দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা – পর্ব : ১

পৰ্ব : ১

ইন্দিরা, দেশ, গণতন্ত্র

এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাওয়াতে প্রধানমন্ত্রীর অনুরাগীবৃন্দ যে উন্মত্ত আচরণ করেছেন তা যেমন একদিকে আমাদের মনে আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে, তেমনি এটাও প্রমাণ করে দিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সব থেকে শক্তিশালী দল কংগ্রেসের “অপরিহার্য” নেত্রী বলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করলেও তাঁর আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিটা কত দুর্বল হয়ে পড়েছে।

কংগ্রেস যখন দু’ভাগ হয় তখন দেশে যে “ইন্দিরা হাওয়া” বয়েছিল, তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আর আজ, হায়, সেই ইন্দিরার পালে হাওয়া দেবার জন্য কত না সাজানো আয়োজন! একথা প্রধানমন্ত্রীর অনুরাগীদের চাইতে আর কে ভাল জানে যে, সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর নামে আসমুদ্রহিমাচলে যে জয়ধ্বনি উঠেছিল তার জন্য ট্রেন, ট্রাক, বাস ইত্যাদির কোনও আয়োজনই তাঁদের করতে হয়নি। আর আজ প্রধানমন্ত্রীকে খেদিয়ে-আনা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত লোকেদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকেই তারস্বরে ঘোষণা করতে হচ্ছে, “দ্যাখ তোমরা, দেখে যাও, আমি কত পার”!

কিন্তু একথা জানাবার জন্য এত কাঠখড় পোড়াবার, দরিদ্রজাতির অর্থের এত অপচয়ের কী দরকার ছিল? তাঁর জনপ্রিয়তা অসীম, অপরিহার্য তাঁর নেতৃত্ব, একথা এত ঢাকঢোল পিটিয়ে কাকে বোঝাবার দরকার ছিল?

ভারতের জনগণকে?—না, কারণ তিনি তো জানেন যে তারা তাঁর পিছনেই আছে। বিরোধীপক্ষকে?—না। কারণ তিনি তো জানেন যে বিরোধীরা কত অশক্ত। কংগ্রেসদলকে?—না। কারণ তিনি তো জানেন দলে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে? কার শ্রবণের জন্য তাঁর এই চাটুকার-সমারোহের সুবিশাল আয়োজন!

এর একটা উত্তরই আমার জানা আছে। প্রধানমন্ত্রীর চোট-খাওয়া আত্মবিশ্বাসকে মেরামত করার জন্যই এই উদ্যোগ আয়োজন। সরল সত্য এই: ইন্দিরা আজ আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। দলকেও তিনি আর বিশ্বাস করেন না।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার যদি এই বিশ্বাস অটুট থাকত যে তাঁর নিজ দল কংগ্রেসের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ সত্যিই অব্যাহত আছে, তাহলে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে তাঁর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাবার পর তিনি স্বাভাবিক পথই গ্রহণ করতেন, অর্থাৎ—

১। তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতেন, ২। মামলা নিষ্পত্তি সাপেক্ষে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে সাময়িকভাবে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, ৩। কংগ্রেস পরিষদ দলের সভা ডেকে তিনি নতুন নেতা নির্বাচন করতেন, ৪। তাঁর হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার সাময়িকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি পদত্যাগ করতেন, ৫। মামলা জিতে ফিরে এসে আবার কংগ্রেস পরিষদ দলের নেতা নির্বাচিত হতেন, ও ৬। পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতেন, অথবা ৭। মামলা জিতে ফিরে এসেই কংগ্রেস সভাপতির পদটি গ্রহণ করতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নতুন নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, ৮। মামলায় হারলেও ক্ষতি ছিল না, কংগ্রেস সভাপতি হতেই পারতেন ও নির্বাচনী কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারতেন!

এতে তাঁর এবং কংগ্রেসের ভাবমূর্তি এতই উজ্জ্বল হয়ে উঠত যে ‘ইন্দিরা হাওয়া’র টানে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত।

ইন্দিরাকে তখন ক্ষমতালোলুপা চামুণ্ডা বলে কারো মনে হতো না, মনে হতো তিনি বরদা অভয়া। গণতন্ত্র সংকটমুক্ত হতো।

কিন্তু ঘটনা উল্টো পথে মোড় নিল। কারণ, ইন্দিরা ভয় পেয়ে গেলেন। এ বিশ্বাস তাঁর হল না যে, তিনি যদি একবার ক্ষমতার আসন থেকে নেমে আসেন তবে আজ যাঁরা “ইন্দিরাজী আমাদের পক্ষে অপরিহার্য” বলে কাগজে দস্তখৎ করে তাঁকে দেখাতে আসছেন, তাঁরাই আবার তাঁকে ভরতের মত ক্ষমতার সিংহাসনটি ফিরিয়ে দেবেন।

অতএব ইন্দিরা ভয় পেলেন। এবং শেষ পর্যন্ত স্থৈর্য হারিয়ে ফেললেন। ফলে তিনি দলের উপরে নির্ভর না করে চাটুকারদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

এই অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। চাটুকারের দল আজ ইন্দিরাকে দেশের আইন, কংগ্রেস দল, এমনকি ভারতের চেয়েও বড় বলে জাহির করতে শুরু করেছেন। কংগ্রেস সভাপতি শ্রীদেবকান্ত বড়ুয়ার বিদূষকজনোচিত সংলাপ ‘ইন্দিরাই ইন্ডিয়া’ গোপাল ভাঁড়কেও হার মানিয়েছে।

এইসব গো-পালের জন্য ইন্দিরাও আজ একদিকে যেমন হাস্যাস্পদ, অন্যদিকে তেমনি করুণার পাত্রী হয়ে উঠছেন।

তথাপি একথা স্বীকার করা উচিত, চাটুকারগণ ব্যক্তিগতভাবে যাই বলুন না কেন, কংগ্রেস পরিষদ দল এই সংকটে ইন্দিরার প্রতি আস্থা জানিয়ে যে প্রস্তাব পাশ করেছেন তাতে বরং তাঁদের সংযমই প্রকাশ পেয়েছে। কংগ্রেস পরিষদ দল নেত্রী হিসাবে ইন্দিরার প্রতি আস্থা জানিয়েছেন; কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। স্পষ্টই বোঝা যায়, ওঁরা নতুন কোনও সংকট সৃষ্টি করতে চান না। এটা ভাল লক্ষণ।

এত শোরগোলের পর ইন্দিরা যদি সুপ্রিম কোর্টের মামলা জেতেনও তবুও তাঁর ভাবমূর্তি আর আগের মত জনমানসে অকলঙ্কিতরূপে প্রতিভাত হবে না। যদি হারেন, কংগ্রেস দলে আবার সংকট সৃষ্টি হবে। ইন্দিরার আত্মবিশ্বাস যদি এর মধ্যে ফিরে আসে তবে তাঁর পক্ষে উচিত হবে জোর করে নেতার পদ আঁকড়ে না থাকা। এবং নতুন নেতা নির্বাচনের স্বাভাবিক পথ অর্থাৎ পরিষদ দলের সুষ্ঠু নির্বাচনের উপর ভরসা রাখা। ইন্দিরার বিকল্প নেই, একথা জপ করানো মানে কংগ্রেস দলকেই পঙ্গু করে রাখা। বাবু জগজীবন রামও যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা। তিনিও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। কংগ্রেস দলে বিচক্ষণ নেতার অভাব নেই এমন ধারণা সৃষ্টি করলেই বরং কংগ্রেসের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বলবৎ হবে।

গণতন্ত্রকে, দেশকে, কংগ্রেস দলকে রক্ষা করবার এই একটা পথই আছে। ইন্দিরা বিহনে ভারত দুর্বল হয়ে পড়বে, ভারত বহির্শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হবে, এইসব কাল্পনিক ভয় ছড়িয়ে দেশে হিস্টিরিয়া বাড়ানো যায় বটে, দেশকে সংকটমুক্ত করা যায় না। দেশের ভালমন্দ এখনও কংগ্রেস দলের আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক বোধের উপরই নির্ভর করছে। এই গণতান্ত্রিক চেতনাটিকে সরল ও পুষ্ট করে তোলাই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার উপায়। আপাতত এছাড়া পথ নেই।

কলকাতা, বর্ষা সংখ্যা ১৯৭৫

পিতার পত্র   

স্নেহাস্পদেষু,

অনেকদিন ধরেই ভাবছি তোমাকে কিছু কথা বলব। আমার সম্বন্ধে। প্ৰায় দু’মাস হতে চলল আমি এক ব্যাধিতে ভুগছি। কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। তোমাকে বলতে পেরে মনের ভার যদি লাঘব হয়, সেই ভরসা।

তোমার এখন যা বয়েস, মাত্রই তের, তাতে হয়ত এখনই আমার কথা সব বুঝতে পারবে না। তবু যে তোমাকেই লিখছি তার কারণ, আমার কেমন মনে হল, কথাগুলো তোমার শুনে রাখা দরকার।

এবার আমার ব্যাধির কথা বলি। বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে তোমার সঙ্গে যখন দেখা করতে যাই, তুমি আমার মাথা ন্যাড়া দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলে, মনে পড়ে? তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, বাবা, তুমি মাথা মুড়িয়েছ কেন? আমি তোমাকে বলেছিলাম, সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে আমার স্বাধীনভাবে লেখার অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এখন আমি যেমন চাই তেমন কথা আর লিখে প্রকাশ করতে পারব না। সরকার যে-সব কথা শুনতে চাইবেন, শুধু সে-সব কথা লিখতে হবে। আমি তোমাকে বলেছিলাম, মনে পড়ে, সরকারের এই কাজকে আমি লেখকের অধিকারে অন্যায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করি। আমি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবার জন্যই মাথা মুড়িয়ে ফেলেছি। যতদিন আমি লেখক হিসেবে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে না পাব ততদিন মাথার চুল গজাতে দেব না।

এই কথার মানে তুমি যথার্থ সেদিন বুঝেছিলে কি না জানিনে, তবু তোমার মুখখানা, আমার চোখে এখনও ভাসে, কালো হয়ে গিয়েছিল। তারপর তোমার মাকে কাছে পেয়ে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলে, “ওরা কি বাবাকে কখনোই লিখতে দেবে না?”

এই প্রশ্নের জবাবে তোমাকে আজ এইটুকুই বলা যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশে যদি আবার প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তোমার বাবা আর কোনোদিনই লেখার সুযোগ পাবে না।

অতএব বুঝতেই পারছ আমার অধিকার কেড়ে নেওয়ায় আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, কারণ আমি এ অবস্থা মেনে নিতে পারিনে। শুধু যে মেনে নিতে অসম্মত তাই নয়, আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাতে চাই। কিন্তু যখনই প্রকাশ্য প্রতিবাদের কথা আমার মনে পড়ে তখনই তোমার, তোমার দিদিদের, তোমার মার, ঠাকুমার মুখগুলো আমার চোখে ভাসে। তোমাদের কেউ নাবালক, কেউ অসহায়, কেউ বা বৃদ্ধ। সকলেই আমার উপর নির্ভরশীল। আমি এতদিন ধরে তোমাদের মোটামুটি একটা স্থিতিশীল সংসারের আশ্রয়ে রেখেছি। আমি কি আমার কোনও ‘সখের খেয়াল’ চরিতার্থ করার জন্য এমন কোনও কাজ করতে পারি যাতে তোমাদের এই আশ্রয়, এই স্থিতি ভেঙে পড়তে পারে? যদি তোমাদের আশ্রয় বজায় রাখাটাকেই আমার জীবনের ধ্রুবলক্ষ্য বলে স্বীকার করে নিই, তা হলে তোমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অবশ্যই প্রতিবাদ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে এই অন্যায়টাকে মেনে নিতে হয়। অসত্যের সঙ্গে আপোষ করতে হয়।

তাহলে লেখক হিসেবে নিজের মর্যাদাকে বিকিয়ে দিয়ে ভাড়াটে কলমবাজের পেশা গ্রহণ করতে হয়।

তাহলে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় দেবার ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয়।

একদিকে তোমরা, তোমাদের নিরাপত্তা, আর অন্যদিকে আমি, মানুষ হিসেবে আমার আত্মমর্যাদা। প্রশ্ন উঠেছে কাকে বিপন্ন করে কাকে রক্ষা করব! অহরহ এই প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে দিচ্ছে, জর্জরিত করে তুলছে। এই আমার ব্যাধি, যে ব্যাধির কথা তোমাকে শুরুতেই বলেছি।

অথচ, অদৃষ্টের কী পরিহাস, দ্যাখো, আমাকে কিনা এখনই এমনধারা একটা বাছাই-এর প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াতে হল, তাও কমিউনিস্ট শাসনে নয়, আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যখন রাষ্ট্রনায়ক তখন। কিন্তু এমন একটা প্রশ্নের সামনে যখন দাঁড়াতেই হচ্ছে, তখন আর উপায় কী, সিদ্ধান্ত একটা নিতেই হয়। প্রশ্নটির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনও অর্থই হয় না।

তাই আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানিয়ে রাখছি। আমার বাক্-স্বাধীনতা হরণের আমি তীব্র প্রতিবাদ করি।

আমি মনে করি আমার লেখার অধিকার, আমার মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ আমার অস্তিত্বকে হত্যা করা। এই কারণে আমি বর্তমান সেন্সর ব্যবস্থাকে মানবিক ন্যায়-নীতিবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী এবং স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করি।

বরাবর আমি মানবিক ন্যায়-নীতির পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে এবং স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রাম করে এসেছি। তুমি যখন বড় হবে, তখন যদি সুযোগ পাও তো তোমার বাবার রচনাগুলো পড়ে দেখতে পার।

এই কারণেই নকশাল আন্দোলনের সেই উচ্ছৃঙ্খল দিনগুলোতেও আমার একক কণ্ঠস্বরকে সদা সক্রিয় রেখেছিলাম। বারবার সেই বিপথগামী তরুণদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, হিংসা এবং হিংস্রতা মানুষের স্বাধীনতা আনে না। বড় জোর এক স্বৈরাচারের শৃঙ্খল থেকে তাকে আরেক স্বৈরাচারের শৃঙ্খলে নিয়ে আবদ্ধ করে। গণতন্ত্রই মানুষের স্বাধীনতাকে জীইয়ে রাখে। কেননা গণতন্ত্রই একমাত্র ব্যবস্থা যেখানে মতবিরোধকে সসম্মানে স্বীকার করে নেওয়া হয়।

সমাজ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে নানা পরীক্ষার পর জ্ঞানী মানুষেরা গণতান্ত্ৰিক মার্গটাকেই মোটামুটি সহ্য করে নিয়েছেন। কারণ এই ব্যবস্থাতে নেতৃত্বের উত্থান-পতন নিয়মতান্ত্রিক পথেই ঘটে থাকে। হিংসা বা হিংস্রতার আশ্রয় নিতে হয় না। পরিবর্তন ঘটাবার অস্ত্র যুক্তিসম্মত বাগ্মিতা। গুলি বা ঘাতকের কুঠার নয়। এই কারণেই গণতন্ত্রের প্রতি আমার এত অকুণ্ঠ ভালবাসা। যদিও গণতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আমি পূর্ণ সচেতন।

আমি পরিবর্তনের কথা বলেছি, নেতা বদলের কথা বলেছি। পরিবর্তনের জন্য ব্যাকুলতা মানুষের ধর্ম। তার মহৎ দুর্বলতাও বটে। মানুষ একদিকে গৃহস্থ আবার অন্যদিকে বিবাগী বৈরাগী। মানুষ ঘর বাঁধে দায়িত্ব নেয় প্রয়োজনের জন্য। আবার সেই মানুষই ঘরের বাঁধন ছিঁড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে এক দুর্নিবার আকর্ষণে। এই হচ্ছে মানুষের চরিত্র। দুটো বিপরীত ভাব দিয়ে তার স্বভাবটা তৈরি। নতুন করে গড়া আর গড়া-জিনিষ আবার ভাঙা। দুটো ক্রিয়াই মানুষের স্বভাবে বাসা বেঁধে আছে। কাজেই যে-মানুষ আজকে গড়ছে, আগামীকাল সেই মানুষই তা ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছে। যে-মানুষের গতকালের কাজ ছিল ভাঙা, সেই মানুষই আজ আবার গড়তে এগিয়ে এসেছে। মানুষ কিছুতেই তার সৃষ্টিতে তৃপ্ত থাকতে পারে না। এই সদা অতৃপ্তিই মানুষের প্রগতির প্রেরণা। মানুষ যেমন অতৃপ্ত, তার সমাজও তেমনি অস্থির। কেননা সমাজ মানুষের হাতেই গড়া। তাই মানুষের সমাজকে বুঝতে গেলে— মানুষকে বোঝা আগে দরকার। আর মানুষ স্বভাবতই পরিবর্তন-প্রিয়।

কাজেই পরিবর্তন-প্রিয় মানুষের পরিবর্তনশীল সমাজে কোনও ব্যবস্থাই ধ্রুব নয়। এই সত্য আমাদের স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের যতগুলো উপায় আছে তার মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়টিই আমার কাছে অধিকতর মানবিক এবং সেই কারণেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। যে-উপায়ে রক্তপাত ঘটে, তার মধ্যে আখেরি কল্যাণ থাকতে পারে বলে আমার মন সায় দেয় না। আমি সেই কথাই নকশালী তরুণদের, তাঁরা আমার প্রাণদণ্ডের হুকুম জারি করেছিল, বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। তাদের নিরর্থক হত্যার অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলাম। হিংসা এবং হিংস্রতা, এসব হচ্ছে জঙ্গলের স্বভাব। সভ্যতা আমাদের সহনশীল করেছে। সহাবস্থানে বিশ্বাসী করে তুলেছে। গণতান্ত্রিক আচার আমি একেই বলি।

হিংস্রতা আমাদের আদিম স্বভাবের অন্তর্গত। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আমাদের সভ্যতার দান। ডিক্টেটারি বা একনায়কত্ব আধুনিক পোশাকে- মোড়া আদিম হিংস্রতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই কারণেই ডিক্টেটারি টিকিয়ে রাখতে কেবলই বল প্রয়োগের দরকার হয়। এবং পরিবর্তন আনতে রক্তপাত কিছুতেই এড়াতে পারা যায় না।

গণতন্ত্রে বিরোধিতাকে সম্মান দেওয়া হয় বলেই এখানে পরিবর্তন সহজে হয়। এবং আজকের ক্ষমতাসীন নেতা আগামীকাল বিরোধী নেতার আসনে গিয়ে সভ্য আচার-আচরণের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।

বারবার ঘুরেফিরে তোমাকে যে গণতন্ত্রের সুবিধাগুলো দেখাচ্ছি, এতেই বুঝতে পারবে, গণতন্ত্র আমার কতটা প্রিয়। মানুষের মর্যাদা গণতন্ত্রে যেমনভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এমনটি আর কোনও ব্যবস্থাতেই পায়নি।

আজ দুঃখের সঙ্গে তোমায় জানাচ্ছি, যে-গণতান্ত্রিক আবহাওয়ায় গত ২৬ বছর আমরা কাটিয়েছি, তুমি জন্মেছ তের বছর আগে, তের বছর ধরে যার মধ্যে তুমি বড় হয়ে উঠছিলে, সেই গণতান্ত্রিক আবহাওয়া আবিল হয়ে উঠেছে। আজ সেই গণতন্ত্রকে নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছেন অদূরদর্শী শাসকগোষ্ঠী। দেশে আজ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। এবং জনসাধারণের মঙ্গল করবার দোহাই পেড়ে আমাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

আমার স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাটুকারবৃত্তি করার স্বাধীনতা ছাড়া অন্য সুরে কথা বলার অধিকারই আজ কারও নেই। এমন কি এই যে তোমাকে এই কথাগুলো জানাচ্ছি, এই অকপট উক্তি যখন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হবে, তখন হয়ত শুনবে তোমার বাবাকে এই অপরাধেও পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছে। কেননা, এসব কথা বলা এখন বারণ।

খবরটা পেয়ে তোমার দুঃখ হবে, কিন্তু ভয় পেয়ো না। এই ধরনের ছোটখাট ঘটনাই মানুষকে শক্ত হতে সাহায্য করে। তাকে ভাবতে শেখায়। এবং সেই ভাবনা তাকে হাত ধরে বড় হবার দিকে নিয়ে চলে। তুমিও নিশ্চয়ই ভাববে। কিন্তু কখনোই নিজেকে এলোমেলো ভাবনার হাতে সঁপে দিও না। ওতে লাভ হয় না। যে ভাবনা মনে প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং উত্তর পাওয়ার জন্য অস্থির করে তোলে, সেই চিন্তাই কাজের চিন্তা। এই ধরনের চিন্তাকেই মনে জায়গা দেবে। তুমি আমার সম্পর্কে যাই শোন না কেন, তাতে বিচলিত হবে না। সর্বদাই এই কথাটা মনে রাখবে, তোমার বাবা দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। তুমি যদি সত্যিই তোমার বাবাকে ভালবাসো, তবে তুমিও তোমার দায়িত্ব পালন করতে শিখবে।

তোমাকে এই চিঠি লেখাটাও আমার একটা দায়িত্ব পালন। আমাকে একটা কিছু করতেই হতো। নাহলে আমার নিজের কাছে জবাবদিহি করতে পারতাম না।

২৬ জুন থেকে এ পর্যন্ত আমি যে কী যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছি আমিই জানি। প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে, আমি প্রধানমন্ত্রীকে এই কথা বলি, প্রধানমন্ত্রী, আপনি এ কোন্ সর্বনাশের পথে নেমে এলেন। এ-পথে আপনার আমার আমাদের বংশধরদের কারও কল্যাণ নেই। ইতিহাস বারবার তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, ফিরুন! আপনি ফিরুন! ব্যস্, এইটুকুই আমার বলবার কথা।

আমি ষড়যন্ত্রকারী নই, রাজনীতির দলবাজী করি না, আমি মাত্রই এক লেখক। এবং দায়িত্বশীল। এবং সমাজসচেতন। এবং যুক্তিবাদী। নিজেকে সৎ রাখবারও চেষ্টা করি। তাই যখন বুঝলাম, প্রধানমন্ত্রী চোরাবালিতে পা ঠেকিয়েছেন, তখন সেটা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়াটাই আমার কর্তব্য বলে জ্ঞান করলাম। আমার বিন্দুমাত্র অহমিকা নেই, তাই আমি জানি আমার কথাতে প্রধানমন্ত্রী কানও দেবেন না। কিন্তু তাতে কি? আমি তো সর্বনাশ দেখতে পেয়েছি। আর তাই আমাকে তা বলতেও হবে।

আমি মস্তক মুণ্ডনও এই ভেবেই করেছি। আমার লেখার অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে আমার মর্যাদাকেই অপহরণ করা। তারই প্রতিবাদ জানিয়েছি আমার মাথা মুড়িয়ে।

কিন্তু আমি সেখানেই থামতে চাইনি। আমার অধিকার রক্ষা করবার জন্য আমাকে আরও একটু এগুতে হচ্ছে। আমাকে একথা বলতেই হবে: প্রধানমন্ত্রী! আপনি এ কোন্ সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছেন? এ-পথে কোনও কল্যাণ নেই। ফিরুন, আপনি ফিরুন।

স্নেহাস্পদেষু, তোমাকে লিখতে পেরে একটু স্বস্তি পেলাম। লেখাটা আরও অনেকে পড়ুন, আমি চাই। কেননা, তা হলে হয়ত আরও অনেকে নিজের কথা বলতে সাহস পাবেন। তাই এটা ছাপতে দিচ্ছি। গণতান্ত্রিক বাতাবরণে তোমরা বড় হয়ে ওঠো, এই কামনা।

আশীর্বাদক, তোমার বাবা,
গৌরকিশোর ঘোষ
কলকাতা, বর্ষা সংখ্যা ১৯৭৫

প্রধানমন্ত্রীকে, খোলা চিঠি

(ফ্যাসীবাদ-বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে গুটিকয়েক কথা)

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,

কারাগারে বন্দী অবস্থায় সম্প্রতি সংবাদপত্র মারফত প্রায় প্রতিদিনই ফ্যাসী-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে আপনার সুললিত ভাষণাবলী পাঠ করছি। এবং ফ্যাসীবাদ বিরোধিতায় আপনার এতাদৃশ অনুরাগ লক্ষ করে যৎপরোনাস্তি পুলকিত এবং কৌতুক বোধ করছি। বহু বিষয়েই, দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছি যে, আমার মত পরিণত মনের এক প্রৌঢ়— গত ২৭ বৎসর যাবৎ যে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতাকেই জীবিকা গ্রহণ করে মোটামুটি সৎভাবে তার অস্তিত্বরক্ষার চেষ্টা করে আসছে— আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছে না। কিন্তু এই একটি ক্ষেত্র, ফ্যাসীবাদ বিরোধিতা, আমার বীতস্রোত স্তিমিত জীবনে আজও তরঙ্গ তোলে। কেননা ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলনের আমিও একজন ভেটারান সৈনিক। আর ফ্যাসীবাদকে আজও আমি সভ্যতার শত্রু বলে মনে করি। তাই এই চিঠি।

আমি ১৯৩৮-৩৯ সালের কথা বলছি। অবশ্যই স্মৃতিমাত্র নির্ভর। তখন আজকের এই পরিণত প্রৌঢ় মাত্রই সদ্য-কৈশোর-অতিক্রান্ত এক প্ৰাণচঞ্চল তরুণ। সেদিন আমাদের কালে “ফ্যাসীবাদ সভ্যতার শত্রু” এই অমোঘ সত্যটি পৌঁছে দিয়েছিলেন মনীষী মানবেন্দ্রনাথ— কমরেড এম এন রায় নামে যিনি সমধিক পরিচিত। এবং সমস্ত প্রগতিশীল শক্তির কাছে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন সভ্যতার শত্রু ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। দুঃখের বিষয়, ভারতে ফ্যাসীবাদ কথাটা তখন ছিল নতুন। তাই বলাই বাহুল্য, তিনি কোনও সাড়া পাননি। না কংগ্রেসের কাছ থেকে, না সোস্যালিস্টদের কাছ থেকে; এমন কি কমিউনিস্টদের কাছ থেকেও না। মানবেন্দ্রনাথের কণ্ঠ সেদিন ছিল একক। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সত্য ছিল।

আজ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির লোলচর্ম যে সকল নেতা আপনার চারদিকে এক মৈত্রী-মণ্ডল সৃষ্টি করে আপনাকে সতত বেষ্টন করে ফ্যাসীবিরোধী আওয়াজে আসমুদ্রহিমাচল প্রকম্পিত করে বেড়াচ্ছেন, সেদিন ফ্যাসীবাদ কথাটির কোনও তাৎপর্যই তাঁরা ধরতে পারেননি। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার আওয়াজের আড়ালে তাঁরা তখন ফ্যাসীবাদের প্রতি সমর্থনই জানিয়ে চলেছেন।

তার একটা কারণ ছিল। সর্বহারা রাষ্ট্রের সোল এজেন্ট হিসাবে স্তালিনের রাশিয়া তখনও পর্যন্ত ফ্যাসী-নায়ক হিটলার-মুসোলিনীর বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। গতরও নাড়েনি। অপ্রস্তুত এবং “মুমূর্ষু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি” (এই কথাটিও মানবেন্দ্রনাথের। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই যুদ্ধে যদি ফ্যাসীবাদী শক্তির পতন ঘটানো যায় তবে সাম্রাজ্যবাদীদের সব সাম্রাজ্যও যুদ্ধের পর একে একে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে) ব্রিটেন ও ফ্রান্স সেদিন জনমতের চাপে সভ্যতার উপর ফ্যাসীবাদের হিংস্রতম আক্রমণ প্রতিরোধ করতে রুখে দাঁড়িয়েছিল। জগতের প্রগতিশীল মহল যখন প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতীক্ষা করছে, এই বুঝি রুশও নেমে পড়ল ফাসীস্তদের বিরুদ্ধে, কেননা নাজী আক্রমণের বেগ তখন পূর্বগামী, অস্ট্রীয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী ইতিপূর্বেই পদানত, এবার লক্ষ্য পোলান্ড, কিন্তু যা প্রত্যাশিত তা হ’ল না; সোভিয়েট রুশ নাজী জার্মানীর সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হ’ল। পোলান্ড বাঁটোয়ারা হ’ল সোভিয়েট রাশিয়া আর নাজী জার্মানীর মধ্যে। মলোটভ-রিবেনট্রপ শান্তিচুক্তির পাটোয়ারী দলিলে সেদিনের এই লজ্জাজনক ইতিহাস বিধৃত হয়ে আছে।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, এবারে আপনার অধুনাতন ফ্যাসীবিরোধী মিত্রবর্গের মহা ডিগবাজীর উপভোগ্য এক প্রহসন শোনাই, অবধান করুন। একালের কোনও গোগোল অথবা মলিয়েরের হাতে “মলোটভ ককটেল” শিরোনামে অপূর্ব সৃষ্টির উজ্জ্বল নিদর্শন হিসাবে যা কিনা প্রতিভাত হতে পারে। তাহ’লে শ্রবণ করুন। মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির পর ছয়মাসকাল আপনার ফ্যাসীবিরোধী আন্দোলনের সদাসঙ্গী মহাপ্রভুগণ “স্তালিন-হিটলার সাম্রাজ্যবাদের শত্রু, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক” এই কীর্তনে মেতে উঠেছিলেন। তারপর ছ’মাস বাদেই সেই মহান ডিগবাজী এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের সঙ্গে গাঁটছড়া, কেননা ইতিমধ্যে রুশ মাটিতে এগিয়ে গিয়েছে হিটলারী হানা। মৈত্রী হয়েছে রুশ-মার্কিন-ব্রিটেনে, ফলে কমরেড কবির কলমে জন্ম নিল অপূর্ব এক সুভাষিত ফ্যাসীবিরোধী কবিতা এবং গান হয়ে তা জনযুদ্ধের স্কোয়াডের কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে “বজ্রকণ্ঠে তোলো আওয়াজ, জাপানী দলকে রুখবো আজ, দেবে না জাপানী উড়োজাহাজ, ভারতে ছুঁড়ে স্বরাজ” ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ফ্যাসীবাদ বিরোধী স্কোয়াডের কাঁধে কাঁধে ঘুরতে লাগলো চার্চিল-রুজভেল্ট-স্তালিনের প্রতিকৃতি। চৈতন্যের কি ত্বরিৎগতি উন্মীলন!

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, এই মহান ডিগবাজী পর্বও ইতিহাসে বিধৃত। সেই ইতিহাস এই অধম লেখককে আজ উদ্‌ঘাটিত করতে হ’ল এই কারণে যে, আজকের ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলন নামক যে পালাকীর্তনের আপনি স্বয়ং মূল গায়েন, সেই পালাগানে যাঁরা আপনার দোহরকি করছেন এবং যাঁরা আপনাকে প্যালা দিচ্ছেন, তাঁদের সকলেই যে সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্যাসীবাদী এবং ফার্স্ট হ্যান্ড ডিগবাজীদাদা, এই সরল সত্যটি প্রকট করে দিতে!

১৯৩৮ সাল থেকে আমরা ফ্যাসীবাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছি। কাজেই এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ চর্চা করতেই হয়েছে। নাজীবাদের পীঠস্থান জার্মানীর (পশ্চিম) কয়েকটি জায়গা সফরকালে নাজী উৎপীড়নের শিকার কয়েকজন হতভাগ্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সুযোগও দৈবক্রমে লাভ করেছিলাম। এতদ্বারা যে সামান্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আহরণ করেছি তার উপর নির্ভর করে অন্তত যে কথাটা বলা চলে, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকেই তা বলছি। প্রগল্ভতা যদি কিছু প্রকাশ পেয়ে যায় তবে তা না হয় নিজ গুণেই মার্জনা করবেন। না হলে হাতের পাঁচ এমারজেন্সী, মিসা তো আছেই— যতটা প্রাণ চায় ততটাই সম্প্রসারিত করে ফ্যাসীবাদ বিরোধিতার আরও নতুন নতুন নজীর সৃষ্টি করবেন।

যে কথাটা বলতে চেয়েছি তা আমার নিজের কথা নয়, ভাষান্তরিত প্রচলিত একটা প্রবচনমাত্র— “হে চিকিৎসক! আপনি নিজের চিকিৎসা আগে করুন।” কেননা যার নিজের মাথায় টাক তার পক্ষে যেমন টাক বিনাশক অব্যর্থ মহৌষধ ফিরি করা শোভা পায় না, তদ্রূপ যিনি স্বয়ং ফ্যাসীবাদী আচরণের অনুরক্ত এবং যাঁর মানসিকতা ফ্যাসীবাদী মূঢ়তায় সমাচ্ছন্ন, তাঁর কণ্ঠে ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে ফাঁকা আওয়াজ একটা নিষ্ঠুর বিদ্রূপকেই মূর্ত করে তোলে। নয় কী?

কথাটা আরও একটু খোলসা করা ভালো।

যথা: (এক) অন্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা।

(দুই) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মুষ্টিমেয় পেটোয়া গোষ্ঠীর অর্থাৎ যো হুকুমের দলের সংকীর্ণ কুক্ষির মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা।

(তিন) জনগণের কল্যাণের অজুহাতে জনগণের মৌলিক ক্ষমতাসমূহ অপহরণ।

(চার) নানা অছিলায় বিরোধী দল দলন ও বিরোধী মত দমন।

(পাঁচ) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার হয় অবলোপ ঘটানো, না হয় তাকে পঙ্গু করে ফেলা।

(ছয়) পরমত অসহিষ্ণুতা।

(সাত) ব্যাপক হারে এবং নির্বিচারে দমন-নীতি প্রয়োগ।

(আট) প্রচারের মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণে এনে সেন্সরের মাধ্যমে একতরফা নিজের ঢাক পেটানো এবং বিরোধীদের চরিত্র হরণ।

(নয়) দলীয় নেতাই দেশ (এক নেতা, এক জাতি, এক পতাকা— এই ধ্বনিই ফ্যাসীবাদের প্রচলিত জিগীর)—এই অহমিকাকে নিরঙ্কুশ প্রশ্রয়দান, এবং

(দশ) ক্রমশঃ হিংসাত্মক মনোবৃত্তির কাছে আত্মবিক্রয়।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, এই দশ দশা ফ্যাসীবাদের সামান্য লক্ষণ। এই সকল লক্ষণ যাতে বিদ্যমান, প্রাজ্ঞজনেরা সেই ব্যক্তিকেই ফ্যাসীবাদী বলে থাকেন, এবং যিনি নিজে ফ্যাসীবাদী, আপনি সহজেই বুঝতে পারেন, তাঁর দ্বারা ফ্যাসীবাদ শুধুমাত্র কায়েমই হতে পারে, উচ্ছেদ কখনোই সম্ভবে না। তাই বলছিলাম, “হে চিকিৎসক, আপনি নিজের চিকিৎসা আগে করুন।” সত্যের মুখোমুখি হোন। গণতন্ত্রের বন্ধনদশা মুক্ত করুন। গণতন্ত্রকে তার সত্য স্বরূপে প্রতিষ্ঠা করুন। একমাত্র গণতান্ত্রিক শক্তিই ফ্যাসীবাদকে বিনষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। মানুষের মাহাত্ম্য গণতন্ত্রেই স্ফূর্তিলাভ করে। তাই আখেরে গণতন্ত্রকে কেউই দাবিয়ে রাখতে পারে না।

যেখানে লোভ, হিংসা আর মিথ্যার শাসন, ফ্যাসীবাদ সেখানেই প্ৰভু যেখানে অন্যায় আর অবিচার, দলন আর পীড়ন, ফ্যাসীবাদ সেখানেই প্ৰভু লোভ আর হিংসা আর মিথ্যা, অন্যায় আর অবিচার আর দলন আর পীড়ন ফ্যাসীবাদের এরাই একমাত্র আশ্রয়। তাই এগুলির উচ্ছেদেই ঘটবে ফ্যাসীবাদের চির পরাভব। আপনি ফ্যাসীবাদের উচ্ছেদ চান? সত্যিই চান? তবে আঘাত করুন সেই মূলে, মূঢ়তার অন্ধকার যেখানে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আপনার শুভবুদ্ধিকে, অপসৃত করুন সেই অহংকে, সত্যকে যা আবৃত করে রেখেছে, ছিন্ন করুন সেই ছলনাকে সোনার হরিণের মায়ায় যে আপনাকে প্রলুব্ধ করে রেখেছে। প্রতিষ্ঠা করুন সেই প্রাণময় গণতন্ত্রকে, যে উৎসাদিত করবে ফ্যাসীবাদকে। উৎসারিত করে দিন স্বাধীন চিন্তা ও চৈতন্যের সেই বেগবতী প্রবাহকে, নানা বিপরীত ভাবনার সংঘাতে সংঘাতে ফুলে উঠে ফেঁপে উঠে যা অতন্দ্র প্রহরীর মত সতত রক্ষা করবে গণতন্ত্রকে। ফ্যাসীবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রকৃত পথ এই। এই সংগ্রামে যদি নেতৃত্ব দেন, তবে স্বাগতম, আমি এবং আমার মতো প্রকৃত ফ্যাসীবিরোধী যোদ্ধারা আপনার পাশে আছি। কেননা এ পথ আমাদের অভ্যুদয়ের। এবং বিপরীত পথ বিনাশের। আপনার শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক।

ইতি—
শুভাকাঙ্ক্ষী, ভবদীয়
গৌরকিশোর ঘোষ
এমারজেন্সী মিসা কয়েদী
প্রেসিডেন্সী জেল, দশ সেল,
১লা ডিসেম্বর, ১৯৭৫।

দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা!

আমার প্রিয় স্বদেশবাসী ভ্রাতা ও ভগিনীগণ!

কারাগারের অভ্যন্তর থেকে আপনাদের উদ্দেশ্যে এই আমার প্রথম এবং সম্ভবত শেষ চিঠি লেখা। কেননা, এই চিঠি সমস্ত বাধা-নিষেধের গণ্ডী পার হয়ে সত্যিই যদি কোনদিন আপনাদের একাংশের হাতে গিয়েও পৌঁছতে সমর্থ হয় তাহলে, আমি জানি, আমার পরম প্রিয় সুহৃদ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পুতুল-নাচ-মঞ্চের প্যায়ারা গুড়িয়া শ্রীমান সিদ্ধার্থ শংকর মুখ্যমন্ত্রী জীউ সেটা বিশেষ প্রীতির চক্ষে দেখবেন না। ফলে আমার নিগ্রহের মাত্রা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা আছে। এই ঝুঁকি নিয়েও আপনাদের কাছে আজ যে এক সতর্ক বার্তা পৌঁছে দিতে অগ্রসর হয়েছি, তার কারণ বঙ্গ সাহিত্যের একজন দীন সেবক হিসাবে, এবং একজন বিবেকবান সাংবাদিক হিসাবে এইটে আমার কর্তব্য বলে মনে করেছি। একনিষ্ঠ গণতন্ত্রবাদী হিসাবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব বটে।

আমার স্বনামে বা ছদ্মনামে (রূপদর্শী এবং গৌড়ানন্দ কবি) প্রকাশিত কিছু রচনা হয়ত কোনও সময় আপনাদের কারো নজরে পড়েও থাকতে পারে। যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই জানেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, হিংসার বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আমার লেখনী অবিরাম ক্লান্তিহীন সংগ্রামে রত ছিল। তথাপি ৬ অক্টোবর ১৯৭৫ ভোর রাত্রে আমার বাড়িতে হানা দিয়ে ইন্দিরার গোয়েন্দা পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখাবার প্রয়োজনও তাঁরা বোধ করেননি। এবং অতঃপর সেই দিনই রাত্রে আমাকে বিনা বিচারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অপবাদে এমারজেন্সী মিসা আদেশবলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারে আটক রাখা হয়। তদবধি আমি কারাগারে। আমার বা আপনাদের হাতে এমন কোনও মৌলিক অধিকারই আজ আর অবশিষ্ট নেই, যা ব্যবহার করে আমি আদালতের শরণ নিয়ে সরকারের এই অন্যায় জুলুমের প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারি; আমার স্বাধীনতা ফিরে পেতে পারি। এখন আর আমি একা নই, ভারতবাসী মাত্রেই আজ কারাগারের বাসিন্দা। ব্যতিক্রম শুধু ইন্দিরা এবং সঞ্জয়।

ক্ষমতালোলুপ ইন্দিরার প্ররোচনায় রাষ্ট্রপতির আদেশবলে অথবা লোকসভার সংখ্যাধিক্যের জোরে নাগরিক সাধারণের সমস্ত রকম স্বাধীনতা আজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সংবিধানকে হত্যা করা হয়েছে। এবং সুপ্রিম কোর্টকেও করা হয়েছে বৃহন্নলা। কেবল দমন আর পীড়ন। কেবলই মিসা আদেশের প্রয়োগ। আজ এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে শ্রীমতী ইন্দিরার সাধের ক্ষমতার সৌধ। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের পরিবর্তে, হায়, আজ ইন্দিরার একমাত্র সহায় গুপ্ত পুলিশ, শুধু গুপ্ত পুলিশ। মিসার ঢালাও অপপ্রয়োগ কত করুণ হতে পারে, কারাগারে তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। অজস্র নিদর্শন। নানা রকম। পাঁচ বছর, সাত বছর বিনা বিচারে আটক। তের বছর, পনেরো বছর বয়সের কিশোর-কিশোরীও বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক। মানবতার এমন ঢালাও অপমান আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এরা কেউ আপনাদের ভাই কেউ বোন, কেউ ছেলে কেউ বা মেয়ে।

অথচ এর কোন প্রতিকারও নেই। সংবাদপত্রে আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, আমাদের এবারের প্রজাতন্ত্রী দিবসের উপহার হিসাবে প্ৰধানমন্ত্রী আমাদের কী দিতে চাইছেন! দাসত্ব। ষোল আনা দাসত্ব।

রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকার নিয়ে আমার, আপনার এবং আমাদের কোটি কোটি দেশবাসীর আদালতে যাওয়া রহিত করেছেন বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। অনুরূপভাবে সংবিধান বর্ণিত ১৪, ২১ এবং ২২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আমাদের মৌলিক অধিকারগুলির প্রয়োগ স্থগিত হয়ে গিয়েছে।

প্রিয় স্বদেশবাসিগণ! এগুলি শুধু কাগজের উপর কালিতে ছাপা প্ৰাণহীন কতকগুলি অক্ষরের সমষ্টি নয়। এইগুলি নাগরিকদের মানুষ হিসাবে বাঁচবার স্বাভাবিক অধিকার। এগুলি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের আমার আপনার রক্ষাকবচ। এগুলির বলেই তাঁরা “বেঁচে থাকার অধিকার” “প্রবলের অন্যায় অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার অধিকার” লাভ করে থাকেন। এক ১৯ অনুচ্ছেদেই সাতটি স্বাধীনতা দেওয়া আছে। যথা:

(ক) বাক্-স্বাধীনতা, (খ) বিনা অস্ত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা, (গ) ট্রেড ইউনিয়ন বা সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, (ঘ) ভারত- ভূখণ্ডের সর্বত্র অবাধে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা, (ঙ) ভারত-ভূখণ্ডের যে কোনও জায়গায় বসবাস, গৃহ নির্মাণ ও চাকরি করার স্বাধীনতা, (চ) সম্পত্তি-অর্জন, ভোগ ও বিক্রয়ের স্বাধীনতা, এবং (ছ) যে-কোনও বৃত্তিগ্রহণ বা যে-কোনও ব্যবসা করার স্বাধীনতা

আমাদের এই সকল স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আদালতে হেবিয়াস কর্পাস আবেদনের অধিকারও কেড়ে নেবার জন্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছেন। সরকার অন্যায়ভাবে নাগরিকদের আটক করলে বা অত্যাচার করলে তার বিরুদ্ধে নাগরিকদের হেবিয়াস কর্পাসই ছিল রক্ষাকবচ। এই মামলায় সওয়াল করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে যা বলেছেন তাতেই সরকারের সর্বনাশা মনোভাব পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বলেছেন, “রাষ্ট্রপতি ২৭ জুন ১৯৭৫ যে আদেশ জারী করেছেন তদনুযায়ী জরুরী অবস্থা বলবৎ থাকাকালে কোনও নাগরিকই, তা তিনি যতই নির্দোষ হোন না কেন বা তাকে যদি ভুল বা মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে বা অলীক অভিযোগের ভিত্তিতে বেআইনীভাবে বা অন্যায়ভাবে বা ভুলক্রমে আটক রাখা হয়ে থাকে তবুও তিনি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণের প্রতিকার কল্পে কোনও আইনসঙ্গত বা সংবিধানসঙ্গত অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।” (স্টেটসম্যান ১০ জানুয়ারী ১৯৭৬, পৃ. ৭, কলম ৪)

সুধীজনমণ্ডলী! এখন আপনারাই বিচার করে দেখুন এর পরেও মানুষ হিসাবে বাঁচার কোন্ অধিকার আর আমাদের থাকে? বিচার করে দেখুন ২৬ জুনের আগে পর্যন্ত আপনারা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রজাতন্ত্রী ভারতের স্বাধীন নাগরিক। আর মাত্র সাত মাসের মধ্যেই আপনারা প্রত্যেকেই পরিণত হয়েছেন ইন্দিরাতন্ত্রী ভারতের শৃঙ্খলিত ভূমিদাসে। কোনও অধিকারই আপনার নেই। আপনি সাত মাস আগেও ছিলেন স্বাধীন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। আর আজ? হতে চলেছেন প্রভুভক্ত জীবেরও অধম। আপনি যেই হোন, আজকের সমাজে যে-স্থানেই অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন কোথায় নিরাপত্তা?

আপনি পদস্থ সরকারী অফিসার? আপনি সমপর্যায়ের কোনও অফিসারের ঈর্ষা বা বিদ্বেষ কিংবা অধস্তন কোনও অফিসারের উচ্চাভিলাষের শিকার যে হবেন না, এ গ্যারান্টি আজ কোথায়? আপনি সাংবাদিক, সাহিত্যিক? যতই বশংবদ হোন না কেন, আপনার কোনও সহকর্মী অধিকতর বশংবদতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাঁর পথের কাঁটা সরাতে তৎপর যে হননি, সে বিষয়ে কি আপনি নিঃসংশয়? মনে রাখবেন ভুল খবর বা অলীক অভিযোগের ভিত্তিতে “বেআইনীভাবে অন্যায়ভাবে অথবা ভুলক্রমে গ্রেপ্তার ও আটক” রাখার অবাধ ক্ষমতা ইন্দিরার প্ররোচনায় রাষ্ট্রপতি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। আপনি আইনজীবী? চিকিৎসক? অধ্যাপক? শিক্ষক? ছাত্র? শিল্পপতি? শ্রমিক? ব্যবসায়ী? রাজনীতিবিদ? কংগ্রেসী? কোথায় আপনার নিরাপত্তা? যাকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য আর প্রয়োজন নেই, ক্ষমতালোভী ইন্দিরার কাছে তার মূল্য ছেঁড়া জুতোর চাইতে বেশি নয়। এমন কি আনুগত্যের সতত লাঙ্গুল সঞ্চালনকারী প্রভুভক্তির দামও ইন্দিরার কাছে কাণাকড়ি নয়। প্রমাণ সর্দার স্বরণ সিং, প্রমাণ উমাশঙ্কর দীক্ষিত, প্রমাণ বহুগুণা, প্রমাণ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি।

প্রিয় স্বদেশবাসিগণ! কী ভাবছেন বেড়ার উপর বসে? এ সাময়িক ব্যবস্থা? ইন্দিরা বিরোধীদের বেয়াদবিতে ক্রুদ্ধ হয়ে এই ব্যবস্থা নিয়েছেন? রাগ পড়ে গেলেই লক্ষ্মীমেয়ের মত ফেরত দেবেন আমাদের অপহৃত সব অধিকার? না কি ভাবছেন দাসত্বের শৃঙ্খল গলায় বেঁধে আজ তো চামড়া বাঁচাই, পরের কথা পরে ভাবা যাবে? না কি ভাবছেন দেশের উন্নতির জন্য দিলামই বা আমাদের সব অধিকার আহুতি? এই যদি আপনার ভাবনার গতি হয়, তবে হিটলার ও মুসোলিনীর উত্থানের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন, সতর্ক হোন, নিজেকে এবং আপনার নিষ্পাপ বংশধরদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য এখনই তৎপর হোন। আর উন্নতি? দেশের জনগণের সর্বরকম স্বাধীনতা অপহরণ করে, জনগণকে দাসে পরিণত করে বিশ শতকের মানুষের সমাজে মোটা উন্নতিও যে করা যায় না, এই সত্য আজ আমাদের নূতন সুহৃদ সোভিয়েট রুশী দেশের গত প্রায় ষাট বছরের ইতিহাসই নগ্নভাবে উদ্‌ঘাটন করে দিয়েছে। সোভিয়েট রুশ আজ আমেরিকার বড় বড় পুঁজিবাদী শিল্প কারটেলের শশব্যস্ত আমন্ত্রণ-কর্তা, আমেরিকার পুঁজিবাদী শস্যের বাজারে সব থেকে শাঁসালো পাইকারী খরিদ্দার। আগামী পাঁচ বছর ধরে সর্বহারার স্বর্গ “ঘৃণ্যতম” পুঁজিবাদী বাজার থেকে শস্য আমদানী করে ক্ষুধার ঘাটতি পূরণ করবে।

পাইকারী দমন পীড়ন আর মিথ্যাকে অবলম্বন করলে দেশ গঠন করা যায় না। উন্নয়নের মায়াজাল সৃষ্টি করা যায় মাত্র। উৎপীড়নের দ্বারা, জবরদস্তি দাসত্ব চাপানোর দ্বারা মানুষের সৃজনী শক্তির উৎস খুলে দেওয়া যায় না। প্রমাণ সোভিয়েটের ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী শিল্পে অনগ্রসরতা। প্রমাণ কৃষি উৎপাদনে বিরাট ব্যর্থতা। প্রকৃতির রোষ বা আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থা ছাড়াও আর একটা শোচনীয় দিক উদ্ঘাটন করে দিয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত সোভিয়েট বিজ্ঞানী আঁদ্রেই শাখারভ। তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘মাই কান্ট্রি এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড’-এ (কলিন্স, হারভিল প্রকাশিত) শাখারভ সোভিয়েট পল্লীজীবনে কোলখোজের ভূমিদাসদের দুঃখ দারিদ্র্যে নিপীড়িত হতাশাব্যঞ্জক উদ্যমবিহীন জীবনযাত্রার শোচনীয় পরিচয় উদ্ঘাটন করেছেন। সেখানে সমর্থ পুরুষ কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে কাজের প্রতি অনীহা এবং মদ্যপানের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহ ক্রমশঃ বর্ধমান। জোয়ানরা ক্ষেতের কাজ ছেড়ে শহরাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে। কৃষির কাজ মুখ্যতঃ বর্তেছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং নাবালক-নাবালিকা খেত-মজুরদের উপর। সোভিয়েটের কৃষি উৎপাদনে মেয়াদী এবং ব্যাপক ব্যর্থতার এটা একটা বড় কারণ বলে শাখারভ মনে করেন।

তাহলেই দেখা যাচ্ছে, দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং জনসাধারণের স্বাধীনতাহরণ এবং পাইকারী আটক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে দাসত্ব কায়েম করে প্রধানমন্ত্রীর বড় সাধের কুড়ি দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মন্ত্র জপ করলেই দুধ-মধুর বন্যা বয়ে যাবে— এটা একটা বিরাট ধাপ্পা। এবং মিথ্যা মরীচিকা। যারা স্বৈরাচারী, ফ্যাসীবাদী, তাদের মদমত্ততার ভিত্তি মিথ্যার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই প্রচারের উচ্চনাদী জয়ঢাক পিটিয়ে মিথ্যাকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠার এত আয়োজন। মিথ্যাকে অপসারিত করে সত্যের প্রকাশ ঘটাতে পারলেই স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা তাই তাসের প্রাসাদের মত হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। কেননা তার কোনও নৈতিক শক্তি নেই।

তাই মিথ্যা অপসারণের দায়িত্ব শিক্ষিত লোকমাত্রকেই নিতে হয়। এ তার বিবেকের নির্দেশ, এ তার মনুষ্যত্বের দায়। আপনারা এই দায় গ্রহণ করবেন না? আপনাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় ও নিষ্ক্রিয়তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ইন্দিরার একনায়কতন্ত্র, নির্লজ্জ ফ্যাসীবাদ আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের গলায় এঁটে দেবে দাসত্বের শৃঙ্খল! আর আপনারা তা মেনে নেবেন শুধু আজকের দিনের স্বাচ্ছন্দ্যটুকুর বিনিময়ে? মনে রাখবেন, নিষ্ক্রিয়তাও পাপ, কেননা তাও সহযোগিতাই।

মনে রাখবেন, যুবরাজ সঞ্জয় আমাদের পরিত্রাতা নন, আমাদের অপহৃত গণতান্ত্রিক অধিকারসকলই আমাদের একমাত্র পরিত্রাতা। অধিকার যেমন অর্জন না করলে পাওয়া যায় না, তেমনি রক্ষা করতে না পারলেও অধিকার থাকে না। অতএব আমাদের হৃত অধিকার আমাদেরই পুনরুদ্ধার করতে হবে। এবং এই সংগ্রামে সত্যই হোক আমাদের একমাত্র হাতিয়ার। বিবেক হোক নেতা।

আসুন, আমরা মিথ্যাকে উন্মোচন করি এবং সত্যকে প্রকাশ করি। আসুন, আমরা নিগ্রহ ভোগের দ্বারা প্রসন্ন চিত্তে সন্ত্রাসকে পরাভূত করি। আসুন, আমরা স্বৈরাচারী প্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সর্বতোভাবে অসহযোগিতা করি। আসুন, আমাদের সব ভালবাসা স্বাধীনতায় অর্পণ করি। আসুন, অহিংসায় দীক্ষিত হই, কারণ অহিংসাই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার শক্তি রাখে। এবং আজ, প্রজাতন্ত্রী দিবসে, আসুন, উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করি— দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা। স্বৈরাচার নয়, গণতন্ত্র। আসুন সমবেতভাবে গেয়ে উঠি:

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে      কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে      কে পরিবে পায়।”

জয় হোক গণতন্ত্রের। জয় হোক প্রেমের। জয় হোক মানুষের।

ইতি বিনীত
গৌরকিশোর ঘোষ
এমারজেন্সী মিসা কয়েদী
প্রেসিডেন্সী জেল, দশ সেল,
প্রজাতন্ত্রী দিবস, ১৯৭৬।

অন্নদাশঙ্কর রায়কে লেখা চিঠি

প্রেসিডেন্সী জেল
১৫ই নভেম্বর
১৯৭৫

শ্রীঅন্নদাশঙ্কর রায়
শ্রদ্ধাস্পদেষু,

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

ভেবেছিলাম আমার ব্যাপারটা নিয়ে আপনাকে বিব্রত করব না। বিশ্বাস করুন, ব্যাপারটা যদি সত্যি নিছক ব্যক্তিগত হত তবে নিশ্চয়ই আপনাকে বিরক্ত করতাম না।

কিন্তু বিষয়টি যদিও অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনাবিচারে আমার কারাবাস, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারের সঙ্গে জড়িত বলেই ব্যাপারটা আর দেশকালের সীমানার মধ্যে আটকে নেই। তাই এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হচ্ছে। কেননা আমি জানি, আপনি বরাবর সত্যের পক্ষে, ন্যায়বিচারের পক্ষে, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে। বস্তুত এই সকল ব্যাপারে আপনার প্রেরণাদায়ক রচনাদিই যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারীদের বিরুদ্ধে আমার রুখে দাঁড়াবার উৎসাহের অন্যতম উৎস, সে কথাও আমাকে স্বীকার করতে হবে। এছাড়া, আপনি স্বীকার করতে চান আর নাই চান বয়োধর্মগতিকেও আপনি এযুগের বঙ্গসাহিত্যের মুখ্য প্রতিনিধি। মুখপাত্র বা।

তাছাড়া অতি সম্প্রতি আমি কোনও এক সংবাদপত্রে দেখলাম বাংলাদেশের ঘটনায় অতিমাত্রায় বিচলিত বোধ করে পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য সাহিত্যিককুল বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের স্বার্থে তথায় অবিলম্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য যৌথ স্বাক্ষরিত যে বাণী প্রেরণ করেছেন তন্মধ্যে আপনার স্বাক্ষরও বিদ্যমান। এবং ভারতরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্বকারীর বিরুদ্ধে আমার একক নগণ্য সংগ্রামও যে মূলত বঙ্গভাষা ও সাহিত্যেরই স্বার্থে, একথা উপলব্ধি করে এই কারণে আনন্দিত হচ্ছি যে আমাদের এই প্রান্তে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের স্বার্থরক্ষাকারী প্রহরীগণ এখনও জাগ্রত আছেন, এখনও তাঁরা তাঁদের তরবারি কোষবদ্ধ করেননি।

সেই উদ্দীপ্ত আশাই আমাকে কারাভ্যন্তর থেকে আপনার কাছে এই চিঠিখানি লিখতে প্ররোচিত করেছে।

আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি গত ৬ই অক্টোবর শেষরাত্রে গোয়েন্দা পুলিশ আমাকে বাড়ী থেকে বিনা গ্রেপ্তারী পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে এবং সেইদিনই সন্ধ্যাকালে আমাকে এমারজেনসি মিসা বলে আটক করে প্রেসিডেন্সী ফাটকে ভরে দেওয়া হয়। তদবধি আমি এখানে সেল-বন্দী।

আমার অপরাধ? সরকারী সেনসর জুন মাসের শেষে আমার দুটি রচনা বাতিল করে দিলে এটাকে আমি আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করি এবং প্রত্যেকটি রচনা প্রকাশিত হবার আগে সেনসরের কাছে জমা দিতে হবে, সরকারের এই নির্দেশও আমি লেখকের মর্য্যাদাহানিকর এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করি। এবং তার প্রতিবাদে মস্তক মুণ্ডন করে নৈতিক সংগ্রাম শুরু করি।

পরবর্তী পর্যায়ে শ্রীজ্যোতির্ময় দত্ত মহাশয় সম্পাদিত কলকাতা পত্রিকার বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যায় আমার দুটি বাতিল রচনা এবং লেখকের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদস্বরূপ আর একটি রচনা প্রকাশিত হয়। সম্ভবত আমার কারাবাসের কারণ তাই। সম্ভবত বলছি এই কারণে যে আমি সত্যিই জানি না। আমাকে আটক রাখার কোনও সুস্পষ্ট কারণ দেখানো হয়নি। সাধারণভাবে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পরিপন্থী যে কোনও কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য” আমাকে আটক করা হল। এবং আশ্চর্যের কথা মাননীয় রাজ্যপাল মহোদয়ও আমার বিরুদ্ধে উচ্চারিত এই মিথ্যা অপবাদটি সম্পর্কে কোনও খোঁজ না নিয়েই সেটি অনুমোদন করে পাঠালেন। এই আমার অনির্দিষ্টকাল কারাবাসের সংক্ষিপ্ত ইতিকথা।

এখন আপনার মাধ্যমে আমাদের বিবেকবান সাহিত্যিক গোষ্ঠীর কাছে আমার প্রশ্ন, আপনারা একজন সাহিত্যিককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল কারাগারের সেলে আটক রাখাকে ন্যায়নীতি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করেন কিনা? যদি করেন তবে এর প্রতিকারের চেষ্টার নৈতিক দায়িত্ব আপনাদের উপর কিনা? যদি বর্তায় তবে সে দায়িত্ব পালন না করাকে অধর্ম মনে করেন কিনা?

এ প্রশ্ন বিনীতভাবে আপনার কাছেও উত্থাপন করছি। আশা করি একটা উত্তর পাব। ভালই আছি। আপনি ও লীলা দি আমার প্রণাম জানবেন।

আপনাদের
গৌরকিশোর ঘোষ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *