আট
আজ হাটবার। ভোর থেকে ট্রাকে করে সবজি, মাছ নিয়ে ব্যাপারীরা চলে আসছে এই গঞ্জের হাটে। চওড়া পিচের বাসরাস্তার দু-ধারের মাঠে ত্রিপল টাঙিয়ে দোকান বসছে আজকের জন্যে। আশে-পাশের গ্রাম থেকে চাষিরা বয়ে নিয়ে আসছে পাট। হাটে ঢোকার মুখেই পাইকাররা ছোঁ মেরে একপাশে নিয়ে গিয়ে দরাদরি করে কিনে নিচ্ছে সেগুলো। একটু বেলা হলে চাষিরা বয়ে নিয়ে আসছে সবজির ঝুড়ি। বেলা দশটার মধ্যেই হাট জম-জমাট।
বনবিহারী কখনও হাটে গিয়ে কেনাকাটা করেন না। এ ব্যাপারে কালীচরণের ঘোর আপত্তি আছে। তার ধারণা সবাই ওঁকে ঠকিয়ে বেশি দাম নিয়ে বাজে জিনিস গছিয়ে দেবে। সাধারণত হাটের দিন দুপুরের পর বনবিহারী চেম্বারে যান না। বিকেলটা বাড়িতেই বইপত্র পড়ে কাটান।
আজ সকালে চেম্বারে যাওয়ার জন্যে যখন তৈরি হচ্ছেন তখন হঠাৎ দেখলেন মামণি তাঁর ঘরে ঢুকেছে। ছেলেটির মৃতদেহ দেখে আসার পর থেকে তিনি একটু গম্ভীর হয়ে ছিলেন। মামণিও আতঙ্ক ভুলতে পারছিল না কিছুতেই।
মামণি সোজা এসে বনবিহারীর সামনে দাঁড়াল। মুখ তুলে দেখল। তারপর আঙুল নেড়ে কিছু জিজ্ঞাসা করল যা গোঙানি ছাড়া অন্য কোনও অর্থ বনবিহারীর বোধগম্য হল না। মেয়েটা তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে কিন্তু সেটা কি তা তিনি বুঝতে পারছেন না। হাত নেড়ে ইশারায় সেটা বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
মামণি তাঁর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে একটা আঙুল বনবিহারীর দিকে তুলে নিজের বুকে ঠেকিয়ে মুখ ফোলাল। বনবিহারী বুঝলেন। তিনি রাগ করেছেন কিনা তা জানতে চাইছে মেয়েটা। হাসি পেল তাঁর। মাথা নেড়ে না বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে বনবিহারীর ডান হাত তুলে নিজের মাথার ওপর চেপে অন্য হাতে ইশারা করল মামণি। অর্থাৎ মাথা ছুঁয়ে কথাটা বলতে হবে।
‘তুমি নিজের প্রাণ বাঁচাতে যা করেছ তার জন্যে আমি একটুও রাগ করিনি।’ বনবিহারী বললেন।
এবার হাসি ফুটল মামণির মুখে।
দরজার ওপাশ থেকে কালীচরণ বলে উঠল, ‘বাঃ শেষ পর্যন্ত মেঘ কেটে গেল। আজ বাজার থেকে ভালো ভালো জিনিস কিনে এনে রান্না করতে হবে।’
কানে ঢোকা মাত্র লাফাল মামণি। তারপর কালীচরণের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানাল সে নিজে রান্না করবে।
কালীচরণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি রান্না করতে জানো?’
মাথা হেলিয়ে মামণি জানিয়ে দিল, সে জানে।
বনবিহারী বললেন, ‘দেখি আজ দুপুরে কেমন খাওয়া হয়! দাও বাজারের ব্যাগ। আজ আমি নিজে বাজার করব।’ কালীচরণ প্রতিবাদ করল, ‘সর্বনাশ! আপনাকে বাজারে যেতে হবে না। আপনার চেম্বার তো খোলা। নিশ্চয়ই সেখানে রোগীরা এসে গেছে।’
‘আসুক। আমি খবর পাঠাচ্ছি বিকেলে বসব। মামণি যখন রাঁধতে চেয়েছে তখন নিজের হাতে বাজার করব। দাও ব্যাগটা।’
কিছুটা মিনমিনে আপত্তির পর কালীচরণ বলল, ‘আমি সঙ্গে যাই?’
‘না না। মেয়েটা একা থাকবে নাকি! অনেকদিন জলখাবারে লুচি খাইনি, লুচি আর বেগুনভাজা কর, ফিরে এসে খাব।’ ব্যাগ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে গেলেন বনবিহারী। অনভ্যস্ত এই যাত্রা তাঁকে প্রফুল্ল করছিল।
বনবিহারীরা যে পাড়ায় থাকেন সেটা গঞ্জ থেকে কিছুটা দূরে। বাড়ির সামনে একটা মাঠ, তারপর বাসরাস্তা। আশে-পাশের বাড়িগুলো যেন পরপর এক লাইনে দাঁড়িয়ে। মাঠ পেরিয়ে তিনি যখন হাঁটছেন হাটের উদ্দেশে তখন পাশের বাড়ির শিবশঙ্করের বউ তাদের বারান্দায় অলসভাবে দাঁড়িয়েছিল। বউটির নাম সুলতা। তার স্বামী ব্যাবসাদার, চা-বাগানগুলোতে জ্বালানি কাঠ থেকে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু জোগান দেয়। স্বামীর ওপর সুলতার প্রভাব নিয়ে এ পাড়ায় লোকে হাসি-মস্করা করে। বছর দেড়েক হল সুলতা তার বিধবা মা সুনয়নীকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। সুনয়নী যৌবনেই বিধবা হয়েছিলেন এক মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে। থাকতেন ছেলের কাছে কিন্তু যেহেতু শাশুড়ির সঙ্গে সুলতার সম্পর্ক ভালো ছিল না তাই সে ভাই-এর আপত্তি সত্ত্বেও মাকে এই সংসারে নিয়ে এসেছিল। তাতে কাজও হল। শাশুড়ি মাসখানেকের মধ্যে সেই যে শহরে অন্য ছেলের বাড়িতে গিয়েছেন আর ফিরে আসেননি। ব্যাপারটা শিবশঙ্করকে ক্ষুণ্ণ করেছিল কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া তার অন্য উপায় ছিল না।
বনবিহারীকে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটতে দেখে সুলতা চিৎকার করে তার মাকে ডাকল, ‘মা, মা, তাড়াতাড়ি এখানে এসো, তাড়াতাড়ি।’
উত্তেজনা সুনয়নীর খুব পছন্দ। একমুখ কৌতূহল নিয়ে তিনি ছুটে এলেন বারান্দায়! ‘কি রে?’
‘দেখো।’
‘ডাক্তারবাবু?’
‘হ্যাঁ গো। ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছে! কি ব্যাপার বলো তো?’
‘বোধহয় চাকরটা, কি যেন নাম, হ্যাঁ, কালীচরণ, শরীর খারাপ হয়েছে!’
‘নাগো। একটু আগে দেখেছি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল।’ সুলতা মাথা নাড়ল, ‘আজ পর্যন্ত কোনওদিন ওকে হাটে যেতে দেখিনি।’ সুলতা বলল, ‘বয়স হয়েছে তা বোঝা যায় না।’
‘নিশ্চয়ই বাড়িতে লোক খাওয়াবে তাই নিজে বাজার করতে যাচ্ছে।’
‘লোক খাওয়াবে? রাঁধবে কে? ওই কালীচরণ তো নমঃ নমঃ করে রান্না সারে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল পোস্ত কি করে রাঁধতে হয়।’ হাসল সুলতা।
‘কি জানি। বেশ ক’দিন দেখছি ওদের বাড়ির এদিকের জানলাগুলো বন্ধ। যেন ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। আগে তো সব খোলামেলা ছিল।’ সুনয়নী বললেন।
‘জানলা খোলা রাখলে ধুলো ঢোকে। কালীচরণকে সেটা পরিষ্কার করতে হয় বলে জানলা বন্ধ রেখেছে। কুঁড়ের হদ্দ। বাড়িতে কোনও মেয়েছেলে থাকলে ও টের পেত!’ সুলতা বলল।
‘বিয়ে করেনি কেন বল তো?’
‘কি জানি? এসে অবিধি তো এইরকম দেখছি।’ সুলতা হাসল, ‘রোগ ঘেঁটে ঘেঁটে আর সংসার করা হয়নি। এই বয়সে আর কে মেয়ে দেবে?’
‘কত বয়স ওর?’
‘পঞ্চাশ-ষাট হবে। তবে শক্তপোক্ত আছে। তোমার জামাই তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলে অমন মানুষ হয় না।’ সুলতা ঘরের দিকে ফিরছিল এই সময় মতির মাকে দেখল। হনহনিয়ে আসছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাসনমাজা ওর কাজ।
‘আজ তাড়াতাড়ি এলে যে?’ সুনয়নী একটু বিরক্ত।
‘যখন সময় হবে তখন তো আসব। মেয়ে এসেছেন, সে তো ছাড়তেই চাইছিল না। তা সাতসকালে মা-মেয়ের হাতে কোনও কাজ নেই নাকি? সরো।’ মতির মা ভেতরে পা বাড়াতে সুনয়নীকে সরে দাঁড়াতে বলল।
‘কাজ থাকবে না কেন? বড্ড মুখ তোর! পাশের বাড়ির ডাক্তারবাবু কখনও হাটে যান না, আজ গেলেন বলে দেখতে এসেছিলাম।’ সুনয়নী হাসলেন। হঠাৎ খেয়াল হল মতির মায়ের। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল তার, ‘আচ্ছা, ওই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এসেছেন নাকি? কোনওদিন কাউকে আসতে দেখিনি, এই প্রথম মনে হল।’
‘মনে হল মানে? কাউকে দেখলি?’
‘না না, দেখিনি। কাল কাজ সেরে যাওয়ার সময় মনে হল ও বাড়ি থেকে বাচ্চার কান্না ভেসে আসছে। একেবারে কচি বাচ্চা।’ মতির মা বলল।
‘সত্যি? তাহলে নিশ্চয়ই কেউ বউবাচ্চা নিয়ে এসেছে ও বাড়িতে। ঠিক শুনেছিস?’
‘আঃ। আমার কান তোমার চেয়ে অনেক পরিষ্কার।’ মতির মা ভেতরে ঢুকে গেল।
চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল সুলতা, এবার মায়ের কাছে এসে বলল, ‘কি গো?’
‘সুনয়নী বললেন, ‘মাথায় ঢুকছে না। বাচ্চা নিয়ে কারা এল ওই বাড়িতে?’
‘আমি কি করে জানব? আর যদি আসেই বা জানলা বন্ধ করে রাখবে কেন?’
‘একবার খোঁজ নিতে যাবে?’ সুলতার চোখে কৌতূহল।
‘ও বাড়িতে কোনও মেয়ে-ছেলে নেই, যাবি কোন অজুহাতে?’
‘আমার যাওয়া ঠিক হবে না, তুমি যাও।’
‘যাঃ। লজ্জা পেলেন সুনয়নী, ‘আমি গিয়ে কী বলব?’
‘বলবে, তোমার কোমরে ব্যথা হয়েছে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, চেম্বারে যেতে পারবে না বলে বাড়িতে দেখাতে এলে। এতে কারও কিছু মনে করার নেই।’ সুলতা বলল।
‘যদি সত্যি সত্যি পরীক্ষা করে? এম্মা!’ গালে রক্ত জমল সুনয়নীর।
‘উঃ! কারও কোমরে ব্যথা হলে কি কোনও ডাক্তার কাপড় খুলে পরীক্ষা করে? তোমার না যত লজ্জা! যাও না এখন?’
‘এখন? এখন তো উনি নেই।’
‘নেই তো কি হয়েছে? এটাই তো সুযোগ। কালীচরণকে ম্যানেজ করে ভেতরে ঢুকে দেখে আসতে পার কে এসেছে।’
‘যদি ঢুকতে না দেয়?’ সুনয়নী মাথা নাড়লেন, ‘এই মতির মায়ের কথা বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে লোকজন ও বাড়িতে ঢুকল আর তুই বা আমি তাদের দেখতে পেলাম না?’
সুলতা রেগে গেল। কথা না বলে ভেতরের দিকে পা বাড়াল সে। সুনয়নী পেছনে যেতে যেতে বললেন, ‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা। ডাক্তার হাট থেকে ফিরে আসুক তারপর যাব। এই শাড়ি পরে কি যাওয়া যায়!’
হাটে ঢুকে বনবিহারী চারপাশে তাকালেন। সবজির ব্যাপারীরা ইতিমধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে। সেদিকে পা বাড়ালেন তিনি। যে লোকটি শাক বিক্রি করছিল তার সামনে দাঁড়াতে সে বলল, ‘ভালো কলমি শাক আছে বাবু।’
বনবিহারী দেখলেন। কুমড়ো, লাউ, লালশাক, কলমি থেকে শুরু করে কি নেই। হঠাৎ চোখ পড়ল শুঁড় বাঁকানো ঢেঁকির শাকের ওপর। বেশ কচি এবং ডাগর বললেন, ‘দাও দেখি পাঁচ আঁটি ঢেঁকির শাক।’
লোকটি হেসে পাঁচ আঁটি শাক বনবিহারীর বাজারের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ শাক তো বনে-বাদাড়ে পাওয়া যায় বাবু। আপনি দুটো টাকা দিন।’
খুশি হলেন বনবিহারী। মা চলে যাওয়ার পর আর ঢেঁকির শাক খাওয়া হয়নি। মায়ের হাতে প্রায় অমৃত ছিল পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে ঢেঁকির শাকের ছেঁচকি। কালীচরণ একবার চেষ্টা করেছিল, মুখে তোলা যায়নি।
‘একি ডাক্তারবাবু! আপনি হাটে এসেছেন?’ জুনিয়ার হাইস্কুলের ভুগোল শিক্ষক বাদলবাবু সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘কোনওদিন দেখিনি তো!’
‘চলে এলাম।’ হাসলেন বনবিহারী।
‘চেম্বার বন্ধ?’
‘ও বেলায় যাব।’
‘কি শাক কিনলেন?’
‘ঢেঁকির শাক।’
‘ঠকে গেলেন। এ তো রাস্তার দুপাশের জঙ্গলে পাওয়া যায়।’
‘যায়। কিন্তু সেগুলো বুনো, স্বাদও ভালো নয়।’
‘ওদিকে ব্যাপার-স্যাপার শুনেছেন?’
‘কোনটা বলুন তো?’
‘একজন উগ্রপন্থীকে চা-বাগানের ভেতরে কেউ খুন করে গিয়েছিল। তার বডি পেয়ে পুলিশ আর মাথা ঘামায়নি। ঝামেলা চুকে গিয়েছে বলে হাত ধুয়ে বসেছিল। কিন্তু এসপি সাহেব অর্ডার দিয়েছেন ছেলেটার খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘ও।’
‘আমাদের হেডমাস্টার মশাই-এর ছেলেকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন ও.সি., প্রশ্ন করে জেরবার করে দিয়েছেন ওকে?’
‘সেকি! ধরে রেখেছে নাকি?’ বনবিহারী চমকে উঠলেন।
‘না। ছেড়ে দিয়েছে।’
‘ওকে কেন ডাকল?’
‘যে রাত্রে ছেলেটি খুন হয় সেই রাত্রে ওকে নাকি কেউ কেউ রাস্তায় দ্যাখে। সন্দেহ বোধহয় সেই কারণে! কি অবস্থা বলুন তো!’
‘হ্যাঁ। এসব একদম ভালো লাগছে না।’ বনবিহারী এগিয়ে গেলেন। তাঁর মনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এসপি সাহেব যদি আবার তদন্ত করতে বলেন এবং ও.সি. যদি—! নাঃ এতটা ভাবতে পারছিলেন না তিনি।
এলোমেলো বাজার করে মাছের দোকানগুলোতে পৌঁছে ভাবনাটাকে সরাতে পারলেন বনবিহারী। অনেকদিন পরে পাথরঠোকা মাছ দেখতে পেলেন। দেড় আঙুল লম্বা একটি শিরদাঁড়ার কাঁটাবিহীন মাছ, ভারী মিষ্টি। ছেলেবেলায় খুব খেতে ভালোবাসতেন। কালীচরণ কখনই এই মাছ কেনে না। কিনলে যে ওর কেরামতি ধরা পড়ে যাবে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই মাছ কত করে বিক্রি করছ?’
‘কোনটা? এই ছিলামাছ?’
‘ছিলামাছ? আমি তো পাথরঠোকা বলে জানি।’ বনবিহারী হাসলেন, ‘পাথরের গায়ে যে শ্যাওলা থাকে তাই খেয়ে বাঁচে।’
‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, এখন লোকে একে ছিলামাছ বলে। কত নেবেন।’
‘পাচশো দাও।’
মাছ পাল্লায় তোলা হল। দেখা গেল তিনশোর বেশি হল না। সংখ্যায় অনেক কিন্তু ওজনে হালকা। এইসময় পেছন থেকে একটা গলা ভেসে এল, ‘কি রে! ডাক্তারবাবুকে ঠকাচ্ছিস না তো?’ পালবাবু পাশে এসে দাঁড়ালেন।
‘না না বাবু। ঠকাব কেন?’ মাছের দোকানদার মাথা নাড়ল।
পালবাবু বললেন, ‘কি মাছ নিলেন? অ্যাঁ। ছিলা! রুই-কাতলা ছেড়ে আপনি ছিলা নিচ্ছেন ডাক্তারবাবু? কি ব্যাপার?’
অনেককাল খাওয়া হয়নি, তাই।’
‘আমার আবার বড়সড় মাছ না হলে মন ভরে না। চলুন একটু চা খাই।’ পালবাবু হাত বাড়িয়ে হাটের জন্যে তৈরি চায়ের দোকান দেখালেন।
‘আমি চা দিনে দুবার খাই পালবাবু।’ বনবিহারী বললেন।
‘আমিও তাই। কিন্তু হাটে এলে আর এক কাপ না খেলে ঠিক জমে না। যাঁরা নিয়মিত হাটে আসেন তাঁদের দেখবেন চা না খেয়ে বাজারের ব্যাগ বাড়িতে নিয়ে যান না। আসুন আসুন।’ পালবাবু চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘খুব ভালো করে চা বানাও বৈরাগী। দুধ না দিয়ে লেবু দাও। চিনি খান তো ডাক্তারবাবু?’
‘অল্প।’ বেজার মুখে বললেন বনবিহারী।
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে পালবাবু গলা নামালেন, ‘বাড়ির খবর ঠিক আছে তো?’
বনবিহারী বুঝতে পারলেন না, ‘কোন খবর?’
‘মেয়েটার কথা কেউ জানতে পারেনি তো?’ গলা আবার নামালেন পালবাবু।
‘না।’ গম্ভীর হয়ে গেলেন বনবিহারী। চায়ের ভাঁড় তাঁর হাতে, খেতে ইচ্ছে হল না।
‘পাচার করে দিন। বাড়িতে যুবতী মেয়েছেলেকে হয়তো লুকিয়ে রাখতে পারেন কিন্তু বাচ্চাকে কি করে পারবেন? সে তো কান্নাকটি করবেই। তখন আশেপাশের বাড়ির লোক নাক গলাবে। এদিকে শুনছি এসপি সাহেব আবার তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। আমার হয়েছে খুব মুশকিল।’ ভাঁড় ফেলে দিলেন পালবাবু।
মুশকিলটা কি জানার চেষ্টা করলেন না বনবিহারী।
হাসলেন পালবাবু ‘পেটের ভেতর কোনও কথা বেশিদিন চেপে রাখতে পারি না আমি। সবসময় ফুটতে থাকে কথাগুলো। কিন্তু বের করলে বেচারা শম্ভু যে বিপদে পড়বে। আমি তো ভাবছি ওকে বলব চাকরি খুঁজে অন্য কোথাও চলে যেতে।’
‘কেন?’
‘এতদিনের লোককে চোখের সামনে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে দেখতে কি ভালো লাগবে! ও চোখের আড়ালে চলে গেলে সেই সমস্যা থাকবে না!’
‘আপনি পুলিশকে ব্যাপারটা বলে দেবেন?’ অবাক হয়ে তাকালেন বনবিহারী।
‘যাচ্চলে! আমি কেন পুলিশের কাছে যাব! পেটে কথা চেপে রাখতে পারি না। বেরিয়ে গেলে আশেপাশের লোকের কানে ঢুকবে। তারপর কানাকানি হতে হতে পুলিশের কানে পৌঁছে তো যেতে পারে।’ পালবাবু হাত নাড়লেন।
‘আপনি এসব কী বলছেন পালবাবু?’
‘আমি কিছুই বলছি না ডাক্তারবাবু। শুধু ভয় পাচ্ছি।’
‘আশ্চর্য! আপনি জানেন এতে শম্ভু বা আমার কোনও দোষ ছিল না। নেহাত মানবিকতার কারণে জড়িয়ে পড়েছি আমি। মেয়েটা এবং তার বাচ্চাটাকে পথে ফেলে দিতে পারিনি। আপনার কাছে সবই তো স্পষ্ট।’
‘কোনও ওষুধ আছে?’ তাকালেন পালবাবু।’
‘কীসের ওষুধ?’ বনবিহারীর এই প্রশ্ন আশা করেননি।
‘কী যে বলি! মুখটা বন্ধ রাখতে হলে তাকে শাসাতে হবে।’
‘আপনি কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছেন?’
‘ছি ছি! এ আপনি কী বলছেন?’
‘তাহলে?’
‘আমার একটা বড় দুর্বলতা আছে। যদি সেটা দূর করে দেন।’
‘আমি আপনার কথা বুঝতেই পারছি না।’
‘তাহলে বলেই ফেলি।’ আশপাশে তাকিয়ে নিলেন পালবাবু, ‘আমার বয়স এখন একষট্টি। আগেকার দিন হলে বলত ঘাটের মড়া। কিন্তু এখন মানুষ দীর্ঘজীবী হয়। নব্বুই পর্যন্ত এখন অনেকেই বাঁচে ঠিক কিনা বলুন?’
মাথা নাড়লেন বনবিহারী। হ্যাঁ।
‘এখনও আমার শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালো! মন তো পঁচিশ-ছাব্বিশের যুবকের চেয়েও, যাকে বলে রোমান্টিক, ঠিক তাই। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেছে একটা কারণে।’ কথাগুলো বলে একটু চুপ করলেন পালবাবু।
‘আপনার কথা শেষ করুন।’ বনবিহারী বললেন।
‘আর কি! আমি শেষ হয়ে গেছি ডাক্তারবাবু। শরীর আর আমার কথা শুনছে না। বারংবার হেরে যাচ্ছি। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। আপনি আমাকে সাহায্য করুন। এই সাহায্য পেলে মুখ চিরকালের জন্যে বন্ধ করে রাখব।’
‘আপনার কথা এখনও বোধগম্য হচ্ছে না।’
‘ধ্যেৎ! আপনি কি! বিয়ে করেননি বলে এসব জানেন না বললে কেউ মানতে চাইবে! আমার সব ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও যাকে বলে সেক্স তা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছি। বাইরে থেকে কেউ বুঝবে না। কিন্তু যারা বোঝার তারা তো হাসাহাসি করে। আপনি এর ওষুধের ব্যবস্থা করে দিন।’ পালবাবু করুণ স্বরে বললেন।
‘এসব কী বলছেন পালবাবু! আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। প্রচুর ভোগ করেছেন। আপনার স্ত্রীর চিকিৎসা আমি করেছি। তিনি এখন যে বয়সে পৌঁছেছেন তাতে এসব তাঁর কাছে অবান্তর। একেবারে মা জননীর রূপ তাঁর। আপনি যে ওষুধ চাইছেন তা জানলে ওঁর পক্ষে সহযোগিতা করা তো সম্ভবই হবে না। উলটে দুঃখ পাবেন এরকম বাসনার জন্যে।’ পালবাবুকে বোঝাতে চাইলেন বনবিহারী।
‘সত্যি, আপনি ভালো ডাক্তার হতে পারেন কিন্তু বাস্তববুদ্ধি নেই। স্ত্রী এখন, আরে আমরা ভাইবোনের মতো জীবন-যাপন করি। তিনি পুজোআর্চা নিয়ে থাকেন। আর আমি, এখনও আমার মনে বাসনা ছটফট করছে। আর সেটা পূর্ণ করার জন্যে মহিলার অভাব নেই। বুঝেছেন! ওষুধটা আনিয়ে দিন। আমি নাম শুনেছি। ভ্যা, ভায়াগ্রা। যা দাম হবে দেব। সাতদিনের মধ্যে আনিয়ে দেবেন। ততদিন মুখ কিছুতেই খুলব না।’ পালবাবু কথাগুলো বলেই হনহন করে চলে গেলেন।
বাজার করা আর হল না বনবিহারীর।
বাজারের ব্যাগ থেকে ঢেঁকির শাক আর ছিলামাছ নামিয়ে কালীচরণ কপালে হাত দিল, এই বাজার করলেন এতক্ষণ ধরে!’
‘বাকিটা তুমি নিয়ে এসো।’ বনবিহারী বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলেন কিন্তু বাইরের দরজায় শব্দ হতে ঘুরে দাঁড়ালেন।