দাবিদার – ৫

পাঁচ

বেণ্ট’স ক্রসিং-এ পৌঁছাতে অনেকটা সময়

অনেকটা সময় ব্যয় হলো জনের-শহর খুঁজে পেতে দেরি হয়েছে বলে নয়, কভার নিয়ে আসতে হয়েছে ওকে, সেজন্য। সতর্ক থেকেছে আকাশের পটভূমে যেন তার কিংবা ঘোড়াটার কোনও কাঠামো ফুটে না ওঠে, সজাগ দৃষ্টি ছিল জমিনের উপর, স্যাডল গান থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরায়নি হাত।

চলার পথে পুরোটা সময়ই যা ঘটেছে তা নিয়ে ভাবছিল জন উইলিয়ামস।

ফ্লেচার’স হোল-এ ও এসেছিল অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে। জীবনে অনেক কিছুই পায়নি ও, ভেবেছিল না-পাওয়া জিনিসগুলো পাবে এখানে, জানতে পারবে না-জানা জিনিসগুলো। ভাসমান এ জীবনের মধুর একটা অবসান চেয়েছিল ও, কোথাও একটু থিতু হতে চেয়েছে-আশা ছিল, যে- বাবাকে সে জন্মের পরে দেখেছে কি না মনে নেই, তাকে দেখবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস: এ জীবনে আর বাবার দেখা পাবে না সে।

ক্লিনটনরা লোক বেশ ভাল ছিল। জনের সেবাযত্নের কখনও কোনও ত্রুটি করেনি। নিজেদের সন্তানের মতই লালন-পালন করত ওকে। কিন্তু নিজেদের ছেলেমেয়ে ছিল ওদের।

ক্লিনটন পরিবারের এত যত্ন আর ভালবাসার পরেও নিজেকে সব সময় একা লাগত জনের, মনে হত ও একজন বহিরাগত।

যখন বড় হলো, দুনিয়াদারি বুঝতে শিখল, ক্লিনটনরা জানাল ওকে, এ পরিবারে কীভাবে তার আগমন।

ওই দিন থেকে আশায় বুক বেঁধে ছিল জন, বাবা একদিন ফিরে আসবে তার কাছে…তার সত্যিকারের বাবা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা কোনও রাইডারকে দেখলেই উতলা হয়ে উঠত ওর মন-কিন্তু ওটা তার বাবা নয় দেখে শেষে হতাশার সাগরে ডুবে যেত।

মরিস উইলিয়ামস কোনও দিন আসেনি, ওকে এক কলম চিঠিও লেখেনি।

ক্লিনটনরা সব কিছু নিয়ে নিউ মেক্সিকো চলে গেল। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে রেঞ্জ ওঅর, পাশাপাশি অ্যাপাচিদের হামলা তো ছিলই।

এ এমন একটা দেশ যেখানে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ মানুষকে বন্দুক চালানো শিখতে হয়।

একদিন জন আবিষ্কার করল, বন্দুক ব্যবহারে সে একটা প্রতিভা বিশেষ।

ক্লিনটনরা প্রকৃতিগত ভাবেই ছিল ভবঘুরে প্রকৃতির। কোথাও খুব বেশি দিন স্থির থাকা বোধ হয় তাদের ধাতে ছিল না। আবার যাত্রা শুরু করল তারা। এবারের গন্তব্য ক্যালিফোর্নিয়া।

ওরা যখন ক্যালিফোর্নিয়া রওনা করল, ততদিনে জন পূর্ণ যুবক। এবারে সে আর ক্লিনটনদের সঙ্গী হলো না।

ফেবলসদের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করল জন।

গর্ডন ফেবলস ছিল একজন ক্যাটল ব্যারন। তার ব্র্যাণ্ড সার্কেল জি।

সেখানে বনি নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় জনের। যুবকটি বয়সে জনের বড়, খুব ভাল লোক।

বনির সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাজ করল জন। তারপর গ্যারল্ড টার্নার নামে এক ইংরেজের খামারে যোগ দিল দু’জনে।

টার্নার সৎ আর ভাল মানুষ ছিল।

মানুষটাকে ওরা দু’জনেই খুব পছন্দ করত।

কিন্তু আউট-লদের হাতে যেদিন খুন হয়ে গেল লোকটা, বনি প্রতিজ্ঞা করল সে এ হত্যার বদলা নেবে।

তবে প্রতিশোধ নেয়ার আগেই সে আর জন লিঙ্কন কাউন্টি ওঅর-এ জড়িয়ে পড়ে।

একের পর এক লড়াই বনিকে শীতল রক্তের নির্দয় খুনিতে পরিণত করে।

জন যদি তখন বনির মতই খুনখারাবিতে মেতে উঠত তা হলে এতদিনে সে-ও হত্যাকারী হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠত। কিন্তু খুনির পথ বেছে নেয়ার ইচ্ছা তার ছিল না।

সে বনির সঙ্গ ত্যাগ করার চিন্তাভাবনা করছে, এমন সময় তার হাতে একটা চিঠি এসে পৌঁছায়। একজন রাইডার নিয়ে এসেছিল চিঠিটা।

জনের পরিষ্কার মনে আছে, চিঠিটা পড়ার পরে আবেগে থরথর করে কাঁপছিল সে। না, ভূসম্পত্তির মালিক হওয়ার লোভে এতটা পথ পাড়ি দেয়নি ও, দিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। অদ্ভুত একটা আবেগ ওর মধ্যে কাজ করছিল যার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, লিখেও বোঝানো সম্ভব নয়।

ও এসেছিল বাবাকে দেখবে বলে, বাবাকে জড়িয়ে ধরবে, ঘ্রাণ নেবে শরীরের-যে পিতার আদর-স্নেহ-ভালবাসা থেকে জন্মের পর থেকে সে বঞ্চিত। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য জনের; এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেও লাভ হলো না। দেখতে পেল না শেষ দেখাটাও। কোনও দিন আর পাবেও না।

বাবাকে দেখতে না পাবার কষ্ট, বেদনা, হাহাকারের কোনও তুলনা নেই।

বার্ট ওর সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাতে বার্টের প্রতি প্রবল ঘৃণা জন্মেছে ওর। প্রতিশোধ নেয়ার তীব্র বাসনাও তৈরি হয়েছে বুকে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে বাবাকে হারানোর প্রচণ্ডতম শোক।

মনে তবু এটুকু সান্ত্বনা: মৃত্যুর আগে মরিস উইলিয়ামস ওকে তার ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছে। সে চেয়েছে জন যেন সার্কেল ইউ-র ন্যায্য ভাগটা পায়।

বুড়ো মানুষটার শেষ এই ইচ্ছাটা পূরণ করবে জন। সম্পত্তির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেবে সে।

বার্ট ওকে ভাগ দিতে চাক বা না চাক।

দরকার হলে বার্টের সঙ্গে লড়াই করবে। বিশালদেহী লোকটার সঙ্গে ওর কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই, বাবারও ছিল না।

কিন্তু পিটার উইলিয়ামসের কী হবে?

পিটার আর সে একই বাপের সন্তান, দু’জনের শরীরে একই রক্ত বইছে।

পিটারও হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। তাই সে জনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে, আসতে চেয়েছে কোনও সমঝোতায়। কিন্তু লড়াই শুরু হলে পিটার কার পক্ষ নেবে? সম্পত্তির দাবিদার হিসেবে সে কি নিজের সৎ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবে?

ছয়

যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বড় শহর বেন্ট’স ক্রসিং। কোনও নদীর নামে এ শহরের নামকরণ করা হয়নি।

ফ্লেচার’স হোল-এ প্রবেশের এটা ছিল সহজতম রাস্তা, এবং বেন্টরা একসময় অস্থায়ী ভিত্তিতে এখানে একটা দুর্গ গড়ে তোলে তাদের ভাড়া করা ট্র্যাপারদের ব্ল্যাকফিট আর সাউদার্ন চেয়েনদের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য। জায়গাটাকে তারা বছর পঞ্চাশেক আগে হান্টিং গ্রাউণ্ড হিসেবে ব্যবহার করত।

শহরের বাইরে থেকে পুরানো দুর্গটার ভগ্নাবশেষ এখনও দেখা যায়। কাঠের বড় বড় খুঁটিগুলো কাত হয়ে আছে, ভেঙে পড়েছে দালানগুলো।

দুর্গটাকে বাদ দিলে পাহাড়ের বাঁধের নীচে চমৎকার ভাবে বেড়ে উঠেছে বেণ্ট’স ক্রসিং। একটা সুপ্রশস্ত ওয়্যাগন রোড শহরের পিছনের ঢাল বেয়ে প্রসারিত হয়েছে।

সারি-সারি দালানগুলোর আকার-আকৃতিও মন্দ নয়। কিছু বাড়ি-ঘর কাঠের গুঁড়ি কেটে বানানো, কিছু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে তক্তা। পাহাড়ে যেহেতু কোনও খনি নেই, অনুমান করল জন, শহরটা গড়ে উঠেছে গরু ব্যবসাকে ভিত্তি করে।

কেন সে এখানে এসেছে, নিজেও জানে না ও-এখানকার কাউকেই সে চেনে না।

পকেটে যে পয়সাকড়ি আছে তা দিয়ে এক বেলাও চলতে পারবে কি না সন্দেহ। অবশ্য ব্যাপারটা নির্ভর করছে জিনিসপত্রের দামের উপর।

…শহরে হয়তো কবরস্থান আছে, থাকলে ওখানে বাবার সমাধিটা খুঁজে পেতে পারে জন। যেভাবেই হোক, বাপের কবর ওকে পেতেই হবে।

দুপুর গড়িয়েছে এখন।

ঘোড়া নিয়ে শহরের মূল রাস্তায় চলে এল জন।

বেন্ট’স ক্রসিং-এ জনমানুষের চিহ্নও নেই। সবাই নিশ্চয় লাঞ্চে ব্যস্ত।

শহরের চারপাশে নজর বুলাল সে।

পাঁচটা স্যালুন, গোটা দুই জেনারেল স্টোর বা মুদি দোকান, একটা মাংসের দোকান, মার্শালের অফিস, এমনকী ছোটখাট একটা ব্যাঙ্কও আছে।

একটু পরেই ও যা খুঁজছিল, পেয়ে গেল—একটা বিল্ডিং-এর সামনে সাইনবোর্ডে লেখা: স্যাম পার্কার, পুরুষের কাপড়; তার নীচে লেখা: আণ্ডারটেকার।

সাইডওঅকে ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়ল জন। হিচরেইলে বাঁধল লাগাম।

স্যাম পার্কারের দোকানে দরজা খুলে ঢোকার সময় টুংটাং শব্দে বেজে উঠল ছোট্ট ঘণ্টী।

কাঠের একটা তাকে ভাঁজ করে রাখা আছে কাপড়; কয়েকটা টেবিলে স্তূপ হয়ে রয়েছে লিভাইস, ক্যালিফোর্নিয়া প্যান্ট আর ফ্ল্যানেল শার্ট।

তালপাতার এক সেপাই দোকানের পিছনে বসে আছে। টাক মাথা। পরনে ভেস্ট আর প্যান্ট। চেয়ারে বসে পা রেখেছে লোহার এক স্টোভের উপর। স্টোভে আগুন জ্বলছে না। কোলের উপর কোঁচকানো একটা কাগজ দেখে বোঝা যায়, মাত্রই মধ্যাহ্নভোজন সেরেছে সে।

কোনও রকম ব্যস্ততা না দেখিয়ে চেয়ার ছাড়ল তালপাতার সেপাই, সিধে হলো, স্টোভ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে ফেলল এঁটো কাগজগুলো। তারপর এগিয়ে গেল খদ্দেরের কাছে। জনের মলিন চেহারা আর ছেঁড়া, নোংরা পোশাকের উপর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি বুলাল সে।

‘হাউডি,’ বলল। ‘কিছু লাগবে?’

‘কিছু লাগবে না। শুধু ছোট্ট একটা খবর জানতে চাই। বাইরের সাইনবোর্ডে দেখলাম: তুমি আণ্ডারটেকার।’

‘হ্যাঁ,’ স্যাম পার্কারের গলার স্বর অকস্মাৎ নেমে গেল, ফুটল আণ্ডারটেকারের স্বর। ‘আমরা তোমার মৃত প্রিয়জনের স্বর্গযাত্রার জন্য এমন সুন্দর ব্যবস্থা করে দেব, দেখলে মনে হবে সে ঘুমাচ্ছে।’

‘না, আমি কারও স্বর্গযাত্রার আয়োজনের জন্য এখানে আসিনি,’ বলল জন। ‘আমি শুধু জানতে চাইছি মরিস উইলিয়ামসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজটা তুমি করেছ কি না।’

চোখ সরু করে জনের দিকে তাকাল স্যাম। চেহারায় ফুটে উঠল সতর্ক ভাব। ‘তুমি কি তার আত্মীয়?’

‘আমি তার ছেলে,’ জবাব দিল জন। কথাটা উচ্চারণ করার সময় নিজের কাছেই কেমন অদ্ভুত লাগল ওর।

‘ওহ্, তুমিই সেই লোক,’ বলল স্যাম। কণ্ঠে ফুটল বিদ্বেষ, সম্বোধনও বদলে গেল। ‘হুঁ, গতকাল বিকেলে তোমার কথা বলেছে বার্ট। মিস্টার, আমার পরামর্শ হয়তো তুমি চাইবে না, তবে এখানকার লোকে বলবে, মন্দ পরামর্শ দিইনি আমি তোমাকে। শোনো, তোমার ওই গল্প নিয়ে এখানে ঘুরঘুর করলে কোনও ফায়দা হবে না। বাড়বে বই কমবে না বিপদ। কাজেই, সবচেয়ে ভাল হয় যদি সুবোধ বালকের মত এখান থেকে কেটে পড়ো। শহরের রাস্তাটা সোজা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। ওই রাস্তা ধরে যেতে মোটেই বেগ পেতে হবে না তোমাকে।’

খুব রাগ হলো জনের।

হারামজাদা বার্ট তা হলে ওর আগেই এখানে এসেছে! বোঝাই যাচ্ছে, স্যাম ডরায় তাকে।

হয়তো শহরের সবাই-ই বার্টকে ভয় পায়।

জনের কথায় তার মেজাজ প্রকাশ পেল। ‘মিস্টার, তোমার কাছে আমি রাস্তার বর্ণনা জানতে চাইনি। আমি জানতে এসেছিলাম, কোথায় তুমি মরিস উইলিয়ামসকে কবর দিয়েছ।’

নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ও স্যামের দিকে। সেই চাউনিতে এমন কিছু ছিল, পিছু হটল এক কদম টেকো।

‘ঠিক আছে,’ বিচলিত গলায় বলল সে। ‘বলছি তোমাকে। অমন কটমট করে তাকাতে হবে না। পুরানো দুর্গের পিছনে একটা গোরস্থান আছে। ওখানে, প্রিয়তমা স্ত্রীর কবরের পাশে কবর দেয়া হয়েছে মরিসকে।’

ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল জন। ‘ধন্যবাদ,’ শক্ত গলায় বলল। ‘তথ্যটা দরকার ছিল আমার।’

চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল সে, লম্বা কদমে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। হিচরেইল থেকে ঘোড়ার লাগাম খুলে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বসল। বেরিয়ে গেল শহর ছেড়ে।

চলতে চলতে ভাবছে জন, শুধু সার্কেল ইউ নয়, বেণ্ট’স ক্রসিং-এর মোকাবেলাও করতে হতে পারে ওকে। এমনকী পুরো ফ্লেচার’স হোল-এর বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে পারে।

সবাইকে ওর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে পারে বার্ট।

নিজের ভাবনায় এমন মশগুল ছিল জন, লক্ষ করেনি ওর পিছু নিয়েছে এক ঘোড়সওয়ার।

বেণ্ট’স ক্রসিং-এর রাস্তা ধরে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছে সে।

সাত

অধিকাংশ সীমান্ত এলাকার কবরস্থানের মত এটারও পরিত্যক্ত চেহারা।

কয়েকটা কবরে কাঠের ক্রুশ লাগানো, কিছু সমাধিতে পাথুরে ফলক। দু’তিনটাতে ফলক-টলক কিছু নেই। তবে গোরস্থানের মাঝখানে সদ্য খোঁড়া কবরটা সহজেই নজর কাড়ে।

ঘোড়াটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে কবরস্থানে ঢুকল জন।

দুটো পাথরের ফলকই দেখতে অবিকল এক।

প্রথম ফলকটিতে লেখা রয়েছে: এখানে শায়িত রয়েছেন ভার্জিনিয়া অ্যাণ্ডার্স উইলিয়ামস, যিনি দুই বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন।

দ্বিতীয় ফলকটি, যেটির কবর কয়েকদিন আগে খোঁড়া হয়েছে, তাতে সংক্ষেপে লেখা: মরিস এফ. উইলিয়ামস; নীচে শুধু জন্ম আর মৃত্যুর তারিখ দেয়া।

মাথা থেকে হ্যাট খুলে নিয়ে সদ্য খোঁড়া কবরটার দিকে তাকাল জন। বুকের ভিতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না।

কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও, পুরানো দুর্গের ভাঙা, উঁচু প্রাচীর ছায়া ফেলেছে ওর গায়ে।

জানে না কতক্ষণ, কত ঘণ্টা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তীব্র শোকে ফেটে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা।

হঠাৎ বে ঘোড়াটার চাপা হেস্বায় চমক ভাঙল জনের। আরেকটি প্রাণীর আগমন টের পেয়ে মাথা তুলেছে বে। নিজের ঘোড়ার কাছে যাওয়ার জন্য পাঁই করে ঘুরল জন।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বোকার মত সে তার স্যাডল গানটা রেখে এসেছে ঘোড়াটার পিঠে। আর এখন এক রাইডার ওর আর ওর ঘোড়ার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

জমে গেল জন। তবে মরিয়া ভাবটা বিস্ময়ে রূপ নিল যখন দেখল ঘোড়সওয়ার একজন নারী।

মহিলা পিঠ খাড়া করে সাইড স্যাডলে বসেছে। কোমরের নীচ থেকে লম্বা স্কার্টে ঢাকা তার শরীর। আর কোমরের উপরে, আঁটসাঁট বডিসে ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকা থাকলেও যৌবন-নদীর ভরা জোয়ারের ঢেউ দু’কূল ছাপিয়ে উপচে পড়তে চাইছে। দুর্দান্ত শরীরের রমণীয় রেখাচিত্রগুলো যে-কোনও পুরুষের দম বন্ধ করে দেবে।

মহিলা প্রায় ওর সমবয়েসী, তবে দুই-এক বছরের ছোটও হতে পারে। কাকচক্ষুর মত কালো কেশরাজি মখমলের মত ছড়িয়ে আছে কানের পিছনে। মাথায় সুদৃশ্য রাইডিং হ্যাট। মেয়েটার অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা গোলাপের পাপড়ির মত মসৃণ ও কোমল, বড় বড় চোখ জোড়া অতল কালো দীঘির কথা মনে করিয়ে দেয়। ও চোখে এখন চিকচিক করছে কৌতুক আর সহানুভূতির মিশ্রণ। নাকটা টিকালো, যেন খোদাই করা, মুখখানা ভরাট, ওষ্ঠদ্বয় লাল টুকটুকে, দৃঢ় চিবুক।

জনের দিকে তাকাল সে, ঠোঁটের কোণে ফুটল রহস্যময় হাসি। ‘তোমাকে আমি চালাক-চতুর ভেবেছিলাম,’ কথা বলে উঠল, যেন বাজল জলতরঙ্গ। ‘অথচ তোমার আর ঘোড়ার মাঝখানে কখন এসে পড়েছি, টের পর্যন্ত পাওনি।’ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার জনের কোমরে। ‘এমনকী একটা হ্যাণ্ডগান পর্যন্ত নেই তোমার কাছে।’

‘অন্য চিন্তায় মশগুল ছিলাম,’ বলল জন।

‘ওদের নিয়ে?’ কবরের দিকে ইঙ্গিত করল সুন্দরী।

‘হ্যাঁ।’ মাথা দোলাল জন।

তোমার বাবার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে,’ বলল মেয়েটি। ‘বাবাই তো ছিল তোমার, তা-ই না?’

‘জী, ম্যা’ম।’ মাথা ঝাঁকাল জন। ‘বাবা।’

‘তুমি এখানে আসার আগেই মারা গেল সে-ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক,’ বলল যুবতী, ‘ডাক্তার আমাকে বলেছে, সে নিজেও বুঝতে পারেনি মরিস সাহেব এত তাড়াতাড়ি মারা যাবে। অবাকই হয়েছিল ডাক্তার।’ গভীর কালো চোখ জোড়া জনের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল। ‘বার্ট বলছে, সে নাকি তোমার কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। কাজটা নিশ্চয় সে কারও সাহায্যে করেছে।’

‘হ্যাঁ,’ জানাল জন, ‘দু’একজন সাহায্য করেছে ওকে।’

সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল নারী। ‘আমাকে ঘোড়া থেকে নামতে একটু সাহায্য করবে?’

‘নিশ্চয়,’ বলল জন। দ্রুত এগিয়ে গেল ও।

চিতার মোহনীয় ক্ষিপ্রতায় ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে নেমে এল তরুণী। জন ওকে যতটা লম্বা ভেবেছিল, ততটা লম্বা নয় সে। মেয়েটির মাথা জনের চোখ ছুঁই-ছুঁই।

‘ধন্যবাদ,’ শক্ত জমিনে দাঁড়িয়ে বলল সে। ‘আমার নাম জুলিয়া রবার্টস। তবে জুলিয়া বলে ডাকে না কেউ। ডাকনাম জুলি।’

‘আচ্ছা,’ বলল জন, ‘আমিও তোমাকে জুলি বলেই ডাকব। আমার নাম জন উইলিয়ামস।’

‘আমি তোমার নাম জানি,’ বলল জুলি।

‘আমাকে দেখছি সবাই-ই চেনে,’ জনের কণ্ঠে বিদ্রূপ। ‘বার্ট আমার নামটা সবখানে ছড়িয়ে দিয়েছে, তা-ই না?’

‘নাম না, বদনাম,’ বলল জুলিয়া, ‘বেণ্ট’স ক্রসিং-এ সে তোমাকে নিষিদ্ধ করতে চায়।’

‘এ শহর ওর কথায় চলে নাকি?’

‘মরিস উইলিয়ামস অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এ শহর তার কথায় ওঠ-বস করে। এ এলাকার সবচেয়ে বড় রানশ সার্কেল ইউ। বেণ্ট’স ক্রসিং মরিস উইলিয়ামসের শহর ছিল। কিন্তু সে অসুস্থ হওয়ার পরে বার্টই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয় হাতে। এখন বেণ্ট’স ক্রসিং-এর হর্তাকর্তা সে। মরিসের মৃত্যুতে সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিল। একমাত্র সে-ই বার্টকে সামলে রাখতে পারত।’

দেখা যাচ্ছে, বার্ট একটা হার্ডকেস।’

‘ওর ধাত তো তোমার ইতিমধ্যে বুঝে ফেলার কথা,’ মন্তব্য করল জুলিয়া। ‘গতকালের ঘটনাতেই বুঝে গেছ নিশ্চয়, ও লোক কেমন।’

মাথা ঝাঁকাল জন। ‘হুম। তুমি দেখছি আমার সম্পর্কে অনেক খবরই জানো। কিন্তু তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’

‘তোমাকে আমি আমার নাম বলেছি,’ বলল জুলিয়া, শহরে আমার একটা থাকার জায়গা আছে।’ চোখের দৃষ্টি আচমকা সরু হয়ে এল তার, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল ঠোঁট। ‘যদি বার্ট অ্যান্ড্রিউর ঘাড় ধরে নাকটা মাটিতে ঘষে দিতে পারো ওর, তা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না। আর ওকে খুন করতে চাইলে আমিই তোমাকে গুলি কিনে দেব!’

মেয়েটার দিকে দীর্ঘক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জন। তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘লেডি, বিষয়টা নিয়ে আমাদের কথা বলা দরকার।’

ওর চোখে চোখ রাখল জুলিয়া। ‘আমিও তা-ই ভাবছি।’ তার গলার স্বর চনমনে, খুশি-খুশি। ‘চলো, বেণ্ট’স ক্রসিং-এ যাই।’

‘আমার সাথে তোমাকে কেউ দেখে ফেলার ভয় নেই?’

‘কাউকেই ভয় পাই না আমি,’ বলল জুলিয়া।

গলার স্বর শুনে বুঝতে পারল জন, এ মেয়ে যা বলছে, তা মিথ্যা নয়।

‘চলো। আমার বাড়িতে গিয়ে বাকি কথা হবে।

আট

রবার্টস’ প্লেস শহরের সবচেয়ে বড় স্যালুন।

জন আর জুলিয়া শহরের মূল রাস্তায় পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে আসছে।

প্রায় হাঁটার গতিতে চলেছে জানোয়ার দুটো।

চলার তালে জনের মাথা ঝাঁকি খাচ্ছে।

এখন নেকড়ের মত সতর্ক সে। দুটো ঘটনা ওর আবেগের লাগাম অনেকটাই টেনে ধরেছে-সার্কেল ইউ-তে গতকাল প্রহৃত হওয়া আর আজ অকস্মাৎ জুলিয়ার সঙ্গে পরিচয়।

সাইডওঅকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর। কোনও কিছুই নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না।

ওকে আর জুলিয়াকে পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখে রাস্তার লোকজন আড়চোখে তাকাচ্ছে, ফিসফিস করছে।

‘আমি দেখেছি তুমি শহরে এসেছ,’ ব্যাখ্যা দিল জুলিয়া। ‘দেখলাম স্যাম পার্কারের ওখানে ঢুকলে, তারপর আবার বেরিয়ে গেলে। বুঝে যাই, তুমিই সেই লোক, যার কথা বার্ট শহরের সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে। তোমার সাথে কথা বলার আগেই তুমি চলে যাও কি না ভেবে চিন্তা হচ্ছিল। তা ছাড়া এমনও ভেবেছি, কথা বলার পরে হয়তো দেখব তুমি মেরুদণ্ডহীন একটা জেলিফিশ ছাড়া কিছু নও।

‘আমার মেরুদণ্ড আছে কি নেই, তা পরে বুঝতে পারবে,’ বলল জন।

ওরা রবার্টস’ প্লেসের হিচর‍্যাকের সামনে এসে থামল।

নিজের ঘোড়া থেকে নেমে জুলিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল

জন ওকে নামতে সাহায্য করার জন্য।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ঢুকল ওরা স্যালুনে।

স্যালুনের ভিতরটা প্রায় খালি।

দুটো টেবিলে কয়েকজন লোক বসে মদ গিলছে। বারের পিছনে ঝিমোচ্ছে বারটেণ্ডার।

‘এসো,’ জনকে আহ্বান জানাল জুলিয়া। পিছন দিককার সিঁড়ি অভিমুখে এগোল ওকে নিয়ে।

জুলিয়ার পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে জন, জুতোর স্পারে টুংটাং শব্দ উঠল। একটা হাত ওর স্যাডল গানে।

সিঁড়ির মাথায় ছোট এক করিডর, তারপর দরজা।

‘আমি এখানেই থাকি,’ জানাল জুলিয়া। দরজা খুলল।

ওর পিছন পিছন ভিতরে ঢুকল জন।

দুই কক্ষবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের এটি লিভিংরুম। সুন্দর সাজানো-গোছানো। লম্বা সোফা, সুদৃশ্য চেয়ার, ডেস্ক, মেঝেয় কার্পেট আর ঘরের মাঝখানে বড় একখানা টেবিলের উপর হাতে বোনা সুন্দর চাদর বিছানো। সব মিলে ঘরের মালকিনের সুরুচির পরিচয় বহন করছে।

দরজা বন্ধ করে তালা মারল জুলিয়া। তারপর পা বাড়াল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের দিকে। নীচের একটা ড্রয়ার খুলে একটা জিনিস বের করল। ঘুরল জনের দিকে।

‘এটা,’ জনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। ‘আমরা কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারি বা না পারি, তোমার দরকার হবে।’

মেয়েটার হাতে লম্বা ব্যারেলের কোল্ট .৪৫। পিস্তলটার গ্রিপ হাতির দাঁতের, সিলিণ্ডার আর ব্যাকস্ট্র্যাপে রুপালি নকশা।

এক নজর বুলিয়েই জন বুঝতে পারল, জিনিসটা উঁচু মানের আর অত্যন্ত দামি।

‘এটা তোমাকে ধার দিলাম,’ বলল জুলিয়া। ‘কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাকে আবার ফেরত দেবে।’

একটু ইতস্তত করে অস্ত্রটা নিল জন। ‘তোমার সাথে মাত্রই আমার পরিচয়। এরকম একটা জিনিস বিশ্বাস করে দেয়া কি ঠিক হলো?’

জুলিয়ার লালচে মুখে মৃদু হাসি ফুটল। ‘ধরো, এটা তোমার প্রতি আমার বিশ্বাসের প্রতীক। বলেছিলাম, বুলেট কিনে দেব। তা হলে বন্দুক দিতে সমস্যা কোথায়?’

পিস্তলটা পরীক্ষা করে দেখল জন।

গুলি ভরা।

‘ঠিক আছে।’ অস্ত্রটা ওয়েস্টব্যাণ্ডে গুঁজল। ‘আমার নিজের অস্ত্র যতক্ষণ ফেরত না পাচ্ছি, কিংবা নতুন আরেকটা জোগাড় করতে পারছি, ততদিন এটা আমার কাছেই থাক।’

‘জিনিসটার যত্ন নিয়ো, বলল জুলিয়া, ‘এটা আমার স্বামীর পিস্তল।’

‘আচ্ছা?’

অদ্ভুত দৃষ্টিতে জনের দিকে তাকাল জুলিয়া। ‘হ্যাঁ, বার্ট অ্যান্ড্রিউ তাকে ছয় মাস আগে হত্যা করেছে।’

কী বলবে কিছু ভেবে ওঠার আগেই জুলিয়া জনের দিকে পিছন ফিরল। ‘মনে হয়, সকাল থেকে তুমি কিছু খাওনি।’ গলা চড়াল সে, ‘ম্যাগি! অ্যাই, ম্যাগি…‘

জুলিয়ার ডাকে সাড়া দিতে ঘরের আরেক দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল একটি মেয়ে। জুলিয়ার সঙ্গে তার চেহারায় আশ্চর্য মিল। তবে আঠারো-উনিশের বেশি হবে না বয়স। জুলিয়ার মতই তার ঝলমলে কৃষ্ণকেশ, একই রকম গভীর কালো চোখ, নিদাগ, মাখন-কোমল ত্বক। তবে একটা পার্থক্য অবশ্য আছে। জুলিয়ার চেহারার কাঠিন্য থেকে এ মেয়েটির লাবণ্যে ঢলঢল মুখখানা সম্পূর্ণ মুক্ত। মেয়েটার পরনে সাদা ড্রেস, ধবধবে ফর্সা শরীরের সঙ্গে দারুণ মানিয়ে গেছে। জনকে দেখে লজ্জা পেল সে, একই সঙ্গে সামান্য ভীতির ছাপও ফুটল চোখের তারায়।

‘এ আমার বোন ম্যাগি রবার্টস,’ বলল জুলিয়া, ‘ম্যাগি, ও জন উইলিয়ামস।’

‘তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ বলল জন।

মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী, তবে জুলিয়ার অসাধারণ রূপের কাছে তাকে ম্লানই লাগছে। জনের কথার প্রতি-উত্তরে কী যেন বলল বিড়বিড় করে, বোঝা গেল না।

‘ম্যাগি, তুই একটু নীচে যা,’ বলল জুলিয়া, ‘হ্যাঙ্ককে বল মিস্টার উইলিয়ামসের জন্য স্টেক আর আলু পাঠিয়ে দিতে। সাথে এক কাপ কফিও।’

‘আচ্ছা, বলছি,’ নরম গলায় বলল ম্যাগি। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মুখ তুলে তাকাল না আর জনের দিকে।

দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জুলিয়া বলল, ‘দুলাভাইয়ের মৃত্যুটা ম্যাগি এখনও সামলে উঠতে পারেনি। আমার উপরেও রেগে আছে ও। আমাদের এক খালার সাথে ইনডিপেনডেন্সে থাকত। কিন্তু ম্যাটি খালা মারা যাওয়ার পর কয়েক মাস আগে এখানে চলে আসে ম্যাগি। ও জানতই না, আমি এ শহরে একটা স্যালুন চালাই।’ হেসে উঠল জুলিয়া। ‘বার্টকে গুলি করে মারতে চাইবার পিছনে আমার বোনও একটা কারণ।’

‘কী রকম?’ জিজ্ঞেস করল জন।

‘পরে বলব,’ জবাব দিল জুলিয়া। ‘ড্রিঙ্ক চলবে তো?’

‘পেলে মন্দ হয় না।’

‘আচ্ছা, বসো। আমি তোমার জন্য ড্রিঙ্ক নিয়ে আসি।’

পাশের কামরায় চলে গেল সে।

লম্বা সোফাটায় বসল জন।

একটু পরেই পাশের ঘর থেকে আবার এ ঘরে ঢুকল জুলিয়া। হাতে একটা বোতল আর দুটো গ্লাস। দুটো গ্লাসেই সরাসরি উইস্কি ঢালল জুলিয়া। পানি-টানি কিছু মেশাল না। জনের হাতে একটা গ্লাস তুলে দিয়ে অপরটা নিয়ে বসল ওর মুখোমুখি চেয়ারে।

‘খাও,’ বলে পুরুষালি ঢঙে নিজের গ্লাসে চুমুক দিল জুলিয়া।

জনও নিজের গ্লাসের তরলটুকু পেটে চালান করে দিল। খালি পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। তবে একটু পরেই রিল্যাক্স বোধ করল। বলল, ‘এখন তোমার গল্প বলো, শুনি।’

‘মরগান রবার্টস, মানে আমার স্বামী আর আমি এ শহরে আসি পাঁচ বছর আগে,’ শুরু করল জুলিয়া। ‘তারপর স্যালুনটা খুলে বসি। আমরা সৎ ভাবে ড্রিঙ্ক পরিবেশন করতাম, সৎ ভাবে গেমস চালাতাম। পেশায় ও জুয়াড়ি ছিল। তবে সৎ মানুষ ছিল। শহরের যে-কাউকে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করো, সবাই তা-ই বলবে।’

মাথা ঝাঁকাল জন। ‘বলে যাও।’

‘মরিস উইলিয়ামস যতদিন কর্মক্ষম ছিল, কেউ তার সামনে দাঁড়াতে পারত না, বার্ট অ্যান্ড্রিউও না। জানি না, ভার্জিনিয়া উইলিয়ামসের প্রথম স্বামী কেমন ছিল, তবে ভাল লোক ছিল না নিশ্চয়। নইলে বার্টের মত এরকম বদমাশকে জন্ম দেয় কী করে! মরিস যতদিন সুস্থ ছিল, সামলে রেখেছে বার্টকে। কিন্তু তার টিউমার না কী জানি হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল, বার্টও শুরু করল অত্যাচার।’

চুপচাপ শুনে যাচ্ছে জন।

‘বুড়ো মরিস সুস্থ-সবল থাকলে কোনও বিবাহিতা নারীর ধারে-কাছেও আসার সাহস পেত না বার্ট,’ বলে চলল জুলিয়া। ‘কোনও বিবাহিতা নারীর দিকে হাত বাড়িয়েছে তার সৎ-ছেলে, শুনলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলত সে। কিন্তু মরিস অসুস্থ হওয়ার পরে…’ প্রথমবারের মত গলা কেঁপে গেল জুলিয়ার।

একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিল ও। তারপর আবার শুরু করল। ‘আমার উপর নজর পড়েছিল ওর। আমাকে খুব চাইত।

আমি আমার স্বামীকে ভালবাসতাম, মিস্টার উইলিয়ামস। বার্টকে সেকথা বলেওছিলাম। কিন্তু মাথামোটাটার মস্তিষ্কে এ কথা ঢোকেনি যে, যে-কোনও মেয়েই ওকে চাইবে না। ভেবেছে, আমাকে পাবার পথে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা আমার স্বামী। তারপর…এক রাতে মরগান একটা গলিপথ দিয়ে হেঁটে আসছিল। এমন সময় কেউ ওকে…’ থেমে গেল জুলিয়া, সশব্দে শ্বাস টানল, তবে অশ্রু দেখা গেল না চোখে। ‘কেউ ওকে, ‘ কর্কশ গলায় বলল, ‘অন্ধকারের মধ্যে সরাসরি গুলি করে মাথায়।’

‘তুমি ঠিক জানো, বার্টেরই কাজ ওটা?’ প্রশ্ন করল জন।

চেয়ার ছাড়ল জুলিয়া, বোতলের কাছে গিয়ে গ্লাসে আবার ভরে নিল মদ।

জন লক্ষ করল ওর হাত অল্প অল্প কাঁপছে।

‘আমি নিশ্চিত,’ বলল জুলিয়া, ‘এ কাজ ও ছাড়া আর কেউ করেনি। তবে কোনও প্রমাণ নেই আমার হাতে, নেই কোনও ক্লু। কিন্তু আমি জানি, বার্টই আমার স্বামীর হত্যাকারী।’

‘বার্ট কি এখনও তোমার পিছু লেগে আছে?’

‘আমার ধারণা, ও বুঝতে পেরেছে, আমি সব জানি। আর এটাও ওর মাথায় ঢুকেছে যে, একটা দশ ফুট লম্বা লাঠি দিয়েও আমি ওকে স্পর্শ করতে চাইব না। তবে…’ দরজার দিকে হাত নেড়ে দেখাল জুলিয়া। ‘আমি এখন ম্যাগিকে নিয়ে চিন্তায় আছি। হারামজাদাটা ওকে না আবার জ্বালাতন শুরু করে। ও যদি আমার বোনের দিকে হাত বাড়ায়…’ বিরতি দিল জুলিয়া। ‘ওর হাত আমি কেটে ফেলব! ঠিক খুন করব ওকে আমি!’

জনের দিকে ফিরল জুলিয়া। ‘যা হোক, এজন্যই আমি তোমার পিছু নিয়েছিলাম। তুমি যদি এখানে বার্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসে থাকো, ধরে নাও, একজন পার্টনার পেয়ে গেছ।’

‘আমি এখানে এসেছি আমার বাবার রানশের ন্যায্য হিস্যা পেতে। বাবা রানশের এক-তৃতীয়াংশ আমার জন্য উইল করে গেছে। তবে বার্ট আমার সাথে যে আচরণ করেছে, তার শোধ অবশ্যই নেব। কিন্তু খুনখারাবির মধ্যে আমি যাব না।’ সিধে হলো জন, হাত জোড়া প্যান্টে ঘষল, যেন ঘাম লেগেছে। ‘লিঙ্কন কাউন্টিতে বহু খুনোখুনি করেছি।’

‘বোকার মত কথা বলবে না,’ ধমকে উঠল জুলিয়া। তোমার কি ধারণা, বার্টকে খুন না করেই সার্কেল ইউ-র জমি পেয়ে যাবে? এক ইঞ্চিও পাবে না।’

‘দেশে আইন আছে,’ বলল জন, ‘আদালত আছে। আমার কাছে লেখা বাবার একটা চিঠি আছে…’ শার্টের পকেট চাপড়াল ও।

খামটা যথাস্থানেই রয়েছে।

পাঞ্চারটা ওর শিরদাঁড়ায় বন্দুক ঠেসে ধরার ঠিক আগে আগে পিটার চিঠিটা জনকে ফেরত দিয়েছিল।

‘আইন-আদালত!’ নাক সিটকাল জুলিয়া রবার্টস। ‘আদালতে মামলা লড়তে হলে টাকা লাগে।’ বিরতি দিল সে। ‘যে লোক বার্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে, আঘাত করতে পারবে তাকে, তাকে আমি টাকা দিয়ে সাহায্য করতে রাজি আছি। কিন্তু আইনি লড়াইয়ের জন্য একটা পয়সাও খরচ করতে আগ্রহী নই।’

‘আমি তো তোমার কাছে কোনও টাকা-পয়সা চাইনি,’ বলল জন, ‘আমি নিজেই টাকা জোগাড় করতে পারব।’

‘কীভাবে?’ জুলিয়ার চেহারায় অবিশ্বাস।

বিষয়টা নিয়ে জন আগেই ভেবেছে। জবাবে বলল, ‘খুব সহজ। আমার ভাগের সার্কেল ইউ-র গরু বিক্রি করলেই টাকা পেয়ে যাব।’

জুলিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ‘কী?’

কাঁধ ঝাঁকাল জন। ‘সার্কেল ইউ-র গরু-ঘোড়াগুলোর এক- তৃতীয়াংশের মালিক আমি। ওগুলো বিক্রি করে দিলেই মামলা চালানোর টাকা জোগাড় হয়ে যাবে।’

কিছুক্ষণ নীরব থাকল জুলিয়া। তারপর যখন কথা বলল, অদ্ভুত শোনাল কণ্ঠ। ‘তুমি ওগুলো চুরির মতলব করছ?’

‘আমার জিনিস আমি নেব, এতে চুরি-চামারির কথা আসছে কোত্থেকে?’

