দাদুর ব্যারাম সোজা নয়
মাঝরাতে টুসির দাদুর পেট-ব্যাথাটা খুব-জোর চাগাড় দিয়ে উঠলো। দুহাতে পেট আঁকড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লে তিনি–এই কলিক। এতেই প্রাণ তার লিক করে বুঝি এক্ষুনিই। তার মর্মান্তিক হাঁকডাক শুরু হয়–টুসি টুসি।
টুসি ঘুমোচ্ছিল পাশের বিছানাতেই, জেগে ওঠে সে। কি দাদু। ডাকছো আমায়?
এক্ষুণি যা একবার বামাপদ ডাক্তারের কাছে। ছুটে যাবি। বলবি যে, মরতে বসেছে দাদামশাই।
অ্যাঁ?–টুসি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।
বলবি যে, সেই কলিকটা–। হঠাৎ ভয়ানক–। উঃ বাবাগো।
ওঃ। সেই কলিক। অনেকটা আশ্বস্ত হয় টুসি। স্টোভে জল ফুটিয়ে বোতলে পুরে দেবো তোমায় দাদু? চেপে ধরবো তোমার পেটে?
ধুত্তোর বোতল। বোতলেই যদি কাজ হোতো, তাহলে লোকে আর ডাক্তার ডাকতো না। বোতলের কাছেই ব্যবস্থা নিত সবাই। উঃ। আঃ। ওরে বাবারে। গেলাম রে।
দাদুর আর্তনাদে বিকল হয়ে পড়ে টুসি। বামাপদবাবুকে কল দিতে যেতেই হয় । কি আর করা?
কিন্তু এই রাত্রিরে? এত রাত্তিরে আসবেন কি ডাক্তার? রাতবিরেতে রাস্তায় বেরুতে টুসি একটু ইতস্তত করে।
বেশি কি রাত হয়েছে শুনি? এই তো সবে দুটো। আর এমন কি দূর? দেরি করিসনে যা। আর্তনাদের ফাঁকে ফাঁকে উৎসাহ-বাণী বিতরণ করেন ওর দাদু।
শার্ট গায়ে, শ্লিপার পায়ে তৈরি হয় টুসি। ছোট্টো মানিব্যাগটা পড়ে যায় পকেট থেকে; যথাস্থানে তাকে আবার তুলে রাখে। ফাউন্টেনপেনটাও আঁটে বুকে। এত রাত্তিরে কে আর দেখছে তার কলম। তাহলেও—তবুও–।
ছুটতে ছুটতে যাবি। দাঁড়াবিনে কোথায়। যাবি আর আসবি। আমি খাবি খাচ্ছি। বুঝেছিস?
অতঃপর মর্মন্তুদ যত অব্যয়শব্দ-অপপ্রয়োগের পালা শুরু হয়ে এর দাদুর–মা গো বাবা গো। গেলুম গো। উঃ। আ। ইস। উঁহুহু।
ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে পড়ে টুসি। এক পলকও দাঁড়ায় না আর।
প্ৰথম খানিকটা সে সবেগেই যায় কিন্তু ক্রমশইঃ ওর গতিবেগ মন্দীভূত হয়ে আসে। খেয়ে না খেয়ে সে বেশ একটু মোটাই; তাড়াহুড়ার পক্ষে খুবই যে উপযোগী নয়, অল্পক্ষণেই সে তা বুঝতে পারে। তবু তার দাদুর যে এখন-তখন, একথা ভাবতেই টুসির মন ভারী হয়ে আসে-ভারী পা-কে তাড়িত করে দেয়। হাঁপাতে হাঁপাতেই সে ছোটে।
এমন সময় রাস্তার এক প্রাণী অযাচিতভাবে এসে টুসির গতিবৃদ্ধির সহায়তায় লাগে, যদিও সে সাহায্য না করলেও টুসির নিজের মতে–বিশেষ কোন ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না।
জনবিরল পথ। কোনো লোক নেই কোথাও। একটা মোটরও চলে না রাস্তায় কেবল ইঁদুররাই এই সুযোগে মহাসমারোহে রাস্তা পারাপার করছে এধারের ফুটপাথ পেরিয়ে ওদিকের অন্দরে গিয়ে সেঁধুচ্ছে। ওদিকে থেকে ছুটে আসছে এদিকে।
যথাসম্ভব তেজে চলেছে, টুসি, ইঁদুরের শোভাযাত্রার পদাঘাত না করে–সবদিক বাঁচিয়ে।
এমন সময় একটা কুকুর–
ইঁদুরদের অন্বেষণেই এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল সে বোধহয়, কিন্তু বৃহত্তম শিকার পেয়ে ক্ষীণজীবীদের পরিত্যাগ করতে মুহূর্তের জন্যেও সে দ্বিধা করলো না। টুসির পেছনে এসে লাগলো সে।
ঘেউ—ঘোউ–ঘেউউউ।
টুসি দৌড়োয় আরো-আরো-জোরে। আরো-আরো–তীরবেগে সে ছুটতে শুরু করে।
কুকুর সশব্দে দৌড়ায়। টুসির পেছনে-পেছনেই।
হাঁপ ফেলার ফাঁক নেই টুসির প্রাণপণে সে দৌড়াচ্ছে–। ফিরে তাকাবার ফুসরৎ নেই তার। না ফিরেই সে উদ্ধত আওয়াজ শোনে, উদ্যত নখদন্ত নিজের মনশ্চক্ষেই দেখে নেয়। আরো জোরে সে ছুটতে থাকে।
ছুটতে-ছুটতে তার মনে হয়, দৌড়োচ্ছে সে এমন আর মন্দ কি। মোটা বলে ইস্কুলের ছেলেরা দৌড়ের-স্পোর্টসে নামাবার জন্যে প্রায়ই ওকে ওসকায়; কিন্তু এরকম একটা কুকুরের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রথম পুরস্কারই মেরে দিতে পারে সে একছুটেই–হ্যাঁ।
কিন্তু দরকারের সময় কোথায় তখন কুকুর? এখন-যখন তেমন তাড়া নেই, কুকুরের তাড়নায় ছুটতে হচ্ছে ওকে।
ছুটবার মুখে টুসির সম্মুখে এসে পড়ে একটা পার্ক লোহার সরু করগেট, শিকের রেলিং দিয়ে ঘেরা। পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে হাঁপ ছাড়ে টুসি। কুকরটা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে। বড় আর একটা উচ্চবাচ্য করে না সে-কি হবে অকারণে ঘেউৎকারে গলা ফাটিয়ে? নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে শিকার এখন। শিকের রেলিং ডিঙিয়ে, কি তার কায়দায় দরজা খুলে ভেজিয়ে ভেতরে ঢোকার কৌশল তো ওর জানা নেই। বাইরে দাঁড়িয়ে নিতান্তই জিহ্বা-আস্ফালন এবং ল্যাজ-নাড়া ছাড়া আর উপায় কি?
পার্কের ওধারে একটা গ্যাসে বাতি খারাপ হয়ে দপদপ করছিল। প্রায় নিভবার মুখেই আর কি। বাতির অবস্থা দেখে দাদুর অবস্থা ওর মনে পড়ে। তার জীবন-প্রদীপও হয়তো ওই বাতির মতোই–ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে টুসি।
পার্কের ওধারের গেটটা পেরিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে খানিকটা গেলেই বামাপদবাবুর বাড়ি।
টুসি পার্কের অন্যধারে যায়। গেটটা আবার কিছুটা দূরেই–অতটা ঘুরে যেতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। সামনেই রেলিং এর একটা শিক বেশ ফাঁক করা দেখতে পায় সে। ছেলেফিলেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যেই বিধাতার সাহায় নিশ্চয়ই এই ফাঁকের সৃষ্টি। ফাঁকের নেপথ্য দিয়ে –ফাঁকি দিয়ে গলে যাবার সোজা রাস্তা নেয় সে।
কিন্তু টুসির হিসেবে ভুল ছিল ঈষত্মাত্র। ছেলের মধ্যে ধরলেও পিলের মধ্যে কিছুতেই গণ্য করা যায় না ভুল ছিল ঈষত্মাত্র। ছেলের মধ্যে ধরলেও পিলের মধ্যে কিছুতেই গণ্য করা যায় না তাকে, বরং পিপের সঙ্গেই তার উপমা ঠিক মেলে। কাজেই মধ্যপথেই সে আটকে যায়–ঠিক তার দেহের মধ্যপথে। এগুতেও পারে না, পেছিয়ে আসাও অসম্ভব।
বহুক্ষণ রেলিং এর সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে–করগেট শিকের বাহুপাশ কিন্তু একচুলও শিথিল হয় না। অবশেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় সে। কি মুশকিলেই সে পড়লো বলো তো। কোথায় বিছানায় আরামে না কোথায় রেলিং-এর ব্যাড়া মে। কান্না পেতে থাকে তার।
কুকুরটাও এতক্ষণে গোটা পার্কটা ঘুরে-ফিরে তাঁর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিল। টুসির মুখের ওপরেই সে লাফাতে-ঝাপাতে শুরু করে এবার।
অসহায় হয়ে হাত পা ছুঁড়ে টুসি কী আর করবে? তাও একখানা হাত, আধখানা পা-তার বেশি আর নয়। পালিয়ে বাঁচবার উপায়ও তার নেই। আগেই সে-পথ সে বন্ধ করেছে।
ওকে ছেড়ে ওর কোঁচা ধরে টানতে থাকে কুকুরটা। অ্যাঁ! মুক্তকচ্ছ করে দেবে নাকি! মতলব তো ভাল নয় ওর! দুহাতে প্রাণপণে কাপড় চেপে ধরে টুসি–গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে। এক কামড়ে কোচার খানিকা ছিঁড়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যায় কুকুরটা। হ্যাঁ, বিরক্ত হয়েই বেশ। হুটোপাটি নেই, দৌড়ঝাঁপ নেই এরকম ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রেলিং-এর গায় লেগে থাকা খেলা ভাল লাগে না ওর। ইঁদুরের খোঁজেই সে চলে যায় আবার।
কুকুরটা ওকে বর্জন করে গেলে কিছুটা স্বস্তি পায় সে। খানিক বাদে একটা লোক যায় পাশ দিয়ে–টুসি তার দিকে ডাক ছাড়ে।
ও মশাই! মশাই গো!
কে? লোকটা চমকে ওঠে। কি? কি হয়েছে তোমার? টুসির কাছে এসে জিগ্যেস করে সে।
আমাকে এখান থেকে বের করে দিন না মশাই! টুসির কণ্ঠস্বর অতিশয় করুণ। ভারি মুশকিলে পড়েছি আমি।
ওর অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করে দ্যায় লোকটা–বাঃ! বেড়ে তো! কার অঞ্চলের নিধি এসে এখানে আটকে পড়োছো চাঁদ! আছে নাকি কিছু তাঁকে?
টুসির পকেটে হাতড়ে মানিব্যাগটা সে হাতিয়ে নেয়। দাদুর দেওয়া ইস্কুলের মাইনে আর বায়োস্কোক দেখার পয়সা–সবই যে রয়েছে ঐ ব্যাগে। টুসির যথাসর্বস্ব! সবটা বাগিয়ে নিয়ে লোকটা সত্যিই চলে যায় যে-! বাঃ! বেশ মজার তো!
টুসি চেঁচাতে শুরু করে–পিক-পকেট! পকেটমার! পুলিশ। ও পুলিশ! চোর, ডাকাত, খুনে পালাচ্ছে পুলিশ! ও পুলিশ।
লোকটা ফিরে আসে ফের–অমন করে চাচাচ্ছো কেন যাদু? এই নিশুতি-রাতে শুনবে কে? কে জেগে বসে আছে সারারাত তোমার জন্যে হারানিধি? এই যে, বাঃ। ফাউন্টেনপেনও একটা আছে দেখছি! দেখি বাঃ বেশ পেনটি তো। পার্কার? কিছু মনে কোরো না লক্ষ্মী ভাইটি।
অতঃপর কলমটি হস্তগত করে ওর মাথায় আদর করে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় লোকটা। টুসি আর চাঁচায় না এবার।
কতক্ষণ যে এভাবে কাটে, জানে না সে-হঠাৎ ভারী একটা সোরগোল শুনতে পায় টুসি।
চোর-চার! পাকড়ো! পাকড়ো উধর ভাগা-উস তরফ।
হ্যাঁ, সেই পকেট-কাটা হতভাগাই। ছুটতে ছুটতে সে এসে টুসির পাশের রেলিং টপকে পার্কের গেট দিয়ে উধাও হয়।
কয়েক মুহূর্ত পরেই এক পাহারাওয়ালা এসে টুসিকেই জাপটে ধরে–পাকড় গয়ি! এই ভাইয়া! নিজের উচ্চকণ্ঠ ছেড়ে দেয় সে–এবার ফুর্তি ওর দ্যাখে কে!
আরেকজন পাহারাওয়ালা এসে যোগ দেয় তার সঙ্গে–এই! বাহার আও। নিকলো জলদি! টুসিকে এক ঘুসি লাগায় সে কষে–চোট্টা কাঁহাকা?
টুসি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে।
আরে! ই তো রোনে লগি! বহুৎ বাচ্চা বা!
বাচ্চা হোই চায় সাচ্চা হই, লেকিন একঠো কো তো থানামে লে-যানা পড়ি।
অপর পাহারাওয়ালাটা বলে–এই! চলো থানাতে।
থানাতেই তো যেতে চাচ্ছি আমি। টুসি কাঁদতে কাঁদতে জানায়–আমায় নিয়ে যাও না থানায় ধরে-বেঁধে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও না আমাকে। ভারী করুণ কণ্ঠ ওর।
যদি চুরির দায়ে পড়েও মুক্তির সম্ভাবনা আসন্ন হয় এই লৌহ-শৃঙ্খলের কবল থেকে–টুসি তাতেও রাজি এখন। বেশ প্রসন্নমনেই রাজি।
দেহের সমস্ত বল দিয়ে দুই পাহারাওয়ালার দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হয় তখন–কিন্তু দারুণ টানাটানিতেও বিন্দুমাত্রও ধসকানো যায় না টুসিকে। একচুলও এদিকে ওদিকে করতে পারে না ওরা।
দুজনের থমকে গিয়ে হাপাতে থাকে। টুসিও।
বড়ি জোরসে সাটল বা! ই-তো এইসা নিকলবে না! একজন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে!
অন্যজন কপালের ঘাম মোছে–লোহা তোড়না লগি। মিস্তির চাহি ভাইয়া!
অতঃপর দুজনের মধ্যে কি যেন পরামর্শ হয়। কানাকানি ফুরোলে দুজনেই ওরা মুখ ব্যাজার করে–ছোড় দে ভাইয়া! ই-চোরসে হামলোগোঁকা কাম নহি!
এই বলে—’স্থানত্যাগেন দুর্জনাৎ’ চাণক্যের এই নীতি-বাক্য মেনে নিয়ে সরে পড়ে তারা তৎক্ষণাৎ।
চোর তো ছেড়েই গেছে, এখন পুলিশেও ছেড়ে চলে গেল, তাহলে পরিত্রাণের ভরসা সেই এতক্ষণে বুঝতে পারে টুসি। কুকুর, পকেটমার, পাহারাওয়ালা একে-একে সবাই ওকে ছেড়ে গেল!
সকলের পরিত্যাক্ত হয়ে একা সে দাঁড়িয়ে থাকে নির্জ্জন পার্কের একধারে রেলিং-এর সঙ্গে একাকার হয়ে একটা আলোর দিকে তাকিয়ে–
বাতিটা দপদপ করছে তখন থেকেই—
তার দাদুও বোধহয়….
ভোর হয়ে আসে। দু-একজন করে লোক এসে দেখা দেয় পার্কে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক সব আসেন–খবরের কাগজ তাঁদের হাতে।
টুসি ঐ তটস্থ অবস্থাতেই নিজের ঘাড়ের ওপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। একজন ভদ্রলোক ব্যাপারটা দেখতে যান ইশারায় তিনি ডাকেন অপর সবাইকে।
ফিস ফিস করে আলোচনা শুরু হয় তাঁদের—
সেই ছেলেটিই না? যার নিরুদ্দেশের খবর বেরিয়েছে আজকের কাগজে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
এই যে লিখেছে–ছেলেটি শ্যামবর্ণ, দোহারা চেহারা, দোহারা বলিলে হয়তো কমিয়েই বলা হয় বরং বেশ হৃষ্টপুষ্টই বলিতে হইবে। যেমন হৃষ্ট, তেমনই পুষ্ট! অদ্য রাত্রি প্রায় দেড় ঘটিকার সময় ডাক্তার ডাকিবার অজুহাতে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া নিরুদ্দিষ্ট হইয়াছে। যদি কেহ উক্ত শ্রীমানকে দেখিতে পান দয়া করিয়া শ্ৰীমানের খোঁজ দেন, তাহা হইলে চিরকৃতজ্ঞ থাকিব। কোনোরকমে একবার ধরিতে পারিলে নগদ পাঁচশত পুরস্কার।
আরো এই যে, এখানেও আবার!-–টুসি ভাই! যেখানেই থাক, ফিরিয়া আইস। আর তোমাকে ডাক্তার ডাকিতে হইবে না। তোমার দাদু আর মৃত্যুশয্যায় নেই, এখন জীবন্ত-শয্যায়। সুতরাং আর কোন ভয় নেই তোমার। কতো টাকা চাই তোমার, লিখিও। লিখিলেই পাঠাইয়া দিব।
আবার এই যে-পুনশ্চ! প্রিয় টুসি, তুমি ফিরিয়া আসিলে ভারী খুশি হইব। এবার তোমার জন্মদিনে তোমাকে একটা টু সীটার কিনিয়া দিব। যেখানে যে- অবস্থায় থাকো, লিখিয়া জানাইও। মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইব। ইতি তোমার দাদু।
তাঁদের একজন খবর দিতে ছোটেন টুসির দাদুকে। বাকি সবাই টুসিকে ঘিরে আগলাতে থাকেন। কি জানি, যদি পালিয়ে যায় হঠাৎ! জেগে উঠেই টেনে দৌড় মারে যদি! হাওড়া গিয়ে ট্রেনে দৌড় মেরে হাওয়া হয়ে যায়। ওঁরা খুব সন্তর্পণেই ওকে ঘিরে দাঁড়ান, ঘুণাক্ষরেও শব্দ হয় না–নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও না!
একজন মন্তব্য করছিলেন–ঘুমোবার কায়দাটা দেখুন! শোবার জায়গাটিও বেছে নিয়েছে বেশ–ফাঁকা-মাঠে-খোলা হাওয়ায়-তোফা আরামে-মজা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোঁড়ার ফুর্তি দেখুন এককার?
অমনি আর সবাই তার মুখে চাপ দিয়েছে–চুপ! চুপ! করছেন কি? জেগে উঠবে যে! জেগে উঠলে পালাতে কতক্ষণ! আমরা কি তখন ধরতে পারবো দৌড়ে? ওর বাবার বাবাই পারেনি যেখানে…।
ধরা শক্ত বলেই ত পুরস্কার দিয়েছে ধরবার জন্যে-কোন রকমে একবার ধরিতে পারিলে–দেখছেন না?
টুসির দাদু এসে পড়েন ট্যাক্সিতে।
নাতিকে দেখে তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে। বলে–আমি মরছি কলিকের জ্বালায় আর উনি কিনা এখানে এসে মজা করে–আয়েস করে ঘুমোচ্ছেন!
এক থাপ্পড় কসিয়ে দেন তিনি টুসির গালে।
আহাহা! মারবেন না, মারবেন না! সবাই হাঁ হাঁ হাঁ করে ওঠেন।
না, মারব না! মারব না বইকি! মশাই, সেই দেড়টার সময় বেরিয়েছে ডাক্তার ডাকতে, দেড়টা গেল, দুটো গেল, আড়াইটা গেল, তিনটেও যায় যায়। পাত্তাই নেই বাবুর! কলিক উঠে গেল আমার মাথায়! জানেন মশাই, পঞ্চাশ টাকার ট্যাক্সিভাড়া বরবাদ গেছে একরাত্রে আমার? কলিক পেটে নিয়েই সেই রাত্রেই দৌড় কি দৌড়! এ-থানায়, সে-থানায় কোন থানাতেই নেই উনি! এ হাসপাতাল, ও-হাসপাতাল–কোথাও নেই হতাহত হয়ে! হাত-পা কেটে পড়ে থাকলেও ত বাঁচতুম! কিন্তু তাও নেই। কি বিপদ ভাবুন ত। কি করি! গেলুম তখন খবরের-কাগজের আপিসে। সেই রাত্রেই। রাত আর কোথায় তখন, ভোর চারটে! নাইট এডিটারের হাতে-পায়ে ধরে মেশিন থামিয়ে স্টপ প্রেস করে একমুঠো টাকা গচ্ছা দিয়ে তবে এই বিজ্ঞাপনটা ছাপিয়ে বের করেছি জানেন?
একখানা আনন্দবাজার পকেটের ভেতর থেকে টানাটানি করে বের করেন তিনি।
তবেই এই বিজ্ঞাপন বেরোয় আজকের কাগজে! আর আপনি বলছেন কিনা, মারবেন না! তিনি আরো বেশি অগ্নিশর্মা হন। মারবো না? তবে কি আদর করবো নাকি ওই বাঁদরকে?
চড়ের চাপটেই চটকা ভেঙে গেছল টুসির কিন্তু সবই ওর কেমন যেন গোল- মাল ঠেকছিল; মাথায় ঢুকছিল না কিছুই। কিন্তু এখন চোখের সামনেই স্বয়ং দাদু এবং তাঁর বিরাশী সিক্কার একত্র যোগাযোগ দেখে তার ফলাফল অচিরেই কতদূর মারাত্মক হতে পারে, মালুম করতে বিলম্ব হয় না টুসির।
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে যায় টুসি-লৌহ-বেষ্টনীর আলিঙ্গন পাশ থেকে মুক্ত হবার অন্তিম-প্রয়াসে!
আশ্চয্যি! শিকের বগল থেকে সে গলে আসে আপনার থেকেই–অনায়াসেই! চেষ্টা না করতেই একেবারে সুড়ুৎ করে চলে আসে! এক রাত্রেই চুপসে আধখানা হয়ে এসেছে বেচারা– কাজেই আলগা হয়ে বেরিয়ে আসতে দেরি হয় না তার!
আর, দাদুর ঘুষি টুসির কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই সে সরেছে। সরেছে উদ্দামগতিতে।
চোখের পলক পড়তে না পড়তে টুসি পার্কের অন্য পারে! রেলিং টপকাবার আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে, সন্নিহিত আরেকটা শিকের উন্মুক্ত আহ্বান উপেক্ষা করে, এমন কি আরেকটা ছেলেপিলের যাতায়াতের ফাঁসের প্রলোভন সংবরণ করেই টুসি এবার সদর-গেট দিয়েই বেরিয়ে গেছে সটান।
বেরিয়েই ছুট কি ছুট! ডাইনে না, বায়ে না, সোজা বামাপদবাবুর বাড়ির দিকে।
ওর দাদু এদিকে গজগজ করতে থাকেন-বাবু এখন বাড়ি গেলেন ত গেলেন। না গেলের ত ওঁরই একদিন কি আমারই একদিন।
একজন এগিয়ে গিয়ে বলতে সাহস করে–আপনার নাতি যে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল মশাই!
উনি গর্জ্জন করেন–নিরুদ্দেশ হয়ে গেল বলেই ত বেঁচে গেল এ-যাত্রা। নইলে কি আর আস্ত থাকত? দেখেছেন ত সেই চড়খানা? সেই নাতিবৃহৎ চড়? তার পরেও কি কোন নাতির-যতই সে বৃহৎ হোক না! উদ্দেশ পাওয়া যেত এতক্ষণ?
গুম হয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে বসেন তিনি।
ও মশাই, পুরস্কার?–পুরস্কার?
দু-চারজন দৌড়ায় ওঁর পেছনে–পেছনে। ছাড়বার মুখে ট্যাক্সিটা ভর-ভরর-ভরর ভরর-র র র র–ভরাট গলায় এক আওয়াজ ছাড়ে, আর সেই সাথে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে যায় ও দের মুখে।