দানপত্র

দানপত্র

জ্যাঠামণির চিঠিটা পেয়ে খুব অবাক হল কুশল। সেই যে বছর কুড়ি আগে ওর বাবা ওদের নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন, তার পরে ওখানকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেননি। জ্যাঠামণিও এতদিন ওদের খোঁজখবর করেননি। ওর তখন বয়স মাত্র সাত। বাবার সঙ্গে জ্যাঠামণির কী নিয়ে যেন খুব কথা কাটাকাটি হয়েছিল, জ্যাঠাইমাও তাতে যোগ দিয়েছিলেন। ওর এখনও মনে আছে, মা দরজার একপাশে ঘোমটা টেনে পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিলেন। একটা কথাও বলেননি।

সেইদিনই বাবা ওকে আর মাকে নিয়ে হুগলি শহর থেকে একটু দূরে ওর মামাবাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। ওদের ওখানে রেখে তিনি চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন তারপর ওদের মামাবাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। যতদিন ওরা মামাবাড়ি ছিল, বেশ সুখেই ছিল। দাদু-দিদিমা বেঁচে ছিলেন না, কিন্তু দুই মামা ওকে আর মাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল। বাবাকেও ওখানে থেকে যেতে বলেছিলেন, ওখানে কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন একথাও বলেছিলেন। কিন্তু বাবা রাজি হননি। তিনি ছিলেন খুব আত্মাভিমানী। নেহাত নিরুপায় হয়েই ওদের মামাবাড়িতে রেখেছিলেন।

পরে কুশল জেনেছিল গাঁয়ে ওদের দোতলা বাড়ি, প্রচুর জমিজমা, ধান ভাঙার কল যা কিছু ছিল সবই জ্যাঠামণি বাবার সরলতার সুযোগ নিয়ে নিজের আর জ্যাঠাইমার নামে করে নিয়েছিলেন। জ্যাঠতুতো দুই দিদি পর্যন্ত মা-র সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। এসব নিয়েই বাবা একদিন কথা বলতে গিয়েছিলেন, তার ফলেই কথা কাটাকাটি।

এসব কথা কিন্তু কুশল বাবা কিংবা মা-র মুখে শোনেনি, শুনেছে বড়োমামিমার মুখ থেকে। তিনি বলতেন, ঠাকুরজামাইকে এমনভাবে যারা ঠকিয়ে আখের গুছিয়ে নিল, ভগবান তাদের একদিন-না-একদিন শাস্তি দেবেনই।

বড়োমামিমার মনটা ছিল বড়ো কোমল। মাকে বুঝতেই দিতেন না যে তিনি ভায়েদের আশ্রয়ে আছেন। সংসারের সব কাজে মা-র সঙ্গে পরামর্শ করতেন। বড়ো হয়ে কুশল বুঝেছিল মাকে সংসারের মধ্যে একাত্ম করে নেবার জন্যেই তিনি ওটা করতেন।

ছোটোমামিমা আবার ছিলেন বড়োমামিমার ভীষণ অনুগত। তাঁর ছেলেমেয়ে ছিল না, তাই কুশলকে খুব আদরযত্ন করতেন। বড়োমামার দুই ছেলেমেয়ে, তাদের সঙ্গে কুশলের খুব ভাব হয়েছিল। বাবা যখন ওদের ওখান থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন শুধু বড়োমামিমা, ছোটোমামিমা আর মামাতো ভাই-বোনেরাই কাঁদেনি, দুই মামার চোখও শুকনো ছিল না।

মামার বাড়ির প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে কলকাতায় এসে জীবনের কষ্টকর রূপটা দেখল কুশল। বাবাকে তখনও উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। সামান্য রুজি নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেছিলেন, মোটামুটি দাঁড় করিয়েছেন। একটা পুরোনো বাড়ির একতলার স্যাঁৎসেঁতে একটা ঘর, এজমালি কলঘর, আর বারান্দার একপাশে চট দিয়ে ঘেরা রান্নার ব্যবস্থা— এই ছিল ওদের সংসার।

কুশলের তো কান্নাই পেয়ে গিয়েছিল। মা-র মুখে কিন্তু এতটুকু ম্লান ছায়া পড়েনি, বরং তিনি যেন নিজের সংসার পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছিলেন।

কুশল বাড়ির কাছেই একটা সাধারণ ইস্কুলে ভরতি হয়েছিল। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিল ও। ইস্কুল, কলেজে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। ইলেকট্রনিক্স ছিল ওর প্রিয় বিষয়, তাই নিয়ে শেষ করেছিল পড়া। দু-বছর হল ও দিল্লিতে একটা বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করছে। ভালো মানে, ফ্রি কোয়ার্টার্স, গাড়ি, আরও অনেক সুবিধে পেয়েছে আপিস থেকে। তার আগে অবিশ্যি কিছুদিন কলকাতায় চাকরি করেছিল।

দুঃখ শুধু একটাই। যখন সবে ওরা সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছে, একটা ভালো বাড়িতে গুছিয়ে বসেছে, ঠিক তখনই পর পর বাবা আর মা মারা গেলেন।

জ্যাঠামণির চিঠিটা তাই ওকে অবাক করেছিল। মনে মনে ও যে একটু বিরক্তি বোধ করেনি তাও নয়। ওদের দুঃখ-কষ্টের জন্য জ্যাঠামণিই যে দায়ী এটা ও কেমন করে ভুলবে!

চিঠিটা ও পড়ল।

স্নেহের কুশল,

তুমি আমার পত্র পাইয়া খুব আশ্চর্য হইবে। সেটাই স্বাভাবিক। তার আগে জানাই, তোমার বর্তমান ঠিকানা আমি তোমার মামাবাড়ি হইতে সংগ্রহ করিয়াছি।

তোমার পিতা আমার সহোদর, তাহার সহিত আমি যে ব্যবহার করিয়াছি ঈশ্বরের বিচারে তাহার ক্ষমা নাই। তাই এই বৃদ্ধ বয়সে আমি অনুশোচনায় দগ্ধ। তোমার জ্যাঠাইমা অনেকদিন হইল গত হইয়াছেন। খুব কষ্ট পাইয়া তিনি দেহত্যাগ করিয়াছেন। আমার দুই কন্যাও অকালে আমাদের মায়া কাটাইয়া চলিয়া গিয়াছে। যে লোভে অন্ধ হইয়া আমি আমার সহোদরকে সব কিছু হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলাম, সেই পাপের শাস্তি এখন আমাকে ভোগ করিতে হইতেছে।

আমি বৃদ্ধ, অনুতপ্ত, তোমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। তোমার কাছে একান্ত অনুরোধ একবার তুমি আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করো। তোমাকে আমার অত্যন্ত প্রয়োজন। আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ একবার আমাকে দাও ইহাই আমার একান্ত অনুরোধ। নতুবা মরিয়াও আমি শান্তি পাইব না। আশা করি তুমি এই অনুতপ্ত, সর্বহারা বৃদ্ধের অনুরোধ উপেক্ষা করিবে না।

আং

তোমার জ্যাঠামণি

পুঃ তুমি যথাশীঘ্র সম্ভব আসিয়ো কারণ আমি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনিতে পাইতেছি।

বারকয়েক পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কুশল। ছোটোবেলার দিনগুলির কথা যেন ছবির মতো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

কয়েকদিন পরে রাজধানী এক্সপ্রেসে হাওড়া স্টেশনে এসে নামল কুশল। ট্রেন সেদিন অস্বাভাবিক লেট ছিল। রিটায়ারিং রুমে স্নান-পর্ব সেরে স্টেশনের ডাইনিং রুমেই ও খেয়ে নিল। তারপর একটা লোকাল ট্রেন ধরল। যে স্টেশনে ওকে নামতে হবে সেখান থেকে ওদের গ্রাম বেশ কিছু দূরে।

শীতকাল। স্টেশনে যখন ও নামল তখন চারদিক অন্ধকার। একটা সাইকেল রিকশায় ও উঠে বসল। সঙ্গে শুধু ছোটো একটা সুটকেস। চারদিকে অনেক পাকা বাড়ি উঠেছে, সেই গ্রাম এখন আর চেনা যায় না। জ্যাঠামণির নাম বলতেই রিকশাচালক চিনতে পারল। আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট পর দোতলা বাড়িটার সামনে এসে থামল রিকশা। কুশল তাকিয়ে দেখছিল। এই বাড়িতেই ওর বাল্যকাল কেটেছে। অনেকটা জমি নিয়ে বাড়ি, তাই আশপাশ ফাঁকা।

অন্ধকারে যেন ডুবে আছে বাড়িটা। রিকশাচালক বলল, বাড়িতে কেউ আছে বলে মনে হতেছে না বাবু।

কুশল ভাবল এই অভিশপ্ত পুরীতে জ্যাঠামণি এখন একাই থাকেন তাই বোধ হয় এত অন্ধকার। ও রিকশাচালককে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি দেখে আসি।

ও সুটকেসটা হাতে নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ওর এখন সব মনে পড়ছে। গেট থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে বাড়িটা, গাছগাছালিতে ঘেরা। সদর দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়তে হল, তারপর খুলে গেল দরজা। অস্থিচর্মসার এক বৃদ্ধ লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। এই কি ওর জ্যাঠামণি! এখন নিশ্চযই বয়স সত্তরের কোঠায়।

কে? বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন।

আমি কুশল, দিল্লি থেকে আসছি, কুশল জবাব দিল।

আয় বাপ, আয়। বৃদ্ধ বলে উঠলেন, আমি যে তোর অপেক্ষাতেই আছি, তুই না আসা পর্যন্ত যেতে পারছি না।

জ্যাঠামণি কোথায় যাবার কথা বলছেন কুশল বুঝতে পারল না। ও বলল, আমি আসছি, রিকশাটা ছেড়ে দিয়ে আসি।

ও গিয়ে রিকশাচালকের ভাড়া মিটিয়ে পাঁচ টাকা বখশিশ দিল। লোকটি খুশি হয়ে বলল, নমস্কার বাবু।

চলে গেল রিকশা।

কুশল ফিরে এল। জ্যাঠামণিকে প্রণাম করল। জ্যাঠামণির খালি পা, গায়ে একটা চাদর পর্যন্ত নেই। পা ঠান্ডায় যেন হিম হয়ে গেছে।

জ্যাঠামণি ওকে আলো দেখিয়ে দোতলায় নিয়ে গেলেন। বললেন, আমি এই পাপপুরী যক্ষের মতো আগলে আছি কুশল। তুই এসব নিয়ে আমাকে মুক্তি দে।

এসব নিয়ে আমি কী করব জ্যাঠামণি, কুশল বলল, এখানে আমি কোনোদিনই থাকব না। তা ছাড়া বাবা-মা যা ভোগ করতে পারলেন না, তা আমি ছেলে হয়ে কোন মুখে ভোগ করব!

ওসব কথা বলে আর আমায় অপরাধী করিস না কুশল, জ্যাঠামণি বললেন, জানি আমার পাপের ক্ষমা নেই। অহরহ বৃশ্চিক দংশনের মতো আমার বুকের ভেতরটা জ্বলছে। এই বিষয়সম্পত্তি এখন আমার কাছে বিষ। তোকে যদি এসব ফিরিয়ে না দিই তবে যে নরকেও আমার ঠাঁই হবে না বাবা।

কিন্তু এসব নিয়ে এখন আমি কী করব! কুশল অনেকটা অসহায়ের মতো বলল।

তোর যা খুশি তাই কর। সব বিক্রি করে দে, বিলিয়ে দে, যা তোর ইচ্ছে, শুধু আমাকে তুই মুক্তি দে বাবা। আমাকে দায়মুক্ত না করলে আমার যে মুক্তি নেই।

জ্যাঠামণির গলায় যেন কাকুতি ঝরে পড়ল। কুশল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, তোমার যদি তাতে শান্তি হয় তবে তাই হোক।

লণ্ঠনের আলোয় কুশল লক্ষ করল জ্যাঠামণির মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন ভীষণ একটা উদবেগের হাত থেকে মুক্তি পেলেন তিনি।

তুই আমাকে বাঁচালি বাবা, পরম স্বস্তির কণ্ঠে তিনি বললেন, ভগবান তোর মঙ্গল করুন। তুই একটু বোস, আমি আসছি।

তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কুশল তাকিয়ে দেখল ঘরে একটা বড়ো খাট আর কিছু আসবাব। দুটো আলমারিও চোখে পড়ল।

জ্যাঠামণি ফিরে এলেন। তাঁর হাতে একটা বড়ো খাম। সেটা কুশলের হাতে দিয়ে তিনি বললেন, এর মধ্যে আমার দানপত্র আছে। বাড়ি, জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি সব আমি তোর নামে লিখে দিয়েছি। উকিলের সামনে সই করেছি, দু-জন সাক্ষীর সইও আছে, কোনো গোলমাল নেই।

কুশল খামটা টেবিলের ওপর রাখল। জ্যাঠামণি বললেন, রাত্তিরে তোর খাবার অসুবিধে হবে। আমি একা মানুষ, রাত্তিরে আর রান্নাবান্নার ঝামেলা করি না, খই-দুধ খেয়েই কাটিয়ে দিই। তুই আজ আসবি জানলে ব্যবস্থা করতাম;;;

ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না জ্যাঠামণি, কুশল বলল, আমি আজ বেলা করে খেয়েছি, একেবারে খিদে নেই।

তবে তোর বিছানাটা করে দিই, জ্যাঠামণি বললেন।

তুমি কেন করবে! কুশল বাধা দিয়ে বলল, আমি নিজেই করে নিতে পারব। লেপ, মশারি সবই তো আছে দেখছি।

ঠিক পারবি তো বাবা? জ্যাঠামণির গলায় একটু কিন্তু কিন্তু ভাব।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, কুশল বলল, দিল্লিতে আমি একাই তো থাকি, নিজের অনেক কাজই আমাকে করতে হয়, তুমি চিন্তা কোরো না।

তবে তুই বিছানা করে শুয়ে পড়, অনেক ধকল গেছে আজ তোর। এই লণ্ঠনটা ঘরে রইল।

জ্যাঠামণি বেরিয়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, তোরা যখন এখান থেকে চলে গেলি তখন তুই খুব ছোটো। ছোটোবেলার কথা মনে আছে তোর?

কিছু কিছু আছে, কুশল বলল, বাবার সঙ্গে তোমাদের কথা কাটাকাটি হচ্ছিল, আমার মা ঘোমটা টেনে দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই দৃশ্যটা স্পষ্ট মনে আছে।

তোর মা ছিলেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী, জ্যাঠামণি বললেন, শত অবিচারেও কোনোদিন মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেননি। আমি মা লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলেছি।

কুশলের কানে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এল। তারপরেই চলে গেলেন জ্যাঠামণি।

কুশল বিছানা করে শুয়ে পড়ল। শীতের রাত, তার ওপর সারাদিনের ধকল, লেপ মুড়ি দিয়ে বালিশে মাথা ঠেকাতে-না-ঠেকাতেই চোখে নেমে এল রাজ্যের ঘুম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে কুশল ঘরে ফিরে এল। খামটা টেবিলের ওপর ছিল, সেটা হাতে নিয়ে ভেতরের কাগজটায় ও একবার চোখ বোলাল, তারপর রেখে দিল সুটকেসের ভেতর।

একটু চা পেলে ভালো হত। জ্যাঠামণি হয়তো এখনও ওঠেননি। বুড়ো মানুষ। ও বেরিয়ে পড়ল, যদি বাইরে কোনো চায়ের দোকান চোখে পড়ে। কিছুটা হাঁটবার পর একটা বাড়ি দেখতে পেল কুশল। এই বাড়িটা আগেও ছিল, ওর মনে পড়ল এই বাড়িতে ও আসত।

বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে কুশল ইতস্তত করছিল এমন সময় আধপাকা চুল একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, কাকে চাই?

না, মানে, কুশল একটু আমতা আমতা করে বলল, আমি ছোটোবেলায় এখানে ছিলাম। আমার নাম কুশল মজুমদার। আমার জ্যাঠামণির নাম অম্বিকা মজুমদার, গতকাল রাত্তিরে আমি এখানে এসেছি।

কুশল! ভদ্রলোকের দু-চোখ যেন বিস্ফারিত হল, তুমি অনন্তর ছেলে!

হ্যাঁ, কুশলের মুখে হাসি ফুটল, এ বাড়িতে আমি ছোটোবেলায় আসতাম।

আসতেই তো, তোমার বাবা যে আমার খুব বন্ধু ছিলেন, ভদ্রলোক বললেন, আমি কত বলেছিলাম বিষয়সম্পত্তির জন্য কেস লড়তে। এখানকার সবাই জানত তোমার জ্যাঠামণি কেমন করে তোমার বাবাকে ঠকিয়েছিলেন, সাক্ষীর অভাব হত না। কিন্তু তোমার বাবা কিছুতেই রাজি হননি। দাদার বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি প্রাণ গেলেও নয়, একথাই বলেছিলেন তিনি। এসো, ভেতরে এসো।

তিনি কুশলকে ভেতরে নিয়ে গেলেন, বাড়ির সবাইকে ডেকে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এর মধ্যে একটি বউ এক পেয়ালা চা আর একটা রেকাবিতে কুচো নিমকি দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে কুশল যেন বাঁচল।

তারপর হঠাৎ তুমি এখানে! সেই ভদ্রলোক বললেন, তোমার জ্যাঠামণির খবর তোমাকে কে দিল?

কে আবার দেবে, কুশল হাসল, জ্যাঠামণি নিজেই আমাকে এখানে আসার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। বিষয়সম্পত্তি সব আমাকে দিয়ে তিনি মুক্ত হতে চান।

এই সুবুদ্ধিটা যদি তাঁর আগে হত, ভদ্রলোক বললেন। তা গতকাল রাত্তিরে তুমি এসেছ বললে, কোথায় উঠেছ?

কেন, আমাদের বাড়িতেই। কুশল অবাক হয়ে জবাব দিল, আর কোথায় উঠব! জ্যাঠামণি তো আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন।

তোমার অপেক্ষায় ছিলেন! এবার যেন ভদ্রলোকের অবাক হওয়ার পালা।

হ্যাঁ, কাল রাত্তিরে তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হল। জ্যাঠামণি অনেক দুঃখ করলেন অতীতের ঘটনার জন্য। তাঁর দানপত্র আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি অবিশ্যি নিতে চাইনি, কী হবে এসব দিয়ে আমার!

ঘরের মধ্যে কয়েক মুহূর্ত কেউ কথা বলল না। তারপর সেই ভদ্রলোকই মৃদু কণ্ঠে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, তিনদিন হল তোমার জ্যাঠামণি মারা গেছেন। শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। বাড়িতে একজন কাজের লোক ছিল, সে-ই তাঁর দেখাশোনা করত। সেও চলে গেছে। আমরাই তোমার জ্যাঠামণিকে দাহ করেছি।

কিন্তু আমি যে…, হতভম্বের মতো বলল কুশল। তখুনি ওর মনে পড়ল জ্যাঠামণির সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যে তোর অপেক্ষাতেই আছি, তুই না আসা পর্যন্ত যেতে পারছি না।’ তবে কি তাঁর অনুতপ্ত আত্মা যতক্ষণ পর্যন্ত না দলিলটা ওর হাতে তুলে দিচ্ছে ততক্ষণ মুক্তি পাচ্ছিল না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *