1 of 2

দানবিক – সুবোধ ঘোষ

দানবিক – সুবোধ ঘোষ

বিহারের সেই ভূমিকম্প! কী ভয়ানক রাগ করে ফণা নেড়েছিলেন বাসুকী নাগ! পটপট করে বেজে উঠেছিল ধরিত্রীর পাষাণের পাঁজর। বড়-বড় খেত আর মাঠের বুক ফেটে গিয়ে গরম জল আর বালুর ফোয়ারা উথলে উঠেছিল। মাটির গভীরে লুকিয়ে থেকে ছোট-ছোট অগস্ত্য যেন এক চুমুকের টানে ওপরের এক-একটা ঝিল আর পুকুরের জল শুষে নিয়েছিল। কত কুয়োর মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বড়-বড় সড়কের জায়গায়-জায়গায় বড়-বড় দহ দেখা দিয়েছিল। আর শহর, বাজার ও বস্তির ছোট-বড় কত বাড়ি যে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল, তার কিছু বিবরণ আর পরিচয় এখনও সেই রিলিফ কমিটির রিপোর্টের পুরোনো ফাইলে পাওয়া যাবে, যদি সে-রিপোর্টের ফাইল এখনও থেকে থাকে।

কোথা থেকে একটা অদৃশ্য আক্রোশের ঝড় হঠাৎ মত্ত হয়ে উঠে যেন প্রচণ্ড এক ধ্বংস আর হাহাকারের খেলা খেলে তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সেই ধ্বংসের কান্না আর হাহাকারের রেশ থেমে যেতে বেশ কিছুদিন লেগেছিল। একবছর পরেও দেখা যেত, বিধবা নারী পথের ধারের একটা ইঁটের স্তূপের কাছে বসে কাঁদছে। সে-নারীর স্বামীর লাশ সেই ইঁটের স্তূপের ভিতর সমাধিস্থ হয়ে কবেই মাটি হয়ে গিয়েছে। তবু অবুঝ বিধবা যেন একটা প্রাণের সাড়া শোনবার লোভে ইঁটের স্তূপের কাছে বসে থাকে। সেই সময় ক্যাপ্টেন দেবেশ মল্লিক দেওঘর থেকে শ্বশুরবাড়ির চিঠি পেয়ে চমকে উঠেছিল।

—তুমি আর কোনও চিন্তা কোরো না দেবেশ। সুলেখা ভালো আছে, বেবিও ভালো আছে।

থ্যাঙ্ক গড! বহু পুণ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সুলেখা আর সুলেখার বেবি।

রাজপুত রেজিমেন্টের সঙ্গে মেডিক্যাল অফিসার হয়ে তখন নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারের রাজমাক ফোর্টের ভিতরে, শান্ত-সুন্দর পাথুরে কোয়ার্টারের সামনে, আখরোট গাছের ছোট ছায়ার পাশে আরাম-চেয়ারে বসে বাংলা উপন্যাস পড়ছিল দেবেশ। চিঠি পড়তে-পড়তে বুকটা বারবার কেঁপে উঠেছিল। কী অদ্ভুত রক্ষা! চারটে দিন যেন একটা রসাতলের অন্ধকারে সমাধিস্থ থেকে, তারপর বেঁচে উঠে বাইরে এসে পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে সুলেখা আর বেবি।

সেদিনই ছুটির জন্য দরখাস্ত করতে চেয়েছিল দেবেশ। সেই মুহূর্তে ছুটে এসে একবার সুলেখার মাথায় হাত রাখতে আর বেবিটাকে কোলে তুলে নিতে মনটা ছটফট করে উঠেছিল। কিন্তু যাক, যখন বিপদ কেটে গিয়েছে, তখন আর এতটা উতলা হওয়ার দরকার হয় না।

আর উতলা হয়নি দেবেশ। কয়েকদিন পরে সুলেখারই কাছ থেকে চিঠি এল। সে-চিঠির লেখা পড়ে মনটা একেবারে শান্ত হয়ে গেল। আহত হয়নি সুলেখা। না সুলেখা, না বেবি, কারও গায়ে সেই নিষ্ঠুর ভূমিকম্পের একটা আঁচড়ও লাগেনি।

প্রকাণ্ড একটা বাড়ি ধসে গেল, ইঁট-পাথর কড়ি-বরগার একটা বিরাট স্তূপ কবরের মতো নিরেট হয়ে এতগুলি মানুষের প্রাণ চাপা দিল। তবু বেঁচে গেল সুলেখা আর বেবি! তিনটে দিন আর রাত সেই রসাতলের অন্ধকারে নির্বাসিত হয়ে থাকতে সুলেখার বুকের পাঁজর ভয় পেয়ে গুঁড়ো হয়ে যায়নি, এই তো আশ্চর্য! আরও আশ্চর্যের কথা, চিঠিতে কোনও ভয়ের কথা লেখেনি সুলেখা। বরং, শেষ লাইনে যেন একটা উল্লাসের ঝঙ্কার আছে।

—বললে বিশ্বাস করবে না, এই তিনটে দিন আর রাতকে তিনটে ঘণ্টার বেশি বলে মনেই হয়নি। বুঝতেই পারিনি যে, তিন-তিনটে দিন আর রাত পার হয়ে গিয়েছে, এমনই অদ্ভুত অন্ধকার! একমিনিটও ঘুমোইনি। চোখ দুটো মাঝে-মাঝে অবশ হয়েছে, এই মাত্র।

পরের চিঠিতে একটা দুঃখের খবর ছিল, যে-খবর পড়ে কয়েকটা দিন দেবেশের মনটা বেশ বিমর্ষ হয়েছিল। দেবেশের কাকা আর কাকিমা খুব বেশি জখম হয়েছেন। প্রাণে বেঁচেছেন ঠিকই, কিন্তু বোধহয় আজীবন পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে। দুজনেই এখন মুঙ্গের হাসপাতালে আছেন। সুলেখা লিখেছে :

বাবা আবার চলে গিয়েছেন মুঙ্গের। কাকা আর কাকিমাকে পাটনাতে নিয়ে যাবেন। তুমি ছুটি নিয়ে চলে আসবার চেষ্টা করো।

তারপরের চিঠিতে ভালো খবর।

না, চিন্তা করবার আর কিছু নেই। কাকা আর কাকিমা সেরে উঠেছেন। হাড় ভাঙেনি। তবে, চোখের দৃষ্টির জোর কমে গিয়েছে, দুজনেরই। ওঁরা দুটো দিন সেই রসাতলের অন্ধকারে ছিলেন, আর তাইতেই চোখের জোর নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু…।

সুলেখার চিঠির শেষ লাইনে আবার একটা খুশির ঝঙ্কার আছে।

—কিন্তু আমার চোখ দুটো তেমনই টনটনে আছে। আশ্চর্য!

সেই চিঠির পর একটা বছর পার হয়ে গিয়েছে। তারপর এই আজ। আজ আর রাজমাক ফোর্টের ভিতরে আখরোটের সেই ছায়ার কাছে বসে কল্পনায় সুলেখার আর বেবির মুখ দেখতে হচ্ছে না। পাটনাতে এসে, কদমকুঁয়ার এই বাড়িতে ঢুকে সুলেখার মুখের দিকে তাকিয়েছে দেবেশ। সুলেখার কোলে বেবি। হেসে-হেসে বেবির মুখটাকে দেখছে দেবেশ।

—এ কী!—বেবির মুখের দিকে তাকাতেই যেন চমকে উঠেছে দেবেশ। বোধহয় একটু আশ্চর্য হয়েছে।

হেসে ওঠে সুলেখা : আগে একবার কাকা আর কাকিমার সঙ্গে দেখা করে নাও। এসো।

দেবেশের চোখের বিস্ময়টাকে যেন হঠাৎ হাসির মায়া দিয়ে ভুলিয়ে অন্যদিকে টেনে নিয়ে গেল সুলেখা। সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে, দোতলার একটি ঘরে ঢুকে কাকা আর কাকিমার সঙ্গে গল্প করে দেবেশ।

দোতলার একটি ঘরে বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে বেবি। ঘরের ভিতরে আলো জ্বলে। প্রকাণ্ড মিররটাও প্রকাণ্ড একটা আলো হয়ে ঝকঝক করছে। রাত হয়েছে অনেক।

বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা যায়। এতক্ষণে বেড়িয়ে ফিরল দেবেশ। গ্যারেজে ঢুকছে গাড়ি, তার শব্দও শোনা যায়। হাতের বই রেখে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সুলেখা।

ঘরে ঢুকেই দেবেশ হাসে। —খাওয়ার হাঙ্গামা সেরে এসেছি। মোরাদাবাদ গিয়েছিলাম। বলাইয়ের স্ত্রী পেটভরে লুচি-মাংস খাইয়ে ছেড়েছে।

তারপরেই বিছানার ওপর ঘুমন্ত বেবির দিকে তাকায় দেবেশ।—বেবিটা যে এত কালো হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি।

ঠিকই বলেছে দেবেশ। বেবির বয়স যখন তিনমাস, তখন ঘুমন্ত বেবির গালে চুমো খেয়ে রওনা হয়েছিল দেবেশ। পাটনা থেকে পেশোয়ার, তারপর পিণ্ডি, তারপর রাজমাক ফোর্টে গিয়ে রেজিমেন্টাল হাসপাতালের চার্জ নিতে হয়েছিল। সেদিন বেবিটা কী চমৎকার ফুটফুটে ফরসা একটা ডলের মতো চেহারা নিয়ে ঘুমিয়েছিল! একবছরের মধ্যে কত কালো হয়ে গিয়েছে বেবি! কোথায় গেল সেই রং?

সুলেখা হাসে—হ্যাঁ, সত্যিই বেশ কালো হয়ে গিয়েছে বেবি।

ঘুমন্ত বেবির কাছে গিয়ে বেবির গাল টেপে দেবেশ। সুলেখা হাসে—ঘুমের মধ্যে আদর কোরো না। শেষে ঝগড়াটে স্বভাবের একটা দুষ্টু হয়ে উঠবে।

একটা সোফার ওপর বসে ডাক দেয় দেবেশ।—তুমি কি এখনই ঘুমিয়ে পড়বার মতলব করছ?

—না।—সুলেখা হাসে। আর হেসে-হেসেই পট করে সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিয়ে দেবেশের পাশে সোফার উপর বসে।

—এ কী!—একটু আশ্চর্য হয় দেবেশ।

সুলেখা—এই তো ভালো।

দেবেশ—অন্ধকার ভালো লাগে?

সুলেখা—হ্যাঁ।

দেবেশ—নতুন অভ্যেস মনে হচ্ছে!

সুলেখা বিব্রতভাবে বলে, অ্যাঁ? তার মানে?

দেবেশ—আগে দেখেছি, অন্ধকার সহ্য করতেই পারতে না।

সুলেখা যেন আনমনার মতো আস্তে-আস্তে বলে—তা বটে।

গল্প করে দেবেশ। খৈবার পাস, আফ্রিদির উপদ্রব আর পাখি শিকারের গল্প। তারপর একটা খুশির উচ্ছ্বাসে হেসে ওঠে দেবেশ। —কিন্তু তোমার ভূমিকম্পের গল্পের কাছে এসব গল্পের আশ্চর্য কিছুই নয় বোধহয়।

সুলেখা বলে—হ্যাঁ।

দেবেশ—তবে বলো।

সুলেখা—কী?

দেবেশ—ওই তিনটে দিন চারমাসের বেবিকে নিয়ে একটা প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপের ভিতরে আটক হয়ে থেকে, না খেয়ে…আমার মনে হয়, এইজন্যেই বেবিটা কালো হয়ে গিয়েছে।

সুলেখা বলে—হ্যাঁ। রেস্ক্যু-পার্টি যখন ভিতরে ঢুকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে এল, যখন ভালো করে চোখে দেখতে পেলাম, তখন দেখলাম, বেবিটা বেশ কালো হয়ে গিয়েছে।

—তোমার খুব দুঃখ হয়েছিল নিশ্চয়।

—অ্যাঁ? দুঃখ? না, এতে খুব দুঃখ করবার কী আছে!

দেবেশের একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সুলেখা। তারপর দেবেশের কাঁধের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে একটা হাঁপ ছাড়ে।—আশ্চর্য!

—কী?—প্রশ্ন করে দেবেশ।

—এই যে বেবিটা কালো হয়ে গেল। একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য গল্পের মতো মনে হয়!

—গল্পের মতো?

—হ্যাঁ।

—কেন?

—কী করে বলব বলো? মনে হয়, এইমাত্র।

কথা শেষ করেই আস্তে একটু কেঁপে ওঠে সুলেখা। তারপরেই যেন নিঝুম হয়ে যায় শরীরটা।

মরণের মুখ থেকে ফিরে এসেছে সুলেখা, কোলের বেবিকে কোলে নিয়ে আবার স্বামীর গা ঘেঁষে বসবার সৌভাগ্য হয়েছে। সৌভাগ্যের আনন্দ যেন এতক্ষণ পরিপূর্ণ হয়ে সুলেখার চেতনায় রিমঝিম করে বাজছে। সুলেখার পিঠে হাত বোলায় দেবেশ।

কিন্তু সুলেখার এই সুখের আবেশের মধ্যে যেন একটা বোবা গল্পের বিস্ময় ছটফট করতে থাকে। সুলেখা নিজেও বোবা হয়ে আর দু-চোখ বন্ধ করে সেই গল্পের ছবিটাকে যেন সারা অনুভব দিয়ে দেখতে থাকে, কিন্তু বলতে পারে না।

সবই মনে পড়ে সুলেখার। সেদিন মুঙ্গেরে পৌঁছে সূর্যকুণ্ড দেখবার কথা ছিল। মুঙ্গেরের চারুবাবু কাকা আর কাকিমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন :

একবার সস্ত্রীক এসে মুঙ্গের বেড়িয়ে যাও, পরেশ।

তাই, অন্য কোনও কারণ ছিল না। পরেশবাবু বললেন, তুমিও চলো, বউমা।

কাকিমা আপত্তি করেছিলেন—চারমাসের একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে সুলেখা আবার কেন ছুটোছুটি করে হয়রান হবে?

পরেশবাবু—কোনও অসুবিধা হবে না। পাটনা থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত যেতে এখন ভালো সড়ক পাওয়া যাবে। নিজের গাড়িতে যাব। অসুবিধার কী আছে?

জায়গাটা বোধহয় বেগুসরাই থেকে মুঙ্গের যেতে পড়ে। একটা বাজার ছিল। আর নতুন একটা ধর্মশালাও ছিল।

ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে পরেশবাবু বললেন, বিকেল পর্যন্ত এই ধর্মশালাতে একটু রেস্ট নেওয়া যাক বউমা, কী বলো? সন্ধ্যায় আবার রওনা হওয়া যাবে।

সেই ধর্মশালা। তিনতলা বাড়ি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, দেখতে কেল্লার মতো বিরাট। সেদিন লোক গিজগিজ করছে ধর্মশালায়। সূর্যকুণ্ডে স্নানে যাওয়ার জন্যই এই ভিড়।

বেবিকে ফ্লানেল দিয়ে জড়িয়ে আর কোলে নিয়ে এই ধর্মশালার বারান্দাতে আস্তে-আস্তে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল সুলেখা। আর, একটা ঘরের ভিতরে চৌকির ওপর বসে খবরের কাগজ সামনে রেখে গল্প করছিলেন কাকা আর কাকিমা। সেই সময়…সেই ধরিত্রীর পাঁজর-কাঁপানো শিহরন, সেই ভয়াল শব্দ, আর সেই প্রচণ্ড হাহাকার, আর্তনাদ। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে তিনতলা ধর্মশালা। প্রচণ্ড ধুলোর ঝাপটা আর অন্ধকারের মধ্যে যেন ছিটকে গেল সুলেখার প্রাণটা।

প্রথমে বুঝতেই পারেনি সুলেখা, একটা নিরেট অন্ধকারের মধ্যে মুখ থুবড়ে কেন পড়ে আছে ও? মূর্ছাটা তখনও ঠিক ভাঙেনি।

তারপরেই চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে সুলেখা—বেবি! আমার বেবি কোথায়?

নিরেট অন্ধকারে ঢাকা কবরটা যেন সুলেখার চিৎকারের সঙ্গে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ তুলে প্রতিধ্বনি ছড়ায়। হাতড়ে-হাতড়ে হাঁটতে থাকে সুলেখা। কিন্তু পদে-পদে হোঁচট খায়। এগিয়ে যেতে পারে না।

প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড দেওয়ালের টুকরো এদিকে-ওদিকে হেলে, বেঁকে, গড়িয়ে আর খানখান হয়ে পড়ে আছে। গুমরে-গুমরে একটা শব্দ ভেসে আসছে, যেন অনেক দূর থেকে। যেন একটা বাজারের শোরগোল চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে কান্নাকাটি করছে।

ভয়ানক করুণ শব্দ, তবু তো জীবন্ত শব্দ। ওরই কাছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করে সুলেখা। আর চারদিকে ছড়ানো ইঁটের ওপর হাতের খাবলা ফেলে-ফেলে ঘুরতে থাকে।—বেবি! আমার বেবি! শূন্য অন্ধকারকে খিমচে-খিমচে বেবিকে খোঁজে আর কাঁদতে থাকে সুলেখা।

হঠাৎ…যেন পাতালপুরীর একটা দানবের হাতের ছোঁওয়া সুলেখার পিঠের ওপর এসে লুটিয়ে পড়ে। যেন সুলেখার পিঠের মাংস ছিঁড়ে নেওয়ার জন্য পাঁচ আঙুলের নখ এগিয়ে দিয়েছে সেই দানবিক আগন্তুক।

লাফ দিয়ে সরে যায় সুলেখা। দম বন্ধ করে সুলেখা। যেন সুলেখার এই যন্ত্রণাক্ত বুকের একছিটে নিশ্বাসের শব্দও শুনতে না পায় দানবটা।

কিন্তু দানবের নিশ্বাস আর পায়ের শব্দ শুনতে পায় সুলেখা। সুলেখার পায়ের শব্দ লক্ষ করে ঘুরছে দানবটা। মড়মড় করে ইঁটের স্তূপ বাজছে। সুলেখার রক্তমাংসের গন্ধ অন্বেষণ করছে রসাতলের সেই দানবিক আবির্ভাব। মস্ত বড় একটা ইঁট হাতে তুলে সেই মরণগুহার নিভৃতে এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে সুলেখা।

দানবটা হাঁসফাঁস করে ঘুরতে থাকে। কিন্তু সুলেখাকে খুঁজে পায় না। শুধু শুনতে থাকে সুলেখা, অন্ধকারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস ছাড়ছে দানব।

চমকে ওঠে সুলেখা। হাতের ইঁট ঝুপ করে খসে পড়ে যায়। চেঁচিয়ে উঠেছে এই মরণগুহার দানব।—কে আপনি চিৎকার করে কাঁদছিলেন? কোথায় গেলেন আপনি?

—আপনি কে? সুলেখার হৃৎপিণ্ডটা যেন উল্লাসে লাফিয়ে ওঠে।

—আমিও আপনার মতো মরেছি।

—কী সব্বনেশে কথা বলছেন!—ফুঁপিয়ে ওঠে সুলেখা।

—সত্যি মরিনি, কিন্তু মরতে হবে যে।—লোকটাও চেঁচিয়ে ওঠে।

—কিন্তু আমার বেবি!—সুলেখার কান্না এইবার সেই মরণগুহার সব অন্ধকার গলিয়ে দিয়ে গুনগুন করে বাজতে থাকে।

—আপনার কোলে ছেলে ছিল কি?

—হ্যাঁ।

—খুঁজেছেন?

—কত খুঁজলাম, পেলাম না।

—আপনি খুঁজবেনই বা কী করে? আপনার সাধ্য কী?—লোকটা যেন বিচলিত স্বরে আক্ষেপ করে।

—আপনি দয়া করে একটু খুঁজবেন?

—নিশ্চয়।—লোকটা আবার হাঁসফাঁস করতে-করতে, অন্ধকারের বুকের ভিতর দিয়ে টলতে-টলতে কোনদিকে যেন চলে যায়।

কী আশ্চর্য, এই মরণগুহার ভিতরে দাঁড়িয়ে সুলেখার মনের ভিতর থেকে মরণভয়ের ভ্রকুটিগুলি যেন আস্তে-আস্তে মরে যাচ্ছে। মরতে হবে, সে-মরণ কি এইরকম জীবন্ত হয়ে থাকার চেয়েও অদ্ভুত? ভয় নয়, ভয় করবার মতো ভীরু জীবনটাই যেন মরে যাচ্ছে। সুলেখার প্রাণ শুধু একটি প্রার্থনা সাধছে। বেবিটাকে চাই। মরে যাওয়ার আগে বেবিকে একবার কোলের ওপর তুলে বুকের কাছে চেপে ধরতে চাই। বেবির গালে একটা চুমো দিয়ে এখানে এই রসাতলের অন্ধকারে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়লে দুঃখ কীসের?

—আপনি আছেন?—বেঁচে আছেন?—লোকটা সুলেখার নিকটে এসে আবার হাঁক দিয়েছে।

—আছি। আপনি বেঁচে আছেন তো?—উত্তর দেয় সুলেখা।

হেসে ওঠে লোকটা।—এখনও আছি।

—আমার বেবি কই?

—এখনও পাইনি।

—তবে আশা কি নেই?—আবার ফুঁপিয়ে ওঠে সুলেখা।

—আছে। আশা ছাড়বেন না।

চলে গেল লোকটা। কিন্তু তখুনি ফিরে এসে চেঁচিয়ে ওঠে, আপনি জল খাবেন যদি, তবে এখানে এসে দাঁড়ান।

ইঁট তুলে নিয়ে একটা ভাঙা দেওয়ালের ওপর ঠকঠক করে আঘাত করে জায়গাটাকে চিনিয়ে দেয় লোকটা। —এখানে একটা চৌবাচ্চা আছে, তাতে জল আছে। বলতে-বলতে চলে গেল লোকটা।

হ্যাঁ, জল। এই রসাতলের সবই তা হলে দানবিক নয়! এখানেও জল আছে, করুণা আছে। সুলেখার কান্না শুনে বিচলিত হওয়ার মতো প্রাণ আছে। এমন কিছু রিক্ত, শূন্য আর শ্রীহীন নয় মরণময় এই অন্ধকারের সংসার। হাতড়ে-হাতড়ে এগিয়ে চৌবাচ্চার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, জল খায় সুলেখা।

—আপনি বেঁচে আছেন?—আবার সেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। সুলেখার প্রাণের জন্য, সুলেখার কোলের ছেলেকে খুঁজে আনবার জন্য এই ধ্বংসের ইঁট-পাথরের ভিতর দিয়ে মাথা ঠুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে-মানুষটা, তারই কণ্ঠস্বর। সত্যিই মানুষ তো?

—বেবি কই?—চেঁচিয়ে ওঠে সুলেখা।

—এই নিন। এগিয়ে আসুন।

—পেয়েছেন, পেয়েছেন!—রসাতলের সেই অন্ধকারের এক মহা করুণার উপহার নেওয়ার জন্য দু-হাত তুলে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে সুলেখা।

লোকটার হাত থেকে বেবিকে তুলে নিয়ে বেবির বুকের ওপর কান পাতে সুলেখা। তারপরেই বেবিকে বুকের ওপর চেপে ধরে। চারমাসের একটা কোমল ও নধর শরীর। তৃষ্ণার্ত বেবি সুলেখার বুকের ওপর মুখ ঘষতে থাকে।

সুলেখা ডাক দেয়, আপনি কোথায়?

—এই তো, কাছেই আছি।

—এখানেই থাকুন।

—হ্যাঁ। আর পারি না!—লোকটা যেন অলসভাবে একটা হাঁপ ছেড়ে বসে পড়ে।

—বেবিকে কোথায় পেলেন?—প্রশ্ন করে সুলেখা।

—ওদিকের একটা ঘরের একটা তক্তপোশের নীচে। কান্নার শব্দ শুনে, অনেক চেষ্টা করে ইঁটের রাশ ঠেলে-ঠেলে, শেষে বাচ্চাটাকে ধরতে পেরেছি। কিন্তু…।

—কী?

—যাক সে-কথা। এখনও বাঁচবার আশা আছে মনে হচ্ছে।

—কী করে বুঝলেন?

—ওদিকে যারা বেঁচে আছে, তারা খুব জোরে হল্লা করছে। বাইরে থেকে কাজ শুরু হয়েছে বলে ওদের ধারণা।

—কীসের কাজ?

—উদ্ধারের। কোদাল-গাঁইতির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওপরের ইঁট-পাথর সরানো শুরু হয়েছে।

উদ্ধার! কথাটা যেন একটা অবাস্তব স্বপ্নের প্রলাপের শব্দ বলে মনে হয় সুলেখার। ওপরের সেই সূর্যের আলোক, গাছের সবুজ আর ফুলের গন্ধকে এখানে বসে যে নিতান্তই পর বলে মনে হয়। এখানে, এই নিরেট অন্ধকারের মরণময় মোহ তারচেয়ে কম মধুর নয়। এখানে দানবের হাতের নখ সুলেখার রক্ত-মাংস লুঠ করতে চায় না, কী আশ্চর্য! এইরকম দানবিক মায়ার গা ঘেঁষে বসে থাকতেই যে ইচ্ছা করে। উঠতে ইচ্ছা করে না। ওপরের সূর্যালোকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে এই শান্তির চোখ যে ঝলসে যাবে!

লোকটার হাতটা হঠাৎ ছুঁয়ে ফেলেছে সুলেখা। সেই হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সুলেখা। লোকটা বলে—না, আমি আপনাকে একলা রেখে পালিয়ে যাব না। মরলে দুজনে একসঙ্গেই মরব।

—বেশ তো!—সুলেখার হাতটা কেঁপে ওঠে। লোকটার অবশ হাতটাকে আস্তে-আস্তে কাছে টানে সুলেখা। যেন মরণবাসরের সঙ্গীকে একটা মধুর উত্তাপের ছোঁয়া দিয়ে অভ্যর্থনা করতে চায়।

কিন্তু মরণগুহার বুকটাই ঝনঝন করে বেজে ওঠে। ঘণ্টা বাজছে। হু-হু করে হাওয়া ঢুকছে। আর টর্চের আলো যেন ঝাঁক বেঁধে দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে।

ওপরের রাবিশের স্তূপ সরিয়ে ভিতরে নেমেছে রেস্ক্যু-পার্টি। ভলান্টিয়ার আর পুলিশ আর স্কাউট।

একটা স্ট্রেচারও যেন ছুটতে-ছুটতে সুলেখার চোখের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। —চলে আইয়ে।—হাঁক দেয় ভলান্টিয়ার।

বেগুসরাই ক্যাম্প হাসপাতালের বেডের ওপর শুয়ে যখন ভালো করে চোখ মেলে তাকাবার মতো চোখের জোর পায় সুলেখা, তখন কোলের কাছে ঘুমন্ত বেবির মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। সুলেখার সেই বেবি নয়, কিন্তু মানুষেরই বেবি। বেশ গোলগাল নরম-নরম আর বেশ কালো একটা চারমাসের মানুষ!

প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে ভেজা চোখ নিয়ে আনমনার মতো বাইরের মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে সুলেখা। তারপর বাচ্চাটাকে বুকের ওপর তুলে নিয়ে দোলা দিয়ে ঘুম পাড়াতে থাকে।

—কী হল? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি, সুলেখা?—সুলেখার কপালে হাত রেখে ডাক দেয় দেবেশ।

—অ্যাঁ? তুমি কোথায়?—চমকে ওঠে সুলেখা।—সুলেখার বুকের ভিতরে যেন অদ্ভুত এক দানবিক মায়ার স্মৃতি চমকে উঠেছে। যেন এক পরম নিবিড় অন্ধকারের সংসারে একটা প্রীতিময় হাত কাছে টেনে নিতে চায় সুলেখা।

দেবেশের হাতটাকে আস্তে-আস্তে কাছে টেনে নেয় সুলেখা।

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৫৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *