দাদিমা – এস, এইচ, বার্টন
জানি ব্যাপারটা তোমার পছন্দ হবে না। তবু আমরা ওকে প্রত্যাখ্যান করতে পারব না।
সেসিলি ফ্রবিশার কথা বলতে বলতে তার স্বামীকে একখানা চিঠি এগিয়ে দিল। ওরা ওদের বিরাট এবং আরামদায়ক রান্নাঘরে নাশতার টেবিলে বসে কথা বলছে। ডাকপিয়নমাত্রই চিঠিটি দিয়ে গেল।
চিঠিটি তুমি নিজেই পড়ো, ফ্রেডেরিক, বলল ও। তাহলে বুঝতে পারবে বিষয়টি কত কঠিন। সুসান ব্লেকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কুড়ি বছরেরও বেশি। একসঙ্গে স্কুলে গিয়েছি। তার মেয়ে যদি আমাদের সঙ্গে এসে থাকতে চায়, মানা করি কীভাবে?
জানি সুসান তোমার প্রিয় বান্ধবী। ওকে আমিও পছন্দ করি। কিন্তু ওর স্বামীটাকে আমার পছন্দ নয়। খুবই বাজে লোক। ওকে আমি বিশ্বাস করি না। নাকেমুখে মিথ্যা কথা বলে।
ওকে আমিও দেখতে পারি না। বিশ্বাস করার তো প্রশ্নই নেই। কিন্তু টেরেন্স ব্লেক এখানে থাকতে আসছে না। সুসানও নয়। থাকতে আসছে ইসোবেল, ওদের মেয়ে। দয়া করে চিঠিটি পড়ো, ফ্রেডেরিক। তাহলেই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। এবং ওরা আসার ব্যাপারে আশা করি আমার সঙ্গে একমত হবে।
ফ্রেডেরিক ফ্রবিশার পড়তে শুরু করল সুসান ব্লেকের চিঠি। দীর্ঘপত্র হলেও সে বেশ মনোযোগেই পড়ল। সে তার স্ত্রীকে সাহায্য করতে চায়, যদি সম্ভব হয়।
সুসান পরিষ্কার ভাষায় তার সমস্যার কথা ব্যক্ত করেছে। তার স্বামী টেরেন্স কানাডায় একটি চাকরি পেয়েছে। ভালো বেতনের চাকরি। আর টাকাটা ওদের। দরকার। টেরেন্স ইতোমধ্যে কানাডা চলে গেছে। সুসান যত দ্রুত সম্ভব তার স্বামীর সঙ্গে যোগ দিতে চায়। কিন্তু ইসোবেল এখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। ওর বয়স মাত্র ষোলো। ওর মা চায় মেয়ে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত ইংল্যান্ডেই থাকুক। তারপর সে কানাডায় বাবা-মার কাছে চলে যাবে। সুসানের ইচ্ছে ইসোবেল তার স্কুলজীবন শেষ করার আগ পর্যন্ত ফ্রবিশার দম্পতির সঙ্গে থাকবে। সুসান এবং সেবিলের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। সুসান অত্যন্ত খুশি হবে যদি সেসিলি আগামী বছর দুই ইসোবেলকে তাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনার সুযোগ দেয়। সেসিলি রাজি না হলে সুসানের পক্ষে আর কানাডা যাওয়া সম্ভব হবে না। আর প্রকৃত বন্ধু বলতে সুসানের শুধু ফ্রবিশাররাই রয়েছে। ইসোবেলের দাদা দাদি মারা গেছেন। কাজেই ইসোবেলের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।
ফ্রেডেরিক ফ্রবিশার চিঠিটি ফিরিয়ে দিল তার স্ত্রীকে। ওর জন্য খারাপই লাগছে আমার, বলল সে।
আমারও, ফ্রেডেরিক। টেরেন্সের কাছে ওর যত দ্রুত সম্ভব চলে যাওয়া উচিত। টেরেন্স এই প্রথম একটা ভালো চাকরি পেয়েছে।
আর সুসান যদি টেরেন্সের কাছে না যায় টেরেন্স হয়তো তাহলে উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে বসবে। ও চাকরিটা হারাবে, বলে দিলাম। ওর ওপর কোনো ভরসা নেই। ওর বউও ওকে বিশ্বাস করে না।
সেজন্য সুসান দায়ী নয়, বলল সেসিলি। ওই লোকটাকে বিশ্বাস করলে সুসানই ঠকবে! রাগত গলায় বলল ফ্রেডেরিক। আমাদের কাছে এ বাড়িটি বিক্রির সময় সে খুব একটা সতোর পরিচয় দেয়নি।
সে দশ বছর আগের কথা, স্বামীকে মনে করিয়ে দিল সেসিলি। আর আমরা এখানে ভালোই আছি।
ফ্রেডেরিক হাসল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে। আমরা সবসময়ই ভালো ছিলাম, মাই ডিয়ার। আমরা যেকটি বাড়িতে ছিলাম কোথাও অসুখী ছিলাম না। এ বাড়িটি তো খুবই চমৎকার। কিন্তু টেরেন্স ব্লেক এ বাড়ি সম্পর্কে আমাদের কাছে একগাদা মিথ্যে বলে অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
হয়তো ওর মন খারাপ ছিল। হয়তো এ বাড়িটি সে বিক্রি করতেই চায়নি। এ বাড়িতে তার পরিবার বহু বছর থেকেছে। তার বাবা-মা-ইসোবেলের দাদা দাদি-এখানেই থাকতেন। ব্লেক পরিবার এ বাড়িতে একশো বছরের বেশি সময় ধরে বাস করেছে। কাজেই বাড়িটি সে বিক্রি করতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।
দোষটা তার। সংসারের প্রতি মনোযোগ ছিল না তার। বোকার মতো সমস্ত টাকা খরচ করে ফেলেছে। তাই বাধ্য হয়েছে এ বাড়ি বিক্রি করতে। এখানে থাকার এত সামর্থ্যই তার ছিল না।
সেসিলি চেয়ার ছাড়ল। স্বামীর কাছে এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল।
টেরেন্স প্রসঙ্গ বাদ দাও। তুমি ওর ব্যাপারে যা বলেছ ঠিকই বলেছ। কিন্তু সুসানকে আমরা কী বলব সেটা বলো?
এক মুহূর্ত নিশ্চুপ রইল ফ্রেডেরিক ফ্রবিশার। তারপর ধীরে ধীরে বলল, তোমাকে তো বললামই, সেসিলি। সুসানের জন্য আমার খারাপ লাগছে। ওর জন্য আমি কিছু করতে চাই।
তাহলে কি চিঠি লিখে ওকে বলে দেব ইসোবেলকে এখানে পাঠিয়ে দিতে?
ঘড়ি দেখল ফ্রেডেরিক। দেরি হয়ে গেল, বলল সে। আধঘণ্টা আগেই কাজে বসার কথা ছিল। ঘুরল তার স্ত্রীর দিকে।
তুমি চাও মেয়েটা এখানে আসুক, তাই না? জিজ্ঞেস করল সে।
মাথা ঝাঁকাল সেসিলি। হ্যাঁ, ফ্রেডেরিক। ইসোবেলকে দেখি না বহুদিন। মেয়েটি ভারি মিষ্টি ছিল। ও এলে মজাই হবে। শত হলেও ও আমাদের পারিবারিক বন্ধু।
হাসল ফ্রেড্রেরিক। তাহলে আজকেই চিঠি লিখে ফেলো, সেসিলি। ওকে আসতে বলে দাও। চেষ্টা করব ও যেন এখানে ভালো থাকে।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে পেছনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে। হলঘরে ওর পায়ের আওয়াজ পেল সেসিলি। তারপর লাইব্রেরি ঘরের দরজা খোলা এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ। ও ওর নতুন বই লিখতে শুরু করেছে। লাঞ্চের আগে আর ওই ঘর থেকে বেরুচ্ছে না।
আশা করি ইসোবেল এলে ওর কাজকর্মে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না, আপন মনে বলল সেসিলি। বাড়িটি অনেক বড়, আমাদের সবার জন্যই এখানে প্রচুর জায়গা রয়েছে।
মাসখানেক বাদে, ডিসেম্বরের এক রাতে সেসিলি ফ্রবিশার তাদের হলঘরে একা দাঁড়িয়েছিল। তার স্বামী গাড়ি নিয়ে গেছে রেলস্টেশনে ইসোবেলকে নিয়ে আসতে। হলঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলাল সেসিলি। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। ঘরের সবকটা বাতি জ্বালানো। ইসোবেলকে স্বাগত জানাতে এ ব্যবস্থা। সে দোতলায় গেল দেখতে মেয়েটির বেডরুম ঠিকঠাক সাজানো রয়েছে কিনা।
নিচতলায় আসার পরে হঠাৎ ওর কেমন অসুস্থ বোধ হতে লাগল। বুকের মধ্যে দপদপ করছে কলজে, মাথাটায় কেমন ব্যথা ব্যথা লাগছে। অগ্নিকুণ্ডের পাশে একটি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল সেসিলি।
সেসিলি ফ্রবিশার, নিজেকে বলল ও। তুমি একটা নির্বোধ মহিলা। তুমি নার্ভাস হয়ে আছ। নার্ভাস কারণ ষোড়শী একটি মেয়ে তোমাদের সঙ্গে থাকতে আসছে। কী বোকা তুমি! তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? তোমার একজন চমৎকার স্বামী আছে যে প্রচুর টাকা আয় করে। সে ভালো ভালো বই লেখে এবং হাজার হাজার পাঠক তা কেনে। তুমি একজন সুখী মানুষ। এখন চোখ বুজে ইসোবেল না আসা পর্যন্ত বিশ্রাম নাও।
আগুনের উত্তাপ এবং আরামদায়ক চেয়ারের নরম গদি একটু পরেই ওর চোখে ঘুম এনে দিল। ঘুমের মধ্যে ও একটা স্বপ্ন দেখল। সে হলঘর দেখতে পেল। দেখল চেয়ারে বসে ও ঘুমাচ্ছে। তারপর দেখল লাইব্রেরি ঘরের দরজা খুলে গেছে এবং এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এল ওই ঘর থেকে। মহিলার পরনে লম্বা, কালো একটি ড্রেস। মাথার চুল পেকে সাদা। সে হেঁটে এগোল হলঘরে। দাঁড়াল ফায়ারপ্লেসের সামনে। ঘুরল ঘুমন্ত মহিলাটি অর্থাৎ সেসিলির দিকে। সেসিলি বুঝতে পারল তার অদ্ভুত অতিথিটি এখন কথা বলবে।
না! আর্তনাদ করে উঠল সেসিলি। বোলো না! আমার সঙ্গে কথা বলো! আমি তোমার কথা শুনতে চাই না!
নিজের চিল্কারের শব্দে জেগে গেল সেসিলি। লাফ মেরে খাড়া হলো। হলঘর শূন্য। তারপর সদর দরজা খুলে গেল এবং একটি মেয়ের গলার স্বর ভেসে এল।
আমি রাস্তা চিনি। এখানে আমি একসময় থাকতাম, জানেনই তো। অন্ধকারেও এ বাড়ির আনাচেকানাচে আমি হেঁটে বেড়াতে পারব।
ফ্রেডেরিক এবং ইসোবেল এগিয়ে গেল সেসিলির দিকে। ফ্রেডেরিকের হাতে মেয়েটির সুটকেস। তার মুখ হাসি হাসি।
আমরা এসে গেছি, সেসিলি। ট্রেন আসতে অনেক দেরি হলো। আর বাইরেও ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে আজ। ইসোবেলকে ওর রুমে নিয়ে যাও। আমি ওর সুটকেস নিয়ে যাচ্ছি। তারপর একসঙ্গে ডিনার করব। বেশ খিদে পেয়েছে। ইসাবেলেরও নিশ্চয় খিদে লেগেছে।
ইসোবেল বেশ লম্বা, গায়ের রঙ তামাটে, রোগাপাতলা। চোখজোড়া উজ্জ্বল, ঝকঝকে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। বোধ করি উত্তেজিত।
মিসেস ফ্রবিশার, বলল সে। আমাকে আপনারা থাকতে দিচ্ছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। আমি আবার আমার বাড়িতে ফিরে এসেছি।
মেয়েটির বলার ভঙ্গি নম্র। জবাবে কিছু বলতে গিয়েও মুখে কোনো কথা জোগাল না সেসিলির। তার কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। নিজের বাড়িতেই অদ্ভুত লাগছে। বাড়িতে মেয়েটি মেহমান নাকি সে?
ইসোবেল হলঘরে একবার চোখ বুলাল। একদম বদলে গেছে সবকিছু। মন্তব্য করল সে। আপনি বাড়ির অনেক রদবদল ঘটিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমরা– সেসিলিকে কথা শেষ করতে দিল না ইসোবেল। হ্যাঁ, বাড়িতে অনেক আলো এবং উত্তাপ। আমরা যখন এ বাড়িতে থাকতাম তখন হলঘরে কোনো ফায়ারপ্লেস ছিল না। আমরা সেই খরচটা চালাতে পারিনি। আপনাদের অনেক টাকা পয়সা, না?
না, বলল সেসিলি-নরম গলায় বলার চেষ্টা করছে–না, ইসাবেল, আমাদের অনেক টাকা পয়সা নেই। আমা
আমার জন্য কোন ঘরটি রেখেছেন? আবারও সে সেসিলির কথায় বাধা দিল।
তুমি বড় বেডরুমটিতে থাকবে। ওখান থেকে বাগান দেখা যায়। ভাবলাম তোমার হয়তো ওই ঘরটাই পছন্দ–
হ্যাঁ, ধন্যবাদ। দোতলার সামনের দিকের ওই বেডরুমটিতেই আমি সবসময় থাকতাম। আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আমি ঘরটি চিনি।
সে দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। ফ্রেডেরিক হাতে সুটকেস নিয়ে মন্থর গতিতে গেল ওর পেছন পেছন। সেসিলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ওদের প্রস্থান।
ফ্রেডেরিক হলঘরে ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী ফায়ারপ্লেসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেসিলির কাছে এলে সে ঘুরে দাঁড়াল।
আমি একটা মস্ত ভুল করে ফেললাম, ফ্রেডেরিক।
ওহ্, এত তাড়াতাড়ি এ কথা কী করে বলছ তুমি? আমরা চুপচাপ, নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও নার্ভাস লাগছিল ফ্রেডেরিকের। তার গলার স্বর এমন নামানো যে স্বামীর কথা প্রায় শুনতেই পেল না সেসিলি।
এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। সেসিলি আগের মতো আর হতাশ বোধ করছে না। হয়তো ইসোবেলকে এ বাড়িতে এনে সে কোনো ভুল করেনি। ইসোবেল তেমন একটা ঝামেলা করছে না। সে সেসিলিকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। খাওয়ার সময় ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং ভদ্রতা বজায় রেখে। সে একটু আগে আগেই ঘুমাতে যায় এবং বেশিরভাগ সময় দোতলায় নিজের কামরাতেই থাকে। নিজের নতুন জীবন নিয়ে ওকে খুশিই মনে হচ্ছে।
আমার মনে হয় তুমি খুব একাকী বোধ করছ, একদিন রান্নাঘরে বসে ইসোবেলকে বলল সেসিলি। লাঞ্চ প্রায় রেডি। ছুটি শেষ হলেই তুমি নতুন স্কুলে যাবে এবং সেখানে সমবয়সী অনেক নতুন বন্ধুবান্ধব পাবে। এত বড় বাড়িতে তোমার এত কিশোরী মেয়ের একা একা লাগাটাই স্বাভাবিক।
একা! ইসোবেল হাসল সেসিলির দিকে তাকিয়ে। আমি একা নই, মিসেস ফ্রবিশার। এখানে একা থাকার কোনো অবকাশ নেই।
তোমার কথা শুনে খুশি হলাম, বলল সেসিলি। হয়তো ইসাবেল ওদেরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।
কিন্তু তোমার নিজের বয়সী বন্ধুবান্ধব দরকার। স্কুলে বন্ধু হলে তুমি তাদেরকে বাসায় দাওয়াত দিতে পারবে।
আমার সমবয়সী কোনো বন্ধুর দরকার নেই। আমার বন্ধু আমি পেয়ে গেছি।
বাহ্, চমৎকার। তবে তোমার বন্ধু হওয়ার জন্য আমার এবং ফ্রেডেরিকের বয়সটা একটু বেশিই–
আমি আপনাদের কথা বলিনি কিন্তু। তাহলে? কে?
সেসিলি তার কথা শেষ করার আগেই মেয়েটি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেল সেসিলি হলঘর থেকে যাওয়ার সময়।
.
সেই রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে ফ্রেডেরিক এবং সেসিলি হলঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে বসেছিল। ইসোবেল দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চুপচাপ। কথা বলতে চাইছে কিন্তু বলার মতো হয়তো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
অবশেষে সেসিলিই ভঙ্গ করল নীরবতা। নিচু গলায় কথা বলছে। স্বর উঁচু করতে যেন ভয় পাচ্ছে।
তোমার চেহারা এমন শুকনো লাগছে কেন, ফ্রেডেরিক? কী হয়েছে? নতুন বইটি ঠিকঠাক লেখা হচ্ছে না?
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল, সেসিলি। কথাটা হয়তো বোকার মতোই শোনাবে তবে সত্য হলো এই যে ইসোবেল আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকে আমি এক কলমও লিখতে পারছি না।
কিন্তু ও তো তোমাকে কোনো বিরক্ত করে না, করে কি? ও কোনো শব্দই করে না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেয়েটা বড্ড বেশি চুপচাপ।
না, না। ও আমাকে বিরক্ত করছে না। ব্যাপারটা ইসোবেলকে নিয়ে নয় থেমে গেল সে। চেহারা দেখে মনে হলো ভয় পেয়েছে।
বলো, ফ্রেডেরিক। প্লিজ, বলে ফেলল।
তুমি তো জানোই আমি একা একা লিখি। ঘর একদম নীরব না থাকলে আমি লিখতে পারি না। আমি আমার টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে যেতে পারি।
সে তো আমি জানিই। তোমার বিশাল লাইব্রেরি ঘরখানার তো কোনোরকম পরিবর্তন করা হয়নি। তুমি প্রতিদিন সকালে নাশতা সেরে ওখানে লিখতে যাও এবং লাঞ্চ পর্যন্ত টানা লেখো।
হ্যাঁ। তবে কয়েকদিন ধরে কিছু লিখতে পারছি না। আমি বারবার চেষ্টা করেছি লিখব বলে। কিন্তু এক কলমও এগোতে পারিনি। কারণ ওই ঘরে আমি একা নই!
তুমি একা নও! এ কথার মানে কী, ফ্রেডেরিক? তুমি লেখার সময় তো আমি ওই ঘরের ধারেকাছেও যাই না। ইসোবেলও না। যদি যায় তাহলে মানা করে দিও। তুমি বলতে না পারলে আমি ওকে বারণ করব।
না, না। ও আমার ঘরে কখনো যায় না। তবে আমি লেখার টেবিলে বসার পরে একটি গলা শুনতে পাই। নারীকণ্ঠ-বুড়ো মানুষের খনখনে গলা। সে যেন আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি তার কথা বুঝতে পারি না। ঘরটি তখন আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। মনে হয় এ ঘরটি আমার নয়। টেবিলটি আমার নয়। চেয়ারটি আমার নয়। লাইব্রেরির কোনো কিছুই আমার নয়।
ফ্রেডেরিক! থামো! সেসিলির গলা চড়ল-আমাকে তুমি ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। তোমার বিশ্রাম দরকার-ছুটি কাটানো প্রয়োজন। আমরা
থেমে গেল সে। একটা ছায়া পড়েছে মুখের ওপর। মুখ তুলে চাইল সেসিলি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ইসোবেল। তুমি কি চাও? আর এত নিশব্দে হাঁটাচলা করো কেন? ভয় রাগিয়ে তুলেছে সেসিলিকে।
আমি সবসময়ই নিশব্দে হাঁটাচলা করি, জবাব দিল মেয়েটি। হাসছে যেন ওর দিকে তাকিয়ে। আপনারা তো চান বাড়িটি সবসময় চুপচাপ থাকবে। আমি চেষ্টা করি আপনারা যাতে বিরক্ত না হন। আমার খুব তেষ্টা পেয়েছিল। তাই নিচে এসেছিলাম এক গ্লাস পানি খেতে।
তাহলে পানি খেয়ে নিজের রুমে চলে যাও।
জি, মিসেস বিশার।
একটু পরে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাতের গ্লাসটি টেবিলে রেখে ওদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
আপনাদের কেউই নিশ্চয় আমার দাদিমাকে দেখেননি, দেখেছেন?
আমি দেখিনি, জবাব দিল ফ্রেডেরিক। আমার স্ত্রীও দেখেছে বলে মনে হয় না। তোমরা যখন এ বাড়িতে থাকতে তখন আমরা এখানে আসিনি।
আমার ছোটবেলায় দাদিমা এ বাড়িতে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। তাঁকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমাকে তিনি অনেক গল্প বলতেন। পুরোনো দিনের গল্প। দাদিমা এখানেই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে আমার বাবা সমস্ত টাকা পয়সা খুইয়ে ফেলে। তারপর আপনারা আমাদের বাড়িটি কিনে নেন।
শুনে খুব খারাপ লাগল, ইসোবেল। তোমার জন্য আমাদের মায়াই হচ্ছে, তবে–
আমার জন্য মায়া করতে হবে না। আমি তো এখন ফিরেই এসেছি। দাদিমা আমাকে বলেছেন বাড়িটি আবার আমার হবে।
ইসোবেল ওদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল। তবে সবাই দু-এক মিনিট নিশ্চুপ থামল। শেষে সে বলল, আপনার লাইব্রেরি ঘরটি কি আমাকে একটু ব্যবহার করতে দেবেন, মি. ফ্রবিশার? ওটা ছিল আমার দাদিমার স্পেশাল রুম। আমি ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরটিতে ঢুকলে তিনি রেগে যেতেন। আমাকে তিনি চেয়ারে বসিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতেন। তবে আমি ওই ঘরে গেলেও আপনাকে কোনোরকম বিরক্ত করব না। আমি চুপচাপ থাকব। দাদিমা তখন আমাকে গল্প বলতেন আমি চুপচাপ শুনতাম।
তবে… আমার মনে হয় না… ফ্রেডেরিক তার বাক্য অসমাপ্ত রেখে দিল। আড়চোখে তাকাল স্ত্রীর দিকে। সেসিলি হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে মুখ ।
তবে এক্ষুনি আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে না। কাল সকালে বললেও হবে। আমি এখন ঘুমাতে যাব। ওহ্, বলতে ভুলে গেছি আমার কাছে দাদিমার একখানা ছবি আছে। নিচে নামার সময় নিয়ে এসেছি। এই যে দেখুন, মিসেস ফ্রবিশার।
সে সেসিলির হাতে ছবিটি খুঁজে দিল। ওটার দিকে তাকিয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল সেসিলির। ভয়ার্ত একটা চিৎকার বেরুল গলা চিরে। ছবির মানুষটিকে দেখেই চিনতে পেরেছে। এ বৃদ্ধাকেই সে স্বপ্নে দেখেছে।
.
সেই রাতে ফ্রবিশার দম্পতির কারোরই ঘুম হলো না। বিছানায় শুয়ে নিচু গলায় তারা কথা বলতে লাগল।
আমরা এখন কী করব, ফ্রেডেরিক? ওকে চলে যেতে বলব। ও আমাদেরকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। আমাদেরকে বাড়ি ছাড়া করবে।
আমাকে বাড়ি ছাড়া করতে পারবে না।
কিন্তু ও তো একা নয়। ওই ভয়ংকর মহিলাও রয়েছে এখানে। ইসোবেলকে সে সাহায্য করছে। ইসোবেল কী বলল মনে নেই? বলেছে ওর দাদিমা নাকি ওকে এ বাড়িটি দিয়ে দেবে। সে আমাদের কাছ থেকে বাড়িটি কেড়ে নেবে।
অসম্ভব। এটি আমাদের বাড়ি। আমরা এটি কিনেছি। আর বৃদ্ধা মহিলা এখানে কী করে আসবে? সে তো মারা গেছে।
তাহলে আমাকে ব্যাখ্যা করো লাইব্রেরি ঘরে কেন তোমার মনে হয় ওখানে তুমি একা নও, সঙ্গে কেউ আছে? কে আছে তোমার সঙ্গে ওই ঘরে? আমি কীভাবে ছবিটি দেখেই চিনে ফেললাম?
কিন্তু, সেসিলি—
চুপ! শোনো!
ওরা শুনতে পেল লাইব্রেরি ঘরের দরজা খুলে গেছে। তারপর আবার বন্ধ হয়ে গেল। হলঘরে মৃদু পায়ের শব্দ। পদশব্দ ওদের বেডরুমের দরজা পার হয়ে গেল। তারপর ইসাবেলের শোবার ঘরের দরজা খোলা এবং বন্ধের আওয়াজ হলো। দূরের অন্ধকার থেকে ভেসে এল মানুষের গলা।
সেসিলি খামচে ধরল তার স্বামীর হাত। আমাকে কালকেই কোথাও নিয়ে চলো, ফ্রেডেরিক। আমি ভয় পাচ্ছি।
আমরা কাল সকালেই কোথাও চলে যাব, সোনা। তবে ইসোবেলকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। ওকে একা বাড়িতে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না।
.
সকাল হতেই ওরা রেডি হতে লাগল। ফ্রেডেরিক সেসিলিকে বলল, একটা সুটকেস গুছিয়ে নাও। আমরা দিন দুই কোনো হোটেলে থাকব। আমি যাই। ইসোবেলকে ঘুম থেকে তুলি গে। তারপর চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব।
তবে সেসিলি রেডি হওয়ার আগেই ফিরে এল ফ্রেডেরিক। জলদি! বলল সে। সুটকেসটা নাও। ইসোবেল তার ঘরে নেই।
ঘরে নেই! তাহলে কোথায় গেছে?
লাইব্রেরি ঘর বন্ধ। তালা মারা। আমি ঢুকতে পারছি না। ইসোবেল ভেতরে আছে। কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।
সে সেসিলিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। ওকে একটা হোটেলে নিয়ে তুলল।
তুমি এখানে নিরাপদেই থাকবে। আমি আসছি এক্ষুনি।
তুমি কোথায় যাচ্ছ, ফ্রেডেরিক?
পুলিশের কাছে। তারপর বাড়ি ফিরব-যদি সত্যি ওটা এখনো আমাদের বাড়ি হয়ে থাকে।
.
জানালা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হবে আমাকে, বলল পুলিশ অফিসার। তালা ভাঙতে পারিনি। খুব শক্ত।
ফ্রেডেরিক শুধু পুলিশ নয়, সঙ্গে একজন ডাক্তারও নিয়ে এসেছে। তারা লাইব্রেরির সামনে অপেক্ষা করছিল। জানালার কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পেল তারা। তারপর চাবি ঘোরানোর শব্দ এবং খুলে গেল দরজা।
আপনি ভেতরে আসুন, ডাক্তার। না, আপনাকে আসতে হবে না, মি. ফ্রবিশার। ভেতরের দৃশ্যটি আপনার জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।
ফ্রেডেরিকের বুক ধড়ফড় করছে। লাইব্রেরিতে সে কিছু নড়ানোর শব্দ পেল। তারপর পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠ। একটি চেয়ার নড়ানোর আওয়াজ। ডাক্তার কী যেন বললেন। মিনিটগুলো ঘণ্টার মতো লাগছে।
আবার খুলে গেল লাইব্রেরির দরজা। বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। তিনি ফ্রেডেরিকের হাত ধরে ওকে হলঘরের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে একখানা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।
সে মারা গেছে, মি. ফ্রবিশার। লেখার বড় চেয়ারটিতে বসে আছে। ওর বয়স যেন কত বললেন?
ষোলো বছর, ডাক্তার।
ষোলো বছর! কিন্তু ওর চেহারায় যা ঘটেছে তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। তার সমস্ত চুল পেকে সাদা এবং মুখখানা হয়ে গেছে বুড়ি মানুষের মতো!