দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ৬

ছয়

বনবিহারী দেখলেন মামণির চোখে-মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। ঝট করে শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে সে দেওয়ালের দিকে সরে গেল। ছেলেটি ঘরে ঢুকে বনবিহারীকে বলল, ‘আমি ওর সঙ্গে একটু একলা কথা বলতে চাই।’

শোনামাত্র তীব্র গোঙানি ছিটকে এল মামণির মুখ থেকে। হাত নেড়ে সে তার আপত্তি জানাল। বনবিহারী বললেন, ‘তোমাকে দেখে ও ভয় পাচ্ছে কেন?’

‘বুঝতে পারছি না। এরকম হওয়ার কথা নয়।’ ছেলেটি একটু বিভ্রান্ত।

‘তাহলে তোমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত!’ বনবিহারী দেখলেন কালীচরণ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটি হাসল, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন এখানে কীরকম কুকুর-বেড়ালের মতো পড়ে আছি। কেন আছি? ওকে নিয়ে যাব বলেই আছি।’

‘কিন্তু ও তোমার সঙ্গে যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’

‘এটাই আমাকে অবাক করছে। আপনি ওর ব্রেন ওয়াশ করেছেন?’

‘আমি? কি বলে করব? কেন করব? ও কে তাই আমি জানি না! পুলিশ বলছে তোমরা উগ্রপন্থী। তোমাদের গুলি করে মারলে পুলিশের কোনও অপরাধ হয় না। এই তোমাদেরও তো আমি ভালো করে জানি না। তাহলে কি বলে ওর ব্রেন ওয়াশ করব?’

ছেলেটা বনবিহারীকে কয়েক সেকেন্ড দেখল। তারপর খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমি তোমার জন্যে এখানে এতদিন অপেক্ষা করছি। তোমার শরীর যখন সুস্থ হয়ে গিয়েছে তখন আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। এখনই বেরিয়ে গেলে ভোর হওয়ার আগে আমরা অনেকটা দূরে চলে যেতে পারি। আমাদের অন্য দলের কমরেডরা যে গোপন আস্তানায় আছে সেখানে পৌঁছলে তুমি নিরাপদে থাকবে।’

মামণি ঠোঁট বেঁকিয়ে অন্যদিকে তাকাল।

‘তুমি যেতে চাইছ না?’

সঙ্গে-সঙ্গে সবেগে মাথা নাড়ল মামণি। না।

‘এখানে তুমি আছ জানতে পারলে পুলিশ শুধু তোমাকেই ধরবে না, ডাক্তারবাবুকেও বিপদে ফেলবে। উনি তোমার এত উপকার করেছেন, ওঁকে কেন বিপদে ফেলবে?’

মামণি কেবলই মাথা নাড়তে লাগল।

‘শপথ নিয়ে দলের নিয়ম ভাঙলে কি শাস্তি পেতে হয় তা তুমি জানো না?’

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি।

‘তাহলে? তুমি কি ওই বাচ্চাটার কথা ভেবে যেতে চাইছ না?’

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মামণি। হ্যাঁ কিংবা না কিছুই জানাল না।

‘কিন্তু ওকে নিয়ে গেলে অনেক অসুবিধে হবে। আমাদের শোওয়া-খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ওইটুকু শিশু সেটা সহ্য করতে পারবে না। ওকে ছেড়ে থাকতে হবে তোমাকে।’

সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল মামণি।

‘ছাড়তে তোমাকে হবেই। একসময় যারা আমাদের প্রিয়জন ছিল তাদের সবাইকে ছেড়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি। একে তুমি ক’দিন দেখছ? এর মধ্যেই এত মায়া জন্মে গেল?’

বনবিহারী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার কথা বললেন, ‘শোনো ভাই। ওকে আর বিরক্ত কোরো না। ও যখন যেতে চাইছে না তখন আর এ নিয়ে কথা বলার দরকার নেই।’

‘মনে হচ্ছে ও থাকলে আপনার লাভ হবে।’

‘আমার? হেসে ফেললেন বনবিহারী, ‘কীরকম?’

‘বিয়ে থা করেননি। এখানকার একমাত্র ডাক্তার বলে ভালো রোজগার আছে। তাই বিয়ে না করেও ওরা এখানে থাকলে চমৎকার সংসারের স্বাদ পেয়ে যাবেন।’

একটুও রাগ করলেন না বনবিহারী, ‘তা বলতে পারো। বাচ্চাটা যদি একটু কান্নাকাটি করত তাহলে তার আওয়াজে বাড়িটা ভরে উঠত।’

ছেলেটা মামণির দিকে তাকাল, ‘শুনলে তো। ওকে এখানে রেখে যাও। ইনি ঠিকঠাক দেখাশোনা করবেন। বাবার স্নেহ পাবে আবার ডাক্তারের সাহায্যও পাবে।’

বনবিহারী প্রতিবাদ করলেন, ‘আশ্চর্য! মা ছাড়া বাচ্চাকে আমি রাখব কেন?’

‘কেন? এই যে বললেন বাড়ি ভরে উঠবে ও কাঁদলে?’

‘অসম্ভব। যদি ও তোমার সঙ্গে যায় তাহলে বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হবে।’ বনবিহারী বলামাত্র কালীচরণের গলা ভেসে এল, ‘ঠিক কথা।’

ছেলেটি কালীচরণকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘শোনো, তোমাকে যখন কমরেড শঙ্কর দলে নিয়ে এল তখন অনেকেই আপত্তি করেছিল, কিন্তু তুমি তখন আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে এত উৎসুক ছিলে যে আমি দলকে রাজি করাই। তুমি কথা বলতে পারো না, অসুবিধে হত কিন্তু কমরেড শঙ্কর বুঝিয়েছিল, ধরা পড়লে পুলিশ তোমার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না। আমরা অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম তুমি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু তখন তোমার ফিরে যাওয়ার পথ খোলা ছিল না। আজ পুলিশ যে আমাদের ধ্বংস করে দিতে কিছুটা সক্ষম হয়েছে তার জন্যে তোমার শরীর দায়ী। তোমার প্রসব বেদনা শুরু না হলে আমরা এখান থেকে সহজেই চলে যেতে পারতাম। তোমার জন্যে আমাদের এই সর্বনাশ হয়ে গেল। এর পরে তুমি এখানে লুকিয়ে থাকতে পারো না।’

চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল মামণি। শিশুকে সে কোলে নিয়ে বসেছিল পাথরের মতো।

কালীচরণ এগিয়ে এল, ‘বাবু আপনি চলে যান।’

‘একদম কথা বলবে না। তোমার এখানে কি দরকার অ্যাঁ?’ খেঁকিয়ে উঠল ছেলেটি। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে আর কতবার এক কথা বলতে হবে?’

মামণি মাথা নেড়ে আবার না বলল।

ছেলেটি বনবিহারীর দিকে তাকাল, ‘ওকে বলেছেন?’

‘কি?’ বনবিহারীর কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘পুলিশ আমাদের দলের সবাইকে—।’

‘না।’ ছেলেটিকে থামিয়ে দিলেন বনবিহারী, ‘ওকে আপসেট করতে চাইনি।’

‘আশ্চর্য! এতগুলো ছেলেকে পুলিশ বিনা কারণে মেরে ফেলল আর আপনি একথা চেপে গেলেন? শোনো, আমি ছাড়া আর যেসব ছেলে দলে ছিল তাদের কেউ বেঁচে নেই। সবাইকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে।’ ছেলেটি বেশ জোরে বলল।

চমকে তাকাল মামণি। তাকিয়েই থাকল।

‘সবাই মারা গিয়েছে যখন তখন বুঝতেই পারছ কমরেড শঙ্করও বেঁচে নেই।’ ছেলেটি খুব শান্ত গলায় খবরটা জানাল।

হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল মেয়েটি। কান্নায় শুধু গোঙানির শব্দ। শিশুর শরীরের ওপর মুখ চেপে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল মামণি। সেই শব্দে তীব্রস্বরে কেঁদে উঠল শিশু।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শঙ্করের পুরো নাম কি?’

‘আপনি কি করে ভাবছেন আপনাকে আমি জানাবো!’

‘একটা কথা বলো, এই শিশুর বাবা কি ওই শঙ্কর?’

‘আমি তো তাই জানি।’

দু-হাতে মুখ ঢাকলেন বনবিহারী। এই শিশুর কি হবে? বাবা মারা গেছে এ জন্মানো মাত্র, মা কথা বলতে পারে না। ভবিষ্যৎ একে কি দেবে?

মামণি কাঁদছিল। তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলল, ‘কমরেড শঙ্কর এবং আর যারা মারা গিয়েছে তাদের অসম্পুর্ণ কাজ শেষ করার দায়িত্ব আমাদের ওপরে, না-হলে তাদের আত্মা কখনই শান্তি পাবে না। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?’

এতক্ষণে মামণি স্থির হল। মুখ না তুলে মাথা নেড়ে নিঃশব্দে জানাল সে বুঝতে পারছে।

‘বাঃ। তাহলে আর দেরি করো না। তৈরি হও।’

মামণি বনবিহারীর দিকে তাকাল। ওকে খুব অসহায় বলে মনে হল বনবিহারীর। ধীরে-ধীরে বিছানা থেকে নেমে মেয়েটা পাশের বাথরুমে চলে গেল।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওদের কোথায় নিয়ে যাবে তুমি?’

‘ওদের নয়, ওকে।’

‘আমি তোমাকে বলেছি শুধু শিশুর দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।’

‘এখন না বললে চলবে না ডাক্তারবাবু। হাসপাতাল থেকে ওদের এখানে আনার আগে একথা ভাবা উচিত ছিল।’ ছেলেটা হাসল।

‘আমি হাসপাতাল থেকে ওদের এখানে না নিয়ে এলে ওরা কোথায় যেত?’

‘কেন? মামার বাড়িতে যেত ও।’

‘মামার বাড়ি?’

‘আমি সদরের হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করেছি। সেখানে তো ড্রাইভার শম্ভুর বোন হিসেবে ওকে ভরতি করিয়েছেন। তার মানে শম্ভু এর মামা। মামা তার ভাগ্নিকে বাড়িতে নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি আনলেন কেন?’

‘শম্ভু নিজের নাম না ব্যবহার করলে হাসপাতাল ওকে ভরতি করত না। তখনই থানাকে জানিয়ে দিত।’ বনবিহারী বললেন।

‘সেটা আমি জানিয়ে দিই তা আপনি কি চাইছেন?’

‘মানে?’

‘আপনি যদি শিশুকে না রাখেন, যদি জোর করেন নিয়ে যেতে তাহলে থানা জানতে পারবে যে শম্ভুকে নিয়ে আপনি হাসপাতালে গিয়ে ওকে ভরতি করেছিলেন। ওখানে শিশুটি জন্মেছে। খাতায় শম্ভুর পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। এই মেয়েটিকে আপনি ওদের ভাষার উগ্রপন্থীদের ডেরা থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু এই খবরটা পুলিশের কাছে গোপন করেননি, মা এবং শিশুকে আপনার বাড়িতে এতদিন রেখেছিলেন কাউকে না জানিয়ে।’ ছেলেটি হাসল, ‘কথাগুলো যে সত্যি তা প্রমাণ করতে পুলিশের কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। তারপর উগ্রপন্থীদের গোপনে সাহায্য করার অপরাধে ডাক্তারবাবু কত বছর জেল খাটবেন তা একটু ভেবে দেখুন। অবশ্য এসব কিছুই হবে না যদি শিশুটিকে আপনি আপনার কাছে রেখে দেন। আমি কথা দিচ্ছি এই এলাকা ছেড়ে আমরা চলে যাব এবং কখনও আপনাকে বিরক্ত করব না। এবার বলুন, আপনি কি চান?’

ছেলেটির প্রশ্ন শেষ হতেই মামণি বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। এখন ওর পরনে সেই পোশাক যা সে জঙ্গলে পরেছিল। গম্ভীর মুখে বিছানা থেকে শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে একটু দেখল সে। তারপর বনবিহারীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শিশুকে এগিয়ে ধরল।

প্রতিবাদ করতে পারলেন না বনবিহারী। কাঁপা হাতে শিশুকে গ্রহণ করলেন। ছেলেটি বলল, ‘অনেক ধন্যাবাদ আপনাকে। চলো।’

মামণি মাথা নীচু করে কালীচরণের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে ছেলেটি তাকে অনুসরণ করল। পাথরের মতো ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বনবিহারী।

কালীচরণ বাইরের দরজা বন্ধ করে ছুটে এল এই ঘরে, ‘মামণিকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে চলে গেল ছোকরা। কিন্তু এ কি করলেন আপনি?’

‘ভবিতব্য।’ বিছানায় বসলেন বনবিহারী শিশুকে কোলে নিয়ে। তারপর বললেন, ‘এর কথা ভাবো কালীচরণ। জন্মাবার আগেই বাবাকে পুলিশ মেরে ফেলেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই মাকে হারাতে বাধ্য হল। এর বাপের বাড়ি কিংবা মামার বাড়ি কোথায় কোনওদিন জানতে পারবে না। ঈশ্বর এর কপালে কী লিখেছেন তা তিনিই জানেন। কিন্তু জোর করে যদি ওকে নিতে অস্বীকার করতাম তাহলে হয়তো আমাকে জেলে যেতে হত কিন্তু জঙ্গলে জঙ্গলে মায়ের সঙ্গে ঘুরে ও সাতদিনও বাঁচত না। আমি ডাক্তার,অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার চেষ্টা করি। কিন্তু এ তো অসুস্থ নয়। কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুপথযাথীকে মৃত্যুর মুখ থেকে সরিয়ে আনতে পারলাম, এটুকুই পাওয়া।’ শ্বাস নিলেন বনবিহারী, ‘তুমি একটা কাজ করো। পালবাবুর ড্রাইভার শম্ভুকে ডেকে নিয়ে এসো। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার।’

‘এত রাত্রে—!’

‘রাত হোক। বলবে খুব জরুরি। কাউকে না বলে চলে আসতে। যাও।’

শম্ভু যে পালবাবুর বাড়িতে থাকে তা কালীচরণ জানত। কিন্তু গঞ্জের নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হল মাথা খারাপ না হলে এত রাতে কেউ কাউকে ডাকতে যায় না। শম্ভুকে ডাকলে যদি পালবাবুর ঘুম ভেঙে যায় তাহলে কী বলবে সে তাঁকে? সে ভাবল বাড়ি ফিরে গিয়ে বলবে শম্ভু বাড়িতে নেই। গাড়ি নিয়ে বাইরে গেছে কোনও কাজে। অবিশ্বাস করার কিছু নেই এতে। কাল সকালে দেখা যাবে। গল্প বানিয়ে সে খুশি হলেও ঠিক করল পালবাবুর বাড়ির সামনে থেকে ঘুরে আসবে। তাতে মিথ্যেটা অর্ধেক বলা হবে। সে যে গিয়েছিল এটা তো সত্যি।

পালবাবুর বাড়ি অন্ধকার। আশেপাশেও কোথাও আলো জ্বলছে না। মোড়ের মাথার সব দোকান বন্ধ। কিন্তু দুটো লোক ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। তাদের একজন চিৎকার করল, ‘কে যায়?’

কালীচরণ দাঁড়াল। গলার স্বর জড়ানো। বোধহয় ভাটিখানা থেকে মদ গিলে ফিরছে। দ্বিতীয়জন কপালে হাত রেখে দেখে বলল, ‘উগ্রপন্থী নাকি?’

প্রথমজন বলল, ‘ধুস! তাদের সবকটাকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে।’

দ্বিতীয়জন বলল, ‘উঁহু। একটা পালিয়েছে।’

‘তা বটে। অ্যাই কে ওখানে? কথা বল। নইলে চেল্লাবো।’

বাধ্য হল কালীচরণ এগিয়ে যেতে। গিয়ে দেখল আলুওয়ালা নিমাই আর মাছওয়ালা কার্তিক সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

‘আমি কালীচরণ।’

‘অ্যাঁ! এই কাকে কী বলছিস? নমস্কার ভাই। কোথায় যাচ্ছ?’

‘ডাক্তারবাবু এখনও ফেরেননি। কোথায় যে চলে গিয়েছেন।’

‘ডাক্তারবাবু? সাক্ষাৎ ভগবান। তুমি ভগবানের সেবক। নমস্কার।’

‘তোমরা এখানে কি করছ?’

‘কিছু না। একটু সুখ-দুঃকের গল্প করছিলাম। ভাটিখানায় সবাই আজ উগ্রপন্থীদের নিয়ে গল্প করছিল।’

‘ওটা এখনও খোলা।?’

‘খোলা মানে। চাঁদের হাট বসেছে যে আজ। আমাদের পুরোনো বন্ধু বাদল, আরে যে মিলিটারিতে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল, সে আজ এসেছে। এসে সব্বাইকে জড়ো করে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। বিনি পয়সায় খেলে যা হয় গলা অবধি ভরে যায়! আমি আর আজ ওখানে যাব না। তুই কি যাবি?’

‘না, শালা শম্ভুটা আমার পেছনে লাগছিল। জোর করে নেশা করিয়ে মজা দেখছিল!’

সঙ্গে সঙ্গে কালীচরণ বলে উঠল, ‘শম্ভু? মানে ড্রাইভার শম্ভু?’

দুজনে একসঙ্গে মাথা নাড়ল।

কালীচরণ আর দাঁড়াল না। সোজা ভাটিখানায় চলে এল। সেখানে তখন চারজন বসে গুলতানি করছে মদের গ্লাস নিয়ে। তাদের একজন শম্ভু। কিন্তু শম্ভুর চোখমুখ দেখে কালীচরণের মনে হল না যে তার নেশা হয়েছে।

কালীচরণ শম্ভুকে ইশারা করল উঠে আসতে। পালবাবুর ভয়ে খুব কম পান করেছিল শম্ভু। কিন্তু তার মনে হল নেশা হয়ে গিয়েছে। নইলে ডাক্তারবাবুর কাজের লোককে শম্ভু এত রাত্রে ভাটিখানায় দেখছে কি করে?

সে উঠে এল। কালীচরণ ফিসফিস করে বলল, ‘ডাক্তারবাবু এখনই যেতে বলল। খুব বিপদ হয়েছে।’

‘বিপদ? কি বিপদ? পুলিশ এসেছে নাকি? ঘাবড়ে গেল শম্ভু।

‘না না। তোমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।’ কালীচরণ বলল।

শম্ভু সঙ্গীদের দিকে তাকাল। ওরা ঢুলছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে যখন এসেই পড়েছ এক গ্লাস দিতে বলি?’

‘না না না।’ জিভ বের করে মাথা নাড়ল কালীচরণ।

‘তাহলে চলো।’

বাইরে বেরিয়ে শম্ভু আবার বেঁকে দাঁড়াল, ‘কাল সকালে গেলে হবে না?’

মাথা নাড়ল কালীচরণ, ‘না।’

‘পালবাবু জানতে পারলে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে, চাকরি যাবে। বিনা পয়সার মদ পেয়েও আমি বেশি খেলাম না। তুমি আমাকে ডাকতে ও বাড়িতে গিয়েছিলে?’

‘না। এতরাত্রে কেউ যায়?’

‘তাহলে ভাটিখানায় ঢুকলে কি করে?’

‘নিমাই আর কার্তিক খবরটা দিয়েছিল।’

হাঁটতে শুরু করে শম্ভু আবর জিজ্ঞাসা করল, ‘কেসটা কি বল তো?’

কালীচরণ জবাব দিল না।

শম্ভু বলল, ‘বাচ্চাটা বেঁচে আছে তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে মেয়েটা কি ঝামেলা করছে?’

‘না না। সে চলে গিয়েছে।’

‘চলে গিয়েছে?’ দাঁড়িয়ে পড়ল, শম্ভু, ‘কোথায়?’

‘জানি না।’

‘কার সঙ্গে গেল?’

‘একটা ছেলে এসেছিল, তার সঙ্গে।’

দুটো হাত কপালে ঠেকালো শম্ভু। ‘উঃ। কি ভালো খবর! বেঁচে গেলাম। সবসময় বুকের মধ্যে কীরকম হত। আর কোনও চিন্তা নেই। তাড়াতাড়ি চলো।’

অন্ধকার রাস্তায় শম্ভু এত জোরে হাঁটছিল যে কালীচরণ তাল রাখতে পারছিল না। তার মনে হল অল্প মদ খাওয়ায় শম্ভুর শরীরে বল বেড়ে গেছে।

দরজা ঠেলতেই ওটা খুলে গেল। এবং তখনই কান্নার শব্দ কানে এল।

হকচকিয়ে গিয়ে শম্ভু জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি যে বললে ওরা চলে গেছে?’

‘মেয়েটা গেছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়নি।’ কালীচরণ ভেতরে ছুটল।

শম্ভুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘সর্বনাশ!’

ঘরে ঢুকেই কালীচরণ হেসে ফেলল। ডাক্তারবাবু চামচে করে জল নিয়ে শিশুর মুখে ঢালার চেষ্টা করছেন কিন্তু শিশু কিছুতেই সেই জল খাবে না।

কালীচরণ বলল, ‘সরুন। আমি দেখছি।’

‘কি করে কান্না থামাই বলো তো!’

‘ওর খিধে পেয়েছে। জলে কি হবে!’

‘ও। কিন্তু ওকে একা ফেলে কি করে দুধ গরম করব আমি?’

বিছানা থেকে শিশুকে কোলে তুলে নিতেই সে চুপ করে মুখ নাড়তে লাগল। কালীচরণ বলল, ‘আহা রে! যাওয়ার আগে মা খাইয়েও যায়নি। সোনা, সোনা, কেঁদো না। আমি এখনই টিনের দুধ গুলে তোমাকে খাওয়াচ্ছি’ তারপর বনবিহারীকে বলল, ‘ওকে বিছানায় না শুইয়ে কোলে রাখুন, তাহলে কাঁদবে না। আমি দুধ তৈরি করে নিয়ে আসছি।’ শিশুকে বনবিহারীর কোলে তুলে দিয়ে বলল, ‘শম্ভু এসেছে।’

‘ও। এখানেই ডাকো ওকে।’

কালীচরণ বেরিয়ে গেলে বনবিহারী অবাক হয়ে দেখলেন, ওই একরত্তি শিশু বিছানা এবং মানুষের কোলের তফাত দিব্যি বুঝে গেছে। এখন সে শান্ত।

শম্ভু ঘরে ঢুকে একটু দূরে দাঁড়াল, ‘বলুন।’

‘কালীর কাছে সব শুনেছ?’

‘সব না। একটু। কোথায় গেল ওর মা?’

‘জানি না। যে নিয়ে গেল সে শাসাল যে আমি যদি এর দায়িত্ব না নিই তাহলে পুলিশকে সব জানিয়ে দেবে। পুলিশ তোমাকে আর আমাকে জেলে পাঠাবে। তাই বাধ্য হয়ে নিতে রাজি হলাম।’

‘আর কখনও আসবে না?’

‘না।’ বনবিহারী বললেন, ‘এইটুকু শিশুকে আমি কীভাবে, মানুষ করব? বাড়িতে কোনও মেয়েমানুষ নেই। তোমাকে ডেকেছি পরামর্শ করতে।’

শম্ভু একটু ভেবে বলল, ‘একটা রাস্তা আছে।’

‘বল।’

‘আমার খুড়তুতো বোন থাকে কুচবিহারে। আট বছর বিয়ে হয়েছে কিন্তু বাচ্চা হয়নি। ডাক্তার বলেছে জামাই-এর জন্যেই বাচ্চা হচ্ছে না। ওরা দত্তক নিতে চাইছে এখন। একে যদি ওদের দিয়ে দিই তাহলে ওরা খুব খুশি হবে, বাচ্চাটাও বেঁচে যাবে। আপনি কি বলেন? শম্ভু বলল।

‘এ তো খুব ভালো কথা। তুমি কালই তোমার বোনের সঙ্গে কথা বল।’

‘কাল হবে না। পরশু ছুটির দিন। কুচবিহারে গিয়ে কথা বলব। আপনি বলছেন ওরা আর বাচ্চার জন্যে আসবে না?’

‘না।’

‘তাহলে আমি আজ যাচ্ছি।’

‘হ্যাঁ। শোনো, একথা ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাউকে বলবে না। পালবাবুকেও না বুঝতে পেরেছ?’

শম্ভু মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতেই কালীচরণ দুধের বোতল নিয়ে কাছে এসে বলল, ‘আপনি খাওয়ান। দেখবেন, বেশি যেন না খায়।’

বনবিহারী সন্তর্পণে বোতলের নিপল শিশুর মুখের সামনে ধরলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *