ত্রিশ
যুগ যুগান্ত থেকে মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে এই পৃথিবী ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। পাহাড় নদী গাছ প্রাণীর পরে তিনি যখন মানুষ সৃষ্টি করলেন তখন অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কিন্তু মানুষকে অমর করার বাসনা তাঁর ছিল না। তার আয়ুসীমা সীমিত করে তিনি অন্য মানুষদের সৃষ্টির পথ খোলা রেখেছেন। মানুষ যতদিন জীবিত থেকেছে ততদিন ঈশ্বর নির্লিপ্ত থেকেছেন। মানুষ তার জীবন ইচ্ছেমতন যাপন করেছে। ঈশ্বর লক্ষ করেছেন অধিকাংশ মানুষ ভালো খাওয়া, থাকার জন্যে নিরাপদ জায়গা পেলেই খুশি। এদের বাইরে কিছু মানুষ সুখী হতে চায়। কিন্তু তাদের অনেকেই জানে না কীসে সুখ পাওয়া যেতে পারে। আবার কিছু মানুষ সাফল্য পেতে চায়। সেই সাফল্য তাকে নেতা হতে সাহায্য করবে। কিন্তু যারা সুখ এবং সাফল্য একসঙ্গে কামনা করে তারাই পড়ে বিপাকে। সুখ যদি সোনা হয় তাহলে সাফল্য হল পাথরের বাটি। দুটো একসঙ্গে চাইলে সোনার পাথরবাটি তৈরি করে দিতে হয় যা দেওয়া ঈশ্বরের পক্ষে অসম্ভব।
বনবিহারী কখনও চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি চাননি। ডক্টর নলিনীকান্ত সরকার, ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় দূরের কথা ডক্টর আবীরলাল মুখোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতিমান হওয়ার বাসনা তাঁর ছিল না। তিনি শহর থেকে দূরে ছোট্ট জনপদে মানুষের সেবা করে গেছেন চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ে। বনবিহারী সুখ চাননি। সুখের সন্ধানে সম্পত্তি বাড়াতে চাননি, অর্থের পাহাড় তৈরি করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। সুখ মাঝে-মাঝে এসেছে আপনা-আপনি। যখন কোনও রোগীকে চিকিৎসা করে রোগমুক্ত করেছেন তখন যে আনন্দ তাকেই সুখ বলে মনে করেছেন। কিন্তু সে-সুখ বাতাসের মতো, মাঝে-মাঝে বয়, বইলেও অনেকসময় টের পাওয়া যায় না।
কিন্তু বনবিহারী শান্তিতে জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন। যতদিন তাঁর মা জীবিত ছিলেন ততদিন বাড়িতে ফিরে এসে সেই শান্তি অনুভব করতেন। মা চলে যাওয়ার পরে তিনি অশান্তি আসুক এমন কাজ করতেন না। তাঁর ধারণা ছিল, সুখ বা সাফল্য সুদূরের কিন্তু শান্তি মানুষ ইচ্ছে করলে তৈরি করে নিতে পারে।
কিন্তু মামণিকে সেই জঙ্গলে দেখার পর থেকেই বনবিহারীর জীবন থেকে সেই শান্তিও উধাও। যার জন্যে সব ছেড়ে সুন্দরবনের গভীরে চলে এসেছিলেন এখন তা অর্থহীন ছিল বলে মনে হচ্ছে তাঁর। হাসপাতালে মামণি সন্তান প্রসব করার পর তিনি যদি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতেন প্রসুতির নাম-ধাম জানেন না, কল পেয়ে জঙ্গলে গিয়ে অবস্থা খারাপ দেখে তুলে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে তাহলে কি সমস্যা হত? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্যই পুলিশকে জানাতেন। পুলিশ এসে জেরা করে তাঁর কাছ থেকে বাড়তি তথ্য বের করতে পারত না। শম্ভু ড্রাইভার সাক্ষী দিত। সে বলত গাড়ি নিয়ে ডাক্তারবাবু জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন। সেখানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটা ছেলে যারা মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল। পুলিশ বুঝতে পারত তাঁর সঙ্গে আগেই ওদের যোগাযোগ হয়। হতেই পারে। কেউ যদি রোগী দেখার জন্যে যেতে বলে ডাক্তার হিসেবে তাঁর যাওয়া কর্তব্য। এক্ষেত্রে পুলিশ মামণিকে গ্রেপ্তার করত। ওর বাবা-মায়ের ঠিকানা পেলে বাচ্চাকে সেখানে পাঠিয়ে দিত। মামণি উগ্রপন্থীদের সঙ্গে ছিল এই অপরাধে জেল হত কি হত না তা জানার দরকার তাঁর ছিল না। তিনি যেমন ছিলেন তেমন শান্তিতে থাকতে পারতেন। হঠাৎ সেই ভোরে তাঁর মনে মামণির জন্যে মায়া কেন এল তা এখন বুঝতে পারছেন না। কিন্তু তাঁর জীবন থেকে শান্তি তখন থেকেই চলে গিয়েছিল।
দুটো দিন এইভাবে কাটল। সন্তানকে মালতী অনেকটাই শান্ত করে রেখেছে। রাত্রে ওকে ঘুম পাড়িয়ে মালতী নীচে নেমে যায়। বাড়িওয়ালির একটা ঘরে শুয়ে পড়ে। ভোর হলেই উঠে আসে ওপরে। বাজারহাট যা করার সে-ই করে। বনবিহারী টাকা দিয়ে দেন।
তৃতীয় দিনে মালতী মুখ খুলল, ‘ওর মাকে খুঁজে পেলেন?’
‘কেন?’
‘এভাবে বাচ্চাটা কতদিন থাকবে?’
‘ওর মা আর ফিরে আসবে না। বোধহয় ওরা দেশে চলে গেছে।’
‘তাহলে?’
‘ক’দিন থেকে এই কথাই ভাবছি মালতী। আমার মনে হয় এবার তোমার দেশে চলে যাওয়া উচিত। তবে যাওয়ার আগে হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে যেও।’
‘দেশে গিয়ে আমি কি করব?’
‘তা আমি কি করে বলব? অ্যাদ্দিন যা করছিলে তাই করো।’
‘এতদিন তো খোকা আমার কাছে ছিল না।’
চমকে উঠলেন বনবিহারী। মালতী নীচু গলায় বলল, ‘ওকে ছেড়ে থাকতে পারব না।’
কয়েক মুহূর্তে মাথায় এল কথাগুলো ‘বেশ তো, সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাও।’
অবাক হয়ে তাকাল মালতী, ‘একি বলছেন!’
‘দ্যাখো গর্ভধারিণী যাকে ত্যাগ করেছে অবলীলায়, তাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না বলছ। তাহলে তো তুমি যেখানে থাকবে সেখানে তার থাকা উচিত।’
‘কিন্তু সেখানে আমার নিজেরই দু-বেলা ঠিকঠাক খাবার জোটে না, এই দুধের বাচ্চাকে খাওয়াব কি করে? ও কি আটাগোলা খেয়ে বাঁচাতে পারবে? তা হয় না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে এখানে থেকেই ওকে মানুষ করতে পারি।’
কথা বাড়াননি বনবিহারী। কিন্তু সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন আর সুন্দরবনে থাকবেন না। যা হওয়ার হবে, তিনি উত্তর বাংলার গঞ্জে ফিরে যাবেন। বাচ্চা দেখে লোকে প্রশ্ন করবেই। যা হোক ভেবে উত্তরটা দিয়ে দেবেন। শিশুর গায়ে উগ্রপন্থীর ছাপ থাকে না। পুলিশ নিশ্চয়ই সন্তানকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কালীচরণ হয়তো বিরক্ত হবে। এই বয়সে শিশুর ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চাইবে না আবার না নিয়েও পারবে না। কালীচরণকে তিনি চেনেন।
পরেশ মণ্ডলকে ডেকে পদত্যাগ পত্রটি ধরিয়ে দিলেন বনবিহারী। ওটা পড়ে সে অবাক। জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার কি অসুবিধে হচ্ছে ডাক্তারবাবু?’
বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘অসুবিধে কেন হবে! শরীর ভালো যাচ্ছে না। এখানকার জল সহ্য হচ্ছে না। লঞ্চে চেপে এত যাওয়া-আসার ধকল নিতে পারছি না।’
‘সেটা অবশ্য আলাদা কথা। একটু দাঁড়ান, আমি হেড অফিসের সঙ্গে কথা বলি। যদি আপনার পরিশ্রম একটু কমিয়ে দেওয়া যায়—!’
‘না ভাই। এমাসের শেষে আমি চলে যেতে চাই।’
পরেশ মণ্ডল কথা না বাড়ালেও রতন সোনা ছোটু হিরো প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনও অবস্থাতেই তারা ডাক্তারবাবুকে ছাড়বে না। রতন বলল, ‘কিছু করতে হবে না আপনাকে। লঞ্চে উঠে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়বেন। খাওয়ার সময় খাবেন। আর লঞ্চ যে ঘাটে রোগী দেখার জন্যে ভিড়বে সেখানে কুড়িজনের বেশি দেখবেন না।’
বনবিহারী হেসে মাথা নাড়লেন। সেদিন মৃদঙ্গভাঙা নদী ধরে যাওয়ার কথা ছিল। বনবিহারী লঞ্চে উঠলেন। দেখলেন ছেলেগুলো মুখ কালো করে আছে । ক’দিনের চেনাশোনা, তাতেই ওরা তাঁকে এত ভালোবেসেছে?
চেয়ারে বসে জল দেখছিলেন। হিরো এসে দাঁড়াল, ‘ডাক্তারবাবু!’
বনবিহারী তাকালেন।
‘এখানে ডাক্তাররা সহজে আসতেই চায় না। আপনি চলে গেলে আমরা বেকার হয়ে যাব। লঞ্চ না ছাড়লে তো আমরা টাকা পাই না।’
‘মানে? তেমরা মাস মাইনেতে নেই?
‘শুধু রতনই মাস মাইনেতে আছে। আবার কবে কোন ডাক্তার আসবেন, লঞ্চ বের হবে তদ্দিন বেকার বসে থাকতে হবে আমাদের।’
‘হু।’
‘আপনি যাবেন না ডাক্তারবাবু।’
‘হু!’
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হিরো চলে গেল।
খানিক পরে সোনা এসে দাঁড়াল। ‘আমরা ঠিক করলাম আজ থেকে আপনার জন্যে আলাদা রান্না করে দেওয়া হবে। ঝাল মশলা একদম কম যাতে শরীর খারাপ না হয়।’
‘আরে সেজন্যে নয়।’
‘একটা কথা বলব যদি কিছু মনে না করেন?’ সসঙ্কোচে বলল সোনা।
‘কী কথা?’
দিদি চলে গেছে বলে আপনার মন খারাপ হয়ে গেছে। তাই এখানে আর থাকতে চাইছেন না। তাই তো?’
‘সব মিলিয়েই, আমার শরীরটাও ভালো নেই।’
সোনা চলে গেলে মাথা নাড়লেন বনবিহারী। ধরা পড়ে গেছেন। সোনার মতো বাচ্চা ছেলেও বুঝে গিয়েছে তাঁর চলে যাওয়ার কারণ।
রতনদের আপত্তি সত্ত্বেও তিরিশজনকে পরীক্ষা করলেন আজ। কোনওরকম এক্সরে বা রক্তপরীক্ষার সাহায্য না নিয়েই বুঝলেন এদের অন্তত আটজনের শরীরে যক্ষ্মা জাঁকিয়ে বসেছে। সাতদিনের ওষুধ দিয়ে কোনও কাজ হবে না। এদের পক্ষে ওষুধ কেনাও সম্ভব নয়। তাছাড়া নিয়মিত ভালো পথ্য করা দরকার। যাদের দুবেলা ভাত জোটে কি জোটে না তারা পথ্য পাবে কোথায়? এভাবে রোগী দেখে লাভ কি? এদের রোগ নির্মূল করার অস্ত্র তাঁর জানা আছে কিন্তু এখানে তিনি নিধিরাম সর্দার। একজনের কানের নীচে বিশাল টিউমার হয়েছে। তার ভারে মুখ বেঁকে গেছে। ম্যালিগন্যান্ট হোক বা না হোক অবিলম্বে অপারেশন করা দরকার। কে করবে? ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ওঁরা তাঁকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল। তিনি সিঁড়িতে পা রাখতেই গলা শুনতে পেলেন, ‘ডাক্তারবাবু।’
ফিরে দেখলেন অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’
লোকটি চাপা গলায় বলল, ‘একটু এদিকে আসুন।’
সন্দেহজনক মনে হল বনবিহারীর। লোকটি ইচ্ছে করেই অন্ধকার ছেড়ে আসছে না। তিনি কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। লোকটি চাপা গলায় বলল, ‘বাবা মুর্শেদ আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। যাবেন আর আসবেন।’
‘তিনি কোথায়?’
‘সাইকেলে দশ মিনিট।’
বনবিহারী চারপাশে তাকালেন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কোথাও কেউ না কেউ ঘাপটি মেরে আছে। নইলে গতবার বাবা মুর্শেদের আসার কথা পুলিশের কাছে কি করে পৌঁছাল। যাবেন কিনা ইতস্তত করছিলেন কিন্তু তখনই তাঁর মুখগুলো মনে পড়ে গেল। আজ দুপুরে দেখে আসা অসুস্থ মানুষের মুখগুলো। তিনি বললেন, ‘চলুন।’
খানিকটা হেঁটে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেল তুলে নিয়ে লোকটা বলল, ‘পেছনে বসুন। কষ্ট হবে না।’
সেই নির্জন রাতে সাইকেলের পেছনে বসে বনবিহারীর মনে হচ্ছিল, পথটা কোথায় শেষ হবে। আধমাইল যাওয়ার পর কালজিরে নদীর মাছধরাদের ঘাটের গায়ে সাইকেল থামাল লোকটা। সেখানে দুজন অপেক্ষা করছিল। তাদের একজন বলল, ‘আসুন।’
লঞ্চে যেতে-আসতে এই ঘাটটা চোখে পড়েছে বনবিহারীর। নৌকো, টলার এখানে রাতের বেলায় জিরোয়। সাধারণ যাত্রীরা এই ঘাটে আসে না কারণ এখান থেকে পারাপার হয় না। লোকটার পিছু পিছু নদীর ধারে নেমে এলেন বনবিহারী। একটা টলারের গায়ে সিঁড়ি লাগানো। লোকটা সেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল বনবিহারীকে নিয়ে। ভেতরে ছাউনির নীচে দুজন মানুষ বসে। বনবিহারীকে দেখে একজন উঠে দাঁড়াল।
‘আসুন ডাক্তারবাবু, আপনাকে কষ্ট দিলাম কিন্তু এছাড়া উপায় ছিল না। পুলিশের এখন কোনও কাজ নেই শুধু বাবা মুর্শেদকে ধরে চালান করা ছাড়া। বসুন।’
বনবিহারী বসলেন। দাঁড়িয়ে ওঠা লোকটি এবার টলারের এক প্রান্ত থেকে একটা থালা আর গ্লাস নিয়ে এসে বনবিহারীর পাশে রাখলেন। টলারের ভেতর আলো কমানো হ্যারিকেন জ্বলছে।
‘খেয়ে নিন ডাক্তারবাবু।’ বাবা মুর্শেদ বলল।
‘না না—।’
‘সঙ্কোচ করবেন না। সারাদিন লঞ্চে ঘুরেছেন, পেশেন্ট দেখেছেন। নিশ্চয়ই খুব খিদে লেগেছে। বাড়িতে গিয়ে তো খেতেনই। এখানেই খেয়ে নিন। এই, ডাক্তারবাবুকে হাত ধোওয়ার জল দাও।’ বাবা মুর্শেদ হুকুম করল।
এর পর কথা চলে না। হাত-ধুয়ে নিয়ে তিনটে রুটি, তরকারি আর মাছের ঝোল তৃপ্তি করে খেলেন বনবিহারী। একটু মশলা বেশি, কি করা যাবে।
খাওয়া শেষ হলে হাত মুখ ধোওয়ার পর বাবা মুর্শেদ জিজ্ঞাসা করল, ‘একটা খারাপ খবর শুনলাম। খবরটা কি সত্যি?’
বনবিহারী চুপ করে থাকলেন। খবরটা কার কাছে খারাপ? বাবা মুর্শেদের কাছে? বাবা মুর্শেদ বলল, ‘আপনাকে এখানকার মানুষ ভালোবেসে ফেলেছে। ভেতরের গ্রামগুলোতেও লোকে আপনার প্রশংসা করে। আপনি চলে গেলে এরা অনাথ হয়ে যাবে ডাক্তারবাবু।’
‘কিন্তু আর আমি পারছি না। আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। হয়তো এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছি না।’
‘আপনি বোধহয় নিজের চিকিৎসা করেন না।’
বনবিহারী হাসলেন। বললেন, ‘তাছাড়া যখনই লঞ্চে রোগী দেখতে যাই তখনই নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। সুন্দরবনের গভীরে হাজার হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সামান্য সুযোগ নেওয়ার ক্ষমতা ওদের নেই। হাজার টাকার ওষুধ মাসখানেক খেলে যে রোগমুক্ত হত তাকে বাধ্য হয়ে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হচ্ছে। আমি রোগী দেখছি, ওষুধের কথা বলছি কিন্তু সেই ওষুধ কেনার সামর্থ্য লোকটির নেই এবং আমার পক্ষেও ওই ওষুধ ওকে দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে ডাক্তার হিসেবে আমি রোগী দেখছি কেন? কি অধিকার আছে লোকটাকে আশা দেখাবার? আপনি বলেছিলেন, তেমন পেশেন্ট থাকলে আপনাকে বলতে যাকে হাসপাতালে এনে অপারেশন করাতে হবে। আপনি তার দায়িত্ব নেবেন। ইতিমধ্যে একজনের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু সব কেস তো অপারেশনের আওতায় পড়ে না। আজ আমি কয়েকজন টিবি রোগীকে দেখলাম। নিয়মিত ওষুধ এবং ভালো পথ্য পেলে বেঁচে যাবে। তাদের হাসপাতালে আসার দরকার নেই। এদের কি হবে?’
‘কোন গ্রাম আর পেশেন্টের নামগুলো কি আপনার সঙ্গীরা লিখে রেখেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ, ওরা যাতে ওষুধ এবং পথ্য পায় আমি তা দেখব। প্রেসক্রিপশন করেছেন?’
‘করেছি কিন্তু ওদের দিয়ে কি হবে? লঞ্চের খাতায় লেখা আছে। হেড অফিসকে লিখতে হবে ওষুধ পাঠাবার জন্যে। যদি পাঠায় তখন কম্পাউন্ডার গিয়ে ইনজেকশন দিয়ে আসবে। না। এভাবে হয় না।’ বনবিহারী মাথা নাড়লেন।
‘মানছি এভাবে হওয়া মুশকিল। কিন্তু আপনি থাকলে তবু কিছু হবে।’
হাতজোড় করলেন বনবিহারী, ‘দয়া করে আমাকে থাকতে বলবেন না।’
বাবা মুর্শেদ একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি যে মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সে তার মায়ের সঙ্গে পাথরপ্রতিমাতেই আছে। যে মাস্টারের বাসায় তারা উঠেছিল তাকে বলা হয়েছে আমি না বলা পর্যন্ত তারা যাওয়ার চেষ্টা না করে। রিকশাওয়ালা বলেছে মেয়েটির মা আপনাকে খুব অপমান করেছিল। মেয়েটি কে?’
‘জঙ্গলে পড়েছিল সন্তান-সম্ভাবনা নিয়ে। উগ্রপন্থীদের সঙ্গী ছিল। আমি ওকে হাসপাতালে ভরতি করি। উগ্রপন্থীরা পুলিশের গুলিতে মারা যায়। ও বোবা বলে ঠিকানা জোগাড় করতে না পেরে নিজের কাছেই সন্তানসহ রেখে দিই। নাম না জানায় ওকে মামণি বলে ডাকি। হয়তো আমার কাছে থাকাটা ওর সহ্য হচ্ছিল না তাই এতদিন পরে মাকে খবর দিয়ে আনিয়েছে। না না। ওদের আপনি ছেড়ে দিন। পাখির ডানা কেটে নিলে তাকে আর পাখি বলে না।’
বাবা মুর্শেদ হাসল, ‘আপনাকে আমার সেলাম। আর আপনাকে আটকাব না।’
যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেইভাবে ফিরে গেলেন বনবিহারী। সিঁড়িতে পা রাখতেই ব্রজ মণ্ডলের বউ-এর গলা পেলেন, ‘বাচ্চাকে নিয়ে মালতী নীচের ঘরে শুয়েছে।’ কথা না বলে ওপরে উঠে এলেন তিনি। হঠাৎ মনে হল সুন্দরবনে আসা একদম বিফলে যায়নি। এখানে বাবা মুর্শেদের মতো মানুষ রয়েছে। এখন প্রশ্ন, বাবা মুর্শেদ সরকারের চোখে সমাজবিরোধী কিন্তু কোন সমাজের?