দামুকাকার বিপত্তি
অনেক দিন আগেকার কথা; আমাদের গাঁয়ের দামুকাকা সন্ধে করে হাট থেকে বাড়ি ফিরছে। সেদিন বিক্রি ভালোই হয়েছে, দড়ির ঝোলাটা চাঁচাপোঁছা, ট্যাঁকটিও দিব্যি ভারী। কিন্তু তাই বলে যে দামুকাকার মুখে হাসি ফুটেছিল সে কথা যেন কেউ মনে না করে। ওর মতো খিটখিটে রুক্ষ বদমেজাজি লোক সারা গাঁ-টা খুঁজে উজাড় করে ফেললেও আর একটাও পাওয়া যেত না। দুনিয়াসুদ্ধ সকলের খুঁত ধরে বেড়ানোর ফলে এখন এমনই দাঁড়িয়েছিল যে এক-আধটা বন্ধুবান্ধব থাকা দূরের কথা, বাড়ির লোকদের মধ্যেও বেশির ভাগের সঙ্গেই কথা বন্ধ, এমনকী, ও ঘরে ঢুকলে ওদের বিরাটাকায় ছাই রঙের হুলো বিড়ালটা পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ উঠে ঘর থেকে চলে যেত। দামুকাকা সবই দেখতে পেত কিন্তু বেড়ালটাকে মুখে কিছু বলত না। অন্যদের শুধু এইটুকু বলত, “তোদের ভালোর জন্যই তোদের বলি, তা তোদের যদি এতই মন্দ লাগে, যা খুশি কর গে যা, পরে যখন কষ্ট পাবি তখন আমাকে কিছু বলিস না।”
যাই হোক সূর্য অনেকক্ষণ হল ডুবে গেছে, চারি দিক থেকে দিব্যি অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আকাশে চাঁদ নেই, শুধু তারার আলোতে সব ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। দামুকাকা হন হন করে এগিয়ে চলেছে, এক ক্রোশ পথ, যত শিগ্গির পার হয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। ভূতপ্রেতে দামুকাকার বিশ্বাস নেই, কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে লোকগুলো দিন দিন এমনই পাজি বদমায়েস হয়ে উঠেছে যে, পয়সাকড়ি নিয়ে পথে বেরুনোই দায়। বরং বড় কুমড়োটা বিক্রি করবার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা না করলেই ছিল ভালো।
প্রায় অর্ধেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, মাথাটা কীরকম যেন একটু ঝিমঝিম করছে, আসবার আগে হাট থেকে একটা পান মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, তাতেই কাঁচা সুপুরি ছিল হয়তো। তবে বুদ্ধিশুদ্ধি যে সবই দিব্যি চাঙ্গা ছিল, এ কথা দামুকাকা বার বার বলত।
পথের পাশেই বিরাট বাঁশঝাড়, তারার আলোয় পথের উপর তার ছায়া পড়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঘোর অন্ধকার করে রয়েছে। ঐখানটার কাছাকাছি আসতেই দামুকাকার কেমন গা শিরশির করে উঠল। তবুও হাতের মোটা বাঁশের লাঠিটি বাগিয়ে ধরে সে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে চলল।
ঠিক বাঁশঝাড়ের সামনা সামনি আসতেই মনে হল সুড়ুৎ করে কালো একটা কী যেন পথের এধার থেকে ওধারে গিয়ে বাঁশঝাড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দামুকাকার কানে এল একটা খ্যাঁস খ্যাঁস, ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ, তা সে বাদুড়ের না আর কিছুর আওয়াজ ঠিক বোঝা গেল না।
