দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ৫

পাঁচ

বনবিহারী ঘরে ঢুকে দেখলেন, দেখে মুগ্ধ হলেন। মা মেরির কোলে যিশুর ছবি মনে পড়ল তাঁর। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছ এখন?’

চমকে শিশুকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরল মা। তখনই বনবিহারীর মনে হল ওর যে নামই থাকুক আজ থেকে ওকে তিনি মামণি বলে ডাকবেন। কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোমার কোনও ভয় নেই মামণি, ওকে কেউ তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আমি কথা দিচ্ছি।’

অবাক হয়ে তাকাল সে। মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘তোমার সন্তান তোমারই কাছে থাকবে।’

একটু যেন স্বস্তি পেল মেয়েটি। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি ফুটল।

বনবিহারী বললেন, ‘মামণি, এবার যাও বাথরুম থেকে ঘুরে এসো। অনেকক্ষণ তুমি এভাবে বসে আছ। আমি তোমার বাচ্চাকে পাহারা দিচ্ছি।’ একটু ইতস্তত করল মামণি, যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না তার।

মামণি। তোমাকে আমি মা বলে ডাকছি! যাও।’

এবার শিশুকে দু-হাতে তুলে এগিয়ে ধরল মামণি বনবিহারীর দিকে। তিনি সাবধানে গ্রহণ করলে সে বিছানা থেকে নেমে এল। এতটুকু শিশুকে সামলে ধরে রাখতে বনবিহারী ভয় পাচ্ছিলেন বলে বিছানায় বসে পড়লেন। মামণি এবার হাসল। তার ঠোঁট নড়ল। কিন্তু কোনও শব্দ বের হল না। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

image8.jpg

কয়েক দিনের শিশু তখন চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। তুলতুলে শরীর। তাঁর ধরে রাখার মধ্যে কোনও খামতি থাকায় সম্ভবত শিশুর অস্বস্তি হল, ঠোঁট একটু কুঁচকে উঠল। কোলে শুইয়ে দিলেন তিনি। দু’তিনবার মুখ ঘুরিয়ে আরামের ভঙ্গি খুঁজে নিয়ে শিশু স্থির হয়ে ঘুমোতে লাগল। পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণী মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাঁটতে শিখে যায়! আধঘণ্টার মধ্যে টালমাটাল দৌড়ায়। হরিণশিশু বা গরুর বাচ্চা যত চটপট বড় হয়, মানুষের শিশুর পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। দীর্ঘকাল তাকে পরিচর্যা করতে হয়। স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে অন্য প্রাণীরা মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে।

সকালে চেম্বারে যাচ্ছিলেন বনবিহারী। দূর থেকে দেখলেন চৌমাথায় বেশ ভিড় জমে গেছে। কেউ খুব চিৎকার করছে। যে ছেলেটি তাঁর চেম্বার খোলে সে বলল, ‘ডাকাত ধরা পড়েছে। পালাতে পারছে না। সবাই ঘিরে রেখেছে। ওর হাতে পিস্তল আছে।’

শেষ কথটা শুনে কৌতূহল হল বনবিহারীর। চেম্বারে না ঢুকে তিনি চৌমাথায় গেলেন। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গঞ্জের লোকজন। মাঝখানে পিস্তল এবং সাইকেল নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে চিনতে অসুবিধে হল না।

ছেলেটা তখন বলছে, ‘আবার বলছি, আপনারা ভুল করছেন। আমি ডাকাত নই। আমরা এই দেশের চেহারাটাকে বদলে দিতে চাই। আমরা আপনাদের জন্যেই লড়ছি। দয়া করে যেতে দিন আমাকে।’

একজন চিৎকার করল, ‘কদিন থেকে দেখছি সাইকেল নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গঞ্জে ঘুরছ। ডাকাতি করার আগে একজন এসে খোঁজখবর নেয়। তুমি তা নয় কি করে বুঝব?’

‘আশ্চর্য! আমার চেহারা দেখে আপনাদের ডাকাত বলে মনে হচ্ছে? আমার কমরেডদের পুলিশ গুলি করে মেরেছে। কথা বলার সুযোগও দেয়নি। ভাগ্য ভালো থাকায় আমি বেঁচে গেছি। তারপরই আমি এই এলাকা থেকে চলে যেতে পারতাম কিন্তু একজনের জন্যে যেতে পারছি না। ছেড়ে দিন পথ, আমাকে বিশ্বাস করুন।’ ছেলেটি করুণ স্বরে বলল।

এইসময় মিষ্টির দোকানের মালিক জীবন ঘোষ বনবিহারীকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘এই যে ডাক্তারবাবু এসে গেছেন। কি করা যায় বলুন তো! উস্কোখুস্কো চুল, ময়লা পোশাক, হাতে পিস্তল, কাগজে যে সব উগ্রপন্থীদের কথা শুনেছি, এ তাই নাকি?’

বনবিহারী কিছু বলার আগেই ছেলেটির নজর পড়ল তাঁর ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তেজিত হল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি তো আমাকে চেনেন, আপনি ওদের বলুন, প্লিজ।’ বনবিহারী অস্বস্তিতে পড়লেন। গঞ্জের যেসব মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে তারা এখন তাঁর দিকে তাকিয়ে। ছেলেটি তখন জনতাকে বলছে, ‘উনি খুব ভালে মানুষ। আমাদের একজনকে উনি বাঁচিয়েছেন। আমাকেও চেনেন। আপনারা ওঁর মুখে শুনুন।’

জীবন ঘোষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ওকে চেনেন?’

‘দেখেছি। একবার আমার চেম্বারে এসেছিল।’ বনবিহারী নীচু গলায় বললেন।

‘ও কি ডাকাত না উগ্রপন্থী?’

‘ডাকাত বলে মনে হয় না।’ বনবিহারী বললেন।

‘অ।’

সঙ্গে সঙ্গে জনতা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। ডাকাত নয় যখন তখন আর আটকে রেখে লাভ কি! অন্য দল বলল, না হোক ডাকাত, পিস্তল হাতে ধরা পড়েছে, জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে, ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া দরকার।

এইসব কথা বলার সময় জনতা একটু এলোমেলো হওয়া মাত্র ছেলেটা সাইকেলে চেপে বসে শূন্যে গুলি ছুড়ল। গুলির আওয়াজ কানে যাওয়ামাত্র ভয় পেয়ে জনতা ছিটকে গেল এদিক-ওদিক। সঙ্গে সঙ্গে জোরে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। সম্বিত ফিরে পেয়ে হইহই করে জনতা দৌড়ল ওর পেছনে। সাইকেল জোগাড় করে কয়েকজন পিছু ধাওয়া করল। কিন্তু কেউ ওর নাগাল পেল না। শোনা গেল যে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এরকম গরম নাটকের এই পরিণতিতে সবাই খুব হতাশ হল।

চেম্বারে ফিরে এলেন বনবিহারী। তাঁর মনে কু ডাকছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে এই তথ্য না জানিয়ে অনেক আগেই পিস্তল থেকে গুলি ছুড়ে ছেলেটা সাইকেলে চলে যেতে পারত। গঞ্জের লোকেরা তাঁকে সন্মান করে। তাই এখনও কেউ তাঁকে সন্দেহের চোখে দ্যাখেনি। তিনি ডাক্তার, তাঁর কাছে যে-কোনও মানুষ চিকিৎসার জন্যে আসতেই পারে। সেই লোকটি ডাকাত না উগ্রপন্থী তা তিনি জানবেন কি করে?

রুগি দেখতে দেখতে একটা সময় চিন্তাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সাড়ে এগারোটা নাগাদ জীবন ঘোষ এল তাঁর চেম্বারে। তখন চারজন রুগি বসে আছেন। তাঁদের ধর্তব্যের মধ্যে না এনে জীবন ঘোষ বললেন, ‘খবরটা শুনেছেন ডাক্তারবাবু?’

‘কি খবর?’ প্রেসক্রিপশন লিখতে-লিখতে জিজ্ঞাসা করলেন বনবিহারী।

‘এক ট্রাক পুলিশ আর জিপ নিয়ে থানার বড়বাবু জঙ্গল সার্চ করতে চলে গেছেন। এবার ছোঁড়াটা মারা পড়বেই।’ জীবন ঘোষ বলল।

বনবিহারী কিছু না বলে কাজ করে যেতে লাগলেন।

‘আচ্ছা, ধরে নিলাম ও ডাকাত নয়, উগ্রপন্থী। কি না দেশের হাল বদলাতে পিস্তল নিয়ে নেমেছে। ছোঁড়াগুলোর কি মাথা খারাপ? বনে-জঙ্গলে ভিজছে, রোজ খাওয়াও জুটছে না ঠিক মতো, বাড়ির আরাম ছেড়ে কি নেশায় এসব করছে? যে দেশে এত পুলিশ, এত মিলিটারি সেই দেশের সরকারের সঙ্গে তোরা পেরে উঠবি? ব্যাঙাচি লড়াই করতে পারে হাতির সঙ্গে। হুঁঃ। একটু বাদেই চৌমাথায় ওর ডেডবডি দেখতে পাব। তা যেটা বলছিলাম, ওর অসুখটা কি?’

‘অসুখ?’ বনবিহারী মুখ তুললেন।

‘ওই যে, তখন বললেন, এই চেম্বারে এসেছিল—!’

‘ও। পেটে ব্যথা হচ্ছিল খুব।’ বনবিহারী গম্ভীর গলায় বললেন।

‘হবে না? জঙ্গলে খাবার কোথায়? না খেয়ে-খেয়ে পেটে ব্যথা হয়েছে। কিন্তু দেখুন, ওই শরীর নিয়ে কীরকম পাঁই-পাঁই সাইকেল চালাল! আচ্ছা, চলি।’

দুপুরের শেষ রুগি চলে যাওয়ার পর বনবিহারী যখন বাড়ি ফিরবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন তখন পুলিশের জিপ তাঁর চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। বড়বাবু জিপ থেকে নেমে সোজা ভেতরে চলে এলেন, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু, অসময়ে বিরক্ত করতে এলাম।’

‘ডাক্তারদের তো সময়-অসময় বলে কিছু নেই।’ বনবিহারী বললেন।

‘আমি কিন্তু রুগি হিসেবে আপনার কাছে আসিনি।’

‘বেশ তো। বসুন।’ বনবিহারী আবার নিজের চেয়ারে বসলেন।

বড়বাবু বসলেন। চারপাশে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে উগ্রপন্থীদের একটা দল হঠাৎ এই অঞ্চলের জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিল। ওদের প্ল্যান ছিল স্কুলবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, পুলিশ মারা। আগাম খবর পেয়ে আমরা জঙ্গলে হানা দেওয়ায় ওরা মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে একজন স্বীকার করেছিল ওদের দলে ক’জন ছিল। যা ডেডবডি পেয়েছিলাম তার সংখ্যা দুটো কম হওয়ায় আমরা ভেবেছিলাম ছেলেটা এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ওরা যে গঞ্জে নানান ধান্ধায় আসা-যাওয়া করে সেই খবর কেউ আমাদের জানায়নি। আজ সকালে লোকজন একজনকে ডাকাত ভেবে ধরে ফেলে। এসব কথা আপনার জানা। ছেলেটা আপনাকে সাক্ষী করেছিল যাতে আপনি বলেন সে ডাকাত নয়। আপনি সেটা বলায় মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং সেই সুযোগে ছেলেটা পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে জঙ্গলে চিরুনি তল্লাশি করেও ওদের দুজনকে ধরতে পারিনি।’

একটানা বলে বড়বাবু শ্বাস ফেললেন, ‘এই চেম্বারে ও এসেছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘এসে কি বলেছিল?’

‘পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল।’

‘আপনি ওকে আগে দেখেছেন?’

‘না।’

‘এই গঞ্জের কেউ নয়, চিনতে পারছেন না, ওকে প্রশ্ন করেননি?’

‘করেছিলাম। বলল, নাথুয়া থেকে এসেছেন। ওখান থেকে মাঝে-মাঝে দু একজন আসেন। ওখানকার সবাইকে তো আমি চিনি না।’

‘ডাক্তারবাবু। ছেলেটার চেহারা দেখে আপনার সন্দেহ হয়নি?’

‘মানে?’

‘যা শুনলাম, ওর পোশাক নোংরা, স্নান না করায় চুল উস্কোখুস্কো। দেখলে বোঝাই যায়, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে না।’

‘কেউ অসুখ নিয়ে এলে তার চেহারা দেখার কথা মনে আসে না।’

‘ওষুধ দিয়েছিলেন?’

‘পরীক্ষা না করিয়ে ওষুধ দেওয়া যায় না। তাই যন্ত্রণা কমাতে ওকে পেইন কিলার দিয়েছিলাম।’ বনবিহারী বললেন।

‘ওষুধের দাম দিয়েছিল?’

‘আমি ফিজিসিয়ান স্যাম্পেল থেকে কাউকে ওষুধ দিলে দাম নিই না। নেওয়া উচিত নয়। তারপর আজ ছেলেটাকে দেখলাম।’

‘সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন ও ডাকাত নয়!’

‘আশ্চর্য! আমি ওকে ডাকাতি করতে দেখিনি, কি করে ডাকাত বলব?’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না কত বড় অপরাধ করেছেন! ওকে পালাতে সাহায্য করেছেন পরোক্ষভাবে। এইসব দেশদ্রোহীদের ছেড়ে রাখলে আবার ষড়যন্ত্র করবেই। আপনি জানেন কয়েকদিন আগে উগ্রপন্থীদের পুলিশ মেরেছে। ওই চেহারার অচেনা ছেলেকে দেখতে পেয়ে আমাদের খবর দেওয়া আপনার কর্তব্য ছিল।’

বনবিহারীর মনের মধ্যে যে আশংকা ছিল সেটা এখন প্রবল হল। কিন্তু তিনি চেষ্টা করলেন নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে। বললেন, ‘দেখুন, একজন পেশেন্ট চিকিৎসার জন্যে আমার কাছে এসেছে, আমি তার চিকিৎসাটুকু করেছি। কেউ তো নিজে থেকে বলবে না আমি উগ্রপন্থী। আমার সঙ্গে কথা বলার সময়ে সে বিন্দুমাত্র সেই আভাস দেয়নি। কল্পনা করে নিয়ে আপনাকে খবর দেওয়ার কথা আমার মনে আসেনি।’

‘আপনি ভেবে দেখুন, কতবড় সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। এই অঞ্চলে উগ্রপন্থীরা অশান্তি সৃষ্টি করুক এটা নিশ্চয়ই আপনি চান না। আপনি এখানকার একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ, জনহিতকর কাজ হাতে নিয়েছেন, তাই আমার পক্ষে এখনই আপনাকে কিছু বলতে অসুবিধে হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে যদি এই ছেলেদের দেখতে পান তাহলে দয়া করে খবর দেবেন। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে ওদের প্রতি আপনার সমর্থন আছে এমন সন্দেহ আমাদের মনে তৈরি করতে। আচ্ছা, উঠছি।’ অফিসার উঠে দাঁড়ালেন।

বনবিহারীও উঠলেন। ‘আপনি বললেন দুজন সেই রাত্রে আপনাদের হাত থেকে পালাতে পেরেছিল। একজন যদি এই ছেলেটি হয় দ্বিতীয়জন কোথায়?’

‘কোনও হদিস পাচ্ছি না তার। হয়তো গভীর জঙ্গলে চলে গেছে। ছেলেগুলোর শরীর যে কি দিয়ে তৈরি তা ঈশ্বর জানেন। এই জঙ্গলে খাবার নেই, ফল পাওয়া যায় না অথচ ওরা দিনের পর দিন ওখানেই ঘুরে বেড়ায়। সমস্যা কি জানেন, জঙ্গলের ধারে যেসব আদিবাসী থাকে তারা ওদের ব্যাপারে কিছুতেই মুখ খুলতে চায় না। আমার সন্দেহ, ওরাই খাবার জোগায়। এসপি সাহেবকে সব জানিয়েছি। দেখি—!’ অফিসার বেরিয়ে গিয়ে জিপে উঠলেন। বনবিহারী অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর সামনে থেকে শেষ সুযোগ চলে গেল। দ্বিতীয়জন যে নারী সে তাঁর বাড়িতে আছে একথা পুলিশকে এখনই জানিয়ে দিলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা যেত। এর পরে আর জানানো সম্ভব নয়!

দিন পনেরো কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। সকাল এবং দুপুরে খেতে আসার সময়ে বনবিহারীর মহানন্দে কাটছে মামণি এবং তার শিশুর সংস্পর্শে। এই বাড়ির আবহাওয়াই যেন বদলে গেছে। বনবিহারীর আশংকা ছিল যদি মামণি বাইরে বেড়াতে যায় তাহলে অনেকের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তাঁর মা গত হওয়ার পর থেকে এই বাড়িতে প্রতিবেশী মহিলাদের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়েছে। দুটি অবিবাহিত পুরুষের বাড়িতে কোনও মহিলার প্রয়োজন থাকতে পারে না। কিন্তু মামণিকে দেখলেই তাদের কৌতূহলও উথলে উঠবে। মামণিকে ব্যাপারটা বোঝানো দরকার। আবার এটাও সত্যি, ওই বয়সের মেয়ের পক্ষে নিজেকে বাড়ির ভেতর বন্দি করে রাখা খুবই কষ্টকর। কিন্তু কালীচরণের মুখে শুনতে পেলেন, বাড়ির বাইরে দূরের কথা, বাইরের ঘরেও যায় না মামণি। বাথরুম, খাওয়ার ঘর আর নিজের ঘরের চৌহদ্দিতে নিজেকে আটকে রেখেছে সে। কেউ যদি বাইরের দরজায় কড়া নাড়ে, চমকে ওঠে মামণি। কাঠ হয়ে বসে থাকে যতক্ষণ না কালীচরণ আবার দরজা বন্ধ করে ফিরে আসে।

আজ দুপুরের খাওয়ার সময় মামণি ধীরে-ধীরে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খাওয়া হয়েছে?’

মামণি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

‘ছাই হয়েছে!’ কালীচরণ বলল, ‘খেতেই চায় না। জোর করে খাওয়াতে হয়।’

‘না মা। তুমি না খেলে বাচ্চাটার স্বাস্থ্য ভালো হবে না। এখন তোমার পেটভরে খাওয়া আর বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুম দরকার রোজ।’ বনবিহারী সস্নেহে বললেন।

চেম্বার থেকে বেরিয়ে আজ রাত আটটা নাগাদ বিডিও অফিসে যেতে হল বনবিহারীকে। ডি এম জানতে চেয়েছে প্রস্তাবিত হেলথ সেন্টার সম্পর্কে কয়েটি তথ্য, সে-ব্যাপারে আলোচনার দরকার। লাল ফিতের জট ক্রমশ খুলে আসছে, বনবিহারী নতুন করে উদ্দীপ্ত হলেন।

বিডিও ছেলেটি তরুণ। সবে ডব্লু বি সি এস পাশ করে চাকরিতে এসেছেন। বনবিহারী ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করলেন। বনবিহারী দেখলেন গঞ্জের আরও চারজন ব্যাক্তিত্ব এসে গেছেন।

বিডিও বললেন, ‘ডি এম জানতে চেয়েছেন হেলথ সেন্টারের জন্যে যে জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে সেটিতে চাষ হয় কিনা। দুই, সরকার সরাসরি দায়িত্ব নেবে না, কিন্তু হেলথ সেন্টারের পরিচালনা কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধিরা থাকবেন। তিন, একটা বোর্ড গঠন করতে হবে যাঁদের মাধ্যমে হেলথ সেন্টার পরিচালিত হবে। আনুমানিক বাজেট তৈরি করে ডি এমকে জানাতে হবে।’

এই নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলল। শেষ পর্যন্ত বিডিও বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনিই তো প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আপনার বক্তব্য কী?’

বনবিহারী বললেন, ‘ডি এম যা যা জানতে চেয়েছেন তা জানানোর ব্যাপারে অসুবিধে নেই। কিন্তু অন্যসব জায়গায় যখন হেলথ সেন্টার সরকারি প্রশাসনে চালিত হয়, এখানে তা হবে না কেন?’

বিডিও বললেন, ‘দেখা গেছে পাবলিক সেক্টারে বেশি কাজ হয়। পয়সা থাকলে লোকে হাসপাতালে না গিয়ে নার্সিংহোমে যায়।’

‘ঠিক। কিন্তু এখানকার কারও প্রশাসনের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া যেসব ডাক্তার এবং নার্স আসবেন তাঁরা যদি সরকারি চাকুরে না হন তাহলে তাঁদের পেতে অসুবিধে হবে। হেলথ সেন্টারে স্টাফ কারা হবেন? সরকার তাঁদের নিয়োগ করবেন, না আমরা? আমাদের পক্ষে তখনই সম্ভব যখন টাকার জোর থাকবে। সেটা তো নেই।’

পালবাবু বললেন, ‘হেলথ সেন্টারে তো বড় অপারেশন সম্ভব হবে না। সাধারণ অসুখ-বিসুখ, ছোটখাটো অপারেশন অথবা মেটার্নিটি ওয়ার্ড থাকলেই আমাদের মঙ্গল। তা এই ব্যাপারটা তো ডাক্তারবাবুর অধীনে একজন ডাক্তারই করতে পারেন।’

বনবিহারী অবাক হলেন, ‘আমি? এতটা কাল শুধু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে কাটিয়েছি। প্রসূতিকে বাঁচাতে হলে, বাচ্চাকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনতে হলে তখনই সিজারিয়ান করা দরকার। আমার পক্ষে অনভ্যস্ত হাতে ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব? তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে। আপনারা চাইলে আমি সপ্তাহে তিনদিন আউটডোরের পেশেন্টদের দেখতে পারি। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে অ্যামেচারিশ কিছু না করে অনেক বেশি প্রফেশন্যাল হওয়া উচিত। বিডিও সাহেব যদি ডি এম সাহেবের সঙ্গে একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট করেন তাহলে সামনাসমানি ওঁর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।’

সেটাই সিদ্ধান্ত হল। আগামীকালই ডি এম সাহেবের সঙ্গে দেখা করে কথা বলে দিন ঠিক করবেন বিডিও। মিটিং ভাঙার আগে বিডিও বললেন, ‘আর একটা কথা। আমাদের এই অঞ্চল খুব শান্তিপূর্ণ জায়গা। কিন্তু আপনারা জানেন এখানেও উগ্রপন্থীরা ঘাঁটি গেড়েছিল। পুলিশ ঠিক সময়ে তাদের ধ্বংস করেছে। যদিও দুজন উগ্রপন্থী পুলিশের হাত এড়িয়ে গেছে। আপনারা এখানকার গণ্যমান্য মানুষ। দয়া করে প্রচার করে দিন কোনও সন্দেহভাজন লোককে দেখলেই যেন তারা আমাকে বা পুলিশকে জানায়। অচেনা লোক এলে তার ওপর যেন সবাই নজর রাখে।’

পালবাবু বললেন, ‘নিশ্চয়ই। তবে গঞ্জের কিছু লোক বলছে বিনা বিচারে গুলি করে মারা নাকি শোভন হয়নি।’

বিডিও বললেন, ‘পুলিশ রিপোর্ট দিয়েছে আত্মরক্ষার জন্যে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল।’ বিডিও হাসলেন, ‘ছেলেগুলো যে অনেক অস্ত্র নিয়ে এসেছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’

বিডিও-র অফিস থেকে বেরিয়ে অন্যরা যে যার মতো বাড়ির পথ ধরলেও পালবাবু বনবিহারীর সঙ্গী হলেন। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘এই বিডিও ছেলেটি বেশ উদ্যোগী। মনে হচ্ছে ও ডি এমকে রাজি করাতে পারবে। কি বলেন?’

বনবিহারী বললেন, ‘দেখা যাক।’

‘আমি কিন্তু একটা কথা ভাবছি।’ পালবাবু বললেন।

‘কি কথা?’

‘হেলথ সেন্টারে গিয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাবার সুযোগ পেলে কেউ তো আর আপনার চেম্বারে যাবে না। খুব অসুবিধায় পড়ে যাবেন আপনি।’ পালবাবু বললেন,

বনবিহারী বললেন, ‘সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হবে। আমি যদি চাকরি করতাম তাহলে যে বয়সে পৌঁছে অবসর নিতে হত সেই বয়সে তো পৌঁছেই গিয়েছি। ডাক্তার, উকিল আর ব্যবসায়ীদের আমৃত্যু কাজ করে যেতে হয়। এটা ঠিক নয়।’

‘আর্থিক সমস্যা হবে না?’

‘আমার আর খরচ কি! দুটো লোকের জন্যে ডালভাত, তা হয়ে যাবে।’

‘উহুঁ ডাক্তারবাবু, দুটো নয়, ঠিক বললে বলতে হয়, চারজন।’

চমকে পালবাবুর দিকে তাকালেন বনবিহারী।

পালবাবু গলা নামালেন, ‘আপনি কিন্তু কাজটা ভালো করলেন না।’

‘কোন কাজ?’

‘মেয়েটাকে বাচ্চা সমেত বাড়িতে রেখে দিলেন। পুলিশও খবর পেয়েছে দুটো উগ্রপন্থী গা ঢাকা দিয়েছে। একজন যদি ওই ছেলে হয় অন্যজন নিশ্চয়ই এই মেয়েটা। যদি পুলিশ জানতে পারে তাহলে ওদের তো ধরবেই, আপনাকেও ছাড়বে না।’ পালবাবু বললেন।

‘আপনি জানেন সেই রাত্রে মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে না গেলে বাঁচানো যেত না। যখন নিয়ে গিয়েছিলাম তখন ও যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল। কোনও অস্ত্র ওর সঙ্গে দেখিনি যে ওকে উগ্রপন্থী বলে ভাবব। তারপর যখন আবিস্কার করলাম মেয়েটি কথা বলতে পারে না, কোথায় যাবে জানাতে পারছে না অথবা চাইছে না তখন তো ওকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারি না। ও যে অপরাধী, ভারত সরকারের পক্ষে খুব বিপদজনক তার কোনও প্রমাণ আমি পাইনি। এর মধ্যে সে একটি শিশুর জন্ম দিয়েছে। ফুটফুটে দেখতে। এই শিশুকে তো উগ্রপন্থী ভাবতে পারছি না। পুলিশ যদি আমার বাড়িতে এসে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে ছিল বলে মেয়েটিকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায় তাহলে শিশুটির কি গতি হবে? তর্কের খাতিরে যদি বলেন মেয়েটিও উগ্রপন্থী তাহলে জিজ্ঞাসা করব উগ্রপন্থী মায়ের পেটে যে বাচ্চা থাকে তাকেও কি উগ্রপন্থী বলা হবে? পালবাবু, ওই শিশুটিকে বাঁচানোর জন্যেই মেয়েটিকে আমার বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। মায়ের দুধ ছেড়ে ও যখন স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত হবে তখন কোনও হোমে ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।’ বেশ আন্তরিক গলায় কথাগুলো বললেন বনবিহারী।

‘বাচ্চার বাবা কে?’

‘জানি না জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু ও তো কথাই বলতে পারে না।’

‘লিখতে নিশ্চয়ই পারে!’

‘পারে। কিন্তু ওই উত্তরটা দিতে চায়নি বলে লেখেনি। এমনকী নিজের বাড়ির ঠিকানাও জানাতে চায়নি।’

‘ও সারাদিন কি করে?’

‘বাচ্চাকে আগলে বসে থাকে। ভয় পায়, কেউ যদি কেড়ে নেয়!’

‘ব্যাপারটা আর কেউ জানলে ক্ষতি হবে আপনার। আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি কাউকে বলব না। শম্ভুকেও নিষেধ করে দিয়েছি। ও বেশ ভয়ে ভয়ে আছে। হাসপাতালে আগ বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে এখন ভাবছে না দিলেই ভালো হত। আচ্ছা, এবার আমি ডান দিকে যাব।’ পালবাবু দাঁড়ালেন।

‘ও হ্যাঁ। তাই তো!’

‘আমি যদি একদিন আপনি থাকাকালীন গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসি তাহলে কি আপনার আপত্তি আছে?’

অস্বস্তিতে পড়লেন বনবিহারী। বললেন, ‘ও কিন্তু বাইরের লোকের সামনে আসবে না।’

‘আমিই না হয় ভেতরে গিয়ে একবার দেখে আসব!’ পালবাবু হাসলেন, ‘চলি।’

অন্যমনস্ক বনবিহারী হাঁটতে হাঁটতে খেয়ালই করলেন না যে তিনি গঞ্জের দোকানপাট এলাকা পেরিয়ে কালভার্টের ওপর এসে গেছেন। দুপাশে ঝাপড়া গাছ থাকায় পথ বেশ অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে হাঁটছিলেন বনবিহারী। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা সাপের লেজে পা দিলে আর দেখতে হবে না। হাঁটছিলেন, টর্চ জ্বেলে রাস্তাও দেখছিলেন কিন্তু বনবিহারী কিছুতেই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না। কালীচরণ মেয়েটাকে গ্রহণ করেছে কিন্তু ও কোত্থেকে এসেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। একমাত্র পালবাবু আর তার ড্রাইভার শম্ভু পুরো ব্যাপারটা জানে। নিজেরা না গিয়ে যদি থানায় একটা উড়ো চিঠিও ওরা পাঠায় তাহলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করবেই। সেটা করার আগে নিজে থেকে জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হয়তো মামণিকে জেলে পাঠাবে পুলিশ কিন্তু সদ্যোজাত শিশুকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করবে না। সেটা না করলে মামণির তো খুশি হওয়ার কথাই। তাঁকে পুলিশ অবশ্যই জেরা করবে। তিনি সত্যি কথাই বলবেন। মাঝরাতে কল পেয়ে পেশেন্ট দেখতে গিয়ে জানতে পারেন মেয়েটি প্রসববেদনায় কষ্ট পাচ্ছে। সিজারিয়ান ছাড়া বেবি বের হবে না। যারা তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের অনুরোধ তিনি পালবাবুর কাছ থেকে গাড়ি জোগাড় করে সদরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটিকে। সেখানে শিশু জন্মাবার পরে জানতে পারেন জন্মাদাত্রী বোবা। ফিরে এসে ছেলেদের হদিস পান না। বুঝতে পারেন মেয়েটির কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই মানবিকতার কারণে ওদের নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন।

পুলিশের কাজ অবিশ্বাস করা। এক্ষেত্রেও তারা তাই করবে। বনবিহারী স্থির করলেন সদরে গিয়ে ডি. এমের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সত্যি ঘটনাটা জানালে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। তাঁর প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল ডি এম। তিনি যদি পাশে থাকেন তাহলে পুলিশ তাঁকে অসন্মান করতে পারবে না।

‘ডাক্তারবাবু!’ অন্ধকার রাস্তার একপাশ থেকে ডাকটা ভেসে এল।

বনবিহারী দাঁড়ালেন, ‘কে ওখানে?’

এবার ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল, ‘আমি। প্রথমে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যদি আপনি আমাকে ডাকাত নই বলে সার্টিফিকেট না দিতেন তাহলে—।’

‘কি চাই?’ বনবিহারী খুব রেগে গেলেন।

‘আপনার সঙ্গে কথা বলতেই এখানে অপেক্ষা করছি।’

‘তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা থাকতে পারে না।’

‘আপনি মিছিমিছি রেগে যাচ্ছেন। শুনুন, আমার পক্ষে এখানে থাকা এখন খুব রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। আমি আজ রাত্রেই এই এলাকা ছেড়ে যেতে চাই। আপনি ওকে ছেড়ে দিন। আমরা চলে যাব। মনে রাখবেন, ওকে আপনার বাড়িতে রেখেছেন জানলে পুলিশ আপনাকে ছেড়ে দেবে না।’ ছেলেটি বলল।

‘আমি কাউকে ধরে রাখিনি। ও যদি যেতে চায় চলে যেতে পারে।’

‘ধন্যবাদ। মুশকিল হল ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। আপনার কাজের লোক কিছুতেই দরজা খুলছে না। ও যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাহলে আমাদের অনেক গোপন কথা ওকে চাপ দিয়ে বের করে নেবে। আপনি বাড়ি যান। আমি ঠিক দশ মিনিট বাদে যাচ্ছি। দরজাটা খোলা রাখবেন।’ ছেলেটি আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। হতভম্ব বনবিহারীর সম্বিত ফিরতে সময় লাগল।

বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আলো দেখতে পেলেন বনবিহারী। বাঃ! এটা তো শাপে বর হল। মামনি যদি ওর কমরেডের সঙ্গে চলে যায় তাহলে কারও কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে না। ডি এমকেও বলতে হবে না। কালীচরণ যদি অস্বীকার করে তাহলে পালবাবু বা শম্ভু যতই বলুক পুলিশ প্রমাণ করতে পারবে না যে তাঁর বাড়িতে ওরা ছিল। উলটে হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী শম্ভুরই ফেঁসে যাওয়ার কথা। সে তার বোনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে এসেছে। কোথায় রেখেছে সে-ই জানে।

শব্দ শুনে কালীচরণ জিজ্ঞাস করল, ‘কে?’

‘খোল। আমি।’ বনবিহারী বললেন।

দরজা খুলে কালীচরণ বলল, ‘আজ সন্ধের পর ভূতে দরজায় শব্দ করছে। কে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয়নি বলে আমিও দরজা খুলিনি।’

ঠিক করেছ। এখন খাবার রেডি করো। খিদে পেয়েছে।’

‘যাচ্ছি।’ কালীচরণ ভেতরে যাচ্ছিল, বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মামণি কি করছে? ঘুমিয়ে পড়েছে?’

‘ঘুমাচ্ছিল। যেই দরজায় শব্দ হচ্ছে চমকে উঠে বসছে। ওকে দেখা দিয়ে শান্ত করুন।’ কালীচরণ চলে গেল।

দরজা বন্ধ না করে ভেজিয়ে রাখলেন বনবিহারী।

শিশু ঘুমাচ্ছে। তার পাশে বসে মামণি উদ্বিগ্ন হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। বনবিহারীকে দেখতে পেয়ে হাসি ফুটল মুখে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছ?’

মাথা নেড়ে ভালো বলল মামণি।

‘তোমার ছেলে?

ছেলের দিকে তাকাল মামণি। গায়ের চাদর সরে গিয়েছিল, টেনে দিল।

‘শোনো মামণি। তুমি যাদের সঙ্গে জঙ্গলে ছিলে তাদের একজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তার নাকি খুব প্রয়োজন।’ বনবিহারী বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন।

‘আঁ। আঁ।’ একটা তীব্র চিৎকার ছিটকে বেরিয়ে এল মামণির গলা থেকে। চোখ বড় হয়ে উঠল। তীব্র বেগে মাথা নেড়ে না বলতে লাগল। আর সেই চিৎকারে চমকে উঠে শিশু কেঁদে উঠল। তাকে কাঁদতে দেখে দু’হাতে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল মামণি।

এইসময় কালীচরণের গলা ভেসে এল, ‘এই কে? হুট করে ঘরে ঢুকে এল কে? দরজা খোলা ছিল নাকি!’

বনবিহারী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন ছেলেটি তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *