দাগ

দাগ

ছেলেটা উঠে যাবার পরেও পা দুটো ফাঁক করে অনেক্ষণ আচ্ছন্নের মতন শুয়ে থাকে কুন্তী, কুন্তী দুসাদ। মনে হচ্ছিল ওর সারা শরীরে রোড রোলার চালিয়ে গেছে কেউ। থাই দুটো জমে পাথর। না তাকিয়েও মানসচক্ষে বুকে আর থাইয়ের ওপর জমাট বেঁধে থাকা কালশিটেগুলো স্পষ্ট দেখতে পায় কুন্তী। ওর এই পঁয়ত্রিশ বছরি বেবুশ্যে জীবনে শুকিয়ে যাওয়া চোখে অনেকদিন বাদে জল আসছিল ওর।

পাশে পড়ে থাকা শায়াটা দিয়ে বুকের সামনে ধরে কোনোমতে উঠে বসে কুন্তী। ছেলেটা তখন জাঙিয়া পরছিল সামনে দাঁড়িয়ে। কুন্তী উঠে বসেছে দেখে হাসতে হাসতে লিঙ্গটা একবার কুন্তীর মুখের সামনে নাড়িয়ে নেয়, গুটখার ছোপ লাগা দাঁতগুলো বার করে বলে, “কিউ বে সালি, ফিরসে একবার চুসেগি কেয়া?”

কুন্তীর গা গুলিয়ে ওঠে, মুখ বিকৃত করে খিস্তি দেয়, “হঠা বে লওড়ে। তেরা টাইম হো গ্যায়া, আব নিকল হিঁয়াসে।”

ছেলেটা অবশ্য তাড়াহুড়োর কোনো লক্ষণ দেখায় না। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের, আনন্দের, বিদ্রুপের জান্তব হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে, খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতেই প্যান্টটা গলিয়ে চেনটা টেনে নেয়। যেন এতক্ষণ ধরে টাকা দিয়ে ভাড়া নেওয়া একটুকরো জ্যান্ত মাটিতে ইচ্ছেমতন নিজের পৌরুষ আর প্রতাপের পতাকা প্রোথিত করতে পারার অসহ্য তৃপ্তিটাই আলগা তাচ্ছিল্যের মতন ওর মুখে লেগেছিল।

কে বলবে একটা আঠেরো-উনিশ বছরের ছোকরার অত দম? ওহ, শুয়োর কা অওলাদ পুরো খাল খিঁচে নিয়েছে বে, থাইয়ের ওপর ফোলা জায়গাটা হাত দিয়ে বোলাতে বোলাতে আড়চোখে ছেলেটার দিকে তাকায় কুন্তী। পয়সা দিয়ে রেন্ডি চুদতে এসেছিস বলে এইভাবে রাক্ষসের মতন খায় কেউ? মালটা ঢুকল যখন, দেখে তো মনে হল ভদ্দরলোকের বাচ্চা। অবশ্য খালপাড়ের রেন্ডির সামনে প্যান্ট খুলে আর কেই বা ভদ্রতা চোদাতে আসে আসানসোলের মতন এই আধা বিহারই আধা বঙ্গালি শহরে? জানোয়ারের জাত এই বিহারিগুলো, একদলা শুকনো থুতু ঘরের কোনায় ছুড়ে দেয় কুন্তী, নিজের জাতবেরাদরদের খুবই ভালো চেনে ও। এই হারামিটা তো আরও সরেস, ঢুকেই আলো নিভিয়ে দেয়, আর তারপরেই কাপড় খুলে দনাদ্দন চার্জ করা শুরু! আর তার সঙ্গে অকথ্য খিস্তি দিচ্ছিল, উফফ, এখনও কান গরম হয়ে আছে কুন্তীর। পনেরো বছরের রেন্ডিগিরির লাইফ কুন্তীর, এমন খিস্তি আর কখনও শোনেনি ও! একবার ওর মায়ের নাম করে দুটো বাজে কথা বলতে মৃদু প্রতিবাদ করতে গেছিল ও, গালে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়ে চুপ করে যায়।

অবশ্য রেন্ডি মানে রেন্ডি, তার বয়স যতই হোক।

জিনসটা গলিয়ে ছেলেটা এবার আদুড় গায়ে ঘরের একমাত্র আসবাব ভাঙা লাল রঙের চেয়ারটায় মৌজ করে বসে। পাশে একটা ময়লা পিঠের ব্যাগ থেকে দেশি দারুর একটা পাইট বার করে ও, তারপর ইঙ্গিতে কুন্তীকে বলে গ্লাস আর জলের বোতল নিয়ে আসতে। ছেলেটা বোতলের ছিপিটা খুলতে দেশি শরাবের উগ্র বন্য গন্ধটা ধক করে নাকে এসে লাগে কুন্তীর, আর তীব্র বিরক্তিতে এইবার ফুঁসে ওঠে সে, “আবে চুতিয়ে তেরা কাম হো গ্যায়া না? বোতল কিঁউ খোল রাহা হ্যায় বে? চল বে লওড়ে, আব নিকল হিঁয়াসে, নেহি তো মওসি গান্ড মে ডান্ডা গাঢ় দেগা তেরা।”

ছেলেটা অবশ্য হেলেদুলেই বসে। তারপর খুক খুক করে হেসে বলে, “চার ঘণ্টে কা পয়সা দিয়ে হ্যায় তেরে মওসি কো, উসকে উপর সও রুপেয়া টিপস। আভি হামকো থোড়া রিল্যাক্স করনে দে বেব্বি। চল, আব ফটাকসে এক বোতল পানি লা, আউর দো দো গ্লাস। তুঝে ভি পিনি হ্যায় ইয়া নেহি?”

মওসিকে বিড়বিড় করে খিস্তি দিতে দিতে ওঠে কুন্তী। শায়াটা গলিয়ে নেয়, জীর্ণ হয়ে যাওয়া ফাটা কাঁচুলিটা টেনেটুনে পরে ফ্যালে, নখরে দেখো হারামজাদে কি! তারপর দুটো গ্লাস আর প্লাস্টিকের বোতলে জল নিয়ে এসে বসে।

প্রথম চুমুকটাই গলা আর বুক জ্বালিয়ে দেয় কুন্তীর, একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিই যেন ওর কণ্ঠা জ্বালাতে জ্বালাতে নামতে থাকে ওর শুকনো বুকে। ওফ কেয়া জহরিলি দারু লায়া হ্যায় বে ইয়ে?

রেললাইন বস্তির লছমির মাল নাকি?

লছমিও একসময় ওর মতোই লাইনওয়ালি ছিল। তারপর একদিন আসানসোলের বেতাজ বাদশা ইন্দর সিং এর সুনজরে পড়ে যায়। তারপর… তারপর আর কী? কয়েকদিন ইন্দর সিং-এর বাঁধা রাখেলগিরি, পরে বয়স হলে ইন্দরই ওকে এই ভাঁটিটা করে দেয়। তখন অবশ্য ইন্দর নতুন কবুতরি পেয়ে গেছে, নাজনিন বলে একটা ইউপির মেয়ে। লছমি বেশি রা কাড়েনি, এমনিতেও এ অঞ্চলে ইন্দর সিং এর সঙ্গে পাঙ্গা নিতে গেলে গাঁড়ে দম লাগে, তার ওপর পোষা রাখেলের রিটায়ারমেন্ট সবসময়ই বড়ো জলদি হয়, নতুন পাখি পেলেই চিড়িয়া উড়! লছমি বরং ওর ভাঁটির ধান্দাতে জ্যাদা ধেয়ান দিয়ে দোহাত্তা কামাতে থাকে। নর্মাল চুল্লুর সঙ্গে ব্যাটারির জল মিশিয়ে কি একটা মিক্সচার বানিয়েছে, নাম দিয়েছে ফুটুশ। এক-একটা চুমুকেই নাকি দিল একেবারে সাত দরিয়া পার রঙ্গিলা আসমানে চুপ্পন ছুপাই খেলতে থাকে।

অবশ্য লোকে ফুটে যেতেও বেশি টাইম নেয় না, মালটার নামই ফুটুশ!

প্রথম ঢোঁকের ধাক্কাটা সামলে টেঢ়া চোখে ছোকরার দিকে তাকায় কুন্তী, উমর মে তো পন্দরাহ সে সোলা বরসের ছোটোই হবে ছেলেটা ওর থেকে। কিন্তু অন্য একটা চিন্তা দ্রুত কুন্তীর মাথায় খেলে যায়। এই পঁয়ত্রিশ-ছত্তিরিশ বছর বয়সে আর এই শুকনো রোগাভোগা চেহারায় আর তো কোনো বাবু ও জোটাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কাপড়া-উপড়া দেখে তো এই মালটাকে পয়সাওয়ালা লেড়কা মনে হয়।

একটু এক্সট্রা ছেনালি করে দেখবে নাকি ও? যদি একটা বাবু মিলে যায় ওর? এই বয়সে?

চিন্তাটা মাথায় খেলে যেতেই একটু সচকিত হয়ে ওঠে কুন্তী। ওদিকে ছেলেটাকে প্রথম গ্লাসেই তীব্র বেপথু মনে হয় ওর। চোখ সরু করে ছেলেটার নড়াচড়া লক্ষ করে ও, আহা যদি হারামিটার ভালো লেগে যায় ওকে? পিছলে যেতে দেওয়া চলবে না ওকে, উঁহু কিছুতেই না। বহুদিন হয়ে গেল, একটা বাঁধা বাবু নেই কুন্তীর। বাঁধা বাবু ছাড়া বেশ্যার আর থাকেটাই বা কী, অ্যাঁ? আর বেশ্যার শেষ জীবনের সম্বল বলতেই বা কী থাকে?

থাকে ভরা যৌবনের সময় এক-একটা বাবু ধরে ধরে, তাদের একটু একটু করে নিঃস্ব করে নিয়ে, শেষ বয়সের জন্যে কিছু জমিয়ে রাখা বিদুরের খুদ। বেশ্যার যৌবন আর গঙ্গা মাইয়াকি পানি, এর থেকে দ্রুত আর কীই বা বয়ে যায় সময়ের উপত্যকা বেয়ে?

কুন্তীরও কি ছিল না? ভরা জওয়ানিতে কলকাতার বাঙালি আর মাড়োয়ারি বাবুদের ধরে ধরে কম পয়সা কামিয়েছে নাকি ও এককালে? সেই বাজোরিয়া নামের ছেলেটা তো হিরের হার অবধি এনে দিয়েছিল ওদের পারিবারিক দোকানের পুঁজি ভেঙে। সোনার দুল আর আংটি কম পেয়েছে নাকি কুন্তী দোসাদ? একজীবনে কম পয়সা কামিয়েছে সে? সোনাগাছির নীলকমলের কমলহিরে ছিল কুন্তী, ওরফে প্রিয়া। আকখা কলকাত্তা তার জওয়ানির নেশায় বুঁদ ছিল একদিন। গড়িয়া সে ডানলপ তক, শিলিগুড়ি সে খড়গপুর তক, রসিলা শওখিন লোকজন একডাকে চিনত তাকে। তার বিছানা গরম করতে দিল্লি, মুম্বাই থেকে ছুটে এসেছে লোক, এমনও হয়েছে কতবার! তখন ওর দাপট আর খুবসুরতি দুটোই মাশাল্লা লা- জবাব। ভেতর একজনকে নিয়ে ঢুকেছে কুন্তী, বাইরে মওসি আরও দুই কাস্টমারের সঙ্গে খোশগল্প করছে এমনটা চেনা ছবি ছিল ওর কোঠির বাইরে। তখন জোশ ছিল, জওয়ানি ছিল, পয়সাও কামিয়েছে বেতাহাশা।

এখন এই আসানসোল খালপাড়ের নোংরা রেন্ডি বস্তি দেখে সেসব দিন অলীক স্বপ্নের সোনালি বুদ বলেই মনে হয় তার।

অথচ শুরুতে কেউ কি ভেবেছিল সিওয়ানের চিতাউলি গ্রামের ভাগচাষি রামচরণ দুসাদের একমাত্র লাডলি বিটিয়ারানি কুন্তীর এই হাল হবে? ভেবেছিল কেউ? এমনিতেই ওরা নীচু জাত, রাজপুত বা ভূমিহার বরাস্তন দেখলে তাদের ছায়া মাড়ানোও ওদের কাছে পাপ। উঁচু জাতের মেয়েরা জল নিয়ে গেলে তবে ওদের ঘরে জল আসে, উঁচু জাতের চোখে চোখ রেখে, গলা তুলে কথা বলা অবধি নিষেধ। এইরকম পরিবারে মেয়ে হয়ে জন্মানো যে কতটা অভিশাপের তা জানার জন্যে হাত গুনতে জানতে হয় না, চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। পুরো বিহারে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি শুরু হয়ে পাটনায় আর সিওয়ানে। গাঁয়ের ডাগদার সাব যেদিন মেশিন-উসিন লাগিয়ে বললেন যে ওর বিবির একটা নানহি-মুনহি মেয়ে হবে, সেদিন তো ওদের ফ্যামিলিতে গভীর দুঃখের লহরই বয়ে গেছিল একটা। রামচরণের মা তো এই কালমুহি, জনমজলি বহুকে ফের বাড়ি নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছিল। বংশের প্রথম বাচ্চাই মেয়ে? হায় হায়, অমন অপশকুম বউয়ের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে হয় না? আর ধাই মা তো গোদ গিরানেকা সামান আনার অর্ডারও দিয়ে দিয়েছিল, হাজার হোক বাচ্চি গিরানোর টাকাতেই তার পেট চলে কি না।

বাধ সাধল রামচরণ নিজে। তার নাকি খুব মেয়ের শখ!

শুনে তো আসপড়োশের লোকেরা তো বেঝিঝক হয়রান! হায় দইয়া… তু কা বঙ্গালি বন গইল বড়অ? ই গাঁও কে কলকাত্তা সমঝ লে লে হউয়া ক্যে? কলকাত্তামে এই সব চলে রে পাগল… লোকে মেয়ে হলেও লেড়কা হোনে জ্যয়সা খুশিয়াঁ মানায় আর তারপর ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েগুলো মর্দানি কাপড়া-উপড়া পেহেনকে ইস্কুল কালেজ ওগ্যায়রাহ যায়, আর বেয়াহাপনা করে বেড়ায়। রাম রাম… ছোঃ। কেউ যায় ওই দলদলে কামকাজ করতে? নেহাতপক্ষে দুটো পয়সার জন্যে ও পাপ শহরে পড়ে থাকা। রামচরণ কি জানে না এই মেয়ে বড়ো হলে কী পরিমাণ দহেজ দিতে হবে পরে? ঠাকুর দেবেন্দ্র সিং- এর অগুনতি ভাগচাষিদের মধ্যে এক ছোটা বেজাত ইনসানের এই জিদ দেখে অবাক মেনে যায় দুসাদ সম্প্রদায়! যেদিন শেষ গাঁওয়ালা বুঢ়োউ ভি মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে যায়, তার ঠিক পাঁচ মাস পরে ট্যাঁ ট্যাঁ করে ভূমিষ্ঠা হয় কুন্তী।

বাপের অগাধ, অপরিমেয় লাঢ় পেয়ারই বোধহয় কুন্তীর মাথাটা বিগড়ে দেয়। তখন ধীরে হলেও গাঁও দেহাতে সেই ম্যাজিকবাক্স আসা শুরু করে দিয়েছে, যার নাম টেলিভিশন। বড়োলোক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে নিত্য টিভি দেখা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায় তার। ক্রমশ টিভি, রেডিয়ো আর যাবতীয় গ্রাম্য বিনোদনের এক অলীক মায়াবী ঊর্ণনাভে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে থাকে রামচরণ দুসাদের মেয়ে কুন্তী দুসাদ।

শেষে একদিন বাল্যসখী দুলারি যেন নিয়তির রূপ ধরেই একদিন ওকে ডেকে নিয়ে যায় গাঁওয়ের ধনীতম জোতদার তুকারাম শুক্লার বাড়িতে। কোই নয়া মেশিনওয়া নাকি এসেছে মার্কেটে, তাতে করে সেদিন সনিমা দেখানো হবে শুক্লাজিদের বাড়িতে, সদ্য আগত দরওয়াজা-ওয়ালা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভিতে।

সেদিনই ‘এক দো তিন’ দেখে ও, এককোণে জড়সড়ো আর পাঁচটা নীচ জাতের বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে। কৈশোরেই যেন সেই লাস্যময় মাধুরীবিভঙ্গ তার চৈতন্যে গেঁথে দেয় বসন্তের কুহুনির্ঘোষ।

সেই কুহুধ্বনি শুনেছিল আর-একজনও। সেদিনই।

তুকারাম শুক্লার ছোটো ছেলে বিনোদ শুক্লা। তখন তার বয়েস একুশ।

বাপ ও মায়ের অন্ধ আদরে বিগড়ে যাওয়া বিনোদের মেয়ে নাচানো অভিজ্ঞ চোখ ভুল করেনি কুন্তীর বাড়ন্ত দেহের ইঙ্গিত পড়ে নিতে। সেদিনই সে তার চামচা ও আড়কাঠি বাবুলালকে জানায় তার মনোগত বাসনা, এই উদ্ভিন্নযৌবনা অনাঘ্রাতা কিশোরীকে বিছানায় না পেলে, এ যৌবন নিয়ে সে কী করবে? নাহি চাহি হুঁ কুছ অওর, হামরা হঁও চাহি!

পরের গল্প অতি সংক্ষিপ্ত। বছর খানেক পরে এক নিদাঘপীড়িত মধ্যাহ্নে স্নানরতা কুন্তীর দেহে মাতৃলক্ষণ দেখে আঁতকে ওঠে কুন্তীর মা। দু-চারটে জোরালো থাপ্পড়ের পর অবশ্য ভীত কুন্তীর স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা ছিল না এই দেহমন কোন্ কালাচাঁদে সঁপেছে সে!

রামচরণ সোজা সরল মানুষ, খবরটা শুনে ঘরের দাওয়ায় খানিকক্ষণ থুম ধরে বসে থাকে সে। তারপর উঠে বাঁধানো লাঠিগাছাটা নিয়ে সে সোজা তুকারাম শুক্লার গদিতে গিয়ে হাজির।

“তাহার বেটুওয়া কা বিহা হামার বেটি সন করওয়াবে হে কে পঢ়ি।”

তুকারাম তো এই দুসাদের বাচ্চার বেহুদা সাহস দেখে অবাক, বলে কি গর্দাখোরটা? বলি দুসাদ চামারের মেয়েদের সঙ্গে অমন একটু-আধটু দুষ্টুমি বরাস্তন, কি ভূমিহার, কি রাজপুতের ছেলেছোকরারা করেই থাকে, তাকে কি বিয়ের সওগাত ভাবতে হবে না কি? বলি জাতধরম, বেজাতের ছুঁই-অছুঁই, সমাজবিধি, সবই কি গাধার গাঁড়ে দিয়েছে নাকি হারামিটা? আহা, হিরের টুকরো ছেলেছোকরা সব, ওদেরও তো একটু খেলার মাঠ-টাঠ চাই, না কি? আর নীচুজাতের মেয়েগুলো তো জন্মেছেই ওই জন্য! এর জন্যে অমন সোনার চাঁদ বিনোদের সঙ্গে এই নাচনিয়া, ফুলঝরি মওগিটার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? এই হারামি দুসাদটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? “আব্বে ভোঁসড়ি কে”, ঠিক এই ভাষাতেই রামচরণকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল তুকারাম (অদ্ভুত ছোটোলোকগুলো আর কোন্ ভাষাটাই বা বোঝে, অ্যাঁ?), “তাহার মাথা খারাব হো গ্যইল বা ক্যা? আব কা করি, তাহার বেটিকে সঙ্গ বিহা করওয়াবে কে পঢ়ি ক্যা? আব ই দিন আ গ্যইল বা কা বরাস্তন কি ঘরে দুসাদ চামার কি বেটি বিহা হো ক্যে আই? সুন লে রে রামচরণ, তোহরে বেটি কা চলন ঠিক নেহি ক্যে বা, উ কুতিয়া সালি ল্যইকি আপন তিরিয়া চরিত্তর সে লাইকান কে ফাঁসাওত বারি…”

তখন বিহারে অগ্নিগর্ভ সময়, আস্তে আস্তে দরিদ্র নিপীড়িত নীচবর্ণের লোকেদের সংগঠিত করছে সিপিআইএম লিবারেশন, লোকে বলে ‘মালে’। তাদের সঙ্গী লালসেনার বন্দুকের নলের নিশানায় প্রতিটি উচ্চবর্ণের জমিদার, জোতদার ও সম্পন্ন চাষি। ওদিকে উচ্চবর্ণের জমিদারেরাও চুপচাপ বসে ছিল না, সানলাইট সেনা, ব্রহ্মর্ষি সেনার নামে তারাও তৈরি করছিল তাদের ভাড়াটে খুনির দল। পরবর্তীকালে এসব দল মিশে গিয়ে তৈরি করবে ভারতের ইতিহাসের কুখ্যাত গণহত্যাকারী মিলিশিয়া রণবীর সেনা, তার নেতা হিসেবে উঠে আসবে শীতল ও স্থির মস্তিষ্কের এক খুনি, মুখিয়া ব্রহ্মেশ্বর সিং।

সেই রাতেই রামচরণ যোগাযোগ করে লালসেনার সঙ্গে। কাহানি বেশ পেকে আসার আগেই এক বর্ষার রাতে বিনোদের সঙ্গে ঘর ছাড়ে কুন্তী। লম্পটটা কুন্তীর মধ্যে কী দেখেছিল কে জানে? তখন কুন্তী আট মাসের গর্ভবতী। কাজটা বিপজ্জনক ছিল বলা বাহুল্য, তবে কুন্তী চেয়েছিল…

কী চেয়েছিল আজ আর মনে পড়ে না তার।

ছেলেটা এতক্ষণ নেশার ঘোরে কী বকবক করে যাচ্ছিল মনে ছিল না কুন্তীর। হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে অঘোরে নিজের কথা ভেবে যাচ্ছিল সে, চটকাটা ভাঙে ঘরের কোণে ওঁয়া ওঁয়া ডাকটা শুনে।

চমকে ওঠে ছেলেটা, “কিসকা রোনে কা আওয়াজ হ্যায় রে? কোই বাচ্চাউচ্চা হ্যায় কা?”

বিরক্তি ও লজ্জায় মরে যাচ্ছিল কুন্তী। হারামিটা কেঁদে ওঠার আর সময় পেল না? একরাশ বিব্রতভাব আর অনেকটা ছেনালিগিরি মিশিয়ে বলে ওঠে সে, “বিটিয়া হ্যায় হামার।”

“আরে বাপ রে, বাচ্চিকো ঘর মে সুলাকে রেন্ডিবাজি চল রহি হ্যায় তেরি? ক্যায়াসা মাল হ্যায় বে তু?”

থাপ্পড়টা মারার জন্যে হাতটা নিশপিশ করে উঠছিল কুন্তীর। তারপর বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে সে, “ক্যায়া করে লাভার, দো মহিনে কে বাচ্চে কো রাস্তে মে ছোড়কে তো ইয়ে কাম নেহি কর সকতে হ্যায় না?”

কামকাজের সময় ছোটো বাচ্চাউচ্চা মওসির কাছে রাখতে হলে নিজের বখরার ওপর পচাস রুপেয়া এক্সট্রা নেয় মওসি, কথাটা আর ভাঙে না সে। কুন্তী নিজেও কি এক সময় চায়নি এই দু-মাসের রক্তপুঁটুলিটাকে সত্যি সত্যি কলকাতার কোনো ডাস্টবিনে ফেলে দিতে?

বুকটা যেন থমকে যায় কুন্তীর। কী যে দেখেছিল সে, সেই মুখার্জিবাবুর মধ্যে? আধবুড়ি, পঁয়ত্রিশ বছুরে রেন্ডিটাকে সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তো ফিলিম লাইনের মুখার্জিবাবুই! মওসি থেকে শুরু করে চম্পা, পূজা, রামধনিয়া, নেপালি মেয়েটা… কী যেন নাম… জুন, সবাই কি কম বুঝিয়েছে ওকে? এতগুলো শুভানুধ্যায়ীদের কথা উপেক্ষা করে এত বড়ো ভুলটা সে কী করে যে করল, এই ক-টা মাস সেই ভেবেই কেটেছে কুন্তীর।

কে জানে, কলকাতা শহরের নামি বেশ্যা প্রিয়ার মনের কোনো একটা কোণে সিওয়ানের চিতাউলি গ্রামের সেই ছোট্ট কিশোরী কুন্তীর সংসার করার ইচ্ছেটা কেন মরতে মরতেও মরেনি।

হাজারোঁ খোওয়াইশেঁ অ্যায়সি, কে হর খোয়াইশ মে দম নিকলে।

বাচ্চাটার কান্নার শব্দটা বাড়ছিলই। স্পষ্টতই বিরক্ত হচ্ছিল ছেলেটা, “চুপ করা না উসকো।”

ফাঁপরে পড়ল কুন্তী। বাচ্চাটা কেন চেঁচাচ্ছে স্পষ্ট বোঝে ও। খিদে পেয়েছে ওর। কিন্তু এখন সামনে কাস্টমার বসিয়ে কি আর বুকের দুধ খাওয়ানো যায় তাকে? এদিকে আওয়াজ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকছে বাচ্চাটার।

ভয় পেয়ে গেল কুন্তী, এই ছেলেটাও যদি হাত ফসকে যায়? হাতে একটা পয়সা নেই ওর। এই বুড়ি বয়সে একটা বাঁধাবাবু থাকলে…

ক-গ্লাস খেয়েছে সে কথা খেয়াল ছিল না কুন্তীর। মাথাটা তার আর কাজ করছিল না বিশেষ, অংশত মানসিক চাপে। অংশত লছমির ফুটুশের কল্যাণে।

কী খেতে দেওয়া যায় বাচ্চাটাকে, যাতে অন্তত খানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চাটা চুপ করে? কী আছে হাতের কাছে? ভাবার জন্যে বেশি সময় নেয়নি কুন্তী। ঘরের কোণায় রাখা কাঠের তাক হাতড়িয়ে বার করে আনে একটা ভারী পিতলের ঝিনুক।

বিনোদের কিনে দেওয়া ঝিনুক। ওর, না না, ওদের অনাগত সন্তানের জন্যে কেনা। আর সব বেচে খেয়েছে কুন্তী। মায়ার টানে এইটা আর বেচতে পারেনি।

স্খলিত পায়ে মদের বোতল থেকে সরাসরি সেই ঝিনুকে মদ ঢালে কুন্তী, তারপর সেই দুই মাসের শিশুটির ঠোঁট ফাঁক করে তার গলায় ঢেলে দেয় সেই অমৃতধারা। পরে আরও এক ঝিনুক।

চুপ করে বাচ্চাটা। যাক, খানিকক্ষণের জন্যে নিশ্চিন্ত ও, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে এসে ফের চৌকিতে বসে কুন্তী। আর বসা মাত্র খপ করে তার হাত ধরে ছেলেটা, তার চোখমুখ দেখেই বোঝে কুন্তী, ছেলে আর নিজের বশে নেই। জড়ানো গলায় সে বলে, “বহুত বঢ়িয়াঁ মাল হ্যায় বেব্বি তু। কাল ফির আয়েঙ্গে। আব এক কিসসি দে দে বেবি।”

বিলকুল কামার্ত বিড়ালের স্বর, মুখার্জির বাচ্চাটার মতো। হারামাজাদা মাদারচোদ বঙ্গালি শালা, চুমু খেতে খেতে ভাবে কুন্তী। মালটা ওকে বিয়ে করে নিয়ে তুলেছিল বেলেঘাটার এক বস্তিতে। তখন কী তোয়াজ তার, বাব্বা! মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যেত কুন্তীর, সে কি স্বর্গে আছে নাকি? এত সুখ লেখা ছিল তার কপালে, মাগো মা! আকৈশোরের সেই অধরা স্বপ্ন কি সত্যি এবার সফল হতে চলেছে তার জীবনে? প্রথমবার তো….

প্রথমবারের কথা ভাবতেই ফের চোখে মুখে রক্ত উঠে আসে কুন্তীর। তখনই বোঝা উচিত ছিল তার, এত সুখ ঈশ্বর লিখে দেননি তার কপালে।

যেদিন ও আর বিনোদ পালায় মহল্লা ছেড়ে, তার তিনদিন পরেই ভাগলপুরে শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা। সেই তালেগোলে তাদের পালাতে যে সুবিধাই হয়েছিল সে কথা অস্বীকার করতে পারে না কুন্তী। পরের একটা মাস স্বপ্নের মতোই কেটে গেছিল ওর। বিনোদই ওকে ভরতি করে দেয় ট্যাংরার দিকে একটা নার্সিংহোমে, টাকা জুগিয়েছিল তুকারামের গল্লা ভেঙে আনা কাঁচা ক্যাশ। যেদিন ওর বাচ্চা হয় সেদিন আনন্দে কেঁদে ভাসিয়েছিল কুন্তী, এখনও মনে আছে। ভাবতে ভাবতে পরের গ্লাসটা বানাতে বানাতে হাত কেঁপে যায় কুন্তীর।

ছেলে হয়েছিল ওর, তাগড়া একটা বেটা। বাচ্চা হওয়ার দু-দিন বাদে ঘরে ফেরে ওরা, মানে ও আর বিনোদ। তখন ওরা উঠে এসেছে উলটোডাঙ্গার পিছনে এক বিহারি বস্তিতে। ওখানে না থাকলেই হয়তো ভালো হত, এখন ভাবে কুন্তী। নিশ্চয়ই ওদেরই কোনো দেশোয়ালি ভাই ওদের খবরটা সিওয়ান তক পৌঁছে দিতে কসুর করেনি।

তারপর যা হয়, ওরা দলবল নিয়েই এসেছিল। শুক্লাজি নিজে, তারপর বিজেন্দর, ঘনশ্যাম, ছুটনিয়া আরও অনেকে। বিনোদকে তুলে নিয়ে যেতে ওদের কোনই অসুবিধা হয়নি। কুন্তীর পাগলের মতো হাঁচোর পাঁচোর, এর ওর পা জড়িয়ে কাকুতিমিনতি, বুক ফাটিয়ে কান্না, কিছুতেই কিছু হয়নি। বিনোদকে তুলে নিয়ে গেছিল ওরা। আর নিয়ে গেছিল ওদের বাচ্চাটাকেও, হাজার হোক খানদানের লহু বলে কথা!

সেদিনটার কথা ভেবে অনেক চোখের জল ফেলেছে ও। আজকাল আর ওর কান্না-টান্না কিছু আসে না। বিনোদ কেন ফিরে আসেনি এ নিয়ে পরে অনেক ভেবেছে ও। কী জানি, হয়তো পরে ফিরে এসেছিল, তখন কি আর কুন্তী পড়ে আছে সেই বস্তিতে? অকেলা বেসাহারা অওরতের চোখের জল মোছাবার মতন হাত কম আছে নাকি কলকাত্তা শহরে? সেই অগণিত হাতেরই কেউ একটা তাকে সযত্নে তুলে নিয়ে আসে সোনাগাছিতে। এ ছাড়া আর কীই বা করত কুন্তী? শালি পেট বড়ি কুত্তি চিজ হ্যায়, আর সব ভুললেও এইটা ভোলার উপায় থাকে না যে!

এই কথাটা পরে আর একবারই ভুলতে চেয়েছিল কুন্তী, এই মাঝবয়সে এসে ফের মা হওয়ার, সংসার করার শখটা চাগাড় দিয়েছিল তার, ওই শালা মুখার্জির বাচ্চাটার কথা শুনে। সেই ভুলের মাশুল কড়ায় গণ্ডায় চোকাচ্ছে সে এখন। বাচ্চাটা জন্মাবার দিনই খবরটা পায় কুন্তী। তার নার্সিংহোমে (জোর করে কুন্তীকে নার্সিংহোমেই ভরতি করেছিল হারামিটা) থাকার সুযোগ নিয়ে কুন্তীর জমানো গয়না, টাকাকড়ি নিয়ে ভেগেছে তার রসিক বাঙালি নাগর। ব্যাংকে টাকা জমানোর কথা কোনোদিন ভাবেইনি সে। ফলে আজ সে সেই একই জায়গায় যেখানে বিশ সাল পহলে এক অভিশপ্ত দুপুরে সে দাঁড়িয়েছিল উলটোডাঙার পেছনের বিহারি বস্তিতে।

কপর্দকশূন্য অবস্থায়।

বাচ্চা কোলে আধবুড়ি বেশ্যাকে আর ফিরিয়ে নেয়নি সোনাগাছি। শেষে অনেক বলে কয়ে এই আসানসোলের মতো আধা বঙ্গালি আধা বিহারি শহরের রেলবস্তিতে থাকতে আসা।

ততক্ষণে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা, আঠেরো-উনিশ বছরের সেই দীর্ঘ, পেটাই ঋজু দেহ মদের ঝোঁকে টলতে থাকে। তারপর পকেট দোমড়ানো-মোচড়ানো দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে কুন্তীর কাঁচুলির ভাঁজে গুঁজে দেয়, ঈষৎ স্খলিত গলায় বলে, “তেরা টিপস।” তারপর জামাটা পরার বদলে হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটা, টলতে টলতে এগোতে থাকে দরজার দিকে।

আর তখনই দাগটা চোখে পড়ে কুন্তীর, ঘরের মধ্যে ষাট ওয়াটের বালবের সামান্য আলোতেও দাগটা চিনতে ভুল হয় না তার। ছেলেটার ডান কাঁধে গাঢ় বাদামি রঙের একটা এবড়োখেবড়ো দাগ, প্রায় ভারতবর্ষের ম্যাপের মতন।

জন্মদাগ।

এই দাগটা চেনে কুন্তী, খুব ভালো করেই। যে ক-টা দিন নিজের প্রথম স্নেহের পুত্তলিটি নিয়ে স্বর্গসুখের খেলায় মেতেছিল সে, তখনই কুন্তী খেয়াল করেছিল এটা। ছেলের ডানদিকের কাঁধে ভারতের ম্যাপের মতন একটা ছোট্ট বাদামি ছোপ। দুনিয়াতে আর অন্য কিছু ভুলতে পারে কুন্তী, কিন্তু এই দাগটা সে মরে গেলেও ভুলতে পারবে না, কিছুতেই না!

আর সেই দাগের মালিক, আঠেরো-উনিশ বছরের ছেলেটা পেরিয়ে যাচ্ছিল বস্তিবাড়িত অন্ধকার গলি। সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই কথাটা কে যেন হঠাৎ করে তার চৈতন্যে জ্বলন্ত শাবলের মতোই গেঁথে দিল। নিজের আত্মজের সঙ্গে শুয়েছে কুন্তী, এইমাত্র। পয়সার বিনিময়ে।

তীব্র নেশার বিষের প্রভাবেই হোক, বা নিজের ছেলের সঙ্গে শোওয়ার গ্লানিতেই হোক, ভিতরটা গুলিয়ে উঠছিল কুন্তীর। একটা অন্ধ ক্রোধ তার তলপেট থেকে উঠে ব্রহ্মরন্ধ্র অবধি জ্বালিয়ে দিতে চাইছিল।

কতক্ষণ একই ভাবে বসে ছিল সে জানে না কুন্তী। চটকা ভাঙে দরজায় ঠকঠক শুনে, সঙ্গে মওসির গলা, “নয়া কাস্টমার আয়া হ্যায় রে, পানসো রুপেয়া দেগা বোল রাহা হ্যায়। মেরা খরচা অলগ, ঝটপট তৈয়ার হো লে রে বাবু।”

উঠে দাঁড়ায় কুন্তী। মেঝে থেকে শাড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে পরে। চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে সস্তা লিপস্টিক। খানিকক্ষণ স্থির হয়ে নিজেকে দেখে। তারপর দরজা খুলতে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে ওর বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে। অনেকক্ষণ থেকে চুঁ শব্দটা নেই যে!

দ্রুত পায়ে গিয়ে কাঁথাটা সরায় ও। নাহ, ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্চাটা।

কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে বুক ওঠানামা করছে না কেন? সন্তর্পণে বাচ্চাটার বুকে হাত রাখে ও, কিন্তু কোনো কিছুর স্পন্দন টের পায় না যে! দ্রুত কান পাতে বুকে, নাহ্, কোথায় সেই ক্ষীণ লাবডুব শব্দ? নাকে হাত দেয়, নিশ্বাসের চিহ্নমাত্র নেই। পাগলের মতো ঠান্ডা হয়ে আসা শরীরটা ঝাঁকাতে থাকে কুন্তী, হতে পারে না, এ হতে পারে না। দুটো জোরে থাপ্পড় মারে গালে, যদি ওঁয়া ওঁয়া একবার কেঁদে ওঠে বাচ্চাটা।

না, নেই। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ব্যাটারির অ্যাসিড মেশানো লছমির ফুটুশ সাপের বিষের তীব্রতা চিরকালের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে বুভুক্ষু শিশুটিকে।

ষাট ওয়াট বালবের গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে স্থাণু হয়ে বসে থাকে কুন্তী। আহা রে, খেতেই তো চেয়েছিল মেয়েটা।

ধীরে ধীরে কাঁথাটা দিয়ে ছোট্ট শরীরটাকে ঢেকে ফেলে কুন্তী। তারপর ক্লান্ত পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বেশবাস ঠিক করে নেয় সেই আধবুড়ি বেশ্যা মেয়েটা। তারপর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা কাস্টমারকে হাসিমুখে আপ্যায়ন করে ডেকে নেয় ভেতরে, তারপর শেকল তুলে বন্ধ করে দেয় দরজাটা।

বাচ্চাটাকে শমশান ঘাটে জ্বালাতে গেলেও তো পাঁচশোটা টাকা লাগে, না কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *