1 of 3

দায়মুক্ত

দায়মুক্ত

কয়েকদিন যেতে-না-যেতেই হাঁপিয়ে উঠলেন রজতাভ। কাঁহাতক চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে বসে থাকা যায়! সেই ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙার পর নিজে চা তৈরি করেন। কলকাতায় থাকলে শিখাকে ডেকে চায়ের কাপ ওর মাথার পাশে রাখতেন। শিখা উঠে পড়ত। এখানে শিখার ঘুম ভাঙে ঠিক সাতটায়। উঠেই ছেলের জন্যে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ছোটে। রঙ্গন অফিসে বের হয় ঠিক আটটায়। দু-মাস আগে বউমাও যেতেন। মাস খানেক আগে বাচ্চা হওয়ার পর তিনি স্বাভাবিক কারণেই দেরিতে বিছানা ছাড়েন।

বউমার সন্তান হবে শুনে শিখা চলে এসেছিল মাস দুয়েক আগে। আসার সময় রজতাভকে সঙ্গে চেয়েছিল। রজতাভ আসেননি। একা-একা কী করে কলকাতা থেকে কলম্বাসে আসবেন এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় শিখার ঘুম হয়নি। কথাটা বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর ইচ্ছের মূল্য রজতাভ কোনওদিন দেননি। আমেরিকা থেকে রঙ্গন অভয় দিয়েছিল। সে এয়ারপোর্টে থাকবে। মায়ের কোনও চিন্তা নেই। নাতি হয়েছে খবর পেয়েও কিছুদিন টালবাহানা করে শেষপর্যন্ত চলে এসেছিলেন রজতাভ। আমেরিকা তাঁর একদম ভালো লাগে না, কীরকম বন্দি-বন্দি মনে হয় নিজেকে। তার ওপর মাসটা এখন জানুয়ারি। বাইরে মাইনাস আট।

সেই ভোর থেকেই জানলার পাশে গিয়ে মাঝে-মাঝে দাঁড়ান রজতাভ। বাইরে বরফ আর বরফ। মাঝে-মাঝে বরফ-সরানো গাড়ি রাস্তা ঠিক করে যাচ্ছে। আর ছুটছে শোঁ-শোঁ গাড়ি, ভাবখানা। এখন যেন থামলেই জমে যাবে। অন্য সময় বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন, চাই কি মলেও পৌঁছে যেতেন। ছুটির দিন বা অফিস ফেরত রঙ্গন তাঁকে নিয়ে ঘুরতে বের হত। এর বাড়ি ওর বাড়িতে নেমন্তন্ন রাখতে যেত। এখন তো বাইরে হাঁটার কোনেও সুযোগই নেই। একহাঁটু। বরফে দু-মিনিট থাকলেই জমে যাবেন। অফিসের পর রঙ্গন বাড়ি ফিরে অবশ্য বলে, যাবে কি নাকি কোথাও। কোথায় যাবেন? গেলে তো গাড়ির বাইরে পা দেওয়া যাবে না। ছেলের সঙ্গে কত আর বড়-বড় ডিপার্টমেন্টাল শপে ঘুরে বেড়াবেন। অতএব সময় কাটছে টিভি দেখে।

শিখার এসব সমস্যা নেই। বউমার শরীর দুর্বল বলে সে-ই সংসার সামলাচ্ছে। কত আধুনিক ব্যবস্থা এখানে, যা ইচ্ছে রান্না করা যায়। তারপর এক মাসের বাচ্চাটা তো আছেই। তাকে নিয়ে কাজের বাইরের সময়টায় পুতুলখেলা চলে তার। কলকাতায় থাকলে প্রায়ই তাঁদের বাকযুদ্ধ হয়। এখানে সেটা হচ্ছে না।

রঙ্গন মদ্যপান করে না। কিন্তু বাবার জন্যে স্কচ এনে দেয়। নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় দুপেগ হুইস্কি খান তিনি। এই অভ্যেসটা হয়েছিল পঞ্চাশ বছরের পর যখন তিনি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হয়েছিলেন।

ছেলের দিকে তাকালে তাঁর খুব ভালো লাগে। পড়াশুনায় তো ভালোই ছিল। তরতর করে প্রতিটি পরীক্ষায় আশির ওপর নম্বর পেয়ে আমেরিকায় চলে এসে দিব্যি চাকরি করছে। এরমধ্যে তিনবার বাড়ি বদলেছে। প্রতিবারই বাড়ির সাইজ বেড়েছে। দেশে থাকলে প্রতি সপ্তাহে দু-বার ফোন পান ছেলের। বউমাটিও মন্দ নয়।

কিন্তু তাই বলে কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে বরফের মধ্যে গৃহবন্দি হয়ে থাকার কোনও মানে হয় না।

ছেলে বলল, তুমি লস এঞ্জেলেসে চলে যাও। ওখানে বরফ তো দূরের কথা ঠান্ডাও বেশি পড়ে না। আমার বন্ধু সুব্রতকে বলেছি। ও খুব আগ্রহী। অনেক জায়গা ওর বাড়িতে। কয়েকদিন ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে এসো।

না-না, একি হয়? চিনি না জানি না! রজতাভ আপত্তি জানালেন।

সুব্রতকে দেখলে একথা মনে হবে না। ও খুশি হবে তোমাকে পেলে!

কিন্তু রজতাভ রাজি হলেন না।

শনিবার বিকেলে এই বাড়িটায় যেন উৎসব শুরু হয়। বউমা এখন শরীরের কারণে পারছেন না কিন্তু তাঁর ভূমিকা শিখা নিচ্ছে। আড়াইটে নাগাদ মা-ছেলে বেরিয়ে যাচ্ছে বরফ ঠেলে। ফিরে আসে পাঁচটায়। রিমোট টিপে গ্যারাজের দরজা খুলে রঙ্গন গাড়ি ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড বাড়ির উত্তাপ গ্যারেজেও থাকে। তারপর গাড়ির ডিকি থেকে প্যাকেটের-পর প্যাকেট নামায় ওরা। রজতাভ সোফায় বসে দেখেন।

প্যাকেট খুলে জিনিসগুলো বের করতে-করতে শিখার মুখে আলো ফোটে, কি দারুণ বেগুন, তোদের এখানে কত টাটকা আর বড় সবজি, আমাদের ওখানে চোখেই দেখিনি! কই মাছটা দ্যাখা তোর বাবাকে, দশ ইঞ্চি লম্বা। ইলিশের সময় বাজার থেকে এক কেজির বেশি নিয়ে আসতে পারে না। অথচ এখানকার বাংলাদেশিদের দোকানে আড়াইকেজি ইলিশের ছড়াছড়ি। তোর এখানে না এলে এসবের দেখাই পেতাম না।

শুনতে-শুনতে মুখ না খুলে পারেন না রজতাভ, বেশ তো, বাকি জীবনটা এখানেই থেকে যাও। নয়ন ভরে দেখে যেতে পারবে।

ছেলে মাথা নাড়ল, নো মোর বাবা।

শিখা বলল, দেখলি! সব সময় আমাকে না খোঁচালে ওঁর ভাত হজম হয় না।

হ্যাঁ। খাওয়ার সুখ আছে এখানে। এত বড় লবস্টার কখনও চোখেই দ্যাখেনি রজতাভ। গাড়ি বাড়ির আরাম আছে। কিন্তু জীবন? জীবন কোথায়? সেই সকালে বেরিয়ে যায় ছেলেটা, ফেরে। সন্ধের মুখে। বউমাও তাই। তখন কোনওমতে রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে না দিলে ভোরে উঠবে কি করে?

আর একটা ব্যাপার ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠেছে রজতাভের কাছে। আচ্ছা নেই, হইচই নেই। মাইনের চেক থেকে বাড়ি-গাড়ির ইনস্টলমেন্ট দিয়ে যাও। তাই প্রত্যেক শুক্র বা শনিবারে এর বাড়ি ওর বাড়িতে কথা বলার জন্যে জমায়েত। ক্যালেন্ডারে ছমাসের যত শুক্র এবং শনিবারে। সব লেখা হয়ে আছে। কবে কার বাড়িতে যেতে হবে। যেহেতু বউমার বাচ্চা হয়েছে তাই আগামী পাঁচ মাস এ-বাড়িতে জমায়েত হতে পারে না।

রঙ্গন জোর করে তাঁকে নিয়ে যেত, শিখা খুশি হয়েই যেত। রজতাভ লক্ষ করেছেন এই পাঁর্টিগুলোর চেহারা। যাঁর বাড়িতেই পার্টি হোক অতিথিদের সংখ্যা প্রায় এক আর একই মুখ সর্বত্র। কারণ একটাই, এই বাঙালিরাই শহরের বাসিন্দা। যদিও প্রচুর বাংলাদেশি এই শহরে থাকেন কিন্তু কলকাতার বাঙালিরা তাঁদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে পছন্দ করেন না। এরকম পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়ে সত্তর-আশি মাইল গাড়ি চালিয়েও লোকে আসে। সাতটার মধ্যে জমায়েত শুরু হয়ে যায়। গৃহকর্তা পানীয় অফার করেন। অর্ধপেগ হুইস্কি অথবা কোমল পানীয়। সেটা শেষ। হওয়ার আগেই গৃহকত্রী সবিনয়ে জানান ডিনার পরিবেশিত হয়েছে। খেতে-খেতে গল্প চলে। একই গল্প। শিখা দুটো পার্টিতে এক পোশাক পরে যায় না। গহনাও আলাদা। না, এটা সম্রাট থেকে কেনা। না-না, নিউমার্কেট কেন, দক্ষিণাপণেই সব পাওয়া যায়। কথাবার্তা এই একই খাতে বয়ে যায়। বাড়ি ফেরা সাড়ে আটটায়। রজতাভ বিরক্ত হয়ে পার্টিতে যাওয়া বন্ধ করলেন। শিখা এসে গাল ফুলিয়ে বলল, কি করছ, তুমি না গেলে সবাই প্রশ্ন করবে। কি জবাব দেবে খোকা?

যা হোক কিছু। বলবে বউমার শরীর খারাপ, তাই বাড়িতে আছি।

আশ্চর্য! বউমার শরীর খারাপ হলে আমার বাড়িতে থাকার কথা।

তাহলে বলে দিয়ে পেট খারাপ হয়েছে আমার।

তার মানে ছেলের সম্মান রাখতে তুমি যাবে না?

আমি না গেলে ওর সম্মান যদি চলে যায় তাহলে না যাওয়াই ভালো।

রজতাভ ছেলেকে ডাকলেন। জানিয়ে দিলেন কেন তিনি যাচ্ছেন না। রঙ্গন হাসল, সত্যি, একদম রোবটের মতো ব্যাপার। আমারই যেতে ইচ্ছে করে না কিন্তু এখানে সম্পর্ক রাখা দরকার বলে যাই। তোমার ভালো না লাগলে যাবে না। আমি যা হোক বলে ম্যানেজ করে নেব। রঙ্গন চলে গেল।

শিখা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে স্বামীকে দেখল, বউমার জন্যে খোকা একা যায়। কিন্তু আর সবাই জোড়ে আসে। তুমি এখানে থাকতে আমি একা যাচ্ছি, এতে যে সম্মান ধুলোয় লুটোবে তা ভেবেছ?

তাই বলো। খোকা নয়, তোমার কথা ভেবে আমাকে যেতে বলছ। তা তুমিও তোনা যেতে পারো। সম্মান বজায় থাকবে। রজতাভ হাসলেন।

শিখা কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রজতাভ জানেন শিখা যাবেই। এখানকার তরুণীমহলে শিখার খুব খাতির হয়েছে। ওর কাছ থেকে সবাই বিভিন্ন রান্নার রেসিপি জেনে নেয়।

পরদিন দুপুরে রোদ উঠল। বেশ কড়া রোদ। বরফও গলতে শুরু করল। ভরসা পেলেন রজতাভ। আপাদমস্তক গরম কাপড় মুড়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন। রাস্তায় মোড় অবধি গিয়েছেন, মনে হল সারা শরীরে কাঁপুনি হচ্ছে। হঠাৎ গাড়িটাকে দেখতে পেলেন। রঙ্গনের গাড়ি। চিৎকার করে বলছে, উঠে পড়, জলদি।

উঠতে গিয়ে দেখলেন পা এগোচ্ছে না। কথা বলতে গেলে শব্দ হারিয়ে গেল। রঙ্গন দ্রুত নেমে এসে তাঁকে টেনে তুলল গাড়িতে। গাড়ির ভেতরটা মেশিন গরম রেখেছে। পেছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল রঙ্গন। ধরাধরি করে তাঁকে শোওয়ানো হল বিছানায়। টেলিফোন পেয়ে ছুটে এল রঙ্গনের বাঙালি ডাক্তার বন্ধু। ইনজেকশন দিল সে। বলল, ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে বোঝা যাবে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে কিনা। মেলোমশাই-এর ইনশিয়য়ারেন্স করা আছে তো?

শিখা জানে না। রঙ্গন দ্রুত রজতাভর পাসপোর্ট যে ব্যাগে থাকে সেটা খুঁটিয়ে দেখল। মাত্র পঞ্চাশ হাজার ডলারের ইনশিয়োরেন্স করিয়ে এসেছেন রজতাভ কলকাতা থেকে আসার সময়। সম্ভবত প্রিমিয়ামের টাকাটা নষ্ট হয় বলে কম টাকায় করিয়েছিলেন। রঙ্গন জানে ওই পঞ্চাশ হাজার ডলার তেমন-তেমন ক্ষেত্রে কিছুই কাজ দেবে না। ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হলে কি পরিণতি হবে ভাবতেই শিউরে উঠল সে।

কপাল ভালো ছিল। ডাক্তার বন্ধু জানাল ইনজেকশনে কাজ হয়েছে। এখন রজতাভ ঘুমোবেন। কেউ যেন ওঁকে বিরক্ত না করে। পাক্কা তিরিশ ঘণ্টা ঘুমোবার পর চোখ খুললেন রজতাভ। শুনলেন তাঁর কোল্ড স্ট্রোক হয়েছিল। ওই ঠান্ডায় যা পরে বের হওয়া উচিত তা তিনি পারেননি। মাথা থেকে পা ঢাকলেই মাইনাস পাঁচকে কবজা করা যায় না। তার জন্যে চাই আলাদা পোশাক। হিট স্ট্রোকের কথা তিনি জানেন, কোল্ড স্ট্রোক আজ প্রথম জানলেন। একা পেয়ে শিখা জানাল তাঁর মুখ নাকি বেনারসের হনুমানের মতো হয়ে গেছে। কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত চামড়া পুড়ে গিয়েছিল। ওইটুকুই খোলা ছিল তখন।

সাতদিনের মাথায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে রজতাভ দেখলেন তাঁর মুখ থেকে শুকনো চামড়া উঠছে। সাপের খোলস যেমন ওঠে তেমনি মুখের চামড়া উঠে যাওয়ার পর তিনি রঙ্গনকে বললেন দেশে ফিরে যাবেন। শিখার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে নাতি আর বউমাকে নিয়ে ব্যস্ত। রঙ্গন আপত্তি করেছিল প্রথমে, শেষে প্লেনে সিট বুক করে দিল। ওদের শহর থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে। কলকাতা। শিখার একটুও ইচ্ছে ছিল না স্বামীকে ছাড়ার। যাওয়ার আগের রাত্রে শুয়ে-শুয়ে বলল, তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই পাইনি।

রজতাভ বললেন, কি চেয়েছ যা তোমাকে দিইনি?

জানি না। যাচ্ছ যাও। কিন্তু রোজ ফোন করতে হবে।

কত বিল দিতে হবে খেয়াল আছে?

তাহলে একদিন অন্তর একদিন?

আচ্ছা।

আর একটা কথা। আমাদের বেডরুমে শোবে না।

তাহলে কোথায় শোব?

অন্য কোনও ঘরে। খোকার ঘরে।

বেশ। তাই হবে। রজতাভ আর তর্ক করতে চাইলেন না।

রঙ্গন এল তাঁকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে। শেষ মুহূর্তে বলল, আমি জানি তোমার এখানে খুব অসুবিধে হয়, তবু তোমাকে দেখলে মন ভালো লাগে।

রজতাভ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি মরে গেলে তুই তোর মাকে এখানে নিয়ে আসিস। কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে দিবি। তুই তো কখনও কলকাতায় ফিরে যেতে পারবি না।

অনেস্টলি বলছি বাবা, ফিরে যেতে চাইলেও যেতে পারব না। এই বাড়িটাকে কিনেছি পঁচিশ বছরের ইনস্টলমেন্টে। তা ছাড়া আমি চাকরি পেতে পারি কিন্তু তোমার বউমা ওখানে গেলে হাউস ওয়াইফ হয়ে থাকবে। সেটা আর ও কিছুতেই পারবে না।

আমি জানি। তাই বলছি, বাড়িটাকে রেখে কোনও লাভ নেই।

এখনই এসব কথা বলবে না।

ছেলের মুখটায় এখনও ওর ছেলেবেলার অভিমান। এখনও যে এটুকু বেঁচে আছে তা দেখে খুব খুশি হলেন রজতাভ।

লন্ডনে নামলেন সকাল আটটায়। এখানে ঘণ্টা পাঁচেক বসে থাকতে হবে। ট্রানজিট লাউঞ্জে পৌঁছে বোর্ড দেখলেন। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্লেন যাচ্ছে। তারা কখন কোন গেট থেকে ছাড়ছে তার বর্ণনা দেওয়া আছে। তাঁর প্লেনের কোনও খবর নেই। মালপত্র যা ছিল তা আমেরিকায় বোর্ডিং কার্ড নেওয়ার সময় প্লেনকোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছেন। খালি হাতে ঘুরতে লাগলেন রজতাভ। দু-পাশে ডিউটি ফ্রি শপের আকর্ষণ। কয়েকটা দোকানে ঘুরতেই বুঝলেন, নামেই ডিউটি ফ্রি শপ। যে-কোনও জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। লন্ডন শহরে এর চেয়ে সস্তায় পাওয়া যায়।

হাঁটতে-হাঁটতে একটা লাউঞ্জে চলে এলেন রজতাভ। অনেক যাত্রী সেই লাউঞ্জের সোফায় বসে আছেন। এঁরা নিশ্চয়ই দূর থেকে আসছেন, অন্য ফ্লাইট ধরবেন। হঠাৎ নজর পড়ল এক মহিলার ওপর। দারুণ ফরসা, লম্বা, সুন্দর শরীর, তবে বয়স ষাটের কম নয়। পরনে অফহোয়াইট শাড়ি। মনে হল এই মহিলা যৌবনে ডানাকাটা সুন্দরী ছিলেন। এঁর বসে থাকার ভঙ্গিতে ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট। ভদ্রমহিলা মুখ ফেরাতেই চোখ সরিয়ে নিলেন রজতাভ। এই সত্তরের কাছাকাছি এসে তিনি এমন কিছু করতে পারেন না যা আঠারো-উনিশে মানায়।

রজতাভ কাঁচের দেওয়ালের কাছে গেলেন। ওপাশে হিথরো এয়ারপোর্টের রানওয়েতে কর্মব্যস্ততা চলছে। গোট পৃথিবী থেকে উড়ে আসা প্লেনগুলো স্বচ্ছন্দে নামছে আবার উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ নাকে মিষ্টি গন্ধ লাগল। ঘুরে তাকাতেই অবাক হলেন। সেই মহিলা উঠে এসেছেন তাঁর সামনে। চুল প্রায় সাদা, গলায় হাঁসের পায়ের দাগ। মহিলা হাসলেন, চিনতে পারছ না?

এই একটি বাক্যে হুড়মুড় করে বিস্মৃতির সব দেওয়া খসে পড়ল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রজতাভ। কি করছেন না জেনেই এগিয়ে গিয়ে মহিলার হাত ধরলেন, তুমি!

মাথা নাড়লেন মহিলা, তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু বুঝলাম তুমি পারনি। তাই উঠে এলাম।

আমি, আমি ভাবতেই পারছি না লালী, তোমাকে এখন এখানে দেখব ভাবতেই পারছি না। কিন্তু তুমি খুব বদলে গেছ।

কীরকম? মোটা হয়েছি? বুড়ি?

দূর! তুমি আরও সুন্দরী হয়েছ।

বাজে বোকো না। পঁয়ষট্টি বছরের বাঙালি মেয়েকে লোকে বুড়িই বলে।

পঁয়ষট্টি?

হ্যাঁ। তুমি আমার থেকে তিন বছরের বড়।

তাইতো। চোখ বন্ধ করলেন রজতাভ। লালী হাত ছাড়িয়ে নিলেন। রজতাভ চোখ খুললেন, হ্যাঁ। ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে তোমাকে দেখেছি।

ভাবা যায়? লালী হাসলেন, তখন যদি আমরা ঠিক করতাম পঞ্চাশ বছর পরে দেখা হবে। তাহলে বিশ্বাস করতাম? চুলগুলো এত্ত উঠে গেল কেন?

বাপ-ঠাকুরদার দান। রজতাভ হাসলেন, তুমি কি একাই যাচ্ছ?

হ্যাঁ। তুমি?

আমিও। চলো, ওই সোফায় বসে কথা বলি। রজতাভ লালীর কনুই ধরে নিয়ে এলেন। লালী বললেন, একটু আস্তে, এখন কি অত জোরে হাঁটতে পারি?তুমি দেখছি এখনও যুবক!

যুবক? হো-হো করে হাসলেন রজতাভ, আমার নাতি হয়ে গেছে।

ছেলে তো আমেরিকায় থাকে।

অবাক হয়ে তাকালেন রজতাভ, তুমি কি করে জানলে?

হাসলেন লালী, চার বছর আগে পর্যন্ত জানতাম। মা বেঁচে ছিলেন ততদিন। মায়ের কাছে তোমাদের খবর পেতাম। তোমার স্ত্রী কেমন আছেন?

ভালো। ছেলের কাছে থেকে গেল কিছুদিনের জন্যে। নাতিকে সামলাচ্ছে।

বাঃ।

তোমার ছেলে মেয়ে?

মাথা নাড়লেন লালী, একটি ছেলে।

তোমার স্বামী?

শরীর ভালো নয়। হাঁপানিতে ভুগছে।

কোথায় যাচ্ছ?

ব্যাঙ্গালোরে। ছেলে ওখানে চাকরি করে। বছরে একবার যাই।

লন্ডনেই থাকো?

না। ম্যাঞ্চেস্টারে।

লালী, তুমি সুখে আছ তো?

স্পষ্ট চোখে তাকালেন লালী, স্বার্থ আর অনুকম্পা দিয়ে যে সম্পর্কের শুরু তাতে কখনও সুখ জন্ম নেয়? ওঁর আত্মীয়স্বজন সবাই তো বিয়ের ব্যাপারটা জানে। পঞ্চাশ বছরেও সেই জানাজানি পুরোনো হয়নি।

মাইকে ঘোষণা চলছিল সমানে। কখন কোন গেট দিয়ে যাত্রীদের প্লেনে উঠতে হবে। টিভি মনিটরে ফ্লাইটচার্চ দেখাচ্ছে। রজতাভর কলকাতা ফ্লাইটের ঘোষণা একবারও করেনি কর্তৃপক্ষ।

রজতাভ বললেন, আবার কি করে দেখা হবে লালী?

জানি না। হয় তো এভাবেই হয়ে যাবে।

গম্ভীর হলেন রজতাভ, তোমার টেলিফোন নাম্বার পেতে পারি?

একটু চুপ করে থাকলেন লালী। এই সময় মাইকে ঘোষণা করা হল, লালীর ফ্লাইট তৈরি। লালী চোখ তুললেন, তোমারটা?

নিশ্চয়ই। পার্স বের করে নিজের কার্ড এগিয়ে দিলেন রজতাভ। সেটা নিয়ে লালী বললেন, কিন্তু একটা শর্ত আছে।

শর্ত? অবাক হলেন রজতাভ।

আমরা যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন কেউ কাউকে ফোন করব না।

সেকি? অবাক হয়ে গেলেন রজতাভ।

আমরা জানব ইচ্ছে করলেই কথা বলে খবর নিতে পারি না একদিন পারতাম না। কিন্তু ইচ্ছেটা কাজে লাগাব না। লালী চোখ বন্ধ করলেন।

তাহলে নাম্বার নিয়ে কি হবে?

হবে! মাথা নাড়লেন লালী, তুমি এবং আমি এমন ব্যবস্থা করে যাব যাতে যেই আমাদের কেউ পৃথিবী থেকে চলে যাবে অমনি যে বেঁচে থাকবে সে যেন জানতে পারে। শুধু এইটুকু! বলো, রাজি আছ?

একটা বড় শ্বাস বুক নিংড়ে বেরিয়ে এল, রজতাভ মাথা নাড়লেন। লালী তাঁর ফোন নাম্বার লিখে দিলেন, কার্ড ব্যাগে ঢোকালেন। এখন ঘনঘন আবেদন জানানো হচ্ছে প্লেনে ওঠার জন্যে। রজতাভ লালীকে ওঁর প্লেনে ওঠার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারলেন। বোর্ডিংকার্ড নিয়ে প্লেনের কর্মচারীরা লালীকে পরীক্ষা করে ভেতরে যেতে বলল। রজতাভ আশা করেছিলেন ভেতরে যাওয়ার আগে লালী মুখ ফিরিয়ে তাঁর দিকে তাকাবে, কিন্তু তাকাল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্লেন উড়ে গেল আকাশে।

হিথরো এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জ যাত্রীর ভিড়ে গমগম করছে। কিন্তু রজতাভর সবকিছু ফাঁকা বলে মনে হচ্ছিল। পঞ্চাশ বছর পরে দেখা হল। অথচ শেষ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর লালীর কথা বেমালুম ভুলে ছিলেন তিনি। প্রথম পাঁচ বছরে রাগ ছিল, জ্বালা ছিল, না পাওয়ার যন্ত্রণা কুরে-কুরে খেত। নিজের যোগ্যতা এত কম ছিল যে ধিক্কার দিতেন নিজেকে। তারপর সামলে নিয়েছিলেন। মোটামুটি ভালো রেজাল্ট হয়েছিল। দ্বিতীয় চাকরিটা তাঁকে ধীরে-ধীরে তুলে নিয়ে গিয়েছে ওপর মহলে। বিয়ে করেছেন, ছেলে হয়েছে। ভালোই ছিলেন এতকাল। লালীর স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল। বাল্যপ্রেমে অভিশাপ আছে অথবা ওই বয়সের প্রেমকে কাফলাভ বলা হয় কারণ তা কখনই স্থায়ী হয় না বুঝে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কখনও ভাবেননি পঞ্চাশ বছর পরে দেখা হলে লালী বলবে সে সুখে নেই। কখনও কল্পনাও করেননি লালী তাঁর সব খবর রাখার চেষ্টা করে গেছে চার বছর আগে পর্যন্ত। তার মানে, জীবন সবসময় থিয়োরি মেনে চলে না।

আঠারো বছর বয়সে রজতাভ পাড়া-কাঁপানো ছেলে। ভালো ফুটবল খেলে, আশুতোষ কলেজে। পড়ে কিন্তু সাত-আটজনের দল নিয়ে হকি স্টিক হাতে নিয়ে মারপিট করে নামও করে ফেলেছে। বাবার প্রচণ্ড শাসন সত্বেও মায়ের প্রশ্রয়ে রজতাভ যখন পাড়ার হিরো তখনই লালীর সঙ্গে দেখা। লালী তখন ক্লাশ টেনের ছাত্রী। বেলতলা স্কুলে পড়ে। ওর স্কুলে যাওয়া-আসার সময় কাজের। মেয়ে সঙ্গী হয়। তাকে উপেক্ষা করে বেপাড়ার কিছু ছেলে লাইন মারছিল। খবর পেয়ে রজতাভ দল নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটাল তাদের। পিটিয়ে থানায় গিয়ে বলল, আমাদের পাড়ার মেয়েকে বেইজ্জত করছিল বলে ওদের মেরেছি।

দারোগা বললেন, ঠিক করেছ। কিন্তু দ্বিতীয়বার করলে জেলে যেতে হবে।

দ্বিতীয় দিন থেকে তিন মিনিটের রাস্তা গাড়িতে যাতায়াত শুরু করল লালী। চতুর্থ দিনে সেই গাড়ির জানলা থেকে কাগজ পড়ল রাস্তায়। গাড়ি চলে গেলে ছোঁ মেরে কুড়িয়ে নিল রজতাভ। সুন্দর হাতে লেখা, তুমি আমার উপকার করেছ বলে কৃতজ্ঞ। বাবা তোমাকে গুন্ডা বলে। তুমি একটু ভালো হতে পারো না? কোনও নাম নেই ওপরে অথবা নিচে।

কিন্তু চিঠির আদান-প্রদান চলল। ওর ক্লাসে পড়ার একটি পরিচিত মেয়ের সাহায্য নিল রজতাভ। সাত নম্বর চিঠিতে নাম দেখা গেল। লালী। জানা গেল ওর বাবা এক নম্বরের স্বৈরাচারী। মেয়েকে কোথাও একা যেতে দেন না। সিনেমা দেখাও বারণ। বাইরে আলাদা দেখা করে কথা বলার কোনও সুযোগই নেই। লালী থাকে দোতলার রাস্তার দিকে ঘরে। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে এক মিনিটের জন্যে ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে আসতে পারে।

লালীর বাবা যে বিরাট ব্যবসায়ী, বিশাল কারখানার মালিক তা জানা ছিল। বাড়ির গেটে দারোয়ান, চারটে গাড়ি। তারপর সেই বৃষ্টির রাত এল। রাস্তায় লোকজন নেই। দশটা নাগাদ অঝোরে ঝরা বৃষ্টির মধ্যে রেইন পাইপ বেয়ে ব্যালকনিতে উঠে গিয়েছিল রজতাভ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দরজা বন্ধ। কয়েকবার টোকা দেওয়ার পর ভীত গলা কানে এল, কে?

আমি রজতাভ।

দরজা খুলে গেল। ভেজা জামাকাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকে সে দেখল হালকা নীল আলো জ্বলছে। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া লালী মুখ হাত চাপা দিয়ে বলল, কীভাবে এলে?বাবা যদি জানতে পারে!

পারবে না। শুধু তুমি বলো, ডু ইউ লাভ মি?

মুখে কিছু বলেনি লালী, শুধু দ্রুত ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেছিল।

এত কাছে দাঁড়িয়ে, নীল আলোয় স্নান করল লালীর ফরসা মুখ, গলা হাত দেখে রজতাভর মুগ্ধতা বাড়ছিল, তখনই কুকুরের ডাক শোনা গেল। লালী ভয়ে চিষ্কার করে উঠল, যাও, চলে যাও, প্লিজ। এখনই সবাই চলে আসবে।

দাঁড়ায়নি রজতাভ। যে পথে এসেছিল সেই পথে নেমে গিয়েছিল রাস্তায়।

পরের দিন দেখা গেল রেইন পাইপে কাঁটাতার লাগানো হয়েছে।

সাত দিনের মধ্যে পাত্র পাওয়া গেল। ছেলেটি ব্রিলিয়ান্ট। বিলেতে রিসার্চ করতে যেতে চায়, পয়সার অভাবে পারছে না। তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হল লালীকে বিয়ে করার শর্তে। বিয়ের পর বরকনে চলে যাবে বিলেতে। একমাসের মধ্যেই সানাই বাজল। লালীর বাবা কোনও ঝুঁকি নেননি। পুলিশ পাহারা ছিল বাড়ির গেটে। সেইদিন রজতাভর মনে হচ্ছিল তার আত্মহত্যা করা উচিত। বন্ধুরা বুঝিয়েছিল, সামান্য একটা মেয়ের জন্যে সে প্রাণ দেবে! তার প্রাণ কি শস্তা!

পঞ্চাশ বছর পরে এইসব ঘটনা মনে পড়বে এমন কেউ বেঁচে আছে কি না জানা নেই। বন্ধুদের মধ্যে যারা এখনও আছে তারাও ভুলে গেছে। লালীর বাবার মৃত্যুর পর ব্যাবসা বন্ধ হয়েছে। সেই পাড়া ছেড়েছেন রজতাভ। আজ মনে এল। সেই বৃষ্টির রাত্রে রেইন পাইপ বেয়ে লালীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন?কীসের টানে? ওকেই ভালোবাসা বলে? তাহলে ভালোবাসার আয়ু কতদিন? দিব্যি তো সব ভুলে ছিলেন পঁয়তাল্লিশ বছর? নাকি অনাদরে ভালোবাসা ঘুমিয়ে থাকে, ঘুমোয় কিন্তু মরে না!

*

কলকাতায় এলেন। ফাঁকা বাড়ি। একটুও ভালো লাগছিল না তাঁর। অথচ কলকাতায় ফিরে আসার জন্যে ওখানে ছটফট করছিলেন। তাঁর টেলিফোনের নাম্বার লেখা বইয়ের এল। আদ্যক্ষরের শেষ নাম লিখলেন, লালী, জিরো, জিরো-ফোর ফোর…।

তারপর তিন-তিনটে বছর পার হয়ে গিয়েছে। পুজো আসছে। ষষ্ঠীর দিন ছেলে বউমা নাতিকে নিয়ে চলে এল বেড়াতে। বউমার বোন ও তাঁর স্বামী এলেন বোকারো থেকে, দিদির সঙ্গে পুজো কাটাতে। বাড়ি এখন জমজমাট। সন্ধের সময় বাঁ-হাতটা হঠাৎ কনকন করতে লাগল, বাঁ-বুকে ঈষৎ যন্ত্রণা। রজতাভ অ্যান্টাসিড খেলেন। মনে হচ্ছিল পেটে বাতাস জন্মেছে। কাউকে বলে বিরক্ত করতে চাইলেন না। কিন্তু রাত দশটা নাগাদ ব্যথা এত বাড়ল যে আর চেপে রাখতে পারলেন না। ডাক্তার পাশের বাড়িতেই। তিনি মুখে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ইনজেকশন দিচ্ছি। কাল সকালেই ইসিজি করাবেন।

ছেলে উদ্বিগ্ন হল, রাত্রে কিছু হবে না তো?

বলতে পারছি না। হসপিটালে রিমুভ করলেই ভালো হয়।

রজতাভ বললেন, আরে না, না। আমার কিছুই হয়নি। ঘুমিয়ে পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা অযথা চিন্তা করছ।

ইনজেকশনের কল্যাণেই ভালো ঘুম হল। সকালে অনেকটা চাঙ্গা। ইসিজির ইচ্ছে ছিল না, রঙ্গন জোর করে নিয়ে গেল। ইসিজি করার পর ডাক্তারের চোখ কপালে। রঙ্গনকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, কে হয়?

বাবা।

এখনই হাসপাতালে নিয়ে যান। খুব খারাপ অবস্থা। রঙ্গনের এক সহপাঠী অ্যাপোলো হাসপাতালের ডাক্তার। সে বলল, নিয়ে আয়। হাসপাতালে আবার ইসিজি করা হল। করার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল অ্যাঞ্জিওগ্রাফ করা হবে। সেটা করা হল বিকেলবেলায়। দেখা গেল রজতাভর হৃৎপিণ্ডগামী রক্তবাহী শিরাগুলোর নব্বইভাগ অকেজো হয়ে গেছে। আগামী কালই বাইপাস অপারেশন করা দরকার।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল রজতাভর। বুকটা খুব ভারি। শুনলেন আজ তাঁর অপারেশন হবে। কাল থেকে সমানে ওষুধ চলছে। আর তখনই মনে পড়ল। যদি অপারেশন টেবিলেই মরে যান। তাহলে কি হবে? লালীকে তিনি জানাবেন কি করে?কথার খেলাপ হয়ে যাবে।

সকাল সাড়ে নটায় ওরা সবাই এল। ছেলে বলল, কোনও ভয় নেই বাবা। আজকাল বাইপাস জলভাত হয়ে গিয়েছে। নার্ভাস হয়ো না।

বউমা বললেন, ওখানে তো বাইপাস হওয়ার পরের দিনই পেশেন্টকে হাঁটায়।

বউমার বোনের স্বামী বলল, আমার বাবার হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। এখন নর্মাল লাইফ। কোনও চিন্তা করবেন না।

চুপচাপ শুনলেন রজতাভ। তারপর বললেন, ভালো হলে ভালো। যদি তা না হয় তাহলে মাকে তোমার কাছে নিয়ে যেয়ো। বাড়ি বিক্রি করে দিয়ো।

শিখা কেঁদে উঠল। রঙ্গন চাপা গলায় বলল, মা!

রঙ্গন! মৃদুস্বরে ডাকলেন রজতাভ।

বলো।

একটা অনুরোধ রাখবে?

নিশ্চয়ই। বলো।

আমার যদি কিছু হয়–। বলে মুখ তুলতেই বউমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। তারপর ওঁর বোনের সঙ্গে। তখনই মনে হল, এরা কি ভাববে? বুড়ো বয়সে প্রেম করছেন? প্রেমিকাকে জানাতে চাইছেন তিনি নেই! ভাবতেই কীরকম কুঁকড়ে গেলেন তিনি।

তোমার কিছু হবে না বাবা। তবু বলো, নিশ্চয়ই রাখব।

একটা ফোন–। মন স্থির করতে পারছিলেন না তিনি।

কাউকে ফোন করতে হবে? রঙ্গন জানতে চাইল।

হঠাৎ শিখার যেন মনে পড়ে গেল, খোকা, ওই ফোনটা।

বউমা বললেন, আঃ মা! আপনাকে নিষেধ করা হয়েছিল।

রজতাভ তাকালেন শিখার দিকে, কি বলছ তুমি? বলো।

হকচকিয়ে গেল শিখা, না, মানে আচ্ছা লালী বলে কাউকে চেনো?

সঙ্গে-সঙ্গে চোখ বন্ধ করলেন রজতাভ। কেঁপে উঠলেন।

নার্স এল এই সময়। আপনারা এবার যান। পেশেন্টকে তৈরি করতে হবে।

সবাই নড়ল। রঙ্গন ঝুঁকে বলল, কি করতে বলছিলে, বাবা!

মাথা নাড়লেন রজতাভ, না, তার আর দরকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *