দামদর
মুড়ির দামের ঘটনাটা কিছুদিন আগেই অন্য জায়গায় লিখেছিলাম, কিন্তু দামদরের ব্যাপারে কোনও কিছু লিখতে গেলে এ গল্পটা বাদ দিয়ে যাওয়া উচিত হবে না।
গল্পটা থাক, আসল কথাটা বলি। আমার এক সহকর্মী আছেন মুড়িভক্ত মেদিনীপুরী। সকালে মুড়ি দিয়ে চা খান, দুপুরে অফিসে মুড়ি খেয়ে টিফিন করেন। সন্ধ্যায়ও বাড়ি ফিরে আবার চায়ের সঙ্গে মুড়ি চেবান। মুড়ি খাওয়ায় তাঁর অরুচি নেই, ক্লান্তি নেই।
হঠাৎ সেদিন দেখি দুপুরে অফিসে টিফিনের সময় মুড়িভক্ত ভদ্রলোক মুড়ি না খেয়ে আপেল খাচ্ছেন। ব্যাপারটা দেখে চমকে গেলাম, সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাতে তিনি নিজেই বললেন, ‘পয়সার টানাটানি যাচ্ছে, মুড়ি খেতে পারছি না তাই আপেল খাচ্ছি।’
ব্যাপারটা মুহুর্তের মধ্যে হৃদয়ঙ্গম হল। মুড়ির কেজি প্রতি দাম চলছে বারো চোদ্দো টাকা। সে জায়গায় আপেল বড় জোর পাঁচ ছয় টাকা কেজি। সুতরাং পয়সা সাশ্রয় করার জন্যে মুড়ি না খেয়ে আপেল খাওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু খুব স্বাভাবিক কি? এই সেদিন পর্যন্ত মুড়ি ছিল সাধারণের, গরিবের খাবার আর আপেল, সে তো রাজা মহারাজা, বড়সাহেবের প্রাতরাশের টেবিলে দেখা যেত, তাও সিনেমার পর্দায়।
মুড়ি নিয়ে আরেকটা দুঃখের গল্প আছে। গল্পটা একদম টাটকা। সেদিন এক ভদ্রলোক আমার কাছে জীবনের সুখদুঃখের গল্প করছিলেন। কথায় কথায় নিজের প্রসঙ্গে বললেন, ‘উনিশশো পঞ্চান্ন ছাপ্পান্নয় এই কলকাতা শহরে সর্বস্বান্ত অবস্থায় একা একা। হাতে কোনও টাকা পয়সা নেই, কাজকর্ম নেই। সাতদিন শুধু মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছি।’ আমি ছাড়াও এই দুঃখের কাহিনীর আরেকজন শ্রোতা ছিলেন, তিনি একথা শুনে বললেন, ‘তবু ভাল। এখন মুড়ির যা দাম, সর্বস্বান্ত হয়ে আর মুড়ি খেতে পারবেন না বরং টানা সাতদিন মুড়ি খেতে গেলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবেন।’
গল্পের খাতিরে শুধু মুড়ির নামে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কোনও না কোনও অছিলায়, কারণে অকারণে সব জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। বন্যার জন্যে বাড়ছে, খরার জন্যে বাড়ছে, পুজোর জন্যে বাড়ছে, ঈদের জন্যে বাড়ছে, বড়দিনের জন্যে বাড়ছে। ট্রাক ধর্মঘটের জন্যে বাড়ছে, রেল রোখোর জন্যে বাড়ছে, কুলি ধর্মঘটের জন্যে বাড়ছে, বাংলা বন্ধ স্থানীয় হরতাল হলে তো কথাই নেই।
সব কারণ যে সবসময় বোধগম্য হয় তাও নয়। ট্রাক স্ট্রাইকে আলুর দাম বাড়ল অথচ আলু দ্রুত পচনশীল নয়। অন্যদিকে কলার দাম বাড়েনি যেটা রাত পোহালে পচে যাবে, অর্থাৎ ট্রাকে কিংবা অন্য কোনও পরিবহনে আসছে না। এলে পচতে বাধ্য।
হিসেব মিলছে না। একটি ছোট ছেলে তার বাবার কাছে পঞ্চাশটা পয়সা চেয়েছিল। বাবা বললেন, ‘জিনিসপত্রের দাম এত বেশি, কী করে তোকে পঞ্চাশ পয়সা দিই বলত?’ ছেলে বলল, ‘দাম যখন বেশিই হয়েছে তা হলে পঞ্চাশ পয়সা নয়, পুরো একটা টাকাই না হয় দাও।’
ইতালি দেশের দ্বিতীয় যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সেই বেদনার্ত রসিকতাটি এই সূত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। বড় দুঃখের রসিকতা এটি, গৃহস্থ বলছেন, ‘আগে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি সওদা করে আনতাম। এখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে গিয়েও পকেট ভর্তি করে কোনও বাজার করে আনতে পারি না। এর পরে কী হবে, কে জানে।’
এক সাংবাদিক জিনিসের দাম বাড়ার ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, লোকে যত টাকা উপার্জন করার আশা করেছিল তার চারগুণ টাকা উপার্জন করছে কিন্তু যেসব জিনিস কিনবে ভেবেছিল ওই বাড়তি টাকা দিয়েও তার চার ভাগের এক ভাগ জিনিস কিনতে পারছে না।
কেন দাম বাড়ে? জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি বলে। টাকার চেয়ে মাল কম বলে এবং কারসাজিতে।
কার কারসাজি, কীসের কারসাজি—সে জটিলতা সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতির লোকেরা খোঁজ করুন। আমি এক বুড়ো দোকানদারের কথা জানি সে রাতে ভাত খেতে খেতে ছেলেদের বলল, ‘বাজার বেশ চড়া যাচ্ছে, এখন সব জিনিসের দাম টাকায় চার আনা বাড়িয়ে দে।’
সকালে বড় ছেলে দোকান দেখে। সে দোকানের ঝাপ তুলেই সব জিনিসের সিকি দাম বাড়িয়ে দিল, চার টাকার জিনিসের দাম কেটে লিখল পাঁচ টাকা। দুপুরে ভাত খাওয়ার পরে মেজো ছেলে দোকানে গিয়ে আর এক দফা বাড়িয়ে সেটা সোয়া ছ’টাকা করল। ছোট ছেলে অফিসে কাজ করে, সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে সে দোকানে আসে। সে তখন সূক্ষ্ম হিসেব করে সাত টাকা আশি পয়সা (৭.৮০) গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিল। এক দিনে জিনিসের দাম প্রায় ডবল হয়ে গেল।
বাজারে জিনিস কম কিন্তু কিছু লোকের হাতে অনেক টাকা। তারা যে কোনও দামে জিনিস কিনবে।
বেনেটোলার মেসের রান্নার ঠাকুরের কথা মনে পড়ছে। ঠাকুরের ভাত কম পড়ত, তরকারি কম পড়ত, মাছ তো থাকতইনা, কিন্তু ডাল, লোকে যত ইচ্ছে খাক, কখনও কম পড়ত না। সে কড়াই থেকে এক হাতা করে ডাল তুলত আর সঙ্গে সঙ্গে এক হাতা জল মেশাত। শেষে ডাল আর নেই, শুধু জল। অর্থনীতির অবস্থাও তাই দাড়িয়েছে। জিনিস নেই বাজারে শুধু টাকা আর টাকা।
পুনশ্চ : একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিবৃত করে শেষ করি। ঝড়বৃষ্টির পরে বাজারে গিয়েছিলাম। একটা এক মুঠো সাইজের ফুলকপির দাম জিজ্ঞাসা করলাম। তরকারিওলা আমার চেনা, আমার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল, ‘পাঁচ টাকা।’ মুখ ফসকিয়ে আমার অজান্তে গলা দিয়ে করুণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল, ‘বাবা’!
সেদিন লরি স্ট্রাইকের মধ্যে বাজারে সেই একই তরকারিওলা। সেই একই সাইজের ফুলকপির দাম জিজ্ঞাসা করলাম। আমার আগের উক্তি দোকানদারের মনে আছে দেখলাম, কঠিনতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল, ‘ডবল বাবা।’