপর কোত্থেকে হাজির হল ছাতারে পাখির ঝাঁক। দল বেঁধে তারা যেন বৃষ্টিঝরা আকাশে নাচ শুরু করে দিল। চিঠি লেখা চুলোয় গেল। খালি ওদের খেলা দেখেই সময় কেটে গেল।
এখন ফাঁক দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখছি, একেবারে অন্ধকার। দূরে কোথাও হয়ত রেডিও বাজছে। গানের সুর কানে ভেসে আসছে।
হাসপাতাল থেকে হঠাৎ চলে আসতে হল। তবে আসবার সময় আমার ঘর ভিড়ে ভরে গিয়েছিল। ডঃ কিশোর নন্দী না-খেয়ে-দেয়ে বসে ছিলেন। সিসটাররা এসেছিলেন। ১ নম্বরের নমিতাদি, তাঁর বন্ধু ব্যানার্জীদি, বোস মশাই— আরও কেউ কেউ, মোট কথা ঘরে জায়গা ছিল না।
আমি ধুতি পানজাবি (হলদেটা) পরে বুকে ইয়া বড় এক লাল টকটকে রঙ্গন ফুল লাগিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমাকে যাঁরা পাহারা দিতেন, তাঁরা সকলেই আত্মীয়ের মত বিদায় জানালেন। গাড়ি চলতে শুরু করার আগের মুহূর্তে নীচের গাড়ি বারান্দা ভরে গিয়েছিল। আমার ঘরের ভিড়ও নীচে নেমে এসেছিল। নমিতাদি এরই মধ্যে নায়ারণবাবুকে দিয়ে এক বাক্সো সন্দেশ আনিয়ে আমার সঙ্গে দিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস দিয়েছিলেন! সেই রাত আর তার পরের সকাল তাই খেয়েই কাটিয়ে দিলাম।
তোমার মাকে বলবে, তাঁর জন্য আমি যতটা সময় পারি অপেক্ষা করেছিলাম। আশা করি তোমরা ভালো। আমি তো ভালোই। ভালোবাসা জেনো।—বাবা
.
পুনশ্চ: আমার সর্বাঙ্গে যে এর মধ্যেই ঘামাচি বেরিয়ে গিয়েছে, খবরদার খবরদার, এই গোপন খবরটি তোমার মাকে দিও না। কারণ এ খবরটি পাওয়া ইস্তক তোমার মায়ের হাত যে নিসপিস করতে থাকবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত এবং তখন তোমাদের ঘাড় পিঠ অক্ষত রাখা খুবই মুশকিল হবে।— বাবা
.
২৮।৭।৭৬
শ্রীচরণেষু,
মা, আমি এবারে একটা দোতলা ঘরে জায়গা পেয়েছি। সামনে গাছপালাও বেশ আছে আর অনেক রকম পাখি। কয়েকটা পাতা বাহারের গাছ আর বাহারি কচুর গাছ দেখে বারবার মথুরাপুরের কথা মনে পড়ে যায়। ইশকুলবাড়িটার এক কোণায় একটা কামিনী গাছ ছিল আর কত রকমের পাতা বাহারের গাছ, বাহারি কচুর পাতা, হরিসভার ইট-গোঁজা পথের ফাঁকে ফাঁকে ঘাসের ফুল, চিনি টোরা আম গাছ— সব চোখে ভাসছে।
কাল থেকে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। সারারাত বৃষ্টি পড়েছে। এখন প্রায় দশটা বাজে— আজও সকাল থেকে ঝিপির ঝিপির করে বৃষ্টি হচ্ছে।
এখানে একটা বেশ সুন্দর বেড়াল ঘুরে বেড়ায়। অবিকল বনচারি বাগানের সেই রাধুর বিড়ালটার মত।
এ বাড়িটায় বারান্দা থাকায়, ইজিচেয়ার পেতে সারাক্ষণ বৃষ্টি পড়া দেখছি।
ভালো থেকো। শোভনা মীরা লক্ষ্মী বাণী ওদের বলো, ভালো আছি। বাবা এলে খবরটি দিও। প্রণাম
গৌর
পারিবারিক
বড়মেয়ে,
গগন গরজে গুরু বক্ষ দুরু দুরু
ত্রাসেতে ছানাবড়া চক্ষু?
কী-হবে কী-হবে ভাবি খাচ্ছ নাকি খাবি
ভুলেছ শুনছি ক্ষিধে তেষ্টা?
তবে কি বর্তমানে খুঁজছো মনে প্রাণে
এমন লোককে যিনি নমবর
দেবেন দরাজ হাতে উৎরে যাও যাতে
থাক না খাতার পাতা শুভ্র?
অথবা যে-খাতাগুলি দিয়েছ হাতে তুলি
সহিত শ্বাস বড় দীর্ঘ
তাহার কোথায় আছে খুঁজছো মান বাঁচে
এমন মার্কের উৎস?
এমত ভাবনা বড় করছে গড়বড়
বিঘ্ন ঘটছে সুখ শান্তির।
মাতৃদেবিকা তাঁরও বুঝছি নিদ্রাহারও
হচ্ছে ক্রমশই ঘাটতি।
শুন শুন মা ও মেয়ে দুশ্চিন্তাকে ধেয়ে
করো না গতর বৃথা শীৰ্ণ।
ছিলে তো বহুরে আড়ে দিব্যি দুটো ষাঁড়ে
টানতে গাড়ি পেতো কষ্ট।
যা ছিলে তেমনই থাকো হৃষ্টপুষ্ট রাখো
ওজন ভোজন সুখনিদ্রা।
যে-দুধ মাটিতে পড়ে কান্না তারই তরে
জানবে করে যে সে মূর্খ
যা কিছু হয়েছে গত তা নিয়ে অবিরত
ভাবনা একেবারে নাস্তি।
প্রাজ্ঞ জনেরা চায় সামনে সর্বদাই
সামনেই চলবার পন্থা
তুমিও চলবে সোজা কর্তব্যের বোঝা
তুলে নেবে মুখে সদা হাস্য।
মানুষ এমনি করে বুদ্ধির দীপ ধরে
কেবলই হেঁটে গেছে সামনে,
পিছনে রয়েছে তার অন্ধ তমসার
অভিজ্ঞ ইতিহাস স্তব্ধ।
আমরা তাহলে কেন পঙ্গু প্রায় হেন
হতাশায় ভাঙ্গি করি ক্রন্দন?
হাত পা যখন একই চেষ্টা করে দেখি
মানুষের এই শেষ বার্তা।
মন্দাক্রান্তা ছাঁদে ভগ্ন পদ বাঁধে
যদিও বাবা ঘোর বর্ষায়,
এ চিঠি মেঘের হাতে ভরসা হয়না দিতে
এখানে সহায় শ্রী সেনসর।
.
[স্ত্রী-কে লেখা চিঠি]
স্পেশাল সেল/ প্রেসিডেনসি জেল/ ৬ আগস্ট ১৯৭৬
কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করো:
১) রেকরড প্লেয়ার এবং রেকরড এখানে থাকলে আমার উপকারের পরিবর্তে অপকারই হবে, কারণ অনেকটা সময় ওর পিছনে যাবে।
২) আমার এখানে যা প্রয়োজন, নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তা বই। মহাভারত (৫ম) এবং রামায়ণ (২য়) আজও পেলাম না।
৩) আমি ধীরভাবে চিন্তা করেই ওগুলো ফেরৎ নিয়ে যেতে বলেছি, কারোর মনে কষ্ট দেবার মত মানসিক অবস্থা এখন আর নেই।
৪) সেই কারণেই পত্রবাহকের হাতে রেকরড প্লেয়ার এবং রেকরডগুলো ফেরৎ দিলাম। একদিনও বাজাইনি। খুলেও দেখিনি।
৫) বইগুলো অবশ্য চাই— মহাভারত (৫ম) আর বাজারে পাবে কিনা, আমার সন্দেহ।
৬) শালকির খবরে স্বস্তি পেলাম। প্রথম চিঠি বউমণিকে লিখলাম। কেন, তুমি বুঝবে।— 30/8/76
পতি বিলাপ
প্রিয়ে
যেদিন আসিলে তুমি আইনজ্ঞ নিয়ে
অধীনকে দেখিতে কারায়
মনে হল
অতি রুক্ষ সাহারায়
ভেসে এল শীতল মেঘেরই যেন একফালি ছায়া
বেহায়া
তৃষিত চক্ষু অতীব বেয়াড়া
তোমার মুখের পানে জ্ঞানগম্যি হারা
তুড়ি লাফ দিতে চায় যত
টেনে ধরি তত
চোখ দিয়ে চোরা ঘাই
মারতে হচ্ছিল তাই
বারংবার ও মুখের আনাচে কানাচে
এস্ বি ননদী পাছে
দোষ ধরে তায়
হায়
মিছা বিধি
পতি রূপে পরিগণ্য হওন অবধি
এত জ্বালা সহি নাই তুমি যাহা দিলা
ঘর ভর্তি জটিলা কুটিলা
কেহ চায় ঠারে ঠোরে কাহারও নজর
এমনই সুতীক্ষ্ণ খোঁচা
দেখে লাগে ডর
সতী-নারী পতি-নর মুখোমুখি বসে
প্রাণ ফাটে তবু কথা
বলি কি সাহসে
দুজনাতে ঘর
পুরে গেল কুড়িটি বছর
মনে হয় তবু সদ্য
তাহার আগেও ধর
বছর চৌদ্দ
যেন বা *U.T. (জেলেরই ভাষায়)
চলেছিল আসনাই
তুমি বসে আমি বসে
টেবিলের এপার ওপার
তবু যেন অতলান্ত সাগরের
অবাধ বিস্তার
আর তার
দুই প্রান্তে দুজনার বাস
শরতের উতল বাতাস
ছুঁয়ে যায় বুড়ি
থুড়ি
না না না শরৎ নয়
পুরানো ফ্যানের হাওয়া দেয় সুড়সুড়ি
আমি দেখি
চুল টানা পাতা কাটা সিথিতে সিঁদূর
সাফ সোফ একখানি পরিচিত মুখ
আমারই সম্মুখ
করে আছে আলো
তবুও কোথায় যেন ঠেকে মেকি মেকি
অতি চেনা অবয়ব গতর বর্তুল
চেনা তবু চেনা নয়
বার বার তবে ভুল
কেন হয় কিসে হয়
সেই চোখ সেই ঠোঁট তবুও সংশয়
মারে ঢুঁ
এ আমার বউ
সত্যিই এই সেই স্ত্রী
যাহাকে এনেছি ঘরে
করিয়া রেজিস্ট্রি
কী যে ছিল কী যে নাই
ধরি ধরি দূর ছাই
মাথায় আসেনা
মেঘলা মগজে হানা
অকস্মাৎ
পড়ে যে ক্বড় কড় বাজ
মুহূর্তেই বিস্মৃতির রাত
ফালা ফালা
যা ছিল নিতান্ত জানা
উদ্ভাসিত আলোর বন্যায়
তা আবার স্মৃতির নাগালে এসে যায়
এবারে নতুন চোখে চাই
ফের দেখি
কিন্তু এ কী এ কী
হস্তপদ চক্ষু কর্ণ নাসা জিহ্বা ত্বক
চুড়ি ঘড়ি হাত-ব্যাগ
একুনেতে অখণ্ড গৃহিণী
তবু মন এতক্ষণ
কেন করছিল
চিনি চিনি চিনিনি চিনিনি
জানা গেল সেই
সত্য সেই
অমনি দারুণ শক্
৪৪০
ভোল্ট গুঁতো মারে টিস্
এ দেখি নির্বাক ছবি
কোথা গেল টকী
কোন্ সে বিধাতা কৈলা
এমন ইয়ারকি
ঘাড় আছে মাথা নাই
যদিবা সম্ভবে
বউ আছে কথা নাই
কে শুনেছে কবে
তাই
অয়ি বাক্যহীনে অয়ি প্ৰিয়ে
আসিলে বসিলে গেলে নাই কোনও কথা
আহা কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা
এ যেন নৌবতে বসা নিঃস্বর শানাই
কথা কথা কত কথকতা
উদাত্ত অনুদাত্ত কড়ি ও কোমলে
সজনে বিজনে কথা নিরন্তর বলে
ফুরাতে পারিনি যাহা চৌত্রিশ বছরে
সেই কথা ফুটিল না রাতুল অধরে
রাগে অনুরাগে
অথবা বিরাগে
ঘুমে স্বপ্নে জাগরণে
ফুটিয়াছে কত কথা খৈ
সখি প্ৰাণসই
ভেবে দ্যাখ
ছোট কথা বড় কথা
ছাড়া-ছাড়া খাপি
কখনও সন্দেশ তুল্য
কখনও জিলাপি
কোনও কথা সোজা চলে
কেহ কোনাকুনি
কেহ বা আড়াই পদী অতর্কিত খুনী
কোনও কথা সঞ্জীবনী সুধা
ক্লান্তিহরা
রসাল শাঁসাল কথা দূরে ঠেলে জরা
কোনও কথা ফুলঝুরি
কেহ বা তুবড়ি
আধো-আধো গদগদ
কোকিল কুজন কথা ঘরে দেয় খিল
কখনও কথার তোড়ে, ওড়ে কাক চিল
হায় প্রিয়ে হায়
তুষ্ট রুষ্ট শিষ্ট মিষ্ট তিক্ত তীক্ষ্ণ
কত না কথায়
কেটেছে সময় কত
কখনও বা বিধিমত
সাধ্য ও সাধনা
দুটো কথা বলাবার তরে
শিলীভূত ইতিহাস
হয়ে আছে হৃদয়ের প্রত্যেক স্তরে
অভিমানে বাক্যবন্ধ
সেও কথা কঠিন নিরেট
অগতির গতি ভেট
পতিটির আত্মসমর্পণ
অতঃপর ঠোঁট ঠেলে মিহি হাসি
ফিক করে বাহিরায় নয়নরঞ্জন
আগে হাসি মৃদু মৃদু পরে ফোটে কথা
গৃহস্থমাত্রেই জানে
সংসারের বাঁধা এ বারতা
তুমিময় কথা আর কথাময়ী তুমি
তবুও সুরেলা সেই ঝুমঝুমি
না বাজিয়েই করিলে প্রস্থান
হায় সেই চোটে লবেজান
আমি
রাত্রি জাগি পদ্য গাঁথি গলগল ঘামি
গ্রহণ করিও পূজা প্রেম প্রীতি
ইত্যাদি ইত্যাদি
অত্র পত্রে নিবেদন ইতি
—বিচ্ছেদকাতর এক পতি
১।৯।৭৬
প্রেসিডেন্সি জেল
গোরা ওয়ার্ড
* U.T. = under trial prisoner = বিচারাধীন বন্দী
[স্ত্রী-কে লেখা চিঠি]
(১) একেবারে পুরানো পায়জামাটা ফেরৎ পাঠালাম। আপাতত অন্যটায় কাজ চলবে। হাসপাতালে আমাকে একটাই নতুন পায়জামা দিয়েছিলে। অন্যটাও পুরনো।
(২) হোক না স্কটিশে ভর্তি। ছেলেদের সঙ্গে না মিশলে পরিণত হবে কী করে? ওদের যুগের সঙ্গে আমাদের যুগের অনেক তফাৎ।
(৩) স্যামসন সম্পর্কে দ্বিতীয় অংশটা কবিতা-কৌশলে বেশ দুর্বল। আমি কিছুটা মেরামত করেছি। কিন্তু সেনসরের বেড়া পেরিয়ে পৌঁছুবার আগেই ভাবনা-চিন্তা বেরিয়ে যাবে। তুমি এই কথাটা ওদের জানিয়ে দিও— স্যামসনের সঙ্গে যেন এই সম্পাদকীয় টীকাটা জুড়ে দেয়। “কবিতাটি রোগশয্যায় রচিত এবং এটি প্রথম খসড়া।”
(৪) আপাতত আর বই-এর দরকার নেই। সুপার সাহেব আমাকে ফাঁসিয়ে রেখেছেন।
(৫) নিয়তির পুনর্বিন্যাস করে নূপুরকে পাঠিয়েছি। সেই চূড়ান্ত রূপটাই, যদি পৌঁছায়, শঙ্খকে দিতে বলেছি।
(৬) জমি তৈরি। ঝুনুদিকে চারা পাঠাতে বলো।
(৭) আপুর চিঠি একদম পাচ্ছিনে। তারকুণ্ডেকে চিঠি দিয়েছি।
(৮) গাদাকে বলবে Peoples Plan I এবং II এবং R.H.-এর Special issue আমাকে যেন সংগ্রহ করে দেন। R. H. যাতে প্রতি মাসে পাই, তারও যেন ব্যবস্থা করেন।
(৯) তোমাদের কারোর চিঠিই গত ১০ দিনের মধ্যে পাইনি।
[স্ত্রী-কে লেখা চিঠি]
(১) বিশুকে, বউমণিকে, মাকে জামগ্রামে চিঠি লিখছিলাম এখন (২) নতুন পায়জামা, বই রাখলাম। পুরানো পায়জামা দুটো ফেরৎ পাঠালাম। দরকার নেই।
(৩) বিশু এবং বউমণির চিঠি দুটোও পাঠালাম। নিয়ে যেও। সুজিতকে পড়িও।
(৪) কল্যাণকে জিজ্ঞেস করে জানাবে যে ডঃ মুখারজি অকটোবরের ১১ তারিখে থাকবেন কি না।
(৫) পদ্য-পত্র একটা তোমাকে পাঠিয়েছি। হয়ত এখনও পাওনি।
(৬) আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে একেবারে বয়কট করল কেন? কী অপরাধ করলাম?
(৭) আজ interview-র তারিখটা ঠিক করে নিয়ে যাও। আমি সুপার- মহাশয়ের কাছ থেকে জেনে নেবো।
.
স্পেশাল সেল/ প্রেসিডেনসি জেল/ কলি ২৭/ ২৫ আগস্ট ১৯৭৬
টুনটুন, তোমার ২১ তারিখে লেখা চিঠি গতকাল পেলাম। দীর্ঘকাল— দু সপ্তাহ পরে— এই প্রথম চিঠি। আমি কিন্তু সমানে তোমাদের কারো না [কারো] কাছে নিয়মিত চিঠি দিয়ে চলেছি। এবং তোমরাও। যাক সে কথা। তোমার চিঠিখানা যে এক ঝলক আনন্দের আভা ছড়িয়ে দিল আমার মনে, এই তো যথেষ্ট।
তোমার মন প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা এবং সেখানে টলটলে ভালোবাসা, তাই তোমার চিঠিতে এমন একটা সহজ আনন্দের ভাব থাকে। তার মানে বাস্তবকে সহজভাবে গ্রহণ করার একটা স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি তোমার মনে আছে। যার কাছে সাময়িক দুঃখ-বেদনা পরাভব স্বীকার করে। এইটে হল আসল জিনিষ। এই শক্তিটাকে সারা জীবনের সাধনা দিয়ে পরিপুষ্ট করে তোলার চেষ্টা করো।
বড় হচ্ছ এখন, সেদিনের সেই ছোট্ট কলির এখন তো ফুল হয়ে ফোটার সময় এসে গেল, জন্মদিন কবে?— বড় হওয়া মানেই এগিয়ে যাওয়া, নিজের মধ্যে যে-সব সম্ভাবনা এতকাল সুপ্ত হয়ে ছিল, সেগুলিকে ধীরে ধীরে জাগ্রত করে তোলা, এই ভাবেই ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। আর জানো তো চলার পথ সংঘাতময়। সে পথে চলতে গেলে আঘাত, পাওয়া এবং দেওয়া, এই উভয়ই যদিও বেদনাদায়ক, অনিবার্য। আঘাতকে যে সহজে গ্রহণ করতে পারে, এবং তার থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে, ভবিষ্যতের চলার কড়িতে তাকে রূপান্তরিত করতে পারে, মানুষ হিসাবে সেই শুধু সার্থক হয়। মনে যার ভালোবাসার পুঁজি নেই, তার পক্ষে এটা সম্ভব হয় না। তোমার মনে ভালোবাসার পুঁজির সঞ্চয় বেশ ভালো। ওটাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে যাও। আনন্দময়ী হও— জন্মদিনের এই আশীৰ্বাদ। ভালো আছি।— বাবা
.
স্পেশাল সেল/ প্রেসিডেনসি জেল/ কলিকাতা/ ৯ সেপটেমবর ১৯৭৬
টুনটুন,
সঙ্গের কবিতাটি তোমার জন্মদিনের উপহার। তোমার এবং তোমার দিদির কেমন লাগল জানাবে। এই কবিতাটির নির্ভুল প্রতিলিপি তৈরি করে, সেইটি তোমাদের কাছে রাখবে এবং আমার হস্তাক্ষরে লিখিত কবিতাটি শঙ্খকাকাকে পাঠিয়ে দেবে। বলবে এইটিই বাবার কবিতার সাম্প্রতিকতম রূপ। তাঁর কেমন লাগল, তুমিও আমাকে জানাতে পার অথবা তিনিও আমাকে জানাতে পারেন— ঠিকানা যদি চান দিয়ে দিও। আরও বলো, শঙ্খের সাম্প্রতিক কয়েকটি কবিতা— দেশ এবং পূর্বাশা (আষাঢ়) পত্রিকায় প্রকাশিত (“হাতেমতাই” আমি পড়িনি)— আমার ভালো লেগেছে। এই কবিতা সেই প্রেরণা প্রণোদিত (তোমার খাতায় এটা লিখে রেখেছি)।
এটা হল প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ, তোমার প্রতিলিপিটি দেবদাস, ভবানী এবং সুশীলদাকে পড়াবে। এবং অবশ্যই কালাদাকে।
তৃতীয় কাজ, সুশীলদাকে বলবে শীতাংশুর “শতাব্দীর সাধনা” আমার খুব ভাল লেগেছে। শিবনাথ শাস্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায়। এটা যেন শীতাংশুকে জানিয়ে দেন তিনি। পূর্বাশায় দীপংকরের অনুবাদও খুব ভালো। তোমার মাকে বলে বছরের প্রথম সংখ্যা থেকেই পূর্বাশার গ্রাহক বাড়ির ঠিকানায় হয়ে যাও। তোমরা পড়ে আমাকে পাঠালেই চলবে। বার্ষিক চাঁদা ২৪ টাকা। পাঠাবার ঠিকানা শ্রীসত্যপ্রসন্ন দত্ত, পূর্বাশা, ৩২ পটলডাঙা স্ট্রিট, কলি ৯। ক্রশ চেক পাঠিয়ে লিখবে বৈশাখ সংখ্যা থেকেই কাগজ চাই।
চতুর্থ কাজ, কাকাকে বলবে যে-উপায়েই হোক মহাভারত (৫ম খণ্ড) যেন এক খণ্ড জোগাড় করে দেয়। বাদলকাকাকেও বলবে। ওদের গাফিলতিতে আমার মহাভারত খোঁড়া হয়ে থাকল, এতে আমি মর্মান্তিক দুঃখ পেয়েছি।
বুবনু কোথায় ভর্তি হল জানাবে? ঝুমরুর খবরই বা কী?
আপ্পুর চিঠি একদম পাচ্ছিনে।
বু-ঠাকুমার জন্মদিনের ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য নেই কেন? ওঁর তো এবার ৭০ বছরে পড়ার কথা।
আশা করি সব কুশল। ভালোবাসা জেনো। বাবা।
.
১ বৈশাখ ১৩৮৩
স্নেহের বাদল,
তুমি, ‘ম্যানেজার বাবু’ এবং প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সকলে আমার নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানবে।
এইবার সমাচার এই, (১) পত্রবাহক— ইনি আমার পরিচারক বন্ধু— মারফৎ শুভ হালখাতার সন্দেশ পাঠাবে।
২) বই-এর অভাবে উপোষী আছি। যদি তোমাদের পক্ষে সম্ভব হয় তবে এক কপি সুকুমার সমগ্র— (মাত্র ১০ টাকায়! করেছো কী! এ যে রীতিমত সাংস্কৃতিক বিপ্লব! পাড়ার প্রতিক্রিয়া কী?)— এবং শরদিন্দু অমনিবাসের যে-খণ্ডে জাতিস্মর ইত্যাদি গল্প আছে, সেই খণ্ড— সয়েলড্ বই-এও আপত্তি নেই— পাঠাতে পার, এর হাতে, তবে খুশি হব।
৩) ব্রজদা-রূপী উত্তমের একটা স্টিল দিয়ে ব্রজদার গুল্প সমগ্রের একটা নতুন ধরণের বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখতে পারো— এটা একটা নিতান্তই পরামর্শ, অনুরোধ নয়।
৪) ভারবির রামায়ণের দ্বিতীয় খণ্ড কোথায়?
৫) মদনমোহনতলার যদি কোনো আনন্দের সংবাদ থাকে— একটা গুজোব কানে এসেছে— তবে দুটো সন্দেশ— extra— একটা আলাদা কাগজে মুড়ে পাঠালেই আমি বুঝে যাব।
৬) ভায়েরা নিশ্চয়ই আজ আসবে। তাদের বলো সুরেশ মজুমদার + প্রফুল্ল সরকার + সত্যেন মজুমদার যে ঐতিহ্যের ঝাড় সৃষ্টি করে গিয়েছেন, আমি তার এক নগণ্য কঞ্চিমাত্র। বিলাতফেরৎ মোক্তার সেই আমাকেই মচকাতে পারেনি। ঝাড় ধরে টানাটানি করে কিছুই করতে পারবে না— এ আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস। ঝাড়ের সঙ্গে যে মিলটা সহজেই আসে সেটা আর এই শুভদিনে উল্লেখ করতে চাই নে। বিলাত-ফেরৎ মোক্তারবাবুর তাই ফাটবে।
৭) আমার সঙ্গে মোক্তারবাবুর যে-খেলা চলছে, তার নিয়ম খুবই সোজা— টিপেছো কি টিপেছি। গত ছয় মাসের প্রথম চার মাসে উনি দুবার টিপেছিলেন। আমিও দুবার টিপেছি। ওঁর একজন অনুচর আমাকে বলেছেন, আমার শেষ টিপুনীতে নাকি অস্থির হয়ে টেবিল চাপড়ে হাই লেভেলে গাঁক গাঁক করে বলেছেন, এসব কী হচ্ছে? কী করে হচ্ছে! অ্যা! এই তো মুরোদ। গত দুমাসে আর কোনও কৃপা বর্ষিত হয়নি। আমি অবিশ্যি সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত।
৮) আশা করি, আমার বিগত জন্মের অন্তরঙ্গ বন্ধুরাও আজ আসবেন। তাঁদের বলো, আমি সর্বদাই এই প্রার্থনা করি, তাঁদের বাড়-বাড়ন্ত হোক। সাগরদাকে প্রণাম।
৯) গত শুক্রবারের যুগান্তরের ঘোষণায় আমি বিস্মিত, ব্যথিত ও ক্লিষ্ট। আমার ভ্রাতা পুরুলিয়ায় বদলি হয়েছে— সত্যি?
আমি এখানে কেমন আছি জানতে যদি আগ্রহ থাকে। পত্রবাহককে শুধু “দিগম্বর সত্যাগ্রহে”র কথাটা জিজ্ঞাসা করো। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ব্রজদার এটা একটা নতুন অবদান।—
পু: পত্রবাহককে যা জানাবার বাচনিক জানাবে। তোমার বউদির কাছেও জানাতে পার।—