আবার কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ রইল জুলিয়া।

ও কী ভাবছে, চেহারা দেখেই বলে দিতে পারে জন। আস্তে আস্তে হাসি ফুটল মেয়েটার মুখে। ধরা পড়লে ওরা তোমাকে ফাঁসিতে লটকাবে।

‘সে ঝুঁকি তো নিতেই হবে,’ সরল গলায় বলল জন।

বসে রইল জুলিয়া। হাতে হাত ঘষছে। ‘তা হলে ব্যাপারটা একই দাঁড়াচ্ছে,’ অবশেষে বলল সে। ‘তুমি ওই কাজটা করলে আজ হোক বা কাল, বার্টকে তোমার হত্যা করতেই হবে। নতুবা ওর হাতে তুমি খুন হয়ে যাবে।’ হঠাৎ নির্মল হাসিতে ভরে গেল জুলিয়ার মুখ। দারুণ খুশি দেখাচ্ছে তাকে। ‘কিন্তু কাজটা তুমি একা করতে পারবে না। লোকবলের প্রয়োজন হবে তোমার। চুরি করার পর গরুগুলো লুকিয়ে রাখা আর ব্র্যাণ্ড বদলাতে তোমার একটা জায়গা লাগবে। ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।’

‘সে আমি ম্যানেজ করে নেব,’ বলল জন।

‘এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি, ‘ প্রস্তাব করল জুলিয়া।

‘চেনাজানা কেউ আছে এরকম?’ জানতে চাইল জন।

‘এক লোককে চিনি আমি,’ জবাব দিল জুলিয়া। ‘সে কিছু ব্যাপারে আমার কাছে ঋণী হয়ে আছে। যদি তাকে একটা চিঠি লিখে দিই…’ এক সেকেণ্ড বিরতি নিল ও। ‘না, চিঠিটা তোমার নিজেকেই নিয়ে যেতে হবে। তোমাকে তার পছন্দ না হলে সে তোমার সাথে কাজ করবে না।’

‘আচ্ছা, যাব,’ আশ্বস্ত করল জন।

‘অনেক দূরের পথ,’ বলল জুলিয়া। ‘কলোরাডো নদীর ধারে, ওয়াইওমিং লাইনের কাছে থাকে সে। এখান থেকে এক শ’ মাইল দূরের রাস্তা। ‘

‘নাম কী লোকটার?’

‘টম ফোর্ড,’ বলল জুলিয়া। ‘ষণ্ডামার্কা লোকজন নিয়ে কাজ কারবার। সে ওয়াইওমিং আর উটাহর কয়েকজন লোককে চেনে, যাদের কাছে তুমি গরু বিক্রি করতে পারবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘আমি তোমাকে চিঠিটা দেব। সাথে দেব খাবার আর গুলি। টাকা-পয়সার ব্যাপারটা ওর সাথে কথা বলে ঠিক করে নেবে।’

‘আচ্ছা,’ বলল জন, ‘আরেকটা কথা।’

‘কী?’

‘সার্কেল ইউ-র ওই ছেলেটা, পিটার উইলিয়ামস…আমার সৎ-ভাই। ওর সম্পর্কে কিছু জানো?’

‘ও অনভিজ্ঞ বালক মাত্র,’ বলল জুলিয়া, ‘সতেরো বছর বয়স। ওর কাছ থেকে কোনও সাহায্যের আশা কোরো না। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত বার্টই ওর অভিভাবক। তবে পিটার যেভাবে চলাফেরা করে, তাতে মনে হয় না, ততদিন আয়ু পাবে ও।’

‘মানে?’

‘কোমরে কীভাবে পিস্তল ঝোলায় ও, দেখেছ?’

‘হুম, দেখেছি।’ পিটারের নিচু করে বাঁধা হোলস্টারের কথা মনে পড়ল জনের। স্ট্র্যাপ শক্ত করে উরুর সঙ্গে বাঁধা ছিল।

‘ছেলেটা পিস্তল-পাগল। এ ধরনের লোকদের সম্পর্কে তো তুমি জানোই। হয়তো ভাল ছেলে ও, কিন্তু পিস্তল ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় নেই। বুড়ো মরিস ওকেও বার্টের মত কড়া শাসনে রেখেছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর পিটার এখন বন্ধনহীন। পিস্তল দিয়ে যা খুশি করতে পারে। স্বপ্ন দেখছে, পিস্তলবাজ হিসেবে সবখানে নাম ছড়িয়ে পড়বে ওর। শহরে এলেই ঝামেলার খোঁজ করে। এখনও কেউ কিছু বলেনি বটে ওকে, তবে ভুল কোনও মানুষের মুখোমুখি যদি পড়ে কোনও দিন, ওটাই হবে পিটার উইলিয়ামসের শেষ দিন।’

সৎ-ভাইয়ের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল জনের। ‘ছেলেটা দেখছি বড্ড বোকা।

‘আমার ধারণা, পিটারের বেপরোয়া চলাফেরার পিছনে বার্টের মদত আছে,’ বলল জুলিয়া, ‘পিটারের যদি কিছু হয়ে যায়, তা হলে সার্কেল ইউ পুরোটাই বার্টের দখলে চলে যাবে।’

‘কিন্তু পিটার তো এখনও কোনও মানুষ খুন করেনি,’ বলল জন।

‘তা করেনি।’

‘ওকে বুঝিয়ে বলা দরকার, ও যা করছে, তা ঠিক নয়।’

‘পিস্তল ব্যবহার করার জন্য যার হাত সব সময় নিশপিশ করে, তাকে এ কথা কে সাহস করে বলতে যাবে?’ কাঁধ ঝাঁকাল জুলিয়া। ‘আসলে ছেলেটাকে মিসগাইড করা হয়েছে। বিলি বনি, জন হার্ডিন-এসব বিখ্যাত বন্দুকবাজের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে মাথাটাই বিগড়ে দিয়েছে। বড় হলে কল্পনার জগৎ থেকে হয়তো বাস্তবে ফিরে আসবে, কিন্তু তার আগেই না কারও হাতে খুন হয়ে যায়।’

‘আমি তা হতে দেব না,’ আপন মনে বলল জন। ‘ও আমার ভাই।’

‘ও যদি তোমার বিরুদ্ধে না লাগে, তো বলব, তোমার ভাগ্য ভাল,’ জুলিয়ার কণ্ঠ কর্কশ শোনাল। ‘বার্ট অ্যান্ড্রিউ ধড়িবাজ শয়তান। তুমি সার্কেল ইউ-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে সে ঠিকই পিটারকে তোমার বিরুদ্ধে তাতিয়ে দেবে। পিটারের কান ভারী করে তুলবে ও। আর তোমার বিরুদ্ধে পিটার লড়াই করতে রাজি হলে বার্টই শেষে জয়ী হবে।’

দরজায় নক হলো।

কফি আর কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল ম্যাগি। ‘একটু পরেই খাবার আসছে,’ নরম, লাজুক গলায় জানাল। টেবিলে ট্রে রাখার সময় প্রাণপণে চেষ্টা করল জনের দিকে না তাকাতে।

‘ধন্যবাদ, ম্যাগি,’ বলল জুলিয়া।

জবাবে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে অপর দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল জুলিয়ার বোন।

জুলিয়ার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ বাস্তবে ফিরিয়ে আনল জনকে।

সে এতক্ষণ ম্যাগি যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ওদিকেই তাকিয়ে ছিল।

‘এই যে,’ বলল জুলিয়া। ‘দয়া করে চেহারা থেকে বিহ্বল ভাবটা দূর করো।’

লাল হয়ে গেল জনের মুখ। ‘কই, কোথায়? আমি ঠিকই আছি।’

‘আমি সিরিয়াস। তোমার মত কারও সাথে ম্যাগিকে জড়াতে দেব না, শীতল শোনাল জুলিয়ার কণ্ঠ। ‘ওসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।’

‘আরে, বললামই তো—’ প্রতিবাদের সুরে কিছু বলতে গিয়েও ব্রেক কষল জন। ‘এসো, কফি খাই।’

‘তুমি খাও,’ বলল জুলিয়া, ‘আমি তোমার গোসলের ব্যবস্থা করছি। তারপর একটু ঘুমিয়েও নিতে পারো।’ লম্বা সোফাটার দিকে ইঙ্গিত করল। ‘ঘুম থেকে ওঠার পর, যদি সত্যি আগ্রহ বোধ করো, টম ফোর্ডের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যাবে।’

‘আমি যথেষ্টই আগ্রহী,’ বলল জন।

‘আরেকটা কথা,’ বলল জুলিয়া, ‘তুমি কিন্তু শহরে বেশি ঘোরাঘুরি করবে না। আমি চাই না, আমার স্বামীর মত তোমারও একই দশা হোক।’

‘ধন্যবাদ,’ শুকনো গলায় বলল জন।

‘আগে কাজ শেষ হোক, তারপর ধন্যবাদ দিয়ো,’ আড়ষ্ট হেসে বলল জুলিয়া। কফি ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

নয়

গত আধ ঘণ্টা ধরে ঘোড়ার পিঠে ঋজু হয়ে বসে আছে জন উইলিয়ামস। অসহ্য উত্তেজনায় চামড়ার ভিতরটা যেন চুলকোচ্ছে।

যে ট্রেইল ধরে ও এগোচ্ছে, সেটাকে ঠিক ট্রেইল বলা যাবে না; গভীর জঙ্গল আর রুক্ষ ভূখণ্ডের মিশ্রণে যে পথটা তৈরি হয়েছে, তার মাঝখানে আর আশপাশে ছোটবড় অসংখ্য পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে দুর্গম করে তুলেছে যাত্রা। এটা কলোরাডোর লুপ বা আঁকাবাঁকা রাস্তাটার একটা প্রান্ত, বেরিয়ে এসেছে ওয়াইওমিং থেকে, উটাহতে আচমকা ঢুকে যাওয়ার আগে কলোরাডোয় সেঁধিয়েছে।

জুলিয়ার বর্ণিত শেষ ল্যাণ্ডমার্কটা পার হয়ে এসেছে জন, ওটা একটা উঁচু মেসা, ডানদিকে খাড়া ঢাল নিয়ে তির্যক ভাবে বেঁকে আছে, আউলহুট টেরিটোরির গভীরে প্রবেশ করেছে ও এখন।

এখন যে-কোনও মুহূর্তে কোনও লুকআউট চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে জনকে-কিংবা সহজেই হতে পারে কারও অ্যামবুশের শিকার।

সব কিছুই নির্ভর করছে টম ফোর্ড আর তার লোকেরা কতটুকু খিটখিটে মেজাজের তার উপর।

তবে এখনও শঙ্কাজনক কিছু ঘটেনি। তাই, শুধু সাবধানী দৃষ্টি রেখে-

ঘোড়াটার নাকের সামনে দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল রাইফেলের বুলেট, বিধল একটা পাথরে।

ঘটনার আকস্মিকতায় সামনের দু’পা উপরে তুলে লাফিয়ে উঠল বে।

পাথরের গায়ে গুলির শব্দ প্রতিধ্বনি তুলল।

চিন্তার জগৎ থেকে নিমিষে বাস্তবতায় ফিরে এল জন উইলিয়ামস।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কোল্টে হাত চলে যাওয়ার কথা ছিল ওর। তবে নিজেকে নিবৃত্ত করল। পিস্তল বের করতে গেলেই গুলি খাবে ভেবে ঝুঁকিটা নিল না। বদলে ভীত ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বাম হাতে শক্ত করে চেপে ধরল লাগাম, শূন্যে উঁচু করল ডান হাত।

পাথরের শক্ত সব বোল্ডার আর ক্ষয়ে যাওয়া জমিনের উপর চোখ বুলাল জন।

কোথাও কেউ নেই, এমনকী বারুদের ধোঁয়ার চিহ্নও দেখতে পেল না।

‘হ্যালো!’ হাঁক ছাড়ল জন। ‘যে-ই থাকো ওখানে, গুলি কোরো না!’

ঊষর ভূমিতে ওর কথাগুলোর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হতে লাগল। শেষ প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যাওয়ার পর জবাব এল। ‘মিস্টার, ঘুরে দাঁড়াও, এবং এখান থেকে কেটে পড়ো।’

‘কেটে পড়ার জন্য এখানে আসিনি আমি,’ চেঁচিয়ে বলল জন। ‘টম ফোর্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

নেমে এল নীরবতা।

পাথরের স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে জনের চোখ খুঁজে বেড়াল অদৃশ্য বন্দুকবাজকে। কিন্তু দেখতে পেল না তাকে।

আবার ভেসে এল কণ্ঠটা। ‘টমের সাথে তোমার কী দরকার?’

‘ফ্লেচার’স হোল-এর জুলিয়া রবার্টসের কাছ থেকে তার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছি!’

আবারও নৈঃশব্দ, বোধ হয় কিছু ভাবছে গানম্যান। তারপর, ‘ঠিক আছে। তোমার গানবেল্ট ছুঁড়ে ফেলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে স্যাডল গান থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়াও।’

নির্দেশ পালনে কালক্ষেপণ করল না জন। সাবধানে হোলস্টার থেকে সিক্সগান খুলে নিয়ে ঘোড়ার বেশ সামনে, একটা পাথরের উপর রেখেছে, এমন সময় ছোট-ছোট নুড়ি পাথর গড়ানোর শব্দ হলো।

পনিস্কিন ভেস্ট আর চ্যাপ্টা, ধূসর হ্যাট মাথায় এক লোক বেরিয়ে এল তিরিশ গজ দূরের উঁচু এক বোল্ডারের পিছন থেকে।

লোকটার মুখভর্তি দাড়ি। চেহারায় সন্দেহ। ডান হাতে ধরা কারবাইনের নল লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জনের দিকে।

‘নাম কী তোমার, স্ট্রেঞ্জার?’ এগিয়ে আসতে আসতে খেঁকিয়ে উঠল সে।

‘উইলিয়ামস। জন উইলিয়ামস।’

দেড়ের কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘শুনেছি কোথাও। তুমি…আচ্ছা, দাঁড়াও…তুমি কি কখনও নিউ মেক্সিকোতে ছিলে?’

‘লিঙ্কন কাউন্টিতে ছিলাম,’ জবাব দিল জন।

‘হবস নামে কাউকে চিনতে? বুটস হবস নামে সবাই তাকে চেনে।’

শক্ত হয়ে গেল জন। ‘বুটস হবসকে চিনি আমি। কেন?’

‘এমনি,’ বলল লোকটা। ‘টমের সাথে তোমার কী দরকার?’

‘বললামই তো, জুলিয়ার কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। সেই সাথে একটা ব্যবসায়িক প্ৰস্তাব।’

জনের উপর চোখ রেখেই পাথরের উপর থেকে ওর গানবেল্ট তুলে নিল লোকটা। তারপর জনের ঘোড়ার স্যাডল থেকে বের করল কারবাইন।

‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘ঘোড়ায় উঠে পড়ো। আমরা রওনা হব।’

‘তুমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাও না, তা-ই না?’

‘ঝুঁকি নেয়ার জন্য বেতন দেয়া হয় না আমাকে,’ জবাবে বলল দাড়িঅলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *