দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২৬

ছাব্বিশ

জোয়ার এসেছে কালজিরে নদীতে। সমুদ্রে জল হু-হু করে ঢুকে পড়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে নদী। দড়িতে বাঁধা ভটভটিগুলো তো বটেই, ঝড়ে লঞ্চগুলোও ঢেউ-এর দোলা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। দূরে দুটো ভটভটিকে দেখা গেল ঢেউ-এর সঙ্গে লড়াই করছে এপারে আসার জন্যে। বনবিহারীর কথা বলতে একটু সময় লাগল।

সোনা ডাকল, ‘ডাক্তারবাবু।’

‘তুমি নিজের চোখে দেখেছ?’ বনবিহারীর মাথা কাজ করছিল না।

‘হ্যাঁ। লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিলাম। ভটভটি ছাড়ার মুখে দিদি দৌড়ে এসে উঠে পড়ল। তখনও জোয়ার আসেনি। ভটভটি ওপারের দিকে চলে গেল।’ সোনা বলল।

‘তোমার ভুল হয়নি তো সোনা!’

‘এ কী বলছেন! আমি তো বেশি দূরে ছিলাম না।’

একটু ইতস্তত করে প্রশ্নটা করে ফেললেন বনবিহারী, ‘সঙ্গে কেউ ছিল?’

‘না। একাই দৌড়ে এলেন মা, একটু দেরি হলে ভটভটিটাকে পেতেন না।’

ওপারের দিকে তাকালেন বনবিহারী। কোথায় গেল মামণি! সেই ছেলেটির কাছে! কখন ওদের কথা হল? কীসের টানে চলে গেল সন্তানকে এখানে ফেলে রেখে? বনবিহারীর ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই পাথরপ্রতিমায় গিয়ে মামণির খোঁজ নিতে!

‘ডাক্তারবাবু, আপনি যাবেন না?’ সোনা জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘আমার শরীরটা আজ ভালো নেই। তুমি না ডাকলে কখন ঘুম ভাঙতো কে জানে! তুমি রতনকে বলো আমাকে ছাড়াই আজ যেটুকু পারে তা করে নিতে। আমি আজ বাড়িতেই থাকতে চাই।’

‘কি হয়েছে আপনার?’ সোনা উদ্বিগ্ন হল।

‘তেমন কিছু নয়। বোধহয় প্রেশার বেড়ে গিয়েছে। বাড়িতে একজনের মৃত্যু হল, কান্নাকাটি শুনতে হয়েছে, সারারাত ঘুম আসেনি।’

‘চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।’

‘না না। তার দরকার হবে না। তুমি যাও!’

ধীরে-ধীরে বাড়িতে ফিরে এলেন বনবিহারী। নীচের তলায় দরজা এখনও বন্ধ। ওপরে উঠে কিছুক্ষণ তক্তাপোশে বসে থাকলেন। শরীর ঝিমঝিম করছে। পায়ের তলায় শিরশিরানি। তখন কিছু বলতে হবে বলে বললেও এখন বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, গোলমাল রক্তের প্রেশারের বাড়াবাড়ির কারণেই হচ্ছে।

বনবিহারী বাইরে যাওয়ার পোশাক পরেই শুয়ে পড়লেন। অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। মামণি কি ছেলেটার ডাকে একবস্ত্রে চলে গেল? আর কি এখানে ফিরে আসবে না? এটা কি সম্ভব? এতদিন একসঙ্গে থেকে একদম না জানিয়ে কেউ উধাও হতে পারে? কথা না বললেও মামণি অবশ্যই বোঝে তিনি ওর জন্যে কতটা ত্যাগ করেছেন! মাথা নাড়লেন বনবিহারী, তাঁর কথা ও মনে না রাখলে তিনি কি করতে পারেন, কিন্তু নিজের পেটের ছেলের কথা ভুলে গেল কি করে? গতকাল থেকেই তো সে প্রতিবেশী একটি বউএর কাছে রয়েছে। মা হয়ে তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারল মামণি!

বুকের ভেতর একটা গরম হাওয়া কেবলই হলকা ছড়াচ্ছিল। গতকাল থেকে কত কি না ভেবে রেখেছিলেন। আজ সময়-সুযোগ দেখে তিনি নিজেই মামণিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন। এতদিন ও যা আকারে ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছিল তা তিনি সরাসরি গ্রহণ করবেন বলে জানাবেন। একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন, বয়সের পার্থক্যটা সঙ্কুচিত করছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু কি লাভ হল! মামণি তো তাঁকে কোনও সুযোগই দিল না।

ছটফট করছিলেন বনবিহারী। এইসময় ঘুমানোর অভ্যেস তাঁর নেই। শরীর যতই কাহিল হোক ঘুম আসছিল না তাঁর। এইসময় দরজায় শব্দ হল, ‘ডাক্তারবাবু!’

‘কে? উঠে বসলেন বনবিহারী।

‘আজ্ঞে, আমি।’ ঘরে ঢুকল সেই লোকটি যে সন্তানের খবর দিয়েছিল গতরাতে।

‘ও, আপনি, আসুন।’

‘আমার ওয়াইফ জিজ্ঞাসা করতে বলল, বাচ্চাটাকে এখন দিয়ে যাব কি?’

‘ও কি করছে?’

‘খেলছে!’ লোকটি চারপাশে তাকাল, ‘ওর মা কোথায়? নীচে তো নেই!’

বনবিহারী তাকালেন, ‘ও পাথরপ্রতিমায় গিয়েছে।’

‘ও। তাহলে আপনি বাচ্চাটাকে সামলাবেন কি করে! তাহলে ওর মা না ফেরা পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে রাখি?’

‘আপনাদের যদি অসুবিধে না হয়—!’

‘কী বলছেন? ওকে পেয়ে তো আমার ওয়াইফ নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেছে। ঠিক আছে। তাহলে চলি।’ ফিরে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়াল লোকটি, ‘আপনার শরীর ঠিক আছে তো?’

‘কেন? দেখে কিছু মনে হচ্ছে?’

‘না না। আচ্ছা, চলি।’

লোকটি চলে গেলে চোখে-মুখে জল দিলেন বনবিহারী। মামণির না ফেরা পর্যন্ত ওরা সন্তানকে ওদের কাছে রাখবে। মামণি না ফিরলে? গঞ্জের মানুষ আর কিছুদিন থাকলে জানতে চাইত মামণি কোত্থেকে এল? আর এই সুন্দরবনের মানুষ জানতে চাইবে বাচ্চাকে ফেলে মামণি কোথায় গেল? ওখানে তিনি সবকথা খুলে বলতে পারেননি পুলিশের ভয়ে। পুলিশ মামণিকে ধরে নিয়ে যেত, এ ব্যাপারে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই। আর এখানে সত্যিকথা বললে লোকে তাঁকেই খারাপ চোখে দেখবে। মামণি তাঁর স্ত্রী নয় জানার পর প্রশ্ন তুলবে তাহলে রাতের পর রাত ওরা একঘরে থাকল কি করে!

কিন্তু এসবের বাইরে আরও সমস্যা ওত পেতে রয়েছে। সন্তানকে নিয়ে তিনি এখানে থাকবেন কি করে? ওকে সঙ্গে নিয়ে রোজ লঞ্চে ঘোরা সম্ভব নয়। আবার ওর জন্যে ঘরে বসে থাকলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। একমাত্র রাস্তা, সন্তানকে নিয়ে আবার গঞ্জে ফিরে যাওয়া। একটা শিশুকে নিয়ে গঞ্জের লোক অত মাথা ঘামাবে না। কিন্তু তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে মামণির জন্যে। কতদিন?

দরজার শব্দ হল। তারপর রতনের গলা শুনতে পেলেন, ‘ডাক্তারবাবু!’

‘এসো রতন।’ তক্তাপোশে বসলেন বনবিহারী।

ঘরে ঢুকল রতন, সঙ্গে পরেশ মণ্ডল।

পরেশ মণ্ডল উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে ডাক্তারবাবু, শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ?’

‘সামান্য। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব।’

‘পাথরপ্রতিমায় গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন?’ পরেশ জিজ্ঞাসা করল।

‘না না। মাথাটা একটু ঘুরছে, রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘শুনলাম কাল এই বাড়ির বাড়িওয়ালা মারা গিয়েছেন। সে কারণে রাত জাগতে হয়েছিল কি? এক বাড়িতে থাকলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।’

‘না, তার জন্যে কিছু হয়নি।’

রতন বলল, ‘বেশ কয়েকদিন ধরে একটানা কাজ করছেন বলে বোধহয়—।’

পরেশ বলল, ‘মুশকিল কি জানেন! হেড অফিস কোনও কথা শুনতে চায় না। এই যে আজ আপনি গেলেন না, কালিচরণপুরের পেশেন্টরা কখন আপনি যাবেন সেই আশায় বসে আছে, শরীর খারাপ বলে আপনি যেতে পারছেন না, হেড অফিস হিসেব করতে বসবে কতটা ক্ষতি হল। আমি বলি কী, আপনি যদি পাথরপ্রতিমার ডাক্তারকে দেখিয়ে একটা সিক সার্টিফিকেট নিয়ে নেন তাহলে ওরা আর কিছু বলতে পারবে না। আইনসঙ্গত হবে।’

‘আমি ডাক্তার হয়েও নিজের সার্টিফিকেট দিতে পারব না?’

‘কিছু মনে করবেন না, সেটা সন্দেহমুক্ত হবে না। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা, আপনি যে পেশেন্টের অপারেশনের জন্যে রেকমেন্ড করেছিলেন তা হেড অফিস মেনে নিয়েছে। হাসপাতালে যা খরচ হয়েছে তা মিটিয়ে দিতে আমাকে অর্ডার পাঠিয়েছে।’

‘বাঃ। অনেক ধন্যবাদ। টাকাটা কীভাবে শোধ দেব কিছু বলেছে?’

‘না। সে ব্যাপারে কিছু লেখেনি। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না তাহলে চলুন—!’

একমুহূর্ত সময় নিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘বেশ চলুন।’

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নীচে নামলেন তিনি ওদের সঙ্গে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। ঘাটের কাছে এসে তিনি লঞ্চের দিকে এগোলেন। পরেশ মণ্ডল হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘না না, লঞ্চে নয়। ভটভটিতে চলুন। শুধু পারপার করার জন্যে লঞ্চ চালু করার নিয়ম নেই। আজ যখন কাজ হচ্ছে না তখন ওটা বন্ধ থাক।’

বনবিহারী বললেন, ‘আমি পাথরপ্রতিমায় যাওয়ার জন্যে লঞ্চে উঠছি না।’

‘তাহলে? পরেশ হতভম্ভ।

‘আমি কালিচরণপুরে গিয়ে পেশেন্ট দেখব।’

‘সেকি! আপনার শরীর খারাপ—!’

‘দেখুন, আর একজন ডাক্তারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট না নিলে যদি ছুটি নামঞ্জুর হয় তাহলে তো আমার কাজই করা উচিত। চলো রতন।’

‘আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না ডাক্তারবাবু।’ পরেশ দু-হাত জোড় করল।

‘ছি-ছি, আপনি তো কোনও অন্যায় কথা বলেননি। তবে সুস্থ থাকলে যতটা পারতাম আজ ততটা পারব না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা মন্দ কি?’

পরেশকে পাড়ে রেখে লঞ্চ চালু করল রতন। মাঝনদী দিয়ে যেতে যেতে রতন গৌরাঙ্গকে ইঞ্জিনের দায়িত্ব দিয়ে নেমে এল বনবিহারীর কাছে। তিনি তখন বাইরে বসে জলের দিকে তাকিয়েছিলেন। রতন বলল, ‘আপনাকে কোনও পরিশ্রম করতে দেব না। চেয়ার বসে যতটা পারেন পেশেন্ট দেখে ফিরে আসবেন।’

‘কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে?’

‘ঘণ্টাখানেক।’

‘অনেক বেলা হয়ে যাবে।’

‘তাতে লাভই হবে। পেশেন্টের সংখা কমে যাবে। যারা খুব অসুস্থ তারা আশায় অপেক্ষা করবে।’ রতন বলল, ‘আমরা পরেশ মণ্ডলকে ঘাঁটাতে চাই না।’

‘মানে?’

‘বহুত চুকলিবাজ লোক। হেড অফিসে তেল দেওয়ার জন্যে এখানে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব রিপোর্ট করে। লঞ্চের ডিজেল কত খরচ হল তা গৌরাঙ্গকে জিজ্ঞাসা করে মিলিয়ে নেয় আমি সত্যি বললাম কিনা। আপনি মানুষ, আপনার শরীর খারাপ হতেই পারে একদিন, তার জন্যে পাথরপ্রতিমার ডাক্তারের সার্টিফিকেট লাগবে কেন?’

হাসলেন বনবিহারী, ‘সব জায়গায় এরকম মানুষ থাকে রতন।’

এইসময় সোনা খাবার নিয়ে এল, হালুয়া আর টোস্ট, সঙ্গে চা।

সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। বনবিহারী খাবারে মন দিলেন।

কালিচরণপুরে পেশেন্ট দেখতে দেখতে নিজের ওপর বিরক্ত হলেন বনবিহারী। এটা তিনি কি করছেন? এই যে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষরা রোগের কাছে অসহায় ভাবে আত্মসর্ম্পণ করে আছে, কতটুকু সাহায্য করতে পারেন তিনি? শতকরা পাঁচ ভাগও নয়। রক্তপরীক্ষা, সোনোগ্রাম, এক্সরে রিপোর্ট না দেখেও আন্দাজে যে রোগের কথা তিনি ভাবছেন তা নির্মুল করার মতো ওষুধ তাঁর কাছে নেই। রোগী দেখছেন, রোগ বুঝছেন কিন্তু মানুষটিকে সুস্থ করতে পারছেন না। এরকম ভাবে রোগী দেখে কি লাভ! তিনি ছোটুকে বললেন, ‘আমি তোমাকে ওষুধের একটা লিস্ট তৈরি করে দেব। তুমি পরেশবাবুকে বলবে ওই ওষুধগুলো সাতদিনের মধ্যে কলকাতা থেকে আনিয়ে দিতে। নইলে পেশেন্ট দেখে কোনও লাভ হবে না।’ সোনা হাসল। রেগে গেলেন বনবিহারী, ‘হাসছ কেন?’

‘আপনি বলছেন, নিশ্চয়ই পরেশদাকে বলব, তবে ওষুধ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অত ওষুধ কেনার টাকা নাকি হেড অফিসের নেই।’

‘তাহলে এই কার্যক্রমের কি দরকার?’

‘শুনেছি এটা আছে বলে অনেক সাহায্য দেশবিদেশ থেকে আসে।’

কথা বাড়ালেন না বনবিহারী। বুঝলেন, সাহায্য আসে কিন্তু তা এই গরিব মানুষগুলোর কাছে পৌঁছয় না। এই যে পনেরো বছরের মেয়েটির পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে, কি ওষুধ দেবেন তিনি! পেটে আঙুল রেখে মনে হচ্ছে ওর অ্যাপেন্ডিস বিপদসীমায় পৌঁছে গেছে। অবিলম্বে অপারেশন করা দরকার। মেয়েটির বাবাকে ব্যাপারটা বললে সে বেচারি কান্নায় ভেঙে পড়ল। এই মেয়েকে নিয়ে বহুদূরের হাসপাতালে অপারেশন করাবার ক্ষমতা তার নেই। সুন্দরবনের জঙ্গলে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে মধু সংগ্রহ করে সে কোনওমতে পরিবারের সবার মুখে একবেলা ভাত জোটায়। তার পক্ষে অপারেশনের খরচ যোগানো অসম্ভব। মেয়েটকে বাঁচাবার জন্যে সে বনবিহারীর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।

চোখ বন্ধ করলেন বনবিহারী। একজনের বুকের টিউমার অপারেশন করার খরচ চেয়ে হেড অফিসের কাছে আবেদন করেছিলেন; এরকম অনুরোধ ভবিষ্যতে না করার জন্যে ইঙ্গিত দিলেও টাকাটা মঞ্জুর করেছে হেড অফিস। এখন এই মেয়েটির জন্যে চাইলে তা ওরা সরাসরি প্রত্যাখান করবে! তাহলে এখানে থেকে তিনি কি করছেন? এই গরিব অসুস্থ মানুষগুলোর কোনও কাজেই তো তিনি লাগতে পারছেন না। গঞ্জে থাকাকালীন যেসব পেশেন্টদের পেতেন তারা এত দরিদ্র নয়। ধার করেও চিকিৎসা করাতে পারে।

তাঁকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে ছোটু বলল, ‘লঞ্চে অক্সিজেন, স্যালাইন আছে। অবশ করার ইনঞ্জেকশন দিয়ে আপনি যদি চেষ্টা করেন তাহলে মেয়েটা বেঁচে যেতে পারে ডাক্তারবাবু। এছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই।’

ছোটুর মুখের দিকে তাকালেন তিনি। নার্সিংহোমের ওটিতে এটা আদৌ জটিল অপারেশন নয়। কিন্তু এখানে তেমন হলে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাছাড়া এক্সরে না করে অপারেশনের ঝুঁকি নিয়ে যদি দেখা যায় অ্যাপেন্ডিসের সমস্যা নয়, অন্য কিছু যা তাঁর পক্ষে সামলানো সম্ভব নয় তখন কি করবেন! পেট একবার ওপেন করলে—! ঘামতে লাগলেন বনবিহারী। মেয়েটা যন্ত্রণায় ককিয়ে যাচ্ছিল। সামনে অন্তত জনা তিরিশেক পেশেন্ট, যারা তাদের অসুখের কথা জানাবে বলে অপেক্ষা করছিল, তারা আচমকা চিৎকার শুরু করল, ‘বাঁচান, বাঁচান ওকে।’

রতন তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘লঞ্চ চালু করে এখান থেকে চলে যাব? বাপবেটিকে কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দিতে পারব।’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘নামাতে হবে না। ওদের পাথরপ্রতিমায় নিয়ে চল। এখনই অপারেশন করাতে হবে।’

‘কিন্তু এরা তো খরচ দিতে পারবে না। হেড অফিসও আর হাত খুলবে না।’

‘আগে ওকে বাঁচাই, তারপর ওসব নিয়ে ভাবব।’ বনবিহারী গম্ভীর গলায় বললেন।

সন্ধের মুখে ফিরে এল লঞ্চ পাথরপ্রতিমায়। পুরোটা পথ মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে বসেছিল বাবা। জলের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক, নদীর ঢেউ-এ মুখ তোলা শুশুক, কিছুই দেখলেন না বনবিহারী। তাঁর চোখ বন্ধ।

বনবিহারীর তাগিদে ঝটপট এক্সরে করার পর মেয়েটিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হল। খানিকক্ষণ বাদে ডাক্তার ফিরে এসে বললেন, ‘খুব জোর বেঁচে গেল মেয়েটা। ওটা বাদ দিয়েছি। কিন্তু অপারেশনের খরচ কে দেবে?’

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘আমি। কাল সকালে দিয়ে দেব।’

ডাক্তার হাসলেন, ‘এভাবে আর কত করতে পারবেন? এখানে চিকিৎসা করতে হলে মনে ঠুলি পরিয়ে রাখতে হয়। ও হ্যাঁ, আপনার সেই পেশেন্টকে যার ব্রেস্ট টিউমার হয়েছিল, আজ বিকেলে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে।’

বনবিহারীর ভ্রু কুঁচকে গেল। মেয়েটা কীভাবে গ্রামে ফিরে গেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *