পৰ্ব : ২
কলকাতার বাবু-বিবেক
(সমর সেনকে আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে)
বেশ্যার বিছানায় এমন মক্কেল
হামেশাই দেখেছি
যারা গাদে আর ফোঁৎ ফোঁৎ কাঁদে
আর বলে, “পাপ আমার সয় না।”
হাড়কাটা সোনাগাছি কিংবা
যাদের দেখতাম রামবাগানে
কী আশ্চর্য আজ দেখি সমাজের এখানে ওখানে
দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম সেই বাহারি ময়না
যারা ঝোলে আর দোলে
আর ফাঁক পেলে হাপুস নয়নে বলে
“এসব ঝকমারি আমার মাইরি একদম সয় না।”
[এস.এস.কে.এম. হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ, কামরা ৫ ॥ ৯ মারচ ১৯৭৬]
আইয়ুবের জন্য দুটি বুনো ফুল
॥ এক ॥
ঈশ্বর ছোট্টো একটা প্রদীপ গড়লেন,
আর দিলেন অল্প একটু তেলের পুঁজি
আর বললেন, “দেখো, তেল ফুরোবার আগে
ঝড় ঝাপটায় কিছুতেই যেন নিভে না যায়
এইটুকু তোমার কাজ।”
প্রদীপ নেভেনি কিন্তু তেল তো ফুরিয়ে এল,
চেঁচিয়ে হাঁক দিলাম, “পুঁজি তো শেষ
এবার বলো কি করব আমি?”
কোনো উত্তর এল না।
লোকটা আশ্চর্য ভুলো তো!
৮ মারচ, ১৯৭৬
॥ দুই ॥
সারাটা জীবন কত না ভেল্কি দেখালে
হে জাদু সম্রাট!
টুপি থেকে পায়রা বের করে ওড়ালে,
কাগজকে করলে ফুল, জলকে করলে দুধ,
শিশুকে যুবক, মানুষকে সরীসৃপ
বিস্ময়ের আর বাকি রাখলে না কিছু।
সবশেষে ঘোষণা করলে উচ্চ কণ্ঠে,
“কে আছো উঠে এস মঞ্চে, পরাস্ত কর আমাকে!”
বেলাশেষের ছায়ার কাঁধে ভর দিয়ে
ধীর পায়ে উঠে গেলাম তাক্ লাগানো জাদুমঞ্চে
তারপর জাদুকরের হাতে উজাড় করে ঢেলে দিলাম
এক প্রাণ ভালবাসা।
মৃদুস্বরে বললাম, “বদল কর তো একে।
জাদুর খেলা গুটিয়ে গেল।
৮ মারচ, ১৯৭৬
অরুন্ধতীকে— শুধু একটু রাগাবার জন্য
তোমার ভালবাসার অগাধ দীঘিতে
নানা ঘাটে কত লোকই তো তৃষ্ণা মেটায়,
আঘাটায় নেমে এক আঁজলা জলে
আমিও যদি শুকনো গলাটা ভিজিয়ে বলি— “আঃ!”
তাতে তোমার কী-ই বা এমন আসে যায়?
[৮ মারচ ১৯৭৬—মেঘলা সকাল ]
অরুন্ধতী,
হারমোনিয়ামের লং প্লেয়িং কি বাজারে বেরিয়েছে? প্রতিক্রিয়া কী? বাবলু- মা এল। নিশ্চয়ই ভাল আছে। রাণাবাবুর একটা বইও আমার কাছে আছে। কোথায় জানি না। রাণাবাবুর খবর কী? তপনের শরীরটা ভাল আছে? হারমোনিয়ামের মুক্তি কবে? বাবলুর ছেলের যে যাই নাম রাখুক, আমার কাছে ওর নাম চিরদিন জয়সূর্য্য থাকবে। সূর্য্যের তেজ আশাকরি শুর পরিবারের লোকেরা সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।
শ্রীসত্যজিৎ রায় প্রিয়বরেষু
রাজভবনের চায়ের কাপে জনঅরণ্য তুফান তোলার প্রতিক্রিয়ায়
যে দেশে কাকই রাজা
সে-দেশে কোকিলের বিশুদ্ধ কুহু তানে
প্রজাদের অবুঝ আবোধ প্ৰাণে
বাজে কিনা হতাশার সুর
কোনও এক বেল্লিক বিরহী বিধুর
ঢিল দেয় কিনা উৎপাদনে
অবশ্যই দেখা প্রয়োজন
সমাজ কল্যাণে
কোকিলের কুহু
শুনে কারো প্রাণ যদি করে ওঠে হু হু
তবে সমাজ বিরোধী এই মন
অবস্থাটা চারিদিকে জরুরী যখন
উচিত কি পাওয়া প্ৰশ্ৰয়?
যেখানে দেশের এত কাজ?
প্রয়োজন উৎসাহ দরাজ?
প্রশ্ন তুলেছেন অতি অমায়িক হেসে
এক গুণী সমাবেশে
মহামান্য রাজা-মহাশয়
গুণীগণও এক গাল হেসে
কেহ বা অপ্রস্তুত একটু কেশে
(কেন না কাজুর সেই সল্টেড অতীব সেয়ানা
এক কুচি দানা
স্বরযন্ত্রে অতর্কিতে মেরেছিল হানা)
হঠাৎ বলেন সমস্বরে, “না না—সবদিক ভেবে—”
হ্যাঁ, সবদিক ভেবে
ঠিক তাই করেছেন মহামান্য কাক
এবার কোকিল ধরে ধরে
অননুকরণীয় তাঁর অনবদ্য স্বরে
কোকিলকে দেবেন-ই তালিম
একেবারে নিজে
কী করে ডাকতে হয় হিতকারী ডাক
রাজার সংকল্প শুনি জ্ঞানীগুণীজন
একে একে পকৌড়ার প্লেট খালি হইল যখন
একটি উদ্গার তুলি সমস্বরে কহিলেন, “ইথে নাহি লাজ
যে-দেশে দস্তুর যাহা সেইমত কাজ”
গৌড়ানন্দ কবি ভনে যে-আছো জহুরী।
প্রেমানন্দে একবার বল হরি হরি।
[এস. এস. কে. এম. হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ
১৫ মারচ—বসন্তের নিতান্ত কাতর দুপুরে]
এই কি নিয়তি
(কবি শঙ্খ ঘোষ, প্রিয়বরেষু)
তবে কি নিয়তি এই
কবিতার শবাধারে, স্তূপীকৃত পুষ্পের গোপনে
সব শব্দ তুলে দেব?
কতটা চতুর আমি কত বা কৌশলী
শব্দ ব্যবহারে
রেখে যাব তারই কিছু করুণ প্রমাণ?
গদ্যের গাণ্ডীবে জ্যা
কখনোই যোজনা করব না? কখনোই
লক্ষ্যবেদী (ধী) শব্দের সুতীক্ষ্ণ শর
ছুঁড়বো না? যেহেতু তা
স্থির লক্ষ্যে ছুটে যায় প্রকাশ্যেই
এবং ছিন্ন ক’রে সুচতুর চক্রজাল
মৎস্য চক্ষু বেঁধে?
যেহেতু টংকারে তার বজ্রের নির্ঘোষ,
ভেঙে দেয় মোহনিদ্ৰা?
হায় ব্রতধারি,
বনবাসে আর কত দিন?
মোহ নিদ্রা আর কত দিন!
শব্দের ধ্বনিমুগ্ধ
অর্জুন! অর্জুন!
এই বৃহন্নলা-বৃহন্নলা
ছলনার খেলা
শব্দ নিয়ে এই মিথ্যা লুকোচুরি খেলা
কত দিন, আর কত দিন!
বীর্যবন্ত শব্দের ভ্রূণ
যা হ’ত শত্রুঘ্ন শর দুর্বার কঠোর
ক্রমাগত উপমার ব্যঞ্জনার
অচরিত্র অর্থহারা দিশাহারা পরিক্রমা শেষে
তবে কি পড়বে খসে
তৃণেরই অতলস্পর্শী বন্ধ্যা অন্ধকারে?
কোনোদিনই দেখাবে না মুখ?
টংকার দেবে না কামুক?
অবিরাম নিষ্ফল ব্যায়ামে
শব্দ যদি ওজন হারায়
হৃত-অর্থ হয় ক্রীতদাস হয়
শব্দের ঠোকায় বিন্দুমাত্র স্ফুলিঙ্গও না
ওঠে যদি
শূন্যগর্ভ তবে সেই শব্দের আধারে
সেই শবাধারে
তুলে কি হবে না দিতে কবিতারও শব?
এই কি নিয়তি?
হায় ব্রতধারি, হায়!
স্পেশাল সেল/প্রেসিডেনসি জেল/৬ সেপটেমবর ১৯৭৬