ততক্ষণে দামুকাকার বেশ বুক ঢিপঢিপ শুরু হয়ে গিয়েছিল। গাঁয়ের সকলের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি না করে সঙ্গীসাথী নিয়ে দল বেঁধে পথ চলাই যেন ভালো বলে মনে হচ্ছিল।
বাঁশঝাড়ের অর্ধেকটা পার হয়ে গেছে এমন সময় বাঁশঝাড়ের মধ্যে থেকে কে যেন একটা লম্বা হাত বাড়িয়ে লাঠিগাছটি হাত থেকে কেড়ে নিল। দামুকাকা দারুণ চমকে উঠে ফিরে দাঁড়াতেই তিন চারটে কালো কালো ডিগডিগে রোগা লোক ওকে ঘিরে ফেলে, কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
দামুকাকা যে-সে ছেলে নয়। ওর বাবা ছিল সেকালের নামকরা হাজারি পালোয়ান, লাঠিখেলায় সে হাজার শত্রুকে ঘায়েল করেছিল। মেরে ফেলেনি অবিশ্যি, কারণ দামুকাকারা ছিল দারুণ বৈষ্ণব, কিন্তু এইসা ঠেঙিয়েছিল যে তারা পালাবার পথ পায়নি। তাদের মধ্যে যে ক’টা পেছিয়ে পড়েছিল লম্বা লম্বা করে একটার পর একটাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে তবে ছেড়েছিল। কাজেই দামুকাকাও নেহাত হেঁজিপেঁজি নয়। নড়বার-চড়বার ক্ষমতা হারিয়ে সে এমনই ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে লাগল যে বাঁশগাছগুলো মড়মড় করে, ঠিক ভেঙে না পড়লেও, তাদের গা থেকে গোছা গোছা পাতা খসে পড়তে লাগল, ফালা ফালা ছাল ছাড়িয়ে আসতে লাগল।
অগত্যা লোকগুলোর মধ্যে একজন একটা কালো গিরগিরে হাত দিয়ে দামুকাকার মুখ চেপে ধরল। মুখ চেপে ধরতেই দামুকাকার নাকে এল কেমন একটা অনেকদিন বন্ধ ঘরের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গন্ধ। ও তক্ষুনি হাত-পা এলিয়ে, দুচোখ কপালে তুলে মুচ্ছো যাওয়ার জোগাড়।
কিন্তু তারা মুচ্ছো যেতে দিলে তো! অমনই খনখনে গলায় পাঁচসাতজন মিলে কানের কাছে ‘ওঁ মোঁড়লের পোঁ, এঁখন ভিঁর্মি গেঁলে চঁলবে নাঁ! আমাদের সভায় আঁগে বিঁচার কঁরে দাও, তাঁর পরে যাঁ ইঁচ্ছে কঁরো গে যাঁও। নঁইলে এঁয়ারা যেঁ খ্যাঁচাখেঁচি কঁরে প্রাঁণ আঁতিষ্ঠ কঁরে তুঁললেন।’
তাই শুনে দামুকাকা মুচ্ছো ছেড়ে, উঠে বসে চারি দিকে তাকিয়ে একেবারে থ! বাঁশঝাড়ের মাঝখানটা একদম ফাঁকা, সেখানে একটা ধুনি জ্বলছে, আর তারই চার ধারে একদল কুচকুচে কালো মেয়ে আঁচড়া-আঁচড়ি কামড়া-কামড়ি করছে, আর তাদের ঘিরে কাতারে কাতারে কালো কালো ছেলে ঝগড়া থামাবার চেষ্টা করছে আর খুব কানমলা আর চিমটি খাচ্ছে। এক বেচারা মাথায় একটা হাঁসের পালক গুঁজে একটা ঢিপির উপর বসে ছিল। দামুকাকাকে টেনে সে পাশে বসাল। দামুকাকার ততক্ষণে অনেকখানি সাহস ফিরে এসেছে, জিজ্ঞাসা করল, “তা মশাই, তা হলে আমায় কী করতে হবে?”
“কিঁছুঁ না, শুঁধু এঁই মেঁয়েগুঁলোর মঁধ্যে কেঁ যে কাঁর চেঁয়ে ভাঁল দেঁখতে সেঁটুকু বঁলে দিন, আঁমরা তো হিঁমশিম খেঁয়ে গেঁলাম। সঁব চেয়ে ভাঁলোর গঁলায় এঁই সোঁনার মাঁলা পঁরিয়ে দিন, আঁর কিছু কঁরতে হবে না।”
দুনিয়ার কোনো মেয়েকে দামুকাকা ভয় পায় না। সামনে এসে হাঁক দিয়ে বলল, “এই সুন্দরীরা, তোরা এখন চ্যাঁচামেঁচি রাখ দিকিনি। এইখানে লাইন বেঁধে দাঁড়া, আমি ভালো করে দেখি কে সব চেয়ে ভালো দেখতে।”
অমনি মেয়েগুলো ঝগড়াঝাঁটি ভুলে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে গিয়ে যে যার চুল ঠিক করতে লেগে গেল, হাত-পা সোজা করতে লাগল।
তাদের রূপ দেখে দামুকাকার তো চক্ষু চড়কগাছ। প্রত্যেকটা সমান হতকুচ্ছিত, কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত, গোল গোল চোখ, আর গিরগিরে রোগা। সবাই হাসি হাসি মুখ করে দামুকাকার দিকে চেয়ে আছে। দামুকাকা একবার তাদের ধারালো দাঁত আর লম্বা লম্বা নখের দিকে তাকিয়ে দেখল। আর অমনি সব ছেলেগুলো করল কী, গতিক বুঝে তফাতে সরে দাঁড়াল, ভাবখানা, একজনকে মালা দিলেই তো হয়েছে!
কিন্তু দামুকাকা যে সে ছেলেই নয় সে তো বলেছি, এগিয়ে এসে মেয়েগুলোর দিকে ভালো করে নজর করে আর একবার দেখে নিয়ে বলল—
“সমবেত ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আনন্দের সহিত জ্ঞাপন করছি যে আপনারা সকলেই সব চেয়ে সুন্দরী, একজনও অন্যদের চেয়ে একটুও কম সুন্দরী নন; অতএব সকলেই এই সোনার মালা পাবার যোগ্যা!” বলেই পট করে মালার সুতো ছিঁড়ে ফেলে, প্রত্যেকের হাতে হাতে একটা করে সোনার পুঁতি দিয়ে, বাকিগুলো নিজের ট্যাঁকের মধ্যে গুঁজে ফেলল। মেয়েরা সবাই ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে, আর ছেলেরা সমস্ত গোলমাল এমন নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়াতে এমনি খুশি হল যে কেউ আর কিছু লক্ষই করল না।
তখন দামুকাকাও গুটি গুটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়ে সদর রাস্তা ধরে “রাম! রাম!” বলতে বলতে ঊর্ধ্বশ্বাসে গাঁয়ের দিকে ছুটল।
বাড়িতে ততক্ষণে কান্নাকাটি পড়ে গেছে, তার মধ্যে দামুকাকা এসে হাজির হওয়াতে সবাই মহা খুশি। গাঁয়ের লোকও মেলায় এসে জড়ো হয়েছিল; দামুকাকা তাদের হাত ধরে বসিয়ে, মুদির কাছ থেকে চিঁড়ে বাতাসা নিয়ে এসে পেট ভরে খাইয়ে দিল। সবাই অবাকও হল যেরকম, খুশিও হল তেমনি।
এর পরে আর দামুকাকা কখনো রাগ-মাগ করত না। হাট থেকে সবাই দল বেঁধে ফিরত।
এই গল্প শেষ করে দামুকাকা বলল, “ওই কালো লোকগুলোর কথা আর কাউকে বলি নি বুঝলি। কী জানি গাঁয়ের লোকেরা যা ভীতু, হয়তো ভূত মনে করে ভয়টয় পাবে, ও পথে আর যাওয়া আসাই করবে না, তা হলে আবার হাট ফেরত আরো আধ মাইল পথ হাঁটতে হবে। তা ছাড়া সত্যি তো আর ভূত-ফুত হয় না।”
আমরা বলতাম, “ও দামুকাকা, ওরা ভূত নয় তো কী?”
দামুকাকা বিরক্ত হয়ে বলত, “তা আর আমি কী জানি! তবে তোদের ইস্কুলে ওদের চাইতেও অনেক খারাপ দেখতে মেয়ে পড়ে, এ আমার নিজের চোখে দেখা।”