পৰ্ব : ৩
স্যামসন, প্রিয়তম বন্ধুর উদ্দেশ্যে
(উৎসর্গঃ কালাদাকে)
স্যামসন প্রিয়বন্ধু স্যামসন
আজ আমি তোমারই মতন
হৃতশক্তি পরিত্যক্ত সহযোদ্ধাহীন
স্মৃতি মারে অবিশ্রান্ত হানা
তাইতে যন্ত্রণা
প্রশ্ন করি নিজেরই ছায়াকে
সেই শুধু নিরন্তর কাছে কাছে থাকে
ছিন্নপক্ষ হাঁটু ভাঙা
আমি কি জটায়ু
নিঃসঙ্গ সংগ্রামে ক্ৰমে
ক্ষীণ হয়ে আসে পরমায়ু
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
নই আমি পাখি
একটি মানুষ আমি একান্ত একাকী
তোমারই মতন বন্দী
আটোসাঁটো চৌকোনা ঘরে
আমি বন্দী আমি বন্দী
মনে পড়ে প্রতিটি প্রহরে
আজ আমি শৃঙ্খলিত দাস
প্রাপ্য শুধু প্রভুদের নানা উপহাস
সহযোদ্ধা একদিন কাছে ছিল যারা
স্বপ্নের মতন ভাসে তাদের চেহারা
পাশে নেই কেউ
হয়ত কেহবা অন্তরের শুভেচ্ছার ঢেউ
গোপনে পাঠাতে চায়
ফের বুঝি হয় সচকিত পাছে হয় ফাঁস
সাধ করে কে আর আনতে চায় গেরস্তের ঘরে
প্রভুদের ত্রাস
তবু আছে কেউ
অতীব আড়াল থেকে পাঠায় সাবাস
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
আমিও তো হতভাগ্য তোমারই মতন
না না আরো রিক্ত আরো নিঃস্ব
আরো দীন আমি
কেন না এ কথা তো জানি
তোমার কেশের গুচ্ছে যে-শক্তি নিহিত
দিন শুধু গুণে যায় দৈবের নির্দেশে
সে আবার নতুন যৌবন
কবে ফিরে পাবে
নব বলে বলী স্যামসন
মুহূর্তে দাঁড়াবে
ছিন্ন ভিন্ন বেড়ি
দাসত্ব-শৃঙ্খল খান খান
এক টানে ছিঁড়ে দেবে প্রভুত্বের নাড়ি
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
আজ হবে জবর তামাসা
প্রভুরা জানে না অতি ধীরে তোমার হারানো বল
চুলে এসে বেঁধেছে যে বাসা
ফিরিয়ে দিয়েছে ফের শক্তির সম্বল
আজ বড়-পরবের দিন
ক্রীড়াঙ্গনে বড় ভিড় ফূর্তির ফোয়ারা
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
সকলেই করে আছে আশা
যে-ছিল মানুষ মাথা যার মর্যাদায়
ছিল উঁচু সোজা শিরদাঁড়া
আজ তাকে জন্তুর মতন
বেঁধে আনা হবে ক্রীড়াঙ্গনে
প্রভুদের সৌখিন ইচ্ছায় দেখাবে তামাসা
উপহাসে অপমানে তার প্রাণ হবে জর্জর
আজ হবে আমোদ জবর
আত্মসুখী লম্পট নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী
জমেছে সবাই এসে
গেছে বসে যার যার বিলাসী আসনে
ভরে গেছে ঘর
জমাট আসর
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
এবার উল্লাসে
ক্রমেই পড়বে ফেটে হুকুমের যত বাহাদুরি
আঙ্গুল তুলবে উপহাসে
ওই যে স্যামসন
কুকুর বা বিড়ালের ডাকে লাগাবে সবাই টিটকারি
স্যামসন স্যামসন
তুমি না কি মহাবলী হা হা
পায়ে বেড়ি শৃঙ্খলিত হাত খুঁড়িয়ে চলেছো
আহা বটে বীরেরই চেহারা
যেমন তোমার নাম তেমন দেখাও দেখি
গোটা কয় খেলা
দেখো বাপু মাটি যেন হয়নাকো পরবের মেলা
চতুর্দিকে রব উঠে আর কেন দেরী
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
যখন দাঁড়ালে উঠে দেহ টান টান
দুই চক্ষু অন্ধ তবু কী দীপ্তি কোটরে
ফুটে ওঠে দাউ দাউ দাসত্বের জ্বালা
স্তম্ভিত প্রভুর দল আশা তো করেনি এই পালা
নির্বোধ স্বজাতি
(মনে বুঝি পড়ে গেল আজ কেউ খোঁজও নেয় না
যাকে নিয়ে একদিন নিরন্তর হ’ত মাতামাতি)
ভেবেছিল তালে তাল দিয়ে দিব্যি কেটে যাবে দিন
রক্ষা পাবে জীবনের সোনার হরিণ
দাসত্বটা অসহ্য কী আর এমন
পোষাকের তলে
কোনোক্রমে একবার ঢাকা দিয়ে দিলে
কার কোন্ চিহ্ন আছে— দাস না স্বাধীন
ধরে কোন্ শালা
তারো তো ঝামেলা
তাই একা রণক্ষেত্রে যাক
লড়াই করুক স্যামসন
কেন না ওরই তো পেঁয়াজি
কী এমন ক্ষতি হত একটা জীবন
মাথাটা নোয়াতে হলে রাজি
যেমন নিয়েছি মেনে সমাজের জ্ঞানী গুণী জন
অবিশ্যি গোঁয়ার ব্যাটা
যুদ্ধে যদি সত্যিই জেতে
ভাগ্যের হাতে হার জিত
তবে তার ফল
অবশ্যই আমরা তার স্বজাতি সকল
সকলেই পাবো তাই তো উচিত
অন্যে যদি লড়ে এনে
হাতে তুলে দেয় স্বাধীনতা
আহা স্বাধীনতা
গৌরব নেব না তার
এ আবার কি রকম কথা
আসলে ফোকটে পেলে
বাহারি এমন বস্তুটাকে
বাইরে রাখলে যদি ঠোকরায় কাকে
তবে তা সইবে নাকো আমাদের প্রাণে
তাই বলে বাবুদের সখের বাগানে
কিংবা সৌখিন কোনও সংগ্রহশালায়
বেলোয়ারি চৈনিক ‘ভাসে’
যত্ন করে রেখে দেওয়া ভালো
বলা তো যায় না ভবিষ্যতে
পালা বা পরবে কোনও কৌতূহলী
কোনোদিন যদি দৈবাৎ সখ চাপে আসে
উঁকি দিতে চায়
স্বাধীনতা কী সে চীজ কেমন চেহারা
চৌকো চ্যাপ্টা লম্বা গোল সাদা কিম্বা কালো
আহা জানে না কো অনেক বেচারা
স্যামসন স্যামসন স্যামসন কই
দ্যাখ দ্যাখ ওই স্যামসন
ওই যে টালমাটাল পায়ে
এদিক ওদিক ঘুরছে খাচ্ছে ধাক্কা
খেয়েছে চোখের মাথা তাই
দিগবিদিক জ্ঞান কোনও নাই
ওই দ্যাখ দুহাত বাড়িয়ে কী যেন খুঁজছে
হা হা হিহি একেবারে কানামাছি খেলা
ওই যে পড়ল হুমড়ি খেয়ে
দ্যাখ দ্যাখ আবার উঠল
ব্যাটা দেখি বড়ই গোঁয়ার
মানতে চাইছে না কিছুতেই হার
উঠছে পড়ছে হাহা
যাই বল জমে গেছে পরবের মেলা
হ্যাঁ এইবার পেয়ে গেছে সিঁড়ি
দিব্যি যাচ্ছে উঠে সোজা ওই থামটার কাছে
ওখানে কি আছে
দ্যাখ দ্যাখ জড়িয়ে ধরল ওই মোটা থামটাকে
কেমন আদরে
কেমন যত্নের সঙ্গে মোলায়েম হাতে
থামের শরীর নাকি কোনও রমণীর
স্পর্শ করছে আলতো নির্জন ঘরে
ওই দ্যাখ খাচ্ছে চুমু থামটাকে ঝুঁকে
ব্যাটা যেন ফুলসজ্জের রাতে
আদর করছে বড় নতুন বউকে
এতো বড় জবর ভাঁড়ামি
না এলে আফশোষ হত এসে
একটুও ঠকিনি
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
অকস্মাৎ সিধে হয়ে দাঁড়ালে যখন
সমস্ত শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে জরা
ভাঙলে পায়ের বেড়ি
খান খান দাসত্বের কড়া
দু বাহুতে শক্তির জোয়ার
দু পায়ের তলে শক্ত মাটি
যেন এ আগ্নেয়গিরি
অকস্মাৎ ভেঙ্গে গেছে ঘুম
মুখ গেছে টুটে
পুঞ্জীভূত অপমান অমর্যাদা
মানুষের অন্তরের দাসত্বের আর্ত হাহাকার
হুহু করে নেমে আসে ছুটে
যেন এ লাভার স্রোত
আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে পুঞ্জ পুঞ্জ সর্বনাশা ধুম
বললে গর্জন করে “দর্শক মহোদয়গণ
এবার দেখাই তবে খেলা
মিথ্যার ছলনার শঠতার প্রভুত্বের পাপ
যত ছিল জমা
তার স্রোতে ভেসে যাবে আজ
নগরের সকল নর্দমা
না তাতেও ধরবে না
দেখুন এবার তবে এই শেষ খেলা”
অতঃপর দুই ভীমবাহু থামে দিল টান
মুহূর্তেই সব খানখান
দ্বিতীয় পৰ্ব
স্যামসন প্রিয়বন্ধু স্যামসন আমি
এ কাহিনী জানি
কিন্তু বন্ধু আমি নই তুমি
নই মহাবলী
বিশ শতকের এক নিতান্তই ছাপোষা গৃহস্থ মামুলি
দৈবেরও আশ্রিত নই
আমার যে হৃতশক্তি সে আর কখনও
অলৌকিক কোনো মায়া বলে
ফিরে তার পাবে না যৌবন
তাও আছে জানা
তবু কেন মেটেনা বাহানা
সামান্য মানুষ আমি
যুক্তি বুদ্ধি বিবেকের-তেজ বিবেচনা
যতদূর নিয়ে যেতে পারে
আমার তো সেইটুকু সীমানা
প্রিয়বন্ধু স্যামসন আর ভালোবাসা
ভালোবাসা ভালোবাসা বুঝি
এই শেষ পুঁজি
শরীর অশক্ত হয়ে আসে
হৃৎপিণ্ডে দুর্গের ফুকরে
মৃত্যু গেড়েছে পাকা থানা
অতি অতর্কিত তার পেয়াদার হানা
আয়ুর সঞ্চয়ে মারে টান
থরথর প্রাণ
বুঝতে পারিনা মৃত্যু
নাকি দাসত্বের হু হু করা জ্বালা
কে বেশী উতলা করে
তোমাতে আমাতে বন্ধু এখানেই মিল
দুজনেই জানি স্থির
দাসত্বের চেয়ে প্রিয় মৃত্যুর মিছিল
মৃত্যু হানা মারে
বুকের যন্ত্রণা বাড়ে
অস্থির অস্থির
বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আসে
নিস্তেজ শরীর যন্ত্রণার পুকুরে যেন ভাসে
অকস্মাৎ রক্তের ভিতরে
শুনি কারা অদ্ভুত আশ্চর্য এক স্বরে
শুধু কলরব করে
স্যামসন স্যামসন স্যামসন
দেখাও তোমার খেলা
নিরন্তর কারা ডাকে
এই নামে কেন বা আমাকে
চোখে ভাসে ক্রীড়াগৃহ
ফেটে পড়া মানুষের উল্লসিত ভীড়
উদ্ভ্রান্ত অস্থির
চোখে মুখে অস্থিরতা
অবয়বে দত্ত গর্ব প্রভুত্বের উদগ্র স্বভাব
কেমন নিবিড়
কেউ করে উপহাস ওষ্ঠে ব্যঙ্গ ভঙ্গীতে বিদ্রূপ
ভাব দেখে মনে হয় সহ্য ওরা করবে না
মানুষের মাথা উঁচু দু পায়ে দাঁড়ানো সিধে রূপ
হঠাৎ চৈতন্যে ফিরি একঘেয়ে নিঃসঙ্গ বিছানা
ক্লান্তচোখে গরাদের ফাঁক দিয়ে চাই
পাখি দ্রুত উড়ে যায় ঘরে
গাঢ় ছায়া নেমে আসে গাছে
বাতাসের স্পর্শ পেতে ভারি ইচ্ছে হয়
অতিকষ্টে শীর্ণহাত বাইরে বাড়াই
দূর থেকে ভেসে আসে পুরবীতে ক্বচিৎ শানাই
কাছেই কোথাও আজ বুঝি আছে বিয়ে বাড়ি
শেষপ্রায় হয়ে আসে বেলা
ক্ষীণ আশা কী আশ্চর্য তবু কেন জাগে
আমার ছুটির আগে
আমাকেও দেখাতে হবে খেলা
প্রিয়বন্ধু স্যামসন দু-খেলার তুলনা চলবে না
খেলা দিয়ে খেলা যাবে চেনা
আমি জানি আমাকেও একদিন শৃঙ্খলিত
বেড়ি পায়ে টেনে আনা হবে ক্রীড়াঙ্গনে
দুরন্ত ষাঁড়কে যথা নাকে-দড়ি রাখা হয় বশে
গোরুর বাথানে
আমুদে দর্শক মত্ত কেবলই চেঁচাবে
কান ঝালাপালা
দেরী নয় দেরী নয় শুরু কর খেলা
স্খলিত দুর্বলদেহ নড়া চড়া
দায় দুহাতে শিকল
এক পা এক পা করে একেবারে মধ্যমাঠে যাব
তারপর সিধে হয়ে টান টান
অকস্মাৎ উপরে তাকাবো
শিকলে দারুণ টানে বাজাব ঝংকার
গাণ্ডীব টংকার
হঠাৎ চমকে উঠে বাচালেরা
কথা যাবে ভুলে
যতটা সম্ভব জোরে ক্ষীণকণ্ঠ তুলে
বলে যাব ভাই সাবধান
মানুষের সামনে আকাল
মানব-জমিনে অন্তর্গত মূলরসে পড়ে গেছে টান
ভাঁড়ার ফতুর
যে যেখানে আছো ভাবো কিসে পাবে ত্রাণ
ওই দ্যাখ নেমে আসে
ভয়াল পিঙ্গল এক দীর্ঘস্থায়ী খরা
ক্রমেই আসছে ছুটে নির্দয় শিকারী সাহারা
চিত্তের শুকাবে রস মাঠ-ফাটা ঠা ঠা রোদ্দুরে
কাঁটা গুল্মে ভরা মন ঝুরঝুরে যেন বালিয়াড়ি
পাবে না তৃষ্ণার শান্তি কে বা কাছে কে আছ বা দূরে
কেবলই ঘূর্ণীর ঝড় অনির্বান চুল্লীর উল্লাস
শুষ্ক তালু খাঁ খাঁ করা বুক
কোথাও পাবে না খুঁজে একটি গণ্ডূষ মাত্র
শান্তির চুমুক
অহরহ জেগে রবে আকণ্ঠ পিপাসা
মেঘেরা ফেরার
রৌদ্রদগ্ধ দাউ দাউ দিন
কোথাও রাখবে না আর ছায়ার বিস্তার
কোথায় নিস্তার
শোনো ভাই শোনো
এখন কর্তব্য এই যতটুকু পারা যায়
ততটুকু আবাদ বাঁচানো
লোভ হিংসা দম্ভ গর্ব প্রভুত্বের উদ্ধত মুকুট
ক্ষমতার অবাধ দাপট অত্যাচার
মানুষের অধিকার নির্বিচারে লুঠ
নানাবিধ প্যাঁচ পয়জার
মূর্খের স্বর্গের দাম্ভিক পতাকা
হিংস্রতম সতর্ক পাহারা
ফলাবে না রসহীন মানব জমিনে একটিও লকলকে চারা
মাঠের দখল
কেড়ে নেবে অনায়াসে হানাদার আগাছার দল
বোবা চোখে চেয়ে রবে স্তূপীকৃত নপুংসক টাকা
হৃদয়কে খালি কর ভাই
বাজে মাল পুরানো জঞ্জাল সব বরবাদ
আছে এই একটি উপায় এক ক্ষীণ আশা
কিছুদিন হৃদয়ের জমি রাখো খাসে
সেখানেই বাঁধ বাঁধো বাঁধ বাঁধো বাঁধ
কাঁধে কাঁধ দাও আর প্রবল বিশ্বাসে
যে যতটা পারো
সঞ্চয় করো ভালোবাসা
হৃদয়কে খাঁ খাঁ মাঠে যাতে অনায়াসে
সেচ পারো দিতে
হয়ত আবার তবে জীবনের অন্তর্গত ভিতে
রস কিছু যেতে পারে জমে
মানুষের মনের ময়দানে ক্রমে
জন্মাতেও পারে তবে মোলায়েম ঘাস
স্নেহময় প্রথম আশ্বাস
ভালোবাসা ভালোবাসা
সঞ্চয় করো ভালোবাসা
আবার বলছি ভাই মানুষের মনের আবাদে
এই শেষ আশা
প্রিয়বন্ধু স্যামসন
কণ্ঠক্ষীণ বেপরোয়া তবু এ চীৎকার
আমার বলার অধিকার
কেড়ে নিতে পারেনিকো বলদর্পী
নির্বোধ গোঁয়ার
তাদের করেছি অস্বীকার
স্যামসন প্রিয়বন্ধু যোদ্ধা স্যামসন
আমার যা বিবেকের দায়
যতটুকু সাধ্য ছিল তাই
দিয়ে করেছি সমাধা নাই আর কিছু নাই
এইবার শরীরের অতি ক্লান্ত ভার
শেষ শয্যা মাটিতে নামাই
সাঙ্গ আমারো শেষ খেলা
এবার পড়ুক তবে বেলা
নামুক আসন্ন সন্ধ্যা প্রশান্ত প্রান্তরে
পাখি ফিরে যাক তার প্রিয়তম নীড়ে
বসুক প্রগাঢ় ছায়া গাছে মাঠে গৃহস্থের চালে
জ্বলুক সিঁদুর ফোঁটা লজ্জানম্র এয়োতির নিটোল কপালে
দু একটা দলছুট বাছুরের ডাক
গোধূলির সঙ্গীত শোনাক
ক্ষয় হোক মানুষের মনের খোয়াই
নিতান্ত একেলা ঘরে
চুপিসারে শান্ত হয়ে আমি তবে এবার ঘুমাই
২৭/৩/৭৬
কোনও এক জিরাফের সন্ধ্যাসঙ্গীত
[একদা চিড়িয়াখানায় আবদ্ধ কোনও একটি জিরাফের প্রচণ্ড বক্ষশূল বেদনা, – মানুষের ভাষায় যাকে হার্ট অ্যাটাক বলে— হয়েছিল। কয়েকদিন ধরে নিরন্তর সুতীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়া সত্ত্বেও সে জিরাফ বলেই চেতনে, অচেতনে ও অবচেতনে এই ক’টি সন্ধ্যাসঙ্গীত রচনা করতে সমর্থ হয়েছিল।]
(প্ৰথম সঙ্গীত। তখন চেতনা নিস্তেজ হয়ে আসছে)
বসন্তের এই মাতাল মজলিশে সকালটা চেঁচিয়ে
আমার ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করল
বলল, “প্রেমিক তোমার জন্য কখন থেকে বসে আছি
বসে বসে ফুরিয়ে এলাম যে”
চোখ মেলতে পারলাম না যন্ত্রণার সংকেতে বার্তা পাঠালাম
“ঝরে পড়ার নিমন্ত্রণ আমিও কি পাইনি”
ওকি সেকথা না শুনেই ফুরিয়ে গেল
(দ্বিতীয় সঙ্গীত ॥ বুকের অসহ্য বেদনায় চেতন অচেতন)
এক লহমায় দেখে নিলাম তোমাকে
সেইমাত্র একবার একটিবার
আকাশে মেঘের দোলায় তুমি দোল খাচ্ছিলে
হঠাৎ চাইলে
কী গভীর ভালবাসা তোমার আয়ত চোখের আদলে
আমি কঁকিয়ে উঠলাম
“হায় তোমাকে ছেড়ে কী করে এখন থাকব
মৃদু হাসলে তারপর আবার আকাশ হয়ে গেলে
(তৃতীয় সঙ্গীত। অচেতন থেকে চেতনে)
যখন কেউ ছিল না কাছে তুমি ছিলে
বুক নিংড়ানো যন্ত্রণার ভিতরে গভীরে মর্মমূলে
আমি জানি তুমি শিওরে ছিলে প্রস্তুত প্রশান্ত প্ৰতীক্ষায়
যখন কেউ থাকবে না কাছে
তখনও জানি তুমি থাকবে সদা জাগ্ৰত শিওরে
সর্বদাই হাত দুখানা বাড়িয়ে গভীরতম প্রেমে
তোমাকে নির্দয় কে বলে প্রিয়তমে
(চতুর্থ সঙ্গীত ॥ অবচেতনে)
তোমাকে কথা দিয়েছি প্রিয়তমে
ধরা দেব সেই আখেরি আলিঙ্গনে
যাত্রা করেছি প্রথম সূৰ্য্য থেকে
থামিনি চলেছি ক্ষতবিক্ষত পা
এখন বিকেল একটু সবুর
আর তো মোটে এইটুকু প্রান্তর
সন্ধ্যা নামতে দাও
আমি তো তোমার নাগালের মধ্যেই
তবু এত আক্রোশ
(পঞ্চম সঙ্গীত। আচ্ছন্ন হবার প্রাক্-মুহূর্তে)
একা চলতে যখন ক্লান্ত হয়ে থমকে পড়ি
সম্মুখে গা-ছমছম বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর অনাত্মীয় আসন্ন সন্ধ্যা
হে প্ৰিয়তমা হঠাৎ তোমার হাতছানি আমায় সচল করে
তোমার সঙ্গে মিলন সে যে বাহির সমুদ্রের ভাঁটার টান
(ষষ্ঠ সঙ্গীত। অচেতন থেকে চেতনের মাঝখানে)
উষ্ণ চুম্বনের নীলামদারদের হাঁকডাকেই বাজার সরগরম
শীতল চুম্বনের গ্রাহক একমাত্র তুমিই
আমি তো তোমার জন্যই পসরা মেলে বসে আছি
(সপ্তম সঙ্গীত ॥ পরিপূর্ণ চেতনে)
আমার সামনে খাঁচার গরাদ
চারদিকে আকাশ ঢাকা বেড়া
কিন্তু এই তো আমি চলে যাচ্ছি প্রিয়তমার কাছে
উগান্ডার অবারিত প্রান্তরের যূথে এই তো ছুটছি উদ্দাম
এই তো পাচ্ছি তার শরীরে টালমাটাল বসন্তের ঘ্রাণ
তাহলে হৃদয় আর আফশোষ কিসের
(অষ্টম সঙ্গীত। পরিপূর্ণ অবচেতনে)
কে আমাকে ভুলেছে
কোন্ বন্ধু মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছে
অভিমানী হৃদয় হায় তুমি কি সাবালক হবেই না
(নবম সঙ্গীত।। অবচেতনে)
আমাকে যারা বাজিয়ে নিচ্ছে
কেন তাদের ঘৃণা করব
আমার ভালবাসা সেকি এতই মরা সোনার
(দশম সঙ্গীত। অবচেতনে)
আমি চাই আমার প্রিয়জনেরা
একে একে আমার আগে গিয়ে
জমজমাট সেই আসরে জায়গা নিন
যে প্রেমিক সেই কেবল জানে
প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-বেদনা কত মর্মান্তিক
(একাদশ সঙ্গীত। চেতনে)
ঝড়ের সময় ভয়ে সবাই কেমন দুদ্দাড় দরজা এঁটে দিয়েছিল
এখন দেখুন তামাশা আম কুড়োতে সবাই কেমন বেসামাল
(দ্বাদশ সঙ্গীত ॥ জিরাফের স্মৃতিফলকের জন্য)
লোকটা বড় আজব ছিল
লোকটা বড় আজাদ ছিল
লোকটা বড়ই আজব কথা বলত
বলত, “ভাই মানুষকে শিকল পরিও না
সে ফুল ফোটাবে”
তারপর কি হল
হাঃ হাঃ সে বড় মজার কথা
লোকে বলল, “ওটা মানুষ নয় জিরাফ”
লোকে ওটাকে চিড়িয়াখানায় ভরে দিল
বন্ধুরা মাঝে মাঝে ওটাকে ঘাস জলও দিয়ে আসে
আহা ওটাকে তারা বড় ভালবাসে
(ত্রয়োদশ সঙ্গীত। একেবারে সজ্ঞানে)
আমার প্রিয়জনেরা শোনো
আমার জন্য খবরদার কেউ চোখের জল ফেলো না
কেন না ললাটের লিখন এই— “এর দুঃখে শেয়াল কুকুর কাঁদবে”
পাঁচ ফোড়ন
এক।।
ভীষ্ম দ্রোণ তলিয়ে গেল
সেনাপতি শল্য
এই ভরসা নিয়ে দাদা
লড়তে যাবেন কল্য।
সিংহ গেল ব্যাঘ্র গেল
হাতিও খেল ল্যাং
বুক চিতিয়ে আছেন দাদা
ভরসা এখন ব্যাঙ।।
দুই।।
এ দলে ভিড়লে মন্ত্রী
ও দলে রাজা
এ দলে মতিচুর
ও দলে খাজা—
ভাবছেন এম এল এ
গাছেরও থাকে
তলারও থাকে—
কোন্ দলে ভিড়লে?
তিন।।
প্রাণটা ত্যাগ করা কিছু নয়
প্রাণ রাখাটাই শক্ত,
বললেন দেশভক্ত।
গদি তো ছাড়তেই পারি
ও কিছু নয়
গদি রাখাটাই শক্ত,
তাই তো ছাড়ছি নে তখ্ত।।
চার।।
এক যে ছিলেন বিলাত ফেরৎ মোক্তার
কেমন চাপল রোখ তার
লড়তে গেলে মামলা মাথায় দেবেন গামলা
বাগ মানাতে পারেন না কেউ এ ঝোঁকটা
নাম কিনলেন বিলাত ফেরত মোক্তার