দারিয়ুসের অবিশ্বাস
দরজাটা খুলতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হল। একটা স্যাঁতস্যাতে বন্ধ সুগন্ধী মিশ্রিত বাতাস এসে খাইরুলকে জড়িয়ে ধরল। প্রায় চারদিন পরে এই ঘরটা খোলা হল। মেরিলিনা অপহৃত হওয়ার পর থেকে এই ঘরটা আর খোলা হয়নি।
জানালা খুলে দিতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল। কিন্তু খাইরুল সাহেবের এই আলোতে হবে না। তিনি ঘরের সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর আবার ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করলেন। তারপর দরজাটা ধাক্কা দিয়ে হালকা খুললেন। দ্রুত গতিতে ঢুকে পড়লেন ঘরের ভেতরে। মন দিয়ে লক্ষ্য করলেন মেঝেটা। নাহ, কোন জুতার কোন ছাপ নেই। খাইরুল কুঁজো হয়ে আরও মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেন মেঝেটা। যদি চিহ্ন থেকেও থাকত তাহলেও এতদিনে ধুলোর নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। খাইরুল এমন কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন, যেটা দেখে বোঝা যায় যে মেরিলিনাকে জোর করে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কোন মাথার চুল নেই। ছেড়া কোন কাপড় নেই। কিচ্ছু নেই। পুরো ঘরটাই সাজানো গোছানো। শংকরের ধারণা কি তাহলে ভুল? খাইরুল কুঁজো হয়ে খাটের নিচটা দেখতে গেলেন! একটা কয়েন পড়ে গেল তার বুক পকেট থেকে। খাইরুল ওটা তুলতে গিয়েই দেখলেন, খাটের পায়ার চারপাশে শুকনো রক্তের দাগ। খুব সূক্ষ্ম। কিন্তু খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে ওটা শুকিয়ে যাওয়া রক্ত।
খাইরুল রক্তের দাগটার কয়েকটা ছবি তুলে নিলেন। তারমানে শংকর ঠিকই বলছিলেন। মেরিলিনা ইচ্ছা করে যায়নি। ওকে জোর করে কেউ ধরে নিয়ে গিয়েছে। ছবিটা নিয়ে থানায় যেতে হবে। এক্ষুনি। এমনিতেই অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে।
বাইরের ঘরে শংকরকে দেখে খাইরুলের মনে পড়ল, তিনি আর অফিসার ইনচার্জ নেই। থানার সাথে সব রকমের সম্পর্ক তিনি নিজে হাতে চুকিয়ে দিয়ে এসেছেন। এটা মনে হতেই খাইরুল কিছুটা বিভ্রান্ত বোধ করলেন। শংকর খাইরুলকে দেখে বললেন, “খাইরুল সাহেব? কি হল?”
খাইরুল যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন শংকরের ডাকে। অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ? হ্যাঁ বলেন।”
শংকর বললেন, “বলছি কি হল? ওভাবে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসেন স্যুপ রান্না করেছি। স্যুপ খাবেন আসেন। আপনার শরীরের জন্য ভালো।”
খাইরুল রোবটের মত শংকরের সামনের চেয়ারটা টেনে বসলেন। এখনও তার তলপেটে আর বাম কাঁধে তীব্র ব্যথা। জোরে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। শংকর একটা গোল বাটি ভর্তি স্যুপ বাড়িয়ে দিলেন খাইরুলের দিকে। খাইরুল চুমুক দিয়ে পুরো বাটিটা শেষ করে ফেললেন। তারপর শংকরকে বললেন, “আপনি বাইরে বের হয়েন না। কেউ দেখে ফেললে পুলিশে খবর দেবে। ঝামেলা হয়ে যাবে।”
শংকর নীরবে মাথা নাড়লেন।
খাইরুল আবার বললেন, “আমরা যখন সব প্রমাণ যোগাড় করে ফেলতে পারব, তখন আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব সত্যিগুলো তুলে ধরব। চিন্তা করবেন না শংকর সাহেব, আপনি নির্দোষ।”
শংকর মাথা নেড়ে বললেন, “আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই খাইরুল সাহেব। আপনার এই অবস্থার জন্য অনিচ্ছাকৃতভাবে আমিই দায়ী। এই অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আপনার যেকোন ধরনের সাহায্য আমি করতে রাজি আছি
খাইরুল মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন, “এইমুহূর্তে আপনি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেই আমার জন্য সব থেকে বড় সাহায্য হবে।”
শংকর শূন্য বাটিটা নিয়ে রান্না ঘরে গেলেন। খাইরুল বাম হাত বাড়িয়ে ওয়াল হ্যাঙারে ঝোলানো মেরিলিনার ফেলে যাওয়া চাবিটা নিলেন। শংকরের অলক্ষ্যে চাবিটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন। তাড়াতাড়ি হাত নাড়াতে গিয়ে তার কাঁধে বিষ পিপড়া কামড় দেওয়ার মত ব্যথা হল। খাইরুল ব্যথাটা দাঁত চেপে সহ্য করলেন। এই লোকটা তাকে নির্দয়ভাবে মেরে জখম করেছে। যতই মুখে বলুক, যতই এটা সেটা বলুক, এই লোকটাকে অন্ধ বিশ্বাস করবেন না তিনি। হতে পারে লোকটা গুপ্তচর। খাইরুলকে ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছে। নাহ, মেরিলিনার চাবির ব্যাপারে তাকে বলা উচিত হয়নি। তাছাড়া তিনি যে এই চাবিতে লেখা ঠিকানায় যাবেন সেটাও শংকরকে বলা যাবে না। তিনি একা যাবেন। লোকটার কথাগুলোও বিশ্বাসযোগ্য না। শংকর সাহা নামে একজন জেলসুপার জেল ভাঙার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিল বহুদিন আগে। সরকার এখনও তাকে খুঁজছে। এই লোকই যে শংকর সাহা তার যথাযথ প্রমাণ কি? তারাগাছির লাশটার ব্যাপারে যে তথ্য লোকটা দিয়েছে সেটা যাচাই করতে পারে একজন মানুষ, জয়ন্ত মল্লিক। মল্লিক যে লোকটার কাছ থেকে চাবিটা পেয়েছিল, শংকরের মতে, এই লোকই পরোক্ষভাবে খুনটার সাথে জড়িত। যদি সেরকমই হয়, তাহলে শংকরকে বিশ্বাস করা যায়। তারপর? তারপর শংকরকে যদি পুলিশের হাতে দিয়ে দেওয়া যায়? খাইরুলের চোখ জোড়া চক চক করে উঠল। পুরস্কার হিসেবে সে পাবে দশ লক্ষ টাকা। নাহ, কি সব ভাবছে। শংকরকে পুলিশের হাতে দিলে তার লাভ কি?
শংকরকে রান্নাঘর থেকে আসতে দেখেই খাইরুল পকেট থেকে হাত বের ফেললেন তিনি।
শংকর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “এখন আপনার প্ল্যান কী খাইরুল সাহেব?”
খাইরুল বললেন, “আমি এখন একটু হাসপাতালে যাব। মল্লিকের জ্ঞান ফিরল কিনা দেখতে হবে। আমার খুব কাছের বন্ধু মল্লিক।”
শংকর কী একটা বলতে যাচ্ছিলো, খাইরুল সেটা অগ্রাহ্য কওে আবার বললেন, “আমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন শংকর সাহেব। আমি যে কথা দিয়েছি, সেই কথা রাখব।”
শংকর নিজের জন্য একট বাটি স্যুপ ঢেলে নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন। তাকে যেভাবেই হোক মেজর জেনারেল ফিরোজকে খুঁজে বের করতে হবে। তার কাছে জানতে হবে, কেন তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল? কেন তাকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল? প্রশ্নের উত্তর পেলে শংকর নিজ হাতে জানোয়ারটাকে খুন করবেন। কসাইখানার শুকরের মত জবাই দেবেন। তারপর সুলেখা আর সুতপার খোঁজে বেরিয়ে পড়বেন। কোন না কোনভাবে তো তিনি নিজের সত্যতা প্রমাণ করেই ছাড়বেন। খাইরুল লোকটার জন্য খারাপ লাগছে। ভুল বোঝাবুঝিটা না হলে এইভাবে লোকটাকে পেটাতে হত না।
খাইরুল শার্ট পরতে যাওয়ার সময় শংকর সাহায্য করতে যাচ্ছিলো। খাইরুল মাথা নেড়ে জানালেন, তার সাহায্য লাগবে না। নিজে নিজেই বেশ কষ্ট করে শার্ট আর প্যান্ট পরলেন। তারপর কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। শংকর জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু খুঁজছেন?”
খাইরুল বলতে যাচ্ছিলেন, আমার রিভলটারটা। পরক্ষণেই তার মনে হল যে তিনি ইস্তফা পত্রের সাথে তার রিভলভারটাও জমা দিয়ে এসেছেন। তাই বললেন, “না কিছু না।”
খাইরুল শংকরকে দরজাটা লাগিয়ে দিতে বলে বিদায় নিলেন।
শংকর চুলায় পানি গরম করতে দিলেন। বসার ঘরের মেঝেতে বিশটা পুশ আপ দিলেন। বারান্দার দরজা দিয়ে হু হু করে হিমেল হাওয়া আসছে। শীত আসন্ন। শংকরের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। তাই উঠে গিয়ে বারান্দার দরজা লাগাতে গিয়ে কি মনে করে নিচে তাকালেন। খাইরুলকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন। শংকরের মাথার ভেতরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। চুলায় পানি চাপাতে আর বিশটা পুশ আপ দিতে তার দশ মিনিটের বেশি লাগেনি। তিনতলা থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে তো খাইরুলের এত সময় লাগার কথা না। তিনি দৌড়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলেন।
খাইরুল বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। লোকটা নিচে নেমেছে। তারপর আবার উপরে উঠে তালা লাগিয়ে দিয়ে নেমে গিয়েছে। শংকরের ভীষণ রাগ হল। তিনি দরজার আই হোল দিয়ে দরজার বাইরের দিকটা একবার দেখার চেষ্টা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ দরজাটা খোলার চেষ্টা করলেন। প্রতিবার ব্যর্থতায় রাগ বাড়তে লাগলো। দরজায় একটা লাথি কষে দিলেন তিনি। খাইরুল যে তাকে অবিশ্বাস করছে এইটা বুঝতে বাকি থাকল না তার। কিন্তু বুঝেও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হল তার। খাইরুল কেন তাকে অবিশ্বাস করবেন?
চুলায় পানি ফুটে গিয়েছে। শংকর অস্বস্তি চাপা দিয়ে গোসল করলেন। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে গোসলটা ঠিকঠাক মত হল না। গোসল করার পুরোটা সময় তিনি ভাবতে লাগলেন, খাইরুল সাহেবের কিছু হলে তাকে সাহায্য করার মত কেউ থাকবে না। তালেব মাস্টার লোকটাও সুবিধার না। তিনি এইভাবে বন্দী হয়ে থাকলে বিপদ দুইজনেরই বাড়বে বৈ কমবে না। বের হতে হবে। যেভাবেই হোক এই বাসা থেকে বের হতে হবে।
এলোমেলোভাবে কোন রকমে গোসল করে শংকর জামা কাপড় পরে নিলেন। তারপর পেছনের দিকের বারান্দার দিকে গেলেন। একটা আম গাছ বাঁকা হয়ে বারান্দার গ্রিল স্পর্শ করে উপরে উঠে গিয়েছে। গাছের ওপাশে একটা বিদ্যুতের পোল। আর পোলের পাশেই আরেকটা ফ্ল্যাটের জানালার কার্নিশ।
শংকর সারা বাসা খুঁজে রান্নাঘরে একটা মাঝারি আকারের হ্যাক-স পেলেন। মাঝারি হ্যাক-স দিয়ে গ্রিল কাটতে অনেক সময় লাগবে। তিনি হ্যাক-স’টা চুলার আগুনে তাতিয়ে নিলেন। তারপর বারান্দার গ্রিল কাটতে শুরু করলেন। সময় সাপেক্ষ কাজ। শংকর নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিলেন। তারপর ধৈর্য্য ধরে একটা একটা করে গ্রিলের ফলা কাটতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর পর হ্যাক-স’টা চুলার আগুনে তাতিয়ে নিলেন।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পরিশ্রমের পরে শংকর প্রায় ষোলটা ফলা কেটে ফেললেন। ডান হাতের মাংসপেশিগুলো অবশ হয়ে গিয়েছে। টানা চল্লিশ মিনিট হাতটার ওপরে অনেক বেশি চাপ পড়েছে।
ফাঁকা অংশটা দিয়ে শংকর নিজের শরীরটাকে বাইরে গলিয়ে দিলেন। তারপর কোনরকমে লাফ দিয়ে আম গাছের ডালটা ধরলেন। পিছলে নামতে নামতে লক্ষ্য রাখলেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা গার্ডটা যেন না দেখে ফেলে। খুব সাবধানে, যতটা শব্দ কম করা যায় ততটা কম করে শংকর নামতে শুরু করলেন। দুই পা পাশের ফ্ল্যাটের জানালার কার্নিশের ওপরে বাধিয়ে দুই হাত দিয়ে আম গাছের শাখায় ধাক্কা দিয়েই শরীরটা ফ্ল্যাটের দেয়ালে গিয়ে মৃদু ধাক্কা খেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে কার্ণিশ থেকে লাফ মারতেই সশব্দে গিয়ে পড়লেন পাশের ফ্ল্যাটের গ্রাউন্ড ফ্লোরের লোহার গ্রিলের ওপরে। এখান থেকে গার্ডরুম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গার্ড শামছুল ছুটতে ছুটতে গেট খুলতে যাচ্ছে। এই সুযোগ। শংকর গ্রিলের দুইটা শিক ধরে লাফিয়ে পড়লেন পাশের মাটিতে। তারপর প্রাচীর টপকে সোজা রাস্তায়।
হাসপাতালে যাওয়া উচিত, শংকর ভাবলেন। পরক্ষণেই মনে হল, তাকে হাসপাতালে আশা করবেন না খাইরুল। করলে তাকে তালা দিয়ে বন্দী করে রেখে যেতেন না। শংকর ঠিক করলেন, রাজধানী যাবেন। সোজা মেজর জেনারেলের বাড়িতে। তার হারানোর কিছুই নেই। সুলেখা আর সুতপার কি হয়েছে এইটুকু জানার জন্যই তার বেঁচে থাকা। শংকর একটা অটো নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
শংকর পেছনে তাকালে দেখতে পেতেন, দুইটা পুলিশ ভ্যান ভবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে নামতে শুরু করেছে সারি সারি পুলিশ।
***
মল্লিক মারা গিয়েছে গতকাল। মস্তিষ্কে ভীষণ রক্তক্ষরণের পরেও লোকটা যে কিভাবে চল্লিশ ঘণ্টা বেঁচে ছিল সেটা একটা রহস্য। কোন নিকটাত্মীয়র খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে মল্লিকের এক সহকর্মীর কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। খাইরুল অসহায়ের মত ক্লিনিকের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এতদিনের পুরনো একটা বন্ধু বিয়োগে ভেতরটা অনুভূতিহীন মনে হল খাইরুলের। আশেপাশে কোলাহল, কিন্তু তিনি যেন একটা শূন্যস্থানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। মল্লিকের মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো শংকরের। আরও কয়েকবার তিনি অফিসে মল্লিকের ব্যাপারটা দেখতে বললেন। অফিসে বসে থাকা স্থূলকায়া মহিলার হাতে অত সময় নেই।
দুপুর পেরিয়ে গেল। হেমন্তের নরম রোদ মাড়িয়ে খাইরুল একটা কফি শপে গিয়ে বসলেন। লাঞ্চের সময় বলে লোকজন তেমন একটা নেই। কফির কাপে গলে পড়তে থাকল হতাশা। প্ল্যানের প্রথম পদক্ষেপটাই বানচাল হয়ে গেল। শংকরের কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণেরও কোন উপায় থাকল না। এখন একটাই পথ খোলা। খাইরুল পকেট থেকে চাবিটা বের করলেন। তাকিয়া মহলে যাবেন তিনি। শংকরকে নিয়েই যাবেন।
অটোতে করে খাইরুল উরসুলা এপার্টমেন্টে চলে আসলেন। বিকেল বেলার ক্লান্ত রোদ সারি সারি ভবনের ফাঁক গলে সরু রাস্তার ওপরে পড়ছে। উরসুলার সামনে অনেকগুলো পুলিশের গাড়ি দেখতে পেলেন তিনি। মাথায় বাজ পড়ল তার। শংকরের ব্যাপারে কি কেউ জেনে গেল? পুলিশ কেন এখানে? খাইরুল এপার্টমেন্টে ঢোকার মুখে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এলো। দুইজনই খাইরুলের পরিচিত। রোগা মতন পুলিশটার নাম সঞ্জয়। খাইরুল যখন থানায় ছিলেন, তখন সঞ্জয়ের সাথে বেশ সখ্য ছিল। সঞ্জয় বলল, “স্যার ভালো আছেন?”
খাইরুল একটা কাঠ কাঠ হাসি হেসে বললেন, “হ্যাঁ ভালো আছি। তোমরা এখানে? কি অবস্থা? কিছু হয়েছে?”
মনে মনে শংকরের ব্যাপারে একটা দুঃসংবাদ ধরে নিয়েই খাইরুল প্রশ্নটা করলেন।
সঞ্জয় বলল, “আর বইলেন না। পাঁচ তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটটায় এক স্কুল পড়ুয়া ছেলে তার বাপকে কুপিয়ে জখম করে ফেলছে।”
খাইরুল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আজকাল টিনএজারদের ভেতরে এটা নতুন কিছু না। খাইরুল তাও প্রশ্ন করলেন, “কখন ঘটছে এই ঘটনা?”
“আর বইলেন না, বুঝছেন। শহরে কি এক প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প না কি সব শুরু হইছে। এই ছেলে নাকি পরীক্ষায় নকল করছে। পরে তার মনে হইছে এইটা পাপ। পাপ সে কেন করল? কারণ বাবা বলছে রোল এক থেকে পাঁচের ভেতরে আনতে হবে। তার এই পাপের কারণ হিসাবে সে তার বাপটাকেই কুপায়ে জখম করে ফেলছে। সে নাকি প্রায়শ্চিত্ত করছে।”
সঞ্জয় বিরক্তিভরে হাত পা নেড়ে চেড়ে কথাটা বলল, “গত কয়েকদিন ধরে কি যে হইছে এই শহরে স্যার। সেদিন এক ব্যাংকার তার বউরে মেরে ফেলছে। বউয়ের আবদার মত সোনার গয়না কিনতে গিয়ে সে একটা লোন স্যাংশন করতে গিয়ে ঘুষ খাইতে বাধ্য হইছে। তাই এই পাপের কারণ হিসাবে বউকে মেরে সে তার প্রায়শ্চিত্ত করছে।”
খাইরুল গম্ভীর হয়ে গেলেন। কবে থেকে শুরু হইছে এই ঘটনা। সঞ্জয় আস্তে আস্তে সব ঘটনা খুলে বলল। রাজনীতিবিদদের লাশ পাওয়া থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন পর্যন্ত। নতুন ওসির সাথেও পরিচয় হল। হাসি খুশি মানুষ। হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার মত তুখোড় পুলিশ অফিসার থাকতে ফ্ল্যাটে এত বড় একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল?”
খাইরুল একটা দায়সারা হাসি হাসলেন। কি বলবেন ভাবতেই ভাবতেই ওসি সাহেব ফরেনসিকের দলটার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
সঞ্জয় ফিসফিস করে বলল, “স্যার, আপনি একটু দেখে শুনে থাকবেন। নতুন ওসি কেন জানি একটু বেশিই কৌতূহলী। আপনার ওপরে নজর রাখতেছেন। সেদিন আপনার হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন করছিলেন।”
খাইরুল হুম বলে কোনরকমে কথাটা এড়িয়ে গেলেন। তার বিরক্ত লাগছিল।
এসপি সাহেবকেও চোখে পড়ল খাইরুলের। তিনি খাইরুলকে তেমন একটা গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না, খাইরুলেরও কারও সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিল না। তিনি ভিড় ঠেলে তিন তলায় উঠলেন। দরজা খুলে দেখলেন শংকর নেই। বারান্দার গ্রিলের শিক কাটা।