দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ৩১

একত্রিশ

সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বনবিহারী। মামণির চলে যাওয়ার খবর এখন আর কারও জানতে বাকি নেই। রাস্তায় বের হলেই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, কোথায় গেল? কেন গেল? একটা দুধের বাচ্চাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়ার কি কারণ ঘটেছিল?

বনবিহারী উত্তর দিয়েছেন যখন যেমন মনে এসেছিল। আর তাতেই শেষ প্রশ্নটা জোরদার হয়েছিল, ‘যে ছিল সে ডাক্তারবাবুর কে?’ মেয়ে? বোন? বা স্ত্রী? মামণি যখন ছিল তখন এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, চলে যাওয়ার পর কৌতূহল প্রবল হয়ে বনবিহারীকে প্রায় ভিলেন করে তুলল।

এই অবস্থায় এখানে থাকাটা অসহ্য হয়ে উঠছিল। সমস্যা হল, তিনি একা সন্তানকে নিয়ে ফিরে যেতে পারেন কিন্তু মালতী সন্তানকে ছাড়তে চাইছে না। এই কয়দিনে সন্তানের ওপর তার মায়া এত বেড়ে গেছে যে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই রাজি হচ্ছে না। তাকে তার গ্রামে ফিরে যেতে বললে সে রাজি হচ্ছে না। তার বক্তব্য হল, সন্তানকে বড় করতে হলে কোনও না কোনও মহিলাকে প্রয়োজন হবেই, তাহলে সে কেন বঞ্চিত হবে? বনবিহারী তাকে বুঝিয়েছেন। সন্তানকে নিয়ে তিনি যেখানে যাবেন সেই জায়গা এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে। সেখান থেকে ঘনঘন গ্রামে আসাযাওয়া করতে পারবে না মালতী। এই সব যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছে মালতী, গ্রামে তার এমন কেউ নেই যে তার টানে সে ফিরে আসবে! গ্রামে থাকলে সতীত্ব বজায় রাখতে চাইলে বেশিরভাগ দিনেই এক বেলার খাবার জুটতো। সন্তানের কাছে আসার পর থেকে তো দু-বেলা পেট ভরে খেতে পারছে।

শেষ পর্যন্ত পরেশ মণ্ডল জানাল, কলকাতা থেকে চিঠি এসেছে। হেড অফিস খুব দুঃখের সঙ্গে তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেও অনুরোধ করেছে পুনর্বিবেচনা করতে। শুনে হাসলেন বনবিহারী, কিছু বললেন না।

ফিরে আসার আগের দিন তিনি মালতীকে পাঠালেন হাসপাতালে। অপারেশনের জায়গাটা কেমন আছে দেখিয়ে আসার জন্যে। ব্রজ মণ্ডলের স্ত্রীর কাছে বাচ্চাকে রেখে মালতী গেল নিতান্ত অনিচ্ছায়।

লঞ্চের সবার মুখ ভার। ডাক্তার-বাবুর চলে যাওয়াটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। আজ শেষবার ডাক্তার বনবিহারী বেরিয়েছেন রোগী দেখতে। প্রতিদিনের মতো তরতর করে ছুটছে না লঞ্চ। যেন যেতে ইচ্ছে করছে না, যেতে হয় তাই যাওয়া। বনবিহারী তাঁর চেয়ারে বসে ছোটুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি রে? লঞ্চের কি হল? এত আস্তে যাচ্ছে কেন?’

ছোটু বলল, ‘লঞ্চেরও মন খারাপ।’

বনবিহারী লক্ষ করছিলেন। লঞ্চের সমস্ত কর্মী আজ গম্ভীর, কাজ করতে হবে বলে করছে। ধীরে-ধীরে বনবিহারীর মনও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হল। হিরো এসে খাবার দিয়ে গেলে একবার তাকিয়ে দেখলেন, খেতে ইচ্ছে করছিল না। তিনি বললেন, ‘হিরো, এখন নিয়ে যাও, পরে খিদে লাগলে বলব।’

অন্যদিন হলে হিরো জোর করত খাওয়ার জন্যে, আজ চুপচাপ খাবার নিয়ে ফেরত চলে গেল। এভাবে যাওয়া ওর স্বভাববিরুদ্ধ তা বনবিহারী জানেন, বিষণ্ণতা আরও বেড়ে গেল। দুপুরে যে ঘাটে লঞ্চ ভিড়ল সেখানে আগে কখনও আসেননি তিনি।

লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখলেন ঘন জঙ্গল পেরিয়ে যেখানে লঞ্চ থামল সেখানে থকথকে কাদা। কাদার ওপারে উঁচু জমিতে জনা পনেরো-কুড়ি মানুষ দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। রতন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওদের লঞ্চে আসতে বলব? আপনি নামতে চাইলে তক্তা ফেলতে হবে। যা বলেন।’

‘ওরা আসবে কীভাবে?’

‘কাদা মাড়িয়ে আসবে। ওদের অভ্যেস আছে।

বনবিহারী তাকালেন। তাঁর মনে হল হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাবে ওই কাদায় পা ফেললে। কোনও অসুস্থ মানুষ ওইভাবে এলে তার অসুস্থতা অবশ্যই বেড়ে যাবে। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘না। তক্তা ফেলতে বলো। আমি যাব।’

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তক্তা ফেলে ফেলে রাস্তা তৈরি করে দিল ওরা। বনবিহারী নীচে নেমে এলেন সন্তর্পণে, সঙ্গে ছোটু আর হিরো। হিরো চেঁচাল, ‘যারা ডাক্তারবাবুকে দেখাতে চাও তারা লাইন দিয়ে দাঁড়াও।’

হুটোপুটি পড়ে গেল লাইন তৈরি করতে। বনবিহারী লক্ষ করলেন জনা চারেক বৃদ্ধা বা প্রৌঢা ছাড়া কোনও অল্প-মধ্যবয়সি মহিলা ওদের মধ্যে নেই। ছোটুকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। ছোটু মাথা নাড়ল, ‘অসুখ করলেও ওরা আসবে না।’

‘কেন?’

‘পুরুষ ডাক্তারকে নিজের অসুখের কথা বলবে না।’

সুন্দরবনের গভীরে বাস করা মেয়েদের মনে এই সংকোচ এতদিন লক্ষ করেননি বনবিহারী। শুধু এই জায়গায় ব্যতিক্রম কেন তা আর জানতে চাইলেন না। রোগী দেখা আরম্ভ করলেন। অন্য গ্রামে গিয়ে যা দেখেছেন এখানেও অসুস্থতার কারণ একই। অনাহার, অর্ধাহারের কারণে অসুস্থতা। মুশকিল হল ওদের বলাই যাবে না ভালো পথ্য করতে। সেটা ওদের কাছে আকাশকুসুম ব্যাপার। ভিটামিন ট্যাবলেট দিয়ে কাজ সারতে হচ্ছে। প্রথম যে বৃদ্ধা তাঁর সামনে এল তাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি কষ্ট হচ্ছে?’

বৃদ্ধা মুখ নামিয়ে বলল, ‘ওই সময় খুব যন্ত্রণা হয়। মনে হয় কাটা ঘায়ে লবণ দিয়েছে কেউ। আটদিনের আগে কমতে চায় না।’

বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকালেন বনবিহারী। অনাহারে শরীর যতই ভাঙুক পঞ্চাশের ওপরে ওর বয়স এ ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ হল না।

‘আপনার এখনও মাসিক হয়?’ স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

মাথা নাড়ল বৃদ্ধা, ‘না।’

‘তাহলে? যা বললেন তাতে—।’

‘আমার মেয়ের কথা—!’

‘কত বয়স তার?’

‘তিরিশ। বিধবা। বর কাঁকড়া ধরত। বাঘে নিয়ে গিয়েচে।

‘ওকে আনেননি কেন?’

‘এখানে তো মেয়ে ডাক্তার আসে না।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন বনবিহারী, ‘মেয়েকে নিয়ে পাথরপ্রতিমায় যেতে পারবেন? ওখানকার হাসপাতালে দেখাতে হবে।’

‘কি করে যাব?’ বৃদ্ধা সাদা চোখে তাকাল।

লাইন থেকে সরে একটু দূরে দাঁড়াতে বলে পরের রোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন বনবিহারী। তাকে দেখে ছোটুকে ওষুধ দিতে বলে বৃদ্ধার কাছে গেলেন তিনি, ‘আপনার মেয়েকে এখন এখানে নিয়ে আসতে পারবেন?

‘কেন?’

‘ওকে সুস্থ হতে হলে পাথরপ্রতিমায় যেতে হবে। ওখানকার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না করলে দিন দিন কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। আপনারা এই লঞ্চে সেখানে যেতে পারেন।’

‘ওখানে পয়সা লাগবে না?’

‘যাতে না লাগে তার ব্যবস্থা করে দেব।’

একটু ভেবে বৃদ্ধা চলে গেল। ছোটু বলল, ‘বিপদ।’

‘কীসের বিপদ?’ বনবিহারী বিরক্ত হলেন।

‘এখান থেকে হেঁটে গ্রামে যেতে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে ওর।’

‘অনেক দূরে গ্রাম?’

‘নদী থেকে অনেক দূরে!’

শেষদিন যে ক’জনকে দেখলেন তাদের তিনজনকে অপারেশন করানো দরকার। কাগজে সেটা লিখে দিয়ে তাঁর কর্তব্য শেষ করলেন বনবিহারী। খবরটা যদি বাবার কাছে পৌঁছয় এবং তিনি যদি ব্যবস্থা করেন তাহলে এরা বেঁচে যাবে।

বিকেল ফুরিয়ে আসছিল তবু রোগীরা দাঁড়িয়ে আছে। ছোটু ওদের বলেছে যে এই ডাক্তারবাবুর আজই এখানে প্রথম এবং শেষ আসা। কাল নিজের দেশে ফিরে যাবেন তিনি। অচেনা-অজানা একজন মানুষ যে তাদের ওষুধ দিতে এসেছে তার জন্যে কাতর হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু লোকগুলো মুখ শুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। রতন তাড়া দিচ্ছে। জোয়ার এলে খুব সমস্যা হবে। এই সময় সেই বৃদ্ধাকে দেখা গেল উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসতে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হল? আপনার মেয়ে কোথায়?’

‘আসতে চাইল না।’

‘কেন?’

‘বলল, ওর বাঁচার শখ নেই। স্বামীকে বাঘে খেয়েছে, ওকে রোগে খেলে খাক।’

‘কী নাম আপনার মেয়ের?’

‘মায়া।’

বনবিহারী ছোটুকে বললেন নামটা লিখে রাখতে।

ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছিল লঞ্চ। রোদ মরে গেছে অনেকক্ষণ। ছায়া ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। বনবিহারী চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। এই সুন্দরবনের গহনে মানুষেরা কি ভয়ঙ্কর লড়াই করে আজও বেঁচে আছে। সভ্যতার সুযোগের কণামাত্র তাদের কাছে পৌঁছয় না। সভ্য মানুষের চেয়ে বন, বাঘ কুমির কাঁকড়া আর চাকের মধু ওদের কাছে অনেক আপন। অল্পই হয়তো সুযোগ হত, কিন্তু কাল এদের ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হবে।

হঠাৎ সোনা এসে তাঁর সামনে বসল, ‘ডাক্তারবাবু!’

‘বলো সোনা।’

‘আপনি কেন চলে যাচ্ছেন?’

স্পষ্ট দেখলেন বনবিহারী। আচমকা নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কেন চলে যাচ্ছি?’ উত্তরটা নিজের কাছেই গুলিয়ে উঠল বলে মুখে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কেন জিজ্ঞাসা করছ সোনা?’

‘আপনি না থাকলে আমরা আবার বেকার হয়ে যাব।’

‘একথা বলছ কেন? নিশ্চয়ই আর একজন ডাক্তার আসবেন।’

‘এখানে কেউ আসতে চায় না। যদি আসে তো কবে আসবে তার ঠিক নেই। তদ্দিন আমরা মাইনে পাব না। আপনাকে আমরা সবাই ভালোবেসে ফেলেছি। আপনার কি এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে?’ সোনা জিজ্ঞাসা করল।

‘না। কষ্ট কি! তবে আমার বাড়িঘর তো সব ওখানে পড়ে আছে।’

‘আপনি তো বলেছিলেন ওখানে আপনার কেউ নেই—!’

‘তা নেই।’

ছোটু সোনার নাম ধরে ডাকতে সে অনিচ্ছা নিয়ে উঠে গেল। বনবিহারী নদীর দিকে তাকালেন। জলের রং কালো। ওপারের ডেক থেকে কেউ চিৎকার করে উঠল, ‘কুমির কুমির!’

বনবিহারী ভালো করে তাকিয়েও কিছু দেখতে পেলেন না। হাওয়া শীতল হয়েছে, আকাশে ফুরফুরে মেঘ। এই সময় রতন দৌড়ে নীচে নেমে এল, ‘ঝড় আসছে, খুব বড় ঝড়, রেডিওতে বলল।’

উঠে দাঁড়ালেন বনবিহারী, ‘ঠিক কী বলল?’

‘সাগরে নাকি একটা গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছিল। কাল থেকে তো রেডিও খুলিনি তাই জানতে পারিনি। ঘাটের কেউ কেউ বলাবলি করছিল। এরকম তো প্রায়ই শুনি তাই গ্রাহ্য করিনি। এখন শুনলাম ষাট-সত্তর মাইল বেগে ঝড় ছুটে আসছে। সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করেছে। নদীর বুক থেকে ঘাটে চলে যেতে বলেছে সব লঞ্চ, নৌকোকে।’ রতন বেশ উত্তেজিত।

বনবিহারী আকাশের দিকে তাকালেন। ফুরফুরে মেঘের গায়ে কালচে রং। কিন্তু ঝড় আসছে বলে মনেই হল না।

সেটা লক্ষ করে রতন বলল, ‘আমরা ঝড়ের আগে পৌঁছতে পারব কিনা জানি না। তেমন বুঝলে বাঁ-দিকের পাড়ের কাছে লঞ্চ নিয়ে যাব।’

‘যা ভালো বোঝো তাই করো।’ বনবিহারী বললেন।

আগে আকাশ নয়, নদীর জল জানান দিল। হঠাৎই ফুলে ফুলে উঠল নদী। ঢেউ ছোবল মারতে শুরু করল লঞ্চের শরীরে। তীব্র বেগে ছুটছে লঞ্চ। ওপাশ থেকে আলো জ্বেলে আসছিল এটা টলার। ঢেউ তাকে নিয়ে লোফালুফি শুরু করল। বনবিহারীর মনে হল যে কোনও মুহূর্তে টলার ডুবে যাবে। ভয়ঙ্কর দুলুনি শুরু হয়ে গেল লঞ্চে। ছোটু সোনা হিরো নেমে এল নীচে।

সোনা চিৎকার করল, ‘মাঝখানে চলে আসুন ডাক্তারবাবু, মাঝখানে।’

কোনওরকমে টলতে টলতে লঞ্চের মাঝ বরাবর চলে এলেন বনবিহারী। ততক্ষণে একটা লোহার বিমের সঙ্গে চেয়ার বেঁধে ফেলেছে ছোটু। বলল, ‘এখানে ধরে বসে থাকুন।’

বনবিহারী বসলেন। লঞ্চের ওপরে রাখা যাবতীয় জিনিস একবার এপাশ আর একবার ওপাশে যাচ্ছে। হিরো চেঁচাল, ‘যাঃ। আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে।’

বড্ড আওয়াজ করছিল লঞ্চের ইঞ্জিন। ঢেউগুলো তার টুঁটি চেপে ধরতে চাইছিল আর সে নিজেকে মুক্ত করতে ছটফট করছে। এইসময় দূরে আলো দেখা গেল। সোনা চেঁচাল, ‘এসে গেছি, এসে গেছি।’

ছোট লঞ্চটাকে লুফতে লুফতে ঢেউ ছুটে যাচ্ছে পাগলের মতো। রতন যখন কোনওমতে লঞ্চটাকে ঘাটে ভেড়াল তখনই হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল বঙ্গোপসাগর থেকে, উন্মাদের মতো। লঞ্চ কাত হতে হতে পাড়ের মাটিতে আটকে গিয়ে স্থির হল। তার একটা দিক উঁচিয়ে রইল, অন্যদিক মাটিতে গেঁথে গেল। চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লেন বনবিহারী। সড়সড় করে নামতে নামতে আটকে গেলেন লঞ্চের প্রান্তে এসে। এমন ভয়ংকর বাতাসের শব্দ তিনি কখনও শোনেননি। এই শব্দ তাঁকে মনে করিয়ে দিল সন্তান একা রয়েছে। তিনি চিৎকার করলেন, ‘আমাকে নামিয়ে দাও।’

সোনা সমান চেঁচাল, ‘লঞ্চ উলটে আছে, নামা যাবে না।’

বনবিহারী দেখলেন ঘাটের যেপাশে তক্তা ফেলে তিনি আসা-যাওয়া করেন সেখান দিয়ে নামা এখন আর সম্ভব নয়। কিন্তু লঞ্চের এই প্রান্ত তো নীচু হয়ে মাটিতে লেগে রয়েছে। না হয় সেখানে কিছু বুনো ঝোপঝাড় রয়েছে কিন্তু সেগুলো তো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে। কথা না বলে রেলিং টপকে ওপাশে যেতেই বিদ্যুৎ চমকাল। বনবিহারী লাফ দিলেন। মাটিতে দুটো পা পড়ল কিন্তু শরীরের অগ্রভাগ সোজা হয়ে থাকতে না পারায় দু-হাত বাড়িয়ে তাঁকে ভার সামলাতে হল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ওপর দিয়ে সড়সড় করে কিছু চলে গেল পাঁচ সেকেন্ড ধরে। স্থির হয়ে রইলেন তিনি।

এখন ঘনঘন বাজ পড়ছে, বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে। বনবিহারী যখন সেই ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তাঁর পোশাক ছিন্নভিন্ন, হাত-পা রক্তাক্ত। খানিকটা আন্দাজে হেঁটে এসে বুঝতে পারলেন তিনি উলটোদিকে চলে এসেছেন। আকাশ যেন সিংহের গর্জনকে ছাপিয়ে ঘনঘন হুঙ্কার দিচ্ছে। বাতাস এর মধ্যে ছিন্নভিন্ন করেছে গাছের শরীর। পথ সামলে বনবিহারী যখন বাড়ির সামনে পৌঁছলেন তখন মানুষের চিৎকার-কান্নায় কান পাতা দায়। অনেকের ঘরের চাল উড়েছে, কেউ কেউ চাপা পড়ে আছে তার তলায়। ওপরে উঠতেই মালতী ছুটে এল, ‘আপনার কিছু হয়নি তো? আমার যে কী ভয় করছিল?’

‘সন্তান কেমন আছে?’

‘ও এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল, এখন উঠে বসে খেলছে।’

স্বস্তি পেলেন বনবিহারী। লণ্ঠনের আলোয় মালতী তাঁর হাত-পা দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হল, ‘একি আপনার তো সারাশরীর কেটে গেছে, রক্ত বেরুচ্ছে।’

‘পথ ছাড়ো।’ বনবিহারী বারান্দায় গিয়ে বালতি থেকে একমগ জল তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই বিদ্যুতের আলোয় ভয়ংকর দৃশ্যটি দেখতে পেলেন। নদী উঠে এসেছে ওপরে। একতলা বাড়িগুলো ধীরে-ধীরে ডুবে গেল তার জলে। এইসময় দরজায় শব্দ হচ্ছিল খুব। মালতী সেটা খুলতে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ব্রজ মণ্ডলের বউ এবং আরও পাঁচজন।

বাইরে মানুষের চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। জল এই দোতলা বাড়ির দুপাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছে স্থলভূমিকে গ্রাস করতে। বনবিহারী ঘরে ঢুকে সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। এই সময় বৃষ্টি শুরু হল। এইরকম ভয়ঙ্কর বৃষ্টির শব্দ, হাওয়ার শব্দ, জলের শব্দ বনবিহারী কখনও শোনেননি। ঘরের অন্য মানুষগুলো জড়সড়ো হয়ে বসে আছে মেঝের ওপর। যদি দোতলা ভেঙে পড়ে তাহলে মরে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করা যাচ্ছে না।

বিদ্যুৎ চমকাল। এবং বনবিহারীকে অবাক করে দিয়ে হেসে উঠল সন্তান। দু-হাত এক করে তালি দিল একবার। তারপর ভয়ংকর জলের ধারার দিকে আঙুল তুলে হাসতে হাসতে শরীর নাচাতে লাগল, বায়না করতে লাগল, তাকে ওই জলের ধারায় নিয়ে যেতে হবে।

চোখ বন্ধ করলেন বনবিহারী। হয়তো এতক্ষণে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এই ভূখণ্ড। আগামীকাল ফিরে যাওয়ার কোনও পথ অবশ্যই খোলা থাকবে না। সোনা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেন যাবেন?’ এখন মনে হচ্ছে আদৌ কি যেতে পারবেন? যে-কোনও মুহূর্তে জল আর বাতাস মিলে এই দোতলাটাকে আছাড় মারলেই শরীর ভাসবে কালজিরে নদীতে।

অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলসাতেই সন্তান সজোরে হেসে জলের দিকে লাফাতে চাইল বনবিহারীর কোল থেকে। শেষ মুহূর্তে তাকে ধরে ফেলতে পারলেন বনবিহারী। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড জানান দিল। ছেলেটা জল দেখে ভয় পাচ্ছে না, প্রলয় দেখে হাসছে। বনবিহারী জানেন না ওকে কতদিন এইভাবে ধরে রাখতে পারবেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *