2 of 2

দাদামশায়ের বন্ধু – হিমানীশ গোস্বামী

দাদামশায়ের বন্ধু – হিমানীশ গোস্বামী

মামাবাড়ি থেকে চিঠি এল—মেজোমামা আসছেন, আমরা যেন অন্তত সাতদিনের জন্য কালকেপুর যাই। আসল নাম কালিকাপুর কিন্তু সকলেই বলত কালকেপুর! কালকেপুর—অর্থাৎ কিনা আমাদের মামাবাড়ির গ্রাম। ছোটো নদী চন্দনা, তার ধারে চমৎকার ছোটো গ্রামটি। আমাদের রতনদিয়া গ্রাম থেকে কালকেপুর গ্রাম কিন্তু খুবই কাছে। হাঁটা পথে সাড়ে তিন মাইল। আমরা হেঁটেই যেতাম—নইলে ট্রেনও ছিল, আবার ওই চন্দনা নদী দিয়ে নৌকায় চড়েও যাওয়া যেত। মেজোমামা থাকেন কটকে, বছরে শীতকালে একবার আসেন—সঙ্গে নিয়ে আসেন অজস্র গল্প, তাঁর বন্দুক এবং প্রচুর গুলি। আরও আনেন কলকাতার সেরা সেরা সব বড়োদিনের খাবার—কেক, পেসট্রি—এইসব। তা ছাড়া বাড়িতেই কতরকম মাছ পাওয়া যেত, নদী থেকে ধরা টাটকা মাছের রাশি। অনেক সময় অত মাছ খেতে খেতে অরুচি ধরে যেত। এরপরও রোজ নতুন পিঠে তৈরি হত—সরা পিঠে, বকুল পিঠে, চন্দ্রকাঠ—তার ওপর মেজোমামার শিকার করে আনা পাখির মাংস। জলে—চরা পাখি ছোটো স্নাইপ থেকে শুরু করে বড়ো পাখি গগনভেরী। চল্লিশ বছর আগে দেশে এখনকার মতো জঙ্গল কমে যায়নি—পাখি তো ছিলই প্রচুর, তা ছাড়া আমাদের গ্রামের আশেপাশে বাঘও এসে পড়ত শীতকালে কখনোসখনো।

কিন্তু মামাবাড়ির চিঠি পড়ে আমরা সেবার যতখানি উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলাম ততখানি না হলেও চলত। সেবার সবই কেমন যেন উলটোপালটা ঘটে গেল, অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। এখনও সবটা যেন ঠিকমতো বিশ্বাস হয় না। এটাও ঠিক—সব কথা গুছিয়ে বলতেও পারি না। অনেকদিন আগে যা ঘটেছে তার সবটা মনে নেই—আবার যে সব ঘটনা ঘটেনি—কেউ কেউ সে কথা বলায় সেগুলো যেন ঘটেছিল বলেই মনে হয়। যাই হোক, আমরা একটা কথা আগেই জানতাম, সেটা হল দাদামশাই সেই যে পুজোর পর দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তারপর থেকে দু—মাসের উপর হয়ে গেল তিনি ফেরেননি। প্রথম সপ্তাহে তাঁর দুটো চিঠি এসেছিল। একটা এসেছিল বেনারস থেকে। তিনি লিখেছিলেন—জায়গা যত ভালো বলে লোকে বলে তত ভালো নয়, তবে এত ভালো বেগুন তিনি কখনো দেখেননি। তারপর এক পাতা ধরে ওই বেগুনের বর্ণনা ছিল। এর পরের চিঠি এসেছিল কাশ্মীর থেকে। তিনি লিখেছিলেন—চমৎকার জায়গা, তবে বেগুনের অভাব খুব বোধ করছেন। তারপর বেগুন না থাকায় তাঁর কীরকম কষ্ট হচ্ছে, সেটা জানিয়েছিলেন দু—পাতা ধরে। ওই চিঠির শেষে লিখেছিলেন, এবার যাওয়ার সময় বেনারস থেকে দু—ঝুড়ি বেগুন আর এক প্যাকেট বীচি নিয়ে যাব।

ব্যস, তারপর দু—মাস আর খবর নেই। তারপরও বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। বাড়ির লোকেরা সাধারণত দাদামশায়ের জন্য চিন্তা তেমন করে না। খেয়ালি মানুষ—কোথাও হয়তো কিছু শিখছেন। হয়তো রাজস্থানে বসে হাতির দাঁতের কাজ শিখছেন, কিংবা মোরাদাবাদে পেতলের কাজ। একবার তো মাদ্রাজে গিয়ে ছবি আঁকা শিখে এসেছিলেন তিনি। তা ছাড়া, শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবিতা লেখা শেখা যায় কিনা তা জানতে চেয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। সে চিঠির উত্তর এসেছিল কিনা—তা আমরা জানি না। বোধহয় আসেনি, এলে নিশ্চয় আমরা জানতে পারতাম। যাই হোক বাড়ির লোকেরা যখন দুশ্চিন্তা শুরু করেছে এমন সময় একটা চিঠি এল তাঁর কাছ থেকে, তাতে তিনি জানিয়েছেন তাঁর আসার তারিখ। বেনারস থেকে তিনি লিখেছেন—এখানে বেগুনের জন্য এসেছিলাম, কিন্তু বেগুন কেনা সম্ভব হয়নি। হরিদাস বেগুন খায় না। বেগুনের নাম শুনলে তেলে—বেগুনে জ্বলে ওঠে। তা ছাড়া, কেবল খায় না তা নয়, বেগুনের গন্ধ পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। তারপর যেন নেহাত না লিখলেই নয় এমনভাবে লিখেছেন, হরিদাস আমার বন্ধু। হরিদাস সাধু। ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল আসামে—বছর পনেরো আগে। সে আমার সঙ্গে যাবে—এখন থেকে সে কালকেপুরেই থাকবে। ওর জন্য রোজ এক সের করে মাছ লাগবে—যেকোনো ধরনের মাছ হলেই চলবে। ছোটো কাঁচা মাছই ওর পছন্দ।

তারপর লিখেছেন, স্টেশনে যেন জনা দশেক লোক থাকে—আমার সঙ্গে একটা কাঠের বড়ো বাক্স থাকবে।

ঠিক সেই তারিখের আগের দিনই আমরা কালকেপুর পৌঁছলাম। দেখলাম মেজোমামা এসেছেন, খাবারদাবারও প্রচুর—কিন্তু বাড়িতে তেমন আনন্দের আবহাওয়াটাই নেই। মেজোমামা বাইরের ঘরে বসে চমৎকার গন্ধওয়ালা তেল দিয়ে বন্দুক পরিষ্কার করছেন দেখলাম। আমাদের দেখে বললেন,—আয় আয়, বোস। তারপর দু—মিনিট চুপচাপ থাকার পর বললেন, —যা ভেতরে যা। ভেতরে গিয়েও দেখি, বাড়ির মধ্যে কেমন যেন একটা অশান্ত ভাব। ছোটোমামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ির সবাই এমন গম্ভীর হয়ে রয়েছে কেন রে? ছোটোমামা বলল, মন্দিরের ওখানে গিয়ে বলব, এখানে নয়। ছোটোমামা মন্দিরের সিঁড়িতে বসে সব কথা বলল। সেই চিঠির কথা পর্যন্ত বলে চুপ করল। আমি বললাম,—তাতে আর কী হয়েছে, জন দশেক লোক নিয়ে স্টেশনে গেলেই চুকে যায়। তখন ছোটোমামা যা বলল তাতে আমার একেবারে মাথা ঘুরে উঠল। ছোটোমামা বলল, চিঠিটায় একটা খটকা আছে বুঝতে পেরেছিস?

—খটকা?—আমি প্রশ্ন করলাম।

ছোটোমামা বলল,—চিঠিটা পড়ে তোর কোনোরকম অস্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়নি?

আমি বললাম, কই না তো? দাদু বন্ধু নিয়ে আসছেন। এটার মধ্যে খটকা কিছু তো লাগছে না। তবে একটা বড়ো বাক্স আনছেন দাদু, সেটাতে একটু খটকা লাগছে!

—ঠিক ধরেছিস। আর কিছু?

—আরও খটকা লাগার কিছু আছে নাকি ওতে?

—তুই একটা বোকা। —ছোটোমামা বলল।

—না আমি বোকা নই। —আমি দৃঢ়ভাবে বললাম,—আমি বোকা হব কেন? এবারে অঙ্কে একশো—র মধ্যে তো আশির ওপরে পেয়েছি, বাংলায় পেয়েছি সত্তরের কাছাকাছি—সেও একশো—র মধ্যে।

ছোটোমামা বলল,—আরে সে কথা নয়। ওই চিঠির মধ্যে আরও একটা মুশকিলের ব্যাপার আছে—তোর মাথায় ঢুকছে না তো? আচ্ছা, তাহলে বলেই দিই। ওই যে চিঠিতে আছে না, বাবার বন্ধু মাছ খাবেন রোজ এক সের করে?

আমি বললাম,—তা মাছ কি এমন খারাপ বস্তু কিছু? আর এক সের মাছ আমিও খেতে পারি।

ছোটোমামা বলল,—কাঁচা?

আমার তখন ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল। তাই তো—দাদুর বন্ধুর জন্য কাঁচা মাছ লাগবে, রোজ এক সের করে! হ্যাঁ, তাই কথাটা দুশ্চিন্তারই বটে। দাদুর বন্ধু হরিদাস সাধু। তিনি খাবেন কাঁচা মাছ। ভাবনারই বটে!

কিন্তু তারপর ছোটোমামা যা বলল, তাতে আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল, হাত—পা জমে গেল ভয়ে।

ছোটোমামা বলল,—বাবার বন্ধু হরিদাস কাকা গত মাসে মারা গেছেন বেনারসে জলে ডুবে।

—অ্যাঁ!—আমার আর কথা সরে না। ওই অ্যাঁ বলেই চুপ মেরে যাই। তারপর অনেকক্ষণ—অনেকক্ষণ পর আমার মুখ দিয়ে মাত্র একটা বাক্য বেরোয়,—সর্বনাশ!

—ঠিক তাই।—ছোটোমামা বলল,—দারুণ সর্বনাশ। বাবার বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। তাঁর ছবিও ছাপা হয়েছিল। বড়ো সরকারি চাকরি করতেন তিনি আবগারি বিভাগে। বদলির চাকরি—কখনো থাকতেন হুগলি, কখনো বা বিহারের পূর্ণিয়ায়, কখনো বা নাসিকে। বিরাট চেহারা ছিল তাঁর। ছ—ফুটের ওপর লম্বা ছিলেন, আর বেশ মোটাও। ভীমের মতো গোঁফও ছিল।

আমার ভয় করছে রে ছোটোমামা!—আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম।

—তোর দোষ কি! বড়দা পর্যন্ত ভাবছে, সকলে মিলে বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়। তবে মেজদা বলছে—অনেক বাঘ ভালুক শিকার করেছি, এবারে একটা ভূতকে অন্তত দুটো বুলেট মেরে দেখব ফলাফল কেমন দাঁড়ায়। বাড়ির আর সবাই সর্বদাই ঠকঠক করে কাঁপছে।

আমি বললাম,—তা শীত পড়েছে বটে খুব। কাঁপতে আমারও ইচ্ছে হচ্ছে রে ছোটোমামা!

ছোটোমামা বলল,—শীতে, না ভয়ে?

আমি বললাম,—কী?

ছোটোমামা বলল,—সহজ প্রশ্ন! ভয়ে কাঁপতে ইচ্ছে করছে, না শীতে?

আমি বললাম—শীতে। শীতেই কাঁপতে ইচ্ছে করছে।—তারপর একটু থেমে বললাম, —না, ভয়েই কাঁপতে ইচ্ছে করছে। তবে, বলতে ইচ্ছে করছে শীতে কাঁপতে ইচ্ছে করছে।

ছোটোমামা বলল,—ব্যাপার খুব সাংঘাতিক। মেজদার দৃঢ় বিশ্বাস, হরিদাস কাকার জলে ডুবে একেবারে সরাসরি গঙ্গাপ্রাপ্তি হলেও তাঁর আত্মা অতৃপ্ত থেকে গেছে, সদগতি হয়নি। অর্থাৎ কিনা তাঁর বাড়ির কেউ বোধহয় ঠিকমতো শ্রাদ্ধশান্তি করেনি—বা গয়ায় পিণ্ডি দেয়নি।

আমি বললাম,—হ্যাঁ রে ছোটোমামা, গয়ায় পিণ্ডি দিলে কী হয়? ছোটোমামা উদাসভাবে বলল,—কিছু পৈতেধারী অসংস্কৃত—মনস্ক ব্যক্তির মুনাফা হয়। আর কী হবে?

আমি বললাম,—কথাটার মানে বুঝিয়ে বলবি একটু?

ছোটোমামা বলল,—লোক মারা গেলে তার আত্মা অশান্ত হয়। পৃথিবীর মায়া কাটাতে না পেরে পৃথিবীর হাওয়ায় থেকে যায়, আর তার পুরোনো পরিবেশে ফিরে ফিরে আসে।

মানে ভয় দেখায়?

ছোটোমামা বলল,—কে বলল ভয় দেখায়? অশান্ত আত্মা অশান্তিতে ভোগে, ছটফট করে, হয়তো দু—একটা কাচের গেলাস ভাঙে, বা বই ছোড়ে। কিন্তু কাউকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে করে বলে কেউ কোনো প্রমাণ এ যাবৎ দেখাতে পারেনি।

আমি বললাম,—এত সব কথা তুই জানলি কেমন করে?

ছোটোমামা বলল,—আমি রাঙাদার কাছে শুনেছি। রাঙাদা তো কলকাতার কলেজে পড়ে, সে অনেক কিছু জানে।

আমি বললাম, শোন ছোটোমামা, আজ বিকেল বেলায় আমরা দুজনে সোজা চলে যাই রতনদিয়া। সাড়ে তিন মাইল পথ, ঘণ্টা দেড়েক হাঁটলেই পৌঁছে যাব।

—কেন?

আমি বললাম,—কী হবে ঝামেলার মধ্যে থেকে। ভূতুড়ে কাণ্ড আমার একেবারেই বরদাস্ত হয় না।

ছোটোমামা এ কথায় বলল, তুই একটা কাপুরুষ।

আমি বললাম,—ঠিক বলেছিস। আমি কাপুরুষ। তুই না যাস, আমি একাই যাব।

ছোটোমামা বলল,—এতবড়ো একটা অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ ছেড়ে দিবি?

আমি ম্লান হাসলাম।

ছোটোমামা বলল,—তুই সেবার বললি না, আফ্রিকায় গিয়ে হাতি গন্ডার শিকার করবি?

আমি বললাম, নিশ্চয়—আফ্রিকায় গিয়ে আমি হাতি গন্ডার শিকার তো করবই। কিন্তু ভূত? না বাবা, ওতে আমাকে পাবে না।

ছোটোমামা বলল,—ঠিক আছে, তুই চলে যা। তারপর আমরা যখন হরিদাস কাকার সঙ্গে কথা বলব, পরকালের কথা জেনে নেব, তখন বলিস না—ইস, ইস তোরা লাকি! জানিস তো, হরিদাস কাকা গল্প বলেন চমৎকার!

—কিন্তু ভূত তো উনি। যখন বেঁচে ছিলেন তখন হয়তো চমৎকার গল্প বলতেন, কিন্তু এখন ভূত হয়ে কীরকম গল্প বলবেন কে জানে?

ছোটোমামা বলল,—আমার মনে হয় তিনি বলবেন অদ্ভুত গল্প! বলে ছোটোমামা হি হি করে হাসতে লাগল। আর আমার গায়ে কীরকম শিহরণ খেলে গেল। এরপর হয়তো কাঁপতে শুরু করতাম প্রবল বেগে, কিন্তু ঠিক সেই সময় বড়োমামার ডাক শুনতে পেলাম— ওরে তোরা খাবি আয়, কোথায় গেলি?

চানও করা হয়নি। অন্য কোনোদিন হলে চান না করলে মামাবাড়িতে খাওয়া শক্ত ছিল। কিন্তু সেদিন কেউ খেয়ালই করল না।

খাওয়াটাও একেবারে নমো নমো করে সারা হল। বড়ো বড়ো গলদা চিংড়ির মালাই, সরু চালের ঘি—ভাত আর পুকুর থেকে ধরা বড়ো বড়ো কই মাছের সরষের বাটা দেওয়া ঝোল থাকলেও, মনটা কীরকম উদাস হয়েই রইল। খাওয়ার দিকে নজরই দিতে পারলাম না।

তারপর রাত্রেও ঘুম এল না। আমি আর ছোটোমামা এক খাটে শুয়েছিলাম লেপ গায়ে দিয়ে। সে রাত্তিরটা ছিল খুবই ঠান্ডা। অথচ কয়েক মিনিট পরেই মনে হল খুব যেন গরম লাগছে, আর গা—টাও ঘেমে যাচ্ছে। মনটাকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছি না। বিকেলবেলা বাড়িতে চলে গেলেই আজ ভালো হত—কিন্তু একা ফিরবার কথা ভাবতেই কীরকম ভয় করছিল আমার। আর ছোটোমামাও এমন দুষ্টু যে, সে আমার সঙ্গে যেতেই রাজি হল না। সে বলল,—ভীরু, তুই একাই যা—না। —বলে কীরকম ইয়ারকির ভঙ্গিতে হেসেছিল। অথচ এটাও তো ঠিক যে ছোটোমামাও দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল! কিন্তু সে দুষ্টুমি করে, বোধহয় আমার ভয় পাওয়া দেখে মজা পাওয়ার জন্যই, আমার সঙ্গে গেল না।

পরদিন ট্রেন রাত দশটায়। আমরা একদল গিয়েছি পাংশা স্টেশনে। যদিও আমাদের স্টেশনে যাওয়ার ব্যাপারে পই পই করে বারণ করা হয়েছিল। আর ভয় পেলেও, আমিও কৌতূহলের জন্যই গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম।

স্টেশনে ট্রেন ঠিক সময়ে থামতেই দাদামশাই নেমে পড়লেন ট্রেন থেকে। তারপর ছুটতে লাগলেন ট্রেনের শেষ দিকে। সেখানে একটা মালগাড়ি থেকে নামানো হল বিরাট একটা কাঠের বাক্স। সঙ্গে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। দাদামশাই বললেন,—এই বাক্সটা যেন যত্ন করে নিয়ে যাওয়া হয়।

অবশ্য নিয়ে যাওয়ার কোনো ভাবনা ছিল না, কেননা বড়োমামা এবং মেজোমামা দশজন লোক এ জন্য সংগ্রহ করেই রেখেছিলেন। তারা বড়ো কয়েকটা বাঁশ এনেছিল সঙ্গে। সেই বাঁশগুলি পাশাপাশি আর কয়েকটা ছোটো বাঁশ আড়াআড়ি রেখে, দড়ি দিয়ে ভালো করে বাঁধতেই সেটা বেশ শক্ত মাচার মতো হল, তার ওপর সকলে মিলে ধরাধরি করে বাক্সটিকে বসানো হল। ওই বাক্সটিকে আনার জন্য যাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তারা তো আর জানে না ওই বাক্সে কী আছে, তারা জানলে আর তাদের দিয়ে ওই বাক্স টানানো যেত না। যাই হোক, বাক্স নিয়ে আমরা নির্বিঘ্নেই রওনা দিলাম। কেবল দেখলাম, মেজোমামা বন্দুকে গুলি ভরা আছে কিনা দেখে নিল। আর বড়ো মামা দাদামশাই—এর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে কী বলল, সেটা ভালো করে বোঝা গেল না অবশ্য। তারপর আমরা প্রায় জনা কুড়ি লোক বাড়ির দিকে রওনা হলাম। দুজন দুটো লণ্ঠন নিয়ে সামনে সামনে চলল পথ দেখিয়ে। তারপর বাক্সটিকে বাঁশের মাচার ওপর রাখা—সেই অবস্থায় জনা দশেক বয়ে নিয়ে চলেছে, যেন বিসর্জনের জন্য প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাক্সের কাছেই দাদামশাই রয়েছেন। তার পেছনে আবার দুজনের হাতে লণ্ঠন। মেজোমামা বন্দুক হাতে চলেছে লণ্ঠনধারীদের ঠিক পেছন পেছন, আর বাকিরা সব পেছন পেছন চলেছি। কেবল আমার হাতে রয়েছে একটা বড়ো টর্চ, সেটা আমাকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু জ্বালাবার জন্য নয়, কেবল বইবার জন্যে।

রাত্তিরটা বেশ অন্ধকার। অমাবস্যাই মনে হয়। তবে পরিষ্কার আকাশ। তা থেকে কোটি কোটি নক্ষত্রের ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে। তাতে সবটা একেবারে অন্ধকার ঢেকে যায়নি। শীত। মনে উত্তেজনা। আমরা ব্যাপারটা জানি বলে ভয় ভয় করছে। ঠান্ডায় আর ভয়ে কাঁপছি। মিনিট কয়েক এইভাবে চলেছি। হঠাৎ সামনে দাদামশাই—এর আওয়াজ পেলাম,—কই, সঙ্গে মাছ—টাছ আনিসনি কিছু?

—মাছ?—বড়োমামা বললেন,—মাছ আনব কেন?

দাদামশায় বললেন,—হরিদাসের খিদে পেয়েছে। এখুনি মাছ দরকার!

যারা কাঠের বাক্সটা বইছিল তারা এ কথায় কেমন হকচকিয়ে গেল। তা ছাড়া হরিদাসকাকার কথাও হয়তো তাদের কানে গিয়েছিল। তারা বাক্সটিকে মাটিতে নামিয়ে বলল,—এর মধ্যে কী আছে? আর আপনি কার সঙ্গে কথা কইছেন? বাক্সটা এত ভারী বা কেন? ভেতরে কে আছে?

বুঝলাম, বেয়ারাদের মনেও সন্দেহ এবং ভয় দুই—ই ঢুকেছে।

দাদামশাই বললেন,—ও কিছু না। তোরা চল, তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালা।

লোকেরা বেশ ভয়ে ভয়েই আবার চলতে শুরু করল। কিন্তু এক মিনিট যেতে না যেতেই তারা আবার বাক্স নামিয়ে বলল,—উঃ কী ভারী! ক্রমশই যেন বাক্সটা বেশি ভারী হয়ে উঠেছে!

মেজোমামা বলল, ওটা কেবল তোদের মনের ভুল। ক্লান্ত হয়ে পড়ছিস কিনা, তাই আরও ভারী ঠেকছে। নে তোল, তাড়াতাড়ি পা চালা।

আবার তারা বাক্সটিকে নিয়ে চলতে শুরু করল। কিন্তু এবারে কয়েক সেকেন্ড চলতেই তারা বাক্সটিকে আবার নামিয়ে ফেলল।

দাদামশাই চুপি চুপি মেজোমামাকে বললেন,—মাছ। একটু কাঁচা পেলেই ঠিক হয়ে যেত। এই এক মুশকিল এদের নিয়ে, যত খিদে পাবে তত তাদের ওজন বাড়বে। কিছু মাছ আমার সঙ্গে আনা উচিত ছিল। ট্রেন লেট করল, নইলে এতক্ষণ বাড়িতেই পৌঁছে যেতাম।

এরপর আর বেয়ারারা বাক্সটিকে অনেক চেষ্টা করেও তুলতে পারল না। দাদামশাই বললেন,—একটু মাছ কেউ জোগাড় করতে পার না তোমরা? কাঁচা মাছ?

বেয়ারারা কিন্তু ইতিমধ্যে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, একটা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার চলছে যা তাদের মাথায় ঢুকছে না ঠিকমতো। আবার এই অস্বাভাবিক অবস্থা, কাঁচা মাছের খোঁজ—দাদামশায়ের বাক্সের সঙ্গে কথাবার্তা বলায়, ওরা যেন কিছু আঁচও করছে।

তারা বুঝতে পারছে, তারা যে মাল বহন করে নিয়ে চলেছে তাতে নির্জীব কেউ নেই, আবার এটাও বুঝতে পারছে, তার মধ্যে সজীবও কারুর থাকার কথা নয়। বাক্স কখনো এত ভারী হয়? বিশেষ করে যে বাক্স তারা কয়েক মিনিট আগেই অনায়াসে বয়ে আনতে পারছিল, সে বাক্স হঠাৎ এমন আচমকা ভারী হয় কেমন করে?

বেয়ারাদের যে প্রধান, সে বলল,—বাবু আমাদের রেহাই দিন। এ মাল বইবার সাধ্যি আমাদের নেই।

দাদামশাই হুংকার দিয়ে বললেন—তোদের গায়ে জোর নেই,—অ্যাঁ, একদম জোর নেই? দাঁড়া, আমি তোদের সঙ্গে কাঁধ দিচ্ছি, আয় ধর সব।

সকলে মিলে চেষ্টা করল আবার। মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি মাত্র উঠল বাক্সটা—কিন্তু তারপরই ফেলে দিতে হল। একজন বেয়ারা বলল,—উই বাপ! এর মধ্যে লুহার হাতি ঢুকছে!—লুহার হাতি ঢুকছে! অর্থাৎ কিনা লোহার হাতি ঢুকেছে। কথাটা শুনে ভয়ের মধ্যেও আমাদের কীরকম হাসি পেয়ে গেল।

মেজোমামা বলল, এবারে সকলে মিলে চেষ্টা করা যাক। তখন বেয়ারা দশ জন ছাড়াও, বাকি সবাই চেষ্টা করলাম ওঠাতে। এবারে অবশ্য ওঠানো গেল এবং আমরা এবারে খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলাম। এবার যেন আমরা উড়ে চলেছি, মুহূর্তে পার হয়ে যাচ্ছি অনেকটা পথ। এইভাবে বোধহয় দু—মিনিট কিংবা তিন মিনিট গেল—এবারে এসে পড়লাম চন্দনা নদীর কাছে। আর বেশিদূর নয়। চন্দনা নদী পার হলেই আমাদের গন্তব্য স্থান।

নদীর ধারে আমরা বাক্সটিকে নামালাম। রেল—ব্রিজের ওপর দিয়ে নদী পার হব—এ নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ মাচার ওপরকার বাক্সটা গড়াতে লাগল নিজে নিজেই! আর সেটা প্রচণ্ড আওয়াজ করে গিয়ে পড়ল চন্দনা নদীর জলে। আবছা অন্ধকারেও জলোচ্ছ্বাস দেখা আর একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেল বাক্সটা। আমি টর্চটা জ্বেলে দেখলাম, বাক্সটির চিহ্ন মাত্রও দেখা যাচ্ছে না। একেবারেই জলে তলিয়ে গেল?

কিন্তু আমরা দেখলাম, যে মাচার ওপর বাক্সটা রাখা ছিল সে মাচাটা বেশ শক্ত সমতল জমির ওপর রয়েছে। আরও একটা জিনিস দেখে আমরা অবাক হলাম, সেটা হল মাচার সঙ্গে যে দড়ি দিয়ে বাক্সটা বাঁধা ছিল, সে দড়িটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে রয়েছে—যেন একটা প্রকাণ্ড শক্তিশালী রাক্ষস তার ধারালো দাঁত দিয়ে দড়ি কেটে রেখেছে।

দাদামশাই দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তারপর অনেকক্ষণ পর বললেন,—হরিদাসটা বড়োই অধৈর্য! বোধহয় নদীতে মাছ দেখে তার আর তর সয়নি! যাক, কী আর করা যাবে? সব বাড়ি চল, কাল এসে খুঁজেটুজে দেখা যাবে বাক্সটা।

সে রাত্তিরে আমরা বাড়িতে ফিরলাম বটে, কিন্তু সমস্ত রাত একেবারেই ঘুম এল না। পরদিন ভোর হতে না হতেই আমরা সব নদীর ধারে গেলাম। দাদামশাই দু—চারজন পাকা সাঁতারুকে জলে নামালেন ওই ঠান্ডার মধ্যেই, কিন্তু তারা অনেক খুঁজেও বাক্সটাকে পেল না।

বড়োমামা বলল,—বাঁচা গেল।

মেজোমামা বলল, —বাঁচা গেল।

আর আমরা? আমরাও সকলে তাই বললাম।

কিন্তু দাদামশাই বললেন,—মাছের লোভে হরিদাস জলে ডুবে ম’লো।

কিন্তু তা কি সম্ভব? হরিদাস তো আগেই মারা গেছে। কেউ কেউ কি দ্বিতীয়বার মরে? আর যদি বাক্সে হরিদাসের ভূতই ছিল, তাহলে ভূতের আবার মৃত্যু কি সম্ভব?

কে জানে! তবে আমরা এরপর আর চন্দনা নদীতে চান করতে যাইনি। যদি,—মানে, ধর হরিদাসকাকা যদি—যাক সব কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না, আশা করি তোমরা বুঝতে পেরেছ কী বলতে চাই? এ গল্প এতদিন বলিনি কেন, সেটা আমাকে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এতদিন কথাটা মনে করতেই ভয় হত। তবে সেদিন ছোটোমামার সঙ্গে দেখা—এখন ছোটোমামারও আমার মতোই অনেক বয়েস। ছোটোমামাকে বললাম,—এখনও ওই কথা মনে পড়লে ভয় হয়।

ছোটোমামা বলল,—আর ভয় নেই রে! কতদিন হয়ে গেল না? তারপর জায়গাটা তো আর ভারতবর্ষে নেই, কবে পাকিস্তান হয়ে গিয়েছে, তারপর হল বাংলাদেশ। হরিদাসকাকাকে আসতে হলে চেক—পোস্ট পার হয়ে আসতে হবে না? সে বড়ো হাঙ্গামা। তা ছাড়া, উনি ঠিকানাও জানেন না তো!

ছোটোমামার ওই ভরসা পেয়েই আমি আজ লিখতে পারলